মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...৬




ছন্দে ছন্দে লিখি মনের স্বপ্ন-কল্প কথা! মমতার রসে সিক্ত, আদরের সুতোয় গাঁথা! খোলসের ভাঁজে লুকানো ছোট্ট ছোট্ট ব্যথা!নিয়েছি মেনে কারণ কিছুই তো নয় অযথা’! ফাইলের এক কোণে লেখা শব্দগুলো চোখে পড়তেই হাসি ফুটে উঠলো আদীর মুখে। কবি হবার এও এক জ্বালা। কখন যে মনে কোন ভাবনা উঁকি দিয়ে বসবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এবং কবি সেই ভাবনাদের শব্দের ফ্রেমে বাঁধতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভুলে যান যে, সে এখন ক্লায়েন্টের কেস ফাইল স্টাডি করছে।

ঠোঁট চেপে এমন রহস্যময় হাসির পেছনে রহস্যটা কি?

ফায়েজের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো আদী। হাসতে হাসতে বলল, পাখী উড়ে চলে যায়, পালক পড়ে থাকে। এই টাইপের একটা কথা আছে মনেহয়।

হুম, আছে তো! কিন্তু হঠাৎ উড়ে যাওয়া পাখীর পড়ে থাকা পালকের পেছনে লেগেছিস কেন?

কারণ ঐ কথাটা তোর আদরের ভগ্নীর ক্ষেত্রে একশো ভাগ প্রযোজ্য। এই যেমন ধর, সে গত এক সপ্তাহ ধরে হসপিটালে আসছে না। কিন্তু এমন সব কর্মকাণ্ড করে গিয়েছে যে, না চাইতেও তার কথা মনে করতে বাধ্য হতে হয় আমাদেরকে। বলতে বলতে ফায়েজের দিকে ফাইল বাড়িয়ে দিলো আদী। ফাইল নিয়ে শব্দগুচ্ছে চোখ বুলিয়ে হাসি মুখে ফায়েজ বলল, আসলেই তো জগতের কোন কিছুই অযথা নয়। সবকিছুর পেছনেই কোন না কোন কারণ থাকেই। এই চিন্তাটা অনেক বদ্ধ দুয়ারের চাবির কাজ করার ক্ষমতা রাখে।

হুমম, আবার কারণের ভিতরেও লুকানো থাকে কারণ, করে উন্মোচন করতে হয় তাদের বরণ। তবুও অসংখ্য কারণ থেকে যায় অবগুণ্ঠিত, কারণের অভাবে তখন হতে হয় তাই ব্যথিত।

মাশাআল্লাহ দারুন বলেছিস তো। জাওয়াদ, নূহা আর তোর ছন্দে ছন্দে কথা বলাটা আমাকে খুব মুগ্ধ করে সবসময়ই। আমি সারাদিন চেষ্টা করেও একটা শব্দের পাশে আরেকটা শব্দ বসাতে পারি না। হাসতে হাসতে বললো বললো ফায়েজ।

আদীও হেসে বলল, আমি কিন্তু কখনোই চেষ্টা করিনা। শব্দদের যখন কাব্য হতে সাধ জাগে নিজ ইচ্ছেতেই ছন্দের সাজে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে আসে। নূহার ভাষায় উই আর প্যাথলজিক্যাল পয়েট, আলহামদুলিল্লাহ।

হেসে ফেললেও আর কিছু না বলে ফাইল স্টাডিতে মনোযোগ দিলো ফায়েজ। বেশ অনেকক্ষণ পর বলল, কি সমস্যা এই দুই ভাইয়ের? একে অপরের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন?  

নিশ্চয়ই জানিস ভয়াবহ রকমের একটা মানসিক রোগ হচ্ছে, "আমিই সঠিক"। উক্ত দুই ভাই আমিই সঠিক রোগে আক্রান্ত। কোন ব্যাপারেই একমতে আসতে পারে না দুজন। সারাক্ষণই লেগে থাকে একে অন্যের পেছনে। বাধ্য হয়ে ওদের বাবা-মা দুই ছেলেকে সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে এসেছে। আখদান দেখছে ওদের কেসটা। কিন্তু দুই ভাইয়ের যুক্তি-তর্কের উত্তাপে বাটারের মতো মেল্ট হয়ে যাচ্ছে বেচারা।

ফায়েজ হেসে বলল, তোরা সত্যি সত্যিই মহান একেকজন মানুষ। কিভাবে যে সহ্য করিস মানুষের কথার এত অত্যাচার। নিজেরাই বা কিভাবে বলিস এত কথা? আমি চিন্তা করার চিন্তাতেই ঘাবড়ে যাই। তোকে, বড়মামাকে, নূহাকে আর রিহ্যাব সেন্টারের ভাইবোনগুলোকে দেখলে মাঝে মাঝে মনেহয় সাইকোলজি রিলেটেড পারসনদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা স্পেশাল ধৈর্য্যশীলতা, সহনশীলতা, হৃদয় ছোঁয়া সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার এবং মানুষের মনে বিশ্বাস ও আশা জাগানোর ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।

আলহামদুলিল্লাহ! তবে এইসব ক্ষমতা সব মানুষের মধ্যেই আছে। মূলত সমস্ত ভালো ও মন্দ গুণই মানুষের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শুধু সেটাকে বিকশিত করতে হয়। এই কেসের দুই ভাইয়ের কথাই চিন্তা কর। কেন ওরা দুই ভাই একে অন্যের ছোট্ট একটা কথাও মেনে নিতে নারাজ? এমনটা তো জন্ম থেকে হবার কোন সুযোগ নেই। আবার হঠাৎ করেই একদিন কারো প্রতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠাটাও সম্ভব নয়। টুকটাক মনোমালিন্য, কথা কাটাকাটি দিয়েই শুধু হয়েছিল ওদের এই বিরোধ। প্রথম যেদিন দুইভাই নিজেকে সঠিক প্রমাণের জন্য একে অন্যের বিরুদ্ধে জিভের তরবারী উন্মুক্ত করেছিল, সেদিনই যদি ওদের বাবা-মা বুঝিয়ে বলতেন সঠিক-বেঠিক নির্ভর করে প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গীর উপর। নিজ নিজ অবস্থান থেকে তোমরা দুজনই সঠিক। আবার একে অন্যের অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করে দেখো। তাহলে তোমরা উভয়েই উভয়কে সঠিক দেখতে পাবে। তাহলে হয়তো দ্বন্দ্বের যে গর্তটা তৈরি হয়েছিল দুভাইয়ের মধ্যে। অতি সহজেই সেটা উপর দিয়ে লাফিয়ে পৌঁছে যেতে পারতো একে অন্যের কাছে। কিন্তু বাবা-মা এমনটা করেনি বলেই ওদের ভুলের সেই গর্ত খরস্রোতা নদীতে পরিণত হয়েছে। বাইরে থেকে বাঁধ দেয়া কিংবা সাঁকো নির্মাণ করাটাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

হুম! আলহামদুলিল্লাহ আমাদের বাবা-মায়েরা এই ভুল করেননি বলেই হয়তো আমাদের ভাইয়ের মাঝে কোন দ্বন্দ্ব নেই।

আদী হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ এতে কোনই সন্দেহ নেই। তা না হলে আমরাও তো ছোটবেলায় ঝগড়া করতাম, মারামারি করতাম, মনোমালিন্য হতো, কথা বলা বন্ধ করে দিতাম একে অন্যের সাথে। কিন্তু যখনই আমাদের দ্বারা এমন কিছু ঘটেছে। বিষয়টা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন বাবা আমাদেরকে নিয়ে আলোচনা করতে বসে যেতেন। গর্ত তো দূরের কথা বাবা আমাদের সম্পর্কের বন্ধনে সামান্য একটা চিড়কেও স্থায়ী হবার সুযোগ দেননি। চলার পথের প্রতিটি চিড়কে মিশিয়ে দিয়ে আমরা হাতে হাত রেখে সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছি এর ক্রেডিট আমাদের অভিভাবকগণের। যারা আমাদেরকে বুঝিয়েছেন, বুঝতে শিখিয়েছেন এবং অন্যেকে বোঝার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়েছেন। আজকাল চারপাশে প্রায় সব মানুষের মুখেই শুধু একটাই বাক্য কেউ আমাকে বোঝে নাপ্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে তুমি কি অন্যেকে বোঝ?” অন্তত তোমার প্রশ্ন শুনে তো এমনটা মনেহয় না। কারণ যারা অন্যেকে বোঝে, তারা কখনোই তাকে কেউ বোঝে না এই আহাজারি করে না। মূলত, জগতে আজকাল কেউই কাউকে বুঝতে চায় না। সবাই শুধু চায় অন্যেরা তাকে বুঝুক। তাই হয়তো এত শত বুঝদার, সমঝদার মানুষের ভিড়ে বোঝাপড়াটাকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ আমরা যখন অন্যকে বোঝার চেষ্টা করি তখনই সম্ভব হয় তার কথা, কাজ বা আচরণের পেছনে কিছু একটা কারণ খুঁজে পাওয়া।

এই ধরণের সব সমস্যার মূল কথা মনেহয় একটাই। এসব সম্পর্কের ভিত্তি আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হয় না। জীবনকে ঘিরে আবর্তিত সম্পর্কগুলো যখন দুনিয়া কেন্দ্রিক হয়। তখন তাতে আন্তরিকতার বদলে স্বার্থপরতা জায়গা করে নেয় অতি সহজেই। অন্যের জন্য ত্যাগ করার কোন রিজন খুঁজে পায়না মানুষ। অন্যেকে ক্ষমা করে দেবার মতো উদারতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়। পারিবারিক জীবনে না হলেও, সামাজিক জীবনে আমাদেরকেও তো এমন মানুষদের মুখোমুখী হতে হয়েছে, হতে হয় প্রায়শই। যারা নিজের ভালো, নিজের সুবিধা, এককথায় নিজেকে ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করতে পারে না। মনেআছে তোর প্রথম প্রথম আমরা খুবই আহত হতাম উদারতার বদলে মানুষের সংকীর্ণতা দেখে? আমাদের অবস্থা দেখে বাবা হাসি মুখে বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যের উত্তম গুণাবলীর দ্বারা পুরো পৃথিবীকে বদলাতে না পারলেও, অন্তত নিজ নিজ পৃথিবীকে অবশ্যই সুখী-সুন্দর ও সুশোভিত করে গড়ে তুলতে পারবে ইনশাআল্লাহ। তাই পৃথিবীতে বদলাতে চাইবার দরকার নেই। নিজ নিজ পৃথিবী গড়ে তোলো শরীয়তের আলোকে। দেখবে তোমাদের পৃথিবীর মনোরম সৌন্দর্য, প্রশান্তিকর আবহাওয়ার টানে মানুষই নিজ থেকে ছুটে এসে সদস্য হতে চাইবে। তখন তোমাদের পৃথিবীতে প্রবেশের যত কঠিন শর্তই রাখো না কেন, শান্তিবাদী, আলোকসন্ধানী কিছু মানুষ পেয়েই যাবে। যারা তোমাদের পৃথিবীতে একটু অবস্থান পাবার জন্য বিনা দ্বীধায় নিজেদেরকে আমূল বদলাতেও রাজী হয়ে যাবে। আলহামদুলিল্লাহ বাবার কথাটাকেই বার বার সত্য হতে দেখেছি আমাদের জীবনে। আসলেই পৃথিবীটা বদলে যেত যদি প্রতিটি পরিবারের নেতৃত্বে থাকতো আদর্শবাদী পিতা-মাতা।

সেটাই। সন্তানদেরকে জীবনের মূল গন্তব্যের সন্ধান এবং সেই পথে চলার দিক নির্দেশনা যদি পিতা-মাতা যথাযথ দিতে পারতেন, তাহলে সবাই আদর্শবান হয়েই বেড়ে উঠতো। আর আদর্শবান ব্যক্তিদের চলার পথ যতই কন্টকাকীর্ণ হোক না কেন, তারা বড়জোর মাঝে মাঝে থমকে যায়, কিন্তু নীতির সাথে কম্প্রোমাইজ করে না। শরীয়তের আলোকে আলোকিত মানুষ সবসময় হয়তো পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু সর্বাবস্থাতেই তারা শরীয়তের দেখানো পথে চলতেই চেষ্টা করে। তারা অধমের সাথে উত্তম হতে পারে। কারো আঘাতের বদলে আঘাত না করে, উল্টো তার হেদায়াতের দোয়া করতে পারে। হাসি মুখে নিজের পছন্দকে ত্যাগ করতে পারে। কারণ তার বিশ্বাস থাকে, এই ত্যাগের উত্তম প্রতিদান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে সেইদিন দেবে, যেদিন বিন্দু পরিমাণ ভালো ও মন্দ কাজের হিসাবও করা হবে।

ফায়েজ হাসি মুখে বলল, জীবনটাকে কত সহজ, সুন্দর মনেহয় এভাবে ভাবতে পারলে তাই না? প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা মেনে নেয়াটা কতই না সহজ হয়ে যায়, এর পেছনের কল্ল্যাণ নিহিত থাকার বিশ্বাসের ফলে। অন্যের জন্য আত্মত্যাগ করে মন কতটাই না আনন্দ অনুভব করে, এর উত্তম প্রতিদান প্রতীক্ষারত আছে এই আশ্বাস। প্রতিটা মানুষ যদি শুধু আল্লাহর সন্তোষকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারতো, দুনিয়াতে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও হয়তো সমস্যা খুঁজে পাওয়া যেত না। যাইহোক, কেউ না হোক, আমরা অন্তত আল্লাহর সন্তোষকে ঘিরেই আবর্তিত হবো ইনশাআল্লাহ।

আদী হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা আমাকে এখন উঠতে হবে। বৌকে ডিনার করাতে নিয়ে যাবো বলেছিলাম। গুড হাজবেন্ডের ডিউটিও তো মাঝে মধ্যে করা উচিত। নাকি বলিস?

ফায়েজ হেসে বলল, অবশ্যই ভ্রাত অবশ্যই। আমিও উঠবো কিছুক্ষণ পর। অপারেশন আছে।

ফায়েজের কাজ থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দরজার পাশে শাফাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা অবাক হলো আদী। পর মূহুর্তেই মনে পড়লো শাফাতকে বলেছিল রাতে কথা বলবে ওর সাথে। হাসি মুখে সালাম দিয়ে বলল, অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছো?

সালামের জবাব দিয়ে শাফাত বলল, জ্বিনা স্যার। দশ মিনিটের মতো হবে। আপনি হয়তো ব্যস্ত ভেবে নক করিনি। এখন কি ফ্রি আছেন আপনি?

আদী হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ তোমার সাথে কথা বলার মতো সময় আছে। চলো করিডোরে দাঁড়াই।


করিডোরে এসে দাঁড়ানোর পরও বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো শাফাত। এরপর ধীরে ধীরে বলল, আমার মনেহয় একজন ভালো কাউন্সেলরের খুব প্রয়োজন স্যার। আমি সপ্তাহ খানেক ধরে খুব ফ্রাস্টেশনে ভুগছি। যারফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে।

খুলে বলা যাবে তোমার সমস্যা?

জ্বি স্যার অবশ্যই। আমি একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসতাম স্যার। পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। যেহেতু বিয়ে হবে আমাদের তাই একে অন্যের অনেক কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম গত ছয়মাসে। কিন্তু গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই আমাদের বিয়েটা ভেঙে যায়।কারণ সুমনা অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এখন সে ঐ ছেলেটাকে বিয়ে করতে চায়। ব্যাপারটা জানার পর আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। লাস্ট যেদিন কথা হয়েছিল সেদিনও তো কত আন্তরিক ছিল সুমনা আমার সাথে। সেদিনও অনেক ভালোবাসার কথা বলেছে। তাহলে কিভাবে সম্ভব অন্য কারো প্রতি ওর ভালোবাসা? তারমানে কি প্রথম থেকেই সুমনা অভিনয় করেছে? একই সাথে দুইটা রিলেশনের সাথে জড়িয়ে ছিল? সুমনার কথানুযায়ী চার মাস আগে এক সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ঐ ছেলেটির সাথে ওর পরিচয় হয়। তারমানে তো আমার সাথে যখন ভালোবাসাময় সময় কাটিয়েছে, তখন ঐ ছেলেটির সাথেও সময় কাটিয়েছে। এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণায় নিজেকে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য মনেহয়। কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে। কঠিন কোন শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করে, যাতে আর কোন মেয়ে এমন ধোঁকা দিতে না পারে, বিশ্বাস ভঙ্গ করতে না পারে কারো। আবার কখনো নিজেকেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। মনটা খুব বেশি অশান্ত। কি করবো, কি করণীয় কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

আদী হাসি মুখে বলল, একটা বাণী আছে, “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেত্মাতার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে, কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়হসপিটালে গড়ে প্রায় প্রতিদিনই সুইসাইড কেস আসে। যার মধ্যে নাইনটি পারসেন্ট সুইসাইড এর পেছনে কারণ থাকে ছেলে-মেয়েদের প্রেম-ভালোবাসা ঘটিত সম্পর্ক ও সমস্যা। আমরা সারাক্ষণ বলি ভালোবাসার দ্বারাই সম্ভব সুন্দর একটা পৃথিবী গড়ে তোলা। অথচ রোজ ভালোবাসার কারণেই অসংখ্য ভুক্তভোগী দেখতে পাই। সবকিছু মিলিয়ে ভালোবাসা বিষয়ক এক আলোচনা আমাদের এক কলিগের এই বাণীটি বলেছিলেন। শুনে অনেক হেসেছিলাম আমরা বাকি সবাই। কেউ কেউ সাপোর্ট করছিল বাণীটিকে, কেউ কেউ উড়িয়ে দিচ্ছিলো। তোমার কি ধারণা বাণীটি সম্পর্কে?

একদম সঠিক কথা স্যার।

আদী হেসে বলল, বর্তমান অবস্থায় তোমার ধারণা এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি নিশ্চিত এক সপ্তাহ আগে হলে এই বাণীটিকে তুমি হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিতে। কারণ তখন ভালোবাসা সুন্দর কোন মোড়কে তোমার সামনে উপস্থিত ছিল। মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, অবস্থার প্রেক্ষিতে ধারণা বদলে যাওয়াটা। এর মূল কারণ সমূহের একটা হচ্ছে, জীবনকে ঘিরে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ এবং স্থির না। পৃথিবীর মতো আমাদের আমাদের চিন্তা-চেতনাও বৃত্তাকারে ঘোরে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও কক্ষপথ বিহীন। যারফলে আমাদের ভেতরে স্থিরতার যথেষ্ট অভাব। পৃথিবীর প্রকৃতি হাজারো রঙ-রূপ ধারণ করে। কিন্তু বেসিক কিছু জিনিসের কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন ধরো, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রির পালাবদল। মনের প্রকৃতিরও রঙ-রূপ বদলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বেসিক কিছু বিষয়েও যখন মন স্থির থাকতে পারে না। তখনই ঘটে বিপত্তি। এই যেমন ধরো, ভালোবাসা বলতে যারা শুধু নারী-পুরুষের সম্পর্কিত ভালোবাসাই বোঝে, তাদের কাছে ভালোবাসা প্রেতাত্মা হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং উচিতও। কারণ ভালোবাসা তো মূলত এক ক্ষুদ্র কোন পরিসরের নাম নয়। মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে সবকিছুর পেছনে মানুষের কন্ডিশন সেট করার প্রবণতা দেখে। একজন নারী কিংবা পুরুষের ভালোবাসাই কি একমাত্র প্রকৃত ভালোবাসা?! জীবনকে জুড়ে থাকা অসংখ্য ভালোবাসাময় বন্ধন তাহলে কিছুই না?! ভালোবাসা ব্যাপকতা আসলে আকাশ ছোঁয়াই। আমরাই ভালোবাসাকে ক্ষুদ্র করতে করতে নির্দিষ্ট একজন মানুষের মধ্যে বন্দী করে ফেলি। সেই মানুষটা যদি ভালোবাসা দিতে অপারগ থাকে, নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেই। কিন্তু যেদিন থেকে আমরা সত্যিই স্বাধীন ভাবে ভালোবাসতে শিখবো। সেদিন থেকে ভালোবাসার শূন্যতায় কেউ প্রাণ হারাবে না ইনশাআল্লাহ। কারণ যাদের ভালোবাসা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকে, তারা ভালোবাসার একটি উপকরণ হারিয়ে গেলেই জীবনকে অর্থহীন ভাবে না। তাদের জানা থাকে ভালোবাসার আরো অসংখ্য উপকরণ আছে জীবনকে উপভোগ করার জন্য।

আমি বুঝতে পারছি স্যার। তবে সুমনার চলে যাওয়া থেকেও ওর বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। সত্যি বলতে কষ্টের চেয়েও রাগ, ঘৃণা বেশি হচ্ছে।

বুঝতে চেষ্টা করছি তোমার মনের অবস্থা। এমন কিছু মেনে নেয়াটা সত্যিই খুব কষ্টকর। অপমানজনকও। ইগোতে লেগে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ আমরা না বলতে যতটা অভ্যস্ত, না শুনতে ততটাই অনভ্যস্ত। মানুষকে ফিরিয়ে দিতে পারি অবলীলায়। কিন্তু কেউ আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে মেনে নিতে নিজের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। আমরা ধোঁকা দেয়াটাকে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করি না। কিন্তু অন্য কেউ আমাদেরকে ধোঁকা দিলে সেটাকে শুধু বিশ্বাসঘাতকটাই নয়, অপমানজনক, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধরে নেই। প্রতিশোধের লাভার উদ্গিরণ শুরু হয় মনের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি থেকে। জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চায় ধোঁকাবাজকে।

এটা কি আমাদের হীনমন্যতা স্যার?

উহু, এটা আমাদের অজ্ঞতা। করণীয় হচ্ছে অ্যাকশন বা রিঅ্যাকশন দেখানোর আগে প্রতিটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। এর ভেতরে নিহিত কল্যাণ সন্ধান করা। ধোঁকা বা বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হলে মানুষ প্রথমেই উক্ত ব্যক্তিকে শিক্ষা দেবার কথা ভাবে। কিন্তু ঐ সময়টা আসলে নিজে শিক্ষা নেবার। ভেবে দেখো চলার পথে অসাবধানতায় কোন গর্তে পড়ে গেলে কি তুমি নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করো নাকি গর্তের উপর প্রতিশোধ নেবার কথা চিন্তা করো? চলার পথে প্রতি কদম দেখে শুনে রাখা উচিত। সেটা চিরচেনা কোন পথ হলেও। কারণ তোমার অজান্তে পথের কোন অংশ ধ্বসে গিয়ে ফাঁদে পরিণত হয়নি এর কোন গ্যারান্টি নেই। নিজের উপর ওভার কনফিডেন্টের কারণে তুমি যদি এখন এক্সিডেন্টের স্বীকার হও, সেই দোষ পথের নয়। সেই দোষ তোমার। শিক্ষা তাই তোমাকে নিতে হবে। পথটা মজবুত ছিল না তাই হয়তো হঠাৎ ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। সফরের শুরুতেই ভেঙে পড়েছে সেজন্য তোমার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। এমন দুর্বল পথ ধরেই যদি আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে। এবং মাঝপথে কিংবা গন্তব্যের একদম নিকটে গিয়ে ভেঙে পড়তো। তখন তো তোমার দুর্গতির সীমা থাকতো না। না সামনে এগোতে পারতে, না পেছনে ফিরে আসাটা সহজ হতো। আমি কি বোঝাতে পেরেছি?

হাসির মৃদু রেখে ফুটে উঠলো শাফাতের চেহারাতে। বলল, জ্বি স্যার আমি বুঝতে পারছি। আপনার কথা শোনার পর সত্যিই মনের ভেতরের লাভা শীতল হতে শুরু করছে।

আলহামদুলিল্লাহ। যাইহোক, গত দেড়মাসে তোমাকে দেখে যতটা বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে একজন মুসলিমের জীবনযাত্রা কেমন হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে ঠিক স্বচ্ছ ধারণা নেই তোমার। হসপিটালে নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমরা যারা মুসলিম আছি চেষ্টা করি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে। কিন্তু তোমাকে কখনোই দেখিনি নামাজ আদায় করতে।

সরি স্যার।

আদী হাসি মুখে বলল, সরি বলার কিছুই নেই। তোমাকে হয়তো গুরুত্ব সহকারে শরীয়তের বিধিবিধান সমূহ শেখানো ও বোঝানো হয়নি। তবে তুমি যদি আগ্রহী থাকো আমি ইনশাআল্লাহ তোমাকে সাহায্য করতে চাই এই ব্যাপারে।

জ্বি স্যার অবশ্যই। আমি শিখতে চাই, জানতে চাই। আমি আপনাদের মতো হতে চাই। গত দেড় মাসে হসপিটালের সবাইকে আমার খুব ভালো লেগেছে। অন্যরকম মনেহয় আপনাদের সবাইকে। আমিও এমন হতে আগ্রহী।

আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে আগামীকাল বিকেলে আমরা আবার কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। তোমাকে যে কথাগুলো বললাম ভেবে দেখো। আর যে কোন সমস্যা আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।

শাফাত হেসে বলল, জ্বি স্যার। থ্যাঙ্কইউ।



আরো কিছুক্ষণ শাফাতের সাথে কথা বলার পর বিদায় জানিয়ে গ্যারেজের দিকে হাঁটতে শুরু করলো আদী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন