রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৬



ছিলি কোথায় এতক্ষণ তুই? নূহাকে দেখে বিরক্ত কন্ঠে বললেন মিসেস সুরাইয়া।

নূহা হেসে বলল, মসজিদে কয়েকজন অ্যারাবিয়ান মহিলা এসেছিল নামাজ আদায় করতে। কথা বলছিলাম উনাদের সাথে। কেন কি হয়েছে?

আধ ঘন্টা ধরে তোর মোবাইল বেজেই চলছে, বেজেই চলছে।

কে ফোন করেছে?

আমি দেখিনি। তুই যেয়ে দেখে নে। শোন আবার গল্প জুড়ে বসিস না এখন। আমার রুমে আয় কথা আছে তোর সাথে।

তোমার রুমে ঘন্টা দেড়েক পর আসছি মামণি। আমি ছোট্ট ফুপ্পির বাড়িতে যাবো। নায়লার এই মূহুর্তে মেন্টাল সাপোর্টের দরকার খুব।

মেয়েকে আর কিছু না বলে রুমের ভেতর ঢুকে গেলেন মিসেস সুরাইয়া।

নিজের রুমে ঢুকে জুয়াইরিয়া আর আত্মজার সম্মিলিত সালামের জবাব দিয়ে নূহা বলল, এই দুষ্টু দুই বালিকা আমার অনুপস্থিতে আমার রুমে কি করছে?

আত্মজা হেসে বলল, তোমার সাথে গল্প করতে এসেছিলাম আপ্পা। এসে দেখি তুমি নেই কিন্তু তোমার ল্যাপটপ ওপেন এবং এফবি আইডিও। আমরা দুইজন একটু ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তোমার ভার্চুয়াল জগতে। আমাদের তো আর ভার্চুয়াল জগত নেই? বলতে বলতে বিশাল লম্বা করে দুইজন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

নূহা চোখ পাকিয়ে কপট রাগের স্বরে বলল, অতিরিক্ত সাহস হয়েছে তোদের। সভ্যতা-ভভ্যতাকে তো মুড়িঘন্ট করে খেয়েছিস। আর ভার্চুয়াল জগত নেই সেজন্য এত লম্বা দীর্ঘশ্বাস না ফেলাই ভালো। যে জিনিস গুলো ছাড়াও জীবন ঠিকঠাক চলে যায় তারমধ্যে ভার্চুয়াল জগত একটা।

জুয়াইরিয়া বলল, হুম্ম, তুমি তো বলবেই। তোমাকে তো আর আমাদের মত বন্দী থাকতে হয় না। তুমি জানো আমাদের কলেজ ফ্রেন্ডরা শুনলে হাসে আমাদের এফবি আইডি নেই। একটা স্মার্ট ফোন অবশ্য আছে কিন্তু তাতে কোন ইন্টারনেট কানেকশন নেই। কারন আমাদের বাড়ির নিয়ম হচ্ছে, বিয়ের আগে কেউ পার্সোনালি ইন্টারনেট ইউজ করতে পারবে না। ভাইজানের এটা কেমন অদ্ভুত নিয়ম আপ্পা?  

গাল ফুলিয়ে বসে থাকা দুই বোনের দিকে তাকিয়ে হাসি চাপলো নূহা। একবার মনেহলো বলেই দিতে কেন তাদের ভাইজানের মনে ভার্চুয়াল জগতকে ঘিরে এত বেশি সাবধানতা। কারণ উনি চান না উনার মতো ভুল অন্য কারো দ্বারা ঘটুক। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আনমনা হয়ে গেলো নূহা। জাওয়াদ কখনোই এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলেনি তার সাথে। কিন্তু কেন? কেন এই বিষয়টাকে সযতনে সবসময় এড়িয়ে গিয়েছেন? নূহার অনেকবার ইচ্ছে হতো জিজ্ঞেস করতে কিন্তু কেন জানি শেষপর্যন্ত করা হয়ে ওঠেনি। হয়তো তার মতো এমনই সঙ্কোচ জাওয়াদের ভেতর কাজ করেছে বলে উনিও এড়িয়ে চলেছেন এই ব্যাপারটাকে।  

কি হলো আপা তুমি যে কিছু বলছো না?

আত্মজার ডাক শুনে নূহা বলল, আচ্ছা আজ কি বৃহস্পতিবার?

হ্যা। কেন আপ্পা?

নূহা বলল, আজ আমাদের সাপ্তাহিক প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু এত সব ঘটনা মিলিয়ে একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। এমনকি বোনদেরকে জানানোও হয়নি আমি যে আজ প্রোগ্রামে থাকতে পারবো না। বিশটা মিসকল এসেছে ওদের। এত লজ্জা লাগছে এখন। কি ভাববে আমার এমন উদাসীনতা দেখে সবাই!

কিসের প্রোগ্রাম আপ্পা? কোন ইসলামিক প্রোগ্রাম? তোমার বাসায় হয়?

হুম, ইসলামিক প্রোগ্রামই বলা যায় আলহামদুলিল্লাহ। তবে বাসায় না স্কাইপে হয়।

স্কাইপে? জুয়াইরিয়া আর আত্মজা দুজনই অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো।

নূহা হাসি মুখে দুজনের মাঝখানে গিয়ে বসে বলল, হুম, স্কাইপে। ছয় মাস আগে আমরা কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে এই প্রোগ্রামটা শুরু করেছি আলহামদুলিল্লাহ।

তোমার ফ্রেন্ড? তোমার তাহলে ফ্রেন্ডও আছে আপ্পা?

জুয়াইরিয়া হেসে বলল, আত্মজার মতো একই প্রশ্ন আমারো। অন্যান্য সব আপু-ভাবীদের ফ্রেন্ড দেখেছি আমরা। কিন্তু কোনদিনও তোমার কোন ফ্রেন্ড দেখা তো দূরে থাক নামও শুনিনি। তাহলে হঠাৎ আবার ফ্রেন্ড এলো কোত্থেকে? নাকি ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড?

নূহা হেসে বলল, পুরোপুরি ভার্চুয়াল বলাটাও মনেহয় ঠিক হবে না। পরিচয় ভার্চুয়াল জগতে হলেও ওরা সবাই ধীরে ধীরে আমার জীবনের খুব আনন্দময় একটা অংশে জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে হালিমা আপু। তোদের সাথে একদিন পরিচয় করিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ। শেষ বয়সে এসে একটা বান্ধবী খুঁজে পেয়েছি সবার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে না দিলে কি হয়?

জুয়াইরিয়া হেসে বলল, কিন্তু আপ্পা সত্যি সত্যিই স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কোথাও তোমার কারো সাথে ফ্রেন্ডশীপ হয়নি?

আসলে ফ্রেন্ডশীপের জন্য কমিউনিকেশন স্কিল খুব ইনপটেন্ট। যেটা আমার মধ্যে সম্পূর্ন রূপে অনুপস্থিত। যাদেরকে আমি ভালোবাসি সারাক্ষণই তাদের স্মরণ করি কিন্তু খোঁজ খবর নেয়া হয়ে ওঠে না। নিজ অভিজ্ঞতা থেকেও তো জানিস, আমি ভুলেও কখনো তোদের কাউকে ফোন করিনা। কিন্তু তোরা সবাই কিন্তু সারাক্ষণই থাকিস আমার ভাবনা জুড়ে। তাই দেখা যায় কেউ নিজ থেকে যোগাযোগ না করলে আমারো করা হয়ে ওঠে না। ব্যাপারটা যে ইচ্ছে করে করি তাও না। আমি মনেহয় মানুষটাই এমন। কিন্তু পরিবারের বাইরে কারো পক্ষে আমার এই স্বভাব বুঝে মেনে নেয়াটা কষ্টকর। এটা আমি বুঝি বলেই বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকি। কারণ বন্ধুত্বও একটা সম্পর্ক। এটাও একটা দাবী আছে। আর যেই দাবী পূরণে আমি উদাসীন সেই দায় নিজের উপর চাপাতেও নারাজ। কারণ এরফলে অজান্তেই হয়তো কারো মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবো। তাই দরকার কি এত সব ঝামেলার?  

আত্মজা হেসে বলল, কোন দরকার নেই। পরিবারের বাইরে তোমার ফ্রেন্ডশীপ করারও দরকার নেই কারো সাথে। আমরা তো আছিই তোমার বন্ধু। কিন্তু আপ্পা প্রোগ্রামে কি করো তোমরা?  
আসলে আমরা ছয়-সাতজনের খুবই চমৎকার একটি আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। যদিও আমরা একেকজন একেক দেশে থাকি কিন্তু তবুও সপ্তাহে একদিন সময় ম্যানেজ করে একসাথে কিছুক্ষণ গল্প করতাম। হালিমা আপু একদিন আড্ডার সময় আমাদেরকে বললেন, আমরা যেহেতু একসাথে কিছুটা সময় কাটাচ্ছি। পুরো সময়টাই শুধু গল্পগুজব করে কাটিয়ে দেয়াটা বোধকরি সময়ের অপচয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। এমন কিছু যদি করা যেত যারফলে আমাদের গল্প করাও হতো আবার পুরো সময়টাই একদম অকারণে বিদায় না নিলো আমাদের কাছ থেকে। তাহলে খুব ভালো হতো। এমনিতেও অবশ্য আমরা বেশির ভাগ সময় কুরআন-হাদীস নিয়েই আলোচনা করতাম। কিন্তু এসবই ছিল ছাড়া ছাড়া আলোচনা। হালিমা আপুর আইডিয়া শোনার পর সবাই মিলে একটা প্রোগ্রাম শিডিউল তৈরি করলাম। কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে প্রোগ্রাম শুরু করি আমরা। এরপর বিষয় ভিত্তিক কোন আলোচনা করি, দারসে হাদীস থাকে, সাইকোলজিক্যাল একটা টপিকও থাকে, মত বিনিময় করি আমরা, আত্নোপর্যালোচনা মূলক আলোচনাও করি। আবার প্রোগ্রামটা যাতে একঘেয়ে না হয়ে যায় সেজন্য টুকটাক বিনোদনের ব্যবস্থাও করি মাঝে মাঝে। যেমন ধর কুইজ, শিক্ষণীয় গল্প, কখনো নিজেদের শৈশবের মজার কোন স্মৃতি চারণ, মজার বা বিচিত্র অভিজ্ঞতা শেয়ার করে মনের আনন্দে সবাই মিলে কিছুক্ষণ হাসি। আলহামদুলিল্লাহ সত্যিই অসাধারণ কিছুটা সময় কাটে বোনদের সাথে। আবার আমাদের মধ্যে ছোট্ট দুটা বোন আছে যাদের কুরআন পড়া সহীহ না পুরোপুরি। হালিমা আপু সপ্তাহে অন্য আরকদিন সময় করে ওদেরকে আরবী ব্যকরণটা দেখিয়ে দেন।  

আত্মজা আবারো গাল ফুলিয়ে বলল, আমার তো শুনেই লোভ হচ্ছে আপ্পা। মানুষ চাইলে সবকিছু থেকেই উত্তমটা বের করে নিতে পারে। তাহলে আমাদেরকে এমন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কেন?

কারণ সবকিছু থেকে উত্তম কিছু বের করে নেয়াটা সবসময় সহজ হয় না। বরং বেশির ভাগ সময়ই এটা খুব কঠিন। এরজন্য সতর্কতা, অভিজ্ঞতা অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। তাছাড়া আমার বর্তমান লাইফ স্টাইল দেখে তোদের মন খারাপের কারণটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না। তোদের মতো বয়সে আমাদের লাইফ আরো অনেক বেশি নিয়ম কানুনে বাঁধা ছিল। তাছাড়া আমি এফবি আইডি খুলেছি তিন বছরও হয়নি। সেই হিসেবে তোদের বয়স আটাশ পেরিয়ে যাবার পরও যদি ভাইয়ারা খবরদারী করতে আসে তখন নাহয় অ্যকশন নেবার কথা ভাবা যাবে।  
জুয়াইরিয়া আর আত্মজা আপ্পা বলে লম্বা করে কিছক্ষণ টেনে ধরে রেখে আবারো গাল ফুলিয়ে বসলো।

নূহা দু’হাতে দুজনের গাল টেনে দিয়ে হাসি মুখে বলল, কয়েকদিন আগেও বলেছিলাম আজ আবারো বলছি। পরিবারের অনুশাসন সম্পর্কে মানুষ কি বলছে, কি ভাবছে সেসবকে কখনোই পাত্তা দিবি না। কারণ যখন পরিবারের অনুশাসনের বাইরে গিয়ে তোরা কোন ভুল কাজ করবি তখন সবার আগে ঐ মানুষেরাই তোদের দিকে আঙ্গুল উঁচু করবে। সমালোচনার আড়ালে নিন্দা করবে। আর তখনো পরিবারই ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নেবে। তাই পরিবারের ইচ্ছের বাইরে গিয়ে কখনোই কোন কিছু করার চিন্তাকে প্রশ্রয় দিবি না। পরিবারের বড়রা যদি ছোটদেরকে কোনকিছু থেকে দূরে রাখতে চান, তার পেছনের কারণটা অবশ্যই কল্যাণময় কিছুই হয়। এখন তোরা তোদের রুমে যা। পরে ইনশাআল্লাহ তোদের সাথে এই বিষয়ে ডিটেইল কথা বলবো। আমি একটু নায়লার কাছে যাই।

আত্মজা বলল, নায়লার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আপ্পা?

নায়লাকে আমাদের অপছন্দের কথা জানানো হয়েছে। এখন নায়লা সিদ্ধান্ত নেবে ওর করণীয়র ব্যাপারে।

নায়লা যদি সৈকতকেই বিয়ে করতে চায়। তাহলে কি সত্যি সত্যিই তোমরা ওকে সৈকতের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে? প্রশ্ন করলো জুয়াইরিয়া।

আমি ঠিক জানি না কি করবেন ভাইয়ারা। টেনশনে আছি নিজেও।

আত্মজা ভীত কন্ঠে বলল, আমার তো কোন একদিন বিয়ে করতে হবে এটা মনে হলেই ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমাদের ক্লাসে দুইটা মেয়ে কি যে ভুগছে বিয়ের পর থেকে। আপ্পা আমাকে তোমরা পরিবারের ভেতরেই কারো সাথে বিয়ে দিয়ো। আমি বাইরে কোথাও যেতে চাই না।

নূহা হেসে বলল, তুই না তোর রাহাত ভাইয়ার বিরাট ভক্ত? সেও তো আমাদের পরিবারের বাইরে থেকেই এসেছিল। আসলে কি জানিস? এখনো পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে। কিন্তু ভালো মানুষগুলো তাদের ভালো মানুষীর কারণেই ভালো কিছু করতে পারে না।

সেটা কিভাবে? প্রশ্ন করল জুয়াইরিয়া।

নূহা হেসে বলল, যেমন ধর একটা ছেলে খুবই উত্তম স্বভাবের। যে যদি মা ভক্ত হয় তাহলে মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করে। আবার যদি স্ত্রী ভক্ত হয় তাহলে কারণ হয়ে দাঁড়ায় মায়ের কষ্টের। সে এতই ভালো যে একজনের সাথে ভালো মানুষী দেখাতে গিয়ে অন্যের সাথে খারাপ হয়ে যায়। এভাবেই একজন ভালো মানুষই হয়ে ওঠে একজন খারাপ মানুষ।

তুমি শুধু প্যাঁচালো কথা বলো আপ্পা।

একদম ঠিক বলেছিল। আত্মজার সুরে সুর মিলালো জুয়াইরিয়া।

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা তাহলে এই প্যাঁচালো সাবজেক্টটাই বাদ দে।

কিন্তু বিয়ে তো করতেই হবে একদিন না একদিন আমাদেরকে। নায়লাকে দেখে খুব ভয় হচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন এমন কিছু থেকে। চিন্তা করে দেখো আপ্পা নায়লার অবস্থাটা। পরিবারের পছন্দের বাইরে যাওয়াটা যেমন ওর জন্য খুব কঠিন। তেমনি মনের ভালো লাগাকে উপেক্ষা করাটাও তো বেশ কঠিন হবারই কথা। আর অনুভূতিটা যদি সত্যিই ভালোবাসা হয়ে থাকে? আচ্ছা আপ্পা ভালবাসা ব্যাপারটা কেন সংঘটিত হয়? মানে আমি জানতে চাইছি একটা মেয়ে একটা ছেলেকে কেন ভালোবাসে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবার আগে?

আত্মজা বলল, একই প্রশ্ন আমারো। নায়লার তো অজানা ছিল না কাউকে পছন্দ করার পরিণাম। তারপরও কেন নিজেকে সংযত করতে পারলো না? আমাদেরকে যাতে কখনোই এমন বিপদের মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্য এই প্রশ্নের জবাব জানাটা খুবই দরকার। কেন ভালোবাসা তৈরি হয় মনে?

নূহা হেসে বলল, এক কথায় বলতে গেলে ভালোবাসা হচ্ছে ভালো লাগার দায়বদ্ধতা। অর্থাৎ, ভালো লাগার দায়ে আবদ্ধ হয়ে মানুষের মনে যে আবেগের জন্ম হয় সেটাই হচ্ছে ভালোবাসা। সেজন্যই যখন দুজন মানুষের একে অন্যের প্রতি ভালো লাগা কমতে থাকে তখন ভালোবাসাও মিলিয়ে যেতে থাকে। আরো সহজ করে বলতে গেলে, কারো প্রতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালো লাগার সমষ্টি হচ্ছে ভালোবাসা।

আত্মজা হেসে বলল, এটা কি তোমার সংজ্ঞা নাকি ভাইজানের?

নূহা হেসে বলল, তোমাদের ভাইজানের সংজ্ঞা। ভালোবাসা আর ভালো লাগা নিয়ে বিশাল এক লেকচার আছে উনার। খুঁজে বের করে তোদেরকে দেবো ইনশাআল্লাহ। এখন বিদায় হ দুটাই।

জুয়াইরিয়া বলল, সাথে বিয়ে ভীতির উপর তোমার লেকচারও চাই আমাদের।

নূহা হেসে বলল, জানিস একটা সময় আমার কাছে বিয়ে মানেই ছিল খুব আপন কারো হাত ধরে স্বপ্নিল এক জগতের প্রবেশ দ্বার। তাই কারো বিয়ে হচ্ছে শুনলে ভীষণ খুশি হতাম। কিন্তু যেদিন থেকে দাম্পত্য কাউন্সিলিং শুরু করেছিলাম একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করেছিল বিয়ে বিষয়টাকে কেন্দ্র করে আমার নিজস্ব ধারণা। বেশ অনেকদিন কারো বিয়ে হচ্ছে জানার সাথে সাথে একরাশ দুশ্চিন্তা এসে ঘিরে ধরতো মনকে। বিভিন্ন দম্পতিদের কাছ থেকে শোনা তাদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার স্লো মোশনে একের পর এক আসতে থাকতো মনের পর্দায়। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবার পর রিয়ালাইজ করলাম যে, বিয়ের আসলে কোন দোষ নেই। বিয়ে কখনোই ব্যর্থ হয় না। দোষ থাকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মানুষ দুটির মধ্যে। তাদের দোষেই বিয়ে ব্যর্থ হয়, আবার তাদের গুণেই নিয়ে ছুঁয়ে দেয় সর্বোচ্চ সাফল্য। তাই ভয় যদি পেতেই হয় নিজেকে পাওয়া উচিত, বিয়েকে নয়।

তবুও আপ্পা বিয়ের অনুভূতিটা কেমন যেন দমবন্ধকর। ভীত কন্ঠে বললো আত্মজা।  

হুম, মিশ্র অনুভূতির দোলায় দুলতে থাকে মন। নিজের অভিজ্ঞতায় মনেহয়েছে মেয়েরা বিয়ের আয়োজনের পুরো সময়টিতেই দোল দোল দুলুনি অবস্থায় থাকে। একই সাথে মনের মাঝে এত রঙের আবির্ভাব খুব কম সময়ই ঘটে। জীবনে প্রিয়তম কারো আগমনের ধ্বনি আনন্দময় লাজুকতার রক্তিম আভা ছড়াতে ছড়াতে, বেদনার নীলাভ চাদরে মুখ ঢেকে গুমরে কেঁদে উঠে আপনজনদের ছেড়ে যাবার বিরহে। আসলে বিয়ে শব্দটা যেমন অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন, কল্পনা, ভাবনার বীজ বুনে দেয় মনের গহীনে। তেমনি দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্ন মনে তুলে যায় কখনো মৃদু মন্দ, কখনো বা থরথর কাঁপন। মন দুই ভাগ হয়ে এক অংশ প্রশ্নকর্তা আর অন্য অংশ উত্তরদাতায় পরিণত হয়। যেমনটা চেয়েছি তেমন হবে তো আমার জীবনসাথী? আমি হতে পারবো তো তার মনের মত? একে অন্যেকে বুঝে মানিয়ে নিতে পারবো তো? মনের মিল মতের অমিলের কাছে নতি স্বীকার করে নেবে নাতো? সম্পর্কের ভিত বিশ্বাস হবে তো? ভরসা করার মত মানুষ হবে তো? ভালোবাসার মত সুন্দর ও কোমল মনের অধিকারী হবে তো? এমন আরো হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে মনের মাঝে।

একদম ঠিক বলেছো আপ্পা। আমার তো এখনই এখন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনের ভেতর। চিন্তিত কন্ঠে বললো জুয়াইরিয়া।

নূহা হেসে বলল, আমার বিয়ে ঠিক হবার পর মামণি বলেছিলেন, মেয়েদের অনেক বড় একটা সমস্যা হচ্ছে বিয়ে কি বুঝতে শেখার পর থেকেই নিজের ভালোলাগা ও পছন্দের আদলে জীবনসাথীর ছবি আঁকতে শুরু করে দেয় মনের মাঝে। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তব কখনোই এক হয় না। বড়জোর কিছু মিল থাকতে পারে কল্পনা আর বাস্তব সাথীর মাঝে। তাই যে মানুষটা জীবনে আসে তাকে কল্পনার মানুষটির দ্বারা বিবেচনা না করে যদি সে যেমন তেমন ভাবেই মেনে নেয়া যায়, তাহলে দাম্পত্য জীবনে সুখের সন্ধানে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। অভিজ্ঞতা থেকে মনেহয় বিয়ের মূল কথাটা হচ্ছে অ্যাডজাস্টমেন্ট। মানিয়ে নিতে পারাটাকে সোনার কাঠি, রূপার কাঠির সাথে তুলনা করা যায়। যার পরশে নতুন সম্পর্কের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা জেগে উঠে। খুব সহজ, স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ হাত যদি বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় একে অপরের দিকে তাহলে “তুমি আর আমি” নামক বিভেদের বেড়াজাল ছিন্ন করে “আমরাতে” একাকার হয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। বেশ কয়েক মাস আগে দেখা এক দম্পতির ঘটনা বলি তোদেরকে।

আত্মজা আর জুয়াইরিয়া দুজনই চেহারায় সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে তুললো মূহুর্তেই।

নূহা বলল, ঐ দম্পতির একজন ডিভোর্স হয়ে যাবার পর কারণ হিসেবে বলছিল তাদের দুজনের স্বভাবের ভিন্নতার কথা। মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অমিলের কথা। দাম্পত্য সম্পর্কের সকল অশান্তির কারণ মনের চাহিদার অমিল এমন ধারণা আসলে ঠিক নয়। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। তাই তাদের মনের চাহিদা, ভালোলাগা-মন্দলাগা গুলোও আলাদা আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটা মানুষ চিন্তা করে, সিদ্ধান্ত নেয় নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও চাহিদার ভিত্তিতে। তাই দুনিয়াকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একরকম হওয়া সম্ভব নয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। তাই নিজেদের মধ্যে অসংখ্য পার্থক্য বিদ্যমান সেটাকে মেনে নিয়ে, একে অপরকে বাদলানোর চেষ্টা না করার মাঝেও দাম্পত্য কল্যাণ নিহিত থাকে। যে কোন সম্পর্কের মাঝেই মাধুর্য ধরে রাখা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধির সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরির সুযোগ গুলোকে ব্যাহত করা। দাম্পত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। মন থেকে বেড়িয়ে আসা শব্দরা একের পর এক সারি বেঁধে দুজনের মাঝে গড়ে তোলে ভালোবাসার সেতু। শব্দের মাঝে প্রাণ আছে। আছে অস্তিত্ব জানান দেয়ায় ক্ষমতা। তাই মন খুলে যত বেশি কথা বলা হয় দাম্পত্য তত বেশি প্রানোবন্ত হয়ে ওঠে দুজনের কাছে। আবার অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগও কিন্তু কম নয় দাম্পত্যে। অভিযাত্রী হয়ে একে অন্যের নিয়ে বেড়িয়ে পড়া যায় নিজ নিজ রাজ্যে পরিদর্শনে। পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় রাজা-রানী, পাইক-পেয়াদাদের সাথে। সেই মক্তবের আঙ্গিনাতে থেকেও ঘুরিয়ে আনা যায় যেখানে ঘটেছিল জ্ঞানের মোড়ক উন্মোচন। সেইসব সাথীদের সাথেও যাদের সাথে কেটেছে শৈশব-কৈশোরের দুরন্ত সময়গুলো। এমন কত শত আনন্দ-বেদানার কাব্য লেখা থাকে প্রতিটা মনের মাঝে। যার মাঝে বিচরণ করতে করতে একে অন্যেকে জানার কাজটাও হয়ে যায় খুব সহজে। আবার বিয়ে মানে কিন্তু শুধু দুজন মানুষের মিলন নয়। বিয়ে দুটা পরিবারকেও একসাথে জুড়ে দেয়। তারা ভাগীদার হয়ে যায় উভয়ের দুঃখ-সুখের। তাই দম্পতিদের একে অপরের সাথে সাথে উভয় পরিবারের সদস্যদের প্রতিও রাখতে হবে মানিয়ে নেবার মত উদারতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তোদেরকে আমি কেন এসব কথা বলছি? এসব তো নায়লাকে বলার জন্য রেডি করেছিলাম।

জুয়াইরিয়া আর আত্মজা দুজনই হেসে ফেললো। নূহাও হেসে বলল, আচ্ছা তোরা এখানে থাকতে চাইলে থাক। কিন্তু আমি যাই নায়লার কাছে। বেশি দেরি হলে আবার মামণি অভিমান করে বসে থাকবে।

জুয়াইরিয়া আর আত্মজাকে রুমে রেখেই ফুপ্পীর বাড়িতে রওনা দিলো নূহা।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন