সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি... শেষ পর্ব



উন্মুখ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছোট পাঁচ বোনের দৃষ্টিতে লুকিয়ে থাকা দোদুল্যমনতা দেখতে পাচ্ছিলো নূহা। বুঝতে পারছিল নিজ নিজ সমস্যা নিয়ে মাঝ সমুদ্রে আটকা পড়ে থাকতে মোটেই ইচ্ছুক নয় ওরা কেউ। সবাই তীরে ফিরে আসতে চায়, গড়তে চায় নিজের জন্য মায়াময় নীড়। তবে নূহার সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছিলো নায়লার জন্য। ছোটবেলা থেকে খুব যত্ন সহকারে শরীয়তের পরিমন্ডলে গড়ে তোলা হয়েছে তাদের সবাইকে। দেয়া হয়েছে সুন্দর ও সঠিক জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সব ধরণের শিক্ষা। তাই নিজের ভুল বোঝা ও মেনে নেয়াটা অনেক বেশি সহজ তাদের জন্য। বাবা-মায়েদের অবদান সন্তানদের পুরোটা জীবন জুড়েই বিরাজ করে। বাবা-মায়েরা নিশ্চুপে শুধু ত্যাগ করে যান সন্তানদের জন্য। বেশির ভাগ সময়ই সন্তানদেরকে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে দেন না তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কষ্টকে। কিন্তু বাবা-মায়েদের আসলে উচিত সন্তানদেরকে উপলব্ধি করতে দেয়া তাদের জীবনে বাবা-মায়ের অবস্থান ও অবদান। তা না হলে বেশির ভাগ সময়ই সন্তানরা সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয় পিতা-মাতার। তাদের পরিবারের এই ব্যাপারটিতে খুব সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে সবসময়ই। যাতে বাবা-মা ও সন্তানরা সম্পর্কের দাবী পূরণের সাথে সাথে মূল্যায়নও করতে পারে যথাযথ। সবকিছু মিলিয়ে তাই পরিবারের অপছন্দের বাইরে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক নায়লার জন্য। নায়লা যায়ওনি। জানিয়ে দিয়েছিল, ভাইয়াদের পছন্দ নয় এমন কোন সম্পর্কে আমি জড়াতে চাই না। পরিবারের সবাই আমাকে কতটা ভালোবাসে, তারাই যে আমার সর্বোচ্চ কল্যাণকামী সারাজীবন সেই প্রমাণই পেয়ে এসেছি। তাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ভাইয়ারা আমার জন্য যে সিদ্ধান্ত নেবেব সেটাই সবচেয়ে সঠিক হবে আমার জন্য ইনশাআল্লাহ। নায়লার সিদ্ধান্তে পরিবারের অন্য আর সবার মতো নূহাও অনেক খুশি হয়েছে। কিন্তু অন্য আর কেউ নায়লার মনের ব্যথাটা বুঝতে করতে চেষ্টা না করলেও নূহা না চাইতেও অনুভব করতে পারছিল নায়লার মনের সুপ্ত ব্যথা। এটা ঠিক খুব গভীর কোন সম্পর্ক বিচ্ছেদের ক্ষত যেহেতু নয়, খুব দ্রুতই হয়তো ব্যথাটা কমে যাবে, সেরেও যাবে। কিন্তু তার আগের সময়টুকু বড়ই যাতনাকর।  

অনেকটা এমনই এক কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সুমাইয়া। ছোট বোনের সাথে সুন্দর সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে গিয়ে বার বার বোনের নেতিবাচক ব্যবহার ক্ষত বিক্ষত করেছে ওর অন্তর। গতকাল সহ্য করতে না পারে ছুটে এসেছিল নূহার কাছে। এতটা ভেঙে পড়তে দেখে সুমাইয়ার বাবা-মার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল সুমাইয়াকে। জুম্মির সমস্যা পড়াশোনা, সর্বোপরী ইবাদাতের প্রতি দিন দিন মনোযোগিতা। আত্মজা এতদিন কান্নাকাটি করেছে ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার জন্য। বাপী পারমিশন দেবার পর এখন আবার দোটানায় পড়ে গিয়েছে। আবেগ বলছে নিজের পছন্দের সাবজেক্ট পড়তে কিন্তু বিবেক বলছে বাপীর ইচ্ছে ছিল সে মেডিকেলে পড়বে। তাই তার উচিত বাপীর শখটাই পূরণ করার। বাপী তো সারাটা জীবনই তার নানান ধরণের শখ পূরণ করেছেন। তার কি দায়িত্ব না বাপীর একটা শখ পূরণ করা? জুয়াইরিয়ার সমস্যা আবার ভিন্ন। আজকাল নিজেকে খুব বেশি জাজমেন্টাল মনেহয়। সারাক্ষণই চারপাশের সবার মধ্যে নানান ধরণের খুঁত দেখতে পায়। নিজেকে এবং পরিবারের বাইরে ছাড়া আর সব মানুষকেই কেমন যেন মুখোশধারী মনেহয়। নূহা আবারো অনুভব করলো পৃথিবীতে কেউই আসলে সমস্যা ছাড়া নেই। পার্থক্য শুধু কিছু মানুষ সমস্যার সাথে কদমে কদম মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। আর কিছু মানুষ সমস্যার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে। আরো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর নূহা বলল, আমাদের জীবনের সকল সমস্যার মূল কারণ কি জানো?

কি আপ্পা? একসাথেই প্রশ্ন করলো পাঁচজন।

নূহা বলল, জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে থেকে দূরে সরে যাওয়া। মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাই বলেই আমরা সেই লক্ষ্যে অর্জনের পথে কোন কাজেই নিজেকে স্থির রাখতে পারিনা। আমরা কারো জন্য ত্যাগ করে দোটানায় পড়ে যাই, কাউকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে হাল ছেড়ে দেই, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই সবার আগে জীবনের মূল গন্তব্যটাকে নির্ধারণ করে নেয়া উচিত আমাদের। অর্থাৎ, জীবন আমাদের কাছে কি চায় এবং আমরা জীবনের কাছে কি চাই এটা জানার চেষ্টা করতে হবে সর্বপ্রথম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জীবন আমাদের কাছে কি চায়? উত্তরটা সবারই জানা। জীবন আমাদের পরীক্ষা নিতে চায়। পরের প্রশ্ন আমরা জীবনের কাছে কি চাই? প্রশ্নের উত্তর হয়তো হওয়া উচিত ছিল, আমরা জীবনের কাছ থেকে পরীক্ষার পাশ মার্ক চাই। কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবটা সবার কাছে ভিন্ন ভিন্ন। যারফলে, আমাদের চারিদিকে গড়মিলই বেশি দেখতে পাই। 

এখন তাহলে আমাদের করণীয় কি আপ্পা? প্রশ্ন করলো জুম্মি। 

নূহা হেসে বলল, কাউকে তার করণীয় বলে দেয়া থেকে আমি সর্বদা বিরত থাকতে চেষ্টা করি। আমি বড়জোর আমার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা তোমাদের সাথে শেয়ার করতে পারি। তোমরা কি করবে সেটা একান্তই তোমাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

জুয়াইরিয়া বলল, ঠিকআছে তুমি তোমার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা বলো আমাদেরকে।

নূহা হেসে বলল, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা বলার আগে একটা গল্প শোনাই চল তোদেরকে।  রূপকথার এক গ্রামে একটি ঘর ছিল। সেই ঘরে ছিল এক হাজার আয়না। সেই গ্রামে বাস করতো খুবই হাসি-খুশি স্বভাবের মিষ্টি একটি ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটি একদিন তার বাবা মা'র মুখে "আয়না ঘর" এর কথা জানতে পারে। এবং সমবয়সী আরেকটি মেয়েকে সাথে নিয়ে সেই আয়না ঘর দেখতে রওনা দেয়। আয়না ঘরের সামনে পৌছে মেয়েটি ভাবলো আগে সে আয়না ঘরে ঢুকে সব কিছু দেখে এসে পরে তার বান্ধবীকে পাঠাবে। ধীরে ধীরে মেয়েটি আয়না ঘরের ভেতর ঢুকলো। ঘরে ঢোকার পর চাতপাশের রঙ্গিন কারুকার্য ও সাজসজ্জা দেখে মেয়েটির মুখ আনন্দে ভরে উঠলো।সে আস্তে আস্তে এগোতে এগোতে সেই একহাজার আয়নার ঘরে প্রবেশ করলো। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো সেখানে ঠিক তারই মতো দেখতে আরও একহাজার মেয়ে হাস্যোজ্জল মুখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে যা করছে বাকিরাও ঠিক তাই তাই করছে। মেয়েটি প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পড়ে খুব মজা পেলো। এবং বাইরে এসে তার বান্ধবীকে বলল, এত সুন্দর জায়গা আমি এর আগে কখনোই দেখেনি। সুযোগ পেলেই এখন থেকে আমি এই জায়গায় চলে আসবো। সব কথা শুনে দ্বিতীয় মেয়েটি কিছুটা ভয় ভয় মন নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো। কিন্তু যতই সামনে এগোচ্ছিল তার মনের আতংক বাড়ছিল। আতংকিত মন নিয়েই সে এক হাজার আয়নার" ঘরে প্রবেশ করলো। ঘরে ঢোকার সাথে সাথে মেয়েটি ঘাবড়ে গেলো। ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো, আতঙ্কিত হয়ে উঠলো চোখ। সে খেয়াল করলো ঠিক তারই মতো দেখতে আরও এক হাজার মেয়ে আতঙ্কিত আর ভয়ার্ত চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি তখন প্রচন্ড ভয়ে দুই হাত তুলে বলল, তোমারা কারা? সাথে সাথেই বাকী এক হাজার মেয়েও দুই হাত তুলে ধরলো ওর দিকে। আর সহ্য করতে পারলো না মেয়েটি। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। এবং বান্ধবীর হাত টেনে ধরে বলল, তাড়াতাড়ি এখন থেকে চল। এটা খুবই বাজে জায়গা।আমি আর কোনওদিন এই জায়গায় আসব না। গল্পটির শিক্ষা বলতে পারবে কেউ?

পাঁচজনকেই নীরব দেখে নূহা হেসে বলল, আমাদের জীবনটাও অনেকটা এই গল্পের আয়না ঘরের মতোই। মানুষ জীবনকে যেভাবে দেখে জীবন অনেকটা সেভাবেই ধরা দেয় তাদের কাছে। যারা জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী রাখে শত দুঃখ-কষ্ট, সমস্যার মাঝেও তারা আশাবাদী থাকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাপ্তির দ্বারা তারা জীবনকে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু যারা জীবনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে তারা অনেক প্রাপ্তির স্বর্ত্বেও হতাশা-নিরাশা-দুরাশা, ও মানসিক বিপর্যয়ের ঘেরাটোপে বন্দী থাকে। জীবন তাদের কাছে হয় ক্লান্তিকর এক বোঝা, বিষণ্ণময় এক উপ্যাখ্যান। তাই যখনই আমাদের জীবনে সমস্যা আসে সবার আগে চেষ্টা করতে হবে ইতিবাচকতার আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখার। আসলে কি জানো? বেশির ভাগ সময়ই আমরা কুরআন-হাদীস শুধু পড়ে যাই। কিন্তু নিজের মাঝে সেটা যথাযথ ধারণ করতে পারি না। তাই আমাদের জ্ঞান হয়তো ঠিকই বাড়ে কিন্তু তার প্রয়োগ বাড়ে না। যারফলে যখনই কোন সমস্যা আসে আমরা ঘাবড়ে যাই। এবং ভুলে যাই সমস্যাটা এসেছে পরীক্ষা হিসেবে। এবং এর প্রতিদান আমাদের জন্য প্রতীক্ষারত ইনশাআল্লাহ। এজন্য আমাদের শুধু জ্ঞানার্জন করলেই হবে না। সাথে সাথে তার চর্চাও করতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা পারবো জীবনে আপতিত ছোট-বড় সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করতে।

নায়লা বলল, আমরা তো এমনটাই চাই আপ্পা। কিন্তু স্থির থাকতে পারি না ইচ্ছেতে। তুমি কিভাবে পারো আপ্পা? তুমি কিভাবে বছরের পর বছর ধৈর্য্যশীলতার এমন পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছো? কিভাবে তোমার জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে স্থির থাকো সর্বদা? কিভাবে হাসতে হাসতে নিজের হাসিকেই ত্যাগ করে দাও অন্যের জন্য? পরিবারের সিদ্ধান্তকে আমি এত সহজ ভাবে মেনে নিতে পেরেছি যতটা না আমার বেড়ে ওঠার পরিবেশের শিক্ষা থেকে। তারচেয়েও অনেক বেশি শক্তি তোমার আত্মত্যাগ জুগিয়েছে আমাকে।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা চল তোদেরকে আরেকটা গল্প শোনাই। তবে এটা রূপকথার গল্প না। আমাদের ছোটবেলার গল্প। তোরা তো দেখিসই আমাদের মা-মামণি-খালামণি- ফুপ্পিদের মধ্যে সবচেয়ে গম্ভীর, চুপচাপ স্বভাবের হচ্ছেন মামণি। মামণিকে শুধুমাত্র ভাইয়াদের পাঁচজনের সাথেই মন খুলে হাসতে দেখা যেত আগে। আবার ভাইয়াদের পরে একমাত্র মামণিকেই আমাদের বাড়ির সবাই কম-বেশি ভয় করে চলে এখনো পর্যন্ত। বুঝতে শেখার পর থেকে আমরা কোনদিনও মামণিকে অসুস্থ হতে দেখিনি। কিংবা হলেও আমাদেরকে বুঝতে দেননি কখনোই। মামণি সবসময়ই ফিট, কর্মচঞ্চল ছিলেন। দশটা পরিবারের অদ্ভুত থেকে অদ্ভুতুরে মানুষদের নিয়ে  আমাদের আনন্দবাড়ি ছিল। মামণি এক হাতে সবাইকে এবং সবকিছু সামলে নিতেন। কার, কখন, কি দরকার মামণি সব জানতেন। মামণির উপর সব ছেড়ে দিয়ে পরিবারের বাকি সবাইও নিশ্চিতে ঘুরে বেড়াতো। যখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি হঠাৎ মামণি স্ট্রোক করলেন। মামণিকে আমরা কোনদিন জ্বরে ভুগতেও দেখিনি। সেখানে এত বড় একটা ব্যাপার। পুরো একমাস সিংগাপুর ছিলেন মামণি। সেই এক মাসে আনন্দবাড়ির চেহারাই বদলে গিয়েছিল। কারণ মামণিকে ছাড়া কিভাবে চলতে হয় সেটা জানাই ছিল না আমাদের কারো। কিছুটা সুস্থ হয়ে যখন মামণি ফিরে এলেন। ধীরে ধীরে আনন্দবাড়িতে আবারো আনন্দ ফিরে আসতে শুরু করেছিল। মোটামুটি সুস্থ হবার পর একদিন বিকেলে মামণি আমাদের সব বোনদের নিয়ে বসলেন। পরিবারের গুরুত্ব বুঝতে শেখার পরই আমাদেরকে শেখানো, জানানো ও বোঝানো হয়েছিল। মামণি সেই কথাগুলোই আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পরিবারের প্রতিটা সদস্য এক একটি মোতি।যদি মোতিদের দিয়ে খুব সুন্দর একটা মালা গাথঁতে হয় তাহলে সবার আগে মোতিদের এক ডোরে বাধঁতে হয়। আর বাঁধার জন্য প্রয়োজন হয় এক খন্ড সুতোর। ঠিক তেমনি সম্পর্কের মোতিগুলোকেও একসাথে বেঁধে রাখতে দরকার এক খন্ড সুতোর। ভালোবাসার সুতোর। আল্লাহর আমাকে এক খন্ড ভালোবাসার সুতো রহমত স্বরুপ দিয়েছিলেন। সেই ভালোবাসার সুতোয় আমি সম্পর্কের মোতিগুলোকে গাথঁতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে। দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। তাই এখন থেকেই তোমাদেরকে পরিবারের ব্যাপারে দ্বায়িত্বশীল হবার চেষ্টা করতে হবে। নিজেদের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে হবে এক খন্ড ভালোবাসার সুতো। যা দিয়ে তোমরা তোমাদেরকে ঘিরে ছড়িয়ে থাকা সম্পর্কের মোতিগুলোকে গাথঁবে। 

এক খন্ড ভালোবাসার সুতো কি সত্যিই সবার মধ্যে থাকে আপ্পা? প্রশ্ন করলো আত্মজা।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ অবশ্যই থাকে। তবে বারো বছর বয়সী আমাদের জন্য মামণির কথাগুলো বোঝা একটু কঠিন ছিল বৈকি। কিন্তু তবুও আমরা বোনেরা মামণিকে আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, ইনশাআল্লাহ আমরা ভালোবাসার সুতোয় সম্পর্কের মোতি গাথঁবো। সেদিন রাতে ঘুমোবার সময় মামণিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মামণি আমি কিভাবে বুঝবো আমার ভেতর ভালোবাসার এক খন্ড সুতো আছে? মামণি বলেছিলেন, ভালোবাসার সুতো সবার মাঝেই থাকে। কিন্তু সেই সুতোতে মোতি গাথাঁর মত শক্তি সঞ্চার ব্যক্তিকে নিজ গুণে অর্জন করে নিতে হয়। শক্তি সঞ্চারের জন্য আমাকে কি করতে হবে এই প্রশ্নের জবাবে মামণি বলেছিলেন, পরিবারের সবাইকে ভালোবাসতে হবে। এত বেশি ভালোবাসতে হবে, এত বেশি ভালোবাসতে যে সেই ভালোবাসার বদলে তোকে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোন অপশনই থাকবে না কারো কাছে। কিন্তু সেজন্য তোকে অনেক কষ্ট করতে হবে। অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কখনো আকাশের উদারতা, কখনো সমুদ্রের গভীরতা, কখনো বা পাহাড়ের অনঢ়তার ভূমিকা পালন করতে হবে। এবং সর্বক্ষেত্রেই সেটা করতে হবে ভালোবাসার সাথে। সেইদিনের পর আমার জীবন পুরো বদলে গিয়েছিল। আমার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছু শুধু আমার পরিবারকে ঘিরেই ছিল। আলহামদুলিল্লাহ এখনো আছে, থাকবেও  ইনশাআল্লাহ। আমাকে ভালোবাসা ছাড়া কারো কাছে অন্য কোন অপশনই থাকবে না। এটাকেও জীবনের আরেকটা লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিয়েছিলাম। কি করবো যাতে সব্বাই আমাকে ভালোবাসবে মামণির মত করে? সারাক্ষণ মাথায় শুধু এই চিন্তাই ঘুরে বেড়াতো। তোমাদের ভাইজানের কাছে যখন পরামর্শ চেয়েছিলাম উনি অনেক মজা পেয়েছিলেন আমার কথা শুনে প্রথমে। কিন্তু যখন বুঝেছিলেন আমার চাওয়াটা কোন বাচ্চা মনের খেয়াল নয়। তখন বলেছিলেন, পরিবারের কারো ভালোবাসা পাবার জন্য কিছুই করতে হবে না তোমাকে। তুমি শুধু একটা কাজ কোরো। পরিবারের সবাইকে ভালোবেসো শুধুমাত্র আল্লাহর ভালোবাসা পাবার জন্য। আর আল্লাহর ভালোবাসা পাবার  জন্য তোমাকে কি করতে হবে জানো? স্বার্থপর হতে হবে। ভীষণ রকম স্বার্থপর। এতোটা বেশি স্বার্থপর যে সর্বাবস্থায় সবার আগে নিজের কথা ভাববে। যেমন ধরো, কেউ তোমাকে খুব কষ্ট দিলো। তুমি সাথে সাথে তাকে মাফ করে দিবে। কেন মাফ করবে? কারণ এতে আল্লাহ খুশি হবেন তোমার উপর। আবার ধরো কেউ তোমার খুব পছন্দের একটা কিছু তোমার কাছে চাইলো। তুমি সাথে সাথে তাকে সেটা দিয়ে দেবে। কেন দেবে? কারণ এতে আল্লাহ তোমার উপর খুশি হবেন। আবার কেউ তোমাকে কোন কাজের দায়িত্ব দিলো। যদি সেটা খুব কষ্টকরও হয় তুমি যথাযথ ভাবে করতে চেষ্টা করবে। কারণ এতে আল্লাহ খুশি হবেন তোমার উপর। এভাবে জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে তুমি শুধু খেয়াল রাখবে আল্লাহ সন্তুষ্ট হচ্ছেন কিনা তোমার উপর। ব্যাস আর কিছুই করতে হবে না তোমাকে। আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, এটা তো খুবই সোজা কাজ। ভাইয়াও হেসে বলেছিলেন, হুম এটা খুবই সোজা। এরপর থেকে গত বিশ বছর যাবত এই খুবই সোজা কাজটি  করে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমি। আমার জীবনে যেই আসে আমি চেষ্টা করি আমাকে ভালোবাসা ছাড়া যেন তার কাছে অন্য কোন অপশনই না থাকে। আর সেই চেষ্টা আমি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করি। নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে আমি বার বার এটাই প্রমাণিত পেয়েছি যে, যখন কারো কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে। তখন সেই কাজটি যদি অনেক বেশি কঠিনও হয়। ব্যক্তির জন্য করাটা খুব সহজ হয়ে যায়।

কথাগুলো বলার সময় অনেক চেষ্টা করেও অশ্রুতে বাঁধ দিতে পারেনি নূহা। বোনের বলা প্রতিটা শব্দকে শোনার সাথে সাথে উপলব্ধি করার কারণে চোখ ভিজে উঠেছিল উপস্থিত পাঁচজনেরও। নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে হাসি মুখে নূহা বলল, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, আমি বিশাল কোন ত্যাগ করে চলছি এমনটা ভাবার আসলে কোনই যুক্তি নেই। আমার সিদ্ধান্তের পেছনে নীতির প্রশ্নটা ছিল সবার আগে। জীবনের উপর থেকে যখন আমার সমস্ত আকর্ষণ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এমন একটা সময়ে রাহাত আমার জীবনে এসেছিল। আমার তিন সন্তানকে পিতার আদর ও ভালোবাসায় বুকে টেনে নিয়েছিল। আর আমি খুঁজে পেয়েছিলাম এমন এক বন্ধুকে যার কাছে মনের কোন অনুভূতিই গোপন করার প্রয়োজন পড়ে না কখনোই। জীবনের খুব কঠিন এক সময়ে রাহাত নির্ভরতার পরম প্রশান্তিময় আশ্রয় হয়ে জীবনসাথীর বেশে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সুতোয় একত্রিত করেছিল ছড়িয়ে পড়া আমাকে। কে বলে যে শুধু মেয়েরাই সংসারকে সাজায়? আমার সংসারের মোতিগুলো রাহাত গেঁথেছিল ওর ভালোবাসা, ত্যাগ, ধৈর্য্য ও  মানবিক গুণাবলীর দ্বারা। রাহাতকে দেখে আমি বুঝেছিলাম নারী বলি আর পুরুষ ভালোবাসার সুতো উভয়ের কাছেই আছে। উভয়েরই তাই ক্ষমতা আছে সম্পর্কের মোতিগুলোকে একত্রিত করে গাঁথার। তাই অন্যেরা মোতি গাঁথছে না সেই চিন্তা করে কারো বসে না থাকা ঠিক না। অন্যেরা হয়তো জানেই না কিভাবে মোতি গাঁথতে হয়। প্রত্যেকের তাই নিয়্যাত থাকা উচিত নিজে মোতি গেঁথে অন্যেদের মালা গাঁথা শেখানো, মালা গাঁথতে প্রেরণা যোগানোর। আবার উঠে দাঁড়ানোর  প্রেরণা আমাকে রাহাত দিয়েছিল। আমার পক্ষে কিভাবে এটা সম্ভব ছিল শুধুমাত্র জাওয়াদ ফিরে আসার কারণে রাহাতকে ছেড়ে দেয়াটা? আর শুধু আমি কেন পৃথিবীর কোন মুসলিমাহ এমন স্বার্থপর কাজ করতে পারে না। তাছাড়া এমনো তো হতে পারে এটাই আমার জন্য আল্লাহর পরীক্ষা। ঈমানদারকে তো তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস দ্বারাই পরীক্ষা করেন আল্লাহ। আর আল্লাহর পরীক্ষায় যারা উৎড়ে যাবে তাদের পরিণতি অবশ্যই জান্নাত ইনশাআল্লাহ। আর জান্নাতে কোন বান্দাহ অতৃপ্ত থাকবে না কখনোই। এই চিন্তাটাই আমার চলার পথের প্রেরণা।

জুম্মি বলল, আমরাও এখন বুঝতে পারছি আমি। আসলেই আপ্পা জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকে না বলেই আমরা এমন এলোমেলো, অগোছালো ভাবে সময়কে চলে যেতে দেই। মানুষ আর জ্বীন জাতিকে আল্লাহ সৃষ্টিই করেছেন ইবাদাত করার জন্য। এটা স্মরণ থাকে না বলেই ইবাদতে অমনোযোগী হতে পারি আমরা। কুরআনের সাথে সময় কাটানো মানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তোষের ছায়াতলে আশ্রয় পাওয়া। এটা উপলব্ধি করতে পারিনা বলেই তিলাওয়াতে অলসতা করতে পারি। তেমনি স্কুল কলেজের পড়াশোনার পেছনেও তো একটা উদ্দেশ্যে আছে আমাদের। আমি যেমন আব্বু, আদী ভাইয়া আর তোমার মতো সাইকিয়াট্রিস্ট হতে চাই। শরীয়ত ভিত্তিক কাউন্সিলিং করতে চাই। প্রেসক্রিপশনে মেডিসিনের বদলে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত সমাধান লিখতে চাই। আমার ফোকাস এই উদ্দেশ্যে থেকে সরে গিয়েছিল বলেই আসলে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলান। ইনশাআল্লাহ আজ থেকে আমি নতুন করে সবকিছু শুরু করবো।

নায়লা বলল, আমিও ইনশাআল্লাহ আজ থেকে আরো ভালো সন্তান হবার চেষ্টা করবো। সর্বোপরী একজন আদর্শ মুসলিমাহ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবো ইনশাআল্লাহ।

সুমাইয়া চোখ মুছে নিয়ে হাসি মুখে বলল, আমিও আমার বোনকে এত বেশি ভালোবাসা দেবো যে সেই ভালোবাসাতে সাড়া দেয়া ছাড়া ওর কাছে ভিন্ন কোন অপশনই থাকবে না ইনশাআল্লাহ।

আপ্পা তুমি বাপীকে জানিয়ে দিও আমি মেডিকেলেই ভর্তি হবো ইনশাআল্লাহ। পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের উপরও কোর্স করবো। বললো আত্মজা। 

জুরাইরিয়া হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আমিও ভালো হয়ে যাবো আজ থেকে। মানুষকে যাচাই কম এবং বোঝার চেষ্টা বেশি করবো।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু তোদের বয়সী মেয়েরা এত বেশি ভালো হলে কিভাবে হবে? সঠিক কাজ করানোর জন্য একটু আধটু ফাইট না করলে তো পানসা লাগে সবকিছু!

নায়লা হেসে বলল, হয়েছে এসব বলে আমাদেরকে বোকা বানাতে পারবে না। ফাইট যাতে করতে না হয় সেজন্যই তো ছোট্ট বেলা থেকে ফার্মের মুরগীর মতো করে বড় করেছো আমাদেরকে। এমন ভাবে ব্রেনওয়াশ করেছো আমাদের যে চাইলেও পারিনা পরিবারের পছন্দের বাইরে কিছু চিন্তা করতে।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। যাইহোক এখন তোমাদের সবার জন্য বিশাল বড় একটা সুখবর আছে সেটা শোনো।

কি সুখবর আপ্পা? একসাথে প্রশ্ন করলো পাঁচজন।

আমাদের ভাইয়াদের ছোট্ট একটা সংগঠন আছে সেটা তো নিশ্চয়ই জানো তোমরা। আমি যেদিন প্রথম সেই সংগঠনের কথা জানতে পেরেছিলাম আদী ভাইয়াকে প্রশ্ন করেছিলাম, কিসের সংগঠন তোমাদের? কি করো তোমরা? দাওয়াতি কাজ করো? ইত্যাদি ইত্যাদি। আদী ভাইয়া আমার এতসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন, দাওয়াতী কাজের টার্গেট নানাবিধ হয়। সেই সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? জবাবে বলেছিলাম, হ্যা আমি পড়েছিলাম যে, দাওয়াতী কাজের টার্গেট হতে পারে নানাবিধ। যেমন, একজন অমুসলিমকে মুসলিম বানানো, একজন নাম মাত্র মুসলিমকে শরীয়তের বিধান সম্পর্কে জানানো, একজন বেনামাজীকে নামাজী বানানো, একজন অসৎ নামাজীকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আদী ভাইয়া তখন হেসে বললেন, আমরা ঠিক এই কাজটিই করি। একজন সার্টিফিকেটধারীকে আমরা শিক্ষিত করার চেষ্টা করি, একজন শিক্ষিতকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার চেষ্টা করি, একজন জ্ঞানীকে উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করি এই বিশ্বভান্ডারের বিস্তৃত জ্ঞান ভান্ডারের তুলনায় তার জ্ঞান কতই না ক্ষুদ্র। এই উপলব্ধির ফলে সে নিজেকে জ্ঞানী ভেবে অহংকারী হবার বদলে পুনঃপুনঃ নিজের অজ্ঞতা উন্মোচনের মাধ্যমে হয়ে উঠে উদার, বিনম্র, কোমল ও বিনয়ী। অতঃপর সেই জ্ঞানীকে শেখাই কিভাবে অর্জিত জ্ঞানের আলোতে নিজেকে আলোকিত করে সেই আলো ছড়িয়ে দিতে হয় দূর থেকে বহুদূর। এবং এই পুরো কার্যক্রমে আমরা শিক্ষকের ভূমিকায় কম এবং ছাত্রের ভূমিকায় বেশি থাকি। অন্যদের শুধু শেখাই না, সাথে নিজেরাও শিখতে শিখতে এগিয়ে চলি।আলহামদুলিল্লাহ আদী ভাইয়ার কথা শুনে মুগ্ধ না হবার কোন উপায়ই ছিল না আমার।

সুমাইয়া হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমরাও বিমুগ্ধ আপু। কি অসাধারণ সুন্দর কনসেপ্ট। এমনটা এরআগে কখনোই শুনিনি।   

নূহা হেসে বলল, আমিও না। সেজন্যই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলাম ভাইয়াকে। যারফলে জেনেছিলাম, উনাদের সংগঠনের সদস্য কিংবা স্টুডেন্ট হচ্ছেন তারা যারা পড়াশোনা মোটামুটি   কমপ্লিট করে ফেলেছেন। যারা নিজেদেরকে শরীয়তের আলোকে গড়ার লক্ষ্যে মূলত এক সাথে জড়ো হয়েছিলে। উনাদের আরেকটি মূল লক্ষ্য ছিল, কিভাবে নিজ নিজ প্রফেশনের দ্বারা ইসলামের জন্য কাজ করা যায়। মোটকথা তাদের উদ্দেশ্যে ছিল নিজেদেরকে দক্ষ মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা। “দক্ষ মুসলিম”  শব্দটা আমার জন্য নতুন ছিল। আদী ভাইয়া তখন বুঝিয়ে বলেছিলেন, ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় পাবার সাথে সাথেই একজন মানুষ মুসলিম হবার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেন। কিন্তু একজন যোগ্য ব্যক্তিকে তখনই দক্ষ বলা সম্ভব যখন তার উক্ত বিষয়ে পরিপক্ক ও বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞান থাকে। সুতরাং,একজন মুসলিমকে তখনই দক্ষ বলা সম্ভব যখন তার ভেতরে শরীয়তের মৌলিক জ্ঞান সমূহ থাকে এবং সে বাস্তব জীবনে সেইসব জ্ঞান মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাই মুসলিম হিসেবে দক্ষতা অর্জন অতীব জরুরি। কেননা দক্ষতা ছাড়া কোন কাজই সুচারু রূপে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। দক্ষ ব্যক্তিকে তুলনা করা হয় সূর্যের সাথে। সূর্যকে ঘিরে যেমন গ্রহরা আবর্তিত হয়। ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষেরা নিজ নিজ প্রয়োজনের তাগিদে ছুটে আসে দক্ষ ব্যক্তিদের কাছে অদক্ষ ব্যক্তিরা দীর্ঘ পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে যা করতে ব্যর্থ হয়। দক্ষ ব্যক্তিরা খুব অল্প সময়েই সেই কাজটিকে সুন্দর সমাধান বা সমাপ্তিতে টেনে নিয়ে যেতে পারেন। নিজের সাথে সাথে চারপাশের নেতিবাচক পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে বদলে দেবার জন্য তাই নিজেদেরকে দক্ষ মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার কোনই বিকল্প নেই।

তারমানে আমরা তো তাহলে শুধু নাম মাত্র মুসলিম আপ্পা। মন খারাপের সুরে বললো আত্মজা।   

নূহা বলল, আমার উপলব্ধিটাও ঠিক তোমাদের মতোই ছিল। নিজের তাকিয়ে সেদিন প্রথম অনুধাবন করেছিলাম একজন মুসলিম হিসেবে আমি কতই না অদক্ষ। আমিও ভাইয়াদের সংগঠনের একজন হবার আবদার করেছিলাম। কিন্তু জানতে পারলাম মেয়েদের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। তবে আমার খুব আগ্রহ দেখে ভাইয়ারা উনাদের ক্লাসের অডিও রেকর্ড দিতো আমাকে। পরবর্তীতে অবশ্য মেয়েদের জন্যও আলাদা গ্রুপ করা হয়েছে। রিসেন্টলি একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর সেই সিদ্ধান্তটি হচ্ছে আমরা ছেলেদের জন্য এবং মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা দুটি জুনিয়র গ্রুপ করবো। যেই গ্রুপে অলস, অমনোযোগী, জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়া দুষ্টু ছেলেমেয়েকে উত্তম মাধ্যমের দ্বারা সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দক্ষ মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ। 

পাঁচজন আনন্দে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লো নূহার উপর। পাঁচজনকে ঠেলে সরিয়ে হাসতে হাসতে নূহা বলল, এত আনন্দিত হবার কিছুই নেই। টিচাররা যে কি দশা করবেন তোমাদের কল্পনা করার ক্ষমতাও নেই তোমাদের। তাই হৈ-হুল্লোড় বাদ দিয়ে নিজেদেরকে প্রস্তুত করো ক্লাসের জন্য। এক মাস পর থেকে তোমাদের ক্লাস শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।  

পাঁচজন আনন্দে চিৎকার করে বলল, ইনশাআল্লাহ।

আরো কিছুক্ষণ ছোটবোনদের সাথে কাটিয়ে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো নূহা। নাস্তার পর ভাইয়ারা সবাই আর বাচ্চারা সবাই মিলে বাসকেট বল খেলার আয়োজন করেছিল। এখনো সেই খেলা চলছে। একপাশে ফাদারস গ্রুপের সদস্যরা এবং আরেক পাশে মাদারস গ্রুপের সদস্যরা মুখে বিশাল আনন্দময় হাসি মেখে দুই জেনারেশনের খেলা উপভোগ করছিল। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকিয়ে সুবহা ভাবীকে দেখে হাসলো নূহা।

সুবহাও হেসে বলল, একজন সাইকো মাস্টার একদিন আমাকে বলেছিল, জীবনকে প্রতিমূহুর্তে আরেকটু সুন্দর করে সাজানোর দুয়ার সবসময় উন্মুক্ত থাকে। কারণ জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া এবং সেই শিক্ষাকে কাজে লাগানোর সুযোগ কখনোই রুদ্ধ হয়ে যায় না। আর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি? জীবন এক অফুরন্ত রত্নভান্ডার। সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না সবই অমূল্য একেকটা হীরা-পান্না-চুনী-মুক্তা। যারা জীবনের এই গোপন মন্ত্র জানে, তারা ঝরে পড়া একটি অশ্রুবিন্দুকেও বৃথা যেতে দেয় না। সযতনে তুলে নেয় আঙুলের ডগায়, জমিয়ে রাখে কাঁচামাল হিসেবে, গড়ে তোলে ধীরে ধীরে মনোমুগ্ধকর অশ্রুমহল। আজ আমার চারপাশে শুধু মনোমুগ্ধকর অশ্রুমহল নজরে আসছে। তুইও কি দেখতে পাচ্ছিস?

নূহা হেসে বলল, উহু! কারণ আমি জানি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, 'মুসিবতে ঘেরা জীবনের পথ, চালিয়ে যেতে হবে তবুও রথ। সর্বাবস্থায় থাকলে সঠিক ও সৎ, ছায়া হবে সর্বদা আল্লাহর রহমত। হেদায়াতের আলোতে আলোকিত জীবন, আল্লাহর প্রসন্নতা বিহীন সম্ভব নয় অর্জন। রব্বের ইচ্ছের কাছে করে তাই আত্ম-সমর্পন, কাটাতে চাই জীবনে আগত প্রতিটি ক্ষণ। দুনিয়ার মায়াজাল তখনই ছিন্ন করতে পারে অবুঝ মন, দুনিয়াবী জীবনের মূল গন্তব্য সম্পর্কে যখন থাকে পূর্ণ সচেতন'। আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার মূল গন্তব্য সম্পর্কে সতেচন। তাই দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ায় মগ্ন হবার কোন সুযোগ নেই। আমাদের এখন অনেক কাজ ভাবী। জুনিয়র গ্রুপ, কিডস গ্রুপ ওদেরকে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এখনো বাকি। ওদের মনে স্বার্থপরতার দ্বার উন্মোচন করতে চাই না আমার কোন কাজের দ্বারা। আমি ইনশাআল্লাহ ওদেরকে দেখাতে, জানাতে এবং শেখাতে চাই ধৈর্য্যশীলতার দ্বারা কিভাবে আঁধারের বুকে দীপ জ্বালতে হয়।   

হাসি মুখে নূহাকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলো সুবহা। আসলেই তো এখনো তাদের অনেক কাজ বাকি। দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার চিন্তায় মশগুল হবার কোন সুযোগ নেই তাদের...   

পরবর্তী গল্প... “আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই”...  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন