সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...৭


ভীষণ ক্লান্ত-শ্রান্ত মনে ধীর কদমে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রাহা ঘুমের কারণে তাদের আনন্দবাড়িতে ঘুমপরী উপাধী অর্জন করলেও গতরাতটা ধরতে গেলে প্রায় নির্ঘুম কাটিয়েছে সে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে ঘুমের সাথে মন খারাপের এমন রেষারেষি সম্পর্ক আগে কখনোই এমন করে টের পায়নি অবশ্য সাধারণত কখনোই খুব একটা মন খারাপ হয় না তার প্রায় সারাক্ষণই হাসি-আনন্দেই থাকে কিন্তু গতরাতে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা ঘটেছে এমনটা এরআগে কখনোই ঘটেনি তাই ঠিক কি করণীয় সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না গতরাত থেকে বার বার শুধু একটা কথাই মনেহচ্ছিলো, নূহার সাথে কথা বলতে হবে ফোনে নয় সরাসরি কথা বলতে হবে আজ যেহেতু বাচ্চাদের স্কুল ছুটি নিশ্চয়ই নূহা বাসাতেই থাকবে নাস্তা সেরেই নূহার বাসায় রওনা করবে ভাবতে ভাবতে বাগানের দিকে দৃষ্টি পড়তেই বিস্ময় জেগে উঠলো মনে একবার মনেহলো ভুল দেখছে, আবার মনেহলো হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তা না হলে এত ভোরে নূহা আসবে কোত্থেকে? পরমূহুর্তেই আবার মনেহলো, নূহার সাথে তো নাবিহাকেও দেখা যাচ্ছে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারলো সত্যি সত্যিই বাগানে দাঁড়িয়ে মেয়ের সাথে গল্প করছে নূহা মূহুর্তেই মনের ভেতরটা বেশ হালকা লাগতে শুরু করলো হাসি মুখে ছুট লাগালো বাগানের দিকে

রাহাকে
আসতে দেখে সালাম দিয়ে দুষ্টুমির স্বরে নূহা বলল, আমার আঁখিদ্বয় ঠিক দেখছে তো? এটা কি সত্যিই আমাদের ঘুমপরী নাকি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।

সালামের
জবাব দিয়ে রাহা হাসি মুখে বলল, আমি তো আরো তোমাকে দেখে ভেবেছিলাম হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। গতরাতে এসেছো বুঝি?

নূহা
হেসে বলল, না ভোরে এসেছি। ফজরের পর হঠাৎ মনেহলো আজ নাস্তা তোমাদের সাথে করবো। তাই চলে এলাম। কিন্তু তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

রাহা
নাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে বলল, আম্মু তোমার মামণিকে কিছুক্ষণের জন্য ধার দেবে আমাকে?

নাবিহা
হেসে বলল, ঠিকআছে খাম্মি তোমরা দুজন কথা বলো। আমি পাপা, বাবা, আদীব্বা আর চাচ্চুদের জন্য চা বানাতে যাই।

নাবিহা
চলে যাবার পর নূহা বোনের হাত ধরে বলল, কি হয়েছে রাহা? তোমাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন?
একটু ক্ষণ চুপ থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহা বলল, গতরাতে রাফি খুব রাগ করেছে আমার সাথে।

নূহা
হেসে বলল, শান্ত মানুষেরা যখন রাগ করেন, তখন একটু বেশিই করে ফেলেন। কারণ বিরক্তি জমতে জমতে রাগ, রাগ ঘনীভূত হতে হতে ক্ষোভ, ক্ষোভ উত্তপ্ত হতে হতে বুম। অর্থাৎ, বিস্ফোরণ।

উফ
, ফান করো নাতো এখন নূহা। আমি সত্যিই ভীষণ আপসেট। রাফি কখনোই কিছু বলে না আমাকে। যা বলি, যা করি চুপচাপ মেনে নেয়। কিন্তু সেসব যে খুশি মনে মেনে নেয় না সেটা গতরাতে ওর ইয়া লম্বা অভিযোগের লিষ্ট শুনে বুঝলাম। কোন প্লাটফর্মে এক সেকেন্ডের জন্যও না থামিয়ে পুরো পনেরো বছর ছুটিয়েছে অভিযোগের ট্রেন। তবে অভিযোগ নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। নিজের ভুল স্বীকার করতেও কোন আপত্তি নেই। আমার কষ্টটা কোথায় জানো?

বুঝতে
পারছি। রাফি ভাইয়া সবসময় হাসি মুখে তোমার সব মেনে নিয়েছেন। কিন্তু অভিযোগ গুলো এক অর্থে প্রমাণ করে দেয় যে, মনে মনে সন্তুষ্ট ছিলেন না সবসময় তোমার উপর।

হ্যা।
একথাটা যখনই চিন্তা করছি প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। মনেহচ্ছে, রাফি কখনোই আমাকে নিয়ে সুখী ছিল না। কখনোই আমাকে আপন ভাবেনি। এত বছরের সংসার, ভালোবাসা সব ফর্মালিটি। তা না হলে সবকিছু এমন মনের মধ্যে পুষে রাখতো না।

নূহা
হেসে বলল, আগে বলো সাইকো থেরাপিস্ট হিসেবে কথা বলবো নাকি তোমার বোন হিসেবে?

তোমার
যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে বলো। অভিমানী কন্ঠে বললো রাহা।

নূহা
বলল, তোমার চির শান্ত-প্রশান্ত স্বামী প্রবরের হঠাৎ জোয়ালামুখীতে রূপান্তরিত হয়ে অভিমান-অভিযোগ উদ্গিরন করার বিস্ময় এবং এত বছর কেন এত সব কথা মনে চেপে ধরে বসে ছিল? এই দুই মিশ্র চিন্তার ফলে প্রচন্ড মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে তোমার মনের ভেতর। এটাকে স্ট্রেসফুল ইভেন্ট বলা হয়। যেমন, রাফি ভাইয়ার মনের কোণে তোমাকে ঘিরে অসন্তোষ থাকতে পারে এটা অচিন্তনীয় একটা ব্যাপার তোমার কাছে। একই সাথে রাফি ভাইয়ার অভিযোগ করাটা অবিশ্বাস্য তোমার কাছে। এই দুই মিশ্র অনুভূতি তোমার মনোজগতের ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যারফলে নানান ধরণের নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা ঘিরে ধরেছে তোমাকে। যেমন, আমাকে ঘিরে এত অভিযোগ লুকানো ছিল রাফির মনের ভেতর? এতই যদি দোষ আমার তাহলে এতদিন চুপচাপ মেনে নিয়েছে কেন? এত বিদ্বেষ নিয়ে তো কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়? তারমানে পনেরো বছর ধরে কি শুধু অভিনয়ই করে গিয়েছে আমার সাথে? কখনোই সুখী ছিল না? সবই কি তাহলে ফর্মালিটি ছিল? ইত্যাদি ইত্যাদি। এটাকে বলে নেগেটিভ অটোমেটিক থটস বা স্বয়ংক্রিয় নেতিবাচক চিন্তা। এই কন্ডিশনে তুমি কোন কিছু চিন্তা করার সুযোগই পাবে না। তারআগেই চিন্তা নেতিবাচকতার স্পিং সুজ পায়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসবে।

উফ
, এত না প্যাঁচিয়ে সহজ ভাষায় বলো। লাগবে না আমার সাইকো থেরাপিস্ট। বোনই ভালো

নূহা
হেসে বলল, ওকে তাহলে এটা কোন ব্যাপারই না। শোন মানুষের ভাবনা স্বভাবগতই অস্থির। কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে ভাবনার স্থির থাকাটা খুব কঠিন। বিশেষ করে উত্তেজিত অবস্থায়। উত্তেজনা সেটা নেতিবাচক হোক বা ইতিবাচক তোমার ভাবনাকে ইলাস্টিকের মতো টেনে লম্বা করে ফেলবে। যেমন ধরো আমরা যদি আমাদের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে বসি তাহলে কি যে কোন একটা ঘটনাতে স্থির থাকতে পারি? কখনোই না। একটা থেকে আরেকটা, আরেকটা থেকে অন্যটাতে চলে যাই। এমনটা কিন্তু নয় যে আমরা সব ঘটনা সিরিয়াল বাই মনে করে বসে থাকি। অটোমেটিকই একটার পর আরেকটা স্মৃতি উঁকি দিতে থাকে। ঠিক একই ঘটনা নেতিবাচক ক্ষেত্রেও ঘটে। একটা ভুল অন্য আর দশটা ভুলের কথা মনে করিয়ে দেয়।দশের লাঠি একেক বোঝাবলে একটা কথা প্রচলিত আছে। মূল সমস্যাটা আসলে এখানে। মানে, যখন আমাদের প্রিয় কারো দ্বারা কোন ভুল হয়। তাদের প্রতি ভালোবাসার কারণে সেটা খুব সহজেই আমরা মাফ করে দিতে পারি। একই ভাবে কোন একটা ভুলের কারণে যদি আপনজনদের কেউ একটু বকেও দেয়। নিজের ভুলের উপলব্ধি প্লাস আপনজন তো ভালোর জন্যই বলছেন। ইত্যাদি চিন্তা থেকে মেনে নেয়াটা সহজ হয়। কিন্তু যখন কেউ ক্রমাগত ভুল করতে থাকে এবং বার বারই আমরা ক্ষমা করে দিতে থাকি। কোন কারণে যদি একবার ক্ষমা করাটা সম্ভব নাহয়। তখন তার কত ভুল নিশ্চুপে মাফ করে দিয়েছি, কতটা সহ্য করেছি। সেটা বোঝাতেও গিয়েও অনেক সময় ভুলের লম্বা লিষ্ট প্রকাশিত হয়ে যায়। কিন্তু এর অর্থ এমনটা মোটেও নয় যে, সবকিছু মনে করে অভিনয় করা হয়েছে। ঠিক তেমনি নিজের একটা-দুটা ভুল মেনে নেয়াটা বেশ সহজ। কিন্তু হঠাৎ করে ভুলের বর্ষণ শুরু হলে মানুষ আপসেট হয়ে যাবে, নেতিবাচক চিন্তা করবে এটাও স্বাভাবিক। মোটকথা হচ্ছে, তোমার আর রাফি ভাইয়ার বর্তমান অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন ঠিকআছে। ভুলটা হয়েছে অন্য খানে

কোন
খানে?

তোমার
কথা, কাজ বা আচরণ খারাপ লাগার পরও রাফি ভাইয়া কিছু না বলে চুপচাপ মেনে নিয়েছেন সর্বদা। তোমাকে কষ্ট দিতে চাননি বলে তোমার ভুলটাকে হজম করেছেন। কিন্তু হজমেরও তো একটা লিমিট আছে তাই না? তাছাড়া সবটা হজম হবার তো নিয়মও নেই। কিছু বর্জ্য বের করে দিতেই হবে। আটকে রাখারও কোন সুযোগ নেই। কিন্তু কেউ যদি জোর করে আঁটকে রাখতে চেষ্টা করে, তার বদহজম, লুজ মোশন হতে বাধ্য।

ছিঃ
আরেকটু ভদ্র ভাষায়ও তো বলতে পারো কথা। এসব উদাহরণ বন্ধ করো। আমাকে কি করতে হবে সেটা বলো।

নূহা
হাসতে হাসতে বলল, দুটা গোল্ডেন ওয়ার্ড বলা শিখতে হবে।

কোন
দুটা?

সরি
এবং থ্যাঙ্কইউ। তোমার মনেআছে ছোটবেলায় আমাদেরকে এই গোল্ডেন প্লাস ম্যাজিক ওয়ার্ডগুলো কত যত্ন করে শেখানো হয়েছিল? কারণ এই ওয়ার্ডগুলোর যথাযথ প্রয়োগ জীবনকে সহজ, সুন্দর আনন্দময় করে তোলে। এমনই একটি গোল্ডেন ম্যাজিক ওয়ার্ড ছিল "সরি" কাউকে সরি বলার আগে ভালো মতো ফিল করে নেয়া জরুরি। কিন্তু সরি বলার আগে চিন্তা গবেষণার করা অপ্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, যদি কখনো মনেহয় কাউকে সরি বলা উচিত সাথে সাথে বলে দিতে হবে। আমার নতুন এক ক্লায়েন্ট এর কথা বলি তোমাকে। বেশ কিছুদিন ধরে কথা হচ্ছে মেয়েটির সাথে। ২৪ বছর বয়স মেয়েটির। বিয়ে হয়েছে দেড় বছর আগে। হাজবেন্ডের সাথে কোন ভাবেই অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না। মেয়েটি তাই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মেয়েটির বাবা-মা, ভাই এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারছে না। তারা তাই মেয়েটিকে কাউন্সিলিং এর জন্য নিয়ে এসেছেন। বিয়ের একদম প্রথমদিন থেকে নিয়ে দেড় বছরের সমস্ত ইস্যুতে যেই বিষয়টা কমন মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে, সরি বলতে না পারা। এমনকি নিজের ভুল বুঝতে পারার পরও সরি বলতে সংকোচ বোধ করা। গত এক বছরে যতগুলো দম্পতি সমস্যা নিয়ে এসেছে। তাদের কমন বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম পেয়েছি, সরি বলতে না পারাটাকে। ভীষণ অদ্ভুত লাগে চিন্তা করতে গেলেই। মনেহয় মানুষ এখন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়, নানান বাহানায় একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যাবার জন্য। তাই হয়তো সম্পর্ককে দৃঢ় করার বাহানার সন্ধান করার বদলে, বাঁধন কেটে ফেলার, ছিঁড়ে ফেরার বাহানা খোঁজে। অথচ "সরি" খুব ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু জটিল সমস্যাকেও করতে পারে জব্দ।" জীবনে অসংখ্যবার "সরি" শব্দের ম্যাজিকে নিজের এবং অন্যের জ্বলজ্বলে সমস্যাকে নিভে যেতে দেখেছি।

তারমানে
তুমি চাইছো আমি রাফিকে সরি বলি?

নূহা
হেসে বলল, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কি বলেছেন জানো?

কি
?

রাখতে যদি চাও সম্পর্ককে সর্বদা আবাদ, কারণে-অকারণে বারংবার বলো ধন্যবাদ

রাহা
হেসে ফেললে, নূহাও হেসে বলল, ধন্যবাদ কাকে বলে, কত প্রকার কি কি? সেটা উদাহরণ সহ বিয়ের পর জেনেছিলাম। প্রতিটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কাজের জন্য জাওয়াদকে হাসি মুখে আন্তরিকতার সাথে জাযাকিল্লাহ বলতে দেখে প্রথম প্রথম বেশ অবাক হতাম। মনে হতো এখানে থ্যাঙ্কইউ বলার কি আছে? ঘর গুছানো, রান্না করা, চা/কফি দেয়া, বাগানে পানি দেয়া, ফুলদানীর ফুল চেঞ্জ করা, পরিবারের খোঁজ-খবর রাখা, ইত্যাদি তো সংসারের নিত্য দিনের কাজ। সবাই করে। প্রতিটা কাজের জন্য এমন আলাদা আলাদা করে ধন্যবাদ দেবার কি আছ? আবার নিজেকে ফিট রাখা, পড়াশোনার রুটিন ঠিক রাখা, সময়মতো নামাজ আদায় করা, কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন এসব তো আমি আমার নিজের জন্যই করতাম। এসব কাজের জন্য থ্যাঙ্কইউ বলার কি আছে? অবশ্য এটাও ঠিক যে উনি যখন প্রতিটি কাজের জন্য স্পেসেফিক ভাবে ধন্যবাদ বলতেন ভীষণ ভালো লাগতো। এরচেয়েও বেশি ভালো লাগতো যখন কোন ব্যাপারে আমি সরি বা থ্যাঙ্কইউ বললে সেটার জন্য উল্টো আমাকে আবার থ্যাঙ্কইউ বলতেন। যেমন, হয়তো এমন কিছু ঘটেছিল যারফলে আমার রাগ করাটা স্বাভাবিক ছিল কিন্তু আমি রাগ করিনি। কিংবা উনি একটা জিনিস বোঝাচ্ছিলেন এবং আমি তর্ক ছাড়া মেনে নিয়েছিলাম চুপচাপ। একদিন অদ্ভুত একটা কান্ড করে নিজেই আবার গোঁ ধরে বসেছিলাম। আমারই ভুল হয়েছে এই আত্মোপোলব্ধি হবার পর যখন সরি বলেছিলাম। হাসি মুখে বলেছিলেন, নিজের ভুলটা মেনে নিয়ে এত সহজ সুন্দর ভাবে সরি বলতে পারার জন্য তোমাকে থ্যাঙ্কইউ। সত্যিই ভীষণ ভালো লেগেছিল যেদিন। কারণ এমনটা অনেকের সাথেই হয়। ইচ্ছে থাকার পরেও ভুল স্বীকার করতে ভয় পায়, বদলে কটূক্তি শুনতে হবে সেজন্য। যারফলে, সম্পর্কের বন্ধনে ভুল সংশোধন বেশ কঠিন। কারণ কেউ নিজ থেকে ভুল মেলে নিলে খুব কমই সেটা অ্যাপ্রিশিয়েট করা হয়। বেশির ভাগ সময়ই উল্টো কিছু কথা শুনিয়ে ছোট করার চেষ্টা করা হয়। এই সমস্ত কারণে যে কোন সমস্যা থেকে বের হবার পথটা খুব বেশি আঁকাবাঁকা। সমাধানের পথটাকে সহজ করার জন্য তাই সবচেয়ে বেশি দরকার মনের ছোট ছোট ভালো লাগা, মন্দ লাগার সহজ স্বাভাবিক স্বীকারোক্তি।

হুম
, ঠিক বলেছো।

নূহা
হেসে বলল, যাইহোক গোল্ডেন ওয়ার্ডে ফিরে যাই। থ্যাঙ্কইউ বলাতে আরেকজন ওস্তাদ ব্যক্তি হচ্ছে জারিফ। মা আজকের নাস্তাটা একটু বেশি মজা হয়েছে। থ্যাঙ্কইউ। তুমি অসুস্থ তাও আমাকে স্কুল থেকে নিতে এসেছো? জাযাকিল্লাহ। দুষ্টু কাজ করার জন্য আমাকে বকে না দেবার জন্য শুকরিয়া। মা তুমি কত কষ্ট করে রান্না করো, আবার আমাকেও বেড়েও খাওয়াও। থ্যাঙ্কইউ। এমনি করেই এক গ্লাস পানি ভরে সামনে রাখলেও জারিফ আনন্দিত কন্ঠে শুকরিয়া জানায়। আমার কাজ বন্ধ রেখে ওর সাথে বসে কার্টুন দেখলে গদগদ কন্ঠে থ্যাঙ্কইউ বলে, ওকে যে ঘুম পাড়িয়ে দেই সেজন্যও শুকরিয়া আদায় করে। খুব বেশি ভালো লাগে আপনজনদের এমন ছোট্ট ছোট্ট মূল্যায়ন। কারণ মূল্যায়ন যে কোন কিছু করার স্পৃহাকে বাড়িয়ে দেয়। যারা মূল্যায়ন করতে জানেন তাদের জন্য শত কঠিন কাজ করতেও কষ্ট বোধ হয় না। বরং, মনে একটা সুখাবেশ তৈরি হয়। কিন্তু ফ্যাক্ট হচ্ছে, সম্পর্কের বন্ধনগুলোতে উন্মুক্ত মনে ধন্যবাদ বলতে পারা মানুষের সংখ্যা বেশ কম। অনেকেই আবার দেখেছি বলেন, পরিবারের সদস্য কিংবা বন্ধুত্বের মাঝে নো থ্যাংকস, নো সরি। সরি আর থ্যাঙ্কইউ বলাকে তারা ফর্মালিটি মনে করেন। কিন্তু কিছু কিছু ফর্মালিটি সম্পর্কের বন্ধনে ভালো লাগা আকর্ষণ বৃদ্ধির পসিবিলিটি বাড়িয়ে দেয়। তুমিই নিজের ভেবে দেখো তোমার কোন একটা ভুল যখন রাফি ভাইয়া চুপচাপ মেনে নেন। তখন যদি তুমি নিজ উদ্যোগে খুশি মনে শুকরিয়া আদায় করো। তাহলে উনার ভালোবাসাকে মূল্যায়ন করার পাশাপাশি, দুজনের সম্পর্কের উপর দিয়েও প্রবাহিত হতে পারে সুবাসিত মিষ্টি হিমেল হাওয়া। এবং পরবর্তীতে কখনো ভুলটা ইস্যু হবার সম্ভাবনাও কমে যায়। বোঝাতে পেরেছি?
হুম, বুঝতে পারছি।

নূহা
হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে নিশ্চয়ই করণীয়ও বুঝতে পেরেছো? অতীত সব ভুলের জন্য আন্তরিক ভাবে সরি বলো রাফি ভাইয়াকে। ভাইয়া যে তোমার প্রতি ভালোবাসার কারণে সবকিছু নীরবে মেনে নিয়েছেন, সেজন্য থ্যাঙ্কইউ বলো। এরপর দুজন মিলে সিদ্ধান্ত দাও এখন থেকে প্রতিটি ভুলকে বিন্দুতেই নিশ্চিহ্ন করে দেবে। বিন্দু বিন্দু জমিয়ে ভুলের সিন্ধু গড়ে তুলবে। গড়তেই যদি হয় ভালোবাসার সাগর গড়ে, সেটার মধ্যে হাত ধরে হাবুডুবু খাও দুজন। আরে এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও দৌড় দাও।

রাহা
হেসে নূহাকে জড়িয়ে থ্যাঙ্কইউ বলে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো। কিছুক্ষণ বোনের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি মুখে পাশ থেকে নাবিহার ডায়েরী তুলে নিলো নূহা। নাবিহা আবদার প্রথম পৃষ্ঠায় তার মামণিকে কিছু লিখে দিতে হবে। এরপর থেকে সে নিজে লিখবে। দুপা বিছিয়ে ঘাসের উপর বসলো নূহা। এরপর লিখতে শুরু করলো, জীবনের পাতায় পাতায় লেখা আছে কত শত ছন্দ-কাব্য, ছড়া-কবিতা, গল্প-উপন্যাস! যার কিছু আনন্দের, কিছু বেদনার, কিছু হাসায়, কিছু কাঁদায়! আছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ভরা অধ্যায়! রাগের আস্ফালন, অভিমানের আত্ননির্যাতন!হিংসার দাবানল, প্রতিহিংসার বিষাক্ত ভয়াল ছোবল! সম্পর্কের বন্ধন, মানসিক উত্থান-পতন! আছে ভুল-ভ্রান্তি, অবমূল্যায়ন! সংশয়-সন্দেহ, উদ্বেগ-হাহাকার, শিহরণ অন্ধকারাচ্ছন্ন শূন্যতার! গোপন ষড়যন্ত্র, পিঠ পিছে আঘাত, সীমাহীন স্বার্থপরতার বিবাদ! হিংস্রতা, পরশ্রীকাতরতা, ঔদ্ধত্য চিত্তে বিবেকহীনতা! তবে এখানেই শেষ নয়, আরো আছে অনেক কিছুই! আছে মায়া, মমতা, প্রেম-ভালোবাসা! আছে গুঞ্জরন তোলা স্বপ্ন, বিচ্ছুরিত আশা! আবেগের রঙধনু, উদারতার পরাগ রেণু! বাঁধনহারা আনন্দানুভূতি, ঢেউ তোলা সুখানুভূতি! আছে ধৈর্য্য, নিষ্ঠা, মানবিকতা! এত রূপের ভিড়েও সন্ধান মেলে সুন্দরতার! যদি প্রতিটি মূহুর্ত কাটে রবের সন্তোষ অর্জনের আকুলতায়!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন