দূর থেকেই ক্যান্টিনের দরজায় যয়নবকে দাঁড়িয়ে থাকতে
দেখলো নূহা। কাছে পৌঁছে প্রশ্ন করলো, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
যয়নব জবাবে বলল, ভেতরে ঢুকেছিলাম ম্যাম। কিন্তু জাওয়াদ স্যার, আদী স্যার
উনাদেরকে দেখে ভয়ে বেরিয়ে এসেছি।
নূহা হেসে ফেলে বলল, তাহলে অতি উত্তম কাজ করেছো। আচ্ছা চলো আমরা বাগানে
গিয়ে বসি। মন খুলে মনের কথা বলার জন্য প্রকৃতিই সান্নিধ্য অতুলনীয়। পেছনের পার্কে
চলে যাই চলো। লেকের পাড়ে বসে কথা বলার আনন্দই অন্যরকম।
কথা বলতে বলতে নূহা আর যয়নব লেকের পাড়ে পৌঁছে একটু
আড়াল দেখে পছন্দ মতো একটা জায়গায় বসলো। যয়নব হাসি মুখে বলল, প্রকৃতির
সান্নিধ্য মনে এমন প্রফুল্লতা ছড়িয়ে দেয় কেন ম্যাম? আমাদের মনটাও অনেকটা প্রকৃতির মতো বলেই কি? মাঝে মাঝে যখন
দমবন্ধ লাগে ছুটে ছাদে চলে যাই। কিছুক্ষণ পরই কেমন যেন শান্তি শান্তি অনুভূত হয়।
ভেতরটা হালকা লাগে। চিন্তার জট খুলতে শুরু করে।
নূহা হেসে বলল, প্রকৃতির সাথে মনের সংযোগ ও যোগাযোগ নিয়ে পরে
ইনশাআল্লাহ কখনো কথা বলবো। আগে চলো তোমার সমস্যা নিয়ে কথা বলি আমরা।
জ্বি ম্যাম। তবে মূল সমস্যায় যাবার আগে আমার মানসিক
একটা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাই। সেটা হচ্ছে, অলসতা। আজকাল খুব অলস হয়ে যাচ্ছি। শারীরিক ও মানসিক
উভয় দিক দিয়েই। কেমন যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছি দিন দিন। বিয়ের পর এই অবস্থা থাকলে তো
নির্ঘাৎ কথা শুনতে হবে শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাছে। শ্বাশুড়িকে দেখলে এখনই ভয় লাগে।
কেমন যেন গাম্ভীর্যে মোড়ানো চেহারা।
নূহা হেসে বলল, সবসময় কিন্তু মানুষকে ঘিরে আমাদের ধারণা ঠিক হয়না।
চেহারাও তেমনি খুব কম সময়ই ব্যক্তির মনের প্রতিচ্ছবি হয়। আমি যখন প্রথম
শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার বড় ননাসকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ঠিক তোমার
শ্বাশুড়ির মতোই গাম্ভীর্যে মোড়ানো চেহারা উনার। রাহাত যদিও বলেছিলেন, পরিবারের মধ্যে
আপা সবচেয়ে হাসিখুশি ও নরম মনের মানুষ। কিন্তু চেহারা দেখে আমার মোটেই তেমন
মনেহয়নি। কিন্তু আপার সাথে কথা হবার পরই বুঝেছিলাম রাহাতের কথাই সত্যি। এবং এখনো
পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের মধ্যে আপাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। তাই সবসময় চেহারা
দেখেই মানুষের সম্পর্কে ধারণা করা ঠিক না। আবার আমার বড় ভাসুরের কন্ঠ শুনলেই মনেহয়
এই বুঝি ধমক লাগিয়ে দেবেন। ভীষণ ভারী, গমগমে কন্ঠস্বর। কিন্তু ভাইয়াও অনেক ভালো একজন মানুষ।
তাই শুধুমাত্র ধারণার রঙে কখনোই অন্যের চিত্র আঁকতে নেই।
যয়নব হেসে বলল, জ্বি আচ্ছা ম্যাম। আর এমন উল্টা পাল্টা ধারণা করবো না
আন্দাজে। কিন্তু অলসতা থেকে মুক্তির উপায় বলে দেন আমাকে প্লিজ।
বলা হয়, যে রাজপথের শেষ প্রান্তে সফলতা দণ্ডায়মান থাকে তার
নাম হচ্ছে, উদ্যম। উদ্যমই মানুষকে কোন কিছুর পেছনে পুনঃপুনঃ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার
ক্ষেত্রে প্রেরণা যোগায়। আর ব্যর্থতার রাজপথ হচ্ছে, অলসতা। অলসতা এমন এক ব্যাধি যার পরিণতি চলাফেলার
ক্ষমতা থাকার পরেও অর্থবের মতো জীবনযাপন করা। নিজের ভেতরে প্রাণচঞ্চলতা অনুভব করার
জন্যও জীবনে উদ্যম ফিরিয়ে আনা উচিত। অলসতার দূর করে উদ্যম ফিরিয়ে আনার জন্য
সর্বপ্রথম দরকার দৃঢ় ইচ্ছে, যথাযথ পরিকল্পনা, লক্ষ্য অর্জনে প্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায়। সেজন্য সবার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে
সত্যিই অলসতা থেকে মুক্তি পেতে চাও কিনা। যদি চাও তাহলে এই মূহুর্ত থেকেই শুরু করে
দাও অলসতাকে জয় করার মিশন। সেজন্য তোমাকে বেশি বেশি কাজ করতে হবে। কাজ না থাকলে
খুঁজে বের করে কাজ করতে হবে। নিজের সব কাজ শেষ হয়ে গেলে অন্যের কাজ করতে হবে।
কাজের দ্বারা নিজেকে এমন ভাবে ঘিরে রাখতে হবে যাতে অলসতা সুযোগই না পায় কাছে
ঘেঁষার। এবং একই ভাবে মানসিক অলসতা দূর করার জন্য মনকে কাজ দিতে হবে। বই পড়া, পাজেল, সুডোকু ইত্যাদি
কাজে মন একই সাথে ব্যস্ত থাকে এবং আনন্দও পায়। নিজেকেও নিয়েও চিন্তা, গবেষণা করতে
পারো। এক কথায় মনকে ব্যস্ত রাখতে হবে কাজের দ্বারা। তবে এরও আগে আরেকটা কাজ করতে
হবে।
কি কাজ ম্যাম?
তুমি অলস এই চিন্তার সুইচটা বন্ধ করে দিতে হবে। শুধু
সুইচই না কোন ভাবে যাতে এই চিন্তা ইলেক্ট্রিক কানেকশন না পায় সেই ব্যবস্থা করতে
হবে। দরকার হলে এই চিন্তার ফিউজ উড়িয়ে দিতে হবে। নিশ্চয়ই জানো, ইচ্ছে একটা
মারাত্মক শক্তিধর আবেগ। ইচ্ছের হাতে বন্দী আমাদের মন। ইচ্ছের হাতের খেলার পুতুল।
তাই বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের মতো অলসতা দূর করার ইচ্ছেটাকেই জাগাতে হবে তোমার
সর্বপ্রথম। তুমি অলস কারণ কি?
কারণ কোনকিছু করতে ইচ্ছে করে না। তাই ইচ্ছের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে
তোমাকে। সুন্দর ইচ্ছে থেকেই কিন্তু সুন্দরের পথে চলার শুরু। অলসতা দূর করে উদ্যমী
হবার ইচ্ছেটাকে তাই আঁকড়ে ধরতে হবে মনপ্রাণে। তাই আজ, এই মূহুর্ত থেকে
তুমি উদ্যমী এমন ভাবার চেষ্টা করো। এবং ছোট ছোট কাজের দ্বারা মনের মধ্যে উদ্যম
ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করো।
ইনশাআল্লাহ এখন থেকে, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আমি উদ্যমী। আমি জানিই না অলসতা
কি? অলসতা বলে যে একটা শব্দ আছে সেটাই তো জানা নেই আমার। আমি কোনদিন অলসতার
নামও শুনিনি। বলতে বলতে হেসে ফেললো যয়নব।
নূহাও হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এভাবে চিন্তা করতে পারলে জীবনের
সমস্যাগুলোকে সত্যিই খুব সহজ মনেহয়।
জ্বি ম্যাম। কিন্তু সবসময় চাইলেও কেন জানি ইতিবাচক
চিন্তা করতে পারিনা। এই যেমন বিয়ের সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে পারছি না। আমি আর রিয়াদ সবকিছু
শরীয়তের বিধান মতো করতে চাইছি। এটাই যেন বিশাল বড় অপরাধ হয়ে গিয়েছে। অথচ এমনটা কি
হওয়া উচিত? মানুষ নিজের খেয়াল খুশি মতো কিছু করতে চাইলেই না বাঁধা দেবার, আপত্তি করার
প্রশ্ন উঠার কথা। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক কিছু করতে চাইলে তো সবার মুখেই
হাসি থাকার কথা ছিল। আপনাকে তো বলেছি ম্যাম রিয়াদ মাত্র কয়েক মাস হলো স্টাডি
কমপ্লিট করে জবে ঢুকেছে। অথচ আমাদের পরিবার থেকে মোহরানার জন্য এমন এমাউন্ট ধার্য
করা হয়েছে, যা কোন মতেই রিয়াদের পক্ষে আদায় করা সম্ভব নয়। এটা নিয়ে গত তিন-চার দিন ধরে
সমস্যা চলছে। রিয়াদের যুক্তি হচ্ছে,
মোহরানা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্দেশিত অপরিহার্য হক স্বামীর পক্ষ থেকে
স্ত্রী প্রতি। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আর স্ত্রীদের তাদের মোহর বা মোহরানা দিয়ে দাও
সন্তুষ্টচিত্তে’। অর্থাৎ, মোহরানা আল্লাহর হুকুম। কোন সামাজিক রীতি-নীতি বা প্রচলন নয়। এবং
সামর্থ্যের মধ্যে মোহরানা নির্ধারণ করা রাসূল (সঃ) এর সুন্নাত। স্ট্যাটাস বা লোক
দেখানোর মানসিকতা থেকে সামর্থ্যের বাইরে মোহরানা ধার্য করা এবং সেটা পরিশাধ না করা
শুধু যে প্রতারণা তাই নয়, সুস্পষ্ট গোনাহ। যেখানে রাসূল (সঃ) বলে দিয়েছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো
মেয়েকে মোহরানা দেয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে, কিন্তু মোহরানা আদায় করার ইচ্ছা তার নেই, সে কিয়ামতের দিন
আল্লাহর সামনে ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে’। রাসূল (সঃ) আরো বলেছেন, ‘পাঁচ ব্যক্তির
ওপর আল্লাহর ক্রোধ অবশ্যম্ভাবী। তিনি ইচ্ছা করলে দুনিয়াতেই তাদের ওপর তা কার্যকর
করবেন কিংবা আখেরাতে। আলোচ্য পাঁচজনের মাঝে এক ব্যক্তি হচ্ছে-যে ব্যক্তি স্বীয়
স্ত্রীকে মোহরানা থেকে বঞ্চিত করে ও তার ওপর অত্যাচার চালায়’। সুতরাং, জেনে বুঝে
আল্লাহর ক্রোধের সম্মুখীন হতে নারাজ রিয়াদ। আমিও ওর সাথে একমত। আমিও চাই যে পরিমাণ
মোহরানা আদায় করার সামর্থ্য রিয়াদের আছে ততটুকুই ধার্য করা হোক।
তোমাদের উভয়ের ইচ্ছের কথা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করোনি
পরিবারের সদস্যদেরকে?
অনেক চেষ্টা করেছি ম্যাম। কিন্তু কেউ না বুঝতে চাইলে
কি বোঝানো সম্ভব বলেন? তাছাড়া তারা কেউই তো অবুঝ নন। আমার বড় বোনের হাজবেন্ড এর খুব প্রভাব
পরিবারের উপর। আমি উনার সাথেও ফোনে কথা বলেছি। উনাকে আমি যথেষ্ট জ্ঞানী ও বিচক্ষণ
ব্যক্তি মনে করতাম। কিন্তু উনি আমাকে বললেন, কুরআনে তো বলে দেয়াই আছে, “ এবং তোমরা
নারীদেরকে খুশিমনে তাদের মোহর দাও। এরপর তারা যদি স্বেচ্ছায় স্বাগ্রহে ছেড়ে দেয়
কিছু অংশ তোমাদের জন্য তাহলে তা স্বচ্ছন্দে ভোগ কর”। সুতরাং, এত অস্থির হচ্ছো কেন? বিয়ের পর তুমি মোহরানার দাবী স্বাগ্রহে ছেড়ে দিলেই তো
হয়ে যাবে। চিন্তা করেন কি অদ্ভুত মানসিকতা? যদি ছেড়েই দিতে হবে তাহলে সামর্থ্যের বাইরে মোহরানা
ধার্য করারই বা কি দরকার? আমার বোন বললো আরো অদ্ভুত কথা। মোহরানা নাকি এক ধরণের নিশ্চয়তা। কিসের
নিশ্চয়তা ম্যাম? যেখানে মানুষের জীবনের এক মূহুর্তের কোন নিশ্চয়তা নেই।
নূহা হেসে বলল, জীবনের এক মূহুর্তের কোন নিশ্চয়তা নেই এই কথাটা যদি
আমাদের স্মরণে থাকতো তাহলে তো জগতে কোন সমস্যাই থাকতো না। সকল মানুষ নিজ নিজ কর্ম
ভান্ডার সমৃদ্ধ করাতে মশগুল থাকতো। এই কথাটা মনে থাকে না বলেই তো শত অন্যায়ের
মাধ্যমেও ভবিষ্যতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেই সাধনায় নিমগ্ন
থাকে মানুষ। যাইহোক, শরীয়তের বিধিবিধান সমূহকে আমরা প্রথা বা সামাজিক রীতি-নীতিতে পরিণত করেছি।
শরীয়ত থেকে শুধু খোলসটা তুলে নিয়ে ভেতরে সবকিছু নিজেদের মন, মরজি মতো
ঢুকিয়েছি। তাতে বাইরে থেকে মনেহয় হয় যে, শরীয়তের বিধান পালন করা হচ্ছে। কিন্তু মূলত পালিত হয়
মানুষের বানানো রীতি-নীতি। মোহরানাকে ঘিরেও আমাদের সমাজে নানা ধরনের প্রথা প্রচলিত
রয়েছে। যেসবের প্রভাবে প্রাণ হারিয়েছে মোহরানার মূল উদ্দেশ্যে। মোহরানা মূলত
একধরণের সম্মানী যা স্ত্রীকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে স্বামী
আদায় করে থাকেন। শরীয়তের এমন বিধানের উদ্দেশ্য নারীদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা। অনেকটা নতুন
জীবনের প্রবেশদ্বারে স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর জন্য উপহারের মতো। আর উপহার তো
আসলে নিজ ক্ষমতার মধ্যেই দেয়া উচিত। এবং যাকে উপহার দেয়া হচ্ছে, তার সম্মানের
দিকে খেয়াল রাখাটাও জরুরি। কাউকে এমন উপহার দেয়া উচিত নয় যাতে তার সম্মানহানী হতে
পারে। আবার কারো সামনে দাঁড়িয়ে বলা যে, তোমার জন্য বিশাল বড় একটা উপহার আছে। কিন্তু এই
মূহুর্তে দেয়া সম্ভব নয়। পরে কখনো দেবো। এমন বলাটাও হাস্যকর। শরীয়তের বিধানেও
মোহরানা এমন ভাবে ধার্য করতে বলা হয়েছে, যা এতটাই অল্পও হবে না যাতে মর্যাদার
কোনো ইঙ্গিত থাকবে না। আবার এতটা বেশিও হবে না, যা পরিশোধ করার সামর্থ্য স্বামীর নেই।
আমি আর রিয়াদ মিলে এই কথাটাই বার বার বোঝানোর চেষ্টা
করছি। অদ্ভুত হচ্ছে, রিয়াদের পরিবারের সদস্যরাও অস্বাভাবিক মোহরানা নির্ধারণকে সাপোর্ট করছে।
রিয়াদের বড় ভাই নাকি ওকে বলেছে,
এখন তোমার সেলারি কম। কিন্তু পরে তো বাড়বেই। তখন আদায় করে দেবে। সাথে সাথেই
পুরো মোহরানা আদায় করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। এখন একাংশ দিলেই হবে। রিয়াদ বলছে, যেটুকু আমার
সামর্থ্য আছে সেটুকুর মধ্যে মোহরানা ধার্য করলে আমাকে অকারণে ঋণের বোঝা মাথায়
তুলতে হবে না। এটাও তো একটা ঋণের মতোই। পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই এমন ঋণ বোঝা আমি
কেন তুলতে যাবো? আমার ফিনানশিয়াল অবস্থা উন্নতই হবে এর কি নিশ্চয়তা আছে? আমার অবস্থার আরো
অবনতি হবে না এই নিশ্চয়তাই বা কে দেবে? তাহলে কেন আমি জেনে বুঝে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য
বিশাল অংকের মোহরানা নির্ধারণ করে গোনাহগার বান্দা হবো? কিন্তু তবুও কেউ
পাত্তা দিচ্ছে না আমাদের কথা।
আসলে কি জানো? আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষই মোহরানার গুরুত্ব
সম্পর্কে জানেই না। এক বোনকে বলতে শুনেছিলাম, মোহরানা নিলে নাকি স্বামীর প্রতি দাবী কমে যায়। তাই
তিনি স্বামী দিতে চাইবার পরও নিজের মোহরানা নেননি। কারণ মোহরানার দ্বারাই নাকি স্বামী
আবদ্ধ থাকে স্ত্রীর কাছে। এমন ধারণা পোষণ করেন মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম না
একেবারে।
আর আরেক গ্রুপের কাছে মোহরানা মানে শুধুই প্রদর্শনী।
বিশাল অংকের মোহরানা ধার্য করা হয়েছে এটাও এখন গর্বের বিষয়। দুঃখ হচ্ছে আমাদের
মুরুব্বিরা এতোটাই গোঁ ধরা স্বভাবের এসব ক্ষেত্রে যে, চাইলেও আমরা
বেরিয়ে আসতে পারি না এই ভুলের বেড়াজাল থেকে!
হুমম, মূল সমস্যা তো মুরুব্বিরাই। এক পরিচিত আংকেলকে মেয়ের
বিয়েতে অনেক টাকা মোহরানার ব্যাপারে বোঝাতে গেলে উনি জবাবে বলেছিলেন, মোহরানা দেবার
ভয়ে কখনোই মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না জামাই। কারণ ডিভোর্স হলে মোহরানা আদায়
করতে বাধ্য থাকবে। আমি এত বেশি অবাক হয়েছিলাম সেদিন। বিয়ের আগেই ডিভোর্সের পরের
ব্যবস্থা নিশ্চিত করে রাখতে চাইছে এখন মানুষ। দাম্পত্য সম্পর্ক কি তাহলে ভালোবাসার
বদলে ভয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে? অর্থ প্রদানের ভয়ে একে অন্যের সাথে উত্তম ব্যবহার
করবে? এসব চিন্তা করতে গেলে মনেহয়, এত ক্ষুদ্র ভাবনার দ্বারা ম্লান না করি আমার
মনোজগতকে।
আমারও ঠিক তাই মনেহয় ম্যাম। কিন্তু এখন তো চিন্তা না
করে উপায় নেই। কি করবো একটা বুদ্ধি দিন প্লিজ।
আসলে শরীয়তের বিধান সমূহ সামাজিক প্রচলন হয়ে গিয়েছে।
আর প্রচলিত ধারার বাইরে যেতে চাইলে বাঁধা আসবে সেটাই স্বাভাবিক। তোমরা যেহেতু সঠিক
তাই নীতিতে ও সিদ্ধান্তে অটল থাকো। এবং উভয় পরিবারের সদস্যদের বোঝাতে চেষ্টা করো।
বোঝানোর সময় কখনোই রাগ করবে না। যতটা সুন্দর করে বলা সম্ভব বলবে। এবং শরীয়তের
আলোকে বলবে।
উনারা সবারই শরীয়তের বিধান জানেন ম্যাম। কুরআন ও
হাদীসে কি বলা হয়েছে তাও জানেন। তবুও কেন এমন মানসিকতা উনাদের সত্যিই বোধগম্য হয়
না। যদি অজ্ঞ হতেন, কিছুই না জানতেন তাহলে একটা কথা ছিল।
একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে আমাদের সমাজের বেশির
ভাগ ভুল প্রথা গুলোই যারা শরীয়তের বিধান জানেন এবং আংশিক বা নিজের সুবিধানুযায়ী
মানেন তাদের দ্বারাই মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। এবং তাদের কাঁধে ভর
করেই টিকে আছে। তাই মনখারাপ বা হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাও।
কিন্তু শেষপর্যন্তও যদি উনারা না মানেন?
নূহা হেসে বলল, মনেআছে বেশ কিছুদিন আগে ক্লাসে তোমাদেরকে বাঁশ গাছের
একটা গল্প বলেছিলাম। আচ্ছা আজ আবারো শোনো গল্পটা। চীনে এক ধরণের বাঁশ গাছ আছে
যাদের লাগানোর পর প্রথম চার বছর নিয়মিত পানি, সার দিতে হয়। যদিও এই চার বছরে বাঁশ গাছটি বাড়ে না।
কিন্তু পঞ্চম বছরে বাঁশ গাছটি হঠাৎ ছয় সপ্তাহে ৯০ ফুট লম্বা হয়ে যায়। এর অর্থ কি
দাঁড়ায়? এমনটাই যে, যদিও বাইরে থেকে কোন পরিবর্তনই পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু বাঁশ গাছটি ঠিকই
পাঁচ বছর ধরে একটু একটু করে শক্তি সঞ্চার করেছে বেড়ে উঠার জন্য। এখন যদি বাইরে
থেকে বাড়তে না দেখার কারণে পানি ও সার দেয়া বন্ধ করে দেয়া হতো তাহলে ব্যাপারটা কি
দাঁড়াতো? অবশ্যই গাছটি মারা যেত। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর যাবত প্রয়োজনীয় যত্ন নেয়া
হয়েছিল বলেই যথা সময়ে গাছটির বেড়ে উঠা সম্ভব হয়েছিল। ঠিক তেমনি আমরা অনেক সময়
মানুষকে সত্যের পথে দাওয়াত দিতে গিয়ে একটুতেই হাল ছেড়ে দেই। তাৎক্ষনিক পরিবর্তন না
দেখার কারণে ভেবে নেই যে, পরিবর্তন অসম্ভব। অথচ এটা কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ অজানা যে, কখন কাকে আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন তাঁর রাহমা'র চাদরে জড়িয়ে নেবেন। তার উপর হেদায়াত নাজিল হবে এবং সে সত্য ও সুন্দরের
পথিকে পরিণত হবে। তাই মানুষের পরিবর্তনের ব্যাপারে কখনোই আশা ছেড়ে দেয়া উচিত নয়।
আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। আসলে বেশির ভাগ সময়ই
যদিও অভ্যন্তরে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগে যায় শুরুতেই। কিন্তু সেই পরিবর্তন দৃশ্যত
হতে বেশ অনেকটা সময় লেগে যায়। তাই হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। উনারা
ঘুমের ভাণ ধরে যতক্ষণ জাগ্রত হওয়া থেকে বিরত থাকবেন, আমাদেরকেও ততক্ষণ ডাক জারি রাখতে হবে। যাতে অতিষ্ট
হয়ে আমাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যই উঠে বসে আরেকদিকে পালিয়ে যাবেন উনারা।
যয়নব হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ ম্যাম তাই করবো আমরা। আপনার কথা শুনে
সত্যিই মনের জোর ফিরে পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
নূহাও হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে চলো এখন আমরা উঠি। পরে
ইনশাআল্লাহ আবার কথা বলবো। আর তোমার প্রয়োজন হলে ফোন তো আছেই।
জ্বি ম্যাম ইনশাআল্লাহ যখনই দুর্বল হতে চাইবে মন ফোন
দেবো ইনশাআল্লাহ।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর যয়নবকে বিদায় দিয়ে সেলফোন
বের করলো নূহা। যয়নবের সাথে কথা বলার সময়ই ম্যাসেজের শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ম্যাসেজ
ওপেন করতেই চোখের সামনে উন্মুক্ত হলো, “তোমার আকাশে সাজিয়ে দেবো সাত রঙয়ের ইন্দ্রধনু, বর্ণিল আলো ছড়াবে
তুমি বিকশিত হবে ফুলের রেণু! তোমার আঙিনার মেঘমালাদের ঝড়িয়ে দেবো বৃষ্টি হয়ে, আঁখিদ্বয়য়ের
স্বপ্ন কুড়িয়ে বাগিচা গড়বো তোমার নিয়ে! বেদনার ধূসর গোধূলি তুলির ছোঁয়ায় করে দেবো
সুর্যোদয়, তাকিয়ো না বিস্ময়ে ভালোবাসার মৃত্তিকাতে এ যে কুটির স্বপ্নময়! তোমাকে ঘিরেই
আবর্তিত মোর অনাদিকালের যত চাওয়া-পাওয়া, বিষাদ ক্লান্ত অন্তরান্তে তব প্রতীক্ষায় চঞ্চল মোর
হিয়া!” এমন ভালোবাসায় সুতোয় বোনা আকুলতা জড়ানো শব্দমালা এসে বসে আছে তার দুয়ারে
ধারণাই ছিলো না নূহা! মুগ্ধতা ও ভালোবাসার আবেশে মন ভরে গেলো! কিছুক্ষণের জন্য
রুদ্ধ করে দিলো আঁখির দুয়ার! চায় না ঝরে যাক এই আনন্দাশ্রুর একটি বিন্দুও! মনের
মধ্যে জমা করে রাখতে চায় এই শ্রাবণধারাকে। কখনো যদি অমোঘ নিয়তি আবারো খরার তপ্তদাহ
নিয়ে হাজির হয় তার জীবনে। এখান থেকেই কিছু জল তুলে সেচ দিয়ে যাবে মনভূমিতে।
ব্যবসার কাজে প্রায়ই শহরের বাইরে যেতে হয় রাহাতকে।
প্রতিবারই ফিরে আসে এমন একটি প্রেমময় বার্তা নিয়ে। নিশ্চয়ই বাসায় তার অপেক্ষাতে
বসে আছে রাহাত। যত দ্রুত পারলো নিজের সবকিছু গুছিয়ে রেখে পার্কিং লটের দিকে ছুটলো
নূহা। বাইরে থেকে ফিরে খালি বাসা দেখলে খুবই মন খারাপ হয় রাহাতের। পার্কিংয়ে পৌঁছে সাবিরা আর ফাতিমাকে তার
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো নূহা। পরমূহুর্তেই মনে পড়লো যে ওদের
দুজনকে আজ বাসায় দাওয়াত দিয়েছে সে। কথা ছিলো দু’জন আজ রান্না শিখবে নূহার কাছে। তারপর সারারাত গল্প
করবে সবাই মিলে।
আজই রাহাত ফিরে আসবে সেটা জানা ছিলো না। এখন কিভাবে প্ল্যান ক্যান্সেল এই
কথা বলবে ওদেরকে? নিশ্চয়ই মনখারাপ করবে কিছুটা হলেও! কিন্তু ঐদিকে রাহাতও নিশ্চয়ই তার সাথে
সময় কাটানোর জন্য বসে আছেন! হায় আল্লাহ! এমন উভয় সংকটের মুহুর্তগুলো কেন আসে
মানুষের জীবনে? ‘একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে এই নদীর খেলা! একজনকে খুশি করতে গেলে অন্যজন কষ্ট পায়
এই তো মনের জ্বালা।’ ভেতর থেকে উঠে আসা ‘কি চাইলাম আর কি হইলো’
টাইপের হাসিটাকে গিলে ফেললো নূহা। বত্রিশ পাটি বের করে ফুটে থাকা ছোট ছোট
ফুল দুটিকে ঝরিয়ে দিতে মন সায় দিলো না একদমই। নূহা কাছে আসতেই দুজন আরো কিছুটা
বিকশিত হয়ে সালাম দিল।
সালামের জবাব দিয়ে নূহা বলল, আমি
সাইকিয়াট্রিস্ট, ডেন্টিস্ট না। দাঁত বন্ধ করে গাড়িতে উঠো চুপচাপ দুজন।
মেয়ে দুটার রিমঝিম হাসির শব্দে নূহার মনে যে সামান্য দ্বিধার মেঘ ভাসছিলো
তা বহুদূরে সরে গেলো। ম্যাসেজের জবাবে রাহাতকে লিখলো, “তারাদের ছাড়িয়েও
আছে অনেক ভুবন, প্রতীক্ষার হবে শেষ দেখো না এমন স্বপন......
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন