সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৭



অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে কি এমন সৌন্দর্য খুঁজে পাস তোরা? আশেপাশের সবকিছু থেকে একদম বেখবর হয়ে যাস আকাশের দিকে তাকিয়ে! এটা কিছুতেই বোধগম্য হয় না আমার।  
আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে মামণির দিকে তাকালো নূহা। হেসে বলল, আঁধার নহে মাতা আমি দেখিতে চাইতেছি বৃষ্টি, আকাশ থেকে ঝরা পানি কণার সন্ধানে উন্মুখ মরুময় দৃষ্টি।

বৃষ্টি হচ্ছে নাকি বাইরে? প্রশ্ন করলেন মিসেস সুরাইয়া।

হুম, ভেতর এবং বাহির উভয় খানেই নামিয়াছে তুমুল বরষা।

ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে মিসেস সুরাইয়া বললেন, খুব আনন্দময় মুডে আছিস মনেহচ্ছে?

আলহামদুলিল্লাহ আনন্দে আছি। কারণ প্রকৃতি থেকে শুধু শিক্ষা নয় আনন্দ কুড়িয়ে নিতেও শিখিয়েছেন আমার বাবা আমাকে।

অনেক কুড়িয়েছেন শিক্ষা এবং আনন্দ। এখন দয়াকরে এখানে এসে বসেন।

জানালা থেকে সরে নূহা গিয়ে মামণির পাশে বসলো। মিসেস সুরাইয়া নূহাকে ধরে নীচে বসিয়ে বললেন, গত একমাস যেতে পারিনি তোর বাসায়। অযত্ন করে চুল তো মনেহয় এক মাসেই পাখীর বাসা বানিয়ে ফেলেছিস। আয় তেল ম্যাসেজ করে দেই।

নূহা হেসে বলল, না না পাখীর বাসা হয়নি। তোমার অভাব পূরণের জন্য তোমার নাতনীতে আল্লাহ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে তার পাপার কাছ থেকে হেয়ার স্পা করা শিখে নিয়েছে। উইকএন্ডে যখন যায় করে দেয় আমাকে।

আল্লাহ আসলেই খুব বেশি মেহেরবান তোর উপর। নয়তো আমার মতো মা আর নাবিহার মত মেয়ে তুই ডিজার্ভ করিস না। বুঝেছিস?

নূহা কিছু না বলে মনের আনন্দে হাসতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিসেস সুরাইয়া বললেন, কি কথা হলো নায়লার সাথে?

কথা হয়নি। যেয়ে দেখি টেনশনে ঘুমিয়ে গিয়েছে। ফুপ্পি আর সুবহা ভাবীর সাথে কিছুক্ষণ বসে গল্প করে চলে এসেছি তোমার চরণে।

মামণীকে নীরব দেখে নূহাও চুপ করে রইলো। বেশি কিছুক্ষণ পর মিসেস সুরাইয়া বললেন, চুপ করে আছিস কেন? জ্ঞান দান কর নয়তো কাব্য শোনা। একদমই চুপচাপ তোকে সহ্য করাটা তো কঠিন। আগে যেয়ে জানালা বন্ধ করে দিয়ে আয়। বৃষ্টির ছাঁট আসছে।

না জানালা খোলা থাক। ভালো লাগছে শীতলতা জাগানিয়া বৃষ্টির ছাঁট। সত্যিই কাব্য শুনবে?

হুম, শোনা।

যতটা বরষা ছুঁয়ে দিয়েছে মনের সেতার, রিনিঝিনি ধ্বনি তুলে গিয়েছে সুরের সম্ভার। যত না দেখেছি তারচেয়েও বেশি এঁকেছি বৃষ্টির ছবি।সময়ের ধূলো জমে আজ মলিন আল্পনার রেখাগুলো সবি। কবিতা লেখার চেষ্টা তাই ব্যর্থ মনোরথে ছাড়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস। বাস্তবতা আর কল্পনাবিলাসিতার ভিড়ে হারিয়েছে মোর বৃষ্টিবিলাস। পছন্দ হয়েছে কাব্য?

মনে আবোল তাবোল যা আসে তাই বলিস। পছন্দ হওয়ার কি আছে এখানে? এলোমেলো কথা বন্ধ করে হেয়ালি ছাড়া সত্যি সত্যি একটা প্রশ্নের জবাব দে। তুই হঠাৎ বাড়িতে এসে থাকার সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলি? গতরাতে ঐ কান্ড করে যাবার পর আমি তো ভেবেছিলাম কয়েকমাস তোর দেখাই পাওয়া যাবে না। তারউপর তুই দুই সপ্তাহের জন্য আসছিস এই সংবাদ জাওয়াদ দিলো আমাদেরকে। এর পেছনের রহস্য কি?  

নূহা বলল, কোন রহস্য নেই মামণি। হসপিটালে কথা হয়েছিল উনার সাথে। বললেন, দুই সপ্তাহের জন্য বাইরে যাচ্ছেন। আমি চাইলে বাড়িতে এসে সবার সাথে কাটাতে পারি এই সময়টা। গতরাতে ওভাবে চলে যাবার কারণে আমি নিজেও খুব অপরাধবোধে ভুগছিলাম। তাই চলে এলাম।

আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলেন মিসেস সুরাইয়া। মামণি যে তার জবাব শুনে সন্তুষ্ট হয়নি সেটা বুঝতে পারছিল নূহা। কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে গেলেই সুন্দর এই পরিবেশটা নষ্ট হবে। তাই চুপ করে রইলো নূহা নিজেও। রেস্টুরেন্টে জাওয়াদের সাথে কথা শেষ করে হাসপাতালে ফিরে এসে নিজের কেবিনে যাবার পর মনে পড়েছিল কয়েকটা কেস ফাইলের আপডেট চেয়েছিল আদী ভাইয়া। রেডি করে রেখেছিল দুদিন আগেই কিন্তু মনের ভুলে দেয়া হয়নি। ফাইলগুলো দেবার জন্যই গিয়েছিল মূলত কমনরুমে গিয়েছিল। আদী ভাইয়া, ফায়েজ ভাইয়া, বড় মামা আর জাওয়াদ শুধু উনারা চারজন আলাদা একটা কমনরুম ইউজ করে। অবশ্য নূহার জন্যও আলাদা একটা টেবিল আছে সেই কমনরুমে। যখন আদী আর জাওয়াদ থাকে না রুমে এবং নিজেও ফ্রি থাকে তখন বড়মামা কিংবা ফায়েজ ভাইয়ার সাথে গল্প করতে চলে যায়, যদি মামা বা ফায়েজ ভাইয়ার কোন ব্যস্ততা না থাকে। নূহা যখন ফাইল নিয়ে গিয়েছিল রুমে ঐ সময় কেউই ছিল না। তাই আদীর টেবিলে ফাইল রেখে বেরিয়ে যাচ্ছিলো রুম থেকে। কিন্তু জাওয়াদের টেবিলের উপর খুব  সুন্দর একটা প্যাকেট দেখে কৌতুহলের তীব্রতার কাছে ভুল-শুদ্ধের জ্ঞান ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। ওপেন প্যাকেট ছিল তাই হাতে নিয়েই দেখতে পেয়েছিল ভেতরে অ্যালবাম। কেন ঐ সময় এমন অদ্ভুত আচরণ করেছিল সেটা ভেবে এখনো খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। সে তো মোটেও সামান্য কোন কারণে এমন বিশ্রী ভাবে রিঅ্যাক্ট করা স্বভাবের মেয়ে নয়। তাহলে কেন সকালে অ্যালবামটা দেখার সাথে সাথে ভীষণ রকম রাগ হয়েছিল? এতটাই রাগ যে দু’হাতে সজোরে অ্যালবামটা ছুঁড়ে ফেলেছিল রুমের এক পাশে থাকা বাসকেটে। এই কান্ড করার পর নিজের রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেয়েছিল দরজায় দাঁড়িয়ে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে ফায়েজ ভাইয়া, হুমায়ূন ভাইয়া আর জাওয়াদ। তিনজনকে দেখার পর যতটুকু ভারসাম্য বজায় ছিল মেজাজের সেটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। জাওয়াদ একপাশে সরেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ফায়েজ ভাইয়া আর হুমায়ূন ভাইয়া পুরো দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুই ভাইকে ঢাক্কা দিয়ে দরজা থেকে সরিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গিয়েছিল কমনরুম থেকে।

রুমে এসে রাগ আর এমন অদ্ভুত আচরণের পিছনে কারণ খুঁজে না পেয়ে ঝরঝর কেঁদে ফেলেছিল। কিছুক্ষণ পরই যখন গ্রুপে জাওয়াদের ম্যাসেজ এসেছিল, নূহা অ্যালবামটা বড় মামা নিয়ে এসেছিলেন গত সপ্তাহে। দেখা তো অনেক দূরের ব্যাপার আমি প্যাকেটটা টাচ করেও দেখিনি। এখনো বাসকেট থেকে ফায়েজকে দিয়ে উঠিয়েছি। আমি মামাকে বলবো যেন নিয়ে যায় প্যাকেটটা। এবং ভবিষ্যতে যেন কখনোই এমন কান্ড না করে সে ব্যাপারেও সাবধান করে দেব। তুমি কান্না করো না প্লিজ। আমি ইনশাআল্লাহ কোনদিন এমন কিছু করবো না যা সহ্য করতে বা মেনে নিতে তোমার কষ্ট হতে পারে। জাওয়াদের ম্যাসেজটা নিজ চরিত্রের ভারসাম্যহীনতা যে দিন দিন বাড়ছে এটা উপলব্ধি করিয়ে লজ্জার চোরাবালিতে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিয়েছিল তাকে। তাই পরের ম্যাসেজে জাওয়াদ যখন জানিয়েছিল দুই সপ্তাহের জন্য বাইরে যাচ্ছে। এই সময়টা বাড়িতে সবার সাথে কাটাতে। সাথে সাথে রাজী হয়ে গিয়েছিল। মন কেন জানি বার বার বলছিল বাড়ির পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু এই কথাগুলো চাইলেও এখন মামণিকে বলা সম্ভব নয়। কেননা মামণি পুরো বিষয়টাকেই আরেকদিকে নিয়ে যাবেন। তারপর হৈ চৈ শুরু করবেন, নূহাকে বকাঝকা করবেন, কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে বিরাট কান্ড বাঁধিয়ে দেবেন।

বেশ অনেকটা ক্ষণ নীরব থাকার পর মিসেস সুরাইয়া বললেন, মনেআছে ছোটবেলায় তোর মনের সব কথা সবার আগে তুই আমাকে বলতি। তোর ক্লাসে কোন মেয়েটাকে তোর পছন্দ না, কাকে কাকে খুব ভালো লাগে, কোন টিচার খুব সুন্দর করে বোঝান, কোন ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকেই চেয়ারে বসে ঝিমুতে শুরু করেন সবকিছু এসে আমাকে বলতি। তোর ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছু আমি জানতাম। ছোট্ট কোন একটা কথাও তুই কখনো আমার থেকে গোপন করতি না। কোন কারণে যদি তোর কখনো মন খারাপ হতো ছুটে আসতি আমার কাছে। কখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকতি, কখনো বা কোলে মাথা রেখে কান্না করতি। কিন্তু গত বারো বছরে একটা বারের জন্যও এমন কিছু ঘটেনি। না তুই কোনদিন তোর মনের কোন  কথা আমাকে বলতে এসেছিস। না কোনদিন এসে বলেছিস, মামণি বুকের ভেতরটা মেঘে মেঘে থই থই হয়ে আছে। তোমার কোলে মাথা রেখে শ্রাবণের জোয়ারে ভাসতে ইচ্ছে করছে খুব।

নূহা হাসি মুখে বলল, জীবনের একটা সময়ে এসে বেশির ভাগ মেয়েরাই নিজেই নিজেকে জাপটে ধরে সামলাতে শিখে নেয় মামণি। নিজের কোলে মাথা রেখেই অশ্রুর জোয়ারে ভাসাটাকেও আয়ত্ত করে ফেলে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মেয়েদেরকে এই ক্ষমতাটা খুব ভালো মতোই দিয়েছেন। মেয়েরা যেমন অন্যের কেটে যাওয়া তাল জোড়া দিতে পারে। তেমনি ব্যহত করতে পারে নিজের ছন্দপতনও।

তুই একথাটা স্বীকার করে নিলেই পারিস যে আমাকে এখন আর তোর বন্ধু ভাবিস না। যেদিন পরিবারের অন্য সবার সাথে মিলে আমিও তোকে জোর করে বাধ্য করেছিলাম রাহাতের সাথে বিয়ের জন্য। সেদিন থেকেই তুই আমার সাথে ফর্মাল হয়ে গিয়েছিস। একেবারে আঁটসাঁট ফর্মাল।

নূহা হেসে ফেলে বলল, এটা তোমার ভুল ধারণা মামণি।

সঠিক ধারণাটা তাহলে কি?

সঠিক ধারণা হচ্ছে, সবার জীবনে ঘটে চলছে অনবরত ছন্দের দ্বন্দ্ব, বিঘ্ন ঘটায় যা উপভোগ করতে জীবনের আনন্দ। প্রাণপণ চেষ্টা করি কখনো হয় না যেন ছন্দ পতন, প্রিয়জনরা থাকে যেন সবসময় হয়ে মোর একান্ত আপন। থাকে যদি ত্যাগ ও শ্রদ্ধাবোধের আন্তরিক সংমিশ্রণ, কিছু ব্যর্থতা-বেদনা সত্ত্বেও গড়া যায় স্বপ্লীল ভুবন।

একটু ক্ষণ চুপ থেকে মিসেস সুরাইয়া বললেন, সব বিষয়ে এমন কাব্য রেডি থাকে কিভাবে?

নূহা হাসতে হাসতে বলল, আলহামদুলিল্লাহ সব বিষয়ই তো জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয় আম্মাজান। কখনো নিজেকে নিয়ে, কখনো বা অন্যেকে নিয়ে মন তাই কাব্য চর্চার সুযোগ পেয়েই যায়।

সারাক্ষণ মন মন করিস নাতো। মন মন করিস বলেই শরীরের প্রতি কোন খেয়াল নেই তোর। চুলের কি অবস্থা হয়েছে দেখেছিস তাকিয়ে একবার?

তুমি তো আছোই দেখার জন্য। আমি শুধু শুধু তাকাতে যাবো কোন দুঃখে? দুষ্টুমি মাখা স্বরে বললো নূহা।

এই যে এমন এলোমেলো, অগোছালো থাকিস রাহাত কিছু বলে না তোকে?

দোস্তরা কখনো দোস্তদের থাকা-খাওয়া, চলা-ফেরা নিয়ে অবজেকশন করে না বুঝলে? দোস্তরা সর্বাবস্থাতে একে অন্যেকে দিকে দু’বাহু প্রসারিত করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। মেনে নেয় যে যেমন তাকে ঠিক সেভাবেই।

রাহাত তোর দোস্ত?

উহু, তুমি যেমন শুকনো মুখে দোস্ত বলছো তেমন দোস্ত মোটেই নয়। হি ইজ মাই বেষ্ট ফ্রেন্ড। তোমার কাছে যে আমি এখন আর দুঃখ গাঁথা নিয়ে আসিনা এর একটা কারণ কিন্তু রাহাতও। আমার মাঝে মাঝে যখন খুব কান্না করতে ইচ্ছে করে আমি ওর বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে বসে কান্না করি। জানো একটুও বিরক্ত করে না তখন আমাকে রাহাত। জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকে। কখনোই সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে না। কারণ ওর জানা আছে আমি কারো মুখে সান্ত্বনার বাণী শুনতে একদম পছন্দ করি না। কখনোই প্রশ্ন করে না কেন কান্না করছি, কি ভেবে কান্না করছি, কি হয়েছে, ইত্যাদি কিছুই না। আর এমনটা শুধু একজন বন্ধুই করতে পারে। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই বিরক্ত হয়, প্রশ্ন করে, কৈফিয়ত চায়। কিন্তু এক বন্ধু নিঃশব্দে আরেক বন্ধুকে শুধু বোঝার চেষ্টা করে। বুঝতে যদি নাও পারে অবুঝের মতোই সাপোর্ট করে। আলহামদুলিল্লাহ রাহাত আমার ঠিক এমন একজন বন্ধু। তাই তোমার যদি ঝগড়া করতেই হয় রাহাতের সাথে যেয়ে করো। ওর কারণেই তোমার আর আমার বন্ধুত্বে দুরুত্ব তৈরি হয়েছে।

আবারো একদম চুপ হয়ে গেলেন মিসেস সুরাইয়া। নূহাও অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বেশ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল, জানো মামণি গত কয়েকদিন থেকে জারিফকে নিয়ে নিয়মিত বিকেল বেলা পার্কে যাচ্ছি। ঐ পার্কটাকে জারিফের ক্লাসের অনেক বাচ্চারাও আসে। জারিফ পার্কে গিয়েই বন্ধুদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে। আর আমি এক কোণে গিয়ে বই নিয়ে বসি। গত সপ্তাহে একদিন খুব অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম তাই আর বই নিয়ে যাইনি। পার্কের বাচ্চাদেরকে দেখছিলাম বসে। কিছুক্ষণ পর মনে মনে নিজের কান ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললাম, তুমি আসলেই একটা বিরাট বুদ্ধু। তা না হলে এমন আনন্দ ভুবনে কেউ বই নিয়ে আসে?! আরে বোকা এখানে যদি নিজেকে হারাতেই হয় তাহলে বইয়ের ভেতর নয়, হারাতে হবে এই নানা রঙ ও নানা বর্ণের শিশুদের ভিড়ে।

মিসেস সুরাইয়া হেসে বল, কান ধরে ঝাঁকানোর সাথে সাথে নিজেকে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেই না আরো উত্তম হতো।   

হুম, তা অবশ্য হতো। কিন্তু আমাকে থাপ্পড় দেবার অধিকার শুধুমাত্র আমার মামণির। নিজেকেও এই অধিকার দিতে চাই না আমি। যাইহোক, এরপর শোনো। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই মনেহচ্ছিলো ফুটন্ত ফুলদের ছুটোছুটি আর ছোট্ট ছোট্ট পাখীদের কলকাকলি চারিদিকে আনন্দধারা বইয়ে দিয়েছে যেন। আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল উচ্ছ্বাস আর প্রশান্তি। হাত বাড়িয়ে ধরার কষ্টও করতে হয় না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই সেই উচ্ছ্বাস আর প্রশান্তি ঠেলে ঠুলে মনের ভেতর নিজের জায়গা করে নেয়। পর মূহুর্তেই আবার ভেতর থেকে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বেড়িয়ে আসে হাসির রূপে। সেদিন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম ফুল-পাখীদের নীড়ে। একদল বল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল, কেউ কেউ লক্ষ্যহীন ছুটছিল দিগ্বিদিক, কেউ বা বালিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে ঘর বাড়ি বানাচ্ছিল। কেউ স্লিপারে, কেউ দোলনাতে খেলা করছিল। তবে পার্কে সবচেয়ে ভাবুক কারা জানো?

কারা?

গেদু গেদু বেবীগুলো। উনারা আপন মনে হাঁটছেন তো হাঁটছেনই। উনাদের বাবা-মায়েরা আবার একটু দুরুত্ব রেখে পেছন পেছন থাকে। কেউ কেউ হাঁটতে হাঁটতে ধাপুস ধুপুস পড়ে যায়। এখানেও আছে বৈচিত্রতা। পড়ে গিয়ে কেউ কান্না করে, কেউ বড় বড় চোখ করে আদুরে ভঙ্গীতে তাকায়, আবার কেউ কেউ হেসে ফেলে। কেউ কেউ যেখানেই যায় বাবা-মার হাত আঁকড়ে ধরে থাকে শক্ত করে, আবার কেউ আঙ্গুল নাচিয়ে বাবা-মাকে সতর্ক করে দিয় যেন তার পেছন পেছন না ঘোরে। এখন তারা বড় হয়েছে, নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারে। আবার দোলনাতে উঠে কেউ চিৎকার করে বলে, পাপা জোড়ে দোল দাও, আরো জোড়ে, আরো জোড়ে। আর কেউ ভীতু কণ্ঠে বলে, আস্তে আস্তে দোল দাও মাম্মা। নয়তো আমি পড়ে যাব।

মিসেস সুরাইয়া হেসে বললেন, এতকিছু কিভাবে খেয়াল করিস তুই? 

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এসবই আমার বাবার চোখ-কান খোলা রেখে পথ চলতে শেখানোর কল্যাণ। তবে সামারের এই সময়টাকে পার্কের আরেকটি আকর্ষণীয় জিনিস হচ্ছে ঘুড়ি। আকাশে নানান ধরণের ঘুড়ি উড়তে দেখে, মনটা কেমন যেন ডানা মেলে দেয়। জানো মামণি শেষ সেদিন জারিফকে নিয়ে পার্কে গিয়েছিলাম ফেরার পথে চোখ পড়েছিল অনেক বৃদ্ধ এক দম্পতির উপর। দুই জনেরই এক হাতে লাঠি আর অপর হাতে একে অন্যেকে আঁকড়ে ধরে পথ চলছিলেন। উনাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল। মনে হয়েছিল ক’জনের ভাগ্য হয় জীবনসাথীর হাত ধরে এমন থুড়থুড়ে বুড়ো হওয়াটা?!। মামণি একটা অনুরোধ রাখবে?

হুম, বল।

আগামীকাল বিকেলে আমরা পার্কে যাবো। তুমি আর বাবা হাত ধরে পার্কে ঘুরে বেড়াবে আর আমি দূরে বসে মুগ্ধ চোখে তোমাদেরকে দেখবো।

তুই কি বোঝাতে চাইছিস? তোর বাবা-মামণি থুড়থুড়ে বুড়ো হয়ে গিয়েছে?

হেসে ফেললো নূহা। এরপর হাসতে হাসতে বলল, মোটেই না। আমার মামণিকে তো এখনো আমার চেয়েও ইয়াং দেখায়। আর বাবা? মাশাআল্লাহ নজর না লেগে যায় এমন অবস্থা এখনো।

মিসেস সুয়াইয়া হেসে বললেন, হয়েছে অনেক শুনেছি তোর আবোল তাবোল কথা। চুলে ম্যাসেজ করা শেষ। এখন ঘুমোতে যা।

আমি তো আজ তোমার সাথে ঘুমোবো। বাবার সাথে কথাবার্তা ফাইনাল করে এসেছি।

কিসের কথাবার্তা?

এক রাতের জন্য বাবার বৌ আমার এবং আমার কন্যার।

তোর কন্যাও আসবে নাকি?

অবশ্যই আসবে। মামণি আজ আনন্দবাড়ির ইতিহাসে এক স্মরণীয় রাতের অবতারণা হতে যাচ্ছে। এক রুমে এক সাথে তিন জেনারেশনের মহা মিলন মেলা।

উফ, আমি মাঝে মাঝে ভেবে পাই না এত কথা তুই কোথায় পাস! বসে থাক এখানে একটু চুপ করে। আমি হাত ধুয়ে আসি।

মামণি উঠে যেতেই নূহা আবারো জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বহু বছর হয়ে গিয়েছে বৃষ্টিতে ভেঁজা হয়নি। ইচ্ছেই করে না কেন জানি। কিন্তু এই মূহুর্তে ভীষণ ইচ্ছে করছিল মামণি আর নাবিহার হাত ধরে ছুট লাগাতে বাগানে।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন