মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...২০




পেছন থেকে হঠাৎ আপ্পাআআ চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেয়ে এমন ভাবে চমকে উঠলো নূহা। আরেকটু হলেই হাত থেকে হালুয়ার বাটি পড়ে যেতো। নূহাকে চমকে উঠতে দেখে খিলখিল করে হেসে ফেললো জুম্মি। কাছে এসে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল, সরি আপ্পা। আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে ঘাবড়ে দিতে চাইনি।

নূহা হেসে বলল, ইটস ওকে। কখন এসেছিস?

এই তো আপ্পা এখনই এসেছি। সাথে নাভীন, নাবিলা আর চাচীমাও এসেছেন আব্বুর নাস্তার নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে। আমার তোমার সাথে আমার ভীষণ জরুরি এবং গোপনীয় কথা আছে। আম্মু বললো আব্বুর রান্নার সুবাসের কারণে তুমি কিচেনে ঢুকতে পারছো না। তাই হালুয়া রান্না করার জন্য উপরে চলে এসেছো। শুনে আমিও চলে এসেছি সাহায্য করতে এবং সাথে সাথে গোপনীয় কথা শেয়ার করতে।

নূহা হেসে বলল, জানিসই তো আমাদের ফাদার গ্রুপের সবাই হালুয়া ভীষণ পছন্দ করেন। সকাল থেকে বসেই আছি। তাই ভাবলাম হালুয়া বানিয়ে ফেলি কয়েক রকমের। যাইহোক, বল তোর গোপনীয় কথা। শুনছি আমি।

আপ্পা আমারো আজকাল সারাক্ষণ শুধু রান্নাবান্না করতে ইচ্ছে করে। এটাই হচ্ছে গোপনীয় কথা। পড়তে ইচ্ছে করে না একটুও। ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করে না। ট্রেনিংসেন্টারের ক্লাসে যেতেও ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ ইচ্ছে করে নাভীনের জন্য ওর পছন্দের খাবার রান্না করতে। নাভীন যেভাবে পছন্দ করে সেভাবে ঘর বাড়ি সাজিয়ে, গুছিয়ে রাখতে। কিন্তু যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। নাভীন সারাক্ষণ শুধু পড়ো, পড়ো করতেই থাকে। এই নিয়ে দুদিন আমাদের মিনি ঝগড়াও হয়েছে।

ক্লাস টেস্টে রেজাল্ট দেখেছি তোর। দশে তিন পেয়েছিস। এমন ভয়াবহ রেজাল্ট করলি কিভাবে? যেখানে ছোটবেলা থেকে সবসময় ক্লাসের টপার স্টুডেন্ট তুই।

একটুও পড়তে ইচ্ছে করে না আপ্পা। আমি কি করবো বলো? আমার সারাক্ষণ নাভীনের সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নাভীন সারাদিন বাইরে থাকে। বাসায় এসেও বই নিয়ে বসে থাকে। তুমি ভাইজানকে ডেকে বলো নাভীনকে যাতে ধমক দিয়ে দেয় একটা জোরে করে।

তোর কর্মকান্ড শুনলে নাভীনের আগে তোকে লাগাবে জোরে করে এক ধমক।

ধমকের কথা শুনে একটুও দমে না গিয়ে জুম্মি আদুরে কন্ঠে আব্দারের সুরে বলল, আপ্পা আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর পড়াশোনা করবো না। এখন থেকে পুরো দমে শুধু সংসার করবো। তুমি পরিবারের সবাইকে জানিয়ে দাও।

নূহা হেসে বলল, তোর মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। কেন পারছি জানিস?

কেন পারছো?

কারণ বেশ কয়েক বছর আগে বিয়ে নামক দমকা হাওয়া আমার মনের অহর্নিশ প্রজ্জলিত জ্ঞানের শিখাটিকেও এমনি করে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পর সংসার জীবনটাকে এত বেশি আনন্দময় লাগতো যে, সারাক্ষণ সংসারের টুকিটাকি জিনিস নিয়েই মগ্ন থাকতে মন চাইতো। জ্ঞানার্জনটা আমার জীবনের একটি মিশন ছিল। কিন্তু ঘরণী এবং রাঁধুনি সত্ত্বার মুগ্ধতার কাছে উবে গিয়েছিল জ্ঞান পিপাসা। আর লেখা পড়া করবো না এমন একটা আভাস দিতে শুরু করেছিলাম বাড়ির সবাইকে। আমার সকল অন্যায় আবদার সর্বপ্রথম বাবার কাছেই জাহির করতাম। আমার পড়তে ভালো লাগে না শুনে বাবা বললেন, ঠিকআছে মন যখন চাইছে না তাহলে এই বছর নাহয় থাক। এনজয় কর তোর নতুন জীবন। আগামী বছর থেকে আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করিস। বাবার প্রস্তাব পছন্দ না হলেও এই বছরের মত রক্ষা পাওয়া গিয়েছে ভেবে চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। বাবাকে বলেছিলাম আমার যে পড়তে ভালো লাগে না সেটা যাতে কাউকে না বলেন। কিন্তু বাবা ঠিকই তোদের ভাইজানকে বলে দিয়েছিলেন।

জুম্মি হেসে বলল, তখন কি ভাইজান তোমাকে ধোলাই দিয়েছিলেন?

নূহা হেসে বলল, অনেকটা সেরকমই। উনি সেদিন রাতে আমাকে কাছে বসিয়ে বললেন, মনেআছে ছোটবেলায় আমার কাছে গল্প না শুনলে তোমার ঘুমই আসতো না? চলো আজ তোমাকে একটা মজার গল্প শোনাই। এক বহতা নদীর নির্জন বাঁকে জন্ম হয়েছিল দুটি গাছের। একে অন্যেকে অবলম্বন করে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছিল গাছ দুটি। প্রকৃতির সব রূপ একসাথে বরণ করে নিতো দুজন। গাছ ডাল-পালা মেলে, মাটির নীচে শেকড় ছাড়িয়ে দিন দিন শক্ত সামর্থ্য হয়ে উঠছিল। দেখে গাছীরও ইচ্ছে হলো ডানা মেলতে, শেকড় ছড়াতে। সে আব্দারের সুরে গাছকে বলল, এই আমিও ডালপালা ছড়াতে চাই। গাছ হেসে বলল, কি দরকার তোমার শুধু শুধু কষ্ট করার? আমি তো আছি ডালপালা ছড়িয়ে তোমাকে রক্ষা করার জন্য। কিছুদিন পর গাছী আবার বলল, নিজেকে খুব দুর্বল মনেহয় মাঝে মাঝে। শেকড় ছড়িয়ে একটু মজবুত হই? গাছ বলল, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো যে কোন ঝড়ের মোকাবিলার জন্য আমার শেকড়ের শক্তিই যথেষ্ট। গাছীর স্বনির্ভর হবার ইচ্ছে গুলো গাছের কাছে গুরুত্ব না পাবার কারণে গাছী দুর্বল আর গাছ নির্ভর হয়েই রইলো। এরপর একদিন ভীষণ ঝড় উঠলো সেই নদীর অবিবাহিকায়। বাতাসের তান্ডব আর নদীর পানির ঝাঁপটা গাছ একা বেশীক্ষণ হইতে পারলো না। এক এক করে ভেঙে পড়তে শুরু করলো গাছের ডালপালা। দুলতে শুরু করলো গাছে বাতাসের সাথে। গাছী তার দুর্বল শরীর নিয়ে গাছকে সাহায্য করতে চাইলো কিন্তু পারলো না। কারণ সে শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই গাছীর ছিল না। গাছের আগেই যে সমূলে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। কিছুক্ষণ পর প্রচন্ড শব্দে গাছও এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো গাছীর পাশে। গাছী তখন কাতর কন্ঠে গাছকে বলল, তোমাকে বার বার বলেছিলাম আমাকে ডালপালা মেলতে দাও, শেকড় ছড়াতে দাও। কিন্তু তুমি আমাকে সেই সুযোগ দাওনি। যদি দিতে তাহলে আজ হয়তো আমাকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হতো না। তোমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারতাম। গাছও তখন অনুশোচনা ও লজ্জা জড়ানো কন্ঠে বলল, তুমি একদম ঠিক বলেছো। নিজেকে তোমার চেয়ে শক্তিশালী আর তোমার উপর সর্বদা কতৃত্ব বজায় রাখার জন্য আমি তোমাকে ডালপালা মেলে মজবুত হতে দেইনি। যদি দিতাম তাহলে হয়তো আজ আমাদের পরিণতি এমন হতো না। দুজনে মিলে এই ঝড়ের মোকাবিলায় টিকে যেতে পারতাম। গল্প শেষ করে উনি প্রশ্ন করলেন, এখন বলো গাছ আর গাছীর গল্প থেকে কি শিখলে? একই প্রশ্ন আমিও তোকে করছি!

প্রশ্নের জবাব দেবার বদলে চেহারা আঁধারে ঢেকে গেলো জুম্মির।

নূহা হেসে বলল, আমার অবস্থাও তোর মতই হয়েছিল। আমার চেহারা দেখে উনি হেসে বলেছিলেন, সর্বাবস্থায় একে অন্যেকে সাহায্য করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে থাকা উচিত। ক্ষমতা ও যোগ্যতার মাঝে তারতাম্য থাকতে পারে। কিন্তু একজন যোগ্য ব্যক্তি একদম অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়ে কখনোই একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গড়ে তুলতে পারে না। জানো একটি সংসারকে উড়োজাহাজের সাথেও তুলনা করা হয়ে থাকে। স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে সেই উড়োজাহাজের দুইজন পাইলট। দুইজনেরই উড়োজাহাজকে উড়ানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। যাতে একজন কোন কারণে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে গেলে অপরজন পতনের হাত থেকে উড়োজাহাজকে রক্ষা করতে পারে। এটা ঠিক যে আল্লাহর রহমতে তোমার স্বামীর যতটুকু যোগ্যতা আছে। তাতে তোমাকে সংসারের হাল ধরার কোন প্রয়োজন কখনোই পড়বে না ইনশাআল্লাহ। কিন্তু ভবিষ্যৎ তো আমরা কেউ জানি না, তাই না?। যে কোন সময় যে কেউ যে কোন দুর্ঘটনায় পতিত হতে পারে। তখন যাতে সংসার, সন্তান ও নিজেকে অন্তত সামলে নিতে পারো এইটুকু যোগ্যতা তো অন্তত অর্জন করে রাখা উচিত তোমার। আর এই বিষয়টা নাহয় বাদই রাখলাম। সংসার হয়েছে, কয়েকদিন পর সন্তানও হবে তোমার। সেই সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইলেও তো তোমাকে আগে জ্ঞানার্জন করতে হবে। কেননা শিক্ষিত মাই তো শিক্ষিত জাতির কর্ণধারদের জন্ম দেবে তাই না? আমার মনের ঘুমিয়ে যাওয়া জ্ঞান পিপাসা এক ঝাটকায় জেগে উঠেছিল তখন। আলহামদুলিল্লাহ এরপরে আর কোনদিন তাহার ঘুমাইবার সাধ জাগেনি। বরং জ্ঞানের সমুদ্রে আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকার নেশাটা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে দিনে দিনে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে জুম্মি বলল, আমি বুঝতে পারছি আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, জানিস আজকাল চারপাশে যত রকমের সমস্যা দেখি এর মূল কারণ অজ্ঞানতা, অবিদ্যাকে মনেহয়। বলা হয় যে, প্রতিটা মানবের মাঝে একটি করে দানবও লুকায়িত থাকে। আর প্রত্যেকের মাঝে বিদ্যমান দানবের লাগাম তার নিজের হাতেই থাকে। কিন্তু সেই লাগাম টেনে ধরার শক্তি নির্ভর করে সেই ব্যক্তির জ্ঞানের উপর। তাই জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জ্ঞান হচ্ছে আলো। একমাত্র সঠিক জ্ঞানের আলোতেই দূর করা সম্ভব প্রবৃত্তির নানান প্রলোভনের আপতিত অন্ধকার। জ্ঞান আমাদের রাহবার। কখনো যদি দুনিয়ার এই গোলকধাঁধার মাঝে নিজেকে হারিয়েও ফেলি কেউ। জ্ঞান পথপ্রদর্শক হয়ে আবার সঠিক পথ খুঁজে নিয়ে সহায়তা করে আমাদেরকে। জ্ঞান একটি আয়না। যাতে আমরা নিজেদেরকে দেখতে পারি। নিজেদের দোষ, গুণ, অপরগতা, অসহায়ত্বকে দেখতে পারি। যা আমাদেরকে অন্যদেরকে বুঝতে সহায়তা করে। তাই জ্ঞানার্জনের সুযোগ থাকা স্বত্বেও নিজেকে এই নেয়ামত থেকে নিজ ইচ্ছেয় বঞ্চিত করার মতো বোকামো আর হতেই পারে না। কত মেয়েরা আছে যারা জ্ঞানার্জন করার একটু সুযোগের জন্য হাতড়ে বেড়ায় চারপাশ। এই তো মাস দুয়েক আগেই আমার ক্লাসের এক স্টুডেন্ট অনেক মন খারাপ করে জানিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির কেউই চায় না ও স্টাডি কন্টিনিউ করুক। পড়াশোনার কোন ব্যাপারে সাহায্য করা তো দূরের ব্যাপার। উল্টো ক্লাস থেকে ফিরে সংসারের কাজ করার পাশাপাশি নানান ধরণের কথাও শুনতে হয় ওকে। ওর হাজবেন্ডও খুব একটা আগ্রহী নয় পড়াশোনার ব্যাপারে। কিন্তু এত কষ্টের পরেও মেয়েটি জ্ঞানার্জন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ তোর স্বামী, শ্বাশুড়ি দুজনই নিজ সাধ্যের সবটুকুন দিয়ে তোকে সাহায্য সহযোগীতা করতে প্রস্তুত পড়াশোনার ব্যাপারে। তাহলে কেন নিজেকে জ্ঞানের আলো থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাইছিস? তুই যদি ভেবে থাকিস যে, অনেককিছু জেনে ফেলেছিস। আর কিছু জানার দরকার নেই। তাহলে এটা অনেক বড় একটা ভুল ধারণা। যেহেতু এতদিন জ্ঞানার্জনের মধ্যে ছিলি। তাই বর্তমান সময়ে নিজেকে তোর আলোকিত মনেহচ্ছে। কিন্তু আর কয়েকটা দিন পার হলেই সেই আলো কমতে শুরু করবে। একটা সময় ম্লান হতে হতে নিভে যাবে।

আপ্পা আমি আসলে এভাবে চিন্তাই করিনি। আমি আসলেই একটা বোকা মেয়ে। নয়তো কি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার জন্য এমন পাগল হতাম। জানো আমাদের ক্লাসের একটা মেয়েরও কিছুদিন আগে বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেদিন কথায় কথায় বললো, ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও নাকি ওর স্টাডির ব্যাপারে খুব একটা ইন্টারেস্টেড না।

আসলে বর্তমানে শরীয়তের বিধি-বিধানের চেয়ে সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার দ্বারা বেশী প্রভাবিত হবার কারণে বিয়ে বিষয়টা দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। আবার বিয়েতে নানান ধরণের কন্ডিশনের মধ্যে মেয়ে ও তার পরিবারের প্রতি একটি কন্ডিশন এটাও থাকে যে, বিয়ের পর পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। এর পেছনে নানান ধরণের যুক্তি থাকে। যেমন, এতে সংসারের ব্যাপারে মেয়েরা মনোযোগী হতে পারে না, আমাদের চাকরীজীবী বৌয়ের কোন দরকার নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কোন যুক্তি খন্ডন করতে চাই না। তবে আমি মনেকরি, একটি মেয়ের জ্ঞানার্জনের পেছনে একমাত্র কারণ অর্থাপার্জন নয়। প্রতিটি মানুষকে শিক্ষিত হতে হবে তার নিজের জীবনকে কল্যাণের পথে টেনে নিয়ে যাবার জন্য। জ্ঞানের আলোয় নিজে আলোকিত হয়ে সেই আলো চারপাশে ছড়িয়ে দেবার জন্য। অনেকের মুখেই শুনেছি মেয়েরা বেশি শিক্ষিত হয়ে দাম্ভিক হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বলবো, যারা দাম্ভিক হয় তারা শুধু সার্টিফিকেট ধারী শিক্ষিত। তারা কখনোই জ্ঞানী নয়। কারণ জ্ঞানের উত্তাপে ব্যক্তি চারপাশকে আলোকিত করে নিজেকে গলিয়ে। একদম মোমবাতির মত। অবশ্য এটাও ঠিক যে, পড়াশোনা সাথে সাথে সংসার সামলানোটা কিছুটা কঠিন কাজই বটে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই খুব সহজেই সেটা দূরীভূত করা সম্ভব। আসলে কি জানিস? জীবনে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তাটা আমরা সেভাবে করে জানি না বা অনুভব করি না বলেই হয়তো ত্যাগের লিষ্টে সবার আগে থাকে শিক্ষার নাম। জীবনকে আলোকিত করার আশায় আমরা তাই সেই উৎসটিকেই নিভিয়ে দেই যেটা থেকে জীবনে ছড়ায় আলোয় বিচ্ছুরণ।

একদম ঠিক বলেছো আপ্পা। আবেগের বশে কি ভুল সিদ্ধান্তটাই না নিতে যাচ্ছিলাম। অনেক জাযাকাল্লাহ আপ্পা আমার ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য। ইনশাআল্লাহ আজ থেকেই আমি আবার সিরিয়াসলি পড়াশোনা শুরু করবো।

নূহা হেসে বলল, এই তো গুড গার্ল। এখন বল গাজরের হালুয়া টেষ্ট করে দেখবি নাকি মুগডালের হালুয়া? অবশ্য পেঁপের হালুয়াও আছে।

সবগুলোই করবো। তবে তারআগে তোমার জন্য যে উপহার নিয়ে এসেছি সেগুলো নিয়ে আসি। বলা মাত্রই ছুট লাগালো জুম্মি। কিছুক্ষণ পরই এক হাতে বই অন্য হাতে পাতাবাহারের চারা গাছ নিয়ে হাজির হলো। উপহার নিয়ে জড়িয়ে ধরে জুম্মিকে আদর করে দিলো নূহা।

জুম্মি হেসে বলল, বই আমি কিনেছি তোমার জন্য। গাছ নাভীন কিনেছে। তুমি সবাইকে গাছ আর বই উপহার দাও। তাই তোমার জন্যও গাছ আর বই নিয়ে এসেছি আমরা দুজন।

নূহা হেসে বলল, অনেক অনেক জাযাকাল্লাহ দুজনকেই। ছোটবেলা থেকেই উপহার দিতে এবং পেতে আমি ভীষণ পছন্দ করি। কাছের দূরের পরিচিত সবাই জানেন উপহার হিসেবে বই আর গাছ আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ। তাই এই দুটো জিনিসই সবচেয়ে বেশী উপহার পাই আমি সাধারণত। আবার কাউকে দেবার ক্ষেত্রেও এই দুটি জিনিসই আমার প্রথম পছন্দ থাকে। যদিও কিছুটা বড় হবার পর যখন পরিবারের বাইরের মানুষদের উপহার দিতে শুরু করলাম। তখন বুঝতে পারতাম অনেকেই আমার দেয়া উপহার পেয়ে খুব একটা খুশি হচ্ছে না। অথচ বাবা শিখিয়েছিলেন ভালো বই হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক। আর গাছ হচ্ছে সজীবতা আর ত্যাগের প্রতীক। গাছ আমাদেরকে শেখায় কিভাবে প্রকৃতি থেকে অশুদ্ধ কিছুকে শুষে নিয়ে নির্মলতা ছড়িয়ে দিতে হয়। এবং জ্ঞান আমাদের সামনে নিত্যনতুন পন্থা উন্মোচন করেন কিভাবে প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেকে সজীব রাখা যায়। কিন্তু যখন এই অসাধারণ সুন্দর উপহার দুটিকে অবহেলিত হতে দেখতাম তখন খুব খুব বেশী কষ্ট পেতাম। একদিন মনখারাপ করে বাবাকে একথা বললে, বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, দুনিয়াতে প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তাদের পছন্দ-অপছন্দও আলাদা। তাই কেউ যদি তোর অপছন্দের জিনিসকে অপছন্দ করে তাতে মনখারাপের কিছু নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক। কখনো যদি কেউ তোর পছন্দে আপ্লুত হয় সেটা হচ্ছে অনেক বড় একটা প্রাপ্তি বা রিটার্ন গিফট।

জুম্মি হেসে বলল, ফুপাজানের কথা শুনলে মন খারাপ ভাব মূহুর্তেই দূর হয়ে যায়। তাই না আপ্পা?

হুম, আলহামদুলিল্লাহ। তবে সেদিন বাবা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কাউকে উপহার দেয়া উচিত সে যা পছন্দ করে সেটার উপর ভিত্তি করে। আমি বাবার অতি বাধ্য কন্যা ছিলাম। বাবা যা বলতেন বিনা তর্কে মেনে নিতাম সবসময়। কিন্তু সেদিন বাবার কথাটি আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। একজন গান শুনতে পছন্দ করতেই পারে। তাই বলে তাকে নিশ্চয়ই আমি গানের সিডি কিনে উপহার দেবো না? কিন্তু আবার এটাও মনেহলো যে, আমার উপহার পেয়ে যদি কেউ খুশিই না হয় তাহলে সেটা দেয়াটাই কি ব্যর্থ হয়ে যায় না? এমন দোলায়িত মন নিয়ে ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম। ভাইয়া হেসে বললেন, কাউকে উপহার দেবার সময় আমি না নিজের পছন্দ বিবেচনা করি, না যাকে দেবো তার পছন্দের কথা চিন্তা করি। আমি কাউকে সেই জিনিসই উপহার দেই যা তার ঐ মূহুর্তে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। যেমন ধরো, কেউ হয়তো টাকার অভাবে বই কিনতে পারছে না। তাকে উপহার স্বরূপ শার্ট বা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে লাঞ্চ করানোর চাইতে, বই কিনে দেয়াটাই আমি পছন্দ করবো। কারো হয়তো মানসিক সাপোর্টের প্রয়োজন। তাকে খুব সুন্দর একটা শোপিস কিনে দেবার চাইতে তাকে নিরবিচ্ছিন্ন খানিকটা সময় দেয়াটাকেই আমি ঐ মূহুর্তে জন্য তাকে দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার মনেকরি। আবার ধরো কেউ একটা কিছু নিয়ে খুব সমস্যায় আছে। তার সাহার্যার্থে এগিয়ে যাওয়াটাকেও আমি তার এবং আমার উভয়ের জন্য উপহার মনেকরি। ভাইয়ার কথাগুলো শুনে মনে হয়েছিল ঠিক এমন কিছু কথাই শুনতে চাইছিলাম আমি।

উফফ, ভাইজানের কথা মানে তো শুধু জাদু আর জাদু। মাশাআল্লাহ।

নূহা হেসে বলল, আমাদের বিয়ের পর কয়েকমাস আমরা আলাদা বাসায় ছিলাম। ঐ সময় সংসার, ক্লাস সবকিছু মিলিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতাম। উনি আমাকে অনেক বেশী সাহায্য করতেন। কিন্তু উনার কিছু কিছু সাহায্যকে জীবনে পাওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার বললেও কম বলা হয়ে যাবে। এমনিতে সবসময় বাসায় ফিরে দুজন একসাথে রাতে রান্না করতাম। কিন্তু কোন কোন দিন পড়ার চাপে রান্না করা সম্ভব হতো না। সেদিন হয়তো উনিও বাসায় ফিরতে অনেক রাত করে ফেলতেন। পরদিন ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে বাসায় ফেরার পথে যখন মনে হতো বাসায় গিয়ে রান্না করতে হবে। শরীর আরো দুর্বল হয়ে যেত, কান্না পেতো। এমন দুর্বল মন নিয়ে ঘরে ঢুকে যখন দেখতাম আমার পছন্দের কোন খাবারের ঘ্রাণ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে আনন্দ আর প্রাপ্তিতে চোখ ভরে যেতো। এমন শুধু একদিন দুদিন না। অসংখ্য দিন উনি আগেই বাইরে থেকে এসে রান্না করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছেন। আবার যখন কনসিভ করেছিলাম ভয়াবহ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। হসপিটালে থাকতে হয়েছে বেশ কিছুদিন। বাসায় ফেরার পর খাবার তো দূরের কথা কোন মানুষ কাছে আসলেও গন্ধে বমি আসতো। উনি অন্য কাউকে তো আমার কাছে আসতে দিতেনই না এমনকি নিজেও আসতেন না। আলাদা রুমে ঘুমোতেন। আবার আমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি সেই ভয়তে শান্তি মতো ঘুমোতেও পারতেন না। তখন আমার রুমে এসে সোফায় বসে থাকতেন। কিংবা সোফাতেই ঘুমোতেন। উনি ততদিন পর্যন্ত আমার কাছে আসেননি, যতদিন পর্যন্ত আমি নিজ মুখে না বলেছি যে, এখন আর গন্ধ লাগে না কোন কিছু থেকে। কখনো ইচ্ছে হতো জিলাপি খাবো কিংবা স্পাইসি কিছু। সাথে সাথে বানিয়ে আনতেন। কিন্তু সেই খাবার দেখার সাথে সাথেই ইয়াক ইয়াক শুরু করতাম। কখনো বমি করে ঘর বাড়ি ভাসিয়ে ফেলতাম। উনি কোনকিছু নিয়েই রাগ করা তো দূরে থাক একটু বিরক্তও হননি আমার উপর। শরীর অসুস্থের কারণে ক্লাসে যেতে পারতাম না। উনি প্রফের সাথে কথা বলে প্রতিদিনের লেকচারের অডিও আনানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আর নিজে তো পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করতেনই যতটা সম্ভব। আমি তখনো বলতাম, এখনো বলি, ছোটবেলা থেকে আমাকে অসংখ্য উপহার দিয়েছেন । কিন্তু এই উপহার গুলোর পাশে অন্য আর সব উপহার ম্লান হয়ে যায়।

আপ্পা তুমি এই কথাগুলো নাভীবকেও বলবে প্লীজ। আজই বলবে। প্লীজ আপ্পা প্লীজ। আমি বললে কখনোই এই কথাগুলোর গভীরতা সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না।

নূহা হেসে বলল, নাভীনের চিন্তা তোকে করতে হবে না। নাভীনকে যা বলার দরকার সেইসব কিছু বলার জন্য আমার চেয়েও অনেক উত্তম কেউ আছেন। তুই তোর নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে সিনসিয়ার হবার চেষ্টা কর। পরশু আইডিয়া চাচ্ছিলি না আমার কাছে নাভীনকে সারপ্রাইজ গিফট দেবার ব্যাপারে?

হ্যা চেয়েছিলাম তো। কিন্তু তুমি তো কোন আইডিয়া দিলে না আমাকে। বলে দাও না আপ্পা এমন কোন উপহারের আইডিয়া যার রেশ সারাজীবন আমাদের পিছু পিছু চলবে, মিষ্টি ভালোবাসাময় সুখানুভূতি পরশ নিয়ে। বুকস, ড্রেস, ফ্লাওয়ারস, সারপ্রাইজ ট্যুর ইত্যাদির সবকিছুই একটা সময় পুরনো হয়ে যায়। নতুন কিছু এসে সেটার জায়গা দখল করে নেয়। আমি এমন কিছু উপহার দিতে চাই যা সবসময় আমাদের মনে দিয়ে যাবে নতুনত্বের আস্বাদন। যে উপহার প্রাপ্তির মুগ্ধতার ছোঁয়ায় হৃদয়কে তোলপাড় করে দুআঁখি গলে বেড়িয়ে আসবে আনন্দ্রাশ্রু রূপে।

নূহা হেসে বলল, আইডিয়া দেবার জন্যই তো আমার নিজের জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার গুলোর মধ্যে থেকে কয়েকটা শেয়ার করলাম তোর সাথে। ঐসব মুহুর্তের কথা ভাবলে এখনো আমার মনে আনন্দের ঝড় ওঠে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হয় অন্তর। অন্তঃরাত্মা থেকে ঢেউয়ের মত ছলকে ছলকে দোয়া বেড়িয়ে আসে সেই মানুষটির জন্য। যিনি আমার জীবনের সমস্ত জটিল, কঠিন মুহূর্তগুলোকেই আমার জন্য এক একটি উপহারে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। অনেক অনেক বেশী সুন্দর একটা মন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উনাকে দিয়েছিলেন। যে মনটি সর্বদা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছে আমার মনকে স্ব মহিমায়। আমি ভুলে গেলেও তাই আমার মন কখনো ভুলে যায় না সেই মানুষটির জন্য আকুল হয়ে আমার রব্বের কাছে দোয়া করতে।

আলহামদুলিল্লাহ। আমি বুঝতে পেরেছি আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে এখন চলেন নিচে যাই। সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে নাস্তার টেবিলে বসে গিয়েছে।


জুম্মি হেসে বলল, হ্যা আপ্পা চলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন