রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৬



ছিলি কোথায় এতক্ষণ তুই? নূহাকে দেখে বিরক্ত কন্ঠে বললেন মিসেস সুরাইয়া।

নূহা হেসে বলল, মসজিদে কয়েকজন অ্যারাবিয়ান মহিলা এসেছিল নামাজ আদায় করতে। কথা বলছিলাম উনাদের সাথে। কেন কি হয়েছে?

আধ ঘন্টা ধরে তোর মোবাইল বেজেই চলছে, বেজেই চলছে।

কে ফোন করেছে?

আমি দেখিনি। তুই যেয়ে দেখে নে। শোন আবার গল্প জুড়ে বসিস না এখন। আমার রুমে আয় কথা আছে তোর সাথে।

তোমার রুমে ঘন্টা দেড়েক পর আসছি মামণি। আমি ছোট্ট ফুপ্পির বাড়িতে যাবো। নায়লার এই মূহুর্তে মেন্টাল সাপোর্টের দরকার খুব।

মেয়েকে আর কিছু না বলে রুমের ভেতর ঢুকে গেলেন মিসেস সুরাইয়া।

নিজের রুমে ঢুকে জুয়াইরিয়া আর আত্মজার সম্মিলিত সালামের জবাব দিয়ে নূহা বলল, এই দুষ্টু দুই বালিকা আমার অনুপস্থিতে আমার রুমে কি করছে?

আত্মজা হেসে বলল, তোমার সাথে গল্প করতে এসেছিলাম আপ্পা। এসে দেখি তুমি নেই কিন্তু তোমার ল্যাপটপ ওপেন এবং এফবি আইডিও। আমরা দুইজন একটু ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তোমার ভার্চুয়াল জগতে। আমাদের তো আর ভার্চুয়াল জগত নেই? বলতে বলতে বিশাল লম্বা করে দুইজন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

নূহা চোখ পাকিয়ে কপট রাগের স্বরে বলল, অতিরিক্ত সাহস হয়েছে তোদের। সভ্যতা-ভভ্যতাকে তো মুড়িঘন্ট করে খেয়েছিস। আর ভার্চুয়াল জগত নেই সেজন্য এত লম্বা দীর্ঘশ্বাস না ফেলাই ভালো। যে জিনিস গুলো ছাড়াও জীবন ঠিকঠাক চলে যায় তারমধ্যে ভার্চুয়াল জগত একটা।

জুয়াইরিয়া বলল, হুম্ম, তুমি তো বলবেই। তোমাকে তো আর আমাদের মত বন্দী থাকতে হয় না। তুমি জানো আমাদের কলেজ ফ্রেন্ডরা শুনলে হাসে আমাদের এফবি আইডি নেই। একটা স্মার্ট ফোন অবশ্য আছে কিন্তু তাতে কোন ইন্টারনেট কানেকশন নেই। কারন আমাদের বাড়ির নিয়ম হচ্ছে, বিয়ের আগে কেউ পার্সোনালি ইন্টারনেট ইউজ করতে পারবে না। ভাইজানের এটা কেমন অদ্ভুত নিয়ম আপ্পা?  

গাল ফুলিয়ে বসে থাকা দুই বোনের দিকে তাকিয়ে হাসি চাপলো নূহা। একবার মনেহলো বলেই দিতে কেন তাদের ভাইজানের মনে ভার্চুয়াল জগতকে ঘিরে এত বেশি সাবধানতা। কারণ উনি চান না উনার মতো ভুল অন্য কারো দ্বারা ঘটুক। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আনমনা হয়ে গেলো নূহা। জাওয়াদ কখনোই এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলেনি তার সাথে। কিন্তু কেন? কেন এই বিষয়টাকে সযতনে সবসময় এড়িয়ে গিয়েছেন? নূহার অনেকবার ইচ্ছে হতো জিজ্ঞেস করতে কিন্তু কেন জানি শেষপর্যন্ত করা হয়ে ওঠেনি। হয়তো তার মতো এমনই সঙ্কোচ জাওয়াদের ভেতর কাজ করেছে বলে উনিও এড়িয়ে চলেছেন এই ব্যাপারটাকে।  

কি হলো আপা তুমি যে কিছু বলছো না?

আত্মজার ডাক শুনে নূহা বলল, আচ্ছা আজ কি বৃহস্পতিবার?

হ্যা। কেন আপ্পা?

নূহা বলল, আজ আমাদের সাপ্তাহিক প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু এত সব ঘটনা মিলিয়ে একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। এমনকি বোনদেরকে জানানোও হয়নি আমি যে আজ প্রোগ্রামে থাকতে পারবো না। বিশটা মিসকল এসেছে ওদের। এত লজ্জা লাগছে এখন। কি ভাববে আমার এমন উদাসীনতা দেখে সবাই!

কিসের প্রোগ্রাম আপ্পা? কোন ইসলামিক প্রোগ্রাম? তোমার বাসায় হয়?

হুম, ইসলামিক প্রোগ্রামই বলা যায় আলহামদুলিল্লাহ। তবে বাসায় না স্কাইপে হয়।

স্কাইপে? জুয়াইরিয়া আর আত্মজা দুজনই অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো।

নূহা হাসি মুখে দুজনের মাঝখানে গিয়ে বসে বলল, হুম, স্কাইপে। ছয় মাস আগে আমরা কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে এই প্রোগ্রামটা শুরু করেছি আলহামদুলিল্লাহ।

তোমার ফ্রেন্ড? তোমার তাহলে ফ্রেন্ডও আছে আপ্পা?

জুয়াইরিয়া হেসে বলল, আত্মজার মতো একই প্রশ্ন আমারো। অন্যান্য সব আপু-ভাবীদের ফ্রেন্ড দেখেছি আমরা। কিন্তু কোনদিনও তোমার কোন ফ্রেন্ড দেখা তো দূরে থাক নামও শুনিনি। তাহলে হঠাৎ আবার ফ্রেন্ড এলো কোত্থেকে? নাকি ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড?

নূহা হেসে বলল, পুরোপুরি ভার্চুয়াল বলাটাও মনেহয় ঠিক হবে না। পরিচয় ভার্চুয়াল জগতে হলেও ওরা সবাই ধীরে ধীরে আমার জীবনের খুব আনন্দময় একটা অংশে জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে হালিমা আপু। তোদের সাথে একদিন পরিচয় করিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ। শেষ বয়সে এসে একটা বান্ধবী খুঁজে পেয়েছি সবার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে না দিলে কি হয়?

জুয়াইরিয়া হেসে বলল, কিন্তু আপ্পা সত্যি সত্যিই স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কোথাও তোমার কারো সাথে ফ্রেন্ডশীপ হয়নি?

আসলে ফ্রেন্ডশীপের জন্য কমিউনিকেশন স্কিল খুব ইনপটেন্ট। যেটা আমার মধ্যে সম্পূর্ন রূপে অনুপস্থিত। যাদেরকে আমি ভালোবাসি সারাক্ষণই তাদের স্মরণ করি কিন্তু খোঁজ খবর নেয়া হয়ে ওঠে না। নিজ অভিজ্ঞতা থেকেও তো জানিস, আমি ভুলেও কখনো তোদের কাউকে ফোন করিনা। কিন্তু তোরা সবাই কিন্তু সারাক্ষণই থাকিস আমার ভাবনা জুড়ে। তাই দেখা যায় কেউ নিজ থেকে যোগাযোগ না করলে আমারো করা হয়ে ওঠে না। ব্যাপারটা যে ইচ্ছে করে করি তাও না। আমি মনেহয় মানুষটাই এমন। কিন্তু পরিবারের বাইরে কারো পক্ষে আমার এই স্বভাব বুঝে মেনে নেয়াটা কষ্টকর। এটা আমি বুঝি বলেই বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকি। কারণ বন্ধুত্বও একটা সম্পর্ক। এটাও একটা দাবী আছে। আর যেই দাবী পূরণে আমি উদাসীন সেই দায় নিজের উপর চাপাতেও নারাজ। কারণ এরফলে অজান্তেই হয়তো কারো মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবো। তাই দরকার কি এত সব ঝামেলার?  

আত্মজা হেসে বলল, কোন দরকার নেই। পরিবারের বাইরে তোমার ফ্রেন্ডশীপ করারও দরকার নেই কারো সাথে। আমরা তো আছিই তোমার বন্ধু। কিন্তু আপ্পা প্রোগ্রামে কি করো তোমরা?  
আসলে আমরা ছয়-সাতজনের খুবই চমৎকার একটি আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। যদিও আমরা একেকজন একেক দেশে থাকি কিন্তু তবুও সপ্তাহে একদিন সময় ম্যানেজ করে একসাথে কিছুক্ষণ গল্প করতাম। হালিমা আপু একদিন আড্ডার সময় আমাদেরকে বললেন, আমরা যেহেতু একসাথে কিছুটা সময় কাটাচ্ছি। পুরো সময়টাই শুধু গল্পগুজব করে কাটিয়ে দেয়াটা বোধকরি সময়ের অপচয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। এমন কিছু যদি করা যেত যারফলে আমাদের গল্প করাও হতো আবার পুরো সময়টাই একদম অকারণে বিদায় না নিলো আমাদের কাছ থেকে। তাহলে খুব ভালো হতো। এমনিতেও অবশ্য আমরা বেশির ভাগ সময় কুরআন-হাদীস নিয়েই আলোচনা করতাম। কিন্তু এসবই ছিল ছাড়া ছাড়া আলোচনা। হালিমা আপুর আইডিয়া শোনার পর সবাই মিলে একটা প্রোগ্রাম শিডিউল তৈরি করলাম। কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে প্রোগ্রাম শুরু করি আমরা। এরপর বিষয় ভিত্তিক কোন আলোচনা করি, দারসে হাদীস থাকে, সাইকোলজিক্যাল একটা টপিকও থাকে, মত বিনিময় করি আমরা, আত্নোপর্যালোচনা মূলক আলোচনাও করি। আবার প্রোগ্রামটা যাতে একঘেয়ে না হয়ে যায় সেজন্য টুকটাক বিনোদনের ব্যবস্থাও করি মাঝে মাঝে। যেমন ধর কুইজ, শিক্ষণীয় গল্প, কখনো নিজেদের শৈশবের মজার কোন স্মৃতি চারণ, মজার বা বিচিত্র অভিজ্ঞতা শেয়ার করে মনের আনন্দে সবাই মিলে কিছুক্ষণ হাসি। আলহামদুলিল্লাহ সত্যিই অসাধারণ কিছুটা সময় কাটে বোনদের সাথে। আবার আমাদের মধ্যে ছোট্ট দুটা বোন আছে যাদের কুরআন পড়া সহীহ না পুরোপুরি। হালিমা আপু সপ্তাহে অন্য আরকদিন সময় করে ওদেরকে আরবী ব্যকরণটা দেখিয়ে দেন।  

আত্মজা আবারো গাল ফুলিয়ে বলল, আমার তো শুনেই লোভ হচ্ছে আপ্পা। মানুষ চাইলে সবকিছু থেকেই উত্তমটা বের করে নিতে পারে। তাহলে আমাদেরকে এমন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কেন?

কারণ সবকিছু থেকে উত্তম কিছু বের করে নেয়াটা সবসময় সহজ হয় না। বরং বেশির ভাগ সময়ই এটা খুব কঠিন। এরজন্য সতর্কতা, অভিজ্ঞতা অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আমার বর্তমান লাইফ স্টাইল দেখে তোদের মন খারাপের কারণটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না। তোদের মতো বয়সে আমাদের লাইফ আরো অনেক বেশি নিয়ম কানুনে বাঁধা ছিল। তাছাড়া আমি এফবি আইডি খুলেছি তিন বছরও হয়নি। সেই হিসেবে তোদের বয়স আটাশ পেরিয়ে যাবার পরও যদি ভাইয়ারা খবরদারী করতে আসে তখন নাহয় অ্যকশন নেবার কথা ভাবা যাবে।  
জুয়াইরিয়া আর আত্মজা আপ্পা বলে লম্বা করে কিছক্ষণ টেনে ধরে রেখে আবারো গাল ফুলিয়ে বসলো।

নূহা দু’হাতে দুজনের গাল টেনে দিয়ে হাসি মুখে বলল, কয়েকদিন আগেও বলেছিলাম আজ আবারো বলছি। পরিবারের অনুশাসন সম্পর্কে মানুষ কি বলছে, কি ভাবছে সেসবকে কখনোই পাত্তা দিবি না। কারণ যখন পরিবারের অনুশাসনের বাইরে গিয়ে তোরা কোন ভুল কাজ করবি তখন সবার আগে ঐ মানুষেরাই তোদের দিকে আঙ্গুল উঁচু করবে। সমালোচনার আড়ালে নিন্দা করবে। আর তখনো পরিবারই ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নেবে। তাই পরিবারের ইচ্ছের বাইরে গিয়ে কখনোই কোন কিছু করার চিন্তাকে প্রশ্রয় দিবি না। পরিবারের বড়রা যদি ছোটদেরকে কোনকিছু থেকে দূরে রাখতে চান, তার পেছনের কারণটা অবশ্যই কল্যাণময় কিছুই হয়। এখন তোরা তোদের রুমে যা। পরে ইনশাআল্লাহ তোদের সাথে এই বিষয়ে ডিটেইল কথা বলবো। আমি একটু নায়লার কাছে যাই।

আত্মজা বলল, নায়লার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আপ্পা?

নায়লাকে আমাদের অপছন্দের কথা জানানো হয়েছে। এখন নায়লা সিদ্ধান্ত নেবে ওর করণীয়র ব্যাপারে।

নায়লা যদি সৈকতকেই বিয়ে করতে চায়। তাহলে কি সত্যি সত্যিই তোমরা ওকে সৈকতের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে? প্রশ্ন করলো জুয়াইরিয়া।

আমি ঠিক জানি না কি করবেন ভাইয়ারা। টেনশনে আছি নিজেও।

আত্মজা ভীত কন্ঠে বলল, আমার তো কোন একদিন বিয়ে করতে হবে এটা মনে হলেই ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমাদের ক্লাসে দুইটা মেয়ে কি যে ভুগছে বিয়ের পর থেকে। আপ্পা আমাকে তোমরা পরিবারের ভেতরেই কারো সাথে বিয়ে দিয়ো। আমি বাইরে কোথাও যেতে চাই না।

নূহা হেসে বলল, তুই না তোর রাহাত ভাইয়ার বিরাট ভক্ত? সেও তো আমাদের পরিবারের বাইরে থেকেই এসেছিল। আসলে কি জানিস? এখনো পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে। কিন্তু ভালো মানুষগুলো তাদের ভালো মানুষীর কারণেই ভালো কিছু করতে পারে না।

সেটা কিভাবে? প্রশ্ন করল জুয়াইরিয়া।

নূহা হেসে বলল, যেমন ধর একটা ছেলে খুবই উত্তম স্বভাবের। যে যদি মা ভক্ত হয় তাহলে মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করে। আবার যদি স্ত্রী ভক্ত হয় তাহলে কারণ হয়ে দাঁড়ায় মায়ের কষ্টের। সে এতই ভালো যে একজনের সাথে ভালো মানুষী দেখাতে গিয়ে অন্যের সাথে খারাপ হয়ে যায়। এভাবেই একজন ভালো মানুষই হয়ে ওঠে একজন খারাপ মানুষ।

তুমি শুধু প্যাঁচালো কথা বলো আপ্পা।

একদম ঠিক বলেছিল। আত্মজার সুরে সুর মিলালো জুয়াইরিয়া।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা তাহলে এই প্যাঁচালো সাবজেক্টটাই বাদ দে।

কিন্তু বিয়ে তো করতেই হবে একদিন না একদিন আমাদেরকে। নায়লাকে দেখে খুব ভয় হচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন এমন কিছু থেকে। চিন্তা করে দেখো আপ্পা নায়লার অবস্থাটা। পরিবারের পছন্দের বাইরে যাওয়াটা যেমন ওর জন্য খুব কঠিন। তেমনি মনের ভালো লাগাকে উপেক্ষা করাটাও তো বেশ কঠিন হবারই কথা। আর অনুভূতিটা যদি সত্যিই ভালোবাসা হয়ে থাকে? আচ্ছা আপ্পা ভালবাসা ব্যাপারটা কেন সংঘটিত হয়? মানে আমি জানতে চাইছি একটা মেয়ে একটা ছেলেকে কেন ভালোবাসে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবার আগে?

আত্মজা বলল, একই প্রশ্ন আমারো। নায়লার তো অজানা ছিল না কাউকে পছন্দ করার পরিণাম। তারপরও কেন নিজেকে সংযত করতে পারলো না? আমাদেরকে যাতে কখনোই এমন বিপদের মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্য এই প্রশ্নের জবাব জানাটা খুবই দরকার। কেন ভালোবাসা তৈরি হয় মনে?

নূহা হেসে বলল, এক কথায় বলতে গেলে ভালোবাসা হচ্ছে ভালো লাগার দায়বদ্ধতা। অর্থাৎ, ভালো লাগার দায়ে আবদ্ধ হয়ে মানুষের মনে যে আবেগের জন্ম হয় সেটাই হচ্ছে ভালোবাসা। সেজন্যই যখন দুজন মানুষের একে অন্যের প্রতি ভালো লাগা কমতে থাকে তখন ভালোবাসাও মিলিয়ে যেতে থাকে। আরো সহজ করে বলতে গেলে, কারো প্রতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালো লাগার সমষ্টি হচ্ছে ভালোবাসা।

আত্মজা হেসে বলল, এটা কি তোমার সংজ্ঞা নাকি ভাইজানের?

নূহা হেসে বলল, তোমাদের ভাইজানের সংজ্ঞা। ভালোবাসা আর ভালো লাগা নিয়ে বিশাল এক লেকচার আছে উনার। খুঁজে বের করে তোদেরকে দেবো ইনশাআল্লাহ। এখন বিদায় হ দুটাই।

জুয়াইরিয়া বলল, সাথে বিয়ে ভীতির উপর তোমার লেকচারও চাই আমাদের।

নূহা হেসে বলল, জানিস একটা সময় আমার কাছে বিয়ে মানেই ছিল খুব আপন কারো হাত ধরে স্বপ্নিল এক জগতের প্রবেশ দ্বার। তাই কারো বিয়ে হচ্ছে শুনলে ভীষণ খুশি হতাম। কিন্তু যেদিন থেকে দাম্পত্য কাউন্সিলিং শুরু করেছিলাম একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করেছিল বিয়ে বিষয়টাকে কেন্দ্র করে আমার নিজস্ব ধারণা। বেশ অনেকদিন কারো বিয়ে হচ্ছে জানার সাথে সাথে একরাশ দুশ্চিন্তা এসে ঘিরে ধরতো মনকে। বিভিন্ন দম্পতিদের কাছ থেকে শোনা তাদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার স্লো মোশনে একের পর এক আসতে থাকতো মনের পর্দায়। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পর রিয়ালাইজ করলাম যে, বিয়ের আসলে কোন দোষ নেই। বিয়ে কখনোই ব্যর্থ হয় না। দোষ থাকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মানুষ দুটির মধ্যে। তাদের দোষেই বিয়ে ব্যর্থ হয়, আবার তাদের গুণেই নিয়ে ছুঁয়ে দেয় সর্বোচ্চ সাফল্য। তাই ভয় যদি পেতেই হয় নিজেকে পাওয়া উচিত, বিয়েকে নয়।

তবুও আপ্পা বিয়ের অনুভূতিটা কেমন যেন দমবন্ধকর। ভীত কন্ঠে বললো আত্মজা।  

হুম, মিশ্র অনুভূতির দোলায় দুলতে থাকে মন। নিজের অভিজ্ঞতায় মনেহয়েছে মেয়েরা বিয়ের আয়োজনের পুরো সময়টিতেই দোল দোল দুলুনি অবস্থায় থাকে। একই সাথে মনের মাঝে এত রঙের আবির্ভাব খুব কম সময়ই ঘটে। জীবনে প্রিয়তম কারো আগমনের ধ্বনি আনন্দময় লাজুকতার রক্তিম আভা ছড়াতে ছড়াতে, বেদনার নীলাভ চাদরে মুখ ঢেকে গুমরে কেঁদে উঠে আপনজনদের ছেড়ে যাবার বিরহে। আসলে বিয়ে শব্দটা যেমন অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন, কল্পনা, ভাবনার বীজ বুনে দেয় মনের গহীনে। তেমনি দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্ন মনে তুলে যায় কখনো মৃদু মন্দ, কখনো বা থরথর কাঁপন। মন দুই ভাগ হয়ে এক অংশ প্রশ্নকর্তা আর অন্য অংশ উত্তরদাতায় পরিণত হয়। যেমনটা চেয়েছি তেমন হবে তো আমার জীবনসাথী? আমি হতে পারবো তো তার মনের মত? একে অন্যেকে বুঝে মানিয়ে নিতে পারবো তো? মনের মিল মতের অমিলের কাছে নতি স্বীকার করে নেবে নাতো? সম্পর্কের ভিত বিশ্বাস হবে তো? ভরসা করার মত মানুষ হবে তো? ভালোবাসার মত সুন্দর ও কোমল মনের অধিকারী হবে তো? এমন আরো হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে মনের মাঝে।

একদম ঠিক বলেছো আপ্পা। আমার তো এখনই এখন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনের ভেতর। চিন্তিত কন্ঠে বললো জুয়াইরিয়া।

নূহা হেসে বলল, আমার বিয়ে ঠিক হবার পর মামণি বলেছিলেন, মেয়েদের অনেক বড় একটা সমস্যা হচ্ছে বিয়ে কি বুঝতে শেখার পর থেকেই নিজের ভালোলাগা ও পছন্দের আদলে জীবনসাথীর ছবি আঁকতে শুরু করে দেয় মনের মাঝে। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তব কখনোই এক হয় না। বড়জোর কিছু মিল থাকতে পারে কল্পনা আর বাস্তব সাথীর মাঝে। তাই যে মানুষটা জীবনে আসে তাকে কল্পনার মানুষটির দ্বারা বিবেচনা না করে যদি সে যেমন তেমন ভাবেই মেনে নেয়া যায়, তাহলে দাম্পত্য জীবনে সুখের সন্ধানে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। অভিজ্ঞতা থেকে মনেহয় বিয়ের মূল কথাটা হচ্ছে অ্যাডজাস্টমেন্ট। মানিয়ে নিতে পারাটাকে সোনার কাঠি, রূপার কাঠির সাথে তুলনা করা যায়। যার পরশে নতুন সম্পর্কের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা জেগে উঠে। খুব সহজ, স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ হাত যদি বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় একে অপরের দিকে তাহলে “তুমি আর আমি” নামক বিভেদের বেড়াজাল ছিন্ন করে “আমরাতে” একাকার হয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। বেশ কয়েক মাস আগে দেখা এক দম্পতির ঘটনা বলি তোদেরকে।

আত্মজা আর জুয়াইরিয়া দুজনই চেহারায় সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে তুললো মূহুর্তেই।

নূহা বলল, ঐ দম্পতির একজন ডিভোর্স হয়ে যাবার পর কারণ হিসেবে বলছিল তাদের দুজনের স্বভাবের ভিন্নতার কথা। মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অমিলের কথা। দাম্পত্য সম্পর্কের সকল অশান্তির কারণ মনের চাহিদার অমিল এমন ধারণা আসলে ঠিক নয়। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। তাই তাদের মনের চাহিদা, ভালোলাগা-মন্দলাগা গুলোও আলাদা আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটা মানুষ চিন্তা করে, সিদ্ধান্ত নেয় নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও চাহিদার ভিত্তিতে। তাই দুনিয়াকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একরকম হওয়া সম্ভব নয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। তাই নিজেদের মধ্যে অসংখ্য পার্থক্য বিদ্যমান সেটাকে মেনে নিয়ে, একে অপরকে বাদলানোর চেষ্টা না করার মাঝেও দাম্পত্য কল্যাণ নিহিত থাকে। যে কোন সম্পর্কের মাঝেই মাধুর্য ধরে রাখা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধির সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরির সুযোগ গুলোকে ব্যাহত করা। দাম্পত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। মন থেকে বেড়িয়ে আসা শব্দরা একের পর এক সারি বেঁধে দুজনের মাঝে গড়ে তোলে ভালোবাসার সেতু। শব্দের মাঝে প্রাণ আছে। আছে অস্তিত্ব জানান দেয়ায় ক্ষমতা। তাই মন খুলে যত বেশি কথা বলা হয় দাম্পত্য তত বেশি প্রানোবন্ত হয়ে ওঠে দুজনের কাছে। আবার অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগও কিন্তু কম নয় দাম্পত্যে। অভিযাত্রী হয়ে একে অন্যের নিয়ে বেড়িয়ে পড়া যায় নিজ নিজ রাজ্যে পরিদর্শনে। পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় রাজা-রানী, পাইক-পেয়াদাদের সাথে। সেই মক্তবের আঙ্গিনাতে থেকেও ঘুরিয়ে আনা যায় যেখানে ঘটেছিল জ্ঞানের মোড়ক উন্মোচন। সেইসব সাথীদের সাথেও যাদের সাথে কেটেছে শৈশব-কৈশোরের দুরন্ত সময়গুলো। এমন কত শত আনন্দ-বেদানার কাব্য লেখা থাকে প্রতিটা মনের মাঝে। যার মাঝে বিচরণ করতে করতে একে অন্যেকে জানার কাজটাও হয়ে যায় খুব সহজে। আবার বিয়ে মানে কিন্তু শুধু দুজন মানুষের মিলন নয়। বিয়ে দুটা পরিবারকেও একসাথে জুড়ে দেয়। তারা ভাগীদার হয়ে যায় উভয়ের দুঃখ-সুখের। তাই দম্পতিদের একে অপরের সাথে সাথে উভয় পরিবারের সদস্যদের প্রতিও রাখতে হবে মানিয়ে নেবার মত উদারতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তোদেরকে আমি কেন এসব কথা বলছি? এসব তো নায়লাকে বলার জন্য রেডি করেছিলাম।

জুয়াইরিয়া আর আত্মজা দুজনই হেসে ফেললো। নূহাও হেসে বলল, আচ্ছা তোরা এখানে থাকতে চাইলে থাক। কিন্তু আমি যাই নায়লার কাছে। বেশি দেরি হলে আবার মামণি অভিমান করে বসে থাকবে।

জুয়াইরিয়া আর আত্মজাকে রুমে রেখেই ফুপ্পীর বাড়িতে রওনা দিলো নূহা।   

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৫



লাইব্রেরীতে ঢুকে সামনে তাফসীর খুলে রেখে চোখ বন্ধ করে আফজাল সাহেবকে বসে থাকতে দেখে দুষ্টুমির পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিলো নূহা। অভিজ্ঞতা থেকে জানে এই মূহুর্তে বাপী খুবই সিরিয়াস মুডে আছেন। সবসময় যতটা সিরিয়াস থাকেন তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এখন দুষ্টুমি করতে যাওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়ালি মারা। ইচ্ছে ছিল ঢুকেই কথার দ্বারা অ্যাটাক করবে বাপীকে। এবং কোন কিছু ঠিক মতো বুঝে ওঠার আগেই আত্মজার ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার পারমিশন আদায় করে নেবে। কিন্তু আধ্যাত্মিক চিন্তামগ্নতায় নিজের মাঝে ডুব দিয়ে থাকা কারো সাথে দুষ্টুমি করাটা নিশ্চয়ই সঠিক কাজের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। তাই নিঃশব্দে চেয়ার টেনে চুপচাপ বাপীর সামনে বসে রইলো নূহা। বেশ অনেকটা সময় পর আফজাল সাহেব বললেন, তুই কি কিছু বলতে এসেছিস?  

নূহা হেসে সালাম দিয়ে বলল, আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও তুমি ইচ্ছে করেই ধ্যানমগ্ন হয়ে বসেছিলে এতক্ষণ তাই না?

সালামের জবাব দিতে দিতে চোখ খুললেন আফজাল সাহেব। ধীরে ধীরে বললেন, সাইকোলজি পড়ার সাথে আন্দাজে কথা বলার কি কোন সম্পর্ক আছে? তোর আর আদীর স্বভাবে আন্দাজে কথা বলাটা মহামারী পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কথায় বলে, ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে। অন্ধকারে সঠিক নিশানায় একটা ঢিল লেগে গেলেই লাফ দিয়ে আকাশে উঠে যাওয়া ঠিক না বুঝেছিস? আরেকটা ব্যাপারও আমি খেয়াল করেছি।

নূহা হাসি মুখে বলল, সেটা আবার কি?

তোদের কথাবার্তার ভেতর থেকে দিন দিন কুরআন ও হাদীসের উল্লেখ কমে যাচ্ছে। মানেহচ্ছে, কুরআন ও হাদীসের কথাই বলছিস কিন্তু সেটা সাইকোলজির ভাষায়। এটা আমার খুবই অপছন্দ। পার্থিব জ্ঞান যেমন মানুষকে শুধুমাত্র অর্থকরী বিদ্যায় জ্ঞানী করতে পারে। ঠিক তেমনি পার্থিব জ্ঞানের প্রয়োগে মানুষের মনে খানিকটা সময়ের জন্য শান্তি ভাব জাগ্রত করতে পারলেও, সত্যিকার অর্থে আশ্বস্ত করতে পারে না। কি বলা হয়েছে সূরা নাহলের ৪৪ নং আয়াতে?

নূহা বলল, “আগের রসূলদেরকেও আমি উজ্জ্বল নিদর্শন ও কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম এবং এখন এ বাণী তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের সামনে সেই শিক্ষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যেতে থাকো৷ যা তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে লোকেরা (নিজেরাও) চিন্তা-ভাবনা করে”৷

এখনো জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই ভাবানুবাদ বলতে পারিস তাহলে? মাশাআল্লাহ। আমি তো আরো ভেবেছিলাম যেই হারে সাইকোলজি আর গল্প-উপন্যাসের বই পড়ছিস তাতে ভেতর ফাঁকা হয়ে গিয়েছে প্রকৃত জ্ঞান থেকে।

নূহা বলল, পুরো কুরআনের ভাবানুবাদ সত্যিই মনে নেই। আগের মতো করে বলতেও পারি না। এটা আমার কোট করা আয়াত সমূহের একটি তাই হুবহু বলতে পেরেছি?

বাড়ি থেকে দূরে থাকার কারণেই যে তোর এই অধঃপতন হয়েছে সেটা কি বুঝতে পারছিস? হিফজ কমপ্লিট হয়েছে?

নূহা নাক মুখ কুঁচকে লজ্জিত স্বরে বলল, এখনো না।

এখনো না? বিস্ময় মাখা কন্ঠে প্রশ্ন করলেন আফজাল সাহেব। একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোর তিন সন্তান হিফজ করেছে আরো দুই বছর আগে। আর তুই কিনা বলছিস এখনো না? তুই তাহলে করিসটা কি? জারিফের কি অবস্থা?

আলহামদুলিল্লাহ ওর লাস্ট পারার সূরা গুলো প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছে?

আফজাল সাহেব চোখ কপালে তুলে বলল, এখনো শেষ পারার সব সূরাই মুখস্ত হয়নি? রাহাত করেটা কি? তোদের অবস্থা তো আমি যতটা ভেবেছিলাম তারচেয়েও নাজুক। জিশান কত বছর বয়সে হিফজ কমপ্লিট করেছিল মনে আছে তোর? আট বছর বয়সে। জিহাদ সাড়ে নয় আর নাবিহা দশ বছরে হিফজ কমপ্লিট করেছিল।জারিফের দশ চলছে। অথচ এখনো শেষ পারাতেই বসে আছে। তুই আমাকে এভাবে নিরাশ করবি এটা আমার চিন্তারও বাইরে ছিল।  

জবাব দেবার মতো কিছুই ছিল না নূহার কাছে। তাই চুপ করে বসে রইলো।

"চিন্তার দিগন্তকে করতে চাইলে সম্প্রসারিত, চিন্তা ও উপলব্ধির সমন্বয়ে কুরআনকে করো পঠিত। অন্ধকার দূরীভূত করে ঘটবে আত্মিক সূর্যোদয়, পাবে শান্তি ও স্বস্থির সন্ধান জীবন হবে আলোকময়।" কে লিখেছে এই কথাগুলো?

ভেতরটা কেমন যেন ভারী হয়ে গিয়েছিল নূহার। খুব আস্তে করে বলল, আমি লিখেছিলাম বাপী।

কেন লিখেছিলি? নিশ্চয়ই আত্মোপলব্ধি থেকেই লিখেছিলি। এখন কোথায় তোর সেই কথা ও কাজে মিল রেখে চলার ব্যাপারে দৃঢ়তা ও সতর্কতা? চুপ করে আসিস কেন? মাথা নীচু করে রেখেছিস কেন? তাকা আমার দিকে।

নূহা চোখ তুলে তাকানোর সাথে সাথে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো আফজাল সাহেবের। এই মেয়েটার চোখের অশ্রুকে অ্যাসিডের মতো মনেহয় সবসময়। সহ্য করা খুব বেশি কষ্টকর। দুনিয়ার কারো চোখের পানি যা করতে পারে না নূহার ছলছল দৃষ্টিই যথেষ্ট আফজাল সাহেবকে নরম করার জন্য। মন সিক্ত হয়ে উঠলেও কন্ঠে বিরক্তি ধরে রেখেই বললেন, কি মুশকিল আবার কান্না করছিস কেন? কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে এমন কান্না করাটাই বা কোথায় শিখেছিস? বাড়ির বাইরে থাকলে এমন আরো কত অধঃপতন যে হবে তোর। আচ্ছা এখন থাক এসব কথা। তোর কথা বল। কি যেন বলতে এসেছিলি?  

নূহা বলল, এখন ইচ্ছে করছে না। আগামীকাল বলবো ইনশাআল্লাহ।

আত্মজার পড়ার ব্যাপারে কিছু নাতো আবার?

হুম।

আচ্ছা যা আত্মজাকে বলে দে ওর যেখানে ইচ্ছে সেখানে ভর্তি হতে। কিন্তু তারআগে তোর এই ভোঁতা মুখ ঠিক কর। একদম দেখতে পারিনা আমি এমন চেহারা।

নূহা অভিমানী কন্ঠে বলল, তুমিই তো মুখ ভোঁতা করতে বাধ্য করেছো আমাকে। আমাকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে কতগুলো কথা শোনালে।

সেটা তো যেদিন সবার মুখ মলিন থাকবে সেদিনও যাতে আমার মায়ের এই চাঁদ মুখটা আলোকোজ্জ্বল থাকে সেজন্য বলেছি। আমি আজকাল প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখি বুঝলি মা। দেখি চির শান্তির জান্নাতে অকল্পনীয় সুন্দর এক বাগিচায় হাত ধরাধরি করে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাদের চোখে হাসি কিন্তু মুখে তর্ক। অবশ্য জান্নাতে মনেহয় না মানুষ অকারণে তর্ক-বিতর্ক করবে।

নূহা হেসে ফেললো। আফজাল সাহেবও ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, জান্নাতের বিবরণ পড়ছিলাম। তোর একটা প্রিয় আয়াত ভাবানুবাদ সহ বল শুনি।

একটুক্ষণ চিন্তা করে নূহা সূরা ইউনুসের ৯ ও ১০ নং আয়াত তিলাওয়াত করলো। এরপর বলল, “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস করেছে এবং ভাল কাজ করেছে তাদের প্রতিপালক তাদের বিশ্বাসের কারনে তাদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন, শান্তির উদ্যানসমূহে তাদের (বাসস্থানের) তলদেশ দিয়ে নদীমালা প্রবাহিত থাকবে। সেখানে তাদের বাক্য হবে, ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা’ (হে আল্লাহ! তুমি মহান পবিত্র)! এবং পরস্পরের অভিবাদন হবে সালাম। আর তাদের শেষ বাক্য হবে, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ (সমস্ত প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য)"।

আফজাল সাহেব বললেন, সুবহানাআল্লাহ! অন্তরকে প্রশান্তিময় শীতলতায় ভরিয়ে তোলে এই আয়াত দুটি। জান্নাতবাসীরা যে বিমোহিত সুরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কৃতজ্ঞতা জানাবে সেকথাই ফুটে উঠেছে। সকাল থেকে ঘুরে ফিরে বার বার একটি হাদীসই পড়ছি। আবূ সাইদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “মহান প্রভু জান্নাতীদেরকে সম্বোধন করে বলবেন, ‘হে জান্নাতের অধিবাসিগণ!’ তাঁরা উত্তরে বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি হাযির আছি, যাবতীয় সুখ ও কল্যাণ তোমার হাতে আছে।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছ?’ তাঁরা বলবে, ‘আমাদের কি হয়েছে যে, সন্তুষ্ট হব না? হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো আমাদেরকে সেই জিনিস দান করেছ, যা তোমার কোন সৃষ্টিকে দান করনি।’ তখন তিনি বলবেন, ‘এর চেয়েও উত্তম কিছু তোমাদেরকে দান করব কি?’ তারা বলবে, ‘এর চেয়েও উত্তম বস্তু আর কী হতে পারে?’ মহান প্রভু জবাবে বলবেন, ‘তোমাদের উপর আমার সন্তুষ্টি অনিবার্য করব। তারপর আমি তোমাদের প্রতি কখনো অসন্তুষ্ট হব না।” রবের সন্তুষ্টি আদায়ে প্রাণটা উন্মুখ হয়ে আছে রে মা। দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্রে। কিন্তু নিজের জন্য কোন ফসলই তো এখনো ঘরে তুলতে পারলাম না। থেকে থেকেই তাই মনে কাঁপন উঠে যায়। শেষপর্যন্ত মিলবে তো রবের সন্তুষ্টি?  

শেষপর্যন্ত মিলবে তো রবের সন্তুষ্টি? প্রশ্নটার দিকে চোখ তুলে তাকানোর আগেই বুক কেঁপে উঠলো নূহারও। চলার পথে বার বারই থমকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যের সঠিক দিশাতেই যাচ্ছে কিনা সেটা দেখে নিতে শিখেছিল ছোটবেলাতেই। কিন্তু আজকাল যে সে থমকে দাঁড়াতেই ভুলে যাচ্ছে। চারপাশে ভালো মত খেয়াল না করেই উর্দ্ধশ্বাসে শুধু ছুটছে আর ছুটছে। বাড়ি থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে বড় ঘাটতি এতদিন মনে হয়েছে পরিবার ও সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকাটা। কিন্তু এখন আত্মোপলব্ধি হলো, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ইবাদত। দিন কে দিন হালকা হয়েছে আমলের ভান্ডার। ধারালো না হয়ে ক্রমাগত ভোঁতা হয়েছে আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা। যখন বাড়িতে ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাপীর সাথে অবশ্যই কিছুক্ষণ কুরআন ও হাদীস বিষয়ক আলোচনা করতো। প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে দশ আয়াত করে পড়া দিতেই হতো জাওয়াদকে। আদরের সময় আদর আর শাসনের সময় শাসন করা স্বভাবের মানুষ জাওয়াদ। তাই ফাঁকি দেবার কোন সুযোগ ছিল না। একদিন আলসেমি করে দশ আয়াতের বদলে পাঁচ আয়াত মুখস্ত করার এমন কথা শুনিয়েছিল। দ্বিতীয়বার কোনদিন আর পড়ায় ফাঁকি দেবার সাহস করেনি নূহা। সূরা কাহাফ পর্যন্ত মেমোরাইজও হয়ে গিয়েছিল জাওয়াদের লেগে থাকার কারণে। কিন্তু এরপর তার জীবনের অন্য আর সবকিছুর মতো আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনে ছুটে চলাটাও থেমে গিয়েছিল।

দুনিয়ার সকল মানুষের মধ্যে কমন জিনিসের একটি হচ্ছে, সবাই স্বপ্ন দেখে। সবাই বুকের মাঝে অনেক স্বপ্ন লালন করে। কিন্তু বেশির ভাগ স্বপ্নই একসময় হারিয়ে যায় জীবন প্রবাহে। আবার কিছু কিছু স্বপ্ন থেকে নিতে হয় স্বেচ্ছা অব্যহতি। তারপরও বেশির ভাগ স্বপ্নই থেকে যায় অপূর্ণ। তবে একটা স্বপ্ন আছে যেটা কখনোই হারিয়ে যাবার সুযোগ নেই। যে স্বপ্ন থেকে অব্যহতি নেবার অবকাশ নেই। যে স্বপ্ন অপুর্ণ হবে কিনা এই চিন্তা থেকে নিরাশ হবারও সুযোগ নেই। সেই স্বপ্নটা কি বল তো মা?

নূহা বলল, আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন আমিও দেখেছি বাপী। এখনো আমারও মনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন এটিই। এই স্বপ্নটা দেখা থেকে আমার হৃদয় কখনোই নিজেকে বঞ্চিত করেনি। তবে স্বপ্ন পূরণের রসদ সংগ্রহে কখনো বুঝে, কখনো বা না বুঝে অবহেলা অবশ্যই করেছি। সেজন্যই হয়তো স্বপ্নটা এখনো পাপড়ি মেলতে পারেনি, এখনো কলিই রয়ে গিয়েছে। অথচ আমি যাদেরকে দেখে এই স্বপ্নটা দেখতে শিখেছিলাম তারা শুধু আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েই ছেড়ে দেয়নি। বরং নিজেরা উদাহরণ হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে স্বপ্নকে মনের মাঝে লালন করতে হয়! কিভাবে কলিকে যত্ন করতে হয়, কিভাবে ডানা মেলতে সহায়তা করতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু স্বপ্ন একা একা কখনোই সফলতার দোর গোঁড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় না। সেজন্য সাথীর প্রয়োজন হয়। আমার স্বপ্নের সাথীরা আমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিল কিংবা আমিই তাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম বলেই হয়তো আমার স্বপ্নটা আজ যে শুধু দলছুট তাই নয়। ভীষণ রকম মলিনও।  

নূহার হাতের উপর হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে হাসি মুখে আফজাল সাহেব বললেন, ইনশাআল্লাহ সব আবার ঠিক হয়ে যাবে।

বেশ দৃঢ় কন্ঠে নূহা বলল, হ্যা বাপী সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবাই মিলে সবকিছু আবার ঠিক করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তারআগে তুমি আমাকে ঠিক করবে। যতদিন এখানে আছি প্রতিদিন তিন বেলা আমাকে একবার করে শাসন করবে।

যতদিন এখানে আছিস? তারমানে আবারো চলে যাবি?

নূহা চুপ করে থাকলে আফজাল সাহেবও বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। এরপর বললেন, নায়লার কি করলি শেষপর্যন্ত?

ভাইয়াদের অপছন্দের কথা জানিয়েছি ওকে। আমার অভিজ্ঞতার দ্বারা বোঝাতেও চেষ্টা করেছি। এরপর ভেবে দেখতে বলেছি। এখনো কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি।

ওর হাবভাবে কি মনে হলো তোর? মেনে নেবে নাকি ঝামেলা করবে?

একটু আগেই না তুমি আন্দাজে কথা বলা নিয়ে কত কিছু শোনালে আমাকে। আমার ধারণার কথা তাই বলবো না তোমাকে। নায়লা যখন সিদ্ধান্ত জানাবে তখনই একেবারে শুনে নিও।

আফজাল সাহেব হেসে বলল, সাইকোলজি নিয়ে বলাতে কি সাইকো মাস্টারের ইগোতে লেগেছে নাকি? নিজেই চিন্তা করে দেখ আদী আর তুই এই বাড়ির সবচেয়ে দুষ্টু স্বভাবের কিনা! ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার ওস্তাদ তোরা দুটাই।

মোটেই না। সবচেয়ে দুষ্টু স্বভাবের হচ্ছে উনি। উনি তোমার সামনে অতি ভদ্র ছেলে সেজে থাকেন। আর ইনিয়ে বিনিয়ে কথার তো বিশাল এক ফ্যাক্টরীর সত্ত্বাধিকারী উনি।

উনি উনি করছিস কেন? নাম ধরে ডাক নয়তো ভাইয়া বলে সম্বোধন কর। উনি উনি আবার কি? আর সবার আগে গিয়ে নায়লার সমস্যার সমাধান কর। আজ সকালে দেখেছি নুসরাত আর শরীফা বাগানে বসে ফিসফাস করছে। বাড়ির মহিলারা কোনায় কানায় বসে বসে ফিসফাস করা মোটেই ভালো লক্ষণ না। কিছু একটা পাকাচ্ছে এরা।

নূহা হেসে বলল, তুমি কি ভয় পাচ্ছো ছোট ফুপ্পি আরশের সাথে নায়লার বিয়ের প্রস্তাব দেবেন?

ভয় পাচ্ছি না। প্রস্তাব যে দেবে সেটা আমি শিওর। তিন-চার মাস আগে একদিন কথায় কথায় বলেছিল শরীফা আমাকে এই কথা।

যদি এমনটা হয়ও সমস্যা কি?

সমস্যা আছে। আরশের জন্য আমি অলরেডি মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছি।

প্রথমে বিস্ময় এরপর চেহারায় অভিমান ফুটিয়ে তুলে নূহা বলল, এটা কেমন কথা হলো? তুমি একা একা কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারো আরশের বিয়ের? আম্মি যখন এই কথাটা জানবে মনে আঘাত পাবে না? নির্ঘাৎ ভেবে নেবে আপন মা নন বলে তুমি উনাকে ছেলের জন্য বৌ পছন্দ করা থেকে বঞ্চিত করছো। এই বয়সে সংসারে এমন অশান্তি টেনে আনার বুদ্ধিটা তোমার মাথায় কিভাবে এলো?

তোর উনি উনি আছে না? তার মাথা থেকে এসেছে।

সেটা আবার কিভাবে?

সেটা আমি বলতে পারবো না। জানতে হলে জাওয়াদের সাথে কথা বলতে হবে তোকে। এখন এসব দুনিয়াবী চিন্তা ভাবনা থেকে লগ আউট করে চল মসজিদে যাই।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, দুনিয়াবী চিন্তা ভাবনা থেকে লগ আউট? ইয়া আল্লাহ! আমার বাপী এসব কি ভাষা বলছে।

আফজাল সাহেবও হেসে বললেন, এসব ভাষাও তোর উনি উনিই শিখিয়েছে আমাকে। ছেলেটা আসলেই বিশাল এক কথার ফ্যাক্টরীর সত্ত্বাধিকারী মাশাআল্লাহ। কিন্তু তুই এখন আমাকে কৈফিয়ত দে মাগরীবের নামাজ কেন মসজিদে পড়িসনি? আশেপাশে কোন মসজিদ নেই বলে বাড়ির বাইরে এত সুন্দর করে একটা মসজিদ তৈরি করলো জাওয়াদ। মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজ আদায়ের এত চমৎকার ব্যবস্থা করলো। অথচ বাড়ির কোন একজন সিনিয়র মহিলা নিয়মিত নামাজ আদায় করে না মসজিদে গিয়ে। নাবিহা, কাশফিয়া সহ বাচ্চারা ছাড়া শুধু আত্মজা আর জুয়াইরিয়া নিয়মিত মসজিদে যায়। এই বিষয়টা নিয়েও কথা বলবি তুই সবার সাথে। কিন্তু কোন মুখে বলবি? নিজেই তো যাসনি মাগরিবের সময়।

নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আর মিস হবে না। তুমি মসজিদে যাও। আমি বাড়ির মহিলাদেরকে নিয়ে আসছি।

তুই যা মহিলাদের সাথে কথা বল। আমি বইগুলো গুছিয়ে রেখে এরপর যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ।

নূহা তখন হাসি মুখে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে বাড়ির অন্দর মহলের দিকে রওনা দিলো।  

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৪



রান্নাঘরের ঢুকেই দু'হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে তওবা, তওবা, তওবা বলে ছোট খাট একটা চিৎকার দিলো নূহা।

খাদিজা বেগম বিকেলের নাস্তা বানাচ্ছিলেন আর রায়হান সাহেব পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎ নূহার চিৎকার শুনে দু'জনেই খানিকটা চমকে উঠলেন।

চোখের সামনে থাকে হাত না সরিয়েই নূহা বলল, আমি তো এসেছিলাম বিকেলের নাস্তার আয়োজন দেখতে। কিন্তু কিচেন যে লাভার পয়েন্ট হয়ে গিয়েছে সেটা তো জানাই ছিল না। দুঃখিত মিস্টার এন্ড মিসেস কোপত-কপোতি। আপনারা মনের আনন্দে বাক বাকুম করেন। আমি প্রস্থান করছি।

রায়হান সাহেব স্বশব্দে হেসে ফেললেন। খাদিজা বেগমও হেসে বললেন, থাপ্পড় খাবি একটা দুষ্টু মেয়ে। যাচ্ছিস কোথায়? এদিকে আয় চায়ের পানি বসা।

রায়হান সাহেব হেসে বললেন, হ্যা মা চা কর বেশি করে। কতদিন রান্নাঘরে বসে গল্প করতে করতে তোর হাতের চা খাওয়া হয়নি।

নূহা হেসে বলল, এক্ষুণি করছি পাপা। কিন্তু মা তুমি কেন নাস্তা বানাচ্ছো? বাড়ি ভর্তি বৌ। গেলো কোথায় সব গুলা একসাথে?

খাদিজা বেগম বললেন, ওরাই বানায় নাস্তা। আজ আমিই ইচ্ছে করে এসেছি। আমাদের বাড়িতে নাক বোঁচা, লিলিপুট সাইজের একজন মেহমান এসেছে। তার আবার আমার হাতের বুন্দিয়া আর নিমকি খুব পছন্দ। তাই বানাচ্ছি।

নূহা হেসে ফেললো। এরপর খাদিজা বেগমকে জড়িয়ে ধরে আদর করে চায়ের পানি চাপালো।

খাদিজা বেগম মৃদূ হেসে বললেন, আজ যে বললি না?

নূহা তাকিয়ে বলল, কি?

আমি লিলিপুট না তোমার ছেলে ল্যাম্পপোস্টের মতো লম্বা। আমার নাক একদম পারফেক্ট। তোমার ছেলের নাক আদিবাসীদের বর্শার মত।

নূহা হেসে বলল, জানোই তো সব শুধু শুধু বলার দরকার কি?

খালা-ভাগ্নীকে এখনই বাঁধা না দিলে ইমোশনাল হয়ে দুজন হয় কান্না করবে নয়তো ঝগড়া করবে সেটা জানা থাকার কারণে রায়হান প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে বললেন, নূহা মা আজ রাতে তোর সেই বিখ্যাত ককটেল বিরিয়ানী রান্না করার আইডিয়াটা কেমন হয় বলতো?

নূহা কিছু বলার আগেই খাদিজা বেগম বিরক্ত কন্ঠে বললেন, মেয়েটা আসতে না আসতেই তোমার ফরমায়েশ শুরু। আর রাতের বেলা বিরিয়ানী খাবে? প্রেশার আর ডায়াবেটিসের কি দশা সেটা খেয়াল আছে?

রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আছে আছে সবই খেয়াল আছে। কিন্তু আমার নূহা মার হাতের রান্নায় স্পেশাল বরকত আছে বুঝলে। যতই খাই না কেন প্রেশার আর ডায়াবেটিস ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকবে। তাই নারে মা?

নয়তো আবার কি? মা শোনো পাপার প্রেশার আর ডায়াবেটিসকে শুধু মিষ্টি করে বলতে হবে স্ট্যাচু। দেন খাওয়া-দাওয়া এন্ড দেন ওভার। এমন কত্তো করেছি আমি আর পাপা আগে।

সেটাই তো! তুমি বুঝলে না খাদিজা। মাথা নাড়তে নাড়তে আফসোসের সুরে বললো রায়হান সাহেব।

খাদিজা বেগম হেসে বললেন, আনন্দবাড়ির সব বুঝ তো তোমাদের চাচা-ভাতিজির মাথায়। আমরা ভাগে পেলেই না কিছু বুঝবো।

এই সময় মা মা বলে চিৎকার করতে করতে জিশান আর জারিফ ঢুকলো। এবং কাউকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুইজন দুইপাশ থেকে নূহাকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে বেড়িয়ে গেল।

রায়হান সাহেব হাসি মুখে বললেন, নূহা মা এসেছে দুই ঘন্টাও হয়নি। অথচ দেখো পুরো বাড়ির পরিবেশটাই কেমন আনন্দময় হয়ে উঠেছে আলহামদুলিল্লাহ।

খাদিজা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, বাড়ির সব পাপেট আর তাদের সুতো নূহার আঙ্গুলে জড়ানো। বুঝলে?

রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোমাদের সব কয়টা বোন আর তাদের কন্যাদের এই একটা জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি মিল। তোমরা সবাই কথার সম্রাজ্ঞী। আমাদের বিয়ের পর তুমি অনর্গল কথা বলতে আর আমি বিমোহিত হয়ে শুনতাম তোমার কথা। নূহা মা আর জাওয়াদের বিয়ের পরও প্রায়ই দেখতাম নূহা মা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে আর জাওয়াদ ঠোঁটের কোণে হাসি মেখে চুপচাপ বসে কথা শুনে যাচ্ছে।

কি সাংঘাতিক কথা! তুমি কি ছেলে আর ছেলের বৌয়ের দিকে নজর রাখতে নাকি?

রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে বলল, তোমার চেয়ে মনেহয় একটু কমই রাখতাম। তাছাড়া তোমার ছেলে আর ছেলের বৌ তাদের রুমে কম আর বাগানে, ছাদে, লনে নয়তো বারান্দায় বসে কথা বেশি বলতো। সেই কথা কি মনে আছে?

খাদিজা বেগম হেসে বলল, রান্নাঘরেও। জাওয়াদ যে এমন বৌ পাগল স্বভাবের হবে আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। বাড়িতে থাকলে নূহা যেখানে যেত পিছু পিছু সেখানেই হাজির হয়ে যেত। কতদিন যে আমি ধমক দিয়ে রান্নাঘর থেকে ওকে তাড়িয়েছি। তবে আমি সবচেয়ে বেশি কি মিস করি জানো?

হুম, ওদের মায়ায় জড়ানো খুনসুটি।

হ্য ননস্টপ চলতেই থাকতো দুইজনের খুনসুটি। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে শুরু করতো রাতে বাড়ি নীরব হয়ে যাবার পরও জাওয়াদের হাসির শব্দ ভেসে আসতো মাঝে মাঝে। সারা জীবনে আমি আমার ছেলেকে যতটা না হাসি-আনন্দে দেখেছি, তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি ঐ আড়াই বছরে দেখেছি। এখনো জাওয়াদ সারাক্ষণই হাসে, দুষ্টুমি করে কিন্তু কি যেন একটা নেই ওর এই হাসিতে যা তখনকার হাসিতে ছিল। আজকাল প্রায়ই মনেহয় দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেবার আগে কি আবারো আমার ছেলের ওমন অন্তর শীতল করা হাসি শুনতে পাবো?

স্ত্রী কাঁধে হাত রেখে রায়হান সাহেব বললেন, এসব কথা ভেবে শুধু শুধু মন খারাপ করো না খাজিদা। আর নূহা মাকে আবার এসব বলতে যেও না। মেয়েটা এত বছর পর সবার সাথে কয়েকটা দিন থাকতে এসেছে। ওকে হাসি-আনন্দে কাটাতে দিও সময়টা তোমরা। সুরাইয়া, নুসরাত, শরীফা ওদেরকেও বলে দিও যেন এমন কিছু না বলে যাতে নূহা আপসেট হতে পারে। আর রাহাতের আদর-যত্নেও যেন কোন অবহেলা না হয়। মনে আছে তো নূহার সাথে বিয়ের সময় রাহাতকে আমরা আমাদের ছোট ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছিলাম সবার কাছে।

আমার সব মনেআছে। ইনশাআল্লাহ রাহাতেরও কোন অযত্ন হবে না। তুমি যাও দেখো কি করছে তোমার নাতী-নাত্নীরা মিলে ওদের মায়ের সাথে।

রায়হান সাহেব বেরিয়ে যাবার পর এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ধীরে ধীরে ছাড়লেন খাদিজা বেগম। নূহা বাড়িতে এলে খুশি যেমন হন, তেমনি ক্ষণে ক্ষণেই মনটা অতীতের আনন্দময় দিনগুলোতে ছুট লাগায়। এখন যেমন মনে হচ্ছিলো ঐ তো জাওয়াদ আর নূহা নাস্তার টেবিলে বসে নিত্যদিনের মতো কোন একটা টপিক নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছে। এক পর্যায়ে তোমার সাথে কথা বলাটাই অর্থহীন বলে রাগ করে উঠে বাইরে চলে গেলো জাওয়াদ। নূহা কিছুক্ষণ গুম ধরে বসে থেকে ধুপধাপ করে নিজের চলে গেলো। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই পুত্র আর পুত্র বধূর এইসব কর্মকান্ড গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল খাদিজা বেগমের। প্রথম প্রথম কিছুটা চিন্তিত, এরপর কিছুদিন বিরক্ত হলেও শেষের দিকে ব্যাপক মজা পেতেন ওদের ঝগড়াঝাঁটি দেখে।      

আদরের বৌয়ের সাথে রাগ করে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা সম্ভব হতো না জাওয়াদের। কিন্তু একদিন ঝগড়া করে বেরোনোর পরও একদম বিকেলে বাসায় ফিরলো। খাদিজা বেগম জাওয়াদকে দেখে বললেন, অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে সারাদিন তোর বৌ বেডরুম থেকে বের হয়নি। কিছু খায়ওনি। আমি বেশ কয়েকবার তেল মেজেছি কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

জাওয়াদ জবাবে বলেছিল, পিচ্ছিল পদার্থকে তেল মাজলে কাজ না হওয়াটাই স্বাভাবিক মা। কিছু কিছু মানুষ হচ্ছে বাইম মাছের মতো। তাদেরকে ছাই দিয়ে ধরতে হয়। আমার সাথে চলো মা তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি কিভাবে ধরতে হয়।

খাদিজা বেগম হাসতে হাসতে বললেন, হয়েছে আমাকে শেখাতে হবে না। তোর বাইম মাছ তুই ধরতে পারলেই যথেষ্ট। যা গিয়ে ধরে নিয়ে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।

নাহ খাবার বরং আমি সাথে করে রুমে নিয়ে যাই। মাছ এখন নদীতে তাকে ডাঙ্গায় উঠানোর জন্য খাদ্য দরকার।

খাদিজা বেগম খাবার রেডি করে দিলে জাওয়াদ রুমে গেলো। খাবারের প্লেট হাতে জাওয়াদকে রুমে ঢুকতে দেখার সাথে সাথে চোখ-মুখ গম্ভীর করে ফেলেছিল নূহা। জাওয়াদ খুব স্বাভাবিক ভাবে পাশে গিয়ে বসে বলল, সুন্দর সুন্দর করে একটু হা করো তো নূহা বেবী! এসো তোমাকে খাইয়ে দেই। মা বললো তুমি নাকি সকাল থেকে কিছুই খাওনি? এটা কিছু হলো? তোমার সাথে শেষ বোঝাপড়া করার স্বিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি ফিরেছি আমি। কঠিন কিছু কথা বলবো আজ তোমাকে। সেসব শুনে যাতে ফিট না খাও। সেজন্য আগে খাদ্য খেয়ে ফিজিক্যালি ফিট হতে হবে তোমাকে। সকালের কথাই ভেবে দেখো। নাস্তা করেছিলে বলেই তো ঐভাবে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পেরেছিলে।  

আমি চিৎকার-চেঁচামেচি করছি? নাকি তুমি আমাকে উল্টো পাল্টা কথা বলেছিলে?

আমি তোমাকে উল্টো পাল্টা কথা বলেছি? আমি? কখন?

কখন মানে? সকালে। আমাকে ব্লক হেডেড গার্ল বলেছো। আরো বলেছো আমি ইগোইস্ট, অ্যারোগেন্ট।

এসব তো সঠিক কথা। উল্টো পাল্টা কি বলেছি সেটা শুনি?

সামনে থেকে যাও। কথা বলবে না আমার সাথে তুমি। খবরদার বলছি।

ঠিকআছে এই কথাগুলোই যদি তোমার কাছে উল্টো পাল্টা মনে হয়ে থাকে। তাহলে ভেবে চিন্তে বলো যে, এই কথাগুলো বলতে আমাকে বাধ্য কে করেছিল?

তোমাকে আবার বাধ্য করা লাগে নাকি? তোমার তো জন্ম থেকেই বিষ জবান। 

আচ্ছা ঠিকআছে কার জবানে মধু আর কার জবানে বিষ সেটা নিয়েই আজ ডিবেট হবে। এখন আগে তুমি খেয়ে নাও। আরে এখনো মুখ করে রেখেছো বন্ধ কেন? হা করো।

নূহা তখন বাধ্য মেয়ের মতো হা করলো।

নূহাকে খাইয়ে দিতে দিতে জাওয়াদ বলল, চোখ মুখ এমন ফোলা ফোলা কেন তোমার? কান্না টান্না করেছো নাকি?

করলে করেছি। তাতে তোমার কি?

আমার কিছুই না। জাস্ট কি পরিমাণ লবণ পানি শরীর থেকে বের হয়েছে সেই সম্পর্কে অবগত হতে চাইছি। আমি এক গ্লাস লবণ পানি নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। সমান সমান হবে তো নাকি আরো আনতে হবে?

ব্যাস একটুকু কথাতেই রাগ ভুলে হেসে ফেললো নূহা। তারপর জাওয়াদকে ঢিসুম করে ঘুষি লাগিয়ে বলল, তুমি একটা অসহ্য। যাও তোমার হাতে আমি খাবো না। এতক্ষণ যা খেয়েছি সব এখন গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে ফেলে দেব।

জাওয়াদ হেসে ফেলেছিল তখন। হাসির আভা ফুটে উঠেছিল নূহার চেহারা জুড়েও।

বাগান থেকে বাচ্চাদের প্রচন্ড রকম হৈ চৈ ভেসে এসে খাজিদা বেগমের দিবা স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে গেলো হঠাৎ করেই। বুন্দিয়া ভাঁজাও শেষ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। নাস্তা বানানোর কাজে সমাপ্তি টেনে নাতী-নাতনীদের আনন্দ উল্লাসে শরিক হবার জন্য বাগানের দিকে রওনা দিলেন তিনি।

@

বাড়িতে আসার পর থেকেই আত্মজা ঘুরে ঘুরে একটু পর পর শুধু একই প্রশ্ন করছিল, আপ্পা বাপীর সাথে কখন কথা বলবে? তোমার কোন ঠিক ঠিকানা নেই দেখা যাবে একটু পরেই দুই সপ্তাহ থাকার প্ল্যান ক্যান্সেল করে তুমি ছুট লাগাবে। সবার আগে তাই বাপীর সাথে কথা বলতে হবে তোমাকে। নয়তো আমি এক মূহুর্তের জন্যও তোমাকে শান্তিতে কোথাও বসতে দেবো না। আত্মজার সামনে হাসলেও মনে মনে নিজের ইমেজের কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাড়ির ছোটদের কাছে ভেবে খুবই লজ্জা লাগছিল নূহার। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। পর মূহুর্তেই আবার মনেহলো এখন নিজের উপর রাগ করার নয়, নিজের হারানো ইমেজকে ফিরিয়ে আনার সময়। একসময় খুব দৃঢ়তার সাথে বলতো, আলহামদুলিল্লাহ নূহা যা বলে তাই করে। কিন্তু সেই নূহা যে নিজের মাঝেই কোথাও গুম হয়ে গিয়েছে সেটা আজকাল খুব ভালো ভাবেই টের পাচ্ছিলো। তাকে খুব দ্রুত ফিরিয়ে আনার তাগিদও অনুভব করছিল। মাগরীবের নামাজ আদায় করার পর বাচ্চাদের কাছ থেকে এক ঘন্টার ছুটি নিয়ে বাপীর সন্ধানে বের হলো নূহা। নুসরাত খালামণির ছোট কন্যা জুয়াইরিয়াকে একা একাই গজগজ করতে করতে বারান্দার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় পায়চারী করতে দেখে দাঁড়িয়ে ওকে টেনে ধরে থামালো নূহা। জুয়াইরিয়া থেমে নূহাকে দেখে বলল, ওহ! সরি আপ্পা তুমি কখন এসেছো? খেয়াল করিনি একদম। কিন্তু বেখেয়াল হবো না কেন বলো? চারপাশের মানুষগুলোর কর্মকান্ড দেখলে মাথা ঠিক থাকে না। 

হাসি মুখে নূহা বলল, চারপাশের মানুষ আবার কি করলো তোকে?

প্রচন্ড বিরক্তি মেশানো কন্ঠে জুয়াইরিয়া বলল, মানুষের মুখে এক কথা আর অন্তরে আরেক কথা। এদের দেখে মনেহয় দুনিয়াটা আসলেই একটা নাট্যশালা আর এরা সবাই অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাই সর্বক্ষেত্রে অভিনয় করে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে।

হেসে ফেললো নূহা। ছোট বোনের স্বভাব অজানা নয় মোটেই। কথা ও কাজের অমিল একটুও পছন্দ করে না। মেনে নিতে পারে না কথা ও আচরণের পার্থক্যকে। নিজেও খুব সতর্ক এই ব্যাপারে। কিন্তু অনেক সময় যে মানুষ ইচ্ছের বিরুদ্ধেও কথা ও কাজের গড়মিল করতে বাধ্য হত এটা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। 

নূহাকে হাসতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো জুয়াইরিয়া। বিষাদ জড়ানো কন্ঠে বলল, জানো আপ্পা আজকাল মনেহয় জীবনটা আসলেই এক নাট্যশালা। আর মানুষ বিভিন্ন দৃশ্য প্রতিনিয়তই শুধু অভিনয় করে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, মানুষকে অভিনয় করতে হয় এটাকে কি ভয়াবহ কোন সমস্যা মনেহয় তোর?  

তোমার হয় না?

আমার কেন জানি এমনটা মনেহয় না বরং মনেহয় এটাই স্বাভাবিক। জীবনে যেহেতু অসংখ্য চরিত্র, অসংখ্য দৃশ্য তাই সর্বক্ষেত্রে একই রকম আচরণ করা সম্ভব নয়। সেহেতু দৃশ্য ভেদে কার্যকলাপ ভিন্ন ভিন্ন হতেই হবে। ভেবে দেখ, একজন নাটকের অভিনেত্রী যখন কোন দৃশ্য অভিনয় করে যে সর্বান্তক চেষ্টা করে সেই মুহুর্ত ও চরিত্রের সাথে মিশে যেতে। কারণ সে জানে যে তার অভিনয় ভালো না হলে পুরো পরিশ্রম বৃথা যাবে। তার নাটক ফ্লপ করবে। সে সম্মানী পাবে না, সম্মানী পেলেও খ্যাতি পাবে না। অথচ অভিনয় ভালো হলে বিখ্যাতও হয়ে যেতে পারে। তাই বার বার সে চেষ্টা করে অভিনয়কে নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করতে।

হুম! তা ঠিক।  

মানুষ ভাবুক মনের ছন্দে কল্পে শব্দে বিজ্ঞের ছলে বলে তো ফেলে জীবন এক অভিনয় ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু নিজ নিজ দৃশ্য অভিনয় করতে অপারগতা প্রকাশ করে। যেমন, অফিসের দৃশ্য মন থাকে বাসায়, আবার ক্লাসের দৃশ্য মন বের হয় বিশ্বভ্রমণে। তাই তোর যদি মনেহয় জীবন এক নাট্যশালা। তাহলে আপসোস আর দীর্ঘশ্বাসের বদলে যখন যে দৃশ্য এসে হাজির হবে, তখন সেই চরিত্রে নিখুঁত অভিনয় করার চেষ্টা করবি। এখন যেহেতু আমার সামনে আছিস পারফেক্ট ছোট বোন হতে চেষ্টা কর। যা আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আয়। তারআগে বলে দে ঠিক কোথায় গেলে তোর বিপিতাকে পাওয়া যাবে?

জুয়াইরিয়া হাসতে হাসতে বলল, বাপীকে কিছুক্ষণ আগে মসজিদ থেকে বের হয়ে লাইব্রেরীর দিকে যেতে দেখেছি। জানো আপ্পা তোমার সাথে কথা বললে মনের ক্ষোভ উবে যায়। তখন মনেহয় চারপাশের সবাই ঠিক আছে। আমিই মনেহয় বুঝতে ভুল করি।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। সূরা আনআম এর ৩২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,“আর দুনিয়ার জীবন? এ তো খেল তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। পরকালের বাড়ী ঘর তাদের জন্য উত্‍কৃষ্ট যারা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে। তোমরা কি তা অনুধাবন করনা?” আমার কি মনেহয় জানিস? জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যকে সুষ্ঠভাবে পালন করার জন্য মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজনীয়তা অনিস্বীকার্য। কেননা যে কোন কাজের সুষ্ঠ সম্পাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে মানসিক স্থিরতা। এই মানসিক স্থিরতা আসে মনের আনন্দময়তা থেকে। আনন্দময়তা আসে ভালো লাগা থেকে। ভালো লাগা আসে মনের চাহিদা পূরণের তৃপ্তি থেকে। আর এই তৃপ্তি পেতে গিয়েই আমরা ভুলে যাই মানব জীবনের শেষ পরিণতি হচ্ছে পরকালের জীবন।  

হ্যা আপ্পা ঠিক বলেছো।  

সেই উপলব্ধি দিয়ে কি হবে বল যা আয়না তো হতে পারেই না উল্টো ভুল প্রতিচ্ছবি দেখায়? পৃথিবীর জীবন হচ্ছে পরকালের জীবনের পূর্বশর্ত। আর পরকালের জীবন হচ্ছে পৃথিবীর জীবনের আয়নায় প্রতিচ্ছবি। এই জীবনে আমরা যাই করবো পরকালের জীবনে সেটাই পাবো। এই জীবনের ধ্বনিত শব্দরাই প্রতিধ্বনি তুলবে পরকালে। এই জীবনের অভিনয় যত ভালো হবে, পরকালে মূল্যায়ন তত বেশি হবে। তাই পরকালের জীবনে পুরষ্কার পেতে চাইলে পৃথিবীর জীবনে করা অভিনয়ের মাধ্যমেই তা লাভ করতে  হবে। তাই জীবনকে যদি তোর অভিনয় মনেহয় তাহলে নিজেকে ভালো অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোল। জীবন যখন যে দৃশ্যের অবতারণা করবে তার সামনে, সেই দৃশ্যকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা। কখনো বাবা-মা, কখনো সন্তান, কখনো ভাই-বোন, কখনো প্রতিবেশী, কখনো ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষক, কখনো বা পথচারী। চরিত্র যেটাই হোক অভিনয় হতে হবে একদম খাঁটি। অ্যাওয়ার্ড না পেলেও অন্তত নমিনেশন পাওয়ার মত।কারণ প্রতি মুহুর্তেই পড়ছে আয়নায় প্রতিচ্ছবি। বুঝেছিস?

জুয়াইরিয়া হেসে বলল, জ্বি আপ্পা। আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকআছে তুমি যাও বাপীর কাছে। আমি এক্ষুণি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি ইনশাআল্লাহ।

বোনের গাল টেনে আদর করে দিয়ে লাইব্রেরীর দিকে হাঁটতে শুরু করলো নূহা। 

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৩



নায়লাকে নিয়ে বাসায় ঢোকার পর পরই আবার ডোর বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে উপরের ফ্ল্যাটের সুমাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলেও হেসে সালাম দিলো নূহা।

সালামের জবাব দিয়ে সুমাইয়া বলল, উপর থেকে আপনাকে বাসায় ঢুকতে দেখেই চলে এসেছি আপু। আপনি ব্যস্ত না থাকলে খুব জরুরি কিছু কথা বলতাম আপনার সাথে।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি ফ্রি আছি। এসো ভেতরে এসো। সুমাইয়াকে সাথে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো নূহা। খেয়াল করলো বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে। এক বছর আগে উপরের ফ্ল্যাটে ভাড়া এসেছিল সুমাইয়াদের পরিবার। তখন থেকেই নূহার সাথে পরিচয়। নূহা বাসায় থাকলে মাঝে মাঝে চলে আসে গল্প করার জন্য। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে সুমাইয়া সবার বড়। খুবই শান্ত ও অমায়িক স্বভাবের মেয়ে। প্রথমদিন দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল নূহার। পরিবার খুব একটা প্রাক্টিসিং না কিন্তু শরীয়তের বিধি-নিষেধ মেনে চলার ব্যাপারে সুমাইয়া যথেষ্ট আন্তরিক। সেজন্য নূহাও চেষ্টা করে ওকে সময় দিতে।

সুমাইয়া বলল, আমাদের পারিবারিক একটা ব্যাপারে আপনার পরামর্শ চাই আপু। সমস্যাটা আমার ছোট বোনকে নিয়ে। এবার কলেজে উঠেছে তানিয়া। হয়তো খেয়াল করেছেন তানিয়া একদমই আমার মতো না। কিন্তু ওকে আমি অনেক ভালোবাসি। খুব বেশি আদরের বোন আমার তানিয়া। যখন ছোট ছিল আম্মু তো জব করতেন। তানিয়া আমার কাছেই বেশি থেকেছে। ছোটবেলায় অনেক সুইট ছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে তানিয়া যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। ওর কথা, কাজ, আচরণ ভীষণ কষ্ট দেয় আমাকে। ভালো কথা বললেও খুব রুড বিহেব করে। আমাদের কথা একদমই কেয়ার করে না। যা মন চায় চাই করে। ওর ফ্রেন্ড সার্কালটাও ভালো না খুব একটা। সবকিছু মিলিয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিভাবে ওকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবো। কারণ আমার কথা তো পাত্তাই দেয় না এক অর্থে।

যখন তানিয়ার মন মেজাজ খুব ভালো থাকে তখন এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে দেখেছো কখনো?

হ্যা আপু দেখেছি। কিন্তু মন মেজাজ যতই ভালো থাকুক বোঝাতে গেলেই নিজের সাপোর্টে তর্ক করতে শুরু করে। খুব অসম্মান করে কথা বলে তখনো।

পরিবারে বা পরিবারের বাইরে এমন কেউ কি আছে যার কথা তানিয়া মনোযোগ দিয়ে শুনবে বা সামান্য কিছু হলেও মেনে নেবে?

আব্বুর কথা শোনে চুপচাপ। কিন্তু করার সময় আবার সেটাই করে সেটা ওর নিজের ইচ্ছে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, এমন স্বভাব সাধারণত কেউ সাথে করে নিয়ে জন্মায় না। পরিবেশ-পরিস্থিতি, সঙ্গ ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে ধীরে ধীরে একজন মানুষ এমন বাজে ভাবে নিজেকে উপস্থাপন এবং জাহির করতে শুরু করে। তানিয়াও নিশ্চয়ই একদিনেই এমন স্বেচ্ছাচারী স্বভাবের হয়ে যায়নি। আসলে একজন মানুষের আবেগের প্রকাশ, ধরণ, মোটকথা আবেগীয় শিক্ষার জন্য তার জীবনের প্রথম ছয় বছর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা দ্বারাও প্রমাণিত, চার থেকে ছয় বছর বয়সে একটি শিশু নিজের আবেগীয় আত্মনিয়ন্ত্রণে যে দক্ষতা অর্জন করে সেটার উপর নির্ভর করেই তার জীবনের গতিপথ পরিচালিত হয়। তুমি নিজের একটি আচরণের দিকে ভালোভাবে খেয়াল করলেও এই কানেকশনটা বুঝতে পারবে। আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে জীবনের প্রথম যখন একটা শিশু জেনে, বুঝে সজ্ঞানে কোন ভালো কাজ কিংবা মন্দ কাজ করে। অভিভাভকগণ সেটাকে কিভাবে নিচ্ছেন এটা খুব প্রভাবিত করে শিশুটির পরবর্তী কর্মকান্ড ও আচার-আচরণকে। যেমন ধরো, তানিয়া যেদিন প্রথম তোমাকে অসম্মান করেছিল। সেদিন নিশ্চয়ই এতটা কষ্ট পাওনি তুমি?    

জ্বিনা আপু। ছোট মানুষ না বুঝে এমনটা করেছে ফেলেছে ভেবে নিজেও অতটা কেয়ার করেনি।

কিন্তু তুমি যদি সেদিন কেয়ার করতে তাহলে হয়তো আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হতো না তোমাকে। সেদিন যদি কিছুটা সময় পর আদর করে তানিয়াকে বুঝিয়ে দিতে তুমি ওকে কতটা ভালোবাসো বলে ওর অন্যায় আচরণকে ক্ষমা করে দিয়েছো। যদি বুঝিয়ে বলতে বড়দের সাথে কখনোই অসম্মান করে কথা বলতে হয় না। তাহলে নিশ্চয়ই তানিয়া বুঝতো। কারণ বাচ্চারা বোঝালেই বোঝে এবং মেনে চলারও চেষ্টা করে। বড়রাই বোঝানোটাকে ঝামেলা মনে করে, এখন ছোট বুঝতে শিখলেই ঠিক হয়ে যাবে এমন চিন্তা করে ধীরে ধীরে আত্মিক আঁধারে ঠেলে দেয় শিশুদেরকে। এবং একটা সময় এই আঁধারে তাদেরকেই নিমজ্জিত হতে হয়।

নিজেদের ভুল বুঝতে পারছি আপু। কিন্তু এখন করণীয় কি?

করণীয় একটিই ওকে আত্মিক আঁধারের রুদ্ধ কুঠুরি থেকে আলোকিত বাতায়নের সম্মুখে এনে দাঁড় করানো। কিন্তু সেজন্য ধৈর্য্য ধরে ওর পেছনে লেগে থাকতে হবে। আবার এটাও ঠিক যে, অশুদ্ধ পরিবেশে নিজে শুদ্ধ থাকতে চাইবার সবচেয়ে বড় যাতনা হচ্ছে, চারপাশের বেশির ভাগ মানুষের অপছন্দের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে নেয়া। ভালো পরামর্শ দিয়ে তখন বদলে কষ্টই পেতে হয়। তবে এরচেয়েও ভয়াবহ কষ্টের হচ্ছে যখন দেখতে পাবে তোমার দেখানো পথ সঠিক হবার পরও কেউ কেউ বেঠিক পথ ছেড়ে না দিয়ে শুধু তোমার সামনে সঠিক পথে চলার অভিনয় করছে। অর্থাৎ, তারা নিজেকে সংশোধন করে না। শুধু যে তাকে সংশোধন করতে চায় তার সামনে নিজের অশুদ্ধ কাজগুলোকে আড়াল করে রাখে। যাতে কেউ তাদের কাজে ইন্টারফেয়ার করার সুযোগ না পায়। এমন কাউকে দেখলে খুব ইচ্ছে জাগে বুঝিয়ে বলতে যে এই ধোঁকা মূলত সেই ব্যক্তিকে নয় বরং নিজেকেই দিচ্ছে। নিজেই নিজেকে ধোঁকা দেবার অর্থ নিজের তৈরি গোলোকধাঁধার চোরাবালির মাঝে ধীরে ধীরে নিজেকে তলিয়ে যেতে দেয়া। কিন্তু একথাটা বোঝানোটাও খুব সহজ কিছু নয়। আসলে কি জানো? জীবনে প্রিয়জনদের মূল্য বুঝি না বলেই আমরা তাদের সাথে নিষ্ঠুর হতে পারি, তাদেরকে আঘাত, অসম্মান করতে পারি। তাদের কল্যাণ কামনা করা আমাদেরকে বিরক্ত করে, রাগানিত্ব করে। এজন্য মূলত ছোটবেলা থেকেই জীবনে পরিবার ও প্রিয়জনদের মূল্য বোঝানোর চেষ্টা করা উচিত। কেননা শুধুমাত্র জীবনে কারো মুল্য কতখানিক এই বোধটাই তাকে যথাযথ মূল্যায়নে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

কিভাবে তানিয়াকে ওর জীবনে আমার মূল্য বোঝাবো আপু?

একমাত্র ভালোবাসার দ্বারাই কারো জীবনে কারো মূল্য উপলব্ধি এবং শূন্যতা তৈরি করা সম্ভব। তবে সেই ভালোবাসার ধরণ ভিন্ন ভিন্ন হতে হবে। কখনো শাসন, কখনো মেনে নেয়া, কখনো এড়িয়ে চলে, কখনো জোড় করে চাপিয়ে দিয়ে, কখনো সম্পূর্ণ ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়ে, কখনো বা বাধ্য করে, শুধু ভালোবাসা দিয়ে যাও উড়ার করে।

সুমাইয়া হেসে বলল, অনেক কঠিন কাজ আপু এটা। তারপরও আমি চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ ঐ চেষ্টাটাই সবচেয়ে বেশি দরকার জীবনে। একজন মনিষী বলেছিলেন, “ইচ্ছা ও চেষ্টার মাঝে লুকিয়ে থাকা আশা, এক বিন্দু আলো হয়ে দূর করে দেয় হতাশা।”

অনেক সুন্দর তো কথাটা। কে বলেছে আপু?

নূহা হাসি চেপে বলল, তুমি চিনবে না। উনি আননোন। যাইহোক, কি খাবে বলো? দেশ থেকে আসা খাঁটি খেজুরের গুঁড় আর বিন্নি চাল দিয়ে পায়েশ রান্না করেছিলাম। ফ্রিজে রাখা আছে। একটু কষ্ট করে নিয়ে নাও। আর যাবার সময় তোমাদের বাসার সবার জন্যও নিয়ে যেও। আমি তোমাদের বাসায় পাঠানোর নিয়্যাত করেই বেশি রান্না করেছিলাম। কিন্তু নানান ব্যস্ততায় পাঠাতে ভুলে গিয়েছি।

নায়লা উঁকি দিয়ে হাসি মুখে বলল, আপ্পা আমিও খেজুরের গুঁড় আর বিন্নি চাল পায়েশ খাচ্ছি। সুমাইয়া আপু তুমি বোস আমি নিয়ে আসছি তোমার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই পায়েশ নিয়ে এসে সুমাইয়া দিয়ে পাশে বসে নায়লা বলল, জীবনে প্রিয়জনের মূল্য বুঝে নেবার কোন শর্টকার্ট ওয়ে আছে আপ্পা?

নূহা হেসে বলল, মনেহয় আছে। মনের মাঝে প্রিয়জনদেরকে ঘিরে স্মৃতিগুলোকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখা। তোর মনেআছে নায়লা বছর তিনেক আগে ফিজিক্যল কিছু সমস্যার কারণে প্রায় ছয় মাসেরও বেশি একদম বেড রেস্টে থাকতে হয়েছিল আমাকে?

হ্যা আপ্পা মনেআছে। আমি, আত্মজা, জুরাইরিয়া প্রায়ই চলে আসতাম তখন তোমার সাথে সময় কাটাতে।

নূহা হেসে বলল, হ্যা। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই আমাকে একদম একা থাকতে হতো বাসায়। জারিফ স্কুলে আর রাহাত কাজে চলে যাবার পর দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা একদম একাকী কাটতো আমার। অবশ্য বই পড়ার তীব্র নেশা থাকার কারণে সময় কাটানো নিয়ে কখনোই তেমন সমস্যায় পরতে হয়নি আমাকে। উল্টো বরং সময়কে ধরার জন্য ছুটতে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে দু’একটা দিন এমন আসতো যে বই পড়তে ইচ্ছে করতো না। সংসারের কাজগুলো পড়ে আছে দেখেও হাত লাগানোর তাগিদা অনুভব করতাম না। বিছানার চাদরে সামান্য ভাঁজ দেখলে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলা এই আমিই, পুরো এলোমেলো বিছানার দেখেও নির্বিকার বসে থাকতাম। সময়টা তখন কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে থাকতো। ঘড়ির দিকে তাকালে মনেহতো সেই কখন দেখেছি দশটা বাজে, এতক্ষণে মাত্র দশ মিনিট পেরিয়েছে? এমন যতগুলো দিন এসেছে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও এলোমেলো করে দিয়ে গিয়েছে আমার ছোট্ট ভুবনটাকে। খুব খেয়ালি আমাকে করে দিয়েছে ভীষণ রকম বেখেয়ালি। তাই হিসেব কষতে বসেছিলাম কেন হয় এমন? কেন মন হঠাৎ শরতের আকাশ হয়ে যায়? এই মেঘ তো এই রোদ্দুর? বাঁধ ভাঙ্গা জোছনা ভরা আকাশে কেন হঠাৎ ই আঘাত হানে কালবৈশাখীর ঝড়? বার বার জিজ্ঞেস করার পর মন একটাই জবাব দিতো, তোমার প্রিয়জনরা যে তোমার থেকে দূরে বহুদূরে, সেজন্য তোমার মনটা হয়ে যায় বাউন্ডুলে, ভবঘুরে।

নায়লা আর সুমাইয়ার সাথে সাথে নূহাও হেসে ফেললো। এক মূহুর্ত পরেই আবার বলল, সবার জীবনেই প্রিয় মানুষেরা সবসময় আলাদা স্থান দখল করে থাকে। জীবনে চলার পথে আমরা যত এগোতে থাকি, বাড়তে থাকে প্রিয় মানুষদের সংখ্যা। মনের পাতায় ছাপ ফেলতে থাকে কারো কথা, কারো লেখা, কারো হাসি, কারো সঙ্গ! ধীরে ধীরে আপন অস্তিত্বের সাথে একাকার হয়ে যেতে থাকে প্রিয় মানুষগুলো। সময়ের স্রোতে ভেসে কিছু প্রিয় মানুষ দূরে চলে যায়, মনে নোঙ্গর গাড়ে নতুন প্রিয়রা। তাদেরকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলে জীবন ভেলা। কিন্তু যারা দূরে চলে যায় নানা কারণে তারা কি সত্যিই হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে? আমার উপলব্ধি বলে নিষ্ঠুর নিয়তি মন থেকে কাউকেই একেবারে মুছে যেতে দেয় না। আর ভুলে যে যাবো তারও উপায় নেই, কারণ তারা যে আমাদের  প্রিয়জন। প্রি-য়-জ-ন.....! চাইলেই কি তাদেরকে ভুলে যাওয়া যায়? লাইব্রেরীতে গেলেই সবার আগে বাপীর চেহারাটা ভেসে আসে মনের পর্দায়। প্রকৃতি সান্নিধ্যে গেলে মনেহয় বাবার কোলেই বুঝি মুখ গুঁজে বসে আছি। যখনই কোন বাঁধা সম্মুখে এসে দাঁড়ায় পাপার প্রশান্ত চেহারাটা মনে করিয়ে দেয়, পরীক্ষা আসে উন্মোচিত করতে যোগ্যতা, দেখিয়ে যায় চুপিচুপি লুকায়িত ক্ষমতা। জারিফকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতে গেলেই মামণির স্মরণে অন্তত সিক্ত হয়ে ওঠে। মজাদার কোন রান্না করার সময় মনেপড়ে কত যত্ন করেই না মা আমাকে রান্না করতে শিখিয়েছিলেন। সাংসারিক কোন বিষয়ে নিজের যুক্তিগুলোকে যখনই যাচাই করে নেবার প্রয়োজনীয়তা ফিল করি। আম্মির ভ্রূ কুঁচকে থাকা মিষ্টি চেহারাটাই সবার আগে মনে এসে দোলা দিয়ে যায়। শিশুদেরকে যখন দেখি মনের আনন্দে খেয়াল মগ্ন, আমার ছোটবেলার খেলার সাথী ভাইবোনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। এমনি করেই নানুমণি-নানাভাই,মামা-মামী,চাচ্চু-ফুপ্পি কত শত প্রিয়জনদেরকে ঘিরে রঙ-বেরঙের স্মৃতির সমাহার মনের মাঝে।  

নায়লা বলল, এমন স্মৃতি তো আমাদেরও আছে। কিন্তু তোমার মতো করে নোটিশ করা হয় না আসলে। তাই হয়তো উপলব্ধি করতে পারিনা।

হুম, উপলব্ধি করতে পারিনা বলেই তো এত সমস্যা তৈরি করতে পারি প্রিয়জনদের সাথে। অবশ্য প্রিয়জনরা আনন্দের বারিধারা হয়ে যেমন ঝরে, প্রচণ্ড খরা হয়ে চৌচিরও করে দেয় মনের বনভূমিকে। কিন্তু কেন এমন হয়? কেন প্রিয়জনরা কষ্ট দেয়? যাদের কারণে সুখ-শান্তিকে উপলব্ধি করতে শেখে মন, তারাই আবার দুঃখ-ব্যথাকে বোঝানোর দায়িত্ব পালন করে অতি পারদর্শিতার সাথে। তারপরও তারা যে কতোটা প্রিয় সেটা দূরে না এলে অনুভব করা যায় না সঠিকভাবে। কাছে থাকতে নির্বোধ মন মানতেই চায় না ভালোবাসা দেবার সাথে সাথে কষ্ট দেবার অধিকারও যে প্রিয়জনদের আছে। প্রিয়জনদের কারণেই যেহেতু আমাদের মনে সুখ-শান্তির অনুভূতি আসে, সেহেতু দুঃখ-বেদনা তো তারা দিতেই পারেন কারণে-অকারণে। কিন্তু আমাদের স্বার্থপর মন শুধু ভালোটাই পেতে চায় সবার কাছ থেকে। একবারও ভেবে দেখে না যে আমি কি সর্বক্ষেত্রে সবার সাথে ভালো? আমার দ্বারা কখনোই প্রিয়জনরা কষ্ট-ব্যথা পাননি বা পান না তা কি আমি জোরের সাথে বলতে পারবো? আমি অন্তত পারবো না এমনটা বলতে। তবে এটাও আবার ঠিক যে, মতের অমিল, ঝগড়া-বিবাদ, কথা কাটাকাটি সন্তর্পনে প্রিয়জনদের সাথে সম্পর্কের ভিতকে নড়বড়ে করে দিতে থাকে। ঘুণপোকার মতো ধীরে ধীরে ক্ষয় করতে থাকে ভালোবাসার বন্ধনের খুঁটিটিকে। আর এই ক্ষয় হতে থাকা খুঁটির উপর ভরসা করেই চলতে থাকে জীবনের পথচলা।

এই ক্ষয়কে ব্যহত করার কোন উপায় নেই আপু? প্রশ্ন করলো সুমাইয়া।

নূহা হেসে বলল, উপায় তো আগেই বলেছি, ভালোবাসা। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আমাদের মন একবার যাদেরকে আপন করে নেয় তাদেরকে কখনোই ভুলে থাকা যায় না। ভুলে থাকতে চাইলেও সম্ভব হয় না। তবে জীবনের প্রয়োজনে কখনো কখনো ভুলে থাকতে হয়। স্মৃতিরা ঝাঁকে ঝাঁকে হানা দিয়ে মাঝে মাঝে মনকে ঘিরে ফেললেও, বেশির ভাগ সময়ই আমরা স্মৃতিদের এড়িয়ে চলা রপ্ত করে ফেলি। কারণ স্মৃতির ভাণ্ডারে অসংখ্য মণি-মুক্তা-জহরতের সাথে ধারালো-সূচালো কাঁচের টুকরোও যে আছে। যার সামান্য আঘাত মনকে করে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত...! আর কেই বা চায় হৃদয় চিড়ে বেদনা কুড়াতে? তারচেয়ে দূরে সরে থাকা কিংবা ভুলে থাকাটাই উত্তম মনেহয়। কি জানি এটাই হয়তো জীবনের নিয়ম। তবে ভালোবাসা কখনোই ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। মূল কথা হচ্ছে, আমরা সবাই সবসময় আলোকোজ্বল এক জীবন পেতে চাই। কিন্তু এমন জীবন গড়ে তুলতে সম্পর্কের মাঝে প্রয়োজন ভালোবাসা-ত্যাগ আর শ্রদ্ধাবোধের সংমিশ্রণ। কিন্তু সুখের মাঝে যেমন অসুখ থাকে, তেমন ভালোবাসা-ত্যাগ আর শ্রদ্ধাবোধের সংমিশ্রণ থাকার পরও সম্পর্কের মাঝে ঘটে ছন্দপতন। এই ছন্দপতনের দ্বন্দ্বে পড়ে যাতে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে না যাই। প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের আচরণ যেন অসাবধানী হয়ে না যায়। একে-অন্যেকে যাতে দোষারোপ না করি, ঝাঁপিয়ে যেন না পড়ি কারো উপর জিভের তরবারি নিয়ে। ভুলে যাতে না যাই তারা যে আমাদের প্রি...য়...জ...ন। এটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বুঝতে পেরেছো?

সুমাইয়া আর নায়লা দুজনই জ্বি আপ্পা বললো।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে এখন চুপচাপ বসে পায়েশ খাও। খাওয়া শেষ করে একজন পরিবারের জন্য পায়েশ নিয়ে বিদায় হও আর অন্যজন আমাকে প্যাকিংয়ে সাহায্য করতে এসো।

সুমাইয়া আর নায়লা হেসে ফেললো। নূহাও হেসে নিজের রুমে রওনা দিলো।

@

বিমানের গেট দিয়ে জাওয়াদকে ঢুকতে দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে সীটে হেলান দিয়ে বসলেন সুহাইব আহসান সাহেব। জাওয়াদ এসে পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, উইন্ডো সীট আমার।

সুহাইব সাহেব সালামের জবাব দিয়ে জাওয়াদকে বসতে দিয়ে বললেন, শুধু উইন্ডো সীট কেন তুমি যদি বলো, মামা সারা পথ তোমার কোলে বসে যাবে তাতেও আমি রাজী আছি।

জাওয়াদ হেসে বলল, দেখে তো মনেহচ্ছে টেনশনের নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এসেছো!

ঝাঁপ? তোমার এত দেরি দেখে এতক্ষণ ডুব সাঁতার কেটে এসেছি। ধরেই নিয়েছিলাম আজও তুমি ফ্লাইট মিস করবে। তারউপর কম করে হলেও বিশ বার ফোন দিয়েছি তোমাকে। ফোনও রিসিব করলে না। কোন সমস্যা হয়েছিল পথে?

জাওয়াদ হেসে বলল, না মামা তেমন কোন সমস্যা হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। মূলত বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়েই দেরি হয়ে গিয়েছিল। এরপর পথে যখন সেলফোন থেকে যোহরের আযান ভেসে আসছিল তখন একদম মসজিদের সামনে ছিল আমার গাড়ি। তাই গাড়ি পার্ক করে মসজিদেই যোহরের নামাজ আদায় করছি। তুমি হয়তো নামাজের সময় ফোন দিয়েছিলে। সাইলেন্ট ছিল এবং পরে আর চেক করা হয়নি। তুমি যোহরের নামাজ আদায় করেছো?

হ্যা আলহামদুলিল্লাহ। তোমাদের বাড়িতে সবাই ভালো আছে? বাচ্চারা? আমার নাবিহা পরীটা?

আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। নাবিহা তোমার জন্য গিফট পাঠিয়েছে। পৌঁছে দিচ্ছি ইনশাআল্লাহ। তুমি অনেকদিন বাড়িতে যাও না সেজন্য তোমার তিন বোন ক্ষেপে আছে অনেক। আমার কাছে তোমার জন্য তিনজন তিনটা থাপ্পড় পাঠিয়েছে।

হেসে ফেললেন সুহাইব মামা। বললেন, নাবিহা মণির গিফটের সাথে রেখে দাও। সব একবারে নেব ইনশাআল্লাহ। এখন আগে আমার প্রস্তাবের ব্যাপারে কি স্বিদ্ধান্ত নিয়েছো সেটা বলো।

কিসের প্রস্তাব? প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলো জাওয়াদ। মনে পড়লো সপ্তাহ দু'য়েক আগে সুহাইব মামা নানান ধরণের কন্যাদের ছবি ভর্তি অ্যালবাম নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তার বিয়ে নিয়ে পরিবারের মানুষদের আকাঙ্ক্ষা আর অস্থিরতা দেখে জাওয়াদের বার বার শুধু এটাই মনেহয়, চাওয়ার সাথে সাথেই যে মানুষের ইচ্ছে পূরণ হয়ে যায় না। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাজিক। নয়তো মানুষ তার দূরদৃষ্টিহীন স্বভাবের কারণে ক্ষণিক চাওয়ায় ভেসে গিয়ে নিজের এবং অন্যদের জীবনের চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কেননা মানুষ বেশির ভাগ সময়ই চিন্তা-ভাবনা ছাড়া শুধু আবেগের স্রোতে ভেসে যায়। এই যেমন তার পরিবারের সদস্যরা ভাবছে সে বিয়ে করলেই মনেহয় সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সে বিয়ে করে তারপরের অবস্থা-পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে সেটা কেউ ভেবে দেখছে না। নিজের ইচ্ছের কারাগারে বন্দী মানুষ ভুলে যায় যে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। ঠিক তেমনি ভাবছে না বলেই পরিবারের সদস্যরা ভুলে গিয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত পুরো জীবনটাকেই তিক্ত, অতিষ্ট, বিষাক্ত করে দিতে পারে বিয়ে তাদের মধ্যে অন্যতম। জাওয়াদ খুব ভালো করেই জানে পরিবারের মানুষ গুলোর স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে বলেই তার বিয়ের জন্য এমন অস্থির হয়ে উঠেছে। যদি শান্ত মনে চিন্তা করতো তাহলে জাওয়াদ বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালে উনারা বরং নিরুৎসাহিত করতো।

কিছু বলছো না যে? প্রশ্ন করলেন সুহাইব মামা।

জাওয়াদ বলল, তুমি অ্যালবাম ভর্তি ছবি দিয়ে এসেছো। ছবি দেখে তো আর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। তোমার অ্যালবাম ওভাবেই প্যাকেট করা আছে। ইনশাআল্লাহ আমরা ফিরে আসার পর একসময় গিয়ে নিয়ে এসো।

ছবি দেখে মেয়ে পছন্দ করবে নাতো কি দেখে করবে?

দুষ্টুমি মাখা হাসি ছড়িয়ে পড়লো জাওয়াদের চেহারাতে। হাসি মুখে বলল, কত ভালো মেইল লিখতে পারে সেটা দেখে করা যেতে পারে। এছাড়া কথার পিঠে কথা বলতে পারে কিনা এটা তো অবশ্যই দেখতে হবে। যেমন ধরো, কোন কারণে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, কথা শুনে তো মনেহয় না তোমার মুখে কোনদিন মধুর একটা ফোঁটাও পড়েছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে সে জবাব দেবে, হ্যা আর আপনার মুখে তো মৌমাছিরা চাক বসিয়েছে। মধু তাই শুধু ঝরতেই থাকে সারাক্ষণ।    

সুহাইব মামা হেসে বললেন, আরেকটা নূহা আমি কোত্থেকে খুঁজে আনবো বাবা তোমার জন্য?

জাওয়াদ হেসে বলল, এই প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানা নেই মামা। তোমারো যেহেতু জানা নেই তাই ছেড়ে দাও এই প্রসঙ্গ। কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পাওয়াটাই ভালো। সেসব প্রশ্নের জবাব তাই খুঁজতে না যাওয়াটাই উত্তম। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এক জীবনে মানুষ সব সুখ পায় না মামা। এক জীবনে তাই সব সুখ নিজের জন্য চাওয়াটা যেমন ভুল, তেমনি অন্যেকে সম্পূর্ণ রুপে সুখী দেখার ইচ্ছে পোষণ করাটাও ভুল। মানুষ স্বভাবতই বড় অকৃতজ্ঞ প্রাণী বুঝলে মামা। গলা পর্যন্ত সুখে ডুবে থাকলেও সুখের জন্য লালায়িত হয়। নাক-মুখও কেন সুখের সাগরে ডুবে গিয়ে তার শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে না সেজন্য আহাজারি করতে থাকে। এই যেমন আমি আমার সন্তানদের নিয়ে যতটা হাসি-আনন্দে থাকি, এক জীবনের জন্য এরচেয়ে বেশি সুখের কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

আমাদের চিন্তাটাই কি তাহলে ভুল?

আমি সেটা বলছি না মামা। আমি নিজেও তো একজন পিতা। তাই বুঝি সন্তানদের সুখী দেখার জন্য বাবা-মায়েদের মনের আকুলতাকে। সেই একই আকুলতার কারণেই আমি আমার এবং আমার সন্তানদের মাঝে থার্ড পারসন কাউকে কখনোই ঢুকতে দেবো না ইনশাআল্লাহ। আমি ব্যক্তি জীবনের সবকিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে পারি মামা। কিন্তু আমার সন্তানদের মনের ছোট্ট কোন খুশির ব্যাপারেও কোন ধরণের কম্প্রোমাইজ করতে আমি অপারগ। এমনিতেই মাকে ছাড়া থাকে ওরা। ওদের যাতে খুব বেশি কষ্ট না হয়। মাকে যাতে খুব বেশি মিস না করে সেজন্য ওদেকে আমি আমাকে ঘিরে আবর্তিত হতে শিখিয়েছি। আমি যতটা না বাবা তারচেয়েও বেশি ওদের মা হতে চেষ্টা করেছি। যখনই ওরা নতুন কিছু করেছে আমি আগে চিন্তা করেছি এখানে নূহা থাকলে এখন কি করতো। আমাদের এই ছোট্ট ভুবনে অন্যকারো প্রবেশের কথা আমি নিজেই চিন্তা করতে পারিনা। সেখানে ঐ ছোট্ট প্রাণগুলো কিভাবে করবে এমন চিন্তা? আমি ভেবে পাই না তোমরা এমন স্বার্থপর চিন্তা কিভাবে করতে পারো মামা?

সুহাইব মামা মুখে কিছু না বলে জাওয়াদের হাতের উপর হাত  রাখলো। জাওয়াদ বলল, জিহাদের চুপচাপ স্বভাব দেখে বাড়ির সবাই মনে করে ও বুঝি সবচেয়ে বেশি স্ট্রং। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে গভীর রাতে জিহাদ বালিশ হাতে হাজির হয়ে বলে, পাপা খুব একা একা লাগছে আমি কি একটুক্ষণ তোমার সাথে ঘুমোতে পারি? একথা আমি দুঃস্বপ্নের ঘোরেও ভাবতে পারিনা মামা জিহাদ কোনদিন গভীর রাতে একাকীত্ব দূর করার জন্য ছুটে আসবে ওর পাপার কাছে। আর এসে আমার রুমের দরজা বন্ধ পেয়ে চুপচাপ নিজের আবার নিজের রুমে ফিরে যাবে। আমার বুকে মুখ গুঁজার বদলে বালিশ বুকে চেপে ধরে নিজের একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করবে। বলতে বলতে শেষের দিকে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলো জাওয়াদের কন্ঠ।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুহাইব মামা বলল, মাঝে মাঝে নিজেদের বোকামীর দ্বারা আমরা তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলি তাই না জাওয়াদ? আই এম রিয়েলি ভেরি সরি বাবা। প্রমিস করছি আর কোনদিন আমি তোমাকে বিয়ের কথা বললো না।

হাত বাড়িয়ে চোখের কোন থেকে অশ্রু মুছে নিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, ছয় বছর বয়স থেকেই আমার ড্রেসিংরুমে নাবিহার রাজত্ব চলে। নাবিহা যেদিন যে ড্রেস বের করে দেয় আমি সেটাই পড়ি। কোনদিন যদি আমার শিডিউলের সাথে নাবিহার পছন্দ করা ড্রেস বেমানানও হয় তবুও আমি সেটাই গায়ে দেই। কারণ পছন্দ করা ড্রেস পড়ে যখন সামনে আসি তখন নাবিহার দুচোখ ভর্তি আনন্দে চিকচিক হাসিটা দেখার জন্য শুধু একটু বেমানান কেন, দরকার হলে আমি জোকারের কস্টিউম পড়ে বিসনেস মিটিং অ্যাটেন্ড করতে যেতে পারি।

স্বশব্দে হেসে ফেললেন সুহাইব মামা। জাওয়াদও হেসে বলল, সারাদিনে জারিফ আমাকে যতবার ফোন আর ম্যাসেজ করে আর কেউই মনেহয় করে না। শুধুমাত্র অপারেশন থিয়েটারই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি জারিফের কল বা ম্যাসেজ সাথে সাথে অ্যাটেন্ড করিনা। কারণ আমি কখনোই চাই না জারিফের মনে এমন চিন্তা প্রবেশ করুক আমি ওকে কম অ্যাটেনশন দেই জিহাদ, জিশান, নাবিহার তুলনায়। আর জিশান? ওর কথা কি বলবো। একটা মূহুর্ত থাকতে পারে না দুষ্টুমি করা ছাড়া। জিশানের দুষ্টুমির যন্ত্রণায় আমি হাসতে না চাইলেও হাসতে বাধ্য হই। তোমরা তো এসব কিছুই দেখো, জানো। তাহলে আমার দ্বিতীয় বিয়েই সুখের জীয়ন কাঠি এমন অদ্ভুত মাইন্ড সেট করে রেখেছো কেন? মামা মন দিয়ে একটা কথা শুনে রাখো আজ। আসমান আর জমিন এক হয়ে যাবে কিন্তু জাওয়াদ কোনদিন জিহাদ, জিশান, জারিফ আর নাবিহার জন্য বিমাতা আনবে না ইনশাআল্লাহ। নেভার এভার।  

সুহাইব মামা হাসতে হাসতে সীটে এলিয়ে পড়লেন একদম। জাওয়াদও হাসি মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। কথা বলতে বলতে কখন যে টেকঅফ হয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি।    

আমাদের আনন্দবাড়ি...২২



দরজা ঠেলে নায়লাকে ঢুকতে দেখে বেশ অবাক হলো নূহা। এই সময় তো ক্লাসে থাকার কথা নায়লার। তারমানে ক্লাস বাদ দিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে নূহার সাথে কথা বলার জন্য। স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক নীচু স্বরে সালাম দিলো নায়লা।

নূহা সালামের জবাব দিয়ে হেসে বলল, তুমি আসবে জানাওনি কেন? আমি তো এখনই বেরোচ্ছিলাম।

জরুরি কোন কাজে যাচ্ছো আপ্পা?

না বাসায় যাচ্ছিলাম। দুই সপ্তাহের জন্য তোমাদের বাড়ির মেহমান হতে যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ। সেটার প্যাকিং করার জন্য বাসায় যাচ্ছিলাম। তোমার কাছে তাই দুটা অপশন আছে। আমার সাথে বাসায় যাওয়া। কিংবা এখন ক্লাসে চলে যাও। আমি তো ইনশাআল্লাহ থাকবোই আজ থেকে তোমাদের সাথেই। রাতে কথা বলা যাবে। কি করবে তুমি বলো?

আমি তোমার সাথে বাসায় যাব আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, ওকে তাহলে চলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালের টুকটাক যে কাজগুলো বাকি ছিল সেগুলো কাজ সেরে নায়লাকে সাথে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো নূহা। বেশ কিছুক্ষণ পর নায়লা বলল, ভাইজান সৈকতের ব্যাপারে কি বলেছেন আপ্পা?  

প্রশ্নের জবাব কি দেবে সেটা ভেবে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো নূহা। নূহার পরিকল্পনা ছিল আগে পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, হাসি-আনন্দ, ত্যাগ-ভালোবাসা, সদস্যের একে অন্যের কল্ল্যানকামীতায় ভরসা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করার পর নায়লাকে ভাইয়াদের অপছন্দের কথা জানাবে। কিন্তু নায়লা আগেই চলে আসার কারণে নূহা যে প্রস্তুতি নিয়েছিল সেটা ভেঙে গিয়েছে। এখন অন্যকোন ভাবে কথা বলা শুরু করতে হবে। ‘পরিকল্পনার বাইরে মানুষের জীবনে যে অংশগুলো আসে, সেগুলোকে দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করতে পারার মাঝেই নিহিত পরীক্ষা জয়ের তৃপ্তি। সাথে ছাতা না থাকার পরও খোলা ময়দানে নামা হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজাকে প্রতিহত করতে পারাই হচ্ছে সাফল্য।’ আচ্ছা এই বাণী খানি কোন মনিষীর? মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নূহা। তার বাণীময় জীবনের সেভেন্টি ফাইভ পার্সসেন্ট বাণীই মনিষী জাওয়াদের বলা। এই লোক কথা কম আর বাণী বেশি বলে। বসে বসে যদি শুধু বাণী বলতো তাও শান্তি ছিল। কিন্তু উনি নিজের পছন্দ-অপছন্দ সবার উপর জাহির করেন। এই যেমন কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত যদি সৈকতকে বাড়ির জামাই হিসেবে পছন্দ করে নিতেন? কিন্তু উনি সেটা তো করেনইনি। উল্টো নায়লাকে বোঝানোর দায়িত্ব তার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন। এমনিতেই কি কম সমস্যার মধ্যে থাকে সে? তারপরও সবাই জীবন্ত সমাধানের বাক্স মনে করে সারাক্ষণই তাদের সমস্যাগুলো চাপাতে থাকে। সাথে সাথেই আবার মনে পড়লো, " সমস্যা দেখে কভু পেয়ো নাকো ভয়, সাহসী মোকাবেলাই করে সমস্যাকে ক্ষয়। সমস্যা যখনই দল বল নিয়ে দেবে হানা, কখনোই ভেবো না তাদের উটকো যাতনা। সমস্যার মাঝেই লুকায়িত আছে সমূহ সম্ভাবনা। খুঁজে নিয়ে নঁকশা আঁকতে হয় রঙিন আল্পনা।" অর্থাৎ, এখন অস্থির না হয়ে তাকেও নায়লার মনের নকঁশা অনুযায়ী আলপনা আঁকতে হবে।

নায়লার প্রশ্ন শুনতেই পাইনি এমন ভাব দেখিয়ে নূহা বলল, সকাল থেকে মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে একদম। বাসায় পৌছে জটপট প্যাকিং সেরে বাড়িতে পৌছেই সবার আগে ঘুম দিতে হবে।

কেন আপ্পা? কি হয়েছে তোমার?

আর বোলো না সকাল থেকে এমন এক মেয়ের সাথে কথা বলছি যে ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ করতে করতে আমার মগজ পুরা ফ্রাই করে দিয়েছে। মেয়েটার মনের মধ্যে ভবিষ্যৎকে ঘিরে এমন সব নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা যা আদৌ হবার কোন সম্ভাবনা বর্তমানে অন্তত পরিলক্ষিত হয় না। অথচ এইসব দুশ্চিন্তার ওর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ হবার পথে। উদাহরণ স্বরূপ ওর বিয়ের কথাটাই যদি বলি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে ওর। এখনো কিছুই ঠিক হয়নি। অথচ এই মেয়ে বিয়ের পর ফুলসজ্জার রাত থেকে শুরু করে সন্তানদের নিয়ে পর্যন্ত চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছে। বিয়ের পর সে এটা করতে চায় না, ওটা করতে চায় না। হাজবেন্ড যদি না মানে তাহলে মনেহয় সংসার করা হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, দেখো বিয়ে এমন একটা সম্পর্ক এর মাঝে বিরাজমান সবকিছুই যে সবার পছন্দনীয় হবে এমন কোন নিয়ম আসলে নেই। এই বিষয়টা তাই মেনে নেয়ার মাঝেই কল্ল্যাণ। তুমি রিলাক্স হবার চেষ্টা করো আগে। টেনশন যে কোন সমস্যাকে অনেক বেশি বড় আর ভারি বোঝা হিসেবে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। তিলকে তাল হিসেবে দেখে তাই আমরা ঘাবড়ে যাই। পাথরকে পাহাড় ভেবে হাল ছেড়ে দেই। এই দৃষ্টিভ্রম দেখে বাঁচতে চাইলে দুশ্চিন্তার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করতে হবে। আর সেজন্য ভবিষ্যতে কি হবে না হবে এই ভাবনাটার তালা খুঁজে বের করে সেটাকে লক করে দিতে হবে সবার আগে।

আসলেই মনেহয় আমরা অকারণে অনেক বেশি চিন্তা করি আপ্পা।

বেশি বেশি চিন্তা করতে তো দোষ নেই। বরং চিন্তা করাটা বেশ ভালো। কিন্তু দুশ্চিন্তা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। বিশেষ করে অতীতের ভুল নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তা এবং মনকষ্টে ভোগা। এবং ভবিষ্যৎকে ঘিরে সুখস্বপ্ন কিংবা উৎকণ্ঠায় বিভোর থাকা। ভবিষ্যৎ তো সম্পূর্ণ রূপে অজানা তাই অজানার পেছনে মনের শক্তি ব্যয় করার কোন অর্থই হয় না। তাছাড়া নিজেরা একটু চিন্তা করলেও দেখতে পাবো যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের বেশির ভাগই দুশ্চিন্তাই অসংঘটিতই থেকে যায়। চলে যাওয়া প্রতিটা মুহুর্ত অতীত আর আগত প্রতিটা মুহুর্ত ভবিষ্যৎ। দাঁড়িয়ে থাকা মুহুর্তটিই হচ্ছে বর্তমান। অতীত ও বর্তমানের উপর আমাদের কন্ট্রোল নেই। তবে এটাও আবার ঠিক যা ঘটে গিয়েছে তাকে কখনই বদলানো সম্ভব নয়। কিন্তু যা ঘটতে যাচ্ছে তাকে কর্মের দ্বারা বদলানো সম্ভব যদি আল্লাহ চান। কিন্তু সেই বদলটাও নির্ভর করে বর্তমান ইচ্ছা ও চেষ্টার উপর। তাই হাতে থাকা বর্তমানের এই একটি মুহুর্তকে যারা কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। ইনশাআল্লাহ সবকিছু তাহলে অনেক সহজ হয়ে যায় তাদের জন্য। কিন্তু একথাটা বার বার মেয়েটাকে বুঝিয়েও লাভ হয়নি।

মেয়েটা কি বুঝতে পাইছে না তোমার কথা নাকি বুঝতে চাইছে না?

আসলে কি জানো মানুষ বেশির ভাগ সময়ই অন্যের মুখ থেকে সেটাই শুনতে চায়, যেটা সে নিজে চিন্তা করছে। আমরা অন্যেদেরকে হ্যা এর চেয়ে না বেশি বলি। ইতিবাচকের তুলনায় আমাদের নেতিবাচক আচরণই বেশি সহ্য করতে হয় মানুষকে। কিন্তু আমরাই আবার অন্যের মুখে না শুনতে নারাজ থাকি। অন্যদের নেতিবাচক আচরণ মেনে নিতে পারি না। এখানেও ঠিক একই ব্যাপার। মেয়েটা যেহেতু ওর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিন্তা করছে, কথা বলছে তাই চাইছে আমিও যেন সেটাকে একই ভাবে মূল্যায়ন করি। কিন্তু ওর অভিজ্ঞতার বাইরেও যে বিশাল একটা জগত রয়ে গিয়েছে সেটা মানতে চাইছে না কিংবা নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ওকে বার বার পেছন থেকে টেনে ধরছে। যাইহোক, ওর কথা থাক এখন। তোমার কথা বলো। পড়াশোনা কেমন চলছে?

আলহামদুলিল্লাহ আপ্পা ভালো চলছে।

তোমাদের ভাইজান কি তোমাদের সবার রিপোর্ট কার্ড দেখেন?

সাথে সাথে অন্ধকার হয়ে গেলো নায়লার চেহারা। শুকনো মুখে বলল, হ্যা আপ্পা। ভাইজান কি তোমাদের রিপোর্ট কার্ডও দেখতেন সবসময়?

নূহা হেসে বলল, হুম। অন্য সবাই এটা নিয়ে আতঙ্কে থাকলেও আমার বেশ ভালো লাগতো। রেজাল্ট খারাপ হলেই কৈফিয়ত দিতে হবে এই ভয়ে ফাঁকি দেবার চিন্তাই আসতো না কখনো মনে। তাছাড়া শুধু দুনিয়াবী পরীক্ষার ব্যাপারে তো না। জীবনকে চির কল্যাণকর জান্নাতের পথে পরিচালিত করার ব্যাপারে আরো বেশি তদারকি করতেন ভাইয়ারা। আলহামদুলিল্লাহ এটা আমাদের অনেক বড় সৌভাগ্য।  

এটা আমিও বুঝি আপ্পা। কিন্তু কখনো যদি কোন কারণে রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায় কৈফিয়ত দিতে হয় সবার সামনে। এটা ভালো লাগে না।

পরকালে আমাদের বিচারও সবার সামনেই হবে। আমরা মানুষকে দেখানোর জন্য, মানুষের চোখে ভালো সাজার জন্য অনেক উত্তম কাজ করি। ঠিক তেমনি নিজেদের দোষ, ঘাটতিগুলোকে মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে আল্লাহর চেয়েও মানুষের কাছে উত্তম হবার চেষ্টায় লিপ্ত হই। আবার অবলীলায় নানান গোনাহের কাজ করে ফেলি আমরা। কিন্তু আল্লাহ দেখছেন এই বোধের চেয়েও আমাদের মনে বেশি কাজ করে মানুষ যাতে জানতে না পারে। যারফলে আমাদের দ্বারা ছোট ছোট শিরক সংঘঠিত হতে শুরু করে। এই ব্যাপারটাকে ব্যাহত করার জন্যই আমাদের ভাইয়ারা সমালোচনা ও প্রশংসা উভয় ক্ষেত্রই উন্মুক্ত রেখেছেন।

নায়লা হেসে বলল, তুমি যখন বুঝিয়ে বলো তখন সবকিছুই ঠিক মনেহয় আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। চলো তোমাকে আমার ছোটবেলার একটা মজার ঘটনা বলি। যখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম ম্যাথ পরীক্ষায় একবার ৯৫ পেয়েছিলাম। রিপোর্ট কার্ড দেখানোর সাথে সাথে ভাইয়ার হাসি ভরা চেহারাটা একটু খানি গোমড়া হয়ে গিয়েছিল। ঐ সময় কিছু বলেননি আমাকে। কিন্তু পরে কেন একটি ম্যাথ ভুল করেছিলাম সেটা জানতে চাইলেন। রাগ করে না খুব সুন্দর করেই ভাইয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি তো সব ম্যাথ পারতে। ম্যাথের নিয়ম কানুনও সব তোমার জানা। তাহলে কেন ভুল হয়েছে? জবাবে বলেছিলাম, আমার নিয়মে ভুল হয়নি ভাইয়া।আমি এক জায়গায় সিক্স হবে কিন্তু বেখেয়ালে নাইন লিখে ফেলেছিলাম। ভাইয়া তখন বললেন, ম্যাথে হান্ডেড পার্সেন্ট মার্কস পাওয়াটা তেমন কোন কঠিন ব্যাপার না। কারণ ম্যাথ যদি তুমি ঠিকমতো  করো তাহলে নাম্বার কম দেবার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং, তোমার ম্যাথ রিপোর্ট আমি সবসময় হান্ডেড পার্সেন্ট দেখতে চাই। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, যদি কখনো ভুল হয়ে যায় আমার?  যদি আমি হান্ডেড পার্সেন্ট না পাই? ভাইয়া তখন বললেন, ''যদি'' এই শব্দটাকেই মনে প্রবেশ করতে  দেবে না কখনো। তুমি শুধু মনে রাখবে তোমাকে হান্ডেড পেতে হবে। যেভাবেই হোক পেতেই হবে। হান্ডেড পাবার ব্যাপারে তোমাকে আগে হান্ডেড পার্সেন্ট শিওর হতে হবে। হান্ডেড পার্সেন্ট কনফিডেন্ট নিয়েও যখন তুমি হান্ডেড অর্জন করতে ব্যর্থ হবে। মনে করবে ওটাই তোমার জন্য পারফেক্ট। আমি তখন বুঝে গিয়েছিলাম ভাইয়া ঠিক কি বলতে চাইছেন আমাকে। এরপর থেকে জীবনে যখনই আমাকে কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এবং আমি কিছুটা হলেও ভীত হয়েছি বা আমার আত্মবিশ্বাস দোলায়িত ছিল। ভাইয়া আমাকে ম্যাথের হান্ডেড পার্সেন্টের উদাহরণটি মনে করিয়ে দিতেন। আমি তখন শুধু মনে প্রাণে এটা চিন্তা করার চেষ্টা করতাম যে, আমি এটা পারবো। কারণ আমাকে এটা পারতেই হবে। এবং আমি যে জিতবোই এতে কোন সন্দেহ নেই ইনশাআল্লাহ। এরপরও যদি হেরে যাই সেটা আমার ভাগ্য। কিন্তু যেহেতু জানি না ভাগ্যে কি আছে সুতরাং আমাকে আমার হান্ডেড পার্সেন্ট দিতে হবে। দিতেই হবে।

নায়লা হেসে বলল, জ্বি আপ্পা আমিও বুঝতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। চেষ্টা করার পরও যদি আমি ব্যর্থ হই তাহলে সেটাই আমার ভাগ্যে ছিল। কিন্তু চেষ্টা করার আগে কখনোই হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না।

নূহা হাসি মুখে হুম বলে বেশ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, বিয়ের আগে তোমাদের রাহাত ভাইয়া আমাদের পরিবারের কেউ ছিলেন না সেটা তো জানোই। উনি ভাইয়াদের সংগঠনের একজন দায়িত্বশীল ছিলেন। উনার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎটা বেশ ফ্লীমি ছিল। শুনবে সেই ঘটনা?

নায়লা চোখ বড় বড় করে বিশাল হাসি দিয়ে বলল, সত্যিই আমাকে বলবে আপ্পা?

নূহা হেসে বলল, অবশ্যই বলবো বালিকা। আচ্ছা শোনো সেই কাহিনী। সুইজারল্যান্ডে একটি ইসলামিক কনফারেন্সে গিয়েছিলেন তোমাদের ভাইজান। উনি সাধারণত যেখানেই যেতেন আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতেন। কনফারেন্সে আমাদের ভাইয়ারা ছাড়াও সংগঠনের আরো কয়েকজন ভাইও গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে রাহাতও ছিলেন। কনফারেন্স শেষ করে সুইজারল্যান্ড থেকে ফেরার পথে ভয়াবহ খারাপ ওয়েদারের কারণে এয়ারপোর্টে আটকা পড়েছিলাম প্রায় সাত ঘন্টা। ঐ সময় তোমাদের ভাইজান ওখানে যে কয়জন ভাই ছিলেন তাদের সম্পর্কে বলেছিলেন। কে কেমন, কার সাথে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল উনার, প্রত্যেকের স্পেশালিটি ইত্যাদি সবকিছু। রাহাতের সম্পর্কেও সবকিছু বলেছিলেন। কেউ হাফেজ শুনলেই তার প্রতি অন্যরকম একটা শ্রদ্ধা কাজ করে আমার মনে। আল্লাহর পবিত্র কালামকে বুকে ধারণ করা মানুষগুলো কতটা বেশি অসাধারণ হন সেটা পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম বলেই হয়তো এমনটা হয়। এছাড়া ওখানে উপস্থিত সবার চেয়ে বেশি খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন রাহাত আমাদের। বার বার এসে জানতে চাইছিল, ভাইজান আপনাদের কিছু লাগবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

নায়লা আশাভঙ্গের সুরে বলল, তারমানে তোমাদের চলতে চলতে হঠাৎ একে অন্যের সাথে ধাক্কা লাগা, হাতের বইপত্র পড়ে যাওয়া, তুলতে গিয়ে মাথায় সাথে মাথা লেগে যাওয়া এমন কিছুই হয়নি? তারউপর ভাইজান ছিলেন তখন তোমার সাথে পাহাড়াদার হয়ে। ধূর, এটা বুঝি ফ্লীমি হলো?

নূহা হাসতে হাসতে বলল, এই মেয়ে এইসব সাংঘাতিক কথাবার্তা কোথা থেকে আবিষ্কার করলো? দাঁড়াও তোমার বন্ধুবান্ধব যাচাই বাছাইয়ের মিশনে নামতে হবে অতি শিঘ্রীই।

নায়লাও হেসে বলল, তারপর বলো কি হল।

এরপর আর কিছু হয়নি। কিন্তু ঐ ঘটনার কারণেই রাহাতের সম্পর্কে সবকিছু জানতে পেরেছিলাম। এবং সেই জানার কারণেই আমি মূলত উনাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলাম। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও তোমাদের ভাইজানের প্রতি রাহাতের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসাকে আমি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। এবং তোমাদের ভাইজানের মুখে শোনা রাহাতের কৃতজ্ঞ স্বভাব, উত্তম চরিত্র সবকিছু মিলিয়ে মনে এই বিশ্বাস জেগেছিল উনি আমাকে আমার মত থাকতে দেবেন। বিয়ের সময় আমরা শুধু রাহাতকেই দেখেছিলাম ওর পরিবারকে নয়। আমাদের বিয়ের বেশ কিছু সময় পর জিশান, জিহাদ আর নাবিহাকে রেখেই আমি কিছুদিনের জন্য রাহাতের পরিবারের সবার সাথে পরিচিত হতে দেশে গিয়েছিলাম। উনাদের বাড়ির পরিবেশ আমাদের বাড়ির পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। ঘরের বাইরে কেউ কেউ হিজাব করলেও ঘরের ভেতর মাহরাম-নন মাহরাম বলে যে কিছু আছে এই বোধটাই অনুপস্থিত। ওখানে যাবার পর আমার মনে হচ্ছিলো আলো, বাতাস হীন কোথাও আটকা পড়েছি। নক ছাড়াই যে কেউ যে কারো রুমে ঢুকে পড়ছে। আমি ঘরের ভেতর হিজাব পড়ে থাকতাম বলেও সবাই বেশ বিরক্ত হতেন। বলতেন, এখানে তো পরিবারের বাইরের কেউ নেই। এটা বাড়াবাড়ি ইত্যাদি। তারপর পুরুষ আত্মীয়তা এসেও আমাকে দেখতে চাইতেন। রাহাত পরিবারের সবার ছোট তাই বড়দেরকে কিছু বলতেও পারতো না। আমি রাহাতের অপরগতাও বুঝতে পেরেছিলাম। তবে সবকিছু মিলিয়ে দুই সপ্তাহেই পাগল হতে বাকি ছিল শুধু আমার। এখনো আমি ভয়তে দেশে যাই না। রাহাত একা একা গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসে ওর পরিবারের সাথে। আমরা অনেক ভাবে ওদের পরিবারের সদস্যদেরকে শরীয়ত ভিত্তিক জীবন যাপনের ব্যাপারে দাওয়াত দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তেমন কোন লাভ হয়নি। আবার জারিফ বুঝতে শেখার পর ওকে ওর চাচা-ফুপ্পিদের সাথে পরিচয় করাতে দেশে নিয়ে গিয়েও বেশ বিপদে পড়তে হয়েছিল আমাকে। কাজনিরা কেন মিউজিক শুনছে, পর্দা করে না কেন কেউ, নামাজ কেন পড়ে না। জাফিরের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বাধ্য হয়েই তাই আমি আর রাহাত এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি জারিফ বড় হয়ে সব বুঝতে শেখার আগে আমরা আর কখনোই ওকে দেশে নিয়ে যাবো না। এই সমস্ত কারণে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে মনেহয়েছে আমরা যারা খুব রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি তাদের কখনোই উচিত না এমন কোন পরিবারে বিয়ে করা যারা শরীয়তের একদম বেসিক বিষয়গুলোও মেনে চলে না।

সৈকতের ফ্যামেলি কি এমন আপ্পা?

নূহা বলল, হ্যা। আর এই কারণেই সৈকতকে ভাইয়াদের কারো পছন্দ হয়নি। আমরা তোমার উপর আমাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না। বুঝতে শেখার পর থেকে জীবনকে সুন্দর করে যাপন করার অন্যান্য আর সবকিছুর মতো তোমাদের সবাইকে বিয়ের গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা, কোন কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয় কাউকে লাইফ পার্টনার করার আগে। এসব কিছুও বলা হয়েছে, বোঝানো হয়েছে। বিয়ে শুধু দুজন মানুষ না, দুটা পরিবারের মধ্যে সেতু স্থাপন করে। এই দুটা পরিবার যদি একে অন্যের থেকে একেবারেই আলাদা হয় তাহলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা খুব বেশি কঠিন হয়ে যায়। হয় পরিবার থেকে দূরে সরে যাওয়া, নয়তো ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্য নিয়ে সংসার করা কিংবা স্বামী-স্ত্রীই আলাদা হয়ে যাওয়া। আর কোন অপশনই থাকে না। নায়লা বিয়ে সম্পর্কটা এমন নয় যে চাইলেই বদলে ফেলা যায়। তাই শুধু আবেগ দ্বারা সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভুল হবে। কেউ আমার সাথী হওয়া মানে তার পুরো পরিবারও আমার সাথে জুড়ে যাওয়া। যেমন ধরো, রাহাত শরীয়তের বিধান বোঝেন, মেনে চলেন বলেই আমাদের দুজনের মধ্যে কোন সমস্যা হয়নি। আমি যখন বলেছি শরীয়তের বিধান মেনে চলতে সমস্যা হয় এমন কোথাও আমি যেতে চাই না। রাহাত বলেছে, ঠিকআছে তোমাকে যেতে হবে না। সবার আগে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আত্নীয়ের হক আমরা দূরে থেকেই যথাযথ আদায় করার চেষ্টা করবো। কিন্তু রাহাত যদি শরীয়তের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ মাইন্ডের হতো তাহলে কিন্তু আমাদের সংসার জীবন এত সুখময় হতো না। তাই আমি তোমাকে অনুরোধ করবো সবদিক বিচার-বিবেচনা করে এরপর সিদ্ধান্ত নাও। সবকিছু চিন্তা-ভাবনা করার পরও যদি তোমার সিদ্ধান্ত পজেটিভ হয়। এবং তোমার পরবর্তী জীবনের সমস্ত দায়ভার নিতে তুমি প্রস্তুত থাকো। আমি ভাইয়াদেরকে রাজী করাবো তোমাদের বিয়ের জন্য ইনশাআল্লাহ।  

কোন জবাব না দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইলো নায়লা। নূহাও আপাতত আর কিছু না বলাটাই ভালো ভেবে চুপ করে রইলো। বাকি পথ নিজের সাথে নায়লাকে বোঝাপড়ার করার জন্য ছেড়ে দিলো।      

আমাদের আনন্দবাড়ি...২১



বাড়িতে ঢুকতেই বাগান বাচ্চাদের বেশ কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং হুমায়ূন এর ছেলে তালহার কান্না শুনতে পেয়ে জাওয়াদ হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে ওখানে দেখে আয় তো!

হুমায়ূন দেখে ফিরে এসে বলল, বাগানে খেলতে গিয়ে পায়ে কাঁটা ফুটেছে তালহার পায়ে। কিন্তু কাউকেই হাত লাগাতে দিচ্ছিলো না পায়ে। যার ফলে কাঁটাটা পা থেকে বের করাও সম্ভব হচ্ছে না। আমিও গিয়েছিলাম কাঁটা বের করে দিতে কিন্তু তালহা বলছে, এক কথা কাঁটা বের করতে  গেলে সে ব্যথা পাবে। তাই কাঁটা বের করতে দেবে না। তুমি কি একটু দেখবে ভাইয়া? আমি রামিছাকে ভেতরে যেতে বলছি।

বাগান থেকে হুমায়ূনের স্ত্রী রামিছা বাড়ির ভেতরে চলে যাবার পর জাওয়াদ তালহার কাছে এলো। জিহাদ সালাম দিয়ে বলল, কাঁটাতে হাতই দিতে দিচ্ছে না পাপা।

সালামের জবাব দিয়ে জাওয়াদ বলল, ঠিকআছে আমি দেখছি।

জিশান হেসে বলল, কিন্তু পাপা তুমি তো দেরি করে ফেলেছো। উনাইশাহ তো নিজে নিজেই ওর বিচার কার্য সমাধান করে ফেলেছে।

তোমরা সবাই রুমে যাও আমি তালহাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি ইনশাআল্লাহ। এরপর উনাইশাহর কান্ড শুনবো। হাসতে হাসতে বললো জাওয়াদ। বাচ্চারা সবাই চলে যাবার পর তালহার পাশে বসলো জাওয়াদ। কান্না বন্ধ করে কাঁটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসেছিল তালহা। কিন্তু জাওয়াদকে দেখা মাত্রই দু’হাত বাড়িয়ে আবারো ঠোঁট বাঁকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হলো। আঙ্গুল দিলে ঈশারায় দেখালো কোন গাছ থেকে তার পায়ে কাঁটা ফুটেছে।    

জাওয়াদ তালহাকে কোলে তুলে নিয়ে সেই গাছের দিকে তাকিয়ে বলল, দুষ্টু গাছ তুমি খুবই পঁচা একটা কাজ করেছো। এত সোনা সোনা একটা বাচ্চার এত্তো সুন্দর পায়ে কেউ কাঁটা ফোঁটায়? শেম অন ইউ। এই অন্যায়ের জন্য তোমাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। বুঝেছো? আর তোমাকে শাস্তি দেবে আমাদের তালহা সোনা। তালহা সোনা বলো কি শাস্তি দেয়া যায় এই দুষ্টু গাছকে? চলো দুষ্টু গাছের গায়ে তুমি আর আমি মিলে দুইটা কাঁটা ফুটিয়ে দেই।

আনন্দিত হয়ে উঠতে গিয়েও আবার একটু চিন্তা করে তালহা বলল, কিন্তু পাপা তুমি যে বলেছিলে গাছের প্রাণ আছে। কাঁটা ফুটালে গাছ ব্যথা পাবে না?

একটু ব্যথা তো সেই হিসেবে পাওয়ার কথা।

তালহা বলল, তাহলে শুধু ধমক দিয়ে দাও। আবার যদি কারো পায়ে কাঁটা ফুটিয়ে দেয় তখন দুষ্টু গাছের গায়েও কাঁটা ফুটিয়ে দেব বলে দাও।   

জাওয়াদ সাথে সাথে তালহার আদেশ আদেশ পালন করলো। জোড়ে করে দুষ্টু গাছকে ধমক দিয়ে দিলো। এরপর বলল, দেখি তো বাবা তোমার পায়ে দুষ্টু গাছটা কোথায় কাঁটা ফুটিয়েছে।

তালহা দেখিয়ে বলল, ধরো না কিন্তু নয়তো আমি ব্যথা পাবো।

কাঁটা বের না করলে তো ব্যথা কমবে না বাবা।

কিন্তু বের করতে গেলেও তো আমি ব্যথা পাবো।

হ্যা তুমি একটু বেশি ব্যথা পাবে বের করতে গেলে।কিন্তু তুমিই ভেবে দেখো সারাক্ষণ ব্যথা নিয়ে থাকবে নাকি একবার একটু বেশি ব্যথা সহ্য করে কাঁটাটা বের করে ফেলবে। তালহা তো তখন গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। জাওয়াদ হেসে বললেন, তুমি কি জানো কোন কিছু তোমাকে ততক্ষণই ভয় দেখাতে পারবে যতক্ষণ তুমি সেটাকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা দেবে। এই যেমন তুমি ব্যথার ভয় পাচ্ছো বলেই কাঁটাটিকে তোমার পা থেকে আলাদা করতে পারছো না। তালহা তখনও দোদুল্যমনতায় ভুগতে লাগলো। জাওয়াদ বলল, যখন মনখারাপ লাগে, ভয় লাগে তখন কি করতে হয় বলো তো তালহা?

তালহা বলল, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হয়।

তাহলে তুমি চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও।

তালহা সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে শুরু করলো। এক সুযোগে জাওয়াদ ওর পা থেকে কাঁটা বের করে নিলেন। তালহা ব্যথা পেয়ে জোড়ে চিৎকার করে উঠলো।  কিন্তু জাওয়াদ জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেলো। আরো কিছুক্ষণ পরে চোখ বড় বড় করে বলল, পাপা ব্যথা চলে গেলো তো।

জাওয়াদও চোখ বড় বড় করে বলল, তাই? ব্যথা চলে গেলো? কোথায় গেলো দুষ্টু ব্যথাটা?

তালহা হেসে বলল, আল্লাহ নিয়ে গিয়েছে। আমি যে সাহায্য চেয়েছিলাম সেজন্য।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। দেখেছো তুমি যদি কাঁটাটা তুলতে না দিতে তাহলে কি ব্যথা যেত বলো? তাই যখনই কোন ব্যথা আসবে তোমার কাছে একটুও ঘাবড়ে যাবে না। তুমি তখন আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে এবং সেই ব্যথাটা দূর করার জন্য নিজেও চেষ্টা করবে। কেমন?

তালহা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ইনশাআল্লাহ পাপা।

তালহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আপন মনেই জাওয়াদ বলল, দুনিয়া জুড়ে নানান ধরণের কষ্ট ছড়ানো রয়েছে বুঝলে বাবা। কষ্ট থেকে বেঁচে থাকার তাই কোন উপায় নেই। বরং কষ্ট থেকে বাঁচতে চাইলে আরো বেশি করে ঘিরে ধরে কষ্ট। তাই পালিয়ে না গিয়ে, ভয় না পেয়ে কষ্টকে মোকাবিলা করতে হবে। এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।

সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী তালহা এত কঠিন কথা না বুঝলেও মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা।

জাওয়াদ তালহাকে আদর করে হেসে বলল, চলো আমরা আমরা খুঁজে দেখি তোমার আপ্পিরা আর ভাইয়ারা সবাই কোথায় গেলো।

নিজের কটেজে যাবার সময় বাচ্চাদের হলরুমে উঁকি দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল জাওয়াদ। বাড়ির যথাক্রমে সাড়ে তিন, চার এবং পাঁচ বছর বয়সি চারজন সোনামণিকে হলরুমের গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ হা করে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জাওয়াদের মনেহলো বাচ্চারা হা করে নিজেদের মুখের ভেতর দেখা হয়তো উনাদের নতুন আবিষ্কৃত কোন খেলা। কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট শরীরগুলোকে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে যেভাবে তারা বিশাল আকৃতির হা করে মুখের ভেতরে কিছু দেখার চেষ্টা করছিল। তাতে কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বাচ্চাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, আমার সোনা পাখীগুলো কি করছে?

সালামের জবাব দিয়ে মানারা বলল, পাপা এখন বিরক্ত করো না। দেখছো না আমরা স্টার খুঁজছি।

স্টার? কিসের স্টার সোনা?

মাওয়ারা বলল, ওহহো পাপা তুমি তো কিছুই জানো না দেখছি। আজকে আমরা অনেকগুলো ভালো কাজ করেছি। সেগুলো স্টার হয়ে গিয়েছে মনের আকাশে। আমরা সেই স্টার খুঁজছি বুঝেছো। যাও যাও আমাদেরকে বিরক্ত করো না।

বাচ্চাদের কথা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও হাসি মুখে ওদের তাকিয়ে ওদের কর্মকান্ড দেখতে লাগলো জাওয়াদ। কিছুক্ষণ পর কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে আদীকে দেখে জাওয়াদ হেসে বলল, কিসের স্টার খুঁজছে ওরা?

আদী হেসে বলল, এসব আমাদের সাইকো মাস্টানীর ঘনঘন বাড়িতে আসার সুফল। দুই সপ্তাহ আগে এসে উনি বাচ্চাদেরকে বলে গিয়েছেন, মানুষ যখন কোন ভালো কাজ করে তখন সেটা একটা স্টার হয়ে যায়। আর মনের আকাশে গিয়ে সেটা ঝিলমিল করে আলো ছড়ায়। যেদিন ঘোর আঁধারে ঢেকে যাবে তোমাদের জীবন, সাহায্য করার কেউই থাকবে না। সেদিন এই ভালো কাজ রূপি ঝিলমিলে স্টারগুলো তোমাদেরকে জোনাকির মত বিন্দু বিন্দু আলোর মত জ্বলে পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ। আর তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে আলোকিত এক জগতে নিয়ে যাবে। যেখানে তোমরা যা চাইবে পাই পাবে। তাই তোমাদেরকে এখন বেশি বেশি স্টার জমাতে হবে। আর যত বেশি ভালো কাজ করবে তত বেশি স্টার জমা হবে তোমাদের কাছে। আল্লাহ যা করতে বলেছেন সবকিছু মেনে চলা, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা, আম্মুকে যন্ত্রণা না করা, সময়মত পড়তে বসা, নিজের খেলনা গুছিয়ে রাখা এই সবকিছু ফাটাফাটি একেকটা ভালো কাজ। আজ উনারা চারজন ফাড়াফাটি কিছু ভালো কাজ করেছেন। এখন তাই স্টার খুঁজছেন।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ এজন্যই হলরুমের সবকিছু এত সাজানো গোছানো। উনাদের এত বেশি বেশি সোনাবাচ্চা হয়ে যাবার কারণ তাহলে এটা। উনারা স্টার সংগ্রহে ব্যস্ত। যাইহোক, উনারা স্টার খুঁজতে থাকুক। চল আমরা যাই। কিন্তু উনাইশাহ নাকি নিজের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে?

আদী হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিছুক্ষণ আগে উসামা বাগানে বসে খেলছিল। উনাইশাহ গিয়ে হাজির হলো সেখানে। উনাইশাহকে দেখার সাথে সাথেই তো উসামার চেহারা কালো হয়ে গেলো একদম। কিন্তু উনাইশাহ পাশে বসে বলল, মামা আমি তোমাকে সরি বলতে এসেছি। এই দেখো সরি কার্ড নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। এটা আমি নিজে বানিয়েছি। কাশফিয়া আপ্পি শুধু একটুখানি হেল্প করেছে। মামা সরি। আমি আর কখনো তোমাকে দুষ্টু কথা বলবো না। কার্ড দেখে আর কথা শুনে উসামার চেহারা একদম খুশি খুশি হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইজন সবকিছু ভুলে গলায় গলায় খাতির করে ফেললো। একবারে মামা-ভাগনী যেখানে, সব সমস্যার সমাধান সেখানে যাকে বলে। সেহেতু ওরা নিজেরাই ভাব করে ফেলেছে তাই আজ আর কিছু বোঝাতে চাইছি না উনাইশাহকে। পরে কখনো বুঝিয়ে বললেই হবে।

হ্যা সেটাই ভালো। আমাদের আসলে বাচ্চাদের কাছ থেকে শেখা উচিত কত সহজে একে অন্যেকে ক্ষমা করে দিয়ে আপন করে নেয়া যায়। কোন হিসাব-নিকাশ, যুক্তি-তর্কে না জড়িয়ে কিভাবে জীবনটাকে সহজ, সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলা যায়। বাচ্চারা উন্মুখ হয়ে থাকে কিভাবে তাড়াতাড়ি মান-অভিমান দূর করে আবার খেলায় মেতে উঠবে সবাই মিলে। আর আমরা বড়রা অনুসন্ধান করি কিভাবে মান-অভিমানকে আরো ঘনীভূত করে তিলকে তালে রূপান্তরিত করা যায়। তবে ছোটরা যাদের ওদের ভুলগুলোকে বুঝতে পারে সেই পদক্ষেপ বড়দেরকেই নিতে হয়। ওদেরকে বুঝিয়ে বলতে হয় সমস্যার কথা। দেখিয়ে দিতে হয় সমাধানের সুন্দর পথ। বাচ্চারা তো মূলত নতুন কিছু শেখার জন্য উন্মুখ হয়েই থাকে। বাচ্চারা খুব অল্পেই খুশি হয়ে যায়। খুব অল্প জিনিসে  খুশি হবার ক্ষমতাটা ধীরে ধীরে বড় হবার পথে চলতে চলতে হারিয়ে ফেলে মানুষ। এই ক্ষমতাটা যেন কখনোই হারিয়ে না যায় মন থেকে সেজন্য বাবা-মাদেরকে সতর্ক থাকা উচিত। কারণ মানুষের আনন্দিত হবার উপকরণ যত বড় হতে থাকে, তার জীবনে নিরান্দদ ততই জায়গা করে নিতে থাকে। আর সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ছোট বেলা থেকেই ছোট ছোট জিনিসের মধ্যে বাচ্চাদেরকে আনন্দ খুঁজে নিয়ে আনন্দিত হতে উদ্বুদ্ধ করা। যেমন বৃষ্টি। আনন্দের সাথে সাথে বৃষ্টি একটা নিয়ামত। এই সময় দোয়া কবুল হয়। বৃষ্টিকে উপভোগ করতে শেখানোর পাশাপাশি বৃষ্টির দোয়াটাও শিখিয়ে ফেলা যায় খুব সহজেই।  

আদী হেসে বলল, বাচ্চা লালন-পালনের একটা স্কুল খুলে ফেল তুই আর সাইকো মাস্টারনী মিলে। জগতবাসী অনেক উপকৃত হতে পারবে ইনশাআল্লাহ। যাইহোক, কথা হয়েছে নূহার সাথে?

হুম, আলহামদুলিল্লাহ হয়েছে। চুপচাপ মেনেও নিয়েছে সব কথা। ইনশাআল্লাহ নিজেকে সামলে নেবে নিজেকে। আর কখনো যদি বেসামাল হয়ে যায় সেজন্য তো আমরা আছিই তাই না? আচ্ছা তুই তালহাকে রুমে দিয়ে আয়। আমি যাই প্যাকিং সেরে ফেলি। বেরোতে হবে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই।

তালহাকে আদীর কাছে দিয়ে বাচ্চাদের রুমে ঢুকলো জাওয়াদ। জিশান আর জারিফ নীচে বসে পাজেল মিলাচ্ছিলো। জিহাদ বই নিয়ে এক পাশে বসে পড়ছিল। আর নাবিহা মুখে হাসি আর চোখে অশ্রু নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসেছিল। বুঝতে পারছিল কোন কারণে খুব বেশি আনন্দিত নাবিহা। কিন্তু সন্তানদের চোখে আনন্দাশ্রুও দেখলেও বুকের মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করে জাওয়াদের। মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলল, কি হয়েছে আমার মামণিটার?

নাবিহা চোখ মুছে মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করে বললো, মামণি যে গতরাতে হুট করে চলে গেলো। আমি সেজন্য অনেক মন খারাপ করে একটা ম্যাসেজ লিখেছিলাম। অনেক অভিমানী কথা লিখেছিলাম মামণীকে। পাপা দেখো মামণি ম্যাসেজের জবাবে আমাকে কি লিখে পাঠিয়েছে।

জারিফ লাফ দিয়ে উঠে বলল, কি লিখেছে মা তোমার জন্য আপ্পি?

জিশান আর জিহাদও এগিয়ে এলো। জাওয়াদ হেসে বলল, নাবিহা আমরা সবাই বসছি। তুমি আমাদেরকে পড়ে শোনাও মা কি লিখেছে তোমাকে নিয়ে।  

নাবিহা আনন্দময় হাসি বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে বলল, মা লিখেছে,“অনেক আগে একটা কার্টুন দেখেছিলাম নাম ছিল ‘ডুমবো’। ছোট্ট একটা হাতির বাচ্চাকে নিয়ে ছিল কার্টুনটি। সেই কার্টুনেই আমি প্রথম দেখেছিলাম বকরা তাদের ঠোঁটে ঝুলিয়ে স্বর্গরাজ্য থেকে ছোট্ট ছোট্ট নবজাতক শিশুকে এনে দিচ্ছে তাদের মায়েদের কাছে। শিশুদের পেয়ে মায়েদের সে কি আনন্দ। বুঝেছিলাম শুধু মানুষই না সব প্রাণীদের মধ্যেই মাতৃত্ব অনুভূতিটা অন্যরকম মন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু। হুমম, তবে তখন শুধু দেখেছি আর আনন্দ পেয়েছি কিন্তু নিজে মা হবার পর উপলব্ধি করেছিলাম অনুভবের সাগরে প্রাপ্তির কেমনতর জোয়ার আসে নতুন প্রাণের আগমনে। যেন তেন প্রাণ কিন্তু নয়, সেই প্রাণ যে একটু একটু করে বেড়ে ওঠে নিজেরই ভিতরে। অনেকটা বকের গলায় ঝুলে ঝুলেই আমার জীবনে আগমন ঘটেছিলো আমার ছোট্ট রাজকন্যার। ওকে প্রথম যখন দেখেছিলাম মনেহয়েছিল এটা কি সত্যিই কোন মানব শিশু নাকি পরীদের দেশ থেকে আসা কোন ফুলপরী? যেভাবে চারপাশ ওর আলোয় আলোকিত হয়ে যাচ্ছে নাকি চাঁদের এক টুকরাই খসে পড়েছে পৃথিবীতে? অনেক খুঁজে যখন শরীরে কোথাও ডানাকাটার দাগ পেলাম না, নিশ্চিন্ত হলাম যে না আমি কোন মানব শিশুকেই দেখছি। কোলে নিয়ে মুখপানে চাইতেই চোখ আটকে গেলো ওর স্বপ্নালু দুটি চোখে। খোলা চোখও যে এমন স্বপ্নের আবেশ জড়ানো থাকে সেই প্রথম জেনেছিলাম আমি। গায়ের রঙ দেখে মনেহচ্ছিল সদ্য ফোঁটা শিশির স্নাত হালকা গোলাপী এক গোলাপকে জড়িয়ে ধরে বসে আছি। ভালোলাগার সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিলাম ওর অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা দেখে। কল্পনার সব রঙ মিশিয়ে তুলি দিয়ে আঁকা এক স্বপ্নকন্যা যেন আমার ছোট্ট রাজকুমারী।

ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমার রাজকুমারীর ভীষণ প্রিয়। পছন্দ করে রংবেরংয়ের ফুল, পাখী, গাছপালা। এজন্যই মনেহয় ওর আবেগ খুবই সমৃদ্ধ, রঙিন আর বৈচিত্র্যময়। রূপকথার রাজ্যে বসবাসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকলেও উর্বর কল্পনাশক্তি দিয়ে সৃজনশীলতাকে বের করতে জানে। শব্দ আর ছন্দের খেলা ভীষণ ভালোবাসে বলেই হয়তো খুব সহজেই রপ্ত করে ফেলেছে ছড়া ও কবিতা লেখা। স্বভাবে ভীষণ আদুরে। এতোটা যে প্রিয় খাবার কি জিজ্ঞেস করলে বলে ‘আদর’। একটুতেই অভিমান করে, সহজে মনোবাসনা ব্যক্ত করতে চায় না। কিন্তু সবাই ওকে আদর-স্নেহ-ভালোবাসাতে ডুবিয়ে রাখুক এটাই ওর একান্ত কামনা। মনেহয় এই সেদিন আকাশে উড়ন্ত পাখী দেখে অঝোর কান্নার সাথে আবদার করছিলো ওকে দুটি ডানা লাগিয়ে দিতে যাতে আকাশে উড়তে পারে। ওকে সেদিন বলেছিলাম মানুষের উড়তে ডানা লাগে না, লাগে স্বপ্ন, চেষ্টা আর ইচ্ছা। আর মামণি তোমার স্বপ্নে একটা ইচ্ছা আর আরেকটা চেষ্টার ডানা লাগিয়ে দেবো। তুমি উড়বে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। কি বুঝেছিল জানি না কিন্তু মেনে নিয়েছিলো আমার কথা। বছর ঘুরে ঘুরে আমার রাজকুমারী ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাবে জানি। কিন্তু বয়স যে মনের মধ্যে ছাপ ছেড়ে যায় এমনটা আমার পছন্দ না। বয়স যতই বাড়ুক মনের মধ্যে ছেলেমানুষি থাকতে হবে, চোখে থাকতে হবে স্বপ্নালু ভাব। কল্পনাকে জয়ের আশ্বাসে থাকতে হবে স্বপ্ন দেখার গুণ। তাহলেই মনজয়ী কৌশলগুলো প্রস্ফুটিত হবে চরিত্রে। জানি সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমার রাজকুমারী নাবিহা বিনতে জাওয়াদ সংসার সমুদ্রে নৌকা ভাসাবে নিজের ভুবনে যাবার জন্য। দোয়া করি জগতের সকল আনন্দ-হাসি-সুখ যেন বারবার আন্দোলিত করে যায় আমার রাজকুমারীকে। তাকে দেখে যেন মনেহয় মানুষ আসলেই আশরাফুল মাখলুকাত।"

পড়তে পড়তে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো নাবিহার। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নিলো জাওয়াদ। অন্যসময় হলে অশ্রু গোপন করার চেষ্টা করতো কিন্তু এই মূহুর্তে ঝরে দিতে দিলো। জিহাদ, জিশান আর জারিফও পাপা আর বোনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, তোমাদেরকে কি একটা ফাটাফাটি আনন্দের সংবাদ দেবো?

কি সংবাদ পাপা? চারজনই একসাথে জিজ্ঞেস করলো।

বিকেলে তোমাদের মা আর বাবা আসছে। এবং আগামী দুই সপ্তাহ তোমাদের সাথে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

এই সংবাদ শোনা মাত্রই তো আনন্দে চিৎকার করে উঠলো চারজন। বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাসে মগ্ন করে দিয়ে জাওয়াদ প্যাকিং করার উদ্দেশ্যে নিজের রুমে রওনা দিলো।   

আমাদের আনন্দবাড়ি...২০



গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে সেই মূহুর্তে জানালায় নক শুনতে পেয়ে দৃষ্টি সামনে থেকে ঘুরিয়ে পাশে তাকালো জাওয়াদ। মুখের সবগুলো দাঁত বের করে হুমায়ূন দাঁড়িয়ে ছিল গ্লাসের ওপাশে। জাওয়াদ গাড়ির লক খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে সালাম দিয়ে হুমায়ূন বলল, মিটিং ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে আমার। তাই চলে এলাম তোমার সাথে বাড়িতে ফেরার জন্য।

জাওয়াদ সালামের জবাব দিয়ে বলল, বুঝলাম। কিন্তু তখন থেকে দাঁত বের করে রাখার কারণটা বুঝতে পারছি না।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, আজকেই তোমাকে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করার সুযোগ পেয়ে গেলাম তো তাই চেষ্টা করেও দাঁত বন্ধ করতে পারছি না।

তুই চাইলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি। একান্তই যদি বন্ধ করা সম্ভব না হয় অন্তত তোর দাঁত গুলো ঝরিয়ে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। কি ট্রাই করবো করবো?

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, মাফ চাই ভাই। এবং সাথে আমার প্রশ্নের জবাবটাও চাই।

হুম! কিন্তু সেজন্য আগে প্রশ্নটা তো জানতে হবে আমাকে।

হুমায়ূন হেসে বলল, আমার প্রশ্নটা হচ্ছে তোমার মনের অনুভূতি জানার পর ফায়েজ ভাইয়া, আদী ভাইয়া, সুবহা, রিসাব এবং আমি যখন কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমরা বিষয়টা সহজ ভাবে মেনে নিতে চাইলেও তুমি আপত্তি করেছিলে। বলেছিলে, এমন কিছু হলে আমাদের পারিবারিক অবকাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যেটা কোন ভাবেই তুমি হতে দিতে চাও না। এবং তুমি সত্যি সত্যিই নিজেকে একদম গুঁটিয়ে নিয়েছিলে এরপর। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে একেবারে বিয়ের ঘোষণা দেবার পেছনে কারণটা কি ছিল?

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জাওয়াদ হেসে বলল, ফার্সিতে একটা প্রবাদ আছে, “সব জিনিসের মূল্য জানো কোনটা কত দামী, নিজের মূল্যেই জানো না তুমি এ কেমন পাগলামী?” হুমায়ূন যখন আমার ভান্ডারে জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল না তখনো আমার মনেহতো, নিজের মূল্য জানাটা মানুষের জন্য খুব বেশি জরুরি। মানুষ ভুলের স্রোতে ভেসে যায়, প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়, অন্যের তরে স্বার্থ বলি দেবার বদলে নিজের জীবনকেই ত্যাগ করে দেয় অহেতুক। ইত্যাদি ইত্যাদি  নানান ধরণের আত্মিক ও শারীরিক জুলুম মানুষ নিজের মূল্য জানে না বলেই করতে পারে নিজের সাথে। নিজ জীবনের মূল্য জানে না বলেই মানুষ অন্যের কারণে নিজের জীবনের সুখ-শান্তি-স্বস্থিকে বিসর্জন করে দিতে পারে। নিজের মূল্য জানে না বলেই মানুষ ছোট্ট একটু লাভের জন্য অনেক বড় কল্যাণকর কিছুকে দূরে সরিয়ে দেয়। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায় মানুষের নিজের মূল্য না বোঝার, না জানার। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আমি আমার মূল্য জানতাম। আমি জানতাম  আমার জীবন শুধু আমার একার নয়। আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে আরো অনেকগুলো জীবন। একটা পুরো পরিবারের হাসি-আনন্দ। একটি ইসলামী সংগঠনের অসংখ্য ভাইয়ের স্বপ্ন ও আত্মত্যাগ। তাই আমি এটাও জানতাম মানসিক ভাবে আমার শান্ত থাকাটা কতটা জরুরি। নূহার প্রতি ভালো লাগার আত্মোপলব্ধির পর সবদিক বিবেচনা করে সরে যাওয়াটাকেই বেটার মনে হয়েছিল আমার কাছে। কিন্তু নূহার দশ বছর বয়স থেকে নিয়ে পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত কখনো ফোনে, কখনো মেইলে কথা বলা। শিশুসুলভ কথা ছাড়িয়ে মনের অজান্তেই দুজন জ্ঞানোরাজ্যে ঘুরে  বেড়ানো। প্রায় পাঁচ বছরের এই অভ্যস্ততা কাটিয়ে তোলাটা বেশ কঠিন হচ্ছিলো আমার জন্য। তাছাড়া ওয়াসওয়াসা দেবার জন্য শয়তান আর সেটাতে সঙ্গ দেবার জন্য তো প্রবৃত্তি ছিলই। আশেপাশের সবাই তো বটেই আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম কাজকর্মে নিজের অমনোযোগিতা। তবে কিছুটা সময় পেরোলে হয়তো এসব ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু নূহা তো আর আমার অবস্থা জানতো না। তাই নিয়মিতই মেইল করতো। প্রায় দু’মাস আমি ওর কোন মেইলের জবাব দেইনি। ভেবেছিলাম জবাব না পেয়ে একসময় মেইল পাঠানো বন্ধ করে দেবে।

হুমায়ূন হেসে বলল, হুম! আমার মনেআছে নূহা সারাক্ষণ মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াতো তখন। আমার কাছে এসেও জিজ্ঞেস করতো মাঝে মাঝে পিভি ভাইয়ার কি হয়েছে সেটা কি জানো? ভাইয়া কেন আমার মেইলের জবাব দেয় না? বাবা-মামণি, পাপা-মা থেকে নিয়ে শুরু করে বাড়ির সবার কাছেই এই একই প্রশ্ন করতো। বাবা বুঝিয়ে বলেছিল, হয়তো জাওয়াদ ব্যস্ত খুব তাই মেইলের জবাব দেবার সময় করতে পারে না। হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল ঐ সময় নূহা। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে অস্থির করাও ছেড়ে দিয়েছিল বাড়ির সবাইকে। তোমাদের বিয়ের আগ পর্যন্ত ওমন চুপচাপই ছিল। যাইহোক, মেইলের জবাব না পেয়ে কি মেইল করা বন্ধ করে দিয়েছিল?

জাওয়াদ হেসে বলল, উহু, বন্ধ করেনি। তবে নিজের মনের অনুভূতি, উপলব্ধি, কবিতা যে লিখে পাঠাতো। সেসব লেখা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে ঘটমান সবকিছু লিখে পাঠাতো প্রতিদিনই। ভাইয়া তোমার কি হয়েছে? কেন মেইলের জবাব দাও না? আমি কি কোন দুষ্টু কাজ করেছি? সেজন্য কি শাস্তি দিচ্ছো? এই ধরণের প্রশ্ন করাও বন্ধ করে দিয়েছিল একদমই। সালাম দিয়ে মেইল  শুরু করতো। এরপর শুধু পরিবারের কথা লিখতো। পুরো দশ মাস আমি ওর কোন মেইলের  জবাব দেইনি। কিন্তু একদিনের জন্যও নূহা মেইল পাঠাতে মিস করেনি। এই ঘটনাটা আমার সামনে একসাথে নূহার চরিত্রের অনেকগুলো দিক উন্মোচন করে দিয়েছিল। যা করণীয় মনে করে তা করবেই। কেউ তাতে উৎসাহ দিক বা না দিক তাতে ওর কাজে কোন প্রভাব পড়বে না। কোন কিছুর পেছনে লেগে থাকার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা। আপন কেউ যদি কষ্টও দেয় তবুও তাকে ভালোবাসা থেকে বিমুখ না হওয়া। ধৈর্য্যশীলতার সাথে প্রতীক্ষা করার ক্ষমতা। শব্দের মাঝে নিজের মনের অবগুন্ঠিত ভাবকে ছড়িয়ে দেয়া। শেষের দিকের প্রতিটা মেইল খোলার সাথে সাথে আমি নূহার রাগ আর জেদের উত্তাপ ফিল করতাম। কখনো পড়ার সময় মনেহতো এই শব্দগুলো অশ্রুসিক্ত। কিন্তু তবুও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। সেজন্যই সাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে দেশে যাবার আগে সিরিয়াসলিই বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে বলেছিলাম মা-মামণিদেরকে।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, কি যে এক অবস্থা হয়েছিল তখন। মাদার গ্রুপের সদস্যরা চলমান বিয়ের আয়োজন ছেড়ে ছুঁড়ে ঝাঁপিয়ে পরেছিল তোমার জন্য পাত্রীর সন্ধানে। কোন কোন দিন তো তিনবেলা তিনটা মেয়ে দেখতে যেতেন। মার একজনকে পছন্দ হয় তো মামণির তাকে মনে ধরে না। মা আর মামণি একমতে আসা মাত্রই আম্মি বলতো, তোমাদের পছন্দকে আমি সম্মান করছি কিন্তু আমাদের রাজপুত্রের সাথে এই মেয়েকে ঠিক মানাবে না। অবশেষে গিয়ে ফুপির চাচাতো দেবরের মেয়ে সাবিতকে সবার মোটামুটি পছন্দ হলো তোমার জন্য। এরপর তোমার দেশে আসার জন্য সবার অধীর অপেক্ষা। কিন্তু তুমি এসে সাবিতের ছবি দেখতেই রাজী হলে না। বরং বললে যে সরাসরিই কথা বলবে বাড়ির বিয়ের ঝামেলা শেষ হবার পর।

জাওয়াদ হেসে বলল, হুম! মা এমনিতেই সারাক্ষণ নূহার কথা বলতো। নূহা এটা করেছে, নূহা ওটা করেছে। বাড়ির একটা মেয়েও নূহার মত না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ঐ সময়টায় আমার কাছে এসে নূহার প্রশংসা করাটাই যেন মার কথা বলার একমাত্র টপিকস ছিল। অবশ্য এর একটা কারণ সম্ভবত এটা ছিল যে, কাজের পাশাপাশি আগে প্রচুর দুষ্টুমিও করতো নূহা। নূহা একদম ছোটবেলা  থেকেই সাংসারিক টাইপ মেয়ে। ছোটবেলাতেও ওর একমাত্র খেলা ছিল ছোট ছোট হাড়ি-পাতিল নিয়ে রান্নাবান্না করা। চার বছর বয়স থেকেই বাবার জন্য আমি চা বানাবো, ভাইয়ার জন্য আমি কফি বানাবো, সবার জন্য আমি প্লেটে ভাত সার্ভ করবো বলে চিৎকার করতো। কাজ করতে পছন্দ করতো, আপনজনদের খেয়াল রাখতে পছন্দ করতো, তাদের ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে মূল্য দিতে শিখে নিয়েছিল কিংবা এসবই ওর স্বভাবজাত গুণ ছিল। এসব কারণে আমাদের মা-মামণিদের মনে নূহাই ঘুরে বেড়াবে এটাও স্বাভাবিক ছিল। তবে সারাক্ষণ দুষ্টুমি করতো বলে ওর দিকে আলাদা করে মনোযোগ দেবার কোন সুযোগ ছিল না কারো। কিন্তু ঐ সময় যখন নূহা একদম  চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। যখন থেকে পরিবারে দেয়া ওর অবদান গুলো দুষ্টুমির বাতাসে বয়ে যাওয়া থেমে গিয়েছিল। তখন মা-খালামণিরা আরো গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিল আমাদের আনন্দবাড়ির সর্বত্র নূহার ছোট্ট ছোট্ট হাতের মমতা ছোঁয়া পরশ। আর আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল নূহার ভেতরের মাতৃত্ব। সুবহা মনেহয় শুধু জন্ম দিয়েছিল কিন্তু আওয়ামকে লালন-পালন ধরতে গেলে নূহাই করেছিল। সেবার দেশে যাবার পর একদিন দোতলার করিডোরে এসে দেখি আওয়াম  রঙ পেন্সিল দিয়ে মনের আনন্দে ড্রইংরুমের দেয়াল জুড়ে ছবি আঁকছে। একটু পর নূহাকে আসতে দেখে ভেবেছিলাম হয়তো আদরের সুরেই বললে তুমি এমনটা কেন করলে বাবা, দেয়ালে আঁকতে  হয় না, ইত্যাদি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নূহা চোখ বড় বড় বলল, এই ফাটাফাটি সুন্দর ছবিগুলো কি আমার আওয়াম সোনা এঁকেছে? মাশাআল্লাহ। কি করে আঁকলো এত্তো সুন্দর ছবি  আওয়াম? ফুম্মাকে কি একটু শিখিয়ে দেবে ছবি আঁকা প্লিজ? আওয়ামের খুশি আর আনন্দ তো মূহুর্তে আকাশ ছুঁয়ে দিয়েছিল। লাফাতে লাফাতে বলল, ফুম্মা আতো থিকিয়ে দেই তোমালে।

হুমায়ূন হাসতে হাসতে বলল, আওয়ামের কথাগুলো এত সুইট ছিল মাশাআল্লাহ। তোমার মনে আছে ভাইয়া ওই সময় আমরা সবাইও আওয়ামের মতো করে কথা বলতাম?

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, হুম! নূহা তখন সত্যি সত্যিই আওয়ামের সাথে ছবি আঁকতে বসে গিয়েছিল। মা এসে দুজনকে দেয়ালে ছবি আঁকতে দেখে চিৎকার করে উঠেছিল। নূহা হাসতে হাসতে বলেছিল, খালামণি এটা তোমার কাছে ঘরের দেয়াল। কিন্তু শিশুদের কাছে এটা হচ্ছে বিশাল এক উন্মুক্ত ক্যানভাস। জানোই তো শিশুদের ভুবন ভীষণ রকম কালারফুল। ওরা তাই এমন সাদা, ফ্যাঁকাসে কিছু দেখলেই নিজেদের মনের ভেতর তুলি ডুবিয়ে রাঙিয়ে দিতে চায় চারপাশ। কোথায় আমাদেরকে ধন্যবাদ দেবে, তা না তুমি চিৎকার করছো। তাছাড়া সামান্য কটা টাকা খরচ করে নতুন করে রঙ করলেই এই দেয়ালের দাগ মিনিটে ফেলা সম্ভব হবে। কিন্তু দেয়ালে এই দাগগুলো দেবার সময় আওয়ামের মনে যে আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়েছে সেটা চির অম্লান থাকবে। শৈশবের আনন্দময় মূহুর্তগুলোর মূল্য কখনোই শব্দে ধারণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আলোকিত শৈশব জীবনের অন্ধকার পথে মশালের কাজ করে। অনেক কষ্ট ভুলে থাকা সম্ভব হয় শৈশবের সুন্দর স্মৃতির মাঝে ডুবে থেকে। তাই অকারণে তুমি আমাদের সৃজনশীলতাকে বাঁধাগ্রস্ত করো নাতো।

শৈশব নিয়ে বলা কথাগুলো নিশ্চয়ই তোমাকে ঘিরেই ছিল!  

হুম! আমারো সেটাই মনে হয়েছিল। এবং ঐদিন প্রথম ফিল করেছিলাম আমি গত দশ মাস ধরে কতটা কষ্ট দিয়েছি নূহাকে। শুধু নিজের দিকটা ভাবতে গিয়ে আমি নূহার মনে কি পরিমাণ শূন্যতা তৈরি হবে সেটা ভেবে দেখিনি। ঐদিন নূহার কলেজের ফাস্ট সেমিস্টারের রেজাল্টও দিয়েছিল। এবং সবসময়ের মতো প্রতিটা সাবজেক্টে টপ মার্কস ছিল নূহার। অথচ আমার অ্যাক্টিভিটিস দারুন ভাবে  প্রভাবিত হয়েছিল মানসিক অস্থিরতার কারণে। ঐদিন তাই আরেকটা ব্যাপারও ফিল করেছিলাম। নূহার সেলফ কন্ট্রোলিং পাওয়ার। মানসিক দুর্যোগের সময় নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সমূহকে যথাযথ পালন করে যাওয়া ভয়াবহ রকমের কঠিন একটা কাজ। কিন্তু নূহার রেজাল্ট প্রমাণ করে দিয়েছিল মনের শূন্যতাকে মনের এক কোনে বন্দী করে রেখে জীবনের স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখার ক্ষমতা আল্লাহ ওকে দিয়েছেন। এমন আরো অনেকগুলো ছোট ছোট কারণ উন্মোচিত হতে শুরু করেছিল আমার সামনে। যার কোন একটা মিস হয়ে গেলেই হয়তো আমি সামনে এগোনোর কথা চিন্তা করতাম না। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তখন আমার মনে হয়েছিল, যেহেতু আমার আর নূহার বিয়ের  পারমিশন শরীয়ত আমাদেরকে দেয়। তাহলে কেন শুধুমাত্র মানুষ কি ভাববে সেই চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমাদের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবো? মানুষের কাছে তো সর্বাবস্থাতেই কিছু না কিছু বলার মতো থাকে। মানুষের কাজ ওই বলা পর্যন্তই। তাই শুধুমাত্র বেমানান এই কারণে আমার  আর নূহার মধ্যের সুন্দর সম্পর্কটাকে চিরতরে শেষ করে দেবার কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। আমার মনে নূহার যে অবস্থান গড়ে উঠেছিল সেটা মুছে ফেলাটাও যে খুব সহজ কিছু ছিল না দশ মাসের অভিজ্ঞতায় সেটাও বুঝতে পেরেছিলাম। তারউপর নূহার মধ্যে সেই প্রত্যেকটা গুণাবলী বর্তমান ছিল যেগুলো আমি পেতে আগ্রহী ছিলাম আমার জীবনসাথীর মধ্যে। কিন্তু নুহা ঠিক আমাকে কিভাবে ফিল করে সেটা তখনো আমার জানা ছিল না। জানতে চাচ্ছিলামও না সেভাবে করে। কিন্তু বিয়ের কথা পরিবারকে জানানোর আগে একবার অন্তত ওর ইচ্ছে জেনে নেয়াটা জরুরি মনে হয়েছিল। সেজন্যই আমি আরো সাত মাস অপেক্ষা করেছি। এবং তখনো আমি হান্ডেড পার্সেন্ট শিওর ছিলাম না যে নূহা সম্মতি দেবে আমার কথার সাথে। তাই বিয়ের সম্মতি চেয়ে করা আমার প্রশ্ন শুনে নূহা যতটা অবাক হয়েছিল। ওর সম্মতি পেয়ে আমিও ততটাই অবাক হয়েছিলাম।

হুমায়ূন হেসে বলল, তোমাদের নিয়ে অনেক মজার একটা গল্প লেখা যাবে বুঝলে। শিরোনাম হবে, অবিশ্বাস্য এক ভালোবাসার গল্প। তবে গল্পটা এখনো অসম্পূর্ণ। নায়িকার অনুভূতি জানা ছাড়া সেটা  সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। নূহার কাছে তো আমি জিজ্ঞেস করতে পারবো না। তুমিই বলো নূহার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল ঐ দেড় বছরে।

তাতো জানি না। কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি নূহাকে। আমার মনের অবস্থার কথাও কখনো বলা হয়নি ওকে। আড়াই বছরের সংসার জীবনে অতি যত্নের সাথে আমরা দুজন জীবনের এই অধ্যায়টাকে এড়িয়ে চলেছি।

কেন? বেশ অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো হুমায়ূন।

জাওয়াদ হেসে বলল, আমি ভয়ে এড়িয়ে চলেছি। মনেহতো প্রসঙ্গটা উঠলেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু জটিলতা তৈরি হবে আমাদের মাঝে। এমন অনেক প্রশ্ন নূহা করবে যার জবাব শুনলে আবার প্রচন্ড কষ্ট পাবে। কষ্টের দ্বার তাই অবরুদ্ধ করে রাখাটাই বুদ্ধিমত্তা মনে হয়েছে। নূহা কেন এড়িয়ে গিয়েছে সেটা অবশ্য আমার জানা নেই। নিশ্চয়ই ওর নিজস্ব কোন কারণ আছে। তবে সব কথার এক কথা হচ্ছে আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা হয়তো কঠিন ছিল। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাবার পর আমি আমার মনের ভালোবাসার ক্ষমতার শেষ সীমানায় ছাড়িয়ে ওকে ভালোবেসেছি। বিশেষ করে নূহার এক্সিডেন্টটা আমাদেরকে খুব দ্রুত একে অন্যের কাছে নিয়ে এসেছিল। আমি যখন নূহাকে আইসিইউ তে দেখেছলাম। প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম এতদিন ধরে মনের যে আবেগকে অবচেতন মনের ভালো লাগা মনে করতাম। সেগুলো আসলে মনের সেই ভালোবাসা যা কখনো কখনো মন অন্যকোন দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে নোটিশ করতে ভুলে যায়। এক মূহুর্তেই তাই সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝরে পড়ে গিয়েছিল আমার মন থেকে। এবং আবারো একবার নিজেদের অজান্তেই আমরা একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেবার তিন স্বীকারোক্তির ঐশী বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের সুশীলত ছায়াতলে সারাজীবনের জন্য একে অন্যের হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। নাহ! ভুল বলে ফেললাম বোধহয়। সারাজীবনের জন্য নয়, অল্প কিছু সময়ের জন্য।

এরপর অনেকটা পথ হূমায়ূন আর জাওয়াদ দুজনই চুপ করে রইলো। এরপর হুমায়ূন বলল, তুমি এভাবে আর কতদিন থাকবে ভাইয়া? এখন মনেহয় তোমার বিয়ে করে নেয়া উচিত।

জাওয়াদ হেসে বলল, চল তোকে একটা গল্প শোনাই। এক পিঁপড়ার খুব শখ সে আকাশে উড়বে। তার ছোট্ট মাটির ঘর থেকে বের হয়ে দূর দূরান্তে ঘুরতে যাবে। অনেক সুখের এবং আনন্দের হবে তার জীবন। একদিন সেই পিঁপড়াটা তার স্বপ্নের কথা বাবা মাকে খুলে বলে। বাবা মা তখন তাকে বুঝিয়ে বলে যে, দূর থেকে যতটা সুন্দর ও আনন্দময় লাগছে বাইরের জগতটা আসলেই অতটা  ভাল না। জলে-স্থলে-আকাশে এমন অনেক ভয়ঙ্কর প্রাণী আছে তাকে আঘাত করে ব্যথা দেবে। আর জ্বলজ্বলে স্বপ্নময় আলো তো সাক্ষাৎ মৃত্যু। কিন্তু বাবা-মার কাছে এত কিছু শোনার পরেও সেই পিঁপড়াটি নিজের মনের স্বপ্নের কথা ভুলতে পারে না। সব সময় মাটির এমন মাটির সান্নিধ্য তার ভালো লাগেনা। নিজের জীবনের সবকিছুকেই তার বিষময় লাগতে শুরু করলো ধীরে ধীরে। অপারেতেই সর্বসুখ আমার বিশ্বাস অনেকটা এমন চিন্তার ঘেরাটোপে আঁটকে গিয়েছিল পিঁপড়া। মাটির ময়লা রঙ আস্তে আস্তে তার অসহ্য লাগতে থাকে। তাই একসময় সে সকল বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সুখের সন্ধানে ছুটে গেলো বাইরের জগতে। তার জন্য নিষিদ্ধ জাদুর পানি পান করলো। যারফলে এক আশ্চর্য পরিবর্তন এলো তার দৈহিক গঠনে। তার দুই পাশে খুব সুন্দর দুটি পাখা গজিয়ে উঠলো। সুখালোর সন্ধানে সে ডানা মেলে দিলো আকাশ পানে। এখানে সেখানে যেখানেই আলোর খেলা তার নজরে পড়ছিল ছুটে যাচ্ছিলো নেশাগ্রস্থের মত সেদিকে। পেছনে পড়ে রইলো তার ছোট্ট মাটির ঘর। তার ভাই-বোন, যাদের সাথে সে প্রতিদিন খেলা করত। তার বাবা-মা, যারা তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। উড়তে উড়তে দূরের এক গ্রামের এক বাড়িতে প্রবেশ করলো পিঁপড়াটি। দেখলো কিছু ছোট ছোট মানুষ এক আশ্চর্য সুন্দর এক আলোকে ঘিরে খেলা করছে। ঠিক যেমন সে তার ভাই-বোনদের সাথে দুষ্টুমির খেলা খেলত! একজন বড় মানুষ এসে তাদের খেলা থামিয়ে দিয়ে তাদের মুখে খাবার দিতে লাগলো। ঠিক তার মা যেমন তার মুখে খাবার তুলে দেয়। হঠাৎ করে তার প্রচন্ড মার কথা মনে পড়লো। কিন্তু মার কাছে ফিরে যাওয়ার আগে একবার কাছ থেকে আশ্চর্য সুন্দর সেই আলোকে দেখতে চাইলো। আলোর কাছে পৌছেই টের পেলো তার হালকা পাখা গলে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রন হারিয়ে সে আলোর উৎস মোমের মত গলিত অংশের উপর পড়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে তার শরীরে ফোস্কা পড়ে গেল। এখন শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। সে  বুঝতে পারল, তার মাটির ঘর কত নিরাপদ ছিল, কত সুখের ছিল বাবা-মার সঙ্গ, কতই না আনন্দময় ছিল ভাইবোনের সাথে কাটানো ক্ষণ। অথচ দূরের সৌন্দর্যের মিথ্যা হাতছানিতে সাড়া দিয়ে গিয়ে শুধু যে সুখ আর আনন্দ হারিয়ে গেলো তার জীবন থেকে তাই নয়। সে হারালো তার জীবনটাকেও। বুঝেছিস?

হুমায়ূন হেসে বলল, হুম, বুঝেছি। নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপাড়েতেই সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। তুমি মোটেই তেমন মানুষ হও। তুমি যখন যে পাড়ে থাকো সে পাড় থেকেই সুখ খুঁজে বের করে সুখী হতে চেষ্টা করো।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ এই তো বুঝেছিস। সুখ নিয়ে তোর ভগ্নীর একখানা কবিতা আছে। আমার খুবই পছন্দের। ‘দেখলুম একজনা, সুখকে বেড়াচ্ছেন খুঁজে চারিদিকে আঁতিপাঁতি। ভাবলুম আনমনা, সুখ কি হারানো বস্তু নাকি একটি অনুভূতি? জবাব ছিলই জানা, সুখ নয় গুপ্তধন, নয় কারো নিজস্ব সম্পত্তি। ইতিবাচক ভাবনায়, নিজের মাঝেই মিলবে সুখের খন্ড খন্ড জ্যোতি।” আলহামদুলিল্লাহ আমার জীবনের সর্বত্র জ্যোতিময়। নতুন কোন সম্পর্কের আলোর প্রয়োজন নেই। আমি আপনালোতেই সন্তুষ্ট এবং রবের প্রতি কৃতজ্ঞ।

হুমায়ূন হাসিমুখে আলহামদুলিল্লাহ বললো। এরপর বাকিটা পথ দুজনই চুপ করে রইলো।