সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২৯




রিহ্যাভ সেন্টারের হলরুমে ঢুকে জিহাদকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলেও হাসি মুখে সালাম দিলো জাওয়াদ সালামের জবাব দিয়ে জিহাদ বলল, পাপা আন্টিরা সবাই এসে গিয়েছেন উনাদেরকে পাশের রুমে বসতে বলেছি আংকেলদেরকে কি এখন ভেতরে আসতে বলবো? উনারা সবাই বাইরে অপেক্ষা করছেন

জাওয়াদ বলল, আরেকটু পরে বলো। এখনো দশমিনিট সময় আছে। কিন্তু তুমি এখানে কেন? নাস্তা করতে যাওনি?

ক্ষুধা নেই আমার। তাই আংকেল-আন্টিদের পাঠানো প্রশ্নগুলো একসাথ করেছিলাম। পাপা আমি কমন প্রশ্নগুলো একসাথ করে সিরিয়াল করে দিয়েছি। তোমাকে আর সব প্রশ্ন পড়তে হবে না।

ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জাওয়াদ বলল, জাযাকাল্লাহ। তুমি এত বেশি বেশি গুড বয় কিভাবে হলে বলো তো?

জিহাদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি যে আমার মা ছেলে সেজন্য

শুধু মা ছেলে সেজন্য? পাপা কিছুই না?

পাপা অনেক কিছু। কিন্তু মা চেয়ে থ্রি টাইম পেছনে।

জিহাদের কান ধরে টেনে দিয়ে জাওয়াদ হেসে বলল, আসলেই তুমি তোমার মা ছেলে। তোমার এই অতি শান্ত-ভদ্র চেহারার আড়ালে যে কত দুষ্টু চেহারা লুকায়িত সেটা বোঝার কোন উপায়ই নেই। স্বভাবে তুমি হুবহু তোমার মায়ের ফটোকপি।

আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু চেহারার আমি হুবহু আমার পাপার ফটোকপি। সেদিন কি হয়েছে জানো পাপা? আমি তোমার ছোটবেলার একটা ছবির সাথে আমার একটা ছবি অ্যাড করে দাদাভাই আর দাদুমণিকে দেখিয়েছিলাম। দুজনই আমাকে তুমি আর তোমাকে আমি বলে ভুল করেছে। এরপর মাকে দেখালাম। মা বললো, ডান পাশের এই গোল্লু মোল্লু সুইট বেবীটা আমার। দেখলেই ইচ্ছে করে ছবি থেকে বের করে এনে একটা আদর দিতে। আর বাম পাশের মুখ ভোঁতা, কাঠখোট্টা, নিমপাতা টাইপ বেবীটা আমার বড় খালামণির। দেখলেই মনেহয় ভীনগ্রহ থেকে আসা কোন এলিয়েন। কথাগুলো বলতে গিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো জিহাদ।

জাওয়াদও হেসে ফেললো। যতটা না কথা শুনে তারচেয়ে বেশি ছেলের হাসি দেখে। ছোটবেলা থেকেই খুব বেশি চুপচাপ স্বভাবের জিহাদ। ভাইবোনেরা যখন দুষ্টুমি, হৈচৈ করে জিহাদ হাসি মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। যখন কোন কাজের প্রসঙ্গ আসে ভাইবোনদেরকে পেছনে ঠেলে দিয়ে নিজে এগিয়ে আসে। যখন প্রাপ্তির সময় আসে তখন আবার সবাইকে সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজে পেছনে সরে দাঁড়ায়। এই স্বভাবের কারণেই হয়তো জাওয়াদ-নূহা দুজনেরই অন্তরের সবচেয়ে কাছের জিহাদ।

নিজেকে সামলে নিয়ে জিহাদ বলল, পাপা প্রশ্ন সিরিয়াল করতে যেয়ে দেখলাম প্রায় সবাই একই রকম প্রশ্ন করেছে। পনেরো জন আন্টি আর বারোজন আংকেল। মোট সাতাশ জন কিন্তু প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুটা। এক. সবাই আলোকিত মানুষ হতে চায়, অনেক জ্ঞানার্জন করতে চায়, সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে, একজন মানুষের তরে হলেও রাহবার হতে চায়। কিন্তু কিছুতেই উৎসাহ ধরে রাখতে পারে না। সময়কে যথাযথ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। এমনকি ইবাদতে আগ্রহ কমে যায়। আমলেও ক্ষেত্রেও গড়িমসি, অলসতা করে। দুই. সবার মধ্যেই কম বেশি বিয়ে ভীতি। কিন্তু কেউই বিয়ে করতে চায় না। সবাই মনে করে বিয়ে মানেই জীবনের সুখ-শান্তি সব শেষ। পাপা সবাই কেন এমনটা মনে করে?

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, তোমার কি ধারণা? প্রথম প্রশ্নের আলোকে তোমার ধারণা আগে শুনতে চাইছি। এরপর আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো ইনশাআল্লাহ

নানাভাই আমাদের একদিন বলেছিলেন, মানুষের জীবনে যত ধরণের সমস্যা আসে। সেইসব সমস্যার মূল কারণ শুধুমাত্র একটা। জীবনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক থাকে না বলেই সমস্যার গোলকধাঁধাতে মানুষ ঘুরপাক খায়। কিন্তু যখনই কারো জীবনের লক্ষ্যটা একবার ঠিক হয়ে যায়। সে মূহুর্তে লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে সমস্যার চোরাবালি থেকে।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। যে কোন সমস্যার সমাধানের জাদুর ছড়ি মনেহয় তোমার নানাভাইকে আমার। ছোটবেলা থেকেই আমরা যখনই কোন সমস্যার মুখোমুখী হতাম তোমার নানাভাইর কাছে ছুটে যেতাম। বাবা প্রথমে আমাদেরকে সমস্যাতে ফোকাস করতে বলতেন। বলতেন, খুঁজে দেখো সমস্যাটার মূল উৎস কোথায়? এরপর ভেবে দেখো কেন সমস্যাটা তোমাদের জীবনে এসেছে? সমস্যার পেছনে তোমাদের ভূমিকা কতটুকু? ভূমিকাটুকু না থাকলে কি সমস্যাটা আসতো না বলে মনেহয়? তাহলে সময় ঠিক কেমন হওয়া উচিত ছিল তোমাদের অ্যাক্টিভিটি? কি কারণে তোমরা সময় সঠিক কাজ না করে বেঠিক কাজ করেছিলে? কি তোমাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল? সময় কি একবারের জন্য মনে হয়েছিল তোমরা ভুল পথে চলছো? যদি মনে হয়ে থাকে তাহলে কি সরে যাবার চিন্তা করেছিলে একবারও? যদি এমন চিন্তার উদ্রেক হবার পরেও ভুলের পথে চলা অব্যহত রেখেছিলে, এরঅর্থ তোমাদের বিবেক, ইচ্ছাশক্তি প্রবৃত্তির বশে। শয়তানের ওয়াসওয়াসায় ভেসে যাবার জন্য তোমরা সদা প্রস্তুত। আর যদি এমন উপলব্ধিই না হয়ে থাকে, তারমানে তোমাদের বিবেক মৃত। স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতাও তোমাদের নেই। শয়তান আর প্রবৃত্তির হাতের পুতুল তোমরা। এভাবে করে বাবা সব সমস্যার কারণ হিসেবে আমাদের সামনে প্রবৃত্তি আর শয়তানের ওয়াসওয়াসাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিতেন। ধীরে ধীরে একটা সময় সমস্যার আগমনে বাবার কাছে ছুটে যাবার আগে আমরা ভাইয়েরা মিলেই চিন্তা গবেষণা শুরু করে দিতাম। এবং কারণ হিসেবে প্রবৃত্তি শয়তানের ওয়াসওয়াসাকেই খুঁজে বের করে, তার সাথে লড়ার চেষ্টা করতাম। এরপর আমরা নিজেরা ব্যক্তিগত ভাবে সমস্যার কারণ খুঁজে বের করাটাও শিখে নিয়েছিলাম।

জিহাদ হেসে বলল, নানাভাই অনেক জ্ঞানী তাই না পাপা?

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, হুম, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আমার জীবনে জীবনের সর্বাবস্থায়, সর্বক্ষেত্রে এমন বিশুদ্ধ চিন্তার মানুষ খুব কম পেয়েছি। বাবা অসাধারণ একজন মানুষ। জ্ঞানার্জন কেন করবো? এর পেছনে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণ বাবা আমাদেরকে দিয়েছিলেন। বাপী আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন, আলোকিত মানুষ হবার জন্য তোমাকে জ্ঞানার্জন করতে হবে। বাবা বলেছিলেন, নিজের অন্ধকার দিক উন্মোচিত করার জন্য তোমাদেরকে জ্ঞানার্জন করতে হবে। পাপা বলতেন, একজন মানুষের তরেও যদি সত্য সুন্দরের রাহবার হতে পারো, এটাই জীবনের পরম প্রাপ্তি। বাবা বলেছিলেন, জ্ঞানের বিবেচনায় যাতে উপলব্ধি করতে পারো, প্রবৃত্তি শয়তানের ওয়াসওয়াসার বশবর্তী হয়েই মানুষ ভুল করে, অন্যায় করে। এবং তাকে যদি সতিকার অর্থে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়ে সেকেন্ড চান্স দিতে পারো, সেটাই জীবনের প্রাপ্তি। আব্দুল্লাহ চাচাজান বলতেন, জীবনকে ঐশ্বর্যময় করতে চাইলে জ্ঞানার্জন করো। আর বাবা বলতেন, জ্ঞানের আলোতে মনের অন্ধকার কোণ গুলোতে দিয়া জ্বালো। আমাদের মাদ্রাসার উস্তাদ বলতেন, জান্নাতের পানে ছুটে চলো উর্দ্ধশ্বাসে। আর বাবা বলতেন, চলার পথের প্রতিটা বাঁকে একবার করে অবশ্যই থামবে। কেউ তোমাদের সাহায্যের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই সেটা নিশ্চিত হয়েই সামনে এগোবে। যখন কোন গর্ত দেখবে ভেতর উঁকি দিতে ভুলে যেও না। কেউ হয়তো হাত উঁচু করে প্রতীক্ষামান তোমার অপেক্ষাতেই। খাঁদা-খন্দ দেখে লাফিয়ে পেরিয়ে যেও না কখনোই। তোমাদের পেছনে যারা আসছে তাদের হয়তো জানা নেই কিভাবে লাফিয়ে পাড় হতে হয়। তাই আশপাশ থেকে খড়কুটো, লতা-পাতা যাই পাবে ভরাট করে দিয়েই সামনে কদম রেখো। সম্মুখ পানে এগিয়ে যাবার পথে কিছু দূর বিরতি দিয়ে পেছন ফিরে দেখে নিতে ভুলে যেও না। পেছনে কেউ হয়তো হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েছে, কেউ হয়তো ক্লান্তির কারণে পথ চলতে পারছে না, কারো হয়তো আবারো উঠে দাঁড়ানোর জন্য এক ঢোক পানির প্রয়োজন, এক মুঠো খাদ্য প্রয়োজন, কেউ না হয়তো শুধুমাত্র দুটা মিষ্টি কথার কাঙাল। তাদের সবাইকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্বও তোমাদেরই।

জিহাদ হেসে বলল, নানাভাই আমাদেরকেও এভাবেই বলেছেন পাপা।

তোমার নানাভাই ব্যক্তি মানুষটাই এরকম। তাই এভাবেই ভাবেন, বলেন এবং করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। একবার কিছু সমস্যার কারণে তোমাদের হুমায়ূন চাচ্চু এরকম উদাসীন হয়ে গিয়েছিল জীবনের সব ব্যাপারে। তখনো মুখে মুখে বলতো বেরিয়ে আসতে চাই ব্যর্থতা থেকে, জ্ঞানার্জন করতে চাই, জীবনকে গড়তে চাই। কিন্তু কথাকে কিছুতেই কাজে রূপান্তরিত করতে পারতো না। বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে বসেছিলেন। এরপর বলেছিলেন, একজন উত্তম মানুষ সেই যে নিজের ভালো মন্দ উভয় দিককেই সমান স্বীকৃতি দিতে পারে। নিজের মন্দ গুণাবলী নিয়ে হতাশ হবার কিছুই নেই। মন্দ টুকুনকে ভালোতে রূপান্তরিত করাই তো তোমাদের কাজ। তবে মনে রেখো একবারেই সম্ভব হবে না নিজেকে জয় করা। নিজের সাথে যুদ্ধেই মানুষ সবচেয়ে বেশি পরাজিত হয়। তাই বার বার হয়তো ব্যর্থ হবে, হেরে যাবে নিজের মন্দ সত্ত্বার কাছে। কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দিও না কখনোই। কারণ এটি সার্বক্ষণিক যুদ্ধ। ব্যর্থ হলে তাই পিছিয়ে যেও না। কারণ সফলতা অর্জনে সবচেয়ে জরুরি ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া। ব্যর্থতা মানে সমাপ্তি নয় কখনোই। ব্যর্থতা মানে চিন্তায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন। নিজেকে যাচাইয়ের সুযোগ, নিজেকে সংশোধনের সুযোগ, ভিন্ন পথে চলে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ। তাই মনে রাখবে প্রতিটা ব্যর্থতা হচ্ছে সফলতা অর্জনের পথে স্পীড ব্রেকার। ব্যর্থতা ভুলের কারনে আসে না, ব্যর্থতা আসে ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য। এবং চলার পথের গন্তব্যটাকে আরেকবার ভালো ভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেবার জন্য। জানো তোমাদের নানাভাই আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে মেনে নেয়া। কোন মানুষই ভুলের উর্দ্ধে নয়। কারো পক্ষেই সর্বদা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। ন্যায় সত্যের পথে চলা মানে অন্যায় মিথ্যাকে ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে দেয়া নয়। তা না হলে বুঝবো কি করে আসলেই আমি হকের পথে আছি? আলো, আলো বলে আমাদের আর্তনাদ তো আঁধারের অবসানেই। যদি আঁধার না থাকতো তাহলে? আমার চিৎকার কি তখন আঁধারের তরে হতো না? উদাহরণ স্বরূপ সামার টাইমের কথা চিন্তা করো। দশটায় সময় মাগরীব হয়। সাড়ে দশটা বেজে যায় তাও সম্পূর্ণ আঁধারে ঢেকে যায় না প্রকৃতি। ঈশার ওয়াক্ত হয় রাত বারোটায়। আবার চার ঘন্টা পরেই ফজর এসে হাজির। প্রায় সময়ই মনেহয়, কতই না ভালো হতো রাতটা আরেকটু লম্বা হলে? কিংবা দিনটা আরেকটু ছোট হলেই বেশি ভালো হতো। এই যে বিপরীত কিছুর প্রতি আকর্ষণ কিংবা চাওয়া। মনে করা যে, বিপরীতটা হলেই ভালো হতো। এটা মানুষের স্বভাবজাত বলা যায়। তাই সংমিশ্রণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ভালো আছি বোঝার জন্যই পাশে মন্দের উপস্থিতি দরকার। আমার মাঝে অন্ধকার আছে বলেই তো আলোর প্রতি এত আকুলতা। যদি আলোয় আলোয় উদ্ভাসিতই হতাম তাহলে দুনিয়াতে আমার কাজটা কি?

জিহাদ বলল, রাইট পাপা। ম্লানতা ছাওয়া লক্ষ্যহীন মোদের হিয়া, আঁধারে ঢাকা বলেই জ্বালতে হবে দিয়া। পথ নয় সুগম, খাঁদা-খন্দে ভরা, দুর্গম পথে চলেও নিজেকে যায় গড়া।

জাওয়াদ হেসে বলল, মাশাআল্লাহ। তোমার সাথে কথা বলার সময় সত্যিই মনেহয় তোমার মা সাথে কথা বলছি।

জিহাদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু পাপা তুমি কি করে বোঝ কোন কথাগুলো আমার নিজের বলা আর কোনগুলো মা থেকে নেয়া?

তা তো ঠিক জানি না। ব্যাস বুঝে যাই কিভাবে যেন। আচ্ছা ওদেরকে মনেহয় এখন ডাকতে পারো।

ঠিকআছে পাপা এক্ষুণি ডাকছি। কিন্তু আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে

হ্যা বলো।

সবাই বিয়ে কে কেন এত ভয় পায় পাপা?

জাওয়াদ হেসে বলল, কারণ বিয়েকে ঘিরে বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদেরই কনসেপ্ট ঠিক ক্লিয়ার না। সবাই পারফেক্ট জীবনসাথী চায়। পারফেক্ট দাম্পত্য জীবন চায়। অথচ একবারও ভেবে দেখে না যে, সে কি একটা পারফেক্ট লাইফ কাটাচ্ছে বর্তমানে? সে কি একটি পারফেক্ট ফ্যামেলির সদস্য? পারফেক্ট সম্পর্ক বলে কি আদৌ কিছু আছে? নাকি জীবনসাথী বেছে নেবার সুযোগ আছে বলেই এত সব শর্ত, এতসব বাহানা? তোমাদের মা একদিন প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা যদি জীবনসাথীর মতো বাবা-মা কিংবা ফ্যামেলি সিলেকশনের সুযোগ থাকতো তাহলে মানুষ কি করতো? ভেবে দেখো ছোট ছোট শিশুরা ভ্রূ কুঁচকে, মাথা চুলকে নিজের জন্য বাবা-মা পছন্দ করছে। কিন্তু বাবা পছন্দ হচ্ছে তো মা পছন্দ হচ্ছে না। বাবার চেহারা দেখে সন্দেহ জাগছে, তার মনের স্বপ্নগুলো বুঝবে তো? মাকে কেমন যেন বেশিই সহজ সরল দেখাচ্ছে। মুখ ফুটে বলার আগেই তার মনের চাওয়াগুলো বুঝে নিয়ে পারবে তো? নিয়মিত ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, নিত্যনতুন খেলনা কিনে দেয়ার ক্ষমতা আছে তো? স্বাধীনতা খর্ব করবে নাতো আবার বাবা সেজে? মা ঠিকমতো আদর-যত্ন করবে তো? আবার দেখা গেলো বাবা-মা উভয়কে পছন্দ হলেও তাদের ফ্যামিলি হয়তো পছন্দ হচ্ছে না। কি অবস্থা হতো তাহলে? প্রশ্ন করে নিজেই হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে গিয়েছিল তোমার মা।

জিহাদও হাসতে হাসতে বলল, মা মাথায় এমন ফাটাফাটি প্রশ্ন কিভাবে এসেছিল পাপা?

তোমার মা এক ক্লাসফ্রেন্ড এর বিয়ের কন্ডিশন শুনে এই প্রশ্ন মনে এসেছিল। তবে ফানি শোনালেও ভাবনার খোঁড়াক আছে। মানুষ সুবিধাবাদী প্রাণী। সুযোগ দেয়া হলে তার অপপ্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। চাপিয়ে দিলে পাহাড় কাঁধে নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু অপশন, চয়েজ দেয়া মাত্রই কন্ডিশুনের বন্যা বইয়ে দেবে। মানুষ জানে এক মূহুর্তের কোন ভরসা নেই। কিন্তু সারাজীবনের সুখ-স্বচ্ছন্দ কিংবা ভালো থাকার নিশ্চয়তা চায়। এটা পর্যন্তও ঠিক ছিল। কিন্তু তারা নিশ্চয়তাটা চায় অন্য আরেকজন মানুষের কাছে। যে কিনা তারই মতো ভালো-মন্দ ভুল-শুদ্ধের সংমিশ্রণ। অদ্ভুত কি জানো? এদের মুখেই আবার সারাক্ষণ শরীয়তের বিধান ধ্বনিত হয়। জীবনের মূল লক্ষ্য কি জানতে চাইলে আবেগঘন কন্ঠে বলে, আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের মাধ্যমে জান্নাত লাভ। দুনিয়া কি প্রশ্নের জবাবে এক মূহুর্ত দেরি না করে বলে, পরীক্ষাক্ষেত্র। পরিবারের হক, আত্মীয়ের হক, প্রতিবেশীর হক, পথচারীর হক সব তাদের জানা থাকে। শুধু নিজের হকটাই জানা থাকে না।

একজন ব্যক্তির তার নিজের উপরের হক কি পাপা?

সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা রাখা। আল্লাহর সিদ্ধান্তে খুশি থাকা। অনিশ্চিত দুনিয়াতে কোন কিছুর নিশ্চয়তা দাবী না করা। নিজের কথা, কাজ আচরণকে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না করা। আল্লাহর সন্তোষ আদায়ের লক্ষ্য নিজ করণীয় করে যাওয়া। নিজ করণীয় একজন মানুষ শুধুমাত্র তখনই করে যেতে পারে যখন তার লক্ষ্য একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে। শুধুমাত্র তখনই অন্যের প্রতি আশা খাটো হয়ে যায়, এবং নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সতর্কতা বৃদ্ধি পায়। আমাদের আনন্দবাড়ির মানুষদের মধ্যে আত্মিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এত কম কেন জানো? কারণ আমরা অন্যেরা কি করছে সেটার চেয়ে নিজে কি করছি সেটার প্রতি বেশি মনযোগী। আমি, তোমাদের মা, বাবা, আদীব্বা আমাদের চারজনের সম্পর্কটা কখনোই এতটা সহজ-সুন্দর স্বাভাবিক হতো না, যদি না আমরা নিজ নিজ কাজ করে যেতাম আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায়ের লক্ষ্য। আমরাও অন্য আর দশজন মানুষের মতোই। আমাদের মন শয়তানের ওয়াসওয়াসা, প্রবৃত্তি, রিপু কোনটাই মুক্ত নয়। ঈর্ষা কিলবিল করে মাথা চাড়া দিতে চায় মনের ভেতর, কষ্ট হয়, ক্ষোভ জাগে, হতাশা ঘিরে ধরে। কিন্তু নিজ নিজ হক সম্পর্কে সচেতনতা আমাদেরকে আবারো জীবনের মূল্য লক্ষ্য পথে টেনে নিয়ে যায়। তাই হয়তো ঈর্ষার মেঘ সরিয়ে আমি আবারো ভাবতে পারি রাহাত তোমার মা এবং আমার মধ্যে বাঁধা নয়। বরং সেই ব্যক্তি যে তখন আমার পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, যখন আমি ছিলাম না। একই কারণে তোমাদের মাও পারেনি রাহাতের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিতে। কারণ তোমাদের মা জানা আছে দুঃসময়ে যারা জীবনের সাথে জুড়ে যায়, তারা আল্লাহর রহমত রূপে আসে। তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া মানে, আল্লাহর রহমতের ছায়া থেকে দূরে সরে যাওয়া। তাছাড়া ভালোবাসা এবং রক্তের চেয়েও অনেক গুণ বেশি মজবুত বেদনার বন্ধন। ভালোবাসাও কষ্ট দেয়, রক্তের বন্ধনও বিশ্বাস ভঙ্গ করে। কিন্তু যে সম্পর্কের ভীত বেদনা থাকে, তারা নিজের সবটুকুন দিয়ে একে অন্যেকে আগলে রাখতে চেষ্টা করে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে। আমাদের মধ্যে আদীই হয়তো সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থ। ওর কোন দায়িত্ব ছিল না, উল্টো অভিমানে দূরে সরে যাবার কারণ ছিল। কিন্তু তারপরও আদী তোমাদের জন্য সেই প্রতিটা কাজ করেছে, যা আমার করার কথা ছিল। এখনো করে যাচ্ছে। কোন প্রতিদানের আশা ছাড়াই। এখানেই পার্থক্য দুনিয়াবী জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যে সম্পর্কে জ্ঞাত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের।

জ্বি পাপা আমি বুঝতে পেরেছি। তারমানে জীবনের সব সমস্যার মূলই হচ্ছে, দুনিয়াতে আসার লক্ষ্য উদ্দেশ্যে সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকা। যারফলে, নিজ নিজ করণীয় করতে না পারা। তাই না পাপা?

জাওয়াদ হেসে বলল, হুম! ভেবে দেখো যারা ইবাদত কিংবা পড়াশোনায় গাফলতি করে, অলসতা করে সময় নষ্ট করে। তারাও কিন্তু পরীক্ষার হলে প্রতিটা মূহুর্তকে কাজে লাগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কারণ জানে নয়তো পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে হবে তাকে। অথচ তারাই দুনিয়া নামক পরীক্ষা ক্ষেত্রে সময়কে স্রোতের মত ভেসে যেতে দেয় উদাসীনতায়। বিয়ের ব্যাপারেও একই অবস্থা। প্রতিটা সম্পর্কের বন্ধনই পরীক্ষা আমাদের জন্য। তাহলে কেন বিয়েতে সবকিছু পারফেক্ট পেতে চাইবো? আমরা আশা করতে পারি, চেষ্টা করতে পারি কিন্তু দাবী করতে পারিনা কিছুই। ঠিক তেমনি ধারণার বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্তও নিতে পারি না নিজের অন্যের ব্যাপারে। তবে সবচেয়ে বেটার যা করতে পারি সেটা হচ্ছে, নিজ নিজ করণীয় করে যাওয়া শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায়ের জন্য। বাকি আলোচনা সবাইকে সাথে নিয়ে করি আমরা। যাও সবাইকে আসতে বলো।

জিহাদ হাসি মুখে বলল, জ্বি পাপা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন