ভালো ও মন্দের পার্থক্য করা খুব সহজ। যে যেদিকে চলতে
চায় খুব সহজেই বেছে নিতে পারে ভালো বা মন্দ যে কোন একটি পথ। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন
মূহুর্তে দুটি ভালোর মধ্যে উত্তমটি বেছে নেয়া প্রায়ই সময়ই খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
জীবন মাঝে মাঝে গণিতের রূপে সজ্জিত হয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়। উল্লেখ যেহেতু
থাকে না চট করে বোঝাও সম্ভব হয় না সেটা কি পাটিগণিত না বীজগনিত? পাটিগণিত গণিত
হলে তাও তো শেষ রক্ষা হয়। কিন্তু বীজগণিতের সমাধানের জন্য তো আবার জন্য জানা থাকতে
হয় সূত্র! অবশ্য বিশ্বাসী মনের জন্য সবকিছুই খুব সহজ হয়ে যায়। দুটা ভালো মধ্যে
থেকে উত্তমটি তারা বেছে নেন অধিক কল্যাণের বিবেচনায়। আর এই বেছে নিতে পারাটাই হয়তো
তারজন্য পরীক্ষা। উভয় সংকটের মুহুর্তগুলোকে বিনা প্রিপারেশনে হঠাৎ আসা পরীক্ষা
মনেহয় নূহার কাছে।
আজও ছোট একটা পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাকে সাবিরা, ফাতিমা এবং
রাহাতকে ঘিরে। সাবিরা ও ফাতিমাকে ওদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার কথা দিয়ে সেটার
বরখেলাফ করতে চায়নি আবার স্বামীর হক নষ্ট করতেও মন সায় দিচ্ছিলো না। বেশ কিছুদিন
আগে নাবিহার করা প্রশ্নটা মনে পড়ে গিয়েছিলো। নাবিহা দুষ্টু মিষ্টি হাসি ভরা মুখে
জিজ্ঞেস করেছিলো, মামণি তুমি তো সাঁতার জানো না। এখন আমি যদি তোমার সামনে কোন নদীতে পড়ে যাই
তাহলে তুমি কি করবে? নূহা জবাবে বলেছিল, শুধু তুমি কেন সাঁতার না জানা যে কেউ যদি আমার সামনে নদীতে পড়ে যায় আমি তার
দিকে একটা লাইফ জ্যাকেট ছুঁড়ে দেব। কাউকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সবসময়ই যে
নিজেকে সাঁতার জানতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলে নদীতে না
নেমেও একটা লাইফ জ্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে তাকে হাবুডুবু খাওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। যার
ফলে হয়তো ডুবে মরতে না হবে না সেই ব্যক্তিকে। নিজের চেষ্টার দ্বারা হাতড়ে হাতড়ে এক
সময় পৌছে যাবে সে তীরে। এখন সেটা জীবন নদী হোক বা প্রাকৃতিক নদী।
মূলত, যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ইচ্ছে থাকতে হবে মনে।
কেননা মানুষ যখন বিশ্বাস নিয়ে পথ চলতে শুরু করে তখন কিছু বাঁধা-বিপত্তি পথ আগলে দাঁড়ালেও
একসময় গন্তব্যে পৌছে
যাওয়া যায়। কিন্তু পথের শুরুতেই যদি শেষ মাথা কত দূর, পথ মাঝে কি আছে
সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়,
তাহলে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে। এতে কিন্তু সমস্যারা বিদায় জানিয়ে
চলে যায় না। বরং পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরে তাকে আর সে ভাবে ভাগ্যিস পথে কদম
রাখিনি। এখানে দাঁড়িয়েই এত কিছু সইতে হচ্ছে চলতে গেলে না জানি আরো কত বাঁধা ঘিরে
ধরতো আমাকে। এই তো সেদিন এক ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে হয়েছিলো। পাহাড়ের উপড়ে ছোট্ট এক
কুটিরে থাকে। গাড়ি থেকে নেমে যখন উপরে তাকিয়েছিল শঙ্কা জেগে উঠেছিল মনে কিছুতেই
পারবে না পায়ে হেঁটে এই পাহাড়ে উঠতে। রাহাত নূহার হাত চেপে ধরে হাসি মুখে বলেছিল, মনেকরো যে একশোটা
সিঁড়ি আছে এখান থেকে কটেজ পর্যন্ত। তোমাকে সুপারওম্যান হয়ে উড়তে হবে না। জাস্ট
ছোট্ট একটা শিশুর মত দু’হাতে গ্রীল আঁকড়ে ধরে প্রতিটা সিঁড়িতে পা রাখতে হবে। সত্যিই রাহাতের সাথে
কথা বলতে ধীরে ধীরে কখন যে উপরে পৌছে গিয়েছিলো টেরই পায়নি। সেদিন আবারো উপলব্ধি
করেছিল, যে কোন কিছু করার আগে ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা সেই কাজকে জটিল করে তোলে
অনেক বেশি। যারফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো মানুষ ব্যর্থ হয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে।
সেদিন পাহাড়ের উপর পৌঁছে রাহাত দুষ্টুমি মাখা স্বরে বলেছিল, পাশে যখন
নির্ভরযোগ্য সাথী থাকে তখন পথ যতই এবড়ো থেবড়ো হোক না কেন মানুষ নিশ্চিন্তে আর নির্বিঘ্নে পথ
পারি দিতে পারে। কি প্রমাণ পেলে তো আমি যে তোমার নির্ভরযোগ্য সাথী? হেসে ফেলেছিল
নূহা। হাসি ফুটে উঠলো এখনো ঠোঁটের কোণে। সত্যিই চলার পথে নির্ভরযোগ্য কেউ পাশে আছে
এটা যে কারো জীবনেই পরম প্রাপ্তি। অনেক সময় কেউ পাশে এই চিন্তাটাই যথেষ্ট হয় সামনে
এগিয়ে চলার জন্য।
সাবিরা ও ফাতিমার সাথে হাসি-মজা ও গল্প করতে করতেই
সাড়া পথ এসেছিলো। বাসায় দরজায় চাবি লাগানোর সময় ভাবছিলো শুধু রাতে থাকার
প্রোগ্রামটা বাদ দিয়ে আর যা যা ঠিক করেছিলো সেইমত সময় কাটাবে দুজনের সাথে। এইটুকু
স্যাক্রিফাইস রাহাতকে বুঝিয়ে না বললেও বুঝবে এবং খুশি মনেই মেনে নেবে। আর বাকি সব
প্ল্যান ঠিকমত হলে সারারাত গল্প করাটা অন্য কোন দিনের জন্য তুলে রাখার আইডিয়াটা
নিশ্চয়ই আনন্দিত মনেই মেনে নেবে ফাতিমা, সাবিরা। কিন্তু দরজা লক দেখে বেশ অবাক হয়েছিলো। পরে
ফোন করে জানতে পেরেছে জরুরী একটা কারণে ফ্লাইট ক্যান্সেল করতে হয়েছে রাহাতকে। আজ
তাই আসছে না। আরো দু’দিন পর আসবে। দুটি ভালোর মধ্যে উত্তমটি বেছে নিতে পারার জন্য মনে মনে
আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করলো নূহা। অনুভব করলো কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সমন্বয়ে
হলেও ছোট্ট একটা পরীক্ষায় হয়তো সে টেনেটুনে পাশ মার্ক পেয়ে গিয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ।
ম্যাম দেখেন না জিলাপি কেমন যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ফাতিমার ডাকে মনের ভাবনা গুলোকে ভাঁজ করে কিচেনে গেলো
নূহা। কি হয়েছে?
দেখেন না তেলে দেবার সাথে সাথে ছড়িয়ে যাচ্ছে কেমন!
নূহা দেখিয়ে দেবার পর মহা আনন্দে জিলাপি ভাঁজতে
ভাঁজতে ফাতিমা বলল, আমি যখন বাসায় গিয়ে আব্বুকে গরম গরম জেলাপি ভেজে দেবো কি যে খুশি হবেন
আব্বু। জাযাকিল্লাহ ম্যাম। আব্বুর পছন্দের কিছু শেখার আইডিয়া দেবার জন্য।
অন্যদিকে সাবিরা সিঙ্গারার ভাঁজ নিয়ে মহা বিপদে ছিল।
জামা-কাপড় ও চেহারাতে ময়দা লাগিয়ে একাকার অবস্থা করে ফেলেছিল। নূহাকে দেখে শুকনো
মুখে বলল, তিন কোণা হচ্ছে নাতো ম্যাম। দেখেন কেমন গোল গোল হয়ে যাচ্ছে।
নূহা হেসে বলল, এই গোল গোল সিঙ্গারাই তোমার আম্মুর কাছে স্বর্গীয় খাবার
মনেহবে। নাবিহার যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন প্রথম আমাকে চা বানিয়ে দিয়েছিলো। ক্লাস
থেকে ফিরে এসে ক্লান্তিতে চেঞ্জ না করেই সোফায় এলিয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর নাবিহা
ওর খেলনা মগে ঠাণ্ডা পানি, একগাদা চিনি আর টিব্যাগ দিয়ে আনন্দে গদগদ হয়ে আমার কাছে এসে বলেছিল, মামণি দেখো আমি
তোমাল দন্য চা নিয়ে এতেতি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি চা মুখে দেবার সাথে সাথে সমস্ত
ক্লান্তি কেটে গিয়েছিল আমার।
ফাতিমা বলল, এটাই সন্তানদের সাথে মায়ের ভালোবাসার বন্ধন তাই না
ম্যাম?
হুম,
আসলে ভালোবাসা যখন স্বার্থহীন হয়, আন্তরিক হয় তখন আর সেটা শুধু ভালোবাসা থাকে না।
ম্যাজিক হয়ে যায়।
সাবিরা হেসে বলল, আপনার বাবুরা সবাই কোথায় ম্যাম?
প্রতি শুক্রবার স্কুলের পর জারিফ ওর নানা বাড়িতে চলে
যায়। সব নাতি-নাতনীদের সাথে নিয়ে আমাদের বাবা, চাচ্চুরা বড় মসজিদে যান জুম্মার নামাজ আদায় করতে। বড়
মসজিদে অনেকেই আসেন নানান সমস্যার আক্রান্ত অনেক সাহায্যপ্রার্থী আছে। বাচ্চাদেরকে
সাথে নিয়ে তাদের সাথে কথাবার্তা বলেন বাবা। এরপর বাচ্চাদেরকে দিয়ে
দান-সাদাকা করান। ছোটবেলা থেকেই দানশীল, পরোপকারী করে গড়ে তোলার ছোট্ট একটা ট্রেনিং বলতে পারো
এটাতে।
এটা তো খুবই উত্তম কাজ ম্যাম। আমাদেরকে যদি ছোটবেলায়
এভাবে শিক্ষা দেয়া হতো সবকিছু। তাহলে আমরাও হয়তো উত্তম মুসলিম হতে পারতাম। মন
খারাপের স্বরে বললো সাবিরা।
নূহা বলল, যা হয়নি সেসব ভেবে আফসোস করতে নেই। এতে মন দুর্বল হয়ে
পড়ে। তাই যা হয়নি সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। বরং এখন নিজেদেরকে উত্তম মুসলিম হিসেবে
গড়ে তোলার চেষ্টা করো। তাছাড়া তোমাদের বাবা-মায়েরা যদি বুঝতেন যে বর্তমানে এই বৈরী
পরিবেশে নিজেদেরকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মেকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের
পরিবারগুলোকে পরিপূর্ণ আদর্শ মুসলিম পরিবার হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়া দ্বিতীয় কোন অপশন
নেই আমাদের কাছে। তাহলে উনারা সবাইও হয়তো নিজ নিজ পরিবারকে দ্বীনের দুর্গ হিসেবে
গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। এবং ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হওয়াটা অনেক বেশি সহজ হয়ে
যেতে পারতো এরফলে।
সাবিরা বলল, জ্বি ম্যাম। আসলে আমরা নিজেদেরকে না গড়ে অন্যকে গড়তে
যাই বলেই আমাদের
চাওয়ায় কোন বরকত নেই। জানেন ম্যাম আমি এমন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেটা
কল্পনার মতই সুন্দর। যে দেশের পৃথিবীর বড় মানুষেরা শিশুদের মত নরম, কোমল, সুন্দর ও নিষ্পাপ
হবে। যে পৃথিবীতে কোন খারাপ মানুষ থাকবে না। থাকবে না কোন অভাব-অনটন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, থাকবে না ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু ও
সাদা-কালোর পার্থক্য। যে পৃথিবী মানুষের তৈরি নিয়ম-কানুন ও আইনের দ্বারা পরিচালিত
হবে না। যার ফলে শয়তান মানুষকে বিপথে পরিচালিত করতে না পেরে আহাজারি ও আর্তনাদ
করবে। দূষিত হবে না যে পৃথিবীর বাতাস। সবুজে সবুজে ঘেরা থাকবে যে পৃথিবী। প্রকৃতির
কোলে মানুষ খুঁজে পাবে প্রশান্তিকর আশ্রয়। বনের পশুপাখীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াবে
মানুষের আশেপাশে। কারণ তারা জানবে যে এরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী না। এরা তো
আশরাফুল মাখলুকাত। এরা সৃষ্টির সেরা জীব। এদের দ্বারা কখনোই কারো অমঙ্গল হওয়া
সম্ভব নয়।
ফাতিমা বলল, ঠিক এমন স্বপ্ন আমিও দেখি ম্যাম। এমন একটা পৃথিবী
যেখানে কেউ কাউকে ভুল
বুঝবে না বরং সবাই সবাইকে বুঝবে। ‘পরের কারণে স্বার্থ দিবো বলি’ এই শ্লোগান আপন
মনে গুনগুন করবে যে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ। যেখানে কোন এতিমখানা থাকবে না।
শিশুশ্রমের কারণে নষ্ট হবে না কোন শিশুর শৈশব। বাসা বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে কোন
শিশুকে ঝলসে যেতে হবে না। যে পৃথিবীতে প্রতিযোগীতার ম্যারাথন দৌড়ে সন্তানদেরকে
লক্ষ্য বানাবে না বাবা-মায়েরা। ছিনিয়ে নেবে না তাদের শৈশবের আনন্দঘন দিনগুলোকে।
বাবা-মায়েরা সন্তানদেরকে বুঝবে। বিকশিত হতে সাহায্য করবে তাদের ভেতরকার সৃজনশীলতাকে।
যে পৃথিবীতে কোন বৃদ্ধাশ্রম থাকবে না। কারণ সন্তানরা "হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতাকে
ভাল রেখ, শান্তিতে আদরে সুখে রেখ,
যেভাবে তারা আমাদেরকে রেখেছেন আমাদের শৈশবে; কিংবা তারচেও বেশি” এই দোয়া শুধু মুখে মুখে পাঠ করবে না। তারা নিজেরাও
চেষ্টা করবে বাবা-মার আদর-যত্ন করতে। মোট কথা এমন একটা পৃথিবী যেখানে সবাই সবাইকে
ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে।
নূহা হেসে বলল, একটা সময় আমিও তোমাদের মত করেই ভাবতাম, স্বপ্ন দেখতাম।
কিন্তু এখন আর এভাবে ভাবি না। কারণ জানি যে জগতে বিরাজমান নানাধরণের বৈষম্য
আল্লাহরই পরিকল্পনার অংশমাত্র। দুনিয়ার সবাই যদি একই রকম ভালো হতো, সর্বত্র যদি একই
পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিরাজমান থাকতো তাহলে তো দুনিয়াটা পরীক্ষাক্ষেত্র হতো না।
আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন চিন্তাশক্তি দিয়েছেন, বিচার-বিবেচনা করার জন্য বিবেক দিয়েছেন। যার প্রয়োগ
করে মানুষ প্রমাণিত করবে যে সে সৃষ্টির সেরা জীব। এটাই তো পরীক্ষা। যে পরীক্ষা
দিতে পৃথিবীতে আসা সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রকেই যদি অস্তিত্বহীন করে দিতে চাও তাহলে
কিভাবে হবে? আমাদের প্রত্যেকের মনে শুধু একটাই স্বপ্ন থাকা উচিত আর সেটা হচ্ছে আদর্শ
মুসলিম হতে হবে আমাদেরকে। সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কারণে মানুষ দৃষ্টিসীমার বাইরে সবকিছু
দেখতেই অক্ষম। তাই মানুষ যাতে সঠিক পথে চলতে পারে সেজন্য আল্লাহ যুগে যুগে
পাঠিয়েছেন পথপদর্শক। যারা আল্লাহর পাঠানো পথপদর্শকদের দেখানো সেই পথে
চলবে,আল্লাহ্র আনুগত্য করবে তারা নিজের জন্যই করবে। দুনিয়ার অন্ধকার পথে যাতে
আমরা মুখ থুবড়ে পড়ে না যাই, ভুল পথে চলে না যাই সেজন্য যে আলো আল্লাহ প্রেরণ করেছেন আমাদের জন্য, আমরা যদি সেই
আলোতে পথ চলতে চেষ্টা করি তাহলে কোন মরীচিকা আমাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিপথে নিয়ে
যেতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। সুতরাং অলীক স্বপ্নের ফুল ফুটিয়ে নষ্ট করো না তোমাদের মূল্যবান
স্বপ্নের বীজ। কুরআন ও হাদীসের আলোতে আলোকিত করো নিজ নিজ মনোজগত অতঃপর সেই আলোতে
নিজের অন্ধকারকে দূরীভূত করে ছড়িয়ে দাও আলো। হয়ে উঠতে চেষ্টা করো জোনাকি। অন্তত
একটি জীবনের জন্যে হলেও।
সাবিরা বলল, আপনি একদম ঠিক বলেছেন ম্যাম। আমাদের আসলে এমন চেষ্টাই
থাকা উচিত।
নূহা হেসে বলল, ঠিকআছে তোমরা রান্না করো আমি ফোন করে খবর নিয়ে আসি
নানাভাই আর নানুমণিকে কেমন জ্বালা যন্ত্রণা দিচ্ছে আমার কন্যা আর পুত্ররা।
@
মাগরীবের নামাজ সেরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ফাতিমা।
তাকিয়ে দেখলো আকাশে আজ যেন মেলা বসেছে তারাদের। এমন তারায় তারায়
খচিত আকাশ ভীষণ পছন্দ তার। মিটমিট করে জ্বলতে থাকা আকাশ কত কথা যে বলে যায় তাকে
চুপিচুপি! তার মনের ভাবনাগুলো যা সে বলতে পারে না কাউকে চুপিচুপি শুনিয়ে দেয়
তারাদের। একটুও বিরক্ত না হয়ে মন দিয়ে তার সব কথা, সব ব্যথা, সব অভিযোগ শোনে তারারা। এমন একজন মানুষ পেতে খুব ইচ্ছে
করে ফাতিমার। যার কাছে মনের আপন কথা, গোপন কথা নিঃসংকোচে ও নির্ভয়ে বলা যাবে। যে তাকে
বুঝবে কিন্তু কখনোই ভুল বুঝবে না। তার মনের এই ইচ্ছেটা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে আজ।
অনেকদিন পর আজ মন খুলে নিজের সমস্যার কথা, মনের উত্থান-পতন, নানান প্রশ্ন সবকিছু বলেছে ম্যামের কাছে। কথার মধ্যে
বিন্দুমাত্র বাঁধা না দিয়ে চুপচাপ তার সব কথা শুনেছে ম্যাম। যদিও তার সমস্যার
সমাধানের উদ্দেশ্যে এখনো কিছুই বলেনি। কিন্তু মনের জমে থাকা কথাগুলো নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে বলতে
পেরে খুব হালকা লাগছিল নিজেকে। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকালো ফাতিমা। হাসলো
নূহাকে পাশে দাঁড়ানো দেখে।
নূহাও হেসে বলল, এই ঠাণ্ডার মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো ভেতরে যাই।
ম্যাম আপনার ভালো লাগে না এমন তারা ভরা রাত? এমন ঝিকিমিকি
জ্বলতে থাকা আকাশ? জানেন আমি ছোটবেলায় ভাবতাম মানুষ মারা গিয়ে আকাশের তারা হয়ে যায়!
হেসে ফেললো নূহা। বলল, এমনটা মনেহয় বেশির ভাগ বাচ্চাদেরই ভাবনা থাকে।
আপনিও তাহলে এমনটা ভাবতেন ম্যাম?
উহু আমি ছোটবেলায় তারা হতে চাইতাম। সারাক্ষণ
ঘ্যানঘ্যান করতাম ভাইয়ার সাথে আমি তারা হতে চাই, আমি তারা হতে চাই। একদিন ভাইয়া আমাকে কোলে নিয়ে বললেন, তুমি কেন তারা
হতে চাও? জবাব দিয়েছিলাম, আমি চাই আমারো আলো থাকবে। আমিও ঝিকিমিকি করবো। ভাইয়া তখন হেসে বলেছিলেন, সেজন্য তোমাকে
অনেক ভালো একজন মানুষ হতে হবে। কারণ এই পৃথিবীর সব ভালো মানুষ ধরত্রীর বুকে এক একটি তারকা।
তারাও ঝিকিমিকি করে জ্বলে মানুষের মনে, মিটিমিটি আলো দেয় পথহারা মানুষের অন্ধকার মনোজগতে।
ফাতিমা হেসে বলল, আঙ্কেল আর আপনার ভাইয়াদের কাছেই বুঝি আপনি এত সুন্দর
করে কথা বলা শিখেছেন ম্যাম?
নূহা হাসি মুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। জানো ভাইয়ার কাছেই আমি প্রথম
জেনেছিলাম কথারও পুষ্টিগুণ আছে। কথার প্রভাবে দূর হতে পারে মনের রাতকানা রোগ।
ভ্যাকসিন হিসেবেও দেয়া যায় কথাকে। আবার অনেক বড় বড় রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে যায় কথা।
তাছাড়া কুরআনেও কিন্তু বলা হয়েছে যে, “সদুপদেশের তুলনা হচ্ছে উৎকৃষ্ট বৃক্ষের ন্যায়,যার শিকড় দৃঢ়ভাবে
মাটিতে প্রোথিত এবং শাখা প্রশাখা আকাশে [পৌছায়]”। আর আমার কি মনেহয় জানো? নিজেই নিজের
আশ্রয় হবার জন্য সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারাটা বেশ জরুরি। অবুঝ মনকে বোঝাতে সমৃদ্ধ
শব্দভাণ্ডার আবশ্যক। ঐ তারাদের মতো ঝিকিমিকি করে জ্বলবে যেই শব্দরা।
আমিও তারাদের মত ঝিকমিক করে জ্বলতে চাই ম্যাম। সেজন্য
আমাকেও তাহলে অনেক ভালো মানুষ হতে হবে তাই না? আমার ইচ্ছাও আছে প্রচণ্ড কিন্তু মাঝে মাঝে কেন জানি
না আগ্রহ হারিয়ে ফেলি সবকিছু থেকে।
জীবনের প্রতি অনাগ্রহ কেন আসে জানো ফাতিমা? আমার মনেহয়
অনাগ্রহ আসে নিজের প্রাপ্তির প্রতি অসন্তোষ থেকে। ভাগ্যকে মেনে নেবার অনীহা থেকে
মনে জন্ম নেয় অনাগ্রহ। আমরা মুখে বলি ভাগ্যে আমাদের বিশ্বাস শত ভাগ। যা হয়েছে
আমাদের মঙ্গলের জন্যই হয়েছে। এতেই নিহিত আছে আমাদের কল্যাণ। কিন্তু আমাদের মন সেটা
মেনে নেয় না বা নিতে পারে না বলেই জীবনকে ঘিরে তৈরি হয় হতাশা, নিরাশা, দুরাশা, অতৃপ্তি। যা ধীরে
ধীরে আমাদের মনকে গ্রাস করে ফেলে। যার ফলে মন দেখে যে তারচেয়ে হতভাগ্য দুনিয়াতে আর
কেউ নেই। এরফলে কিছু মনে জন্ম হয় অনীহা, কিছু মনে জন্ম হয় পরশ্রীকাতরতা, কিছু মন হয়ে উঠে
প্রতিহিংসাপরায়ণ। কারো ভালো দেখলেই যে মনে ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করে তুষের আগুণ।
আমরা যদি মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও অপ্রাপ্তির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতাম তাহলে
নিজেদের দুঃখ-কষ্ট-অপ্রাপ্তি গুলোকে অর্থহীন মনেহতো। কিন্তু আমরা নিজেদেরকে নিয়ে
এতই মগ্ন থাকি যে অন্যের দিকে তাকানোরই ফুরসত থাকে না। আমাদের ফ্রীজ ভর্তি খাবার
থাকে তাই ইচ্ছে করছে না বলে খাবারের প্লেট ঠেলে অবলীলায় উঠে যেতে পারি। কিন্তু
যাদের দিনের শুরু হয় এই ভাবনা দিয়ে আজ কি খাবার মত কিছু জুটবে আদৌ ভাগ্যে? তাদের কারো পক্ষে
মনেহয় অনাগ্রহ করার কোন অবকাশ থাকে না। তাই তো ডাস্টবিনেও খাবারের সন্ধানে ঘুরতে
দেখা যায় অনেক মানুষকে। জীবন তাদের সামনে কোন অপশন রাখে না। তাদের তাই কোন চয়েজ
থাকে না। সেজন্য অনাগ্রহেরও অবকাশ থাকে না।
আমি সত্যি এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি ম্যাম।
তাহলে চিন্তা করে দেখো তোমাকে ঘিরে তোমার প্রভুর
নিয়ামত সমূহের কথা। কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে যেতে হবে
তোমাকে। আমরা আমাদেরকে দেয়া নিয়ামতের কথা ভাবি না বলেই জীবনকে ঘিরে অনাগ্রহের জন্ম
হয়। অথচ আমার কি আছে, কি কি পেয়েছি সেটা সন্ধান করলে বেড়ে যেতে পারে জীবনকে ঘিরে আগ্রহ। তাই
দৃষ্টিকে নিজেতে আবদ্ধ রেখো না। চোখ মেলে বাইরে তাকাও। তোমার চারপাশে থাকা প্রতিটি
মানুষ, তোমাকে ঘিরে ঘটা প্রতিটি ঘটনার মাঝে লুকায়িত আছে শিক্ষা, লুকায়িত আছে
সামনে এগিয়ে যাবার পথের আলোকিত নকশা।
আমি বুঝতে পেরেছি ম্যাম।
আর একটা কথা মনে রেখো এই পৃথিবীতে কারো জন্য কিছু ঘটে
না। প্রতিটা ঘটনা ঘটার পেছনে নির্দিষ্ট কারণ থাকে। ঘটনাটি ঘটে সেই কারণকে
বাস্তবতায় রূপ দেয়। তাই কখনো ভাববে না যে তোমার কারণে কারো ক্ষতি হয়েছে, বা তোমার কারণে
কারো অকল্যাণ সাধিত হয়েছে কিংবা তোমার দ্বারা বদলে গিয়েছে কারো জীবনের গতি পথ। যদি
আপাত দৃষ্টিতে এমন মনেও হয়, দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে রাখতে এটাই আল্লাহর আল্লাহর পরিকল্পনা ছিলো। এবং এতেই
নিহিত সমূদয় কল্যাণ।
ইনশাআল্লাহ আমি এখন থেকে এভাবেই চিন্তা করতে চেষ্টা
করবো ম্যাম।
হাত বাড়িয়ে ফাতিমাকে খানিকটা আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো
নূহা। হাসি মুখে বলল, অনেক সময় বিভিন্ন কারণে আমদের মনে স্বয়ক্রিয় এবং একই সাথে নিয়ন্ত্রনহীন
ভাবে নানা ধরণের নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা দলে দলে হাজির হতে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও
যখন সেসব নেতিবাচক চিন্তার গতিকে ব্যহত যায় না, তখন আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি, নিজের করণীয় বুঝে
উঠতে পারিনা। আশার আলো নিভে যায়,
হতাশ জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে, নিরাশার মেঘে ঢেকে যায় তারাভরা আকাশ। নানান ধরণের
মানসিক কষ্ট , ক্লান্তি ঘিরে ধরে তখন মনকে। খুব বেশি অসহায় বোধ হয়। বিঘ্নিত হয় মনের
শান্তি, স্বস্থি। আশা জাগানিয়া মন বাঁধনহারা হয়ে উড়ার চেষ্টা করতে যেয়ে ডানা ভেঙে
লুটিয়ে পড়ে। নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে মন এমতাবস্থায়। আসলে আমাদের সবার মনেরই
দুটো দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে আবেগপুর্ন, অন্যটি হচ্ছে যুক্তিনির্ভর। এই দুটি দিকের
ভারসাম্যপুর্ন সহাবস্থানই পারে মনের শান্তিকে অক্ষুন্ন রাখতে। আর এটা তখনই সম্ভব
হবে যখন আমরা সঠিক চিন্তার দ্বারা আমাদের আবেগগুলোকে চিহ্নিত করে, যুক্তির দ্বারা
সেগুলোকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবো। আর নিজেকে চেনা-জানা-বোঝা এবং নিজের প্রতি
আস্থা-বিশ্বাস-শ্রদ্ধা বোধ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এবং আমরা আমাদের জীবনকে তখনই সার্থক
করে তুলতে পারবো যখন আমাদের জানা থাকবে কোথায় জীবনের সার্থকতা!
এজন্যই সবার আগে নিজেকে খুব ভালো মতো চিনতে, জানতে ও বুঝতে
হবে তাই না ম্যাম?
হুমম! যখন মনের প্রতিটি অ্যাকশন, রিঅ্যাকশন এর
পেছনের কারণকে সুস্পষ্ট ভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়। ভেবে দেখো তো তখন কেমন লাগবে? কেন শূন্যতার
আবহে ভাসছে মন, কেন কিছুই ভালো লাগছে না?
কেন সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকেও নিজেকে আড়াল করে রাখতে ইচ্ছে করছে? কেন সবচেয়ে প্রিয়
গল্পের বইটা ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করছে না। ফুটন্ত ফুল বাগানে মন প্রজাপতি হয়ে উড়তে
চাইছে না কেন? কেন স্নাত হতে ইচ্ছে করছে না রিমিঝিমি শ্রাবণও ধারায়? এমন অসংখ্য না
জানা 'কেনর' উত্তর খুঁজে পাওয়ার আনন্দই অন্যরকম। আসলে নিজের সম্বন্ধে যত বেশি জানা যায়
সমস্যায় মোকাবিলা করাটা ততই সহজ হয়ে যায়। আর নিজের সম্বন্ধে জানতে হলে নিজের সাথে
কোয়ালিটি টাইম কাটানো অত্যাবশ্যক। চিনতে হবে নিজ মনের অলি-গলি-গুপচি। জানতে হবে
কোথায় সাগর, কোথায় পাহাড়, কোথায় মরুভূমি। কিসে মন আনন্দিত হয়, কিসে বেদনাক্ত হয়, কিসে হাসে, কিসেই বা হয় বিরক্ত। যখন নিজ মনে চড়াই-উৎরাই খুব ভালো
মতো জানা থাকে তখন অন্যদেরকে বুঝতেও অনেক সহজ হয়। ভাল-মন্দ, দোষ-গুণের
সমন্বয়ে প্রতিটি মানুষ। তারাই অন্যের দোষগুলোকে সহজে ক্ষমা করতে পারে, যারা জানে সে
নিজেও দোষের উর্দ্ধে নয়। নিজেকে বিশ্লেষণ করতে জানলে কে কি করেছিল বা কেন করেছিল
সেটা বোঝাটাও অনেক সহজ হয়ে যায়। তুমি যখন তোমার আচরণের পেছনে চিন্তার সূত্র ধরতে
পারবে, আবেগের রঙ বদলের খেলার সাথে পরিচিত থাকবে। তখন তোমার নিজেকে চিনতে সুবিধে
হবে, নিজেকে হ্যান্ডেল করাটা সহজ হবে। তেমনি অন্যদেরকে বুঝতেও
সুবিধে হবে। জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায় যদি সমস্যার পেছনের ‘কারণ’ জানা থাকে এবং
সেই সম্পর্কীত ‘কেন’র জবাব জানা থাকে। এই দুটার কম্বিনেশন তোমাকে তোমার অজানতেই একটা আশাবাদী ও
ইতিবাচক চরিত্রের মানুষের রুপান্তরিত করবে। যতটা হবার চিন্তাও হয়তো তোমার কাছে
অসম্ভব।
ফাতিমা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আমি বুঝতে পারছি ম্যাম। নিজের
সম্পর্কে ঠিকমতো জানা নেই বলেই আমি মানুষের এত সমালোচনা করি, এত দোষ ধরি।
একটুতেই হতাশ হয়ে যাই মানুষের ব্যাপারে। ইনশাআল্লাহ এই মূহুর্ত থেকেই নিজেকে জানার চেষ্টা অভিযান শুরু আমার।
নূহা হেসে বলল, এখন তাহলে চলো ভেতরে গিয়ে দেখি ফ্রাইড রাইসের কি
অবস্থা করেছে সাবিরা। একটু ভুল হলেই তো আবার ঠোঁট ফুলিয়ে বলবে আমাকে দিয়ে কিছুই
হবে না। আমি একটা অপদার্থ।
ফাতিমা হেসে বলল, জ্বি ম্যাম চলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন