সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...৫



আজাদ সাহেবের রুম থেকে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো জাওয়াদ ওভার রিঅ্যাক্ট হয়ে যাচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছিল কিন্তু কিছুতেই মেজাজে ভারসাম্য আনতে পারছিল না জিশানের ব্যাপারটা হয়তো মোটেও তেমন বড় কিছু নয় বুঝতে শেখার পর থেকে শরীয়তের আলোকে চলার পথের প্রতিটি বিষয় বাচ্চাদেরকে বোঝাতে শেখাতে চেষ্টা করেছে তাই এই ধরণের ঘটনাগুলো সামলে নেবার মতো বুদ্ধি বিবেচনা ওদের আছে তবুও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে যাবার মত সময় এখনো আসেনি অবশ্য নিশ্চিন্ত হয়ে বসে যাবার সুযোগ জীবনে আসেও না সাধারণত মানুষ ভুল-শুদ্ধের সীমানাতে দাঁড়িয়ে থাকে অসাবধানে বাড়ানো একটি কদমই যথেষ্ট চলার পথের গন্তব্য বদলে যাবার জন্য সেজন্যই বাড়তি সতর্ক থাকার চেষ্টা করে সবসময় তবে সেই বাড়তি সতর্কতা টুকুন সবসময় বাচ্চাদের সামনে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে কারণ বাচ্চারা যখন দেখতে পায় সামান্য কারণেই বাবা-মা অস্থির হয়ে যাচ্ছে তখন ঝামেলা এড়ানোর জন্য ছোটখাট ব্যাপারগুলো গোপন করতে শুরু করে কখনো বাবা-মাকে অকারণ টেনশন দিতে না চাইবার কারণে, কখনো বা নিজেই সামলে নিতে পারবে এমন চিন্তা থেকে চিন্তা যেটাই হোক ফলাফল একই, দুরুত্ব তৈরি হয়ে যাওয়া যে কয়েকটা বিষয়ে খুব স্পেশালি নূহাকে বলেছিল তারমধ্যে অন্যতম ছিল, কোন ভাবেই যেন তাদের সাথে বাচ্চাদের ইনফরমেশন গ্যাপ তৈরি না হতে পারে এতবার করে বুঝিয়ে বলার ফলেও যেভাবেই হোক ভুলটা নূহা করেছে সেজন্যই হয়তো এত বেশি রাগ হচ্ছিলো

পেছনে
হাসির শব্দ শুনে ঘুরে তাকালো জাওয়াদ। নাবিহা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। মেয়ের মুখের আনন্দিত হাসি জাওয়াদের রাগ উপশমের কাজ করে গেলো। হাসি ফুটে উঠলো জাওয়াদের চেহারাতেও। হাসি মুখে সালাম দিয়ে বলল, আমার আম্মাজান কেন হাসছেন?

সালামের
জবাব দিয়ে নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, দাদীর কাছে তোমার একটু বড়বেলার আর মামণির অনেক ছোটবেলার ভীষণ মজার একটা ঘটনা শুনেছি। সেটা মনে করে হাসছি।

জাওয়াদ
হেসে বলল, তাই? তা কি সেই ভীষণ মজার ঘটনাটা? আমিও তো একটু শুনি

না
না এখন বলা যাবে না। ভাইয়া আর জিশানকে সাথে নিয়ে এরপর বলবো। তারপর আমরা চারজন মিলে একসাথে হাসবো।
জাওয়াদ হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। জিশান কটেজেই আছে। তুমি যাও। আমি জিহাদকে নিয়ে আসছি।

ওকে
পাপা বলে নাবিহা ছুট লাগালো। নাবিহার আনন্দিত আত্মপ্রকাশের সাথে সাথেই জাওয়াদের মনের মেঘ কেটে গিয়ে নক্ষত্রের মেলা বসে গিয়েছিল। আর নূহার ছোটবেলার স্মরণ এই অমাবস্যার রাতেই কোত্থেকে যেন টুক করে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়ে গেলো জাওয়াদের মনে। কি অদ্ভুত যন্ত্রণাদায়ক একটা বাচ্চা ছিল নূহা মনে হতেই হেসে ফেললো। হাসি মুখেই লাইব্রেবীর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। জিহাদের খোঁজে লাইব্রেরীর দরজায় কাছে এসে ভেতরের দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো জাওয়াদ। দেখতে পেলো ছোট ভাই ফাহাদের চার বছর বয়সী ছেলে নাহিয়ান দুপা ছড়িয়ে একটা সেলফের সামনে বসে আছে। সেলফ থেকে অনেকগুলো বই নীচে নামিয়েছে। পাশে খেলনা জুসার মেশিন এবং সে বই থেকে পৃষ্ঠা ছিড়ে ছিড়ে চেপে চেপে জুসার মেশিনের মধ্যে ঢুকাচ্ছে। জাওয়াদকে দেখতে পেয়ে বিশাল একটা হাসি দিয়ে সালাম দিয়ে নাহিয়ান বলল, চাচ্চু আমি অরেঞ্জ জ্যুস খাবো না। অরেঞ্জ জ্যুস একটুও মজা না। বাব্বা বলেছে বই খেতে অনেক মজা। আমি তাই বইয়ের জ্যুস বানাচ্ছি। বেশি করে বানাচ্ছি ভাইয়াদের আর আপ্পিদেরকেও দেবো। বাকিটা ফ্রীজে রেখে দেবো পরে ওভেনে গরম করে খাবো। তাহলে আর ঠাণ্ডা লাগবে না কারো।

হাসি
চেপে সালামের জবাব দিয়ে নাহিয়ানের কাছে গিয়ে বসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে জাওয়াদ বলল, বইয়ের জ্যুস? ওয়াও। তা কি কি বইয়ের জ্যুস বানাচ্ছে আমার বাবাটা?

আনন্দে
গদগদ হয়ে নাহিয়ান বলল, কমিকসের জ্যুস। চাচ্চু তুমি খাবে?

জাওয়াদ
হেসে বলল, আমার নাহিয়ান বাবা সোনাটা এত কষ্ট করে এত মজার জ্যুস বানাচ্ছে। চাচ্চু কি না খেয়ে পারে?

নাহিয়ান
তখন জ্যুসের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য আরো কয়েকটা কমিকস হাতে নিলো। জাওয়াদ ওর হাত ধরে বলল, বইয়ের জ্যুস বানানোর বুদ্ধিটা আমার বাবাটা কোথায় পেলো?

বাব্বা
বলেছে বই পৃথিবীর সবচেয়ে মজার খাবার।

জাওয়াদ
হেসে বলল, বাব্বা একদম ঠিক বলেছে। বই এই পৃথিবীর সবচেয়ে মজার খাবার। কিন্তু বাব্বা তোমাকে এটা বলতে ভুলে গিয়েছে বই পেটের না মনের খাবার। নাহিয়ান বেশ বড় বড় চোখ করে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। জাওয়াদ আদর করে হেসে বলল, মনে আছে চাচ্চু যে তোমাকে বলেছিলাম ফল, দুধ, সবজি, মাছ ইত্যাদি খেলে কিভাবে তোমার শরীর অনেক শক্তিশালী হবে?

নাহিয়ান
মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, হু, মনে আছে তো। মাছ, দুধ, সবজিতে অনেক ভিটামিন আছে।
হ্যা। ঠিক তেমনি বইয়ের ভেতরও অনেক ভিটামিন আছে। বেশি বেশি বই পড়লে তোমার মন অনেক শক্তিশালী হবে। কিন্তু সেজন্য বই জ্যুস বানিয়ে খাওয়া লাগবে না। বই পড়তে হবে বেশি বেশি তাহলেই তোমার মনের খাওয়া হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছো বাবা?

ছিঁড়ে
ফেলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে নাহিয়ান বলল, এগুলো তাহলে কি করবো?

জাওয়াদ
হেসে বলল, দেখি কি করা যায় এগুলো নিয়ে। কিন্তু তুমি আর কখনো বই ছিঁড়বে না কেমন সোনা! বই ছিঁড়তে হয় না। কেন জানো? কারণ বই আমাদের উপকারী বন্ধু। ভেবে দেখো বই তোমাকে কত সুন্দর সুন্দর গল্প বলে। তাই না?

হ্যা।
মাথা ঝাঁকিয়ে বললো নাহিয়ান।

জাওয়াদ
হেসে বলল, এখন তাহলে তুমি আম্মুর কাছে যাও। জিহাদ যাও নাহিয়ানকে দিয়ে এসো।

এতক্ষণ
হাসি মুখে চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল জিহাদ। পাপার আদেশ পাওয়া মাত্র নাহিয়ানকে কোলে তুলে নিয়ে দিয়ে এলো চাচীর কাছে। আবারো লাইব্রেরীতে ফিরে এসে দেখতে পেলো পাপা ছেঁড়া বই সরিয়ে, বাকি সব বই সেলফে গুছিয়ে রাখছে। জিহাদও এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা বই হাতে তুলে নিয়ে বলল, আই এম সরি পাপা।

জাওয়াদ
হেসে বলল, সরি কেন?

নাহিয়ান
আমার সাথে লাইব্রেরীতে এসেছিল। আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল নাহিয়ানের দিকে। তাহলে এতগুলো বই ছিঁড়তে পারতো না। কিন্তু এরআগেও নাহিয়ানকে নিয়ে লাইব্রেরীতে এসেছি। চুপচাপ বসে কমিস দেখে। কখনোই বই ছেড়ে না। আজ কেন ছিঁড়লো বুঝতে পারছি না।

জাওয়াদ
হেসে বলল, তোমার ফাহাদ চাচ্চুর উপমার কারণে ছিঁড়েছে। নাহিয়ানকে হয়তো কোন কারণে তোমার চাচ্চু বলেছিল বই এই পৃথিবীর সবচেয়ে মজার খাবার। নাহিয়ান তাই টেষ্ট করে দেখতে চাচ্ছিলো।

জিহাদ
হেসে কুটিকুটি হলো কিছুক্ষণ। এরপর বলল, বাচ্চাদের সাথে উপমা ব্যবহার করে কথা বলার সময় সাবধান থাকা উচিত। তাই না পাপা?

হুম
! উপমা দেবার সময় খেয়াল রাখা খুব জরুরি যাতে এমনটা না হয় যেন উপমার কারণে কোন কিছুর সঠিক অর্থই বুঝতে ব্যর্থ হয় বাচ্চারা। আসলে বাচ্চাদেরকে যে কোন কিছু বুঝিয়ে বলার সময় চেষ্টা থাকা উচিত যতটা সম্ভব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলতে। উপমা ব্যবহার করতে দোষ নেই। বরং উপমার দ্বারা কথাকে আকর্ষনীয় করে অনেক সহজেই বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হয় বেশির ভাগ সময়ই। কিন্তু সেক্ষেত্রে এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চারা উপমার সঠিক অর্থ বুঝতে পেরেছে কিনা। তাহলেই আর উপমা বিভ্রাট ঘটার সুযোগ বা ভয় থাকবে না

ইনশাআল্লাহ
আমি মনে রাখবো পাপা।

জাওয়াদ
হেসে বলল, হুম! তোমাকে তো মনে রাখতেই হবে। বড় ভাইয়া হিসেবে ছোট ভাইবোনদেরকে বিভিন্ন জিনিস বোঝানোর দায়িত্ব তো তোমাকেই পালন করতে হবে ইনশাআল্লাহ। আর সেজন্য তোমাকে আরো অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।

ইনশাআল্লাহ
পাপা আমিও একদিন তোমার মতো করে নিজেকে গড়ে নেবো। তখন আমিও ছোট ভাইবোনদের মুভমেন্ট দেখেই তোমার মতো করে বলে দিতে পারবো, ওদের পরবর্তী অ্যাকশন বা রিঅ্যাকশন কি হতে যাচ্ছে।

হেসে
ফেললো জাওয়াদ। হাত বাড়িয়ে জিহাদের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, চলো তোমার জাল দাদাভাইয়ের সাথে দেখা করে আসি। নাবিহা আবার সারপ্রাইজ নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

জিহাদ
পাপার হাত ধরে টেনে বলল, তাহলে তাড়াতাড়ি চলো পাপা

জাওয়াদ
হেসে বলল, হ্যা চলো।

@

রুমে
ঢুকে নূহার চেহারা দেখেই রাহাত বুঝতে পারলো কিছু একটা ঘটেছে। কি হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করতে যেয়েও আবার নিজেকে সামলে নিলো। বলার ইচ্ছে থাকলে নূহা নিজ থেকেই বলবে। নয়তো হাজারটা প্রশ্ন করেও কিছু বলানো যাবে না। এই ব্যাপারটা যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে সেদিন থেকে নূহাকে প্রশ্ন করাটা ছেড়ে দিয়েছে। প্রশ্ন করার পর জবাব না পেয়ে বিরক্ত হবার চেয়ে, প্রশ্ন না করাটাই উত্তম মনেহয় রাহাতের। কিন্তু এই মূহুর্তে নূহার মেঘে ঢাকা চেহারা দেখে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করাটাকে নিজের দায়িত্ব মনেহলো। তাই নূহার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কোন কারণে কি মন খারাপ তোমার? কিছু ঘটেছে?
রাহাতকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে সাথে সাথে নূহা বলল, গত সপ্তাহে জিশানের ক্লাসের একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম তোমাকে। মনেআছে তোমার?

হ্যা
মনেআছে। জিশানকে খুব পছন্দ করে এমন কিছু বলেছিল মেয়েটি। আবার কি কিছু বলেছে?

আমাকে
বলেছিল তাই হয়তো ওর পাপাকে আর বলেনি জিশান এই ব্যাপারে। আজ হয়তো কোন কারণে বলেছে। উনি খুব বিরক্ত হয়েছেন আমি কেন ব্যাপারটা আগেই জানাইনি সেজন্য। বাবাও এখন ফোন করে বললেন আমার উচিত ছিল সাথে সাথেই কথাটা শেয়ার করা।

বেশ
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাহাত বলল, ভাইজানের বিরক্ত হওয়াটা তো স্বাভাবিক, তাই না? মনেআছে, দুবছর আগে জারিফের রেস্টুরেন্টের খাবার খাওয়ার খুব শখ চেপে বসেছিল। তুমি বাইরের খাবার পছন্দ করো না সেজন্য আমার কাছে চুপিচুপি বায়না ধরতো জারিফ। আমি বেশ কয়েকদিন ওকে নিয়েও গিয়েছিলাম তোমাকে না বলে। কিন্তু একদিন ঠিকই ধরা পড়ে গিয়েছিলাম তোমার কাছে। জারিফের সামনে খুব হাসলেও, পরে একাকী তুমি আমাকে এর ক্ষতিকর দিকটা বুঝিয়ে বলেছিলে। বাবা-মা মধ্যে কখনোই সন্তানের ব্যাপারে কোন আড়াল বা লুকোচুরি থাকতে নেই। সন্তানরা যদি এই ব্যাপারটা একবার ধরে ফেলে যে, তার বাবা-মা একে অন্যের সাথে সর্বক্ষেত্রে অনেস্ট নয়। তাদের মধ্যে লুকোচুরি, আড়াল বিদ্যমান। তখন তারাও এই ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে। তারাও লুকোচুরি করে, অনেককিছু গোপন করে এবং সর্বক্ষেত্রে অনেস্ট থাকার প্রয়োজনীয়তা ফিল করে না। আবার অনেক সময় এই ইনফরমেশন গ্যাপটাকে তারা বাবা-মা উইক পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। একজনকে আশ্রয় করে অন্যজনের কাছে নিজেকে বেটার হিসেবে উপস্থাপন করে। যা পরবর্তীতে দ্বৈত সত্ত্বার জন্ম দেয় ব্যক্তিত্ত্বে।

নূহা
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, তুমি মনেহয় ভাবছো আমি কষ্ট পেয়েছি উনি বিরক্ত হওয়াতে!

তারমানে
তুমি কষ্ট পাচ্ছো না?

অবশ্যই
কষ্ট পাচ্ছি। তবে সেটা আমার ভুলের জন্য। উনার রাগ বা বিরক্তির কারণে নয়। শোনার সাথে সাথেই আমার শেয়ার করা উচিত ছিল এই বিষয়টা। আমার তো অজানা নয় বাচ্চাদের ব্যাপারে উনি কতটা স্পর্শকাতর। তাছাড়া জিশান এখনও অনেক ছোট, তার উপর পরিবেশটা বৈরী। ছোট একটু অসাবধানতাও পরবর্তীতে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এই ব্যাপারগুলোকে কখনোই হালকা ভাবে নেয়া ঠিক নয়। হ্যা যতটুকু বোঝানো দরকার ছিল আমি জিশানকে বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু যেহেতু ওরা বেশির ভাগ সময়ই ওদের পাপার সাথে থাকে। তাই উনার জানা থাকলে বিভিন্ন সময় ছোট ছোট উদাহরণের মাধ্যমে বুঝটাকে জিশানের মনে দৃঢ় করে দেবার চেষ্টা করতে পারতেন। ইতিবাচক নেতিবাচক উভয় প্রকার উদাহরণের গুরুত্ব অপরিসীম। চিন্তার খোরাক যোগায়, উপলব্ধি সমৃদ্ধ হয়, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এমন ব্যাপারগুলোতে বাবা-মারা বেশির ভাগ সময়ই হয় শাসন করেন, নয়তো এড়িয়ে যান। বুঝিয়ে বলেন খুব কম সময়েই। আবার বোঝানোর মাঝেও তো বিদ্যমান নানান পদ্ধতি।

হ্যা
সেটাই। আসলে ভুল আমারো হয়েছে। ভাইজানকে বলার ব্যাপারে তোমাকে মনে করিয়ে দেয়া উচিত ছিল আমার।

নূহা
হেসে বলল, হয়েছে অন্যের দোষ নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে আর মহান সাজতে হবে না। এমনিতেই আপনার মহত্ত্বের নীচে চাপা পড়ে হাঁসফাঁশ করছি আমি দয়াকরে আর ওজন বাড়াবেন না।

রাহাত
হেসে বলল, আমার ভালোবাসার বাগানে ফোঁটা ফুলেরা কখনোই মূল্যায়ন পেলো না তোমার কাছে। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ।

হয়েছে
এখন দুঃখবিলাসের খাতাও খুলতে হবে না। ছেড়ে যাও দুঃখকে। চড়ে বেড়ায় কিছুক্ষণ মুখ ভোঁতা করে। ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে অন্য কোন দিকে চলে গেলে সবচেয়ে ভালো।

রাহাত
হাসতে হাসতে বলল, কি নিয়ে এত টেনশন করছো বলো তো? আচ্ছা চলো ভাইজানকে ফোন করি। আমিও তো শুনেছিলাম জিশানের কথা। খুলে বলবো ভাইজানকে।

সেজন্যও
না আসলে। তাছাড়া নিজের যে কোন ধরণের ভুলই অকপটে স্বীকার করতে পারি আমি আলহামদুলিল্লাহ। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেও আমার আপত্তি থাকে না কখনোই।

তাহলে
এত বিষণ্ণতার কারণ কি?

কারণ
হঠাৎ মনেহচ্ছে আমার বাচ্চাগুলো বড় যাচ্ছে। নাবিহার দিকে তাকালে অবাক লাগে মাঝে মাঝে। বিস্ময় জাগে এটাই কি আমার সেই ছোট্ট পরীটা? জিহাদের কথা শুনলে তো মনেহয় ওর ভেতর থেকে ওর পাপাই বুঝি কথা বলছে। জারিফের যুক্তি আর পাকামোতে আমি অতিষ্ট। একমাত্র জিশানই সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। ওকেই তাই সবচেয়ে ছোট মনেহতো। পাজী মেয়েরা কিনা আমার সেই ছোট্ট ছেলেটাকেই খুঁজে পেলো লাভ ইউ বলার জন্য।

হেসে
ফেললো রাহাত। নূহাও মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, জানো অগুনতি স্বপ্ন ছিল আমার সন্তানদেরকে ঘিরে। এটা করবো, সেটা করবো এমন কত শত প্ল্যান যে করেছিলাম। ওদের সাথে কিভাবে সময় কাটাবো সেইসব মূহুর্ত এঁকে এঁকে কাটিয়ে দিয়েছি কত রাত, কত দিন। কিন্তু তার কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারিনি আমি। মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি, কেন পারিনি স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে? এই না পারাটা আমাকে আজকাল খুব বেশি কষ্ট দেয় রাহাত। বার বার শুধু মনেহয় জিহাদ, জিশান, নাবিহার মা হবার হক আমি আদায় করতে পারিনি।

তুমি
এভাবে কেন ভাবছো নূহা?

কারণ
আমি কাজই এমন করেছি। এখন আমি কাছে নেই বলে ওদের পাপা বাবা-মা দুজনের ভালোবাসাই ভরপুর দেবার চেষ্টা করেন ওদেরকে। যখন ওদের পাপা দূরে ছিল এই দায়িত্বটা আমার ছিল, তাই না? কিন্তু বাবা-মা দুজনের ভালোবাসা দেয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। আমি তো মায়ের আদর, মমতা, ভালবাসাও ঠিকমতো দেইনি ওদেরকে। আমাকে ঘিরে ওদের তিনজনের আকুল করা ভালোবাসা যখন দেখি। খুব বেশি অপরাধী মনেহয় নিজেকে। তারউপর আবার এসব নিত্যনতুন ভুল। আমি এমন কেন বলো তো?

নূহাকে
কাছে টেনে নিয়ে চুপ করে রইলো রাহাত। একজন মানুষের সবসময়, সর্বাবস্থাতে একই রকম দৃঢ় সমঝদার থাকার কোনই সুযোগ নেই। মানুষ যেহেতু তাই দুএক সময় মনের নেতিবাচকতার স্রোতের বিপরীতে চলার চেষ্টা না করে, স্রোতের টানে ভেসে যাবেই। নূহাকে তাই এই মূহুর্তে ভেসে যেতে দেয়াটাই ভালো। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি সমঝ দুটোই নূহার আছে। কিছু একটা আঁকড়ে ঠিকই নিজেকে সামলে নেবে কিছুটা সময় পর। অতটুকু সময় ওকে দেয়াটাকেই এই মূহুর্তে একজন উত্তম জীবনসাথীর পরিচয় মনেহলো রাহাতের

আলতো
হাতে রাহাতকে ছাড়িয়ে ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো নূহা। ঠাণ্ডা বাতাসের চাদর মূহুর্তেই প্রাণপনে ঝাপটে ধরে কাঁপন তুলে দিয়ে গেলো। নূহার কেঁপে ওঠা নজর এড়িয়ে যায়নি রাহাতের। শাল বের করে নূহার পাশে গিয়ে গায়ে জড়িয়ে দেবার ফাঁকে বলল, অতীতের একটা ভুলের স্মরণে আমি একদিন বেশ মন খারাপ করেছিলাম। তখন তুমিই বলেছিলে, তোমার নিমিত্তে যা কিছুই রয়েছে নির্ধারিত। স্বমহিমায় এসে করবেই পুলকিত কিংবা আশাহত। রব্বের ইচ্ছেতেই জগতে সবকিছু হয়। তেমনি অপূর্ণতাও একদিন পূর্ণতা পায় নিশ্চয়। তাই মনের অকারণ দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা, আফসোস সবকিছুকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দাও। তোমার বলা কথাটাই এই মূহুর্তে তোমাকে বলছি। যা কিছু ঘটেছে তারজন্য আফসোস করো না। কারণ আফসোস এক ধরণের গুপ্ত ঘাতকের মতো। যা গুণপোকার মতো মনের সংশোধনের আশাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ফেলে। তাছাড়া এখন তোমার মধ্যে যে সমঝ এসেছে, চৌদ্দ বছর আগে তো তেমনটা ছিল না। চৌদ্দ বছর আগের পরিবেশ-পরিস্থিতিও এতটা অনুকূল ছিল না। এখন চিন্তা করলে সময়ের অনেক কিছুই হয়তো অনেক সহজ স্বাভাবিক মনেহবে। কিন্তু সময় সেটাই ছিল সবচেয়ে অস্বাভাবিক কিছু। তাই বদলে যাওয়া সময়ের আয়নায় নিজের অতীতের প্রতিচ্ছবি দেখতে যেও না। এতে শুধু কষ্টই বাড়বে তোমার মনের। এরচেয়ে তোমার সন্তানদেরকে আরো বেশি ভালোবাসা দেবার চেষ্টা করো। তুমি শুধু একবার হ্যা বলো। এই মূহুর্তে আমি ঘরজামাই হবার জন্য ছুট লাগাতে প্রস্তুত আছি তোমার সাথে।

নূহা
হেসে ফেললো। একটুক্ষণ চুপ থেকে হাসি ভরা মুখেই বলল, ইনশাআল্লাহ বলবো। খুব শিঘ্রীই হয়তো বলবো। তবে সেজন্য আরেকটু সময় দাও আমাকে নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্য।

রাহাত
হেসে বলল, অবশ্যই। এখন কি আমাকে খেতে দেবেন? অনেক ক্ষুধা লেগেছে

নূহা
হেসে বলল, অবশ্যই। চলেন খেতে যাই

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন