মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...১৯



ফজরের নামাজ সেরে অনেকক্ষণ ধরে কুরআন তিলাওয়াতের অভ্যাসটা একদম ছোটবেলা থেকেই সাফিনের। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে অনেক চেষ্টা করেও অভ্যাসটার উপর আমল করতে পারছে না। আজও নামাজ আদায় করে কুরআন নিয়ে বসতে ইচ্ছে না করাতে ঘুমোনোর চেষ্টা করলো। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও ঘুমোতে ব্যর্থ হয়ে উঠে বারান্দায় এসে বসলো। বেশ কিছু গাছে শুকনো পাতা দেখে বুকের ভেতরটা ছলছল করে উঠলো। বিয়ের পর প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের প্রতি সাফিনের ভীষণ রকম আকর্ষণ জানার পর, নানান ধরণের গাছপালা দিয়ে তাদের বেডরুম, বারান্দা সবুজের ছোঁয়াতে মনোরম করে তুলেছিল আফরা । প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরে দেখতো নতুন কোন গাছ কিনে এনেছে আফরা। সারপ্রাইজ দিতে খুব পছন্দ করতো মেয়েটা। অবশ্য সারপ্রাইজ পেলেও অনেক আনন্দিত হতো। সাফিনও তাই নিত্যনতুন বাহানা আর পদ্ধতি খুঁজতো আফরাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য। বিবাহিত জীবনের এক বছর মনোহর কোন স্বপ্নের মতোই ছিল। চোখের পলকে কিভাবে যেন কেটে গিয়েছিল একটা বছর দুজন টেরই পাইনি। সুখের সময়গুলো জীবন থেকে এমন দ্রুত হারিয়ে যাওয়াটাই বোধহয় নিয়ম। আফরার সাথে কাটানো দিনগুলোতে এক মূহুর্তের জন্যও সাফিনের জীবনে সুখের বাতায়ন বন্ধ হয়নি। সারাক্ষণই দুজন ভেসে বেরিয়েছে প্রাপ্তির সাগরে। এখনো মাঝে মাঝে সবকিছু দুঃস্বপ্নের মতোই লাগে সাফিনের কাছে। মনেহয় এখনই হয়তো ঘুম থেকে চমকে জেগে উঠে দেখবে আফরা পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।

গভীর ভাবে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করলো সাফিন। কিন্তু কিছু একটা যেন আড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিছুতেই বুকের ভেতর প্রবেশ করতে পারছিল না বাতাস। কেমন যেন দম বন্ধ করা, হাহাকার জাগানো শূন্যতার অনুভূতি ঘিরে ধরলো সাফিনকে। মনে হতে লাগলো ধূ ধূ এক মরুভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। চারিদিকে কেউ নেই, কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। অসহায়ত্বের উত্তাল সাগরের ঢেউ ভাসিয়ে দিয়ে গেলো মনের সৈকত। তীব্র স্রোতের ঝাপটা এসে লাগলো চোখে, ছলকে ছলকে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইলো পানির ধারা। সাফিন জানে এবং বোঝে এমন মুহুর্তগুলো থেকে প্রিয়জনদের সঙ্গই শুধু মুক্তি দিতে পারে মানুষকে। আগে কোন কারণে যখনই মন বিক্ষিপ্ত হতো সাফিন পছন্দের কারো কাছে ছুটে যেত। এমন কারো কাছে যার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, যার কথা শুনতে ভালো লাগে। মনের অজানা ঝড়ের তাণ্ডবে নিভু নিভু আশার প্রদ্বীপ্তিকে যে দুহাতে আগলে ধরে আবার জ্বলে উঠতে সাহায্য করে। যার আশা জাগানিয়া শব্দরা কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ ভেদ করে হাজির হয় সূর্য কিরণ রূপে। কিন্তু এখন মন ভালো করার জন্য কারো কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না। কার জন্য ভালো করবে মন? তার মন খারাপ দেখে কষ্ট পাবার সেই মানুষটাই তো হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে।

বারান্দায় থাকা গাছগুলোতে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাফিন ধীরে ধীরে। গত কয়েকদিন গাছে পানি দেয়া হয়নি। পানি আনার উদ্দেশ্যে রুমে ঢুকতেই দরজায় নক শুনতে পেয়ে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলে সামনে জাওয়াদকে দেখে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেলো সাফিন। ফজরের নামাজের সময় যখন ভাইজানকে দেখেছিল তখন থেকেই ইচ্ছে করছিল কাছে যেতে, কথা বলতে। কিন্তু জানা আছে মনের এই অবস্থায় ভাইজানের সাথে কথা বলতে গেলে আরো বেশি দুর্বল হয়ে যাবে। আর সবসময়ের মতোই মুখ ফুটে না বললেও তার মনের কষ্টগুলো বুঝে নেবেন ভাইজান। এবং নিজেও কষ্ট পাবেন। আপনজনদের কাউকেই কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না সাফিনের। যদিও বুঝতে পারে আপনজনেরা সবারই কষ্টে আছে তার কারণে।

আমি কি ভেতরে আসবো?

প্রশ্ন শুনতে পেলেও জবাব দিতে ভুলে গেলো সাফিন। ভাষাহীন বেদনাক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো জাওয়াদের দিকে। ছোটবেলায় অনেকদিন পর ভাইজানকে দেখলে আনন্দে ছুটে গিয়ে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়তো কোলে। ঠিক তেমনি করেই হঠাৎ জাওয়াদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাফিন। নিজেকে শক্ত রাখার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল জাওয়াদ। কিন্তু ছোটভাইকে বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে দেখে অশ্রু সংবরণ করতে ব্যর্থ হলো সেও। বেদনার বরফ যখন প্রিয় কারো ভালোবাসার উত্তাপে গলতে শুরু করে তখন তাকে ঝরে যেতে দিতে হয়। তাই কিছুক্ষণ কেঁদে নিতো দিলো সাফিনকে। এরপর বলল, চলো আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি। তারআগে তুমি যাও চোখে-মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।

সাফিনকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো জাওয়াদ। প্রকৃতির সান্নিধ্য খুব পছন্দ করে সাফিন। তাই বাগানের সাথে লাগোয়া রুমটাই পছন্দ করেছিল নিজের জন্য। সবুজের সন্ধানে জাওয়াদ বাগানের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো একা একা দোলনার উপর বসে আছে জিহাদ। পাপাকে দেখা মাত্রই হেসে হাত নাড়লো জিহাদ। ছেলেকে হাসি ফিরিয়ে দিতে দিতে হাতছানি দিয়ে কাছে আসতো বললো জাওয়াদ। জিহাদ ছুটে এসে দুহাত বাড়িয়ে দিলে টেনে উপরে তুলে এনে জাওয়াদ বলল, আমার বাবাটা এমন একা একা বসেছিল কেন ওখানে? মন খারাপ?

না পাপা মন ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ। এমনিতেই বসেছিলাম।

দূর থেকে তোমাকে দেখে গভীর চিন্তামগ্ন মনে হচ্ছিলো। কি ভাবছিলে সেটা কি বলা যাবে আমাকে?

একটুক্ষণ সময় নিয়ে জিহাদ বলল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তো বলেছেন কারো উপরই সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না। তাই না পাপা?

জাওয়াদ হেসে বলল, তোমার কি কোন কারণে মনেহচ্ছে তোমাদের উপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হয়েছে?

মা আর তোমার উপর হয়েছে বলে মনেহয় মাঝে মাঝে।

ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, তুমি তো এখনো অনেক ছোট বাবা। অনেক কিছুই এখনো বোঝ না, জানো না। তাই এমনটা মনেহয়।

তোমার কখনোই এমন মনেহয় না পাপা?

আলহামদুলিল্লাহ! আমার কখনোই এমনটা মনেহয়নি। কারণ আমার দেখা জগতটা যে অনেক বড় বাবা। যে জগতের প্রায় প্রতিটা মানুষকেই আমি যোদ্ধার রূপেই দেখতে পেয়েছি। অবস্থা ও অবস্থান ভেদে যাদের যুদ্ধের ধরণ হয়তো আলাদা। কিন্তু প্রতিনিয়ত সবাই যুদ্ধ করে চলছে নিজ নিজ জীবনের সাথে। তবে অবাক, বিস্ময়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। আমার দেখা যে মানুষগুলোকে আল্লাহর রাহের সবচেয়ে উদ্যমী, প্রত্যয়ী পথিক মনে হয়েছে। তাদের জীবনের পরীক্ষাগুলোকেও তত কঠিন হতে দেখেছি। জানো কিছু কিছু মানুষের জীবনের গল্প শুনে তো নিজেকে চিমটি কেটে দেখেছি। কারণ এতটাই অভাবনীয় ছিল সেসব গল্প যে, প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক ছিল সত্যিই বাস্তব নাকি আমি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি। ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়েছি এতটা কঠিন, এতটা অসম্ভব কি করে হতে পারে কারো পরীক্ষা? কিন্তু সেই মানুষগুলোকে অদ্ভুত রকমের প্রশান্ত থাকতে দেখেছি নিজ নিজ পরীক্ষাকে ঘিরে। কাঁটা বিছানো পথে রক্তাক্ত পায়ে চলেও তাদের কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হতে শুনেছি রব্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা। নিজ অবস্থার প্রতি সন্তোষ ভরা প্রাণে আলহামদুলিল্লাহ বলতে শুনেছি তাদেরকে। আসলে কি জানো বাবা? যারা দুনিয়ার এই জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সম্পর্কে অবগত। তারা কখনোই আগত পরীক্ষায় ঘাবড়ে যায় না। কারণ তাদের জানাই থাকে দুনিয়াতে এসেছেই পরীক্ষা দেবার জন্য। আমিও যখন এভাবে চিন্তা করতে শিখেছিলাম তখন থেকে আর কারো পরীক্ষা দেখে ভীত হইনি। বুঝে নিয়েছি এই পরীক্ষা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে এবং যদি প্রার্থনা ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে যাওয়া হয় নিরবধি। তাহলে আল্লাহ একদিন সফলতার পথ প্রদর্শন করবেনই।

আমিও এভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করি পাপা। কিন্তু তবুও যে মাঝে মাঝে এমন মনে হয়।

জাওয়াদ হেসে বলল, সেটাই তো বললাম বাবা। তুমি তো এখনো অনেক ছোট। তোমার জীবনের গন্ডিটাও অনেক ছোট। নিজ পরিবারের বাইরে মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলো দেখার ও জানার সুযোগ এখনো তোমার হয়নি। তাছাড়া জানার পরেও মাঝে মাঝে আমাদের মনে এমন ভাবনা উঁকি দিয়ে ফেলে। সেজন্য এত আপসেট হবার কিছু নেই। এরপর থেকে যখনই এমন কিছু মনে হবে তখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। দোয়া করবে যেন কঠিন পথে তোমার ও তোমার প্রিয়জনদের চলাটাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সহজ করে দেন। তুমি যদি আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও ভরসা আঁকড়ে পথ চলতে চেষ্টা করো। তাহলে সবকিছুর মধ্যে থেকেই নিজের জন্য কল্ল্যাণ খুঁজে নিতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আমি যখন তোমার বয়সী ছিলাম। আমিও একটুতেই মন খারাপ করতাম। তখন আবদুল্লাহ চাচাজান আমাকে সর্বাবস্থায় খুশিতে থাকার একটা টিপস বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সকল ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যেমন আমাদের পরীক্ষা নেন। তেমনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার ব্যবস্থাও তিনিই করে দেন। তাই নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। দেখবে অপার্থিব এক শান্তির বলয় তোমাকে সর্বদা ঘিরে রাখবে। আমি চাচাজানের টিপসটা ফলো করতে চেষ্টা করেছি সবসময়। এবং নিজের সমস্ত ভার আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে পরম শান্তি অনুভব করেছি নিজ প্রাণে। তুমিও এই টিপসটা ফলো করে দেখতে পারো। আরেকটা কথা কি জান?

কি পাপা?

এই জগতে কারো জীবনই সরল নয়। সবার জীবনেই ছোট-বড় অসংখ্য বাঁক আছে। চড়াই-উৎরাই আছে। কিন্তু যেহেতু আমরা বেশির ভাগ সময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি, নিজের চিন্তাতেই মশগুল থাকি তাই মনেকরি আমার পরীক্ষাটাই বুঝি জগতে সবচেয়ে কঠিন। সেজন্য দৃষ্টিকে শুধু নিজ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে, বাইরের দিকেও প্রসারিত করতে হবে মাঝে মাঝে। তাহলে আর নিজ পরীক্ষা ভারে নুয়ে পড়বে না মন ইনশাআল্লাহ। বুঝেছো বাবা?

জিহাদ হাসি মুখে বলল, জ্বি পাপা। একটা প্রশ্ন করি পাপা?

অবশ্যই।

আমি যদি বেশি বেশি করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে বলি, আমার পাপা, মাকে আবারো একসাথে করে দিতে। তাহলে কি আল্লাহ আমার উপর বিরক্ত হবেন?

জাওয়াদ হেসে বলল, তোমার এমন স্বার্থপর চিন্তায় পাপা বিরক্ত হচ্ছে এটা বলতে পারি।

কেন?

কারণ এই যে তুমি শুধু পাপা আর মার কথা চিন্তা করছো। কিন্তু বাবার কথা চিন্তা করছো না। মা যদি পাপার কাছে চলে আসে তাহলে বাবা একা হয়ে যাবে না?

না বাবা একা হবে নাতো। আমরা তো বাবার জন্য অনেক ভালো দেখে আরেকটা নতুন মা নিয়ে আসবো। আমি তো মনে মনে বাবার জন্য কয়েকজন নতুন মা পছন্দ করেও রেখেছি।

জাওয়াদ হেসে ফেলে হাত বাড়িয়ে জিহাদের কান ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, এই শান্তশিষ্ট চেহারার কারণে কেউ টের পাচ্ছে না। তুমি যে দিন দিন শুধু দুষ্টুই হচ্ছো, দুষ্টুই হচ্ছো।

জিহাদ হাসতে হাসতে বলল, আমার চেহারা হুবহু তোমার মতন। সবাই বলে আমি তোমার কার্বন কপি।

সেজন্যই তো আমিই শুধু বুঝি তুমি কত বড় একটা দুষ্টু ছেলে। তোমার মা সবাইকে বলে তার বড় ছেলের মতো শান্ত বাচ্চা দুনিয়াতে বিরল। বড় ছেলের এই সমস্ত তথ্য তার মায়ের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে অতি শিঘ্রীই। যাতে জিশান আর জারিফকে কান টানা দেবার সময় জিহাদের কান দুটা ধরেও একটু টেনে দেয়।

জিহাদ তখন দুহাত বাড়িয়ে পাপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আই লাভ ইউ পাপা।

ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করে জাওয়াদ বলল, লাভ ইউ ঠু। এখন তুমি জিশান, জারিফ আর নাবিহার কাছে যাও। একা বসে থাকবে না কোথাও। আমি তোমার সাফিন মামার সাথে কথা শেষ করে আসছি। এরপর সবাই মিলে নাস্তা করবো ইনশাআল্লাহ। এখন বলো দরজা দিয়ে যাবে নাকি যেভাবে উঠেছো, সেভাবেই নামবে?

জিহাদ হেসে বলল, এখান থেকে নিচে জাম্প দিয়ে নামবো।

জাওয়াদ হেসে বলল, ওকে ডান। দাও জাম্প।

সাথে সাথেই পাঁচ ফিট নীচে জাম্প দিলো জিহাদ। এরপর পাপার দিকে তাকিয়ে বিশাল কিছু করে ফেলেছে এমন ভাব করে ভাইবোনের সন্ধানে ছুট লাগালো। জিহাদ দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যাবার আগ পর্যন্ত হাসি মুখে সেদিকে দিকেই তাকিয়ে রইলো জাওয়াদ। এরপর বারান্দায় শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলোর দিকে মনোযোগ দিলো।

বারান্দায় এসে জাওয়াদকে গাছের পরিচর্যায় রত দেখে সাফিন লাজুক কন্ঠে বলল, পানি দেয়া হয়নি বেশ কিছুদিন গাছগুলোতে।

সাফিনের কথা শোনার পরের কিছুক্ষণ চুপ করে নিজের কাজেই মশগুল হয়ে রইলো জাওয়াদ। এরপর হাসি মুখে বলল, ভালোবাসায় জগতে বসবাসরত বাসিন্দাদের কিছু কিছু ব্যাপার আমার ঠিক বোধগম্য হয় না। এরমধ্যে একটি হচ্ছে, যাকে ভালোবাসে বলে দাবী করে তাকেই বিভিন্ন ভাবে অবহেলা করে। ভালোবেসে যার জন্য জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়, তার ভালো লাগা-মন্দ লাগা গুলোকে মূল্যায়ন করে না। অথচ প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা জানান দেয়ার খুব সহজ একটা পন্থা হচ্ছে, তাদের ভালো লাগা ও পছন্দের জিনিসগুলোকে কেয়ার করা। ভালোবাসা মানে সবসময় পাশে থেকে কদমে কদম মিলিয়ে পথ চলা নয়। কখনো দূরে থেকেও কারো পথ চলাকে সহজ করে দিতে পারাটাও ভালোবাসা। হাতে হাত রেখে নির্ভরতার আশ্বাস জাগানো যেমন ভালোবাসা। তেমনি অন্য কারো হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করাটাও ভালোবাসা। তোমার মনেআছে সাফিন বেশ কয়েক বছর আগে তুমি একদিন আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা জানতে চেয়েছিলে?

জ্বি ভাইজান আমার মনেআছে।

ব্যক্তিজীবনে আমি মুখে সারাক্ষণ ভালোবাসা জানান দেয়ার চেয়ে, বিভিন্ন কাজের আড়ালে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারাটাকেই বেশি রোম্যান্টিক মনেকরি। কাউকে আনন্দ দেবার চেয়ে, তার দুঃখগুলোকে দূর করেই বেশি তৃপ্তি পাই। কারণ যখন দুঃখ কেটে যায় মানুষ এমনিতেই আনন্দে ভাসে। কিন্তু মনের কোনে যদি চাপা কষ্ট থাকে, তাহলে অনেক আনন্দেও মানুষ মন খুলে হাসতে পারে না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি তোমাকে। আমার এক ফ্রেন্ড কথায় কথায় একদিন ওর শ্বশুরবাড়ির আর্থিক সংকটের বিষয়টা শেয়ার করেছিল আমার সাথে। এর কিছুদিন পরে সেই ফ্রেন্ডটি ওর ওয়াইফকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য ডায়মন্ড রিং কিনতে চাচ্ছিলো। আমার কাছে যখন জানতে চেয়েছিল কোথা থেকে কিনলে সুবিধা হবে। আমি বলেছিলাম, ডায়মন্ড রিং না কিনে ঐ টাকাগুলো তুমি তোমার ওয়াইফে দাও। তাকে বলো সে যেন টাকাগুলো তার ভাইদের স্টাডির জন্য পাঠিয়ে দেয়। যতটা খুশি রিং পেয়ে হতো তারচেয়ে হাজার গুণ বেশি খুশি এই উপহার পেয়ে হবে তোমার স্ত্রী। কারণ তখন যে অনুভব করবে, তার হাজবেন্ড শুধু তাকেই না তার পরিবারের সদস্যদেরকেও ভালোবাসে, তাদের কেয়ার করে। এটা যে কোন মেয়ের জন্যই পরম পাওয়ার। এবং এরফলে তোমাদের আত্মিক বন্ধনও আরো সুদৃঢ় হবে। আমার সবসময়ই মনেহয় এমন কিছুই হচ্ছে ভালোবাসা। যে অনুভূতি মানুষকে নিজ স্বার্থের গন্ডি ছাড়িয়ে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে অন্যের কল্ল্যাণার্থে। আমার মতে সেটাই হচ্ছে প্রকৃত ভালোবাসা।

জ্বি ভাইজান ভালোবাসা এমনই হওয়া উচিত।

তাহলে নিজের দিকে তাকিয়ে ভেবে বলো তো আফরার প্রতি তোমার ভালোবাসা কি এমন?

খানিকটা বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকালো সাফিন। ঠিক কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে না পেরে মাথা নিচু করে বসলো।

জাওয়াদ বলল, তোমার নিশ্চয়ই মনেআছে নূহা যখন জিহাদ, জিশান, নাবিহাকে কন্সিভ করেছিল তখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

জ্বি ভাইজান।

শারীরিক অসুস্থতা, প্রথমবার প্রেগন্যান্সি সবকিছু মিলিয়ে নূহা মানসিক ভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল মাঝের কিছুটা সময়। একদিন খুবই আবেগ ভরা কন্ঠে অশ্রু সজল চোখে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, বেবীরা পৃথিবীতে আসার সময় আমি যদি মারা যাই তুমি কি করবে? শুধু আমি কেন স্ত্রীকে ভালোবাসে এমন সব হাজবেন্ডদের জন্যই খুবই ইমোশনাল একটা প্রশ্ন এটি। নূহার প্রশ্ন শুনে আমার বুকের ভেতরটা প্রচন্ড রকম ভারি হয়ে উঠলেও হাসি মুখে জবাব দিয়েছিলাম, ইনশাআল্লাহ আমার করণীয় সবকিছু করার পাশাপাশি, আমি সেই সব কিছুও করার চেষ্টা করবো যা তুমি থাকলে করতে। আমি আমাদের বাবুদের বাবা হবার পাশাপাশি মা হবারও চেষ্টা করবো। ওদেরকে ঠিক সেভাবে গড়ে তুলবো যেমন স্বপ্ন আমরা দুজন মিলে দেখেছিলাম। তোমার অভাব আমি হয়তো দূর করতে পারবো না শত চেষ্টা করলেও। কিন্তু আমাদের সন্তানরা যাতে ওদের মাকে ভুলে না যায় এবং মাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সেই ব্যবস্থা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। আমি সেই প্রতিটা কাজ করবো যা তুমি এখন করো। যেমন, পরিবারের সবার প্রতি খেয়াল রাখা। স্পেশালি আমাদের বাবাদের ও মায়েদের প্রতি। এছাড়াও আরো অনেককিছু বলেছিলাম। যে সমস্ত কাজ সাধারণত নূহা করতো সেসব কিছুই উল্লেখ করেছিলাম। আমার কথা শুনে নূহা হেসে ফেলেছিল। হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি আগে থেকেই জানতাম তোমার মতো কাঠখোট্টা মানুষ জীবনেও কোনদিন বলবে না যে, তুমি মারা গেলে আমিও মারা যাবো। কিংবা তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে এক মূহুর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয় পৃথিবীতে। আমি তখন নূহাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমি এমন কোন জবাব দিলে কি তুমি বেশি খুশি হতে? নূহা বলেছিল, উহু, আমি প্রচন্ড মর্মাহত হতাম তুমি যদি বলতে, আমিও তোমার সাথে মরে যাবো বা তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। তুমি এমন কিছু বললে ফিল করতাম, তোমার যে ভালোবাসাকে আমার অতলান্ত সাগর মনেহয়। তার শুদ্ধতার গভীরতা আসলে মোটেই তেমন নয়। তুমিও ঐ সমস্ত মানুষের মতো যারা কাউকে ভালোবেসে জীবনের মুল লক্ষ্যটাকেই ভুলে যায়। যারা ভুলে যায় যে, জীবনটাকে তারা আল্লাহর কাছ থেকে আমানত হিসেবে পেয়েছে। দুনিয়াতে সে পরীক্ষা দিতে এসেছে অনন্ত জীবনের। বৌ কিংবা অন্য কারো জন্য জীবন দিতে আসেনি। তাই তোমার জবাব শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি যদি সত্যি তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাই তুমি কখনোই নিজ কর্তব্য কর্মে কোন অবহেলা করো না। কারণ কেউ যখন কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে সে কখনোই এমনটা চাইতে পারে না যে, তার ভালোবাসার মানুষটি তার শোকে কান্ডজ্ঞান ভুলে যাবে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। দুনিয়া থেকে চলে যাবার পর যদি পেছনে ফিরে দেখার সুযোগ থাকতো, আমার বিশ্বাস সবাই তার আপনজনদেরকে সুখী দেখারই প্রত্যাশা করতো। নূহার এই কথাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। একথাটা একদম সত্যি। আমরা যখন কাউকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসি। তাদেরকে কিছুতেই দুঃখী দেখতে পারি না। এমনকি নিজের জন্যও না। ভালোবাসার একটাই দাবী, সর্বাবস্থায় কল্যাণকামীতা।

দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুধারা মুছতে মুছতে সাফিন বলল, আমি বুঝতে পারছি ভাইজান।

জাওয়াদ হাত বাড়িয়ে সাফিনের মাথায় রেখে বলল, তাহলে তোমার রুমের দিকে তাকিয়ে দেখো। আফরা কি এমন এলোমেলো, অগোছালো করে রাখতো সবকিছু? মনে করার চেষ্টা করো তো আফরা সবকিছু কিভাবে রাখতো। আফরার কথা, কাজ, আচরণ কেমন ছিল পরিবারের সাথে? তুমি কেমন ছিলে তখন? আফরা চলে যাবার পর কদিন তুমি ওর বাবা-মা আর ভাইবোনের খোঁজ নিয়েছো? তোমার নিজের বাবা-মার প্রতি কতটা দায়িত্ব পালন করেছো? সাফিন ভালোবাসা কখনোই মানুষকে এমন আঁধারে নিমজ্জিত করে না। ভালোবাসা এমনটা করতেই পারে না। কারণ ভালোবাসা হচ্ছে আলো। সকল আঁধারের অবসানে ভালোবাসা বিচ্ছুরিত হয়। তাই সত্যিই যদি তুমি আফরাকে ভালোবাসো। বেরিয়ে এসো আপনও আঁধার থেকে। কারো জন্য মরে যাওয়াটা ভালোবাসার পরিচয় বহন করে না। নিজ কর্তব্য কর্ম সমূহের হক আদায়ের মাধ্যমে কাউকে বাঁচিয়ে রাখাটা হচ্ছে, ভালোবাসা। তাই আফরাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিও না। তুমি চাইলে আফরা প্রতিক্ষণ নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাবে তোমার মাঝে।

আমাকে কি করতে হবে ভাইজান? তুমি যা বলবে আমি করবো ইনশাআল্লাহ।

জাওয়াদ হেসে বলল, এই তো গুড নয়। কি করতে হবে আমি অবশ্যই তোমাকে বলে দেবো। তবে এখন নয়। আগে চলো নাস্তা করবে। নাস্তার পর আমরা কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। এখন আমি যাচ্ছি। কিন্তু তুমি আগে সুন্দর করে তোমার পুরো রুম গোছাবে এরপর বাইরে আসবে। ঠিকআছে?


সাফিনের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখে ফুটে উঠলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জ্বি ভাইজান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন