মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...৯



দূর থেকেই রাস্তায় কেউ একজন পায়চারী করছে দেখতে পেয়েছিল জাওয়াদ। পাশে গাড়ি দাঁড়ানো দেখে আন্দাজ করতে পেরেছিল হয়তো গাড়িতে কোন সমস্যা হয়েছে। মফস্বল এলাকা তাই সন্ধ্যার পর থেকেই গাড়ি চলাচল একদম কমে যায় এদিকটায়। চলার পথে হঠাৎ কোন সমস্যা হলে সাহায্য পাওয়াটা বেশ কঠিন। ফোন করে সাহায্যকারী কাউকে ডেকে আনতে হয়। দুরুত্ব আরো কিছুটা কমার পর পায়চারী করতে থাকা ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে হাসি ফুটে উঠলো জাওয়াদের মুখে। ততক্ষণে পায়চারী করতে থাকা পথচারীও জাওয়াদের গাড়ি দেখতে পেয়ে ছুটে এলো। জাওয়াদ জানালার গ্লাস নামিয়ে দিতেই হাসিমুখে বলল, আমি কি লিফট পেতে পারি? আমার গাড়ি বিনা নোটিশে হার্টফেল করেছে।

জাওয়াদ বলল, লিফট দিতে আমার তেমন কোন আপত্তি নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, উপকার করতে গিয়ে আবার বিপদে পড়বো নাতো? যাকে লিফট দিচ্ছি সেই আবার লিফট হয়ে আমাকে উপরে পৌঁছে দেবে নাতো? ছোট ছোট চারটা মাসুম বাচ্চা আছে আমার। তাই অনেক হিসাব করে পথ চলতে হয়।

ভয় নেই ভাই। আমি একজন ঈমানদার মুসলিম। আর উপকারীর অপকার করার চিন্তা করাও অসম্ভব একজন ঈমানদারের পক্ষে। কারণ সে বিশ্বাস করে তার প্রতিটা অ্যাকশন লিখিত হচ্ছে এবং যার জবাবদিহি করতে হবে একদিন।

জাওয়াদ বলল, তাহলে এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ভ্রাত? আসুন আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর পথে আপনাকেও নাহয় পৌঁছে দেব আপনার কাঙ্ক্ষিত স্থানে ইনশাআল্লাহ।

গাড়িতে উঠে বসে হাসতে হাসতে আদী বলল, বেশ নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেলো আজ। তাই না?

হুমম, তবে জীবনের টুইস্টের মোকাবিলার নাটক সিনেমার ট্র্যাজেডির বিশাল বিশাল প্যাকেজ ফ্লপ হয়ে যায় ভ্রাত। সেই তুলনায় এটা তো কোন ঘটনাই না। চলার পথে গাড়ি নষ্ট হতেই পারে। আর যেহেতু বাড়িতে যাবার পথ এই একটাই। পরিবারের কাউকে না কাউকে সাহায্যকারী হিসেবে পেয়ে যাওয়াটাই বরং স্বাভাবিক।

আদী হেসে বলল, তাও অবশ্য ঠিক। তবে সত্যিই আজ আবারো ট্র্যাজেডির মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল জীবন। বৌকে বলেছিলাম ডিনার করাতে নিয়ে যাব। পথে গাড়ি নষ্ট হলো। সেলফোন বের করে দেখি চার্জের অভাবে যায় যায় অবস্থা। তাইয়্যেবাকে আমার অবস্থা সম্পর্কে অবগত করে বাড়ি থেকে কাউকে দিয়ে গাড়ি পাঠাতে বলার জন্য ডায়াল করতে না করতেই ফোন বন্ধ হয়ে গেলো। আশেপাশে কোথাও টেলিফোন বুথ নেই সেটা জানা আছে। গাড়ি থেমে থাকা অবস্থায় আমি ভেতরে বসে থাকতে পারিনা। বাইরে বেরোতে যেয়ে খেয়াল করলাম জ্যাকেট হসপিটালে ফেলে এসেছি। কিন্তু ভেতরেও বসে থাকতে পারছিলাম না। বাইরের প্রচণ্ড ঠান্ডায় চিন্তা করার ক্ষমতাও যখন প্রায় জমে যাচ্ছিলো আল্লাহ সাহায্যকারী রুপে তোকে পাঠিয়ে দিলো। আলহামদুলিল্লাহ তোর গাড়ি দেখা মাত্রই শরীর ও মনের কম্পন থেমে গিয়েছিল।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আপনজন, কাছের মানুষদের এটাই তো ম্যাজিক। বিপদের সময় আপন কাউকে দেখলে মন স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু অচেনা কাউকে দেখলে আরো অস্থির হয়ে ওঠে। যেমন, আমার গাড়ি না দেখে যদি অপরিচিত কোন গাড়ি দেখতি অনেকগুলো প্রশ্ন মনে উঁকি দিতো। অপরিচিত কারো কাছে লিফট চাওয়া উচিত হবে কিনা? লিফট দিতে রাজী হবে কিনা? ভালো মানুষ কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি।

আদী হেসে বলল, তা অবশ্য ঠিক। আপনজন, কাছের মানুষের ঘিরে কতটা নির্ভরতা, প্রশান্তি, স্বস্থি অনুভূতি সৃষ্টি করে দিয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের মনে। তাই না? অথচ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে আমরা সেই কাছের মানুষদের আঘাত করি, দূরে সরিয়ে দেই। বেশিরভাগ সময়ই বোধদয় হয় না যে, এরফলে নিজের একটি আশ্রয়ই হারিয়ে ফেলছি। তোর মনে আছে আব্দুল্লাহ চাচাজান বলেছিলেন, তোমাদের বন্ধনের মাঝে যখন কোন কিছু দ্বন্দ্বের জন্ম দেবে। তখন সেই জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু নিজেদের বন্ধনে সেটার কোন প্রভাব পড়তে দেবে না।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ মনে আছে। চাচাজান আরো বলেছিলেন, যখন কাছের মানুষদের কেউ তার নিজ দায়িত্ব পালনের কথা ভুলে যায়। তখন হয় তার হয়ে কাজটা করে দিতে হবে, নয়তো তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে। এই মূহুর্তে তুমি যে কাজটা করতে ভুলে গিয়েছো সেটা আমার পক্ষে করে দেয়া সম্ভব হয়। সুতরাং, এই নাও ফোন।

আদী বলল, ফোন দিয়ে কি করবো? আর কি ভুলে গিয়েছি সেটাও তো মনে পড়ছে না।

জাওয়াদ বলল, তাইয়্যেবা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে তোর জন্য। ফোন দিয়ে জানিয়ে দে।

আদী হেসে বলল, ও হ্যা তাই তো! এক্ষুনি জানিয়ে দিচ্ছি। শুকরিয়া ভ্রাত। কল করে তাইয়্যেবাকে বিস্তারিত সবকিছু বলে ফোন রাখলো আদী।

টেনশনে ছিল খুব? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।

আদী হেসে বলল, কন্ঠস্বর শুনে তো মনেহলো মিশ্র আবেগের কারাবাসে ছিল এতক্ষণ। অবশ্য তাইয়্যেবার কোন দোষ নেই। অসংখ্যবার বাইরে ঘুরতে যাবার কথা দিয়েও কোন না কোন কাজে আঁটকে যাবার কারণে শেষপর্যন্ত কথা রাখতে পারিনি। তাই প্রথমেই হয়তো ওর মনে আজও কাজে আঁটকে গিয়েছি এমন চিন্তাই উঁকি দিয়েছে। যারফলে, দেরি হচ্ছে দেখে টেনশনের বদলে অভিমান মনে জমাট বাঁধাটাই স্বাভাবিক।

তোর কি মনেহয় না বাইরের মানুষের কাছে নিজেদের ইমেজ, রেপুটেশন ধরে রাখার ব্যাপারে আমরা যতটা কেয়ারফুল, ঘরের মানুষের ক্ষেত্রে ততটাই উদাসীন? আজ আমিও বাচ্চাদেরকে লাইব্রেরীতে নিয়ে যাবো কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ মূহুর্তে জরুরি একটা কাজে এসে যাওয়াতে ওদের সাথে প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেছি। আমি সাধারণত বাচ্চাদের সাথে এমনটা করিনা। বরং চেষ্টা করি বাইরের কাজের শিডিউল চেঞ্জ করার। আমরা আসলে ধরেই নেই যে, ঘরের মানুষেরা সমস্যাটা বুঝবে এবং মেনে নেবে। কিন্তু তারা যদি কখনো অবুঝ হতেও চায়, উল্টো তখন আমরাই আবার দোষারোপ করি তাদেরকে বুঝতে না চাইবার কারণে। এটাও কি একধরণের স্বার্থপরতা নয়? কাছের মানুষ বলেই কি তাদের উপর এই চাপিয়ে দেয়া, মেনে নিতে বাধ্য করা? এভাবেই ধীরে ধীরে কাছের মানুষদের কাছে আমাদের কথা ও কাজের মূল্য কমতে থাকে। তাই হয়তো বাইরের জয়জয়কার, ঘরে ঢুকে বদলে যায় নিস্তব্ধতায়। বাইরের মানুষদের মুখে আমাদের কথা ও কাজের উল্লাসিত প্রশংসা শুনে ঘরের মানুষদের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে করুণ হাসি। তাদেরকে গোপন করতে হয় বেদনাক্ত দীর্ঘশ্বাস।

জাওয়াদ থেমে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ আদীও চুপ করে রইলো। এরপর বলল, তোর মনেআছে জাওয়াদ পরিবারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বাবা বলেছিলেন, আকাশ ছুঁয়ে দেবার স্বপ্নে বিভোর মানুষ উর্দ্ধপানে উড়তে গিয়ে প্রায় সময়ই সজোরে মুখ থুবড়ে নীচে ছিটকে পড়ে। এর কারণ এটা নয় যে, তাদের ডানাতে উড়ার শক্তি কম থাকে। আসল কারণ তাদের পায়ের নীচের মাটিটা খুব দুর্বল থাকে। তাই আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখার আগে তোমরা তোমাদের পায়ের নীচের মাটিটাকে শক্ত ও মজবুত করে নিও। তাহলে ঝড়ো হাওয়ার কখনো যদি উপরের ছাঁদ উড়েও যায়, নতুন করে গড়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু যদি জমিনই না থাকে, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আকাশে শুধুই ডানা মেলে উড়ার শান্তি ও মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশান্তিকর আশ্রয় জমিনের বুকেই।

জাওয়াদ হেসে বলল, হুম! প্রশান্তিকর আশ্রয় জমিনের বুকেই। বাইরের উল্লাসে মন আন্দোলিত হয়। কিন্তু ঘরের চিৎকার-চেঁচামেচিতেও প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে ওঠে যদি চিৎকারকে উহ্য করে তার উৎসের পানে দৃষ্টিকে প্রসারিত করা যায়।

সেটা কি রকম? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো আদী।

এই যেমন ধর বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই যদি আমার কন্যা ও পুত্ররা চিৎকার করে ঝগড়া জুড়ে দেয়। এর পেছনে কারণ তো এটাই থাকবে যে, আমি ওদেরকে ঘুরতে নিয়ে যাবার কথা বলেও নিয়ে যায়নি। ওদের নিশ্চয়ই অনেক প্ল্যান-প্রোগ্রাম ছিল ঘুরতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। আমার সাথে সময় কাটাবে, দুষ্টুমি করবে, বিরক্ত করবে, যন্ত্রণা দেবে। কিন্তু ওদের সব পরিকল্পনা বানচাল করে গিয়েছে আমার কারণে। এখানে ক্যালকুলেশন হচ্ছে, আমাকে ঘিরে প্ল্যান করা মাইনাস আমার কারণেই সেই প্ল্যান ভেস্তে যাওয়া =  আমার উপরেই সেই রাগ দেখানো। অর্থাৎ, ওদের রাইট আছে।

আদী হাসতে হাসতে বলল, তোর উচিত ছিল সাইকোলজি নিয়ে স্টাডি করা। নূহার মতো নিত্যনতুন ফর্মূলা উদ্ভাবনে তোরও তুলনা নেই। দুজন মিলে সাইকো ওয়াল্ডে নতুন যুগের সূচনা করতে পারতি।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তবে কথা হচ্ছে গিয়ে এই ক্যালকুলেশনটাও উনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন। কোন একটা কারণে উনি একদিন বাড়িঘর খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন। আমার উপর রাগ করে আবার সবকিছু এলোমেলো করেছিলেন। এরপর বলেছিলেন, তোমার জন্য আমি সারাদিন ধরে সবকিছু সাজিয়েছিলাম। তোমার কারণেই আবার সবকিছু নষ্ট করি। এখন তোমার দায়িত্ব হচ্ছে সবকিছু আবার সাজানো, গোছানো।

আদী হেসে বলল, শাস্তি মেনে নিয়েছিলি?

অবশ্যই মেনে নিয়েছিলাম। মনে নেই বাপী বলেছিলেন, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি হচ্ছে, সে যে নিজের ভুল ও দোষ বিনাদ্বিধায়, অকপটে স্বীকার করে নেয়। আলহামদুলিল্লাহ নিজের দোষ স্বীকার করে নেবার সাহসীকতা আমার সবসময়ই ছিল, আছে। আর প্রিয়জনদের অভিমান, অভিযোগের পেছনে মূলত ভালোবাসাই লুকায়িত থাকে। প্রিয়জনদের কাছে ক্ষমা চাওয়া, তাদের দেয়া শাস্তি মেনে নেয়াটাও তাই ভালোবাসারই প্রকাশ। তাছাড়া আমার সারাজীবনের সাধনা এটাই ছিল, আপনজনদের চোখে নিজেকে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। বাইরের মানুষদের মুখে প্রশংসার বাণী শোনার চেয়ে, ঘরের মানুষদের মুখে ছোট্ট কোন স্বীকৃতিই আমার পরম পাওয়া।

এমনটাই তো হওয়া উচিত। বুঝতে পারছি আমাকে আরো সিরিয়াস হতে হবে তাইয়্যেবার চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে। আসলেই আমরা ধরেই নেই ঘরের মানুষ বুঝবেই। কিন্তু একতরফা কত বুঝবে একজন মানুষ? তাছাড়া সবসময় কেন বাইরের মানুষ বা কাজই ফার্স্ট প্রায়োরিটি পাবে আমাদের কাছে? প্রিয়জনদের খুশির মূল্য তো সাথে কাজের কম্পিটিশন চলতে পারে না। প্রিয় ঐ মানুষগুলো আছে বলেই তো জীবন এখনো এত সুন্দর, এত সৌরভময়।

সুন্দর আর সৌরভের কথাতে মনে পড়লো। ফুল কোথায়? বৌকে ডিনারে নিয়ে যাচ্ছিস অথচ ফুল নেই হাতে? নাহ! তোকে দিয়ে কিছুই হবে না। শুধু মন নিয়ে গবেষণাই করে যাবি। নিজ জীবনে প্রয়োগ করা শিখবি না।

আদী হেসে বলল, সত্যিই আমি ফুল নেবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ভুলে গিয়েছি। এখন তো আফসোস করেও লাভ নেই। কোথাও ফ্লাওয়ার শপ খোলা পাবো না।

প্রেমিকদের এত অল্পে হাল ছেড়ে দিতে নেই ভ্রাত। পবিত্র ভালোবাসা তো অপরাজিত বীরের ভূমিকা পালন করে জীবনে। শুধু ইচ্ছে ও চেষ্টার সংমিশ্রণ প্রয়োজন হয় যে কোন বাঁধাকে অতিক্রম করার জন্য।

কিন্তু আমার মাথাতে তো কোন বুদ্ধিই আসছে না। মাইনাস টেম্পারেচারে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে মনেহয় বুদ্ধি জমে গিয়েছে।

জাওয়াদ বলল, দুর্বুদ্ধি তো জমেনি। অবশ্য জমবেই বা কিভাবে? দুর্বুদ্ধিকে যথাযথ ও পর্যাপ্ত উত্তাপ দিয়ে স্বাভাবিক রাখার কাজ শয়তান নিষ্ঠার সাথে পালন করে যায়। কোন গড়িমসি, হেলাফেলা, অলসতা করে সে না। ভদ্রতা শিখেছি অভদ্রের কাছ থেকে এমন একটা বাণী আছে মনেহয়। তার জের ধরে বলা যায়, নিষ্ঠার সাথে নিজ কাজের পেছনে লেগে থাকা আমাদের শয়তানের কর্মকান্ড অনুভব করে শেখা উচিত।

আদী হেসে ফেললে জাওয়াদও হাসলো। কিছুক্ষণ দুইভাই মিলে মনের আনন্দে হাসির ফোয়ারা ছোটানোর পর জাওয়াদ বলল, নাহিবাকে ফোন দিয়ে বল তাইয়্যেবার জন্য ফুলের তোড়া বানাতে। আমরা বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই বানিয়ে ফেলবে ইনশাআল্লাহ। এইসব কাজে আমার কন্যা তার মায়ের জেরক্স কপি।

আদী হেসে বলল, তাই তো! আমার কেন মনেহলো না নাবিহার কথা। এক্ষুনি ফোন করে বলছি। সেলফোন তুলে নিয়ে নাবিহাকে কল করে চাচীর জন্য ফুলের তোড়া বানাতে বললো আদী। এরপর দুইভাই মিলে গল্প করতে করতে তাদের আনন্দবাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি ছোটালো।

@

কফি নিয়ে টেরেসে এসে ফাতিমা ও সাবিরাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নূহা হাসি মুখে বলল তারপর কি সিদ্ধান্ত নিলে তোমরা? সন্ন্যাসীই হবে?

ফাতিমা হেসে বলল, না ম্যাম আমরা আলোকিত মানুষ হবো। নিজেরা আলোর পথে চলবো এবং অন্যদেরকেও আহ্বান জানাবো আলোর জগতে ইনশাআল্লাহ।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। দোয়া করি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তোমাদের উত্তম ইচ্ছেগুলোকে কবুল করে নিন।

একটু ক্ষণ চুপ থেকে ফাতিমা বলল, আসলে ম্যাম জীবনে নানান ধরণের কষ্টের মধ্যে সবচেয়ে বড় একটা কষ্ট ছিল, নিজের মনের কথাগুলো কাউকে মন খুলে বলতে না পারার কষ্ট। নিজের ভেতর ঘুমড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আমি খুব ভালো মতো বুঝেছি। আলহামদুলিল্লাহ যেদিন থেকে আপনাকে নিজের মনের না বলা কথাগুলো বলতে শুরু করেছিলাম, মন থেকে কষ্টের স্তূপ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল। এখন অনেক হালকা লাগে নিজেকে। চিন্তার দিগন্তও প্রসারিত হয়েছে অনেকখানিই। সাথে সাথে নিজ করণীয় ও বর্জনীয়র ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে শরীয়ত ভিত্তিক যে নির্দেশনা পেয়েছি, ইনশাআল্লাহ সেই আলোকে নিজের ভুলগুলোকে শুধরে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করবো এখন থেকে। কেন আমার পরিবার-পরিজন দুনিয়া নিয়ে মত্ত এটা নিয়ে আর অভিযোগ বা আহাজারি করবো না। শরীয়তের বিধান মেনে চলে না বলে তাদের সাথে আর মিসবিহেব করবো না। বরং সম্পর্কগুলোকে সুন্দর করার ইনশাআল্লাহ। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো সেটা বুঝতে পারছি না। এই ব্যাপারে তাই পরামর্শ চাই ম্যাম।

নূহা হেসে বলল, ছোটবেলায় খুব যত্ন করে যে কয়টা বিষয় আমাদেরকে শেখানো হয়েছিল তারমধ্যে মানুষের কথা বলার শক্তিও ছিল। ভাইয়া বলেছিলেন, প্রতিটা মানুষের কাছেই একটি করে পরশপাথর থাকে। যার ছোঁয়ায় সে বদলে দিতে পারে অনেক কিছুই। আর সেই পরশপাথরটি হচ্ছে, তার কথা। মানুষ জন্মসূত্রেই তার কথাতে ম্যাজিক পাওয়ার নিয়ে আসে। মানুষ জাদুর ছড়ির জন্য স্বপ্নায়িত হয়। ভাবে কতই না মজা হতো তারও যদি একটি জাদুর ছড়ি থাকতো। বেশির ভাগ মানুষ আসলে জানেই না তারও যে একটা করে জাদুর ছড়ি। যার পরশে আঁধারের বুকে সে দিয়া জ্বালাতে পারে। হতাশার নদীতে সাঁকো বানাতে পারে। অমাবস্যার রাতেও জোছনার শিশির ঝরাতে পারে। গোধূলি বেলাতে প্রভাতের স্বপ্ন আঁকতে পারে। ধূধূ মরুভূমির বুকে রিমিঝিমি বরষা সাজাতে পারে। মিথ্যার রাজ্যে সত্যের বাগিচা গড়তে পারে। সাদা ক্যানভাসের বুকে রঙের মেলা বসাতে পারে। মূলত, কথা বলাটাও বিশাল এক শিল্প। যারা শিল্পের প্রয়োগে শৈল্পিক ভাবে নিজ কথার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে পারে, তাদের কথার প্রভাবে আরো অনেক কিছুই সংঘটিত হতে পারে।

সাবিরা বলল, তারমানে সর্বপ্রথম আমাদের মুখের ভাষাকে সুন্দর ও সুমিষ্ট করতে হবে। তাই না ম্যাম?

হুম! তবে সবকিছুতেই ভালো ও মন্দ উভয় দিক বিদ্যমান। কথাও তাই মন্দ প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। অনেক সময় খুব সামান্য কারণেই ভীষণ রকম রোদেলা মনটা হঠাৎ করেই ঘন কালো মেঘের আড়ালে ঢেকে যায়। সেই খুব সামান্য কারণটি হচ্ছে, কারো কথা। তবে নেতিবাচক কথা। মনের আনন্দের প্রদ্বীপ শিখাকে দপ করে নিভিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে নেতিবাচক কথা। তারাভরা আকাশকে মেঘে ঢেকে দিতে পারে নেতিবাচক কথা। বসন্তের আনন্দ কোলাহলে ঝরাপাতার বিরহী সুর ছড়িয়ে দেয় নেতিবাচক কথা। লক্ষ্য পানে ছুটে চলা পথিককে গোলকধাঁধার ফাঁদে আঁটকে দেয় নেতিবাচক কথা। স্বপ্নালু আঁখিদ্বয়ের সম্মুখে নেতিবাচক কথা খুলে দেয় দুঃস্বপ্নের দুয়ার। ডুবিয়ে দেয় আকন্ঠ নিরাশার চোরাবালিতে। এবং আবারো প্রমাণ করে দিয়ে যায় কথার ক্ষমতা। কি ভয়ঙ্কর ক্ষমতা কথার তাই না? মনের প্রকৃতির আবহাওয়া-জলবায়ু-মৌসুম সবকিছু বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে কথা। মূহুর্তে ধ্বসিয়ে দিতে পারে মনের সিগন্যাল টাওয়ারকে। বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে মনকে সমস্ত জগত থেকে। আবার কথাই পারে অন্ধকার কুঠুরি থেকে বের করে নিয়ে এসে আলোর পথিক বানাতে। ভাইয়া আমাদেরকে কথার ক্ষমতা নিয়ে একটা কবিতা বলেছিলেন।

কি কবিতা ম্যাম? আমরা শুনতে চাই প্লীজ। আবদারের সুরে বললো সাবিরা।

নূহা হেসে বলল, “কথার ক্ষমতা নিয়ে নেই কোন সন্দেহ, না কোন সংশয়! পথহারা ভবঘুরের তরে কথা হতে পারে শান্তির আশ্রয়! আনন্দপুরীতে কথা বাজাতে পারে অবিশ্বাসের কুটিল ডংকা! বন্ধুকে রূপান্তরিত করে শত্রুতে করে দিতে পারে নিঃসঙ্গ একা! ভালোবাসার রেশমি সুতোতে অক্লান্ত বোনে সুখ-স্বপ্নের মূহুর্ত! কথাই আবার বন্ধনকে করে এলোমেলো দিয়ে যায় গভীর ক্ষত! অজান্তেই কেউ ইতিবাচক কথার প্রভাবে সুখের স্রোতে ভাসে!না বুঝেই আবার পথহারায় সে নেতিবাচক কথার জলোচ্ছ্বাসে!" তাই মানুষের কথার ক্ষমতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখাটা অতীব গুরুত্বপুর্ণ। তা না হলে কারো ইতিবাচক কথায় প্রভাবে আকাশে ডানা মেলতে না মেলতেই, হয়তো অন্য কারো নেতিবাচক কথার তীরে মুখ থুবড়ে ভূপতিত হতে হবে। বোঝাতে পেরেছি আমার কথা?

সাবিরা আর ফাতিমা দুজনই বলল, জ্বি ম্যাম।


নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে তোমরা আরো কিছুক্ষণ গল্প করে এরপর ঘুমোতে যাও। আমাকে জরুরি কয়েকটা মেইল চেক করতে হবে এখন। তবে কফি শেষ করতে করতে আরেকটু ক্ষণ গল্প করা যাক চলো। দুজনের সাথে বসে কফি শেষ করে নূহা উঠে নিজের রুমে রওনা দিলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন