মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...৫



রান্না শেষ করে স্টাডি রুমে উঁকি দিয়ে নূহাকে ফোনে কথা বলতে দেখে বিরক্ত না করে ফাতিমা ও সাবিরা ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো। মুগ্ধ চোখে দেয়ালে ঝুলানো ওয়ালমেট গুলো দেখতে দেখতে সাবিরা বলল, আমার আম্মুও অনেক সুন্দর সেলাইয়ের কাজ জানেন জানো! আমিও অনেক কিছু শিখেছিলাম কিন্তু এখন মনেহয় ভুলে গিয়েছি না করতে করতে।
ফাতিমা হেসে বলল, আমিও ছোটবেলায় আম্মুর কাছ থেকে অনেক ধরণের সেলাইয়ের কাজ শিখেছিলাম। আসলে আমাদের আম্মুরা যেমনটা গুণী আমরা তেমনটা হতে পারিনি। বিশাল বড় সংসার, অনেক গুলো সন্তান দেখা শোনার পরও কত ধরণের শৌখিন কাজ করতেন উনারা। আর আমরা পড়াশোনা করতেই হিমশিম খাই।

এর কারণ আপনারা কোন কিছু করতেই চান না। পড়াশোনা করেই মনে করেন বিশাল কিছু করে ফেলেছেন। আপনাদের কাছে পড়াশোনা মাটি কাটা কিংবা ইটের বোঝা টানার মতই পরিশ্রমের কাজ। এটা করার পর তাই ফেসবুক, ব্লগ, স্কাইপ, আর বিভিন্ন ওয়েব সাইটে ঘুরঘুর করা ছাড়া আর কিছুই শেখার বা করার মত শক্তি অবশিষ্ট থাকে না।

নূহার কথা শুনে সাবিরা ও ফাতিমা দুজনই হেসে ফেললো। নূহাও হেসে বলল, সরি অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম তোমাদেরকে। ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই তোমাদের? চলো খেয়েনি আমরা।

ফাতিমা বলল, জ্বিনা ম্যাম তেমন ক্ষুধা লাগেনি। আরেকটু পরে খাবো। এইসব শোপিস আর ওয়ালমেট আপনার বানানো?

নূহা হেসে বলল, তোমাদের আম্মুদের মতো আমার মামণিও বিরাট গুণী মহিলা মাশাআল্লাহ। ছোটবেলায় ভীষণ অবাক হতাম মামণিকে দেখে। এত বড় একটা সংসার, এত গুলো ছেলে-মেয়ে সামলানোর পরও নিজ হাতে আমাদের বোনদের জন্য ড্রেস বানাতেন। সেইসব ড্রেসে নানা ধরণের হাতের কাজ করতেন, কুসিকাঁটা দিয়ে লেস লাগিয়ে দিতেন, নিজ হাতে আমাদের জন্য মাফলার বুনতেন, ঘর সাজানোর জন্য ওয়ালমেট ও শোপিস বানাতেন। মামণি ইংরেজি সাহিত্যের স্টুডেন্ট ছিলেন। চমৎকার সব গল্প-কবিতাও লিখতেন। আর মামণির মজাদার রান্না তো তোমরাও খেয়েছো। এছাড়াও সমাজসেবা মূলক কাজ এবং আরো কত কিছু যে করতেন। মামণিকে আমার মনেহতো অলরাউন্ডার। একদিন জানতে চেয়েছিলাম যে, কিভাবে করো এত কাজ একসাথে? মামণি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, পারি কারণ এসব করতে আমাকে কেউ বাধ্য করেনি। আমি সবকিছু মনের আনন্দে করি। নিজেকে ব্যস্ত ও ভালো রাখার জন্য করি। অহেতুক অবসর মানুষকে অকর্মণ্য বানানোর সাথে সাথে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মাথা ঘামানো শেখায়। যারফলে সংসারেও তৈরি হয় নানা ঝামেলা। কিন্তু কাজের মধ্যে থাকলে ছোটখাট বিষয় নিয়ে ঝামেলা বাঁধার সুযোগ থাকে না। আমি তখন থেকে মামণির মত হতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু মামণির মত অলরাউন্ডার হতে পারিনি। আমি হয়েছি সব কাজের অকাজী। মানে হচ্ছে সব কাজই টুকটাক শিখেছি এবং ঐ শেখা পর্যন্তই।

আপনি যা যা শিখেছেন আমাদেরকে সবকিছু শেখাতে হবে। ফাতিমা আর সাবিরা আবদারের সুরে বললো।

নূহা হেসে বলল, এই যে তোমরা সবাই এলোমেলো, অগোছালো, পাগল পাগল কথাবার্তা ও কাজকর্মের দ্বারা আমাকে এত জ্বালাও। তবুও তোমাদেকে এত ভালো লাগে কেন জানো?

কেন ম্যাম? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো ফাতিমা।

কারণ তোমরা সবসময় শেখার জন্য প্রস্তুত থাকো। কখনোই নিজের ঘাটতিগুলোর পেছনে কোন যুক্তি দেবার চেষ্টা করো না। কখনোই বলো না আমি পারবো না বা আগে কখনো করিনি। যখনই কোন দোষ দেখিয়ে দেয়া হয় তোমরা হাসি মুখে বলো, আসলেই ম্যাম আমাকে এটা থেকে বের হতে হবে। আগে কেউ ধরিয়ে দেয়নি তো আমাকে নয়তো কবেই নিজেকে শুধরে নিতাম ইনশাআল্লাহ। তোমাদের এমন স্বীকারোক্তি সত্যিই মুগ্ধ করে আমাকে, আলহামদুলিল্লাহ। জানো কাউকে যখন তার দোষ বা ঘাটতির ধরিয়ে দেয়া হয়। এবং জবাবে সে এমন কিছু বলে সত্যিই তখন নিজের সবটুকুন দিয়ে তাকে সাহায্য করতে ইচ্ছে করে। কারণ কোন কিছু না পারাটা মোটেই দোষের কিছু নয়। কিন্তু নিজের না পারা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা এবং সেটা রপ্ত করার চেষ্টা না করাটা মনেহয় অবশ্যই দোষের। আমি এটা পারবো না, আগে কখনো করিনি, আমার দ্বারা আর যাই কিছু সম্ভব হোক এটা সম্ভব হবে না। ইত্যাদি বলে মানুষ নিজেই নিজেকে দুর্বল করে রাখে। আমরা প্রায় সবাই বিভিন্ন বিষয় বা কাজকে ঘিরে এমনটা বলে থাকি। এমনটা বলার সময় ব্যক্তির বেশির ভাগ সময়ই খেয়ালই থাকে না যে, সে চেষ্টা না করেই কোন কিছু পারবে না সেটা জানিয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকটা চেষ্টা করতেই সে নারাজ এমন মনোভাবই প্রকাশ করে।

সাবিরা বলল, জ্বি ম্যাম। আমার ভেতর আগে এই প্রবণতাটা খুব ছিল। কোন কিছু করার চেষ্টা না করেই বলে দিতাম, আমার দ্বারা এটা করা সম্ভব নয়। আগে কোনদিনও এখন কিছু করিনি আমি। এখন আলহামদুলিল্লাহ অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি এই সমস্যাটা।

নূহা হাসি মুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। নিজের সাধ্যের মধ্যে থাকা কাজের ব্যাপারে মানুষের এমন মনোভাব সত্যিই খুব অবাক করে আমাকে! কোন কিছু না পারার মাঝে কি বিশেষ কোন মর্যাদা বা কৃতিত্ব আছে? তাহলে নিজের অযোগ্যতাকে নিয়ে মানুষ এত খুশি কিভাবে থাকে যে যোগ্য হবার চেষ্টা করতেও চায় না? এমনকি এই না চাওয়াটা যে দোষের সেটা পর্যন্ত মেনে নিতে রাজী থাকে না অনেকেই। উল্টো নানান যুক্তি দিয়ে মজবুত দলিল হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করে নিজের চেষ্টা না করার ইচ্ছেটাকে। এই যেমন, বেশ অনেকদিন আগে কিছু বোনের সাথে কথা হচ্ছিলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন খুব গর্ব করে বলছিলেন বিয়ের আগে কোনদিন রান্নাঘরে ঢুকে দেখেনি, এক গ্লাস পানি ঢেলে পান করেনি, নিজের রুম গোছায়নি ইত্যাদি। ভাবছিলাম এসব কি আসলেই এত গর্বের বিষয় যতটা গর্ব করে বলছে উনারা? তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছিলাম যখন এক এক করে বোনেরা সবাই কে কি করেনি, কে কি পারে না ইত্যাদি বলতে শুরু করেছিলেন মহা আনন্দিত হয়ে! না পারাটাই যখন আনন্দের খোঁড়াক হয়, গর্বের বিষয় হয় তখন কষ্ট করে মানুষ কোন কিছু শিখতেই বা যাবে কেন? কি এক অদ্ভুত মানসিক প্রতিবন্ধকতা! সেদিন মনে মনে আরেকবার শুকরিয়া আদায় করেছিলাম আল্লাহর আমাকে আমাদের আনন্দবাড়ির সদস্য করে দুনিয়াতে পাঠানোর জন্য। একদম ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি সাংসারিক সমস্ত কাজ আমাদেরকে শেখানো হয়েছে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও গুছিয়ে রাখার জন্য, বাগান দেখাশোনার জন্য, রান্নার জন্য, এমন প্রতিটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা একাধীক কাজের লোক ছিল আমাদের বাড়িতে। কিন্তু নিজের প্রতিটা কাজ আমাদেরকে নিজ হাতে করতে হতো। কাজের লোকদের দিয়ে কোন কাজ করানো কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল আমাদের জন্য ছোটবেলায়। ঐ সময় মাঝে মাঝে মন খারাপ হতো। কিন্তু এখন বুঝি কতটা কল্যাণময় ছিল বাবা, ভাইয়াদের সেই সিদ্ধান্ত। আলহামদুলিল্লাহ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব কাজই আমরা ভাইবোনেরা জানি এবং করতে পারি। আর আমাদের বাবা, ভাইয়ার পরিকল্পনাও এটাই ছিল। জীবন ধারণের স্বাভাবিক কাজগুলোর বেলাতে কখনোই যাতে আমাদেরকে বলতে না হয়, এই কাজটা তো আমরা কোনদিন করিনি। আমরা যাতে কোনদিন নিজের ঘাটতি নিয়ে গর্ব না করি। বরং যেন বুঝতে পারি নিত্য প্রয়োজনীয় ও দৈনন্দিন কোন কাজের জন্য পরনির্ভরশীল না হওয়াটাও জীবনের সার্থকতা।

ফাতিমা বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আমরাও এখন এভাবে চিন্তা করতে পারি ম্যাম। আমরাও এখন নিত্য প্রয়োজনীয় ও দৈনন্দিন প্রতিটা কাজ শিখতে আগ্রহী। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হবার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা এখন জানি যেহেতু মানুষ জন্ম থেকেই সবকিছু শিখে আসে না। তাই কোন কিছু না পারাটা লজ্জার নয় মোটেও। কিন্তু কোন কিছু শিখতে না চাওয়াটা অবশ্যই লজ্জার।

নূহা হেসে বলল, কোন কিছু শিখতে না চাওয়াটা অবশ্যই লজ্জার এই উপলব্ধিটা দরকার সর্বপ্রথম। আবার শিখতে গিয়ে সামান্য বাঁধা পেয়েই আমার দ্বারা এই কাজ সম্ভব নয়, এমন চিন্তার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া থেকে বেঁচে থাকাটাও জরুরি। আমি যখন প্রথম রান্না শিখতে শুরু করেছিলাম। তখন সবকিছু করতাম কিন্তু কাঁচামরিচ আর পিঁয়াজ কাটতাম না। কাঁচামরিচ ধরলেই আমরা হাত জ্বলতে শুরু করতো আর পিঁয়াজ কাটতে গেলে নাক-চোখ-মুখ লাল হয়ে, ফুলে একাকার হয় যেত। এমন সমস্যা দেখে মামণিও আমাকে কখনো পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ধরতে দিতেন না। কিন্তু ভাইয়া যেবার দেশে এসে এই তথ্য জেনেছিলাম। উনি আমাদের ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বনভোজনের আয়োজন করলেন। কে মসলা রেডি করবে, কে সবজি কাটবে। এভাবে সবাইকে কাজ ভাগ করে দিয়েছিলেন। আমার ভাগে ফেলেছিলেন সমস্ত রান্নার পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ কেটে দেয়া। নাক-চোখ দিয়ে পানি ঝরতে ঝরতে সর্দি হয়ে গিয়েছিল আমার সেদিন। আর হাত এমন ভাবে জ্বলছিল মনেহচ্ছিলো কেটে ফেলে দেয়াও এরচেয়ে শান্তির। উফফ, এখনো সেদিনের কথা মনে পড়লে উনার নিষ্ঠুরতার হতবাক হয়ে যাই। আবার ভীষণ হাসিও পায়। তবে সেদিনের পর থেকে পেঁয়াজ, মরিচ কাটার ব্যাপারে সমস্ত অনীহা দূর হয়ে গিয়েছিল। কারণ ভাইয়া বুঝিয়ে বলেছিলেন, আমার অভ্যাস নেই বলেই এমনটা হয়েছে। যদি অল্প অল্প করে অভ্যাস করে ফেলতাম তাহলে আজ এতটা কষ্ট হতো না। এবং চেষ্টা শুরু করার মাস খানেকের মধ্যেই আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মরিচ ধরা মাত্রই তখন আর হাত জ্বলতে শুরু করতো না। পেঁয়াজ কাটাটাও ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে গিয়েছিল।

ফাতিমা বলল, জাওয়াদ স্যারকে দেখলেই মনেহয় অনেক কঠোর একজন মানুষ। আমি গত দেড় বছরে যে কয়বারই স্যারকে দেখেছি, কখনোই হাসতে দেখিনি।

নূহা হেসে বলল, উনি কঠোর এতে কোনই সন্দেহ নেই। তবে উনার কঠোরতার পেছনে আমি সবসময় নিজের ও অন্যদের জন্য কল্ল্যাণকেই খুঁজে পেয়েছি। জানো উনার মতো এত আদর, এত ভালোবাসা পৃথিবীতে আর কারো কাছ থেকে আমি পাইনি। আমার বাবা-মামণির ভালোবাসাও উনার ভালোবাসাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কখনোই। কিন্তু চলার পথে যখনই আমি কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়ে হাল ছেড়ে দিতে চেয়েছি এবং কারো উৎসাহেও উঠে দাঁড়াতে চাইনি। তখন শাসন ও শাস্তি মোড়কে উনিই হাজির হয়েছেন ভিন্ন রূপে। এবং শুধু আমাকে উঠে দাঁড়াতেই বাধ্য করেননি, গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থাও করেছেন। আর ভালোবাসা তো এমনটাই হওয়া উচিত তাই না? যার আহ্লাদে থাকবে কল্ল্যাণকামীতা, শাসনেও। উনিই আমাকে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হবার আনন্দকে উপলব্ধি করিয়েছেন। আমার প্রয়োজনীয় সব কাজ চালিয়ে নেবার মতো যোগ্যতা আমার আছে। এটা যে ভীষণ রকম একটা অর্জন সেটা আমি উনাকে দেখে জেনেছি, শিখেছি, বুঝেছি এবং মেনে নিয়ে আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করেছি। মানুষ যখন গর্ব ভরে নিজে কিছুই করেনা, সব কাজ কাজের লোক দিয়ে করায় এমন বলেছে। আমি আনন্দিত ও সন্তুষ্ট চিত্তে বলেছি, আলহামদুলিল্লাহ আমার কাজের মেয়ে আমি নিজেই। নিজের কাজ নিজে করার মাঝে শান্তি, স্বস্থির সাথে সাথে স্বাধীনতাও বিদ্যমান। কারো জন্য থেমে থাকছে না নিজের কোন কাজ। কারো উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না কোনকিছুর জন্য। কারো কাছ থেকে কিছুই জানে না, বাবা-মা কিছুই শেখায়নি এমন সার্টিফিকেটও পেতে হয়না। সবচেয়ে বড় কথা জীবন এতে গতিশীল থাকছে।

সাবিরা বলল, বুঝতে পেরেছি ম্যাম। আজ থেকে ইনশাআল্লাহ নিজের সব কাজ নিজে করতে চেষ্টা করবো। যা যা পারিনা শেখার চেষ্টা করবো। অন্যের উপর নির্ভরশীল করবো না জীবনকে। ম্যাম আমরা চাই জাওয়াদ স্যার আপনাকে যেভাবে সবকিছু শিখিয়েছেন। অর্থাৎ, কখনো আদর করে, কখনো বা শাসন করে। কখনো ভালোবাসা দিয়ে, কখনো নিষ্ঠুরতা দিয়ে। আপনিও আমাদেরকে সেভাবে সবকিছু শেখাবেন। আমরা স্বাবলম্বী, স্বনির্ভর ও স্বাধীন একটা জীবন চাই। ব্যস্ত থাকতে চাই এবং ব্যস্ততাকে উপভোগ করতে চাই। কোন কাজ করি না এমনটা বলে নির্লজ্জ অহংকার করতে চাই না। কৃতজ্ঞ ও আনন্দ চিত্তে বলতে চাই, আমিই আমার কাজের মেয়ে। প্রমিস করেন আপনি আমাদেরকে সবকিছু শেখাবেন?

নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই শেখাবো তোমাদেরকে। অন্তত হাতের কাজ তো অবশ্যই শেখাবো তোমাদেরকে। কেন জানো? তাহলে আর মনের ছিঁড়া অংশ গুলোতে এমব্রয়ডারি করানোর জন্য অন্যের কাছে যেতে হবে না। সুঁই আর সুতোর বুননে মনের মধুরী মিশিয়ে নিজেই ফুটিয়ে তুলবে ছোট ছোট নকশি কাঁথা। মনের ফেটে যাওয়া অংশগুলোতে কুসিকাঁটার ছোঁয়ায় লাগিয়ে দিতে পারবে সুন্দর সুন্দর লেস।

সাবিরা হেসে বলল, আপনার কথা শুনলে সত্যি মন অন্যরকম হয়ে যায় ম্যাম। আপনি আমাদের সাথে থাকলে আমরা অবশ্যই এমনটা পারবো, ইনশাআল্লাহ।

সাবিরা পৃথিবীতে কোন মানুষকে আমরা সবসময় সাথে পাবো এর কোন নিশ্চয়তা নেই। যে কোন মুহুর্তে আসা যে কোন ঝড়ে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে পারে সেই প্রিয় মানুষটা, যাকে আমরা নিজের অবলম্বন মনে করে স্বর্বস্ব দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিলাম। তাই আমাদেকে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হবে সবসময় ও সর্বাবস্থায়। কারণ পৃথিবীর একটি মানুষও যখন আমাদের কাছে থাকবে না, তখনও আল্লাহ আমাদের সাথে থাকবেন। আর আল্লাহর পর নিজের উপর ভরসা করতে হবে। কারণ যেই পর্যন্ত ব্যক্তি নিজে জাগতে না চায় শত প্রেরণার বাণীও তাকে জাগাতে পারে না।

এরআগে আমাদেরকে কেউ এভাবে চিন্তা করতে শেখায়নি কখনো ম্যাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ফাতিমা।

দেখো দুনিয়াতে সবাই নিয়ম মাফিক শিখে বড় হয় না। বেশির ভাগ মানুষই প্রয়োজনে শিখে, কেউ বা ঠেকে শিখে। বাবা-মা কিংবা পরিবারের সদস্যদেরকে দোষারোপ করা তাই ঠিক না। তারা নিজেরাই হয়তো জানতেন না তাই শেখাতে পারেননি। তোমাদেরকে আল্লাহ এখন জানার সুযোগ করে দিয়েছেন। সুতরাং, এটাকে কাজে লাগাও। যতটুকু সম্ভব গড়ে তোল নিজেদেরকে। তাতে অন্তত শুদ্ধ একটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। বীজ থেকে চারা বের হয়ে ফুল-ফল দিতে কিন্তু অনেক সময় লেগে যায়। আমরা আজ যে স্বপ্নের বীজ বুনবো তার ফুল-ফল দেখে না যাবার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু সেজন্য যদি আমরা স্বপ্নের বীজগুলোকে মুঠোর মধ্যেই রেখে দেই তাহলে ভুবন বাগিচা কিন্তু শূন্য পড়ে থাকবে না। অন্য কেউ তাতে বুনে দেবে দুঃস্বপ্নের বীজ। আর এরজন্য আমরাই দায়ী থাকবো।

আমাদেরকে তাহলে এখন কি করতে হবে ম্যাম? প্রশ্ন করলো সাবিরা।

সেটা তো আগেই বলেছি। নিজেকে জানতে হবে। তোমাদের নিজ নিজ জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জানতে হবে, গন্তব্য কোথায় সেটা জানতে হবে। আমি জানি মানুষের মনে মাঝে মাঝে এমন ঝড় বয়ে যায়, তা যদি প্রকৃতি দেখতো স্তম্ভিত হয়ে যেত। বন্যা, ঘুর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস হয় মনের মাঝেও। সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তছনছ হয়ে যায় মনের বাগিচা, ঝরে যায় সব ফুল, প্রজাপতিরা ভুলে যায় ডানা মেলতে, ভ্রমর করে না গুঞ্জন, আকাশ জোড়া থাকে না রংধনু। কিন্তু আমরা যদি জানি যে এইসবই আমাদের জন্য পরীক্ষা তাহলে এই কঠিন সময়গুলো পার হওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। দেখো সমস্যা কার জীবনে নেই বলো? বিভিন্ন ক্লাসের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যেমন বিভিন্ন রকম, প্রতিজন মানুষেও প্রশ্নপত্রও তেমন আলাদা আলাদা। কিন্তু আমরা সবাই প্রতিমুহুর্তে দিয়ে যাচ্ছি নিজ নিজ পরীক্ষা। আমার ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো করার জন্য কত কিছু করো তোমরা ভেবে দেখো তো! আমার সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখো, আমার দেয়া নোটস মনযোগ দিয়ে পড়ো, আমার বকাঝকা হাসিমুখে মেনে নাও। আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করার জন্য কি এসব করো? আলাহর সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম নামাজ। কতটুকু মনযোগী তোমরা নামাজে? নোট আকারে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া আছে কুরআনে। কিভাবে উত্তর লিখতে হবে সেটাও দেখিয়ে দেয়া হয়েছে হাদীসে। তারপরও কেন জীবনকে ঘিরে এত অভিযোগ বলতে পারবে?

ফাতিমা বলল, আমরা সত্যিই অনেক অকৃতজ্ঞ ম্যাম।

হ্যা আমরা অনেক অকৃতজ্ঞ। কারণ আমরা জানিই না কত নেয়ামত ঘিরে আছে আমাদেরকে। আর এটা জানার জন্যই তো নিজেকে জানা দরকার। নিজের মাঝে ডুব দিয়ে খুঁজে দেখা দরকার প্রাপ্তি সমূহকে। আসলে মানুষের মধ্যে যদি চৈতন্যবোধ সৃষ্টি না হয় তাহলে সে আত্মত্রুটি নির্ণয় করে তা বর্জন করতে পারে না। আর একমাত্র জ্ঞানই সৃষ্টি করতে পারে চৈতন্যবোধ। আত্মশুদ্ধির জন্য তাই জ্ঞানার্জনের কোন বিকল্প নেই। এজন্যই হয়তো বান্দার উদ্দেশ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রথম শব্দ ছিল, ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়। আসলে একমাত্র জ্ঞানের আলোতেই উন্মোচিত হয় জীবনের প্রসারিত দুয়ার। জ্ঞানই দূর করে মনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সমস্ত অকৃতজ্ঞতা, অজ্ঞতার আঁধার। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, জ্ঞান যদি ভিত্তিহীন ও অপ্রতুল হয় তাহলে কিন্তু আমাদের চলার পথ নির্ভুল হবে না। তাই অর্জিত জ্ঞানকে অবশ্যই শরীয়তের আলোকে যাচাই করে নিতে হবে।

ফাতিমা ও সাবিরা একসাথে বলল, আমরা বুঝতে পেরেছি ম্যাম।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ বুঝতে পারলে তো খুবই ভালো। আচ্ছা এখন চলো খেতে যাই আমরা। বাকি গল্প খাওয়ার পর হবে ইনশাআল্লাহ।

ফাতিমা ও সাবিরা হাসি মুখে বলল, জ্বি ম্যাম চলুন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন