মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...১৮



রান্নাঘরের দরজার কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই জাওয়াদের মনেহলো ভাগ্যিস গতরাতের খাবার সব হজম হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে। তা না হলে নির্ঘাৎ মামার রান্নার সুবাস সহ্য করার অক্ষমতার কারণে বাইরে বেরিয়ে আসতো। ভেতরে না ঢুকে দরজা থেকেই পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু ততক্ষণে সুহাইব সাহেব দেখে ফেলে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললেন, জাওয়াদ তুমি দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো আব্বা।

শুধুমাত্র রান্নার তীব্র দুর্গন্ধের কারণে এমন ভালোবাসাময় আহ্বান এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ভেতরে ঢুকে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, কি অবস্থা রান্নার?

এই তো প্রায় শেষ। রান্না করতে করতে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করলাম বুঝলে বাবা। কিছুক্ষণ আগে নূহা উঁকি দিয়েছিল। বললাম, মা একটা কবিতা রচনা করেছি। শুনে বল তো কেমন হয়েছে। নূহা কবিতা না শুনেই ইয়াক বলে দৌড়ে পালালো। আধ পাগলী মেয়েটা না শুনেই আমার কবিতাকে ইয়াক বললো কেন বলো তো? রান্না শেষ করেই আমি দুষ্টু মেয়ের কাছে কৈফিয়ত চাইতে যাবো।

জাওয়াদ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিল কবিতার কথা শুনে না। রান্নার সুবাসের কারনে নূহা ইয়াক বলে পালিয়ে গিয়েছে। তবে মামাকে সেই তথ্য জানিয়ে ব্যথিত না করতে চাইলো না। হাসি মুখে বলল, বাদ দাও মামা ঐ আধ পাগলী মেয়ের কথা। আমাকে শোনাও তোমার কবিতা।

সুহাইব সাহেব আনন্দময় কন্ঠে বললেন, “মন দুটি যেন স্বপ্নের আনন্দময় ঘর, প্রকৃতি যাদের বড়ই মায়াবী মনোহর। বাগিচায় কোলে হরেক রঙা ফুল হাসে, ফুলের বুকে সুখ ছড়িয়ে প্রজাপতি ভাসে। দোলনায় দোলে দুটি পাখি, রূপ রহস্যে ভরা যাদের আঁখি। একজনের আছে বৃক্ষছায়া, অন্যজনের অন্তর ছোঁয়া মায়া। যারা শব্দে শব্দে ছড়ায় যাদু, তিক্ত প্রাণে ভরায় মধু। একে অন্যেকে আঁকড়ে থাকে, চলার পথের প্রতিটি বাঁকে। সুখ স্বপ্নের উষ্ণ আলিঙ্গনে, মগ্ন তারা সুন্দরের নিমন্ত্রণে

জাওয়াদ হাসি চেপে বলল, মাশাআল্লাহ! অসাধারণ কবিতা মামা। আমি বিমুগ্ধ।

এই কবিতাটা তোমার আর নূহার জন্য উপহার আমার পক্ষ থেকে। বলো তো কেন?

তুমিই বলে দাও মামা।

নিজেরা নিরানন্দের ডুবে থেকেও আনন্দবাড়ির বাকি সদস্যদের জন্য মুঠো মুঠো আনন্দ ছড়ানোর জন্য।

জাওয়াদ হেসে বলল, জাযাকাল্লাহু খাইরান মামাজান। তবে আমরা কেউই নিরানন্দে ডুবে নেই। আমরা দুজনই নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছি সন্তোষ ভরা চিত্তে আমাদের রব্বের সন্তুষ্টি আদায়ের লক্ষ্যে। আলহামদুলিল্লাহ।  

সুহাইব সাহেব হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। জুম্মিকেও ফোন করে দিয়েছি যাতে জামাইকে নিয়ে চলে আসে। আমরা সবাই একসাথে আনন্দ করবো। অথচ জুম্মি থাকবে না এটা কি হয় বলো?

কখনোই হওয়া উচিত নয়। খুব ভালো করেছো জুম্মি আর নাভীনকে আসতে বলে।

বেশ গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে সুহাইব সাহেব বললেন, একজন বাবার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টের একটা মেয়ের বিয়ে দেয়া বুঝলে জাওয়াদ। আদরের মেয়েটাকে অন্যের হাতে তুলে দেবার চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছুই নেই। তুমি শুধু একবার চিন্তা করার চেষ্টা করে দেখো নাবিহার বিয়ের কথা! ফিল করবে বাতাসে কোন অক্সিজেনই নেই। দম বন্ধ করা অবস্থা সৃষ্টি হয়। আমার শুধু মনেহয় জুম্মির বিয়ে নিয়ে বেশি তাড়াহুড়া হয়ে গিয়েছে। আরো দু'এক বছর অপেক্ষা করা যেত। তোমার কি মনেহয়?

জাওয়াদ হেসে বলল, আমার মনেহয় আরো দু'এক বছর আগেই বিয়ে দেয়া উচিত ছিল।

তুমি যা মিন করছো বুঝতে পারছি। আমিও ফিল করি আমাদের এই জেনারেশনের বাচ্চাগুলো তোমাদের মতো না। তোমরা অনেক বেশি সতর্ক ছিলে নিজের এবং পরিবারের প্রতিটা ব্যাপারে। কিন্তু ওদের মধ্যে তোমাদের সেই দৃঢ়তা খুঁজে পাই না। তারউপর এতটা যত্ন সহকারে শরীয়তের প্রতিটা বিষয় ছোটবেলা থেকে শেখানোর পরেও ওদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভুলের পথে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। এটা আমার জন্য খুবই কষ্টের। এই যেমন, নাভীনের বিয়ের জন্য যখন আমরা পাত্রী খুঁজছিলাম। জুম্মি তখন এসে জানালো নাভীনকে ওর লাইফ পার্টনার হিসেবে পছন্দ। সবার সামনে জুম্মির এমন স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে আমি খুবই ব্যথিত হয়েছিলাম।

জাওয়াদ হেসে বলল, স্পষ্ট ভাবে কথা বলার শিক্ষা ছোটবেলা থেকে আমরাই ওদেরকে দিয়েছিলাম মামা। জুম্মির স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে তাই আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। একটা কথা আছে না মামা যে, আগে তিতা পরে মিঠা ভালো। সম্পর্কের বন্ধনে স্পষ্টবাদীতা অনেকটা আমলকীর মতো। তাৎক্ষণিক খানিকটা তেঁতো লাগলেও, পরবর্তীতে মিষ্টতাই ছড়ায়। আর জীবনসাথী হিসেবে কাউকে পছন্দ করতে কিন্তু নিষেধ নেই। সীমালঙ্ঘন করাটা নিষিদ্ধ। আলহামদুলিল্লাহ জুম্মি কিংবা নাভীন কেউই সীমালঙ্ঘন করেনি। নিজেদের ভালো লাগার কথা স্বীকার করে নিয়ে বরং আমাদেরকেও সাহায্য করেছে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে। অবশ্য আমার ধারণা নাভীনের জায়গায় অন্য কেউ হলে তুমিও খুশি হতে জুম্মির স্পষ্টবাদীতায়।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুহাইব সাহেব বললেন, নাভীন তোমার ছত্রছায়ায় বড় হয়েছে। তাই ওর বাবার অন্যায় কাজের জন্য নাভীনকে কখনোই আমি অপছন্দ করিনি। কিন্তু সাথে সাথে এটাও ঠিক পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারি না নাভীনকে। ওর বাবার কারণে আমাদের পুরো পরিবারকে যে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেটা ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তুমি কিভাবে সবকিছু ভুলে নাভীন, নাবিলা আর ওদের মাকে আপন করে নিয়েছিলে আমি এখনো ভেবে পাই না।

মেঝমামা আমাদের সাথে যা কিছু করেছে এতে তো নাভীন, নাবিলা আর মেঝমামীর কোন দোষ ছিল না। বরঞ্চ উনাদের উপরও অনেক অন্যায় ও অবিচার করেছে মেঝমামা। মেঝমামা যখন মামীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। আমার কাছে উনাদের পাশে যেয়ে দাঁড়ানো টাকেই নিজের দায়িত্ব বলে মনে হয়েছিল। আমি তখন সেটাই করতে চেষ্টা করেছি। এমনটা না করে যদি মেঝমামার ভুলের বোঝা আমরা ওদের উপর চাপিয়ে দিতাম। সেটাই তো ভুল হতো তাই না?

সবই বুঝি বাবা। কিন্তু নাভীন, নাবিলাকে দেখলেই চোখের সামনে ঐ মনুষ্য রুপী শয়তানটার ছবি ভেসে ওঠে। আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। তবে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ হচ্ছে বিয়ের বয়সী যে কয়জন আছে বর্তমানে। সবার বিয়ে ঠিক করে ফেলো। নায়লার মধ্যে কান্ড যাতে আর কেউ ঘটাতে না পারে। নায়লার ঘটনাটা জানার পর ভীষণ অবাক হয়েছিলাম আমি। তুমিও হয়েছিলে জানি।

জাওয়াদ হেসে বলল, না মামা আমি অবাক হই না আমার ছোট ভাইবোনরা এমন কোন ভুল করে ফেললে। এটা ঠিক যে, কারো দ্বারা যাতে কোন ভুল সংঘটিত না হয়। সেজন্যই এত সব নিয়মকানুন মেনে চলতে উৎসাহিত করা হয়েছে ওদেরকে ছোটবেলা থেকে। ঠিক তেমনি কারো না কারো দ্বারা কখনো না কখনো ভুল হয়েই যাবে এটার জন্যও প্রস্তুত থাকতে চেষ্টা করি। কারণ সাধ করে তো কেউ এক্সিডেন্ট করে না। কখনো অন্যের দোষে, কখনো বা নিজের এক মূহুর্তের অসতর্কতায় ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু। তাই ছোটরা যখন ভুল করে তখন ব্যথিত হলেও ওদের ভুলটাকে উত্তম রূপে শুধরে দেয়ার চেষ্টা করাটাই উত্তম মনেহয় আমার কাছে। তাছাড়া শরীয়তের বিধি নিষেধ মেনে চলার অর্থ তো নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে এড়িয়ে চলা নয়। ভালো লাগার স্রোতে ভুলের পথে ভেসে যাওয়াতে আপত্তি, বিপত্তি। কিন্তু ভালো লাগাকে নিজের জন্য জায়েজ করে নেয়াটা সাহসীকতা ও বুদ্ধিমত্তা।

সুহাইব সাহেব হেসে বললেন, জাওয়াদ সত্যি করে বলো তো তোমার মনের মধ্যে কি এখনো গিল্ট কাজ করে নূহার আর তোমার সম্পর্ককে ঘিরে? তোমার কথাবার্তায় আমি বার বার ফিল করি। যখনই পরিবারে এমন কিছু সংঘটিত হয় তুমি কেমন খানিকটা গুঁটিয়ে যাও। এসব ব্যাপারে কাউকে বোঝানোর দায়িত্বও তুমি নিতে চাও না সহজে। নূহার দিকে ঠেলে দাও সবকিছু। অথচ অন্যান্য সব ব্যাপারে তুমি নূহার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নাও। তুমি এখনো লজ্জা পাও তোমাদের সম্পর্কের কথা ভেবে তাই না? এখনো সংকোচ বোধ করো। আমার ধারণা কি ঠিক?

মূহুর্তেই লাজুকতা মাখানো হাসি ছড়িয়ে পরলো জাওয়াদের চেহারা জুড়ে। কিছুটা সময় নিয়ে বলল, মামা ছোটবেলায় নূহাকে আমি অনেকটা নিজের সন্তানের মতো বড় করেছিলাম। নূহা আর আমার মধ্যে যা ঘটেছে তা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। এমন কিছুর পারমিশন এখনো আমার বিবেক আমাকে দিতে চায় না। আমি কিছুতেই এই হিসাবটা মেলাতে পারি না। ভাবতে গেলেই সঙ্কুচিত হয়ে যাই। চারপাশ থেকে কেন, কেন, কেন এই প্রশ্ন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে। আমি কখনোই মানুষ কি বললো, না বললো সেটা কেয়ার করি না। আমার কাছে জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে একমাত্র মানদন্ড শরীয়ত। শরীয়ত যেহেতু আমার আর নূহার বিয়ের পারমিশন দেয়। সুতরাং, এই ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগার কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু আমি তখনো অস্বস্তিতে ভুগেছি, এখনো হুবহু একই রকম অস্বস্থি ফিল করি নিজের মধ্যে। ঐ সময় শুধুমাত্র নূহা প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিলো বলেই আমি আমাদের সম্পর্কটাকে নতুন আরেকটি নাম দেবার জন্য রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শুধু নিজের জন্য হলে কখনোই আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতাম না। আমার তরে এমন উদাহরণ সেট করতাম না পরিবারের নেক্সড জেনারেশনের জন্য। আমি সারাটা জীবন নিরলস পরিশ্রম করেছি সবদিক দিয়ে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার। কষ্টের সাগরে আকন্ঠ ডুবে গেলেও এমন স্পর্শকাতর একটা ব্যাপারে আমি নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হতে দিতাম না। কারণ আমার জানা ছিল এরফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ একটা অধ্যায়। অর্থাৎ, বিয়ের ব্যাপারে নেক্সড জেনারেশনের কাছে আমি নিজেকে দৃঢ় ভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হবো। এবং হচ্ছিও। আমি প্রচন্ড ভায় পাই এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে। মনেহয় কেউ যদি উল্টে আমাকে প্রশ্ন করে। কি জবাব দেবো? যদিও জানি এটা আসলে আমার মনের দুর্বলতা। নয়তো পরিবারের সবাই কম-বেশি জানে এবং বোঝেও আমাদের ব্যাপারটা।

শুধুমাত্র নূহাকে কষ্ট পাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য তুমি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে? নতুন করে আবারো নূহার প্রতি তোমার ভালোবাসার গভীরতাকে উপলব্ধি করলাম আজ। হাসি মুখে বললেন সুহাইব সাহেব।

এটা ভালোবাসার গভীরতা কিনা জানি না মামা। তবে এখনো পর্যন্ত নূহার কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্টের আমার জন্য কিছুই নেই পৃথিবীতে। অথচ আমি নিজেও কিন্তু অনেক সময় আঘাত করি নূহাকে বিভিন্ন ভাবে। আগেও করেছি, এখনো কথা শোনানোর কোন একটা সুযোগ আমি হাতছাড়া করি না। একটা জায়গায় বরং দশটা কথা শুনিয়ে দেই। কিন্তু নূহা কষ্ট পাচ্ছে এই চিন্তাটার উদ্রেক যখনই হয়। আমার পুরো দুনিয়া থমকে যায় ঐ মূহুর্তের মাঝে। কিন্তু নূহার কষ্টের প্রতি আমার এই অনুভূতি কোন প্রেমিক পুরুষের না। এই অনুভুতি আমার সেই স্বত্তার। যে পৃথিবীতে আসার পর থেকেই ভালোবাসার আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়েছিল নূহাকে। ছোট্ট নূহার কাছে আমি বাবার মত ছায়াবৃক্ষ হতে চেষ্টা করেছি। ভাইয়ার মতো শত আবদার মেনে নিয়েছি। শিক্ষক রুপে জীবনবোধের শিক্ষা দিয়েছি। বন্ধু হয়ে অবুঝ নূহাকে বুঝে নিয়েছি। কিন্তু প্রেমিক বা হাজবেন্ড হতে চাইনি কখনোই। মামণি যখন নূহার জন্য রাজপুত্র কোথায় পাবে সেই চিন্তা করতো। আমিও চিন্তায় মশগুল হতাম। কিছুক্ষণ আগে তুমি বললে না যে, মেয়ের বিয়ের কথা চিন্তা করলেই মনেহয় বাতাসে কোন অক্সিজেন নেই। নূহার বিয়ে কথা চিন্তা করতে গিয়েই জীবনে প্রথম আমি এমন পরিস্থিতির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। আমাদের ফুল বাগানের সবচেয়ে আদুরে ফুলটা কোথায় যাবে, সেখানে ওর যথাযথ আদর, কদর হবে কিনা ভেবে প্রায়ই শঙ্কিত হতাম। কিন্তু নূহাকে নিজের করে পেতে চাইবার চিন্তা করাটাও আমার কল্পনার বাইরে ছিল। তবে নূহা আর আমার সম্পর্কের পরিণতি দেখে আবারো উপলব্ধি করেছিলাম, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতিটা বিধি নিষেধ মেনে চলাটা কতটা জরুরি। নূহার জায়গায় যদি তাসমিয়া আমাকে নিয়মিত মেইল করতো। পরিবারের সবার খোঁজ খবর জানাতো। তাহলে কিন্তু কখনোই অন্য রকম ভালো লাগার জন্ম হতো না। কারণ তাসমিয়া আমার আপন ছোটবোন। আর এই তথ্য সম্পর্কে আমার মনের চেতন, অবচেতন, অচেতন সমস্ত অবস্থাই অবগত ছিল। যদিও তাসমিয়ার চাইতে হাজার গুণ বেশি আদরের ছিল নূহা আমার কাছে। কিন্তু যেহেতু আমরা মাহরাম ছিলাম না একে অন্যের জন্য। এবং অবচেতন মনের সেটা জানা ছিল। তাই আমাদের ভালো লাগা ভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে আমাদের অজানতেই। এটা অনেক বড় একটা শিক্ষা মামা আমার জন্য। আমার আর নূহার সম্পর্ক যেখানে এমন পরিণতিকে পৌঁছাতে পেরেছে। সেখানে জুম্মি, নাভীন ওদের মনে ভালো লাগার জন্ম হতেই পারে একে অন্যের প্রতি। আবার এটাও ঠিক যে, আমার সাথে এমনটা না হলে হয়তো আমি এত সহজ ভাবে মেনে নিতে পারতাম না মানবিক দুর্বলতার এই বিষয়গুলো। খুব বেশি কঠোর থাকতাম ছোটদের সাথে এসব ক্ষেত্রে। বোঝার চেষ্টা না করে বোঝানোর কিংবা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম নিজের সিদ্ধান্ত। মোটকথা, আমার মনের একটা রুদ্ধ জানালা খুলে দিয়েছিলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এভাবেই। এরআগে আমি মনের পছন্দ, ভালো লাগাগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ ছিলাম। অকারণ দৃঢ়তা ছিল কিছু ব্যাপারে। কারো প্রতি ভালো লাগার প্রকাশকেও নাজায়েজ মনে হতো। নিজে নিজেই জায়েজের সীমাকে সঙ্কুচিত করে নিয়েছিলাম। অনেক বেশি অনুদার ছিলাম এই ব্যাপারগুলোতে।

সুহাইব সাহেব হেসে বললেন, এখন অবশ্য আমারও এমনটাই মনেহচ্ছে। এখন আর আমার মনে কষ্ট নেই জুম্মির স্পষ্ট স্বীকারোক্তিকে ঘিরে। আলহামদুলিল্লাহ সঠিক সময়ে জুম্মি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল বলেই। আমরাও সঠিক সময়ে বিয়ে দিতে পেরে ওদেরকে ভুলের স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে প্রতিহত করতে পারেছি।

হুম! আলহামদুলিল্লাহ।

তবে আগে বাড়িতে ফিরলেই সবার আগে ছুটে আসতো জুম্মি। পুরো বাড়িটাই কেমন যেন আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল জুম্মির বিয়ের পর। নূহা উপরের ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে তোমার মামী আর আমার জীবনে আবার আলো ফিরে এসেছে। বাড়িতে ফিরে যখন দেখি নূহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখা মাত্রই হেসে হাত নাড়ে তখন মন ভালো হয়ে যায়। পলকেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বাবাদের জন্য মেয়েরা আসলে জাদুর ছড়ি।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এতে কোনই সন্দেহ নেই। যাইহোক, আমি কোন সাহায্য করবো তোমাকে?

সাহায্য আমিও চাইতে যাচ্ছিলাম তোমার কাছে। তুমি যখন এসেছোই সাফিনের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেও। একটু বোঝাতে চেষ্টা করো ওকে। প্রায় চার মাস তো পেরিয়ে গেলো। আর কতদিন নিজেকে এমন সবার কাছ থেকে, সবকিছু বিচ্ছিন্ন করে রাখবে? কতদিন এভাবে স্বেচ্ছা বন্দিত্বের জীবন যাপন করবে? আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আদী আর নূহাকে দিয়েও চেষ্টা করেছি বোঝাতে। এখন শুধু তুমিই আছো যার কথা হয়তো সাফিন শুনবে ইনশাআল্লাহ।

জাওয়াদকে নীরব থাকতে দেখে বুকের ভেতরটা প্রচন্ড ভারী হয়ে উঠলো সুহাইব সাহেবের। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন, তোমার মামীমা যখন প্রথম কন্সিভ করেছিল ছুটে বড়আপার কাছে গিয়ে বলেছিল, বড়াপা আমার মেয়ে হলে কিন্তু জাওয়াদের সাথে বিয়ে দেবো। আপনি ওয়াদা করেন আমার কাছে অন্য কারো সাথে জাওয়াদের বিয়ে ঠিক করতে পারবেন না। বড়াপা প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল আলিফার কথা। কিন্তু নাছোড় বান্দাহ বলে কথা। ওর ঘ্যানঘ্যানে অতিষ্ট হয়ে বড়াপা বলেছিলেন, আচ্ছা যাও আমার পক্ষ থেকে ওয়াদা রইলো। জাওয়াদ যদি আপত্তি না করে তোমার মেয়েই হবে আমার পুত্রবধূ। তখন তোমার মামীমার খুশি যদি দেখতে। ছোট্ট খুকিদের মতো লাফানো শুধু বাকি রেখেছিল। কিন্তু বেচারীর সকল আশায় গুঁড়ে বালি পড়লো যখন আমাদের ছেলে হলো। ইফতিতে কোলে নিয়ে করুণ কন্ঠে বলেছিল, কি হতো তুই মেয়ে হলে?

জাওয়াদ হেসে ফেললে সুহাইব সাহেবও স্বশব্দে হেসে ফেলে বললেন, তবে ছেলে হওয়াতে দমে না গিয়ে আরো উৎসাহী হয়ে উঠলো তোমার মামীমা। বললো, এবার মেয়ে হয়নি তো কি হয়েছে। পরের বার হবে ইনশাআল্লাহ। সেই মেয়ের জামাই করবো জাওয়াদকে। এবং তার সেই স্বপ্নের কারণে ইফতির পর একে একে সাফিন, ইমাদ, সাদাত, ইয়াস এবং সাহিলের জন্ম। মেয়ের আশা যখন ছেড়েই দিয়েছিল আলিফা তখন গিয়ে শেষ বয়সে জুম্মির জন্ম হলো। তবে তোমাকে মেয়ের জামাই বানানোর স্বপ্নও আল্লাহর অপূর্ণ রাখেননি। নূহাও তো আলিফারই মেয়ে।

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, হুমম...!

মনে আছে তোমাদের বিয়ের সময় আলিফার আনন্দ যেন আকাশ ছুঁয়ে দিয়েছিল। আবার সাফিনের বিয়ের সময়ও খুব খুশি ছিল তোমার মামীমা। ইফতির বিয়েটা হুট করেই হয়ে গিয়েছিল। তাই সাফিনের বিয়ের সময় নানান আয়োজন করেছিল। আফরা মেয়েটাও অসাধারণ ছিল। অল্প কয়দিনের জন্য আমাদের জীবনে এসেছিল বলেই হয়তো ওমন মায়ায় বাঁধনে বেঁধে রেখে গিয়েছে। সারাক্ষণ ছোট্ট পরীর মতো বাড়িময় ছুটে বেড়াতো। কার কি লাগবে, না লাগবে জিজ্ঞেস করতে করতে অস্থির করে তুলতো। সাফিন তো ছোটবেলা থেকেই শান্ত, গোছানো স্বভাবের ছেলে ছিল। আফরার সাথে বিয়ের পর আরো আরো বেশি দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছিল। আফরা এমন ধরণের মেয়ে ছিল যাদের পরশে চারপাশের সবকিছু আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। আমি আর তোমার মামীমাই ভুলতে পারিনা আফরার কথা। সাফিনের মনের অবস্থা তাই খুব ভালো মতই বুঝতে পারি। কিন্তু নিয়তির লিখনকে মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের কাছে অন্য কোন অপশন থাকে না। এই কথাটা আমার চেয়ে তুমিই ভালো বোঝো। তাই তুমিই হয়তো পারবে সাফিনকে বোঝাতে। কিছু বলছো না যে জাওয়াদ?

বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না মামা। যে কষ্টের প্রচন্ডতা আমি আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করতে পারি। অন্য কাউকে যখন তেমন কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে দেখি। চাইলেও ঠিকমতো বোঝাতে পারিনা তাকে। সেজন্যই আমি যতবারই ভেবেছি সাফিনের সাথে কথা বলবো। শেষপর্যন্ত বলতে পারিনি। আমি পরিচিত মামা জীবন থেকে ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার অসহ্যকর যাতনার সাথে। বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবার পর আমি যখন পুরো দুনিয়ার সমস্ত আনন্দ ও উচ্ছ্বাস হাতের মুঠোয় পুড়ে ছুটে এসেছিলাম। দেখতে পেয়েছিলাম আমার জীবনসঙ্গিনী অন্যের হয়ে গিয়েছে। ভালোবাসার রঙে একটু একটু করে যে স্বপ্নীল ভুবন এঁকেছিলাম। কোথাও তার কোন অস্তিত্ব নেই। দুই বছর আমি যাতনায় দগ্ধ হয়েছিলাম। মনেহয়েছিল নূহাকে আঁকড়ে ধরলেই ওর ভালোবাসার পরশে দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতি মূহুর্তেই উবে যাবে। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্বর্ত্বেও আমি নূহার কাছে যেতে পারিনি। কারণ আমার আর নূহার মাঝখানে রাহাত দাঁড়িয়ে ছিল। যদিও আমার আর সাফিনের অবস্থার মধ্যে অনেক পার্থক্য। কিন্তু ওকে বোঝাতে গেলে আমাকে আবারো সেই পথে হাঁটতে হবে। যে সফরের প্রতিটা কদম শুধু ব্যথাই তুলে আনে আমার জন্য। সময়ও হয়তো সব ক্ষত দূর করতে পারে না মামা। কিছু কিছু বেদনা সারাটা জীবন একই মাত্রায় স্পর্শ রেখে যায় মনের মাঝে। আমার ভালোবাসা চোখের সামনে থেকেও আমার নেই। আর সাফিনের ভালোবাসা ওকে ছেড়ে এমন এক জায়গায় চলে গিয়েছে। যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। এই বিষয়টাকে খুব সহজ ভাবে মেনে নেবার মতো অসংখ্য যুক্তি আছে। কিন্তু সেসব যুক্তি দেবার সময় ফিল করি, মুখে উচ্চারিত শব্দ আর অন্তরের প্রবাহিত আবেগের ধারা সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে বইছে। আমি নিজে যে ব্যাপারে দুর্বল। অন্যকে সেই ব্যাপারে বোঝাতে যাওয়ার ইচ্ছাশক্তির যোগান দিতে পারি না।

তাহলে কি সাফিনের জীবনটাও এভাবেই কাটবে? পেছনের বেদনাক্ত সফর ছেড়ে নতুন সফরের সূচনা করার জন্য তোমার কাছে অন্তত তোমাদের সন্তানরা ছিল। কিন্তু আফরা তো মৃত সন্তান জন্ম দেবার কয়েক ঘন্টা পর নিজেও চলে গিয়েছিল সন্তানের পিছু পিছু। কি নিয়ে জীবন কাটাবে সাফিন?

যখন আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই থাকে না। তখন নতুন অবলম্বন খুঁজে নেয়াটা বেশ সহজ হয় মামা। সাফিনের কোন পিছু টান নেই। সামনে এগিয়ে যাওয়াটা ওর জন্য একটা সময় সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তাই আপাতত ওকে আমাদের আরেকটু সময় দেয়া উচিত।

কিন্তু ওর এই অবস্থা যে তোমার মামীমা আর সহ্য করতে পারছে না। খুব কান্না করে ছেলের জন্য। আমারও নিজেকে খুব অসহায় মনেহয়। তুমিও তো সন্তানের পিতা। তোমাকে তো বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই আমাদের অবস্থাটা।

ঠিকআছে মামা আমি ইনশাআল্লাহ কথা বলবো সাফিনের সাথে।

তাহলে এখনই বলো। তুমি বললে সাফিন রুম থেকে বেরিয়ে সবার সাথে নাস্তা করবে বলেই আমার বিশ্বাস। তোমার কথা অমান্য করবে না কখনোই।


জবাবে মামাকে কিছু না বলে চুপচাপ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো জাওয়াদ। এক মূহুর্ত দ্বিধা করে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলো সাফিনের রুমের দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন