সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...১৭



মেয়েটির চোখের দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে! কথা বলার ভঙ্গী এবং আচরণের মাঝেও! ঠিক কি সেটা সম্পূর্ণ রূপে বুঝে উঠতে না পারলেও বেশ অস্বস্থি বোধ করে জাওয়াদ মুনাকে দেখলেই। বেশ কয়েকদিন থেকেই লক্ষ্য করছে নূহাকে নিয়ে যখনই ঘুরতে বের হচ্ছে কোত্থেকে যেন হাজির হয়ে যাচ্ছে মুনা। সারাক্ষণ একা একা থাকতে হচ্ছে না নূহাকে ভেবে প্রথম দিকে বেশ ভালোই লাগতো মুনার সাথে বন্ধুত্বের কথা শুনে। কিন্তু যখন থেকে মুনা হুটহাট বাসায় চলে আসতে শুরু করলো, নূহা আর জাওয়াদের পার্সোনাল সময়ের মধ্যেও ভাগ বসানো শুরু করলো। কিছুটা বিরক্তি এসে ভিড় করেছিল জাওয়াদের মনে। এক ছুটির দিনে হঠাৎ একটা জিনিস কেনার জন্য নূহা সুপার মার্কেটে যাবার পরপরই মুনার হাজির হয়ে যাওয়া। নূহা বাসায় নেই বলার পরও জাওয়াদকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়া এবং গল্প করার চেষ্টা করার পর থেকে মুনার উপস্থিতি কেমন যেন অস্বস্তিকর লাগতে শুরু করেছে। শরীয়তের অনুশাসনের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক জাওয়াদ। প্রয়োজন ছাড়া নন মাহরাম মেয়েদের সাথে কথা বলা কর্মক্ষেত্রেও যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। আবার তার ব্যক্তিত্বের অতিরিক্ত গাম্ভীর্যতার কারণে মেয়েরাও কখনোই খুব একটা ফ্রেন্ডলি হবার চেষ্টা করেনা। কিন্তু মুনা সেইসব মেয়েদের থেকে একদম আলাদা। বেশ ভালোই গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে। কথা বলতে না চাইলেও নানান বাহানায় কথা বলার চেষ্টা করে।

আচ্ছা নূহা কি মুনার এই ব্যাপারগুলো খেয়াল করেছে? খেয়াল করলে এখনো এত প্রশ্রয় দিচ্ছে কেন? যদিও মুনা সরাসরি এখনো তেমন কোন কথা বা আচরণ করেনি। কিন্তু নিজের সাথে সাথে নূহাকেও সতর্ক করে দেয়া উচিত অনুভব করলো জাওয়াদ। যেখানে পতনের ভয় সেখান থেকে দূরে থাকাটাই পছন্দ করেছে সে সবসময়। নূহার দিকে তাকালো। পার্কে এলে দুনিয়ার সবকিছু ভুলে বাচ্চাদের পেছন পেছন নিজেও বাচ্চা হয়ে ছুটে বেড়ায় নূহা। এক মাসেই সে সাত-আট জন ক্ষুদে বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছে। এখনো বাচ্চাদের নিয়ে গোল হয়ে বসে সবাইকে কবিতা শেখাচ্ছে। মুনা কিছুক্ষণ পাশে বসে ছিল। এরপর উঠে এসে জাওয়াদ যেখানে বসেছে এর আশপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরাসরি না তাকিয়েও বুঝতে পারছে জাওয়াদ মুনা তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। বই বন্ধ করে উঠে দাড়াঁলো জাওয়াদ। ধীর পায়ে নূহার দিকে এগিয়ে গেলো। জাওয়াদকে আসতে দেখে হাসি মুখে তাকালো নূহা। মূহুর্তেই মনের অস্বস্থি ভাবটা কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো জাওয়াদের। তার বদলে মুগ্ধতা ছোঁয়া হাসি ফুটে উঠলো তার চেহারাতেও। এই মেয়েটি কি বোঝে কতটা ভালোবাসে তাকে সে ? জাওয়াদের কেন জানি বেশির ভাগ সময়ই মনেহয় নূহা তার মনের ভালোবাসার গভীরতাকে উপলব্ধি করতে পারে না সঠিক মাত্রায়। আবার কখনো মনেহয় নূহা হয়তো মনের ভাব একটু কমই প্রকাশ করতে পছন্দ করে। পাশে দাঁড়িয়ে আলতো করে নূহার মাথায় হাত রেখে জাওয়াদ বলল, তুমি থাকো সবার সাথে। আমি লাইব্রেরী থেকে ঘুরে আসি। একটা বই আনতে হবে।

আমি আসবো সাথে?

না তুমি থাকো। সময় কাটাও বাচ্চাদের সাথে। আমি লাইব্রেরী থেকে সরাসরি বাসায় চলে যাব ইনশাআল্লাহ। তুমি সন্ধ্যার আগেই চলে এসো।

কিন্তু আমাদের তো আজ একসাথে সূর্যাস্ত দেখতে যাবার কথা ছিল লেক সাইটে।

আজ থাক! অন্য আরেকদিন সূর্যাস্ত দেখতে যাবো ইনশাআল্লাহ।

নূহা হেসে বলল, ওকে ইনশাআল্লাহ। হাসি মুখে জাওয়াদকে বিদায় দিলেও একটুক্ষণ পরই চারপাশের সবকিছু কেমন যেন শূন্যতা ঘেরা, ফ্যাঁকাসে মনেহতে লাগলো নূহার কাছে। কিন্তু হুট করে চলে যাবার কথা বললে বাচ্চারা সবাই মন খারাপ করবে। তাই খেলা শেষ করে সবাইকে নিজ নিজ বাসায় পৌঁছে দিয়ে বাসায় দিয়ে পা বাড়ালো নূহা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আদার মিষ্টি ঝাঁঝালো ঘ্রাণ এসে নাকে লাগলো। লাইব্রেরী থেকে ফিরে এসে নিশ্চয়ই চা বসিয়েছেন জাওয়াদ। ডক্টর সাহেব বৌকে সাহায্য করতে খুব পছন্দ করেন সেটা এতদিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে নূহার। কিন্তু সেটা আবার বৌকে বুঝতে দিতে উনি নারাজ। নূহা শুকরিয়া আদায় স্বরুপ কিছু বলতে গেলে অবাক হওয়ার ভঙ্গী করে জাওয়াদ বলে, তোমাকে কোথায় সাহায্য করলাম? আমি রান্না করতে পছন্দ করি তাই রান্না করেছি। তাছাড়া সংসার যেমন তোমার একার না, রান্নাঘরও একার না। তোমাকে রান্না করতে দেখলে কি আমি খুশিতে গদগদ হই? হই না কারণ এটাই স্বাভাবিক। তেমনি সময় পেলে এবং ইচ্ছে হলে আমি রান্না করবো এটাও স্বাভাবিক। তবে হ্যা এই ব্যাপারে তুমি কোন এক্সপেক্টটেশন রাখতে পারবে না আমার উপর। এটি একশো ভাগ আমার ইচ্ছাধীন একটি ব্যাপার। জাওয়াদের সরাসরি কথা বলার স্বভাবটা বিয়ের পরপর কিছুদিন কষ্ট দিলেও এখন ভীষণ ভালো লাগে নূহার। সেও চেষ্টা করে মনে কথা চেপে না রেখে বলে দিতে। এবং যে কোন কাজ বা আচরণের পেছনের কারণকে স্পষ্ট করে দিতে। এতে অকারণ চাহিদা তৈরি ও ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ অনেক কমে যায় সম্পর্কের মাঝে।

পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো নূহা। জাওয়াদকে চমকে দেবার দুষ্টু বুদ্ধি চেপেছে মাথায়। কিন্তু রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে নিজেই চমকে উঠলো। জাওয়াদ নেই ভেতরে! তাহলে কোথায় জাওয়াদ ? ভাবতে ভাবতে ঘুরে দাড়িঁয়ে সামনে একদম সামনেই জাওয়াদকে দেখে আবারো চমকে উঠলো নূহা।

জাওয়াদ অবাক কন্ঠে বলল, আরে এই মেয়ে এমন লাফিয়ে উঠলো কেন?

নূহা স্বস্থির শ্বাস ছেড়ে বলল, তোমাকে হঠাৎ দেখে চমকে গিয়েছিলাম।

জাওয়াদ বেশ সিরিয়াস কন্ঠে বলল, তোমার আসলে কোন দোষ নেই বুঝলে। তোমার হাজবেন্ড মাশাআল্লাহ চমকে দেয়ার মতই হ্যান্ডসাম এন্ড অ্যাডোরেব্যল। নূহা হেসে ফেলে জাওয়াদের বুকে মুখ গুঁজলো। জাওয়াদও হেসে নূহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিন্তু আপনি নিজের ঘরে কেন উঁকি ঝুঁকি করছিলেন সেই কারণটা কি জানতে পারি?

নূহা হেসে বলল, তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকে তোমাকে না দেখে নিজেই চমকে গিয়েছিলাম।

এখানে চমকে যাবার কি আছে বোকা বালিকা? রান্নাঘরে ছিলাম না তারমানে বাসার অন্য কোথাও আছি।

প্রিয় কাউকে আমরা যেখানে প্রত্যাশা করি সেখানে না পেলে কি অদ্ভুত অনুভূতি হয় তাই না? মাত্র এক মূহুর্তে মনের প্রবাহমান আনন্দের কোলাহল রূপান্তরিত হয়ে যায় হাহাকার জাগানো শূন্যতায়! কথাটা বলতে গিয়ে ছলছল হয়ে উঠলো নূহা।

নূহার কন্ঠের আবেগে জাওয়াদের বুকের ভেতরটাও কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। মায়া জড়ানো কন্ঠে বলল, তোমার কি এমন হাহাকার জাগানো শূন্যতার অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল কিছুক্ষণ আগে? আলতো করে চোখের কোণে এসে জড়ো হওয়া অশ্রু মুছে নিয়ে আরেকটু শক্ত করে জাওয়াদের বুকের মাঝে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো নূহা।

বেশ অবাক কন্ঠে জাওয়াদ বলল, আশ্চর্য তুমি কান্না করছে কেন? কান্না করার মত কি ঘটলো এখানে? জাওয়াদের প্রশ্ন শুনে নূহার আবেগের সাগরে হঠাৎ যেন উত্তাল ঝড় উঠে গেলো। ছলকে ছলকে বাইরে বেড়িয়ে এলো নোনা পানির ঢেউ। গতিরোধ করার চেষ্টা করলো না নূহা ঢেউয়ের। শুধু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, কথা বলবে না তুমি এখন আমার সাথে। একদম কথা বলবে না। খবরদার বলছি!
এই প্রথম নূহাকে কান্না করতে দেখে কষ্টের বদলে ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো জাওয়াদের। কি অদ্ভুত মেয়েদের সাইকোলজি। কিসে যে হাসবে আর কিসে যে কাঁদবে বোঝা মুশকিল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে নূহাকে সামলে নেবার সময় দিয়ে বলল, রিকোয়েস্ট না অর্ডার?

নূহা বলল, কি রিকোয়েস্ট না অর্ডার?

ঐ যে বললে, কথা বলবে তুমি এখন আমার সাথে। একদম কথা বলবে না। খবরদার বলছি!জানতে চাইছি এটা কি রিকোয়েস্ট না অর্ডার?

হেসে ফেললো নূহা। জাওয়াদকে ঠেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, দূর হয়ে যাও তুমি।

যতখানিক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল তারচেয়েও অনেক খানিক কাছে নূহাকে টেনে নিয়ে জাওয়াদ বলল, ‘দূর হয়ে যাও তুমিএটা কি রিকোয়েস্ট না অর্ডার? হেসে ফেললো তখন দুজনই একসাথে।

জীবন গল্পের দু'একটি অধ্যায় একটু বেশির চমকপ্রদ হয়! সেই সব অধায়ের প্রতিটি বর্ণ থাকে আলোকোজ্জ্বল! দ্যুতি ছড়ায় প্রতিটি শব্দ, গুঞ্জন তোলে প্রতি লাইন! বিচ্ছুরিত হয় প্রতিটি পৃষ্ঠা! জাওয়াদ আর নূহাও তাদের জীবনের এমনি একটি অধ্যায়ের রচনা করে চলছিল প্রতি মুহূর্তে। স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছিল জীবনে আগত প্রতিটি ক্ষণ। অবশ্য মাঝে মাঝে যে দুএকদিন সূর্য একটু আধটু তেঁতে উঠতো না জীবনের এমনটাও আবার নয়।

প্রতিদিনই হসপিটাল থেকে ফেরার পথে বাসার কাছাকাছি পৌছে গাড়ি থেকেই জাওয়াদ দেখতে পেতো উন্মুখ হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছে নূহা। গাড়ি যতই বাসার দিকে এগোতে থাকে নূহার আনন্দে উদ্ভাসিত চেহারা একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকে জাওয়াদের চোখে। প্রতিটা দিনই কিছু স্পেশাল মূহুর্ত নিয়ে আসে জীবনে। এই মূহুর্তটি তেমনই স্পেশাল মূহুর্তগুলোর একটি ছিল জাওয়াদের জন্য। ডিউটি শেষ করে যখন গাড়িতে বসার পর যখন মনে পড়ে তার প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে বসে আছে কেউ। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার সমস্ত ক্লান্তি সুখানুভূতির মিষ্টি হিমেল হাওয়ার পরশে কর্পূরের মত উড়ে যেতে শুরু করে। ভালোবাসা ভরা মন নিয়ে বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করছে এটা অনেক বড় একটি প্রাপ্তি যে কোন মানুষের জন্য। নিত্যদিনের প্রাপ্তিগুলো বেশি দিন তার প্রাপ্য সম্মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় বেশির ভাগ সময়ই। এ আর নতুন কি ভেবে মানুষ একসময় সেটাকে নোটিশ তো দূরে থাক ইগনোর করতে পর্যন্ত ভুলে যায়। এই ব্যাপারে তাই সতর্ক থাকতে চেষ্টা করে জাওয়াদ। নূহার পথ চেয়ে বসে থাকাটা যে তাকেও খুব আনন্দাপ্লুত করে কথা ও আচরণে সেটার প্রকাশ ঘটাতে কখনোই ভুল যায় না। সেও চেষ্টা করে প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে অন্তত ছোটছাট চমক সাথে করে নিয়ে আসতে নূহার জন্য। একগুচ্ছ ফুল, পছন্দের ফ্লেভারের আইসক্রিম, নতুন কোন বই এমন ছোট্ট ছোট্ট উপহার পেলেই উচ্ছল আনন্দে মেতে ওঠে নূহা। এত অল্পে যারা আন্তরিক খুশি হয়, তাদেরকে খুশি দিতে কখনোই কার্পন্য করা উচিত না।
বেশ কয়েকদিন থেকে একটা বইয়ের কথা বলছিল নূহা। লাইব্রেরীতে কয়েকবার গিয়েও বইটি পায়নি। আজ হঠাৎ এক ফ্রেন্ডের কাছে বইটি দেখে এক প্রকার ছিনিয়েই নিয়ে এসেছে জাওয়াদ। বইটি দেখে নূহা আনন্দের কথা ভেবে নিজেরও আনন্দ লাগছিল। কিন্তু মোড়ের কাছে পৌঁছে দূর থেকেই বুঝতে পারলো নূহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নেই। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা কাঁপন টের পেলো। সবকিছু ঠিকআছে তো বাসায়? কেননা অসুস্থ থাকলেও বারান্দার চেয়ার বসে তার প্রতীক্ষা করে নূহা। বাসার কাছে পৌছানোর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত বার বার শুধু মনেহচ্ছিলো এই বুঝি রুম থেকে বারান্দায় বেড়িয়ে আসবে নূহা। গাড়ি গ্যারেজে না ঢুকিয়েই দরজার দিকে ছুটলো জাওয়াদ। কিন্তু দরজার কাছে যেতেই ভেতর থেকে ভেসে আসা সম্মিলিত হাসির শব্দ শুনতে পেলো। নূহার তাহলে কিছু হয়নি বুঝতে পেরে মনে স্বস্থি ফিরে পেলো। বাসায় নিশ্চয়ই মেহমান এসেছে। দেড়মাসেই বেশ কয়েকজনের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে নূহার। ফিরে এসে গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়ে বললো, তোমার ফ্রেন্ডদের নিয়ে কিছুক্ষণে জন্য ড্রইংরুম থেকে অন্য কোথাও গিয়ে বোস। আমি বেডরুমে যাবার পর আবার কন্টিনিউ করো তোমরা। কিন্তু সবার সাথে গল্পে এতই মশগুল ছিল নূহা তিনবার একই ম্যাসেজ পাঠানোর দশ মিনিট পেড়িয়ে গেলেও কোন রিপ্লাই দিলো না। যথেষ্ট কর্মব্যস্ত একটি দিন গিয়েছে জাওয়াদের। ক্লান্ত ছিল বেশ শরীর। ক্লান্তিবোধের কারণেই বিরক্তি খুব দ্রুতই খোলস পালটে রাগে বদলে গেলো। যেহেতু বহিঃপ্রকাশের সুযোগ নেই তাই রাগ নিয়েই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

আরো মিনিট পাঁচেক পর নূহাকে ছুটে আসতে দেখা গেলো। সালাম দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি খুব সরি। খেয়াল করিনি তোমার ম্যাসেজ। সবাইকে লাইব্রেরীতে বসিয়ে এসেছি তুমি ভেতরে চলো। সালামের জবাব দিয়ে আর একটি কথাও না বলে চুপচাপ ভেতরে চলে গেলো জাওয়াদ। সাথে সাথে মনটা খারাপ হয়ে গেলো নূহার। সেতো ইচ্ছে করে এমনটি করেনি। তাহলে এমন রাগ দেখালো কেন জাওয়াদ? অভিমানের মেঘ ঘনীভূত হবার আগেই নিজেকে সামলে নিলো নূহা। ভুল তো আসলে তারও হয়েছে। খেয়াল রাখা উচিত ছিল জাওয়াদের আসার সময় হয়ে গিয়েছে। ফোন করে আগেই জানানো উচিত ছিল বাসায় কিছু ফ্রেন্ড এসেছে। কিন্তু গল্পে এতই মশগুল হয়ে উঠেছিল সবার সাথে কোনকিছুরই খেয়াল ছিল না। নানান ধরণের দুনিয়াবী গল্পগুজবের আড্ডা ছিল বলেই কি এমন নিজের দায়িত্ব পালন করতে ভুলে গিয়েছিল? মামণীকে প্রায়ই বলতে শুনেছে দুনিয়াবী রসাত্মক আলোচনার ইন্ধন যোগায় শয়তান। সুতরাং, সেই আসরে বসে মানুষ উত্তম কাজ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবে এটাই স্বাভাবিক। লজ্জা ও অপরাধবোধের একটা মিশ্র স্রোত বইতে শুরু করলো মনে। মনে প্রাণে চাইছিল প্রতিবেশিনীরা সবাই এখন চলে যাক। কারো স্বামী বাসায় এলে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবাইকে আগের মতই গল্প চালিয়ে যেতে দেখে বেশ অস্বস্থিতে পড়ে গেলো নূহা। কাউকেই সরাসরি চলে যাবার কথা বলতে পারছিল না। আবার জাওয়াদকে একা বসিয়ে রেখে গল্পেও মন বসাতে পারছিল না। এই কথা সেই কথা করে শেষ পর্যন্ত আরো প্রায় চল্লিশ মিনিট পর সবাই উঠলেন। সবাইকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করতেই বুকের ভেতর ভারী কিছুর অস্তিত্ব টের পেলো নূহা। শুধু লজ্জা আর অপরাধবোধই নয় সাথে সাথে মনের ভেতর কেমন যেন একটা ভয় ভয় আবহ ছেয়ে গিয়েছে।

বেডরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও দোদুল্যমনতায় ভুগতে লাগলো। এই সময় জাওয়াদকে রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে দেখে আরো সঙ্কুচিত হয়ে গেলো। নূহার দিকে তাকিয়ে ওর মনের অবস্থা আঁচ করতে মোটেই কষ্ট হলো না জাওয়াদের। মায়ার দখিনা হাওয়া উড়িয়ে নিতে যেতে চাইলো জাওয়াদের মনে জেঁকে বসা রাগের মেঘ। কিন্তু জানে যে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান। তাই যা বলার এখনই বলতে হবে নূহাকে। লজ্জা ও অপরাধবোধের আঁধার কেটে গেলে ঘটনাটিও ঘনত্ব হারাবে। অনেক সুখী ও সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন দেখে তারা। ছোট বলে এমন সব ঘটনা এড়িয়ে যেতে যেতেই একসময় সম্পর্কের মাঝে ফাঁক তৈরি হতে শুরু করে। আর ফাঁক তৈরি হওয়া মানেই সম্পর্ক গতি হারানো। এমন কোন সুযোগ দিতে নারাজ জাওয়াদ। যতই ব্যথিত আর অনুতপ্ত হোক না কেন যা বলার এখনই বলতে হবে। নূহার দিকে না তাকিয়েই ক্ষুধা লেগেছে খেতে দাও বলে ডাইনিং হলের দিকে পা বাড়ালো। খাবার টেবিলে বসে জাওয়াদ আর নূহা সারাদিনে তাদের জীবনে ঘটমান ছোট থেকে ছোট বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে খেতে খেতে। দুজনের কাছেই এই সময়টা খুব পছন্দের। একে অন্যের অবর্তমানে কে কি করেছে শেয়ার করে সেই সময়গুলোকেও যুগলবন্দী বানিয়ে দেবার চেষ্টা করে দুজন মিলে। তবে তাদের আলোচনাতে পরিবারের সদস্যদের কথা থাকলেও কখনোই বাইরের মানুষ নিয়ে কোন কথা থাকে না। স্বামী-স্ত্রীর কথাবার্তার মধ্যে মানুষের কথার পরিমাণ বেশি থাকলে দাম্পত্যে বাইরের মানুষের প্রভাব পড়তে শুরু করে। এমনটা চায় না বলেই জাওয়াদ আর নূহা তাদের ব্যক্তিগত সময়গুলোকে এমন মানুষের স্মরণ থেকে বিরত রাখে যাদের কথা বলা আর না বলার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য থাকে না।

বেশ অনেকক্ষণ খাবার টেবিলে চামচের শব্দ ছাড়া আর কোন ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যাচ্ছিলো না জাওয়াদ আর নূহার ছোট্ট সুখের নীড়ে। কোন কথা না বলে নীরবে খেয়ে যাচ্ছিলো জাওয়াদ। অনেকক্ষণ নীরব থেকে নূহা বলল, আমার ভুলটি কি খুব বেশি বড়? তুমিই তো সবসময় বলো কাউকে আত্মপক্ষসমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কখনোই অপরাধী ভাবা ঠিক নয়।

ঠিকআছে তোমাকে আত্মপক্ষসমর্থনের সুযোগ দেয়া হলো।

জাওয়াদের মুখ থেকে বের হওয়া এইটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল নূহার মুখের দুয়ারে এসে আঁটকে থাকা শব্দদের বাঁধ ভেঙে দেবার জন্য। হড়বড় করে বলতে শুরু করলো। উনারা আমাকে বলে আসেননি। পাশের বাড়ির একটি পার্টিতে এসেছিলে যাবার সময় দেখা করতে এসেছিলেন আমার সাথে। তুমি বাসায় ছিলে না তাই উনারা গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন। হ্যা মানছি আমার ভুল হয়েছে। আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল। তোমাকে ম্যাসেজ করে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আর ভুল তো হতেই পারে তাই না?

জাওয়াড মাথা ঝাঁকিয়ে বেশ জোরের সাথে বলল, অবশ্যই হতে পারে।

তাহলে তুমি এমন করছো কেন আমার সাথে?

যাতে তুমি ভুলকে অনুধাবন করতে পারো যথাযথ সেজন্য। নূহা অবাক চোখে তাকালে জাওয়াদ হেসে বলল, ফিশ কাটলেট অনেক টেষ্টি হয়েছে। জাযাকিল্লাহ।

নূহা মুখ ভার করে অভিমানী গলায় বলল, তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছো? কেন?

জাওয়াদ হেসে বলল, জীবনে চলতে গিয়ে জেনেছি দুনিয়াতে সব কাজ করারই নিজস্ব কিছু টেকনিক আছে। সেই টেকনিক খাঁটিয়ে কাজ করলে অতি অল্প সময়ে অনেক বেশি লাভবান হওয়া যায়। সেটা বিনা টেকনিক প্রয়োগ ছাড়া সম্ভব হয় না। ঠিক তেমনি নির্ঝঞ্ঝাট দাম্পত্যেরও কিছু টেকনিক আছে। আমার কি মনেহয় জানো? সবসময় যে সমস্যার সমাধানের জন্য দুজন মিলে একসাথে বসে কথা বলতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই। সঠিক সময়ে চুপ থাকতে পারাটাও অনেক সময় সমস্যার সমাধানের পথকে সুগম করে দেয়। প্রচন্ড রেগে ছিলাম আমি। তখন কথা বলতে গেলে কষ্ট দিয়ে কিছু বলে ফেলাটা স্বাভাবিক ছিল। তুমিও তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করতে। অকারণে যুক্তি-তর্ক বেঁধে যেতে পারতো আমাদের মাঝে। কিন্তু নিশ্চুপ থাকার কারণে আমরা দুজনই বিষয়টা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট সময় পেয়েছি। একে অন্যের অবস্থানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে দেখেছি। আমি তখন তোমার অসহায় অবস্থাটা অনুধাবন করতে পেরেছি। তুমি খুঁজে পেয়েছো আমার রাগের পেছনের যৌক্তিকতা। এখন বলো বোঝাতে কি পেরেছি আমার জীবনসঙ্গিনীকে টেকনিকের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা?

নূহা হেসে বলল, ইয়েস স্যার। জাযাকাল্লাহ। পায়েশ দেই আপনাকে?

হুম মিষ্টি মুখ করা যায় এখন। কিন্তু পায়েশ রান্না করতে গিয়েছো কেন আবার শুধু শুধু? তোমাকে তো বলেছি রান্নাবান্নার পেছনে সময় যতটা না দিলেই নয় সেটুকুর বেশি দেয়ার দরকার নেই। সামনে তোমার এগজাম। পড়াশোনায় মন দাও।

পায়েশ আমি রান্না করিনি। মুনা দিয়ে গিয়েছে। নিজ হাতে নাকি রান্না করেছে।


মুনা নামটি শোনার সাথে সাথে পায়েশ মুখে দেবার রুচি নষ্ট হয়ে গেলো জাওয়াদের। বলি বলি করেও নূহার সাথে কথা বলা হয়ে উঠছে না মুনার ব্যাপারে। মেয়েটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আজ খুব সিলি একটা বাহানা নিয়ে হসপিটালে গিয়ে হাজির হয়েছিল। নূহার সাথে কথা বলাটা জরুরি হয়ে উঠেছে। নিজের জীবনের সুখ-শান্তি খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে জাওয়াদের কাছে। মুনার মত কোন থার্ড পারসনকে কোন ভাবেই তাদের জীবনে প্রবেশের সুযোগ দেয়া যাবে না। মনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেললো জাওয়াদ। ইনশাআল্লাহ আজই সে কথা বলবে নূহার সাথে এই ব্যাপারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন