ডাইনিং টেবিলে এসে নাস্তার সমস্ত আইটেমে চোখ বুলিয়ে খাবো নাআআআ বলে বিরাট
চিৎকার করে ছুট দিয়েছিল জারিফ। জিহাদ, জিশান, নাবিহা তিনজনই চেয়ার টেনে বসে পড়েছিল ততক্ষণে। কিন্তু ছোট ভাইকে দৌড়ে
পালাতে দেখে তিনজনও উঠে পিছন পিছন ছুট লাগালো। চারজনকে এমন দৌড়ে পালাতে পিছু
নিয়েছিলেন মিসেস নুসরাত। এক ছুটে বাগানে যেয়ে নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিল জারিফ।
জিহাদ পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এমন কেন
করলে ভাইয়া?
জারিফ জবাব দিলো, আমি খাবো না।
দেখতে একটুও সুন্দর হয়নি খাবার।
নাবিহা এগিয়ে গিয়ে জারিফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এভাবে বলতে হয় না ভাইয়া। বড় মানা ভাই শুনলে কষ্ট পাবে তো। মানা ভাই কত কষ্ট
করে সকাল থেকে আমাদের জন্য নাস্তা বানিয়েছেন। ভালো না লাগলেও একটু করে খাওয়া উচিত
আমাদের। যাতে মানা ভাই খুশি হন। মনে নেই তোমার পাপা আমাদেরকে কি বলেছিলেন?
পাপা কি বলেছিলেন আপ্পি? আমি ভুলে গিয়েছি।
জিশান হেসে বলল, পাপা বলেছিলেন, মানুষকে খুশি করার জন্য, আনন্দ দেবার জন্য
যদি তোমাদেরকে কখনো একটু কষ্ট পেতে হয় কিংবা করতে হয়। কখনোই পিছিয়ে যাবে না। বরং
তোমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকা প্রতিটি আনন্দে অন্যদেরকে শরীক করার চেষ্টা করবে। কারণ
জগতময় আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণ ছড়িয়ে দেয়াটাই তো তোমাদের কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে শুধু
একটা কথা মনে রাখবে। সেটা হচ্ছে, কখনোই এমন কিছু
করবে না যাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নারাজ হতে পারেন তোমাদের উপর।
জারিফ হেসে বলল, হ্যা এখন আমার
মনে পড়েছো তো। আপ্পি, ভাইয়া চলো চলো
নাস্তা করতে যাই আমরা। নয়তো বড় মানা ভাই কষ্ট পাবে।
চার ভাইবোনকে গলাগলি ধরে নাস্তার টেবিলে এসে বসতে দেখে এবং খুব আনন্দ নিয়ে
খাবার খেতে দেখে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠেছিল মিসেস নুসরাতের। মোটেই নরম মনের
কোন মানুষ নন মিসেস নুসরাত। বরং পরিবারের সবচেয়ে শক্ত মনের সদস্যদের কাতারে নিজের
নাম লিখিয়ে নিয়েছেন বহু বছর আগেই। কিন্তু আজ কেন জানি নিজেকে সামলাতে খুব বেশি
কষ্ট হচ্ছিলো। নিজের দুর্বলতা কারো চোখে পড়ে যাক সেটাও চাচ্ছিলেন না। তাই নাস্তার
প্লেট নিয়ে বারান্দার এক কোণে এসে বসেছেন। দরজার ফাঁকা দিয়ে জিহাদ, জিশান, নাবিহা আর
জারিফের হাস্যরত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকাতে মিসেস নুসরাতের মন ছুট লাগালো
অতীত পানে। জাওয়াদ আর নূহার বিয়ের কয়েক মাস পর কোন এক ছুটির দিনে পরিবারের সবাই
মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছিলেন। চোখে মুখে ঝিকিমিকি ভালোবাসা নিয়ে জাওয়াদ যখন নববধূর পাশে
বসতে যাচ্ছিলো তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন, এই তুই ঐদিকে
কোথায় যাচ্ছিস? বিয়ে হয়েছে বলে
কি সারাক্ষণ বৌয়ের আঁচলের নীচে থাকবি নাকি? মা-খালাদের প্রতি
পালনীয় সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে ভুলে যাবি?
জাওয়াদ হাসি মুখে বলেছিল, জ্বি খালাজ্বি বলেন কি দায়িত্ব
পালন করতে হবে আপনার জন্য?
আমার পাশে এসে বোস। আপাতত জার্নিতে আমাকে বিনোদন দেয়া হচ্ছে তোর দায়িত্ব।
জাওয়াদ বিনা বাক্য ব্যয়ে তার পাশে বসতে গেলে মিসেস নুসরাত বলেছিলেন, এখানে না জানালার পাশে বসবি তুই। এখানে বসলে কথা বলবি আমার সাথে কিন্তু
তাকিয়ে থাকবি বৌয়ের দিকে। এই সুযোগ আমি তোমাকে দেবো না বাপধন। জাওয়াদ তখন হাসতে
হাসতে জানালার পাশে গিয়েই বসেছিল। দুষ্টুমি মাখা স্বরে তিনি তখন বলেছিলেন, তোর বৌকে বলেছি আজ ওকে বোঝাবো দজ্জাল শ্বাশুড়ি কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি।
ভেরি গুড আইডিয়া। যদি নিজের বুঝ থাকে অন্যেকে বোঝানোটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
তাই যত কষ্টকরই হোক নতুন পরিস্থিতি বোঝার সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই।
তোর বৌও এই কথাই বললো আমার কথা শুনে। তোরা দুইজন সবসময় একই সুরে বাজিস কিভাবে?
বুঝলেন খালাজ্বি সম্মুখের সুন্দর লক্ষ্য চলার পথের বাঁধা-বিঘ্নকে জয় করার
ব্যাপারে উৎসাহ ও উদ্দীপনার কাজ করে যায়। অনেক কঠিন কাজও খুব সহজেই করে ফেলা যায়
যদি মানুষ নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যে পৌঁছানোর নকশা অনুযায়ী চলে। আলহামদুলিল্লাহ
আমাদের দুজনের কাছে এমন একটা লক্ষ্য ও গন্তব্য আছে। কি সেই লক্ষ্য আমিও তো একটু শুনি! ইনশাআল্লাহ আমরা দুজন মিলে দাম্পত্য জীবনকে ঘিরে খুব সহজবোধ্য, মনোরম ও আকর্ষণীয় একটি সঙ্গীত রচনা করে যেতে চাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
জন্য। যে সঙ্গীতটা শুনতে যেমন ছন্দময় ও শ্রুতিমধুর হবে, তার প্রতিটি শব্দ হবে হৃদয় স্পর্শিত অনুভূতির রসে সিক্ত। মনকে নাড়া দেবে, প্রাণে সাড়া জাগাবে, অজান্তেই গুনগুন
করে উঠবে অন্তরও মাঝে।
এত ভাবুকতা যে কোত্থেকে এলো তোদের দুইজনের মনে! তবে আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা
করছি তোদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাগত জানানোর জন্য। আনন্দবাড়ির দুষ্টুদের শ্রেষ্ঠ
দুষ্টু হচ্ছিস তোরা দুইটা। দেখা যাক দুই দুষ্টুর সংমিশ্রণে কি জন্ম নেয় পৃথিবীতে।
অবশ্য বিষে বিষ ক্ষয় বলেও একটা কথা আছে। হয়তো দেখা যাবে তোদের বাচ্চাকাচ্চাই হয়েছে
আনন্দবাড়ির শ্রেষ্ঠ শান্তশিষ্ট বাচ্চাদের অন্যতম।
জাওয়াদ তখন হাসতে হাসতে বলেছিল, জগতে কোন কিছুই
অসম্ভব নয়। তাই যে কোন কিছুই সংঘঠিত হতে পারে। তাহারা দুষ্টু হোক বা শান্ত হোক
সেটা নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই, চাওয়াও নেই। তবে
যেমনই হোক তাহাদের মাতার মতন মনোজাগতিক কৃষাণী হোক এটাই প্রার্থনা।
মনোজাগতিক কৃষাণী? সেটা আবার কি? অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন মিসেস নুসরাত।
জাওয়াদ জবাবে বলেছিল, মনের ভেতরটা যদি
অনুর্বর থাকে তাহলে আমাদের চিন্তা-চেতনা-ভাবনা-বিবেচনা সঠিক ও পর্যাপ্ত রসদের
অভাবে পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হয়। অনুর্বর জমির মতো অনুর্বর মনও ফসল ফলাতে ব্যর্থ
হয়। আবার ফসল ফললেও তার গুণগত মানে ঘাটতি থেকে যায়। উন্নত ও পর্যাপ্ত ফলনের জন্য
তাই মনভূমিকেও চাষের জমির মতোই উপযোগী করে তৈরি করতে হয়। আমাদের প্রতিটা কাজ, প্রতিটা অ্যকশন এমন হওয়া উচিত যার জন্য প্রাউড ফিল করা যায়। আর এরজন্য
ডিসিপ্লিন অর প্ল্যানিং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রুলের সমন্বয়ে তৈরি হয় ডিসপ্লিন।
অনুশাসন থেকে তৈরি হয় প্রাইড। আর প্রাইডের জন্য দরকার হয় স্বচ্ছ চরিত্র। যা কিনা
পরিস্কার চিন্তা-চেতনা-ভাবনা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। মোটকথা অক্লান্ত পরিশ্রম ও
সাধনায় চরিত্রকে গড়তে হয়। মনোজাগতিক কৃষাণ-কৃষাণী হওয়া ছাড়া চরিত্রকে গড়ে তোলা
সম্ভব হয়।
হুম, বুঝলাম। তবে এখন
লেকচার বন্ধ। তোকে বিনোদন দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে,
লেকচার শোনানোর
না। বুঝেছিস? সুযোগ একটু পেলেই
হয়েছে ক্লাস নেয়া শুরু করিস তোরা জামাই-বৌ। আচ্ছা তাহলে বলে দাও কি করতে হবে তোমাকে বিনোদন দেবার জন্য। তোর বৌকে একটা রোম্যান্টিক ম্যাসেজ লেখ। লেখার পর আমাকে দেখিয়ে তারপর সেন্ড
করবি। বুঝেছিস?
অবশ্যই বুঝেছি খালাজ্বি। আপনি কিছুক্ষণ
চলন্ত প্রকৃতি দেখতে থাকুন। আমি ততক্ষণে রোমান্টিক একটা ম্যাসেজ লিখে ফেলছি
ইনশাআল্লাহ।
এবং সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যে জাওয়াদ নূহার জন্য ম্যাসেজ লিখে
ফেলেছিল। এত বছর পরেও যে ম্যাসেজের প্রতিটা শব্দ মিসেস নুসরাতের মনে আছে। “ কথার যাদুকরী ক্ষমতার সাথে পরিচয় ছিল! জানা ছিল মানুষের শব্দ পারদর্শিতার
কথা! শব্দে লুকায়িত প্রাণ জাগাতে পারে নব আশ্বাস! নিরাশার আঁধারে দিয়া হয়ে জ্বলতে
পারে শব্দ! তোমার শব্দের জোয়ার-ভাটার ইচ্ছে স্রোতে ভেসে! শব্দের বহুমুখী প্রতিভার
সাথে পরিচয় হয়েছিল অবশেষে! জেনেছিলাম,গাইতে পারে শব্দ, উড়তে পারে বাঁধনহারা উল্লাসে! হাসতে পারে শব্দ,শিশির হয়ে ঝরতে পারে দুর্বাঘাসে! শব্দ অমূল্য মোতি,শব্দ ছড়ায় জোনাক জোনাক জ্যোতি! শব্দে লুকায়িত শক্তি,আত্মবিস্মৃত মনে জাগায় ভক্তি! শব্দে আছে আশা,
অজান্তেই
প্রাণেতে বুনে দেয় ভালোবাসা! শব্দ ঝরে নীরবে,মুগ্ধতার শ্রাবণ
হয়ে আপন গৌরবে! শব্দ বাড়িয়ে দেয় হাত,কুয়াশা ছিন্ন করে
আলোর প্রভাত! শব্দ করে অভিমান,কম্পিত হিয়া ভুলে
যায় সুখের গান! শব্দের থৈথৈ আদর,বুঝিয়ে দেয়
প্রিয়জনের কদর! শব্দে আছে সম্ভাষণ,কারো নিভৃত
সূর্যোদয়ে সাজে ভুবন! শব্দ দেখায় স্বপন,পূর্ণতাতে যার
তুমি আজ আপন!”
নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন মিসেস নুসরাত অতীতের সেই ভালোবাসাময় মূহুর্তগুলোর
মাঝে। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে নূহাকে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি
টেনে বললেন, কিছু বলবি মা?
নূহা হেসে বলল, তুমি নাস্তার
প্লেট নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছো কেন? দেখতে খারাপ হলেও
খেতে কিন্তু বেশ মজাই হয়েছে মামার রান্না করা খাদ্য। তাই নির্ভয়ে খেতে পারো।
মিসেস নুসরাত হেসে বলল, খেয়েছি কিছুটা।
আমার কাছেও ভালোই লেগেছে। কিন্তু আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তবে তোর বানানো হালুয়া
খাবো। আচ্ছা শোন একটা কথা সকাল থেকে বলি বলি করেও বলা হচ্ছে না তোকে। আমাদের পাশের
বাড়িতে নতুন প্রতিবেশী এসেছে।
সেটা তো আরো দুইমাস আগে এসেছে।
কথা পুরোটা না শুনেই মাঝখানে কথা বলার অভ্যাসটা আর তোর গেলো না।
নূহা হেসে বলল, আচ্ছা সরি। এই
নাও মুখে তালা দিলাম। তুমি কথা শেষ করার আগে আর কিছু বলবো না।
আমার সাথে প্রতিবেশী সেই মহিলার বেশ সখ্যতা হয়েছে বলতে পারিস। দুই মেয়ে
মহিলার। বড় মেয়েটার মনেহয় কোন সাইকোলজিল্যাল সমস্যা আছে। তোর সাথে যোগাযোগ করতে
বলেছি। তোর নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। যোগাযোগ করলে একটু দেখিস কি সমস্যা মেয়েটার।
নূহা হেসে বলল, একটু না পুরো
সমস্যাই দেখবো ইনশাআল্লাহ। আপাতত সমস্যার রাজ্যই আমার আবাসভূমি। তাই সেখানেই দেখি
সমস্যা, মনে জেগে ওঠে
আশা।
কিসের আশা?
নূহা হেসে বলল, সেটা বলা যাবে
না। এটা আমার টপ সিক্রেট। এসব কথা এখন বাদ।
তুমি চলো মামণি ডাকছে তোমাকে। আরেকটু পরই মনেহয় রওনা দেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তুই যাবি আমাদের সাথে?
যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাহাত একটু আগে ফোন দিয়ে জানালো বিকেলে আসছে
ইনশাআল্লাহ। তাই আর যেতে চাচ্ছি না। তুমি চলো বাপীর জন্য হালুয়া প্যাক করে দেবো।
মিসেস নুসরাত হেসে বললেন, আচ্ছা চল।
@
আলো ও অন্ধকারের মাঝে আলো অপ্রতিরোধ্য। সত্যিই কি তাই? হবে হয়তো! সেজন্যই হয়তো তীব্র আন্ধকারের মধ্যেও একবিন্দু আলো তার অস্তিত্ব
জানান গিয়ে যায়। কিন্তু আলোকে ম্লান করতে অন্ধকারকে বিশাল চাদর নিয়ে হাজির হতে হয়।
আচ্ছা ইতিবাচক অনুভূতি গুলোকে আলো আর নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে কি অন্ধকারের সাথে
তুলনা করা যায়? যদি যায় তাহলে
আনন্দ ও বেদনার মধ্যে কোন অনুভূতিটা অপ্রতিরোধ্য?
ভালো লাগা ও মন্দ
লাগার মধ্যে কার আধিপত্য বেশি মনের উপর? ধীরে ধীরে
পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিক্ষিপ্ত এসব
ভাবনা দলে দলে দলে হানা দিতে লাগলো ইমরানের মনে। চোখ বন্ধ করলো সে। মনটাকে টেনে
আরেকদিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। মনের ভাবনা গুলোকে ভাঁজ করে তুলে
রাখাটা এখানো রপ্ত করতে পারেনি সে। মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়ে যায়
তার।
তুই এখানে আমি আরো লাইব্রেরী, ক্যান্টিন সব
জায়গায় খুঁজে এলাম তোকে। বাসায় যাবি না? ইমরানের পাশে
বসতে বসতে বললো ইয়াস।
বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো ইমরান। ছোটবেলা থেকে একই সাথে বড় হয়েছে
ইমরান ও ইয়াস। একই স্কুলে ও কলেজে পড়েছে। ইউনিভার্সিটিতে এসেও একই বিষয় নিয়ে পড়ছে
দুজন। একে অন্যেকে ছাড়া চলেই না দুজনের। পরিচিত মহলে ‘মানিকজোড়’ নামে খ্যাত দুজন।
বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে ইয়াস বলল, কি রে তোর কি মন
খারাপ কোন কারণে?
ইমরান বলল, বুঝতে পারছি না।
কেন জানি না কিছুই ভালো লাগছে না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। আচ্ছা
তোর কি কখনো এমন হয় যে, অকারণেই মন খারাপ
হয়ে যায়?
আগে মাঝে মাঝে এমন মনে হতো। কিন্তু একদিন আদী ভাইয়া বুঝিয়ে বলেছিলেন, আমাদের মন খারাপ আসলে কখনোই অকারণে হয় না। মন খারাপের পিছনে সবসময়ই কোন না
কোন কারণ থাকে। তবে সবসময় কারণটা আমরা বুঝতে পারি না বিধায় মনে করি অকারণে মন
খারাপ হয়েছে।
হুমম, সেটাই হবে হয়তো।
হবে হয়তো না। আসলেই এটাই। তুই তো জানিস’ই আদী ভাইয়া
সাইকিয়াট্রিস্ট। ভাইয়া আমাকে চমৎকার করে
বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছিলেন। ভাইয়া বলেছিলেন, ব্যাপারটা অনেকটা
এমন যে, আমাদের মনের এক
কোণে বদ্ধ কুঠিরে আটকা পড়ে আছে বেদনাক্ত কোন স্মৃতি। মাঝে মাঝেই যে নিজেকে মুক্ত
করার জন্য ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। বদ্ধ ঘরের দূষিত বাতাস ও ধূলো-বালি ফাঁকফোকর
দিয়ে তখন বাইরে চলে আসে। যার প্রভাবে ব্যহত হয় স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস। হাঁসফাঁস
করতে থাকে মন তখন বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য। ধূলো-বালির কুয়াশার আস্তর ফেলে দেয় যার
ফলে বুঝে উঠতে পারে না কি থেকে কি হয়ে গেলো। ধারণা করে নেয় অকারণেই বুঝি তার এমন
লাগছে। তুই আমার সাথে বাসায় চল। ভাইয়া বাসায় থাকলে তোর এই মাঝে মাঝে অকারণে কেন মন
খারাপ হয়ে যায় এটার কারণ কি হতে পারে সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা যাবে।
ইমরান হেসে বলল, সাইকিয়াট্রিস্টরা
কত সহজেই মনের অবস্থা সমূহের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সমাধান দিয়ে ফেলেন। কিন্তু
সমস্যার ব্যাখ্যার মত সমাধানগুলোও যদি সহজ হতো কতই না ভালো হতো।
এই কথা বলছিস কেন?
কিছুক্ষণ নীরবতার পর ইমরান বলল, আমার কাজিন ইকবাল
ভাইয়া একসময় অসৎ সঙ্গের কারণে নেশায় আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু পরে সবাই মিলে
বোঝানোর পর বেড়িয়ে এসেছে অন্ধকার সেই জগত থেকে। কিন্তু তারপরও সবাই এখনো উনাকে
অবিশ্বাসের চোখে দেখে। চাচার এক বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল কিন্তু
এখন আর তারা তাদের মেয়েকে ইকবাল ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে না। মনে মনে বেশ
ভেঙ্গে পড়েছেন ভাইয়া।
ইয়াস বলল, জানিস ভাইজান
একটা কথা প্রায়ই বলেন আমাদেরকে। বলেন, নিজের ভুল বুঝতে
পেরে যারা নিজেকে শুধরাতে চেষ্টা করে তাদেরকে কখনোই অবিশ্বাস করা ঠিক না। কারণ
তাদেরকে বিশ্বাস না করতে তারা কখনোই নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে পারবে না। আর আমরা
যদি তাদের হাত না ধরি, তাহলে যে কোন সময়
তারা আবার পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এসব নীতিকথা মনে করে আমাদের সমাজের
মানুষেরা উড়িয়ে দেয়। তারা জেনে শুনে ঘুষখোর ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে কিন্তু
নিজেকে সংশোধন করে সত্যের পথে পা বাড়ানো কারো দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে না। আমাদের এই
সমাজে তাই ভালো হতে চাইলেও ভালো হওয়াটা অনেক কঠিন।
হ্যা ঠিক বলেছিস তুই। এখন বুঝতে পারছি আমি আসলে ইকবাল ভাইয়াকে নিয়েই
ভাবছিলাম। তাই মন খারাপ লাগছিলো খুব।
ইয়াস হেসে বলল, আদী ভাইয়া অবশ্য
এই কথাটাও বলেছিল। পছন্দের কারো সাথে মন খুলে কথা বললেও মনের গুমোট ভাব কেটে যায়।
মন খারাপের অজানা কারণ বেড়িয়ে আসে কথার ফাঁকে।
ইমরান বলল, আচ্ছা আদী ভাইয়া
কি সময় দিতে পারবেন আমাকে? আমি তাহলে ইকবাল ভাইয়াকে নিয়ে আসতাম একদিন। আমার খুব ভয় হচ্ছে মানুষের
নেগেটিভ আচরণের কারনে ভাইয়া আবার না ফিরে যায় অন্ধকার সেই জীবনে।
ইয়াস বলল, ইনশাআল্লাহ আমি
তোকে জানাবো। এখন চল আমরা উঠি।
ইয়াস উঠে দাঁড়িয়ে
হাত বাড়িয়ে দিলো ইমরানের দিকে। ইমরানও হেসে বন্ধুর বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন