সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...১




(উত্তম মানুষ হতে চাই কিন্তু জানি না কিভাবে হবো?! সুখী সুন্দর একটা জীবন চাই কিন্তু জানা নেই কোথায় পাবো প্রশান্তির দেখা?! অর্থহীন জীবন কাটাতে চাই না, সময়কে কাজে লাগাতে চাই কিন্তু কেন জানি না ইচ্ছের উপর দৃঢ় থাকতে পারি না হতাশাকে ছুটি দিয়ে আশাবাদী মন নিয়ে সামনে কদম বাড়াতেই নিজেকে হারিয়ে ফেলি নিরাশার আঁধারে! মূল গন্তব্য পানে ছুটে চলতে চাই অবিরাম, বাঁধাহীন কিন্তু বার বার শুধু হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই এই সুযোগে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় অনেক পেছনের কেউ! কষ্ট হয় তখন, খুব বেশি কষ্ট! কেউ বোঝে না সেই কষ্ট মেনে নেয়া সেতো অনেক পরের কথা আলোকিত একটি ভুবনের বাসিন্দা হতে চাই সত্য ন্যায়ের পথে চলতে চাই কিন্তু সবচেয়ে বেশি বাঁধা আপনজনদের কাছ থেকেই আসে! সামান্য ব্যর্থতায় চারপাশের মানুষগুলো সামালোচনার গুঞ্জন তুলে দেয় কেউ নেই পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেবার, আশ্বাসের বাণী শোনাবার কেমন করে তবে ফুল হয়ে ফুটবো মোরা সত্যের আঙিনায়??!!” বাস্তব জীবনে হোক কিংবা ভার্চুয়াল আজকাল এই প্রশ্নগুলো শুনতে হয় বার বার অসংখ্য জনের কাছে যারা জীবনের মূল গন্তব্যের সন্ধান তো জানে, কিন্তু সেই লক্ষ্য পানে তাদের ছুটে চলা ব্যহত হয় নানান কারণে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের পথে বার বার হুমড়ি খেয়ে পড়া এবং আবারো উঠে দাঁড়িয়ে চেষ্টা জারি রাখা কিছু মানুষের গল্পখুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা )

জানালার
গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে এক মনে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিল নূহা। সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। কখনো টুপটুপ, কখনো ঝিরঝির, কখনো ঝমঝম, কখনো এলোমেলো। আকাশ থেকে নেমে আসা এই পানি রাশিরও কত রূপ! কত ভাবেই না ছুঁয়ে যায় মৃত্তিকাকে। আর মৃত্তিকাও বুক পেতে গ্রহণ করে নেয় ঝরে পড়া পানিরাশির সব রূপকে। ম্যাসেজের শব্দে সেলফোনের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো নয়টা বাজতে দশমিনিট বাকি। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতো টিচার হবে। ছোট ছোট বাচ্চাদের টুইংকেল টুইংকেল ছড়া কবিতা শেখাবে। কিন্তু সেই স্বপ্নের বারোটা বাজিয়ে এখন বড় বড় বাচ্চাদের সাইকোলজি পড়াতে হচ্ছে। হাসি ফুটে উঠলো নূহার ঠোঁটের কোণে। মনে পড়লো আদী ভাইয়ার কাছে যেদিন প্রথম বলেছিল সাইকোলজি নিয়ে পড়তে চায়। চিন্তিত কন্ঠে জবাব দিয়েছিল, সাইকোলজির কি পড়বে? সাইকোলজিতে পড়ার কি আছে সেটাই তো মনে করতে পারছি না। টেক্সট বইতে কি পড়েছিলাম কিছুই আমার মনে নেই। তবে হ্যা দীর্ঘ ষোল বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলতে পারি যে, সাইকোলজি শুধুই অনুভবের। মন দিয়ে শুধু অনুভব করতে হয় অপরাপর মনগুলোর রকমারি চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব-সংঘাত। যারা পারে তাদের গাদা গাদা বই পড়ার কোন প্রয়োজনই পড়ে না। তাদের শুধু দরকার হাতে একগুচ্ছ ফুল আর চেহারায় প্রশান্তিকর অভিব্যক্তি। সেদিন আদী ভাইয়ার কথা ঠিকমতো বুঝতে করতে পারলেও। কিছু অভিজ্ঞতা নিজের ঝুলিতেও জমা হবার পর নূহাও এখন অনুভব করে সাইকোলজি আসলেই শুধুই অনুভবের! সম্মুখে বসে থাকা মনের প্রতিচ্ছবিটাকে নিজের অনুভবের আয়নায় দেখে নিতে জানতে হয় শুধু! সেজন্য শুধু প্রয়োজন সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী খুব অনুভূতিশীল একটি মন। মানুষের মন শিশুদের মতই অবুঝ, আদুরে। মনকে বুঝতে বোঝাতে হলে তাই থাকতে হয় আহ্লাদী শব্দভান্ডার, জানতে হয় পুতুল খেলা, ছুটতে হয় প্রজাপতির পিছু পিছু, উড়তে হয় ঘুড়ি হয়ে, জ্বলতে হয়ে জোনাকির টিমটিমে আলো নিয়ে। দশটায় ক্লাস আজ কিন্তু একটুও বাইরে বেরুতে ইচ্ছে করছিল না নূহার। এমন সাধারণত কখনোই হয় না। দায়িত্ব পালনে কখনোই কোন অবহেলা করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আজ মনকে মানাতেই পারছে না বাইরে বেড়োবার জন্য।

ম্যাম প্লিজ হেল্প মিভীষণ প্রিয় আদরের স্টুডেন্ট সাবিরার এই ছোট্ট ম্যাসেজে চোখ বুলিয়ে মন বদলে গেলো নূহার। আজ আবার কি হলো এই মেয়ের? স্টুডেন্ট গুলোকে নিয়ে মহা যন্ত্রণার মধ্যেই থাকতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো কিছু না কিছু হয়। কখনো কেউ ম্যাসেজ পাঠায়ম্যাম কিচ্ছু ভালো লাগে না। কেন ভালো লাগে না সেটা বুঝতে পারছি না। আপনি খুঁজে বের করে বলে দেন।গত পরশু একজন লিখে পাঠালো, ‘ম্যাম মনটার মধ্যে কেমন কেমন যেন করছে। সব আছে কিন্তু কিন্তুই নেই এমন অনুভূতি হচ্ছে। কোন খাবার খেয়েও মজা পাচ্ছি না। সবকিছু বিস্বাদ লাগছে। কি করি বলেন তো?’ ম্যাসেজ দেখে আপন মনেই অনেকক্ষণ হেসেছিল নূহা। কি যে হয়, কি যে করতে চায় আর কি যে বলে নিজেরাই জানে না, বোঝে না এখনকার ছেলেমেয়েগুলো। অবশ্য এমনটা সবারই মাঝে মাঝে কম বেশি হয়। দেখা যায় সবকিছু ঠিক আছে অথচ কিছুই ভালো লাগছে না। কোথাও শান্তি পাচ্ছে না মন। পছন্দের মানুষ কিংবা প্রিয় জিনিস গুলোও তখন মনের সেই হাহাকার ভাবকে দূর করতে পারে না। নিজের মাঝেই গুম হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তখন। আঁতিপাঁতি করে নিজের ভেতরেই তখন মানুষ খুঁজে ফেরে একটু প্রশান্তি। কিন্তু মনের কোথাও দেখা মেলে না কিছুরই। মনের আকাশ, মেঘ, চাঁদ, তারা, রংধনু, নদী, সাগর, পাহাড়, বন্দর সবকিছু কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। যেদিকেই চোখ যায় শুধু ধূধূ মরুভূমি। নূহার নিজেরও মাঝে মাঝে এমন হতো আগে। তারপর একদিন মনের ধূধূ মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল তপ্ত বালুর উপরই। মাথার উপর সূর্য উগড়ে দিচ্ছিলো বিরক্তির লাভা। উফফ, কি যাতনা দায়ক ছটফটে অনুভূতি। কিছু ফুলের কিছু বীজ ছিল সাথে। মনেহলো এই বীজগুলোকে মরুভূমিতে ছড়িয়ে দেয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। যতদূর পর্যন্ত হাঁটতে পারলো বীজ ছড়িয়ে দিলো মরুভূমিতেও। আবার যেদিন আটকা পড়তে হয়েছিল মরুভূমিতে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিলো নূহার। ওমা এতো আর মরুভূমি নেই! যে ঘাসফুলের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। নানা রঙয়ের ফুল তাতে প্রজাপতির চঞ্চল ছুটোছুটি খেলা চলছিল মরুভূমি জুড়ে। এরপর থেকে মরুভূমিতে আটকা পড়লেও আর কষ্ট হয় না তেমন।

নাহ আজ স্টুডেন্টদেরকে শেখাতে হবে কিভাবে মরুভূমিতে করতে হয় শ্রাবণের চাষ বাস। নূহার সবসময়ই মনেহয় যে নিজেকে জানা, বোঝা চেনাটা খুব বেশি গুরুত্বপুর্ণ প্রতিটা মানুষের জন্য। অনুভূতির পেছনে কি আবেগ কাজ করছে সেটা না জানলে জীবনের মহামূল্যবান সময়ের অনেকটা হেলায় হারিয়ে যায়। মানুষ বুঝতেই পারে না কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে এবং তার করণীয় কি! যারফলে মনে জায়গা করে নেয় বিষণ্ণতা, নিরাসক্ততা। আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে জীবনের প্রতি। আর এসব থেকে মনকে মুক্ত রাখতে নিজেকে জানার কোন বিকল্প নেই। নিজেকে জানা, বোঝা চেনার জন্য নিজের সাথে থাকতে হবে নিজের সখ্যতা। দুনিয়ার সবাইকে সময় দিতে গিয়ে নিজের কথাই ভুলে যায় মানুষ। শত কাজের ভিড়ে নিজের জন্য থাকে না এক খন্ড অবসর। অথচ খুব জরুরি নিজের সাথে নিজের একান্ত আলাপন। দিনের কিছুটা সময় শুধুই নিজের সাথে কাটানো উচিত। মনের চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ গুলোকে যাচাই বাছাই করে নেবার জন্য। কোন কোন জিনিসটা সত্যি প্রয়োজন, কি কি না পেলেও স্বাচ্ছন্দে কেটে যাবে জীবন। যে কোন দুটো পছন্দের মধ্যে থেকে যদি একটিকে বেছে নিতে হয় কখনো তাহলে কোনটাকে নেবে? এই বোঝাপড়া থাকা উচিত নিজের সাথে। হ্যা এটা ঠিক যে জীবনকে এমন মেপে মেপে হিসাব করে কাটানো যায় না। কিন্তু একদম লাগামহীন ছেড়ে দেয়াও উচিত না মনকে। লাগামটা হাতে ধরা না থাকলেও কোথায় আছে সেটা জানা থাকা দরকার।
মোবাইলের শব্দে ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে এলো নূহা। ম্যাসেজের জবাব না পেয়ে শেষপর্যন্ত কল দিয়েছে সাবিরা। সালাম বিনিময়ের পর নূহা বলল, আজ আবার কি হয়েছে তোমার?

কিছুই বুঝতে পারছি না ম্যাম। কেন জানি না কিছুই ভালো লাগছে না। অথচ মন খারাপ হবার মতো কিছুই ঘটেনি।
কিছু তো অবশ্যই ঘটেছে যার ফলে তোমার অবচেতন মন থেকে উঠে আসছে ধোঁয়া। যার প্রভাবে চেতন মনের ব্যহত হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস। এক কাজ করো। চোখ বন্ধ করে এক কোণে বসে যাও। চিন্তা করো এই ভালো না লাগার আগ পর্যন্ত ঠিক কি কি ঘটেছে তোমার সাথে। খুঁজে দেখার চেষ্টা করো বিষাদের কারণ।

আমি একা একা পারবো না ম্যাম। আপনি আমাকে সাহায্য করেন।

একা একাই পারবে তুমি চেষ্টা তো করো আগে। পৃথিবীতে কাউকেই সারাক্ষণ বা যখন প্রয়োজন তখনই কাছে পাবে না তোমার। তাই নিজেকেই নিজের আশ্রয় হতে হবে। সেজন্য নিজেকে চিনতে, জানতে বুঝতে হবে। আজ থেকে নিয়মিত কিছুটা সময় নিজের সাথে কাটাবে। চেষ্টা করবে নিজেকে চিনতে, জানতে বুঝতে। মোটকথা যে সময়টা জুড়ে চলবে তোমার নিজের সাথে নিজের কথোপকথন। নিজেই হবে নিজের উপদেষ্টা, নিজেই নিজের জর্জ আবার ব্যারিষ্টারও।নিজেই করবে নিজেকে শাসন, শোষণ দুর্বলতার মুহুর্তে নিজেই নিজের ভরসা হয়ে নিজেকে করবে আলিঙ্গন।

এই কথাগুলোও কি আপনার কল্পনার ফুল ম্যাম? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো সাবিরা।

নূহার চেহারাতেও ফুটে উঠলো হাসির রেখা। বলল, জানো আমি সবসময় এমন কিছু মানুষকে খুঁজতাম যারা আমার মত করে চিন্তা করে। সবসময় স্বপ্ন দেখেছি যখন খুঁজে পাবো তাদেরকে নিয়ে আমি কাজ শুরু করবো। ঘৃণার বদলে ভালোবাসা ছড়ানো, দুঃস্বপ্ন ঘেরা মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দেয়া, হতাশার ঘোর অমানিশায় আশা জাগানিয়া হওয়া, নিজে কাঁটার উপর দিয়ে চলে অন্যের জন্য ফুল ছড়িয়ে দেয়া, নিজের কষ্টের মেঘগুলোকে অন্যের জন্য আনন্দের শ্রাবণ রূপে ঝরানো, মনের মধ্যে নিরবধি বেদনার স্রোতকে চাপা দিয়ে সুখের ধারা বইয়ে দেয়া হবে সেই কাজ। ভোরের প্রথম সূর্যকিরণের মতই আলো-আঁধারির অবছায়ায় তোমাদের কয়েকজনের মধ্যে আমি সেই মানুষগুলোরও ঝলক দেখতে পাই মাঝে মাঝে। কিন্তু নিজের মনের অনুভূতির কাছে যদি এমন অসহায় থাকো তাহলে অন্যকে নিয়ে ভাববে কিভাবে? বিশৃঙ্খল মন নিয়ে কি অপরের জীবনকে সাজাতে পারবে? তাই আগে নিজের মনটাকে গুছিয়ে নিতে হবে তোমাদেরকে। নিজেকেই যদি নিজের মাঝে খুঁজে ফিরতে হয় তাহলে পথহারাকে পথের সন্ধান কিভাবে দেবে?

আমি খুব দুঃখিত ম্যাম।

নূহা হেসে বলল, হয়েছে এখন আবার দুঃখী আত্মার লেবাস ধারণ করতে হবে না। তারচেয়ে যা বললাম তাই করো। নিজ মনে অবগাহন করে নিজেকে খুঁজে বের করো নিজের মাঝ থেকে। নিজেকে খুঁজে পেলেই না সত্যের আঙিনায় ফুল হয়ে ফুটতে পারবে। এখন রাখছি ক্লাসে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

==============

ক্লাসের লেকচার শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালো নূহা। এখনো পনেরো মিনিট হাতে আছে। পরীক্ষার খাতায় যে যার যা মনে এসেছে তাই লিখেছে সেটা নিয়ে বকাঝকা করবে নাকি নিজের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে কথা বলবে ভাবতে ভাবতে চোখ চলে গেলো ক্লাসের শেষ সিটে বসা ফাতিমার দিকে। গালে হাত দিয়ে উদাস মনে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। লেকচার চলাকালীন সময়েও ফাতিমার মনকে একাধীক বার আকাশ থেকে টেনে নামিয়ে আনতে হয়। বকা দিয়েও লাভ হয়নি এই ব্যাপারে। মায়াকাড়া হাসির সাথে মধু ঝরা কণ্ঠে জবাব দেয়, আমি কি করবো ম্যাম আকাশ যে আমাকেআয় খুকু আয়সম্বোধনে সুরে সুরে ডাকে। নূহা বুঝতে পারে মেয়েটার মনের ভেতরটা অনেকটা আকাশের মতো। বায়বীয় শূন্যতা আর তাতে ভাসে নানা আকৃতির মেঘ। আকাশের বুকে ভাসমান মেঘদের মতোই ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তার আকার, একসাথে এসে জড়ো হয় আবার খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আকাশের মাঝে ফাতিমা খুঁজে ফিরে নিজেকে। ফাতিমা...

নূহার ডাক শুনে আকাশ থেকে নেমে এলো ফাতিমার দৃষ্টি। ভালো ভাবে তাকালো নূহার দিকে। না চেহারা দেখে তো ম্যামকে বিরক্ত বা রাগান্বিত মনেহচ্ছে না। স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলল, জ্বী ম্যাম।

জোকসটা শুনেছো? যেটাকে এক ব্যক্তি তার সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়ে ডক্টরের কাছে হাজির হলেন। ডক্টর তার সারা শরীর চেকাপ করেও ব্যথার অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। কিন্তু সেই ব্যক্তির জোর দাবী এটাই ছিলো যে সে শরীরের যেখানেই স্পর্শ করছে ব্যথার অনুভূতি টের পাচ্ছে। পরবর্তীতে দেখা গেল যে সেই ব্যক্তির ব্যথা আসলে ছিলো তার আঙ্গুলে। যারফলে সে যেখানেই হাত দিচ্ছিলো ব্যথার অনুভূতি টের পাচ্ছিলো।

জ্বী ম্যাম আপনি এই জোকসটা একদিন ক্লাসে বলেছিলেন।

আমাদের শরীর মনের সম্পর্কটা অনেকটা এই জোকসের ব্যক্তির অবস্থার মত। মন যদি ভালো না থাকে তাহলে শরীর প্রফুল্লতা নিয়ে কোন কাজই করতে পারে না। আর কাজ করার বাধ্যতা না থাকলে তো শরীরও ঝিম ধরে বসে থাকে। আবার শরীর যদি ভালো না থাকে মনের জোরে যতই চলতে চেষ্টা করো না কেন ক্লান্তি ঘিরে ধরবে একটু পর পর। শরীর মন যেটাই খারাপ থাক না কেন একটি প্রভাবিত করে অপরটিকে। যারফলে কাজ হয় না পারতে দায়সাড়া গোছের। আমাদের শরীরের ভেতর মনের বাস। শরীর মন অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। শরীর ভাল না থাকলে মন ভাল থাকে না, মন ভাল না থাকলে শরীর ভালো থাকলেও যথাযথ কাজ করতে পারে না। কাজেই সুস্থ্য থাকার জন্য এই দুটিকেই ভাল রাখার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা শরীরের ব্যাপারে যতটুকু জানি বা যত্নশীল মনের ব্যাপারে সিকি পরিমাণও জানি না বা যত্নশীল না। আমাদের শরীরে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য উভয় অংশের কোথায় কি আছে সেই সম্পর্কে আমাদের পরিপুর্ণ ধারণা থাকলেও, জানি না মনের কিছুই। শরীরের ব্যাপারে আমরা যতটা যত্নশীল মনের ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। শরীরটাকে ফিট রাখতে কত উদ্যোগই না গ্রহণ করি আমরা কিন্তু মনকে ফিট রাখতে কি কিছু করি? শরীরের মধ্যে শুধু চেহারাটাকে সাজাতেই কত রকমের প্রসাধনী আছে কিন্তু মনের প্রসাধনীর খোঁজ কি জানি আমরা? মাথা ব্যথা করলে পেইন কিলার নিতে হবে, এসিডিটির সমস্যা হলে এন্টারসিড খেতে হবে, ডায়রিয়া হলে স্যালাইন খেতে হবে ডাক্তারের কাছে না গিয়েই আমরা এই প্রাথমিক চিকিৎসা গুলো জানি। কিন্তু মনের মধ্যে শূন্যতার অনুভূতি হলে কি করতে হবে, কোনকিছুতে আগ্রহ বোধ না হলে কি করতে হবে, কারণে অকারণে রাগ হলে কিংবা একটুতেই ধৈর্য্যচ্যুতি হলে এর প্রতিকার কি তা কি জানি আমরা? উপটান, মুলতানি মাটি, কাঁচা হলুদ, দুধের সর, নানা ধোরণের মশ্চারাইজার কত কিছুই না ঘষি আমরা শরীরের চামড়াকে ঠিক রাখার জন্য। কিন্তু মনের আভরণ রোদ-খরা-বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ক্ষয়ে যেতে থাকে, খাদা-খন্দ তৈরি হতে থাকে আমরা তা ঘষে ঠিক করা তো দূরে থাক হয়তো খবরই রাখি না। আর খবর রাখি না বলেই মন অশান্ত হলে আমরা জানি না কেন সে অশান্ত, সামান্য কোন কথায় ভীষণ ভাবে রিঅ্যাক্ট করার পেছনে কারণ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে ভেবে নেই যে আমার স্বভাবটাই মনেহয় এমন। কিন্তু খুঁজে দেখি না কেন আমার স্বভাবটা এমন। অথচ শারীরিক কোন উপসর্গ নিয়মিত হতে থাকলে বড় কোন রোগের পূর্বাভাস ভেবে আমরা ডক্টরের কাছে ছুটি। নিশ্চিত হবার জন্য করি কত ধরণের এনালাইসিস। আরেকটা সমস্যা কি জানো?

পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিলো ক্লাসজুড়ে। প্রশ্ন করতে করতে অস্থির করে তোলা স্টুডেন্টরা সবাই একদম চুপ হয়ে গেলেও তার দিকে নিবদ্ধ থাকা চোখগুলোকে ছলছলে নদী মনে হতে লাগলো নূহার। ভাসমান শ্যাওলার মতোই যাতে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রশ্নরা। ছলকে ছলকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে কিন্তু পারছে না কোন এক অজানা কারণে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, তোমরা তো জানো বিশাল বড় যৌথ পরিবার আমাদের। চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুপাতো সব কাজিনরা মিলে একসাথে ভাইবোনের মত বড় হয়েছি আমরা। কোন একটা কারণে আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যর কাছে আমি সবচেয়ে বেশি স্পেশ্যাল। ছোটবেলা থেকেই জ্বর ঠাণ্ডা তো দূরে থাক আমি যদি স্বাভাবিক কোন কারণেও একটি হাঁচি বা কাশি দিতাম পাশে পরিবারের যেই থাকতো লাফ দিয়ে উঠতো আমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আমার মনের ব্যাপারে কম সময়ই এতটা যত্নশীল পেয়েছি পরিবারের সদস্যদের। বরং মনখারাপ করলে, চুপ করে বসে থাকে, ভালো লাগছে না বললে মামণি খুব বিরক্ত হতেন। ক্ষোভ নিয়ে বলতেন, বেশী আহ্লাদের কারণেই আমি মুডি হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। আমার চুলকে আরো সুন্দর করার লক্ষ্যে চুলে এগ হোয়াইট ঘষতেন যে মামণি তাকে কিন্তু আমি বেশির ভাগ সময়ই পাশে পাইনি কোন কারণে ঘষা লেগে মনের এক কোনার রঙ উঠে যাওয়া অংশে নতুন রঙের প্রলেপ দেবার জন্য। আমি কিন্তু আমার মামণির দোষ বলছি না। মনের ব্যাপারে যে আমাদের আপনজনেরাও উদাসীন সেটা বোঝাতে চাচ্ছি। আর এজন্যই শারীরিক অসুস্থতার সময় রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেন যে আম্মু, দেখা যায় মনের একটা অন্যরকম আবেগের প্রকাশ দেখে তিনিই বকে দিচ্ছেন আচ্ছা করে। প্রতিদিনের রুটিন ভেঙ্গে সাতটার বদলে আটটায় ঘুম থেকে উঠলে চিন্তিত মুখে আদর মাখা কণ্ঠে যে আব্বু জানতে চান, কি রে মা তোর শরীর খারাপ করেনি তো? তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বললে সেই আব্বুই বিরক্ত কণ্ঠে বলেন, সব ইচ্ছাকে পাত্তা দেয়া ঠিক না। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আদর মাখা কণ্ঠে জানতে চান না যে, কেন তোর ইচ্ছা করছে না মা খুলে বল আমাকে।

টুপ টুপ করে অশ্রু বিন্দু ঝরে পড়তে শুরু করলো কয়েকটি চোখ থেকে। সিক্ত হয়ে উঠেছিল নূহার আঁখিদ্বয়ও। ঘড়ির দিকে তাকালো আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি তার ক্লাস শেষ হতে। সময়ের সাথে ছুটতে গেলে এখন আশ্রয় হওয়া চলবে না তাকে। সময় মাঝে মাঝে এমনই এক নিষ্ঠুর বাহনে পরিণত হয় যা মানুষকে একদণ্ড দাঁড়াবার সুযোগ দেয় না প্রিয়জনদের পাশে। ঠিক যেন স্টেশনে পৌছে নির্দিষ্ট ট্রেন চলতে শুরু করেছে এমন এক অবস্থা। নিজের মালপত্র নিয়ে ছুটন্ত ট্রেনের পিছনে ছোটা। সময় নেই বিদায় জানাতে আসা প্রিয়জনের দিকে তাকানোর। হাত বাড়িয়ে অশ্রু মোছা তো দূরে থাক, হাত নেড়ে বিদায় জানানোরও সময় নেই। তা না হলে ব্যহত হবে তার নিজের গন্তব্যে পৌছা। তাই আবারো কথা শুরু করলো নূহা, মনের জগতে আমরা যেমন একলা। মনের পরিচর্যায়ও আমরা একদম একলা। সবচেয়ে আপন যে জন সেই জনকেও বেশির ভাগ সময়ই পাশে পায় না মন। আর এতে আপনজনের কোন দোষ নেই। সে নিজেই তো মন সম্পর্কে উদাসীন কিংবা অজ্ঞ। তার হয়তো বুঝটুকুই নেই যে এখন কেউ তাকে চাইছে পাশে। তাই নিজেকেই হতে হবে নিজ মনের সুখ-দুঃখের সাথী, আশ্রয়, অবলম্বন, পথপদর্শক। আর সেজন্য জানতে হবে মনকে, বুঝতে হবে মনকে, করতে হবে মনের যত্ন, মাখতে হবে মনে প্রসাধনী। মনেরও আছে ব্যথা, ভোগে মন পানিশূন্যতায়, ধিকিধিকি জ্বলে মন নিরবধি। তাই জানা থাকতে হবে মনের পেইন কিলার কি, কিসে দূর হবে পানিশূন্যতা, কার প্রভাবে মন ক্ষান্ত হবে দহন করা থেকে। বুঝতে পেরেছো তো তোমরা সবাই আমার কথা?

জ্বী ম্যাম। ভেসে এলো সবার মৃদু কণ্ঠস্বর।

তাহলে আজ থেকে শুরু করো নতুন করে নিজেকে জানা। বুঝতে চেষ্টা করো তোমাদের মনের অনুভূতিগুলোর পেছনের কারণ। কিসে আনন্দ পায়, কিসে বিষণ্ণ হয়, কিসে সুখ পায় মন, কিসের প্রভাবে হত বেদনাক্ত। তারপর খুঁজে বের করতে চেষ্টা করো এর উপশম। কথা বলো নিজের সাথে মন খুলে। হয়ে উঠো নিজেই নিজের সবচেয়ে কাছে বন্ধু, পরামর্শদাতা। তবে হ্যা একটা বিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে কখনোই যাতে মন টেনে নিয়ে যেতে না পারে সীমালঙ্ঘনের পথে। আমরা সবাই জানি তো সর্বক্ষেত্রে আমাদের সীমা কি?

শরীয়ত ম্যাম। জবাব দিলো ফাতিমা।

হ্যা শরীয়ত। আরেকটা কথা সবসময় শরীয়তের বাউন্ডারি থেকে এতটুকু দুরুত্বে অবস্থান করার চেষ্টা থাকতে হবে যাতে কখনো পা পিছলে পড়ে গেলেও বাউন্ডারির ভেতরেই থাকে আমাদের শরীর। এমন যাতে নাহয় শরীর মনের অর্ধেক বাউন্ডারির ভেতর আর অর্ধেক বাইরে। বুঝতে পেরেছো?

জ্বী ম্যাম। এবার সবার কণ্ঠস্বর বেশ দৃঢ় মনেহলো নূহার কাছে। হেসে বলল, তাহলে আজ এই পর্যন্তই থাক আমাদের আলোচনা। ইনশাআল্লাহ আগামী ক্লাসে আবার কথা হবে তোমাদের সাথে


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন