মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...১০



অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পরেও কিছুতেই ফিজিক্সের বাংলা কি মনে করতে পারছিল না সাহিল। এক সময় হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলো। ইয়া আল্লাহ! একি দেখছে?! সব দেখি সাদা! সেকি বইয়ের বদলে খাতা খুলে বসেছে নাকি? চোখ বন্ধ করে মাথাটাকে ডানে-বামে, উপরে-নীচে বার কয়েক ঝাঁকি দিয়ে তাকানোর পর দেখলো অক্ষর ফুটতে শুরু করেছে বইয়ে কিন্তু সবই ঝাপসা। কেমন যেন মাথা ঘুরতে শুরু করলো সাহিলের। সবসময় পরীক্ষার আগের দিন এমন হয় তার। মনেহয় কিছুই বোঝে না, কিছুই জানে। আগে যা পড়েছিল সেসবও মাথার ভেতর থেকে একদম হাওয়া হয়ে যায়। রিলাক্স হওয়া উচিত আসলে আমার ভাবলো সাহিল। বই বন্ধ করে ভাইবারে ঢুকে কিছুক্ষণ বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করলো। ঠিক করেছিল পরীক্ষার শেষ হবার আগে ফেসবুকে যাবে না। কিন্তু অটল থাকতে পারলো না। গত দু'দিন ঢোকেনি লগিন করতেই দেখলো ইনবক্সে দশ বারো জনের ম্যাসেজ। জাস্ট একটু ঘুরে দেখেই চলে যাবে এই নিয়্যাতে ঢুকলেও কিভাবে যে পনে দুইঘন্টা পেড়িয়ে গেলো টেরই পেলো না। ঢুকেছিল রিলাক্স হতে কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যখন দেখলো রাত এগারোটা বাজে। চোখের সামনে আবারো সব ধোঁয়া ধোঁয়া লাগতে লাগলো। এখনো ছয়টা চ্যাপ্টার রিভাইস দেয়া বাকি তার!

ধূর, কেন যে ঢুকতে গিয়েছিল এই সময় ফেসবুকে? নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিলো সাহিল। নিজের সেল্ফ কন্ট্রোল পাওয়ার আরো বাড়ানো দরকার ফিল করলো। এমন না যে সে পড়তে চায় না বা পড়ার প্রতি আকর্ষণ ফিল করে না। জ্ঞানার্জন করতে হবে এটা নিয়ে কোনই দ্বিমত নেই সাহিলের। তার সমস্যা শুধু একটাই মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না বেশিক্ষণ। পড়তে বসলে কিছুক্ষণ পরই শুধু মনেহয় যাই একটু দেখে আসি কি করছে বন্ধুরা অনলাইনে। এভাবে করেই সময়গুলো যে কিভাবে কেটে যায় টেরই পায় না। টের পায় পরীক্ষার আগের দিন। তখন এমন চোখে মুখে আঁধার দেখে। নিজের উপরই মেজাজ খারাপ হতে শুরু করলো। এখন চেষ্টা করলেও পড়া হবে না। বই বন্ধ করে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো সাহিল। ক্ষুধার সামান্য নড়াচড়া অনুভব করছে পেটের মধ্যে। খাবারের সন্ধানে রান্নাঘরে রওনা দিলো। ফ্রীজ খুলেই মন ভালো হয়ে গেলো। বিকেলেই অবশ্য ঘ্রান পেয়েছিল লেয়ার পুডিংয়ের। তার সবচেয়ে পছন্দের মিষ্টি খাবার এটা। প্লেটে বড় বড় দু পিস পুডিং নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হতেই ডোরবেল শুনতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। ল্যাপটপ হাতে নূহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো সাহিল। হাসতে হাসতে বলল, তোমার লেপুকে কি আবারো বোবায় ধরেছে আপা?

ছোট ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো নূহাও। বলল, কবে দেখবি এটাকে ধরে একটা আছাড় দিয়ে ভেঙে গুড়া গুড়া করে দেব আমি।

সাহিল হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে কষ্ট করে আছাড় দেয়া লাগবে না আপা। তুমি এভাবে তোমার লেপুকে হাতে করে দু'চার বার তিনতলা আর দোতলা আপ ডাউন করলেই দেখবে ও নিজ থেকেই জাম্প দিয়ে পড়ে গিয়েছে তোমার হাত থেকে।

কপট রাগের ভঙ্গি করে নূহা বলল, বেশি ফাজলামো শিখেছিল তাই না? ধোলাই খেতে না চাইলে সামনে থেকে যা। এই দাঁড়া তোর এগজামের প্রিপারেশনের কি অবস্থা সেটা বলে যা?

আপা তোমাকে হান্ডেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিচ্ছি পাশ করবো ইনশাআল্লাহ।

হায় আল্লাহ! তুই কি শুধু পাশ করার জন্য পড়িস নাকি?

আপারে দুঃখের কথা কি বলবো। আমি পড়তে তো জ্ঞানার্জন করার জন্যই চাই। কিন্তু শেষ মেষ শুধু কোন মতে পাশ করাটাকেই বিশাল বড় অর্জন মনেহয়।

চিন্তা ও কর্মের ভারসাম্য না থাকলে এমনই হয়। যা তুই সামনে থেকে আমার। এমনিতেই নানান যন্ত্রণায় আছি। ফাঁকিবাজ টাইপ বাচ্চাকাচ্চা আশেপাশে থাকলে সেই সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে।

সাহিল হেসে বলল, আপা তুমি সমস্যা মোকাবিলা করো কিভাবে?

সমস্যা দিয়ে।

সাহিল অবাক হয়ে বলল, মানে?

মানে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কথা শুনিসনি? আমি তেমন সমস্যা দিয়ে সমস্যার মোকাবিলা করি। পরে তোকে বুঝিয়ে বলবো। এখন তুই যা তো। আচ্ছা শোন আমাদের কম্পু বিশেষজ্ঞ কোথায় বলতে পারবি?

সাহিল হেসে বলল, সাদাত ভাইয়া তো এখনো বাসায় ফেরেনি। কিন্তু রাহাত ভাইয়া না গত মাসে তোমাকে নতুন ল্যাপটপ এনে দিলো। তারপরও এটা ব্যবহার করার দরকার কি?

সেটা তুই বুঝবি না। গত আট বছর ধরে এই ল্যাপটপটা সুখে দুঃখে আমার সাথে সাথে থেকেছে। আমার কত অত্যাচার সহ্য করেছে রাত-দিন। শুধুমাত্র মাঝে মাঝে শব্দ বন্ধ হয়ে যায় বলে আমি মুহুর্তেই তাকে বিদায় করে নতুন একটাকে কোলে তুলে নেবো? বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। আমি তাই ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে আমার জীবন থেকে বের করে ফেলে দেবো না যতক্ষণ পর্যন্ত না ওকে সুস্থ্য করার শেষ চেষ্টাটাও ব্যর্থ হয়ে যাবে।

সাহিল হাসতে হাসতে বলল, তুমি তো এমন ভাবে বলছো যেন এটা কোন যন্ত্র না বরং মানুষ।


আজ যন্ত্রের সাথে এমন নির্দয় হতে পারলে, কাল মানুষের সাথেও যে হয়ে যাবো না সেই গ্যারান্টি কে দেবে? তাই আজ যন্ত্রের সাথে দরদী হবার চেষ্টা করছি। যাতে ভবিষ্যতে মানুষের ব্যাপারেও হতে পারি।

সাহিল আনন্দিত কন্ঠে বলল, তোমার কথা যে আমাকে কি পরিমাণ মুগ্ধ করে রে আপা। বোঝানোর ভাষা জানা নেই।

আর তোর রেজাল্টও যে আমাকে কি পরিমাণ বিমর্ষ করে বোঝানোর ভাষা নেই। প্রতিবার এভাবে টেনেটুনে কোন মতে পাশ করলে হবে? কেন তুই মন দিয়ে একটু পড়াশোনা করিস না বল তো? আমাদের পুরো ফ্যামেলিতে তোর মত এত্তো খারাপ রেজাল্ট আর কেউ করেনি কোনদিন।

সাহিলের হাস্যেজ্জল চেহারাটি সাথে সাথে আঁধারে ঢেকে গেলো। ভাইয়ের চেহারার এই পরিবর্তন নূহার চোখ এড়িয়ে গেলো না। বুঝতে পারলো না চাইতেও কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সাহিলের মনে। সাহিল ঘুরে নিজের রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করলে নূহা টেনে ধরে বলল, সরি ভাইয়া, আমি তোকে কষ্ট দেবার জন্য এমন বলিনি।

সাহিল অভিমানী কন্ঠে বলল, আমার আসলে আনন্দবাড়িতে জন্মগ্রহণ করাটাই ঠিক হয়নি।

ছিঃ সাহিল এটা কি ধরণের কথা? তুই জানিস এমন কথা বললে আল্লাহ নারাজ হন?

ক্ষোভের স্বরে সাহিল বলল, তোমরা সবাই মিলে আমাকে বাধ্য করেছো এমন বলতে। যেখানেই যাই সবাই সারাক্ষণ বিভিন্ন ভাবে আকার ইঙ্গিতে একথাই মনে করিয়ে দেবার চেষ্টায় করে আমাকে। আমি পরিবারের সম্মান নষ্ট করে দিচ্ছি। বাইরে সারাক্ষণই ভাইয়াদের আর তোমাদের বোনদের গুনগান শুনতে হয় আমাকে।

কিন্তু শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন কেন করা উচিত সেই বিষয়ে বোঝানো ছাড়া আমরা কি তোকে কখনো অন্য কিছু বলেছি?

কিন্তু মানুষ তো বলে। আর একথা তো আসলেই সত্যই। তোমরা দেশে বিদেশে যে যেখানেই পড়াশোনা করেছো সেরা স্টুডেন্ট এর খেতাব অর্জন করে নিয়ে এসেছো। ভাইজান, দাদাভাইয়ের রুমে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে যাই সেলফে রাখা নানা ধরণের মেডেল, গোল্ড মেডেল আর ট্রফি দেখে। কিন্তু আমার নিজের কোন অর্জনই তো নেই। আমি তো কোনদিন দৌড় প্রতিযোগিতাতেও ফাস্ট, সেকেন্ড বা থার্ড হতে পারিনি। আমাদের উইনারে ভরা পরিবারে আমিই একমাত্র লুজার।

হেসে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো নূহা। আচ্ছা সত্যি করে বল তো তোর ক্ষোভটা আসলে কোথায়? আমরা উইনার এটাতে নাকি তুই লুজার সেটাতে?

আমার নিজের উপরই বিরক্ত আমি। কিন্তু আপা আমি কি করবো চেষ্টা করো করছি কিন্তু কেন জানি না মনোযোগ ধরেই রাখতে পারি না বেশীক্ষণ পড়ার ব্যাপারে।

এর কারণ তুই পড়তে হবে বা পড়া উচিত এই বোধ থেকে পড়াশোনা করিস। প্রয়োজন উপলব্ধি করে ভালোবাসা থেকে জ্ঞানার্জন করতে চাস না। কোন কিছু আমাদেরকে তখনই আকর্ষণ করে যখন সেই জিনিসটা মধ্যে আমরা ভালোলাগা, আনন্দ ইত্যাদি খুঁজে পাই। যেমন ধর তুই অনলাইনে যে আনন্দটা খুঁজে পাচ্ছিস সেটা হয়তো বইয়ের ভেতর পাচ্ছিস না। তাই বই নিয়ে বসলেও তোর মন পড়ে থাকছে অনলাইনে। ফলে যেই একটু দেখে আসি কি করছে বন্ধুরা, একটু দুষ্টুমি করে রিলাক্স হয়ে আসি। ইত্যাদি ভাবনা থেকে বার বার বই বন্ধ করে একটু উঁকি দেখতে গিয়ে হাতছাড়া করে ফেলিস সময়।

লজ্জা মেশানো হাসি দিয়ে সাহিল বলল, আসলেই তো এমন করি আমি। ভাবি বেড়িয়ে যাব একটু দেখেই কিন্তু কিভাবে সে সময় পার হয়ে যায় টেরই পাই না।

নিজের সমস্যা কোথায় এটা বুঝতে পারাটা কিন্তু অনেক বড় একটা বিষয়। সমস্যা বুঝতে পারা মানে সমাধানের পথে চলার পথ তোর জন্য তৈরি। তুই এখন যা পড়তে বোস। এগজাম শেষ হলে আমি তোকে সাহায্য করবো ইনশাআল্লাহ।

কোন ব্যাপারে সাহায্য করবে আপা?

নূহা হেসে বলল, তোর অন্তরে জ্ঞানের পিপাসা জাগানোর ব্যাপারে।

সাহিল হেসে বলল, তোমার অন্তরে জ্ঞানের পিপাসা কে জাগিয়েছিল আপা? ভাইজান তাই না?

অনেকের মধ্যে উনি অবশ্যই অন্যতম ছিলেন। জানিস ভাইয়া একদিন বলেছিলেন, প্রিয়জনদেরকে খুশি দিতে পারাটাও অনেক বড় একটি প্রাপ্তি জীবনের। এবং এই খুশি দেবার জন্যও দরকার পড়ে জ্ঞানের। খুব মজা পেয়েছিলাম যখন বলেছিলেন, তুমি ভালো একজন মানুষ হতে চাও? একজন ভালো সন্তান, বোন, বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশী, স্ত্রী, মা এমনকি একজন ভালো পথচারীও যদি হতে চাও। তাহলে এই সব কিছুর ওয়ানস্টপ সুপারমল হচ্ছে জ্ঞানার্জন। এই পৃথিবীতে পরশপাথর বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেটি হচ্ছে সঠিক ও শুদ্ধ জ্ঞান। যা তোমাকে সেই মানুষে রূপান্তরিত করবে নিজেকে যেমনটা হয়তো কল্পনাও করে দেখোনি কখনো।

সাহিল বলল, ভাইজান যখন মাঝে মাঝে বোঝান। তখন আমিও নিজের মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রতি তীব্র একটা আকর্ষণ অনুভব করি। মনেহয়, আমাকে অনেক জানতে হবে, শিখতে হবে, বুঝতে হবে। আমার মনেহতো দুনিয়ার সবাইকে সবকিছু জানতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। প্রয়োজনীয় বিষয়ে জানলেই যথেষ্ট। কিন্তু ভাইজান বলেছিলেন, সেই প্রয়োজনটা নির্ধারণ কে করবে? কেউ কি আগে থেকে বলতে পারে পরবর্তী জীবনে কখন তার কিসের দরকার পড়ে যাবে? সুতরাং, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সম্পর্কেই অন্তত বেসিক জ্ঞানার্জন করার ইচ্ছে রাখতে হবে।

নূহা হেসে বলল, সেটাই ইচ্ছে রাখতে হবে। কারণ ইচ্ছে থাকলেই চেষ্টা করে দেখার ইচ্ছে জাগে মনে। ইচ্ছেই উন্মুক্ত করে নতুন ইচ্ছের দিগন্তকে। যাইহোক এখন তুই পড়াতে যা। কিন্তু আগামীকাল তো শনিবার। কলেজ বন্ধ। কিসের পরীক্ষা তোর?

কলেজে না তো আপা। একাডেমীতে পরীক্ষা। গত পরশু ছিল পরীক্ষা। একটা কারণে টিচার নিতে পারেননি। সেটাই আগামীকাল নেবেন। আপা তুমি এক মিনিট দাঁড়াও। তোমার জন্য একটা উপহার আছে। ছুটে রুমে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো সাহিল। হাসি মুখে বলল, আমি তোমার জন্য কিছু বই নিয়ে এসেছিলাম। তোমার বাসায় স্টুডেন্টরা এসেছে তাই ভেবেছিলাম আগামীকাল দেবো।

বই হাতে নিয়ে নূহা হেসে বলল, একটি বই যুগিয়ে যায় একটু খানি উড়ার ক্ষমতা! একটি বই বাড়িয়ে দেয় এক বিন্দু জ্ঞান সাগরের গভীরতা! আর তুই সেখানে এত্তোগুলা বই নিয়ে এসেছি আমার জন্য? জাযাকাল্লাহ।

সাহিল হেসে বলল, মনে থাকে যেন আগামীকাল থেকে কিন্তু তুমি আমার টিচার! আমার অন্তরে জ্ঞানো পিপাসা জাগানোর টিচার!

নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই মনে থাকবে। এখন তুই পড়ত যা। আচ্ছা যাবার আগে একটা তথ্য দিয়ে যা। আমার দুধ মাতা আর দুধ পিতা কি ঘুমিয়ে গিয়েছেন?

সাহিল হেসে বলল, মনেহয় না। তুমি আসার আগে যখন রুম থেকে বেরিয়েছিলাম আম্মুর কথা শুনতে পেয়েছি। আর আম্মু জেগে আছে মানে আব্বুও জেগে আছে।

নূহা হেসে বলল, তাহলে দুজনকে গুড লাইট এন্ড সুইট ড্রিম বলেই যাই। সাহিলকে পড়তে পাঠিয়ে নূহা বড়মামা আর মামীর বেডরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে সামনেই নূহাকে দাঁড়ানো দেখে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলেও পর মূহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সুহাইব সাহেবের চেহারা। প্রায় ছোঁ মেরে নূহার হাত চেপে ধরে বলল, নূহা খুব ভালো হয়েছে মা এসেছিস। আমিও মনে মনে তোর কথাই ভাবছিলাম।

কিছুটা অবাক কন্ঠে নূহা বলল, কেন মামা? কি হয়েছে?

তুই চল আমার সাথে। কি হয়েছে, না হয়েছে সব বলছি। নূহাকে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে কণ্ঠস্বর আরো একধাপ নামিয়ে বললেন, তুই জানিস আজ কি হয়েছে?

নাতো! কি হয়েছে মামা?

অনেকদিন পর আজ সকালের নাস্তায় তোর মামী ছিটা রুটি বানিয়েছিল। তুই তো জানিস কত দুর্বল আমি এই খাদ্যটার উপর। বল জানিস না?

ডায়াবেটিস হবার পর থেকে দুনিয়ার সমস্ত মজাদার খাবারের উপর দুর্বল হয়ে পড়েছেন মামা। যেদিন মামী যাই রান্না করেন সেদিন মামা সেই খাবারের উপরই দুর্বল হয়ে পড়ে সেটা খুব ভালো করেই জানা আছে নূহার। তাই হাসি চেপে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হু, মামা জানি তো তুমি খাদ্যের উপর একটু দুর্বল।

সুহাইব সাহেব বললেন, খাদ্যের উপর দুর্বল হতে যাব কেন? খাসীর মাথার সাথে মুগ ডাল দিয়ে যে তরকারীটা রান্না করে তোর মামী। সেটা দিয়ে ছিটা রুটির খাওয়ার উপর একটু দুর্বল। দুনিয়াতে কেউই তোর মামীর মতো রান্না করতে পারে না এই দুটা জিনিস। বিশেষ করে মুগ ডাল দিয়ে খাসীর মাথা। তোর মামী দুদিন পর পর এদিক যায়, সেদিক যায়। জানে তার হাতের খাবার ছাড়া আমার চলে না। তাও বেড়ানোর শখ কমে না। তারউপর দিনে দিনে ফিরে এলেও একটা কথা ছিল। কোথাও গেলে তিন-চার দিনের আগে আসে না। উপরের তলায় তুই থাকিস। অথচ মাসের মধ্যে দুবার গিয়ে তোর বাসায়ও দুদিন করে চারদিন থাকে। এই জিনিসটা আমি কিছুতেই বুঝিনা। তোর বাসায় গিয়ে থাকার কি আছে? রাহাত ট্যুরে গেলেই তোর মামী ব্যাগ গুছিয়ে বলে, জামাই বাসায় নাই আমি নূহার কাছে গেলাম। মেয়েটা আমার একা একা ভয় পাবে। এখন তুইই বল এটা কোন যুক্তি হলো? তোর স্বভাব চরিত্র ফুলন দেবীর মতো। সেই তুই পাবি একা থাকতে ভয়? কিন্তু এই কথা তোর মামীকে কে বোঝাবে? কিছু বলতে গেলে উল্টো আমাকে নানান কথা শুনিয়ে দেবে। বলবে, কেন বিনে পয়সার বাবুর্চি একদিন কোথাও যেয়ে থাকবে ভাবতেই কলিজা ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে বুঝি? চিন্তা কর মা এটা কোন কথা হলো? স্বামী রান্নার ভক্ত হলে স্ত্রীর খুশি হবার কথা। কিন্তু তোর মামী উল্টো নারাজ। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজেই রান্না করা শিখবো। আজ যেমন মুগ ডাল দিয়ে খাসীর মাথা রান্না করাটা শিখেছি। মাংসের কোন গন্ধ তো থাকেই না, উল্টো ইয়ামি যে ফ্লেবারটা আসে তোর মামীর রান্না থেকে। সেই রহস্য আজ ধরে ফেলেছি। শুনবি তোর মামী কি করে?

অবশ্যই শুনবো মামা।

রান্না যখন প্রায় শেষ তখন বাগার দেয়। দুই টেবিল চামচ অলিভ ওয়েল আর এক টেবিল চামচ বাটারের ভেতর পেয়াজ ছেড়ে লালচে হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত ভাজে। এরপর আদাকুচি দিয়ে আরো মিনিট খানেক নেড়ে তরকারীতে দিয়ে দেয়। ব্যাস হয়ে যায় ইয়ামি ফ্লেবার।

নূহা হেসে বলল, তোমার গোপন কথাটা কি এটা? আইমিন মুগডাল দিয়ে খাসীর মাথা রান্না করা শিখে ফেলেছো?

আরে না। এটা তো কথা প্রসংগে উঠে গেলো তাই তোকে বললাম। আসল ঘটনা হচ্ছে আজ নাস্তায় পছন্দের মেন্যু ছিল তাই একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম। তোর মামীর স্টিক্ট অর্ডার ছিল আজ দুপুরে শুধু স্যালাড খাওয়ার। কিন্তু হসপিটালে যাবার পর জাওয়াদ, আদী, ফায়েজ যখন নাস্তা করতে যাচ্ছিলো আমিও সাথে গিয়েছিলাম ক্যান্টিনে। বিশ্বাস কর আমি শুধু একটা ডোনাট আর এক কাপ কফি খেয়েছি। কিন্তু আমি যখন ডোনাট খাচ্ছিলাম ঐ মূহুর্তের ছবি তুলে তোর মামীর কাছে পাঠানো হয়েছে। শুধু তাই না ছবি তোলার সময় চালাকি করে স্ন্যাক্স ভর্তি প্লেট আমার সামনে ঠেলে দিয়ে বিশ্ব খাদক স্টাইলের ছবি তোলা হয়েছিল।

হাসি চেপে চোখ বড় বড় কর নূহা বলল, কে তুলেছিল ছবি?

ফায়েজ আর জাওয়াদ তো এই ধরণের কর্মকাণ্ড করতে পারে না কখনোই। বাকি থাকে কে? আদী। আমি নিশ্চিত এই কাজ আদী করেছে। ছোটবেলা থেকে বাঁদরামোতে ওস্তাদ এই ছেলেটা। এখন তুই বিবেচনা করে বল মা আদী কি কাজটা ঠিক করেছে? আমি বাসায় ঢোকা মাত্র তোর মামী ঘোষণা দিয়েছে আগামী এক সপ্তাহ আমাকে শুধু লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতে হবে। তুই'ই বল এটা কোন শাস্তি হতে পারে? আমি কি গরু যে লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করবো?

আর চেপে রাখতে না পেরে হেসে ফেললো নূহা।

সুহাইব সাহেব বিরক্ত কন্ঠে বললেন, এই হচ্ছে গিয়ে তোর সমস্যা। কিছু বললেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়িস। আরো কিছু হয়তো বলার ছিল সুহাইব সাহেবের কিন্তু স্ত্রীকে রুম থেকে বের হয়ে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে চুপচাপ গৃহপালিত স্বামীর মতো দ্রুত প্রস্থান করলেন।

নূহার কাছে এসে দাঁড়িয়ে মিসেস আলিফা বললেন, কি বলছিল এতক্ষণ তোর মামা?

নূহা মুখ গম্ভীর করে ঝগড়াটে স্টাইলে বলল, শোনো মামী আমার মামা গৃহপালিত হাজবেন্ড সেটা মানছি। কিন্তু তাই বলে এক সপ্তাহ তাকে লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতে হবে এটা মানতে পারলাম না।

মিসেস আলিফা বললেন, মানতে পারবি না কেন? তুই নিজেই তো লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করিস। তোর বাবা দেশ-বিদেশ থেকে নানান জাতের লতাপাতা এক্সপোর্ট করে এনে সারাদিন চাষ করে তোর জন্য। তোর তো সবার আগে মেনে নেবার কথা। তবে মানতে না পারলে নাই। আমি হকের পথে চলি। তাই কারো মানা, না মানাতে আমার ডিসিশন বদলে যায় না। যাইহোক, তোকে পেয়ে ভালোই হলো। আগামীকাল ভোরে আমার সাথে মর্নিং ওয়ার্কে যেতে হবে তোকে।

কেন?

সেদিন না বলেছিলি পার্কের একপাশে হাঁটু সমান বড় বড় ঘাসে ছেয়ে গিয়েছে? আমাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিবি। তোর মামার জন্য সাত বস্তা ঘাস কেটে আনবো সেখান থেকে। আগামী এক সপ্তাহে প্রতিদিনের জন্য এক বস্তা ঘাস বরাদ্দ করা হয়েছে তার জন্য।

নূহা হেসে ফেলে বলল, সহজ সরল পেয়ে আমার মামাটাকে জ্বালিয়ে গেলে তুমি ইচ্ছে মতো।

হয়েছে মামার হয়ে এখন তরফদারী করতে হবে না। এই সময় তোর আগমনের কারণটা কি শুনি?

আমার ল্যাপটপ হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই সাদাতের কাছে নিয়ে এসেছিলাম দেখাতে। কিন্তু সাহিল বললো সাদাত এখনো বাসায় ফেরেনি। আচ্ছা এখন তুমি সত্যি করে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও।

চা বানিয়ে নিয়ে আয় আগে। একটা কেন তোর দশটা প্রশ্নের জবাব দেবো।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা বানিয়ে আনছি চা।

তুই চা বানিয়ে আন। আমি ততক্ষণে ধমক দিয়ে তোর মামাকে শুইয়ে দিয়ে আসি। নয়তো জেগে বসে থাকবে আমার জন্য।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন