সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২০




বাচ্চাদের রুমে উঁকি দিয়ে নাবিহাকে দেখতে পেয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো রাহাত কিচেন থেকে ডাইনিং রুম, ড্রয়িংরুম, বারান্দা, লন কোথাও নাবিহাকে না পেয়ে বুকের ভেতর কেমন যেন একটা কাঁপন উঠে গিয়েছিল বার বার প্রশ্ন জাগছিল মনে, কোথায় চলে গেলো মেয়েটা? ছোটবেলায় এক মূহুর্ত কোথাও স্থির হয়ে বসতে চাইতো না নাবিহা সারাক্ষণই বাড়ি ভরে ঘুটঘুট করে ঘুরে বেড়াতো রাহাতও নাবিহার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো দুই ভাইয়ের তুলনায় সবকিছুতেই এগিয়ে ছিল নাবিহা কথা বলাও শিখে নিয়েছিল দেড় বছর বয়সেই জিহাদ আর জিশান যখন ভাংগা, ভাংগা শব্দ বলার চেষ্টা করতো নাবিহা তখন আঙুল নাচিয়ে ধমক দেয়াও শিখে ফেলেছিল পেছন পেছন হাঁটা খুবই অপছন্দ ছিল নাবিহার কয়েক কদম হাঁটতো আর পেছন ফিরে দেখতো রাহাত আছে কিনা দেখলেই চোখ বড় বড় করে মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে বলত, একতা ধমত যাও, যাও ধমত, ধমত আবার যদি পেছন ফিরে রাহাতকে না দেখতো কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলত, কই কই কই গেলো আমার বাব্বা রাহাত আড়াল থেকে বেড়িয়ে এলে নাবিহা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো কোলে মেয়ের ছোটবেলার স্মৃতি স্মরণে মনের সাথে সাথে চোখও ছলছল করে উঠলো রাহাতের অন্য রকম একটা টান অনুভব করে নাবিহাকে ঘিরে সবসময়ই হাত বাড়িয়ে দরজা নক করতেই নাবিহা ঘুরে তাকালো রাহাতকে দেখে হেসে সালাম দিয়ে বলল, বাবা এসো আমি ঘর গুছাচ্ছি জিশান আর জারিফ মিলে পুরো ঘর এলোমেলো করে রেখেছে মামণি দেখলে কষ্ট পাবে না বলো? তাই আমি গুছিয়ে রাখছি

সালামের
জবাব দিয়ে রাহাত হাসি মুখে বলল, তোমার মামণি জানালো তুমি নাকি নাস্তা আনতে যেয়ে হারিয়ে গিয়েছো। তাই তোমাকে খুঁজতে বেরিয়েছি।

আনন্দিত
কন্ঠে নাবিহা বলল, আমি ইচ্ছেই করেই নাস্তা নিয়ে বাইরে যাইনি বাবা। মামণিকে ভেতরে ঢোকাতে চেয়েছিলাম। মামণি কি এসেছে?

হুম
, এসেছে। তোমার মামণি কিচেনে। আমি কোন সাহায্য করবো তোমাকে?

না
বাবা সাহায্য লাগবে না। আমার গোছানো শেষ। তুমি জানো বাবা এই রুমের সব ডেকোরেশন পাপা আর মামণি মিলে করেছিল আমাদের জন্য। ওয়াল পেইন্টিং গুলোও দুজন মিলে এঁকেছিল। এমনকি এই রুমের সব ফার্নিচারও দুজন মিলে বানিয়েছে

রাহাত
হেসে বলল, হ্যা মা আমি জানি। কিন্তু তুমি জানো না যে, তোমাদের জন্য এসব ফার্নিচার বানানোর সময় আমিও সাথে ছিলাম।

বিস্ময়
ভরা কন্ঠে নাবিহা বলল, তুমিও পাপা, মামণির সাথে ছিলে?

রাহাত
হেসে বলল, উহু, শুধু তোমার পাপার সাথে ছিলাম। ইনফ্যাক্ট, তোমাদেরকে ওয়েলকাম জানানোর সব আয়োজনের সাথেই ছিলাম

কিভাবে
ছিলে? আমাকে বলো না বাবা প্লিজ। আমি শুনবো। উচ্ছাসিত আবদার জানালো নাবিহা

রাহাত
হাসি মুখে বলল, আমরা যেদিন তোমাদের আগমনী সংবাদ জেনেছিলাম সেদিন আনন্দের জোয়ার এসেছিল রিহ্যাব সেন্টারে কর্মরত সবার মনে। সেদিন কাজকর্ম সব বন্ধ করে আমরা শুধু আনন্দই করেছিলাম। পাকিস্তানী এক ভাই ছিলেন খুব ভালো মিষ্টি বানাতে পারতেন। সবাই মিলে উনার ডিরেকশনে মিষ্টি বানালাম। এরপর পুরো এলাকার সবাইকে ধরে ধরে মিষ্টি খাইয়েছি। যারা খেতে চায়নি তাদেরকে চেপে ধরে খাইয়েছি।

নাবিহা
খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল, পাপাও ছিল তোমাদের সাথে?

না
ভাইজান ছিলেন না। আমাদেরকে ফায়েজ ভাইয়া ফোন করে জানিয়েছিলেন। আসলে এখানে আসার মাস তিনেক পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তোমার মামণি। তোমার নানাভাই আর নানুমণি এসে তখন সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। এর এক সপ্তাহ পর আমরা জেনেছিলাম আমাদের রাজকন্যা নাবিহার আগমনী বার্তা।

নাবিহা
হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম মামণি এখানে ছয় মাস ছিল।

হ্যা
ছয়মাসই ছিল। তবে একটানা ছয় মাস নয়। প্রথমবার এসে তিন মাস ছিল। এরপর অসুস্থতার কারণে চলে গিয়েছিল। দুই মাস পর আবার এসে তিন মাস ছিল এখানে। তোমাদের জন্য এইসব আয়োজন পরের সেই তিন মাসে করেছিল।

তুমি
কিভাবে সাথে ছিলে?

রাহাত
হেসে বলল, আমি তোমার পাপার সাথে ছিলাম। জানো, ঐসময় মাগরীবের নামাজের পর খোলা আকাশের নীচে বসে ভাইজান শুধু তোমাদেরকে ঘিরে উনার স্বপ্নকথনই শোনাতেন। ভাইজানের সেসব কথা শুনতে শুনতে আমাদের সবার মনে পিতৃ সত্ত্বা জেগে উঠেছিল। আমরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম অসাধারণ একজন বাবা হবার। ভাইজানের সবকিছুই জানা ছিল কিন্তু তবুও শিশুদের সঠিক ভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে নানান ধরণের কোর্স করতে শুরু করেছিলেন। কোর্সে যা যা শিখতেন সব আমাদেরকে শেখাতেন। সবচেয়ে মজা হয়েছিল যখন বেবী ফুডের কোর্স করেছিলেন। প্রতিদিনই ভাইজান বেবীফুড রান্না করতেন আর আমরা সবাই দল বেঁধে সেসব খেতাম। কয়েকজন ছিল একদম খেতে চাইতো না। ওদেরকে জোর করে চেপে ধরে খাওয়ানো হতো বেবী ফুড। এত আনন্দের ছিল আমাদের সেই দিনগুলো। মনেহলে এখনো হাসি ফুটে ওঠে মুখে।

এরপর
একদিন পাপা হারিয়ে গেলো তাই না? নাবিহার কন্ঠের বেদনা রাহাতের বুকের ভেতরটাও ভারী করে দিলো। এগিয়ে গিয়ে নাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, হুম, আর এক মূহুর্তেই বদলে দিয়েছিল আমাদের সবার জীবন। শুধু আনন্দবাড়ির সদস্যরাই নয়, আমাদের সংগঠনের প্রতিটি কর্মীও হাসতে ভুলে গিয়েছিল। ভাইজান আমাদের সবার জন্য ছায়াদানকারী বটবৃক্ষের মতো ছিলেন। ভাইজানের সাথে আমাদের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি ছিল না। কিন্তু উনি আমাদের সবার মনে পিতার স্থানে ছিলেন। অনেক ছোটবেলায় আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন। বাবার আদর-শাসন, নসিহত কেমন সেটা আমি ভাইজানের সাথে পরিচয় হবার আগে কোনদিন বুঝিনি। আমরা বড় ভাইয়ারাও বেশ ভালো মানুষ। কিন্তু তারা নিজেরাই জীবনের মূল গন্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞাত। আমার চিন্তাভাবনাও তাই দুনিয়া কেন্দ্রিকই ছিল। আমার মা ইচ্ছে ছিল তাই ভাইয়ারা আমাকে হিফজ করিয়েছিলেন। কিন্তু কুরআন তখন শুধু আমার মুখে ছিল। কুরআনকে বুকে ধারণ লালন করার শিক্ষা আমি ভাইজানের কাছে পেয়েছিলাম। ভয়ংকর সংবাদ আমারো মেনে নিতে অনেকদিন লেগেছিল। রিহ্যাভ সেন্টারের উদ্বোধন ভাইজান থাকতেই হয়েছিল। কিন্তু টুকটাক অনেক কাজ তখনো বাকি ছিল। আমরা যারা কাজ করতাম বিকেল হলেই মনে হতো এখনই বুঝি ভাইজান আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে হাজির হবেন। মাগরীবের নামাজের পর আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকতাম। খুব কষ্টের ছিল সেই দিনগুলো আমাদের।

তারপর
ধীরে ধীরে তোমরা সবাই পাপাকে ভুলে গিয়েছিলে?

রাহাত
হেসে বলল, আমরা কেউ কখনোই ভাইজানকে ভুলে যাইনি মা। তুমিই বলো তোমার পাপা কি ভুলে যাবার মতো মানুষ?

কক্ষনো
না। খুব জোড়ের সাথে বললো নাবিহা

আলহামদুলিল্লাহ
সেজন্যই আমরাও কক্ষনো ভাইজানকে ভুলে যাইনি। জানো জিহাদ, জিশান আর তুমি যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলে আমরা সবাই দল বেঁধে তোমাদেরকে দেখতে গিয়েছিলাম। পুরো হসপিটাল ভরে গিয়েছিল মানুষে। বাধ্য হয়ে আদী ভাইয়া বাইরে বিশাল স্ক্রিন লাগিয়ে দিয়েছিল। সরাসরি দেখতে না পেলেও সেদিন তোমাদের লাইভ ভিডিও দেখেছিলাম

তোমাকেও
ভেতরে ঢুকতে দেয়নি? কেন দেয়নি? আদীব্বাকে ধমক দিতে হবে আজই।

রাহাত
হেসে ফেললে নাবিহাও হেসে বলল, বাবা তুমি আমাকে প্রথম কবে কোলে নিয়েছিলে?

তোমাদের
যখন সাত মাস বয়স তখন একদিন আদী ভাইয়া তোমাদের তিনজনকে নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছিলেন। সেদিনই প্রথম কোলে নিয়েছিলাম তোমাকে।

আচ্ছা
তুমি যখন মাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে তখন ভয় লাগেনি বিয়ের কথা বলতে? দুষ্টুমি মাখা স্বরে প্রশ্ন করলো নাবিহা।

এটা
তো টপ সিক্রেট প্রশ্ন মা। এটার জবাব তো দেয়া যাবে না।

প্লীজ
বাবা বলো না আমাকে। আমি কাউকে বলবো না প্রমিস। জেন্টাল ওম্যান প্রমিস। প্লীজ প্লীজ

আমিও
কাউকে বলবো না প্রমিস। জেন্টাল ওম্যান প্রমিস। বলো না প্লীজ। কথা শুনে পেছন ফিরে নূহাকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে রাহাত আর নাবিহা দুজনই হেসে ফেললো। নূহা চেহারায় কৃত্রিম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বলল, এখনই এক চোট বোঝাপড়া হয়ে যেতো আপনার সাথে। কিন্তু ডাক এসেছে আপনার নদীতে সুইমিংয়ে যাওয়ার। বড় পুত্র বাগানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। যান রাতে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

রাহাত
হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলে নাবিহা বলল, কেন তুমি আমার বাবাকে থ্রেট দিচ্ছো শুনি তো একটু? তুমি কি কোনদিন কিছু জানতে চেয়েছো আমার বাবার কাছে?

হায়
আল্লাহ! কি নিষ্ঠুর একটা মেয়ে দিয়েছেন আমাকে। কখনো সে পাপার চামচ, তো কখনো বাবার। মায়ের তো কোন মূল্যই নেই এই মেয়ের কাছে।

নাবিহা
ছুটে এসে নূহাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওহো মামণি তুমি বোঝো না কেন এভাবেই তো দুষ্টু পাপা আর বাবাদেরকে বশে রাখতে হয়। তোমার কাছ থেকেই শিখেছি আমি এই বুদ্ধি।

নূহা
হেসে বলল, অনেক দুষ্টু হয়েছে তুমি বুঝেছো?

হুম
, আমি তোমার মেয়ে না, দুষ্টু না হলে কি হবে? মামণি দেখো আমি রুম গুছিয়েছি। সব পারফেক্ট কিনা বলো?

উহু
, তুমি যদি আমার পাশে না দাঁড়িয়ে থেকে কটে শুয়ে হাত-পা নেড়ে খেলা করতে তাহলে সবকিছু পারফেক্ট হতো।
নাবিহা হেসে বলল, আমি শুতে গেলে কট ভেঙে যাবে। নয়তো এক্ষুণি শুয়ে হাত-পা নেড়ে দেখাতাম তোমাকে। আচ্ছা মামণি তুমি দেখো সবকিছু ঠিক আছে কিনা। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি তোমার জন্য। এবার হারিয়ে যাবো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিয়ে আসছি নাস্তা ইনশাআল্লাহ।

নাবিহা
বেরিয়ে যাবার পর পুরো রুমে চোখ বুলালো নূহা। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো বাচ্চাদের প্রতিটা জিনিস। একসাথে সমস্ত ভাবনারা কেমন যেন জমাট বেঁধে গিয়েছিল। আলাদা করে তাই কোন কিছুই অনুভব করতে পারছিল না নূহা। মনের এই দমবন্ধকর অবস্থার নিরসনে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পর্দা গুটিয়ে মৃদু ঢাক্কায় খুলে দিলো জানালার কপাট। জানালার ওপাশের বাড়িটাই মুনাদের। মুনা প্রায় সারাক্ষণই বারান্দায় বসে থাকতো। এই জানালায় দাঁড়িয়ে অনেক সময় ঈশারায় কথা বলেছে মুনার সাথে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নূহার। জাওয়াদ খুব সুন্দর করে মুনার আচরনের ভারসাম্যহীনতার কথা বুঝিয়ে বলেছিল। কিন্তু তবুও বিষয়টা জানার পর কেমন যেন থমকে গিয়েছিল নূহার চিন্তা চেতনা। যে মুনাকে চেনে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না সেই মুনার সাথে জাওয়াদের বলা মুনাকে। এত অল্প সময়ে মনের এতখানিক কাছে খুব কম মানুষই আসতে পেরেছিল না আসতে দিয়েছিল। মানুষের চেহারা দেখে কখনোই তাকে পছন্দ করতো না নূহা। তার কাছে সবসময়ই মানুষের কথা, কাজ, আচরণ সর্বোপরি উন্নত মানসিকতা গুরুত্বপুর্ণ। কিন্তু সেই দুই মাসে একবারও নূহার মনে হয়নি মুনা তাকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাচ্ছে। আন্তরিকতার কোন কমতি কখনোই অনুভব করেনি মুনার কোন কথা বা আচরণে। আবার এটাও ঠিক মুনা সারাক্ষণই এমন সব প্রসঙ্গ তুলতো যাতে নূহা বাধ্য হতো জাওয়াদের কথা বলতে। খুব কৌশলে মুনা তার কাছ থেকে ধীরে ধীরে জাওয়াদের পছন্দ অপছন্দ জেনে নিয়েছে। মানুষের চরিত্রের কেমন দ্বিমুখীতা? এজন্যই কি বলে ছায়া দেখলেও তেড়ে মারতে আসে এমন শত্রুর চেয়েও বন্ধুর খোলসে থাকা শত্রু হাজার গুণ বেশি ভয়ংকর? কেননা মিষ্টি কথা সুন্দর ব্যবহারের কারণে এদের ব্যাপারে সাবধান হবার কোন সুযোগ থাকে না।

@

জাওয়াদের
কাছ থেকে জানার পর একটি একটি করে মুনার প্রতিটি আচরণের উপর থেকে খোলস ঝরে পড়তে শুরু করেছিল নূহার চোখের সামনে। স্বামী সংসার নিয়ে কথা বলতে খুব আনন্দ তৃপ্তি পায় মেয়েরা। আর এই সুযোগটাই হয়তো কাজে লাগিয়েছে মুনা। খুঁচিয়ে খুটিয়ে একটু একটু করে জেনে নিয়েছে ওদের জীবনের অনেক কিছু। বিশেষ করে জাওয়াদের ব্যাপারে। প্রথম যেদিন বাসায় এসেছিল মুনার ড্রেসআপ দেখে নূহার নিজেরই লজ্জা লাগছিল। কিন্তু সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই মুনা যখন পর্দা করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল নূহা। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহ দেখানো শুরু করেছিল। কয়েকদিন এসে বইও নিয়ে গিয়েছে নূহার কাছ থেকে। মুনাকে যেদিন নামাজের ব্যাপারে বলেছিল খুবই আগ্রহ আন্তরিকতার সাথেই মেনে নিয়েছিল। শরীয়ত ভিত্তিক জীবনযাপন জাওয়াদ আর নূহার দুর্বলতা বলেই কি এত আগ্রহ দেখিয়েছিল মুনা? ভাবতেই মনের ভেতরটা কেমন তিক্ত হয়ে উঠলো। একটা মেয়ে কিভাবে আরেকটি মেয়ের সুখের সংসার নষ্ট করার চিন্তা করতে পারে? আর সে নিজেই বা কিভাবে এতটা বেখেয়ালী হয়ে পড়েছিল? জাওয়াদের মনে যদি আল্লাহর ভয় না থাকতো তাহলে কি হতো? উফ, আর ভাবতে পারলো না নূহা।

কাঁধে
হাতের স্পর্শ পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে চেহারায় হাসি টেনে জাওয়াদের দিকে তাকালো নূহা। জাওয়াদ ঘুরে এসে নূহার সামনে বসলো। নূহার হাত ধরে বলল, বুঝতে পারছি সব শোনার পর মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার।
আমি কেন কিছু বুঝতে পারলাম না মুনার আচরণ থেকে ভেবে উঠতে পারছি না

বুঝতে
পারোনি এটা তোমার উদারতা। তোমার সহজ, সুন্দর পবিত্র মনের পরিচয়। কিন্তু তুমি সবাইকে তোমার নিজের মতই ভাবো এটা অবশ্যই তোমার উদাসীনতা ছিল। আমি তোমাকে যথেষ্ট সজাগ, সচেতন সাবধানী মেয়ে মনে করতাম নূহা। কিন্তু তুমি খুবই আবেগী এবং অবিবেচক। আমার কথায় কষ্ট পেয়ো না আবার।

আমি
একটুও কষ্ট পাচ্ছি না। তুমি তো ভুল কিছু বলছো না। যা সঠিক তাই বলছো। আমি অবশ্যই অবিবেচক। তা না হলে কেন মুনার মত আল্ট্রা মর্ডান একটি মেয়ে এত সহজে নিজের লাইফ স্টাইল চেঞ্জ করে ফেলতে রাজী হয়ে যাচ্ছে! সেটা একটু হলেও ভেবে দেখার চেষ্টা করতাম। সত্যি বলতে আমার মনে এই ধরণের কোন চিন্তা আসেইনি

আমিও
তো সেটাই বলছি তোমাকে। আসলে তুমি যখন বিপথে চলা একটা মেয়েকে সঠিক পথে ফিরে আসার ব্যাপারে আগ্রহ পোষণ করতে দেখেছো। তখন তোমার চিন্তার সবটুকু দিয়ে তাকে কিভাবে সাহায্য করা যায় সেই পন্থা খোঁজার চেষ্টা করেছো। তুমি মুখে বলার চাইতে করে দেখানোতে বিশ্বাসী। তাই তোমার উদারতা, স্বভাবগত সুন্দরতা দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়েছো। প্রতি মূহুর্তে উৎসাহ দেবার চেষ্টা করেছো। তুমি মুনার মাঝে বিদ্যমান ক্রুটি সমূহকে দূর করার চেষ্টা করছিলে। তাই ওর আচরণগত ত্রুটিগুলোকে সেভাবে খেয়াল করোনি। মনেআছে তোমার অবর্তমানে যেদিন মুনা বাসায় এসেছিল। তোমাকে বলেছিলাম আমি ওকে ঢুকতে দিতে চাইনি কিন্তু খানিকটা জোড় করেই ঢুকেছে। এবং যখন কথা বলার চেষ্টা করছিল আমি তখন বাগানে এসে বসেছিলাম। এবং তুমি আসার আগ পর্যন্ত আমি বাগানেই ছিলাম। তোমাকে যখন এই কথা বলেছিলাম তুমি মোটেই নেতিবাচক ভাবে নাওনি। বরং আমাকে বুঝ দেবার জন্য বলেছিলে, মুনা আসলে শরীয়তের বিধি নিষেধ তেমন একটা জানে না। ধীরে ধীরে আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু মুনা যদি আত্মসংশোধন করতে চায় এমন মনোভাব তোমার কাছে পোষণ না করতো তুমি কিন্তু এই আচরণটিকে এতটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারতে না। এতটা উদার হতে পারতে না মুনার ব্যাপারে। এবং সেটা মুনা বুঝতে পেরেছিল বলেই এই জিনিসটিকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে

হুম
! এখন আমিও সেটা উপলব্ধি করছি

এটা
শুধু উপলব্ধির বিষয় না নূহা। ঘটনাটি কিন্তু অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষার সংমিশ্রণ আমাদের জন্য। প্রথমত, কারো জন্যই এত দ্রুত মনের দরজা খুলে দেয়া ঠিক নয়। হুট করে কাউকে ভালো লেগে যেতেই পারে। কিন্তু তাকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেবার আগে অবশ্যই যাচাই, বাছাই বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, পরিচয়ের সাথে সাথে কারো কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়া যেমন ঠিক না। তেমনি পছন্দ ভালোলাগার কথাও বুঝতে দেয়া উচিত নয়। এতে করে পছন্দ ভালোলাগাতে ব্যবহার করে যে কেউ অতি সহজেই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়ে যায়। তৃতীয়ত, কেউ আমাদেরকে তখনই ধোঁকা দিতে পারে যখন আমরা নিজেরা তাদেরকে বিশ্বাস করে সেই সুযোগটা দেই। তাই নতুন হোক বা পুরনো সব সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্ধভক্তি, অন্ধবিশ্বাস সর্বদা পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত।

নূহা
মুখ ভার করে বলল, আমার আর এখানে থাকতেই ইচ্ছে করছে না। তুমি অন্য কোথাও বাসা দেখো। মুনার কথা মনে হলেই মেজাজ বিষিয়ে উঠছে। জানি না সামনে এলে ওকে আমি কি না কি বলে ফেলবো।

জাওয়াদ
হেসে বলল, তুমি কিছুই বলতে পারবে না। সামনে এলে ঠিকই হাসিমুখে কথা বলবে। এতদিনে এইটুকু তো তোমাকে আমি বুঝেই নিয়েছি। তুমি জানো বেশির ভাগ পুরুষকে মেয়েদেরকে এক কথায় ডিফাইন করতে বললে তারা কি বলে?

মে
বি জেলাসী

হ্যা
জেলাসী। কিন্তু আমার কি মনেহয় জানো? প্রতিটা আবেগেই নেতিবাচক ইতিবাচক দুটি দিকই বিদ্যমান। ভালোবাসার মত সুন্দর একটি আবেগ যেমন কারো কারো ভুল আচরণের কারণে পবিত্রতা হারাতে পারে। ঠিক তেমনি ঈর্ষার মতো ক্ষতিকর আবেগও সঠিক মাত্রায় ব্যবহারের কারণে সম্পর্কের মাঝে বিদ্যমান ভারসাম্যকে বজায় রাখতে সহায়তা করে। ঈর্ষাকে আগুনের সাথে তুলনা করা হয়। বলা হয় ঈর্ষা হচ্ছে এমন এক আগুন যা জ্বলে নিজেকে ক্ষয় করে। ঠিক যেমন আগুনের স্পর্শে মোমবাতি ক্ষয় হতে থাকে ধীরে ধীরে। ঈর্ষাও তেমন ক্ষয় করে দেয় সম্পর্ককে
তাহলে যে তুমি বললে ঈর্ষাও ভালো দিক আছে

কথা
শেষ করার আগেই মাঝখানে প্রশ্ন করলে তো সমস্যা। প্রশ্ন করার আগে জেনে নিতে হবে অপর পক্ষ তার বক্তব্যের শেষ শব্দটি বলে সমাপ্ত করেছে কিনা

নূহা হেসে বলল, উফফ, এত্তো লেকচার দিচ্ছো কেন তুমি আজ? বলো কি বলবে শুনে ধন্য হই

মনে
আছে এখানে আসার দুতিন দিন পর সারারাত আমরা দুজন বাগানে বসে গল্প করেছিলাম? বেশ ঠান্ডা ছিল সেদিন। আগুন জ্বেলে তার পাশ ঘেঁষে বসেছিলাম দুজন। আশেপাশের বাসা থেকে যাতে কেউ আমাদেরকে স্পষ্ট দেখতে না পায় সেজন্য বাগানের আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা নিরাপদ দুরুত্বে ছিলাম বলে সেদিন কিন্তু আগুন আমাদেরকে জ্বালাতে পারেনি। বরং উষ্ণতা এবং সাথে আলোও দিয়েছিল। আসলে আগুন তো শুধু জ্বালায়- পোড়ায়ই না, আগুন উত্তাপ দেয়, আলোও ছড়ায়। এমন উত্তাপ আর আলো ছড়ানো আগুন রূপি ঈর্ষা থাকাটা তাই খারাপ নয় বরং দরকার

কিন্তু
সেজন্য তো নিরাপদ দুরুত্বে থাকতে হবে। বাস্তবের আগুন চোখে দেখা যায় তাই সাবধান থাকা সম্ভব হয়। কিন্তু মনের আগুন তো অদৃশ্য। সেটা থেকে নিরাপদ দুরুত্বে থাকাটা কি এতটা সহজ হবে?

না
মোটেই সহজ হবে না। এরজন্য অনেক সাধনা অনেক অনুশীলনের প্রয়োজন পড়বে। আর একথা তুমি নিশ্চয়ই জানো কোন কিছুকে আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে অনুশীলন কখনোই যথেষ্ট হয় না। অনুশীলনের লাল ফিতা বলে কিছু নেই। সাফল্য অর্জন করার চেয়ে টিকিয়ে রাখাটাই বেশি কঠিন। আর সেজন্য সবসময় অনুশীলন জারি রাখার কোন বিকল্প নেই। সুখী দাম্পত্য জীবনও তো অনেক বড় একটা সাফল্য তাই না? এরজন্য তো তাই সর্বদা আমাদেরকে অনুশীলন জারি রাখতে হবে। একে অপরকে সাহায্য করতে হবে। একজন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লে অন্যজনকে আবহাওয়া বুঝে কখনো পাইনাপেল জ্যুস, কখনো বা ধূমায়িত কফি নিয়ে হাজির হতে হবে। বুঝেছেন?

নূহা
হেসে বলল, উমম... আই লাভ পাইনাপেল জ্যুস এন্ড কফি

জাওয়াদ
নূহাকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, এন্ড আই লাভ। অনলি ইউ।

জাওয়াদকে
দূরে সরিয়ে দিতে দিতে নূহা বলল, আমার এখন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন ঘুমোতে যাব।
জাওয়াদ হেসে বলল, কোন সমস্যা নেই। একাধীক স্টাইলের ঘুম ভাঙ্গানিয়া গান জানা আছে আমার। পুরোনো কোন একটা শুনবে নাকি নতুন কিছু ট্রাই করবো সেটা শুধু বলে দাও তুমি!

জাওয়াদ
আর নূহার ছোট্ট সুখের নীড়ের আকাশ জুড়ে বিন্দু বিন্দু যে কালো মেঘ ঘনীভূত হতে শুরু করেছিল। দুজনের সম্মিলিত হাসির মূর্ছনায় ভালোবাসার রিমঝিম বরষা সাজে নেমে এলো অঝোর ধারায়


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন