সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...৩০




মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য কেন প্রয়োজন? প্রশ্নটা করে কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো জাওয়াদ কিন্তু সম্পূর্ণ হলরুমে পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেলো ছেলেরা কেউ জবাব দেবার চেষ্টা তো করলো না, এমনকি অন্য কেউ জবাব দেবে ভেবে একে অন্যের দিকে তাকালোও না মেয়েদের হয়ে কথা বলার জন্য নাবিহা ভেতরের রুমে ছিল নাবিহারও কোন সারা পাওয়া গেলো না পাশে বসা তিন ছেলের দিকে তাকালো জাওয়াদ জিশান স্বভাব স্বরূপ নিঃশব্দে সবগুলো দাঁত দেখিয়ে দিলো জারিফ চিন্তাক্লিষ্ট চেহারায় বসেছিল পাপা তার দিকে তাকিয়ে আছে বোঝা মাত্রই শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেলো জিহাদ দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল হাসি ফুটে উঠলো জাওয়াদের চেহারাতেও হাসি মুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ প্রশ্ন শোনা মাত্রই যে তোমরা জবাব দেবার জন্য অস্থির হয়ে যাওনি, সেজন্য জাযাকাল্লাহ অনেক বড় একটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে শ্রোতার চেয়ে বক্তার সংখ্যা বেশি আমরা নিজে জানার চেয়ে অন্যকে জানাতে বেশি আগ্রহী নিজে মেনে চলার চেয়ে অন্যকে মানিয়ে চলানোর পেছনে অধিক শ্রম ব্যয় করি কোন বিষয়ে সঠিক জ্ঞান আছে কি নেই সেই বিবেচনা করার আগেই, জ্ঞান বিতরণ শুরু করি প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর বলার জন্য দাঁড়িয়ে যাই কোন বিষয়ে নিজে জানা না থাকলে অন্যের কাছ থেকে কোন রকমে একটু জেনে হলেও প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করি এর কারণ কি বলে মনেহয় তোমাদের? এই প্রশ্নের জবাব শুনতে চাইছি আমি তোমাদের যে কারো কাছ থেকে

ছেলেদের মধ্যে থেকে তামীম বলল, কারণ আমরা জানি না বলতে লজ্জাবোধ করি। কোন কিছু জানি না স্বীকার করাটাকে অপমানজনক মনে করি।

জাওয়াদ বলল, রাইট। আমরা জানি না বলতে লজ্জাবোধ করি। অথচ জানার প্রথম শর্তই হচ্ছে, না জানা। আমরা জ্ঞানার্জন কেন করি? নিজের অজ্ঞানতা দূর করার উদ্দেশ্যেই তো তাই না? কেউ যখন নিজেকে অজ্ঞ মেনে নিতেই নারাজ থাকবে, সে জ্ঞানার্জনে আগ্রহ পাবে না এটাই স্বাভাবিক। এবং তার দ্বারা বার বার বিভিন্ন ভাবে প্রমাণিত হবে, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। কারণ এটা আমরা সবাই জানি, দ্বীনের অল্প জ্ঞান মানুষকে সংকীর্ণ করে দেয়। এবং দ্বীনের জ্ঞান যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, ব্যক্তির উদারতাও বাড়তে থাকে। ঠিক তেমনি মানুষের অভিজ্ঞতার ভান্ডার যখন ক্ষুদ্র থাকে, তখন চারপাশের সবকিছুকে হয় খুব জটিল কঠিন মনেহয় কিংবা সবকিছুকেই সহজ মনেহয়। চারপাশের সবকিছু কেমন মনেহবে সেটা আবার নির্ভর করে ভান্ডারের অভিজ্ঞতা নেতিবাচক নাকি ইতিবাচক সেটার উপর। কারো মনে যখন এক টুকরো আলো থাকে, তার কাছে জগতকে আলোকময় মনেহয়। কিন্তু যার মনটা আঁধারে ঢাকা থাকে, সে আলোর মাঝেও আঁধারকেই খুঁজে নেয়। সব সমস্যার মূল আসলে এখানটাতেই। আমরা নিজ নিজ অভিজ্ঞতার হাতে জিম্মি। আমাদের ছোট্ট কুয়াটাই আমাদের জগত। এবং সেই মানদণ্ডেই আমরা বিশাল সমুদ্রকে বিবেচনা করি দম্ভের সাথে। এমনটা না করে যদি আমরা সবাই সবাইকে বোঝার চেষ্টা করতাম, একে অন্যের অভিজ্ঞতাকে সম্মান প্রদর্শন করতাম, নিজের মত কারো উপর চাপিয়ে না দিতাম, নিজের এবং অন্যের হকের ব্যাপারে সচেতন থাকতাম। তাহলে মানুষে মানুষে এত দ্বন্দ্ব হয়তো থাকতো না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমরা এমনটা করতে পারি না? জবাব শুনতে চাইছি তোমাদের কাছ থেকে। হাম্মাদ?

নিজের নাম শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে হাম্মাদ বলল, মনেহয় আমাদের কাছে জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকার কারণে আমরা এমনটা করতে পারি না। তাই না ভাইজান?

জাওয়াদ হেসে বলল, হ্যা তাই। মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য কেন প্রয়োজন? এই প্রশ্নটা আমাদের মাদ্রাসার উস্তাদজ্বি বুঝিয়ে বলেছিলেন। আমাদের ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের একটা গ্রামে। ছোট্ট একটা মাদ্রাসা ছিল গ্রামে। সেখানেই আমরা পাঁচ ভাই হিফজ করেছিলাম। আমাদের যেখানে ক্লাস হতো তার পাশেই মাঠ ছিল। গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেখানে খেলাধূলা করতো। খুব হৈচৈ, ছুটোছুটি করতো সবাই মিলে। প্রায় সময়ই আমরা চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হতাম অধ্যয়নে মনোযোগ দিতে। এমনটা প্রায় রোজ দিনই হতো। যারফলে আমাদের সামনে এগিয়ে যাবার গতি কিছুটা হলেও কমে গিয়েছিল। আবার আমাদের বয়সী ছেলেরা পাশেই খেলাধূলা, আনন্দ-উল্লাসে মত্ত। অথচ আমাদেরকে চোখ-মুখ বুজে পড়তে হচ্ছে ভেবে মনও কিঞ্চিৎ ব্যথিত হতো। আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই একদিন উস্তাদজ্বি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বলো তো, মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য কেন প্রয়োজন? অনেক ছোট ছিলাম তখন আমরা। নয় বছরের মতো বয়স ছিল। এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না। উস্তাদজ্বি তখন আমাদের সবাইকে বাইরে নিয়ে গেলেন। এবং খেলার মাঠের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য এজন্য প্রয়োজন যাতে রকম দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াতে না হয়। কারণ লক্ষ্যহীন দিগ্বিদিক যারা ছুটে বেড়ায় তারা নিজের সাথে সাথে অন্যদের লক্ষ্য অর্জনের পথেও বিঘ্ন ঘটায়। কারণ তোমার নিজের যখন কোন লক্ষ্য থাকবে না, তুমি অন্যের লক্ষ্যের মর্যাদা বুঝবে না, এবং মূল্যও দিতে পারবে না। ঠিক যেমন ছেলেমেয়েগুলোর কোন লক্ষ্য নেই বলেই, ওরা তোমাদের লক্ষ্য অর্জনের পরিবেশকেও নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু যদি স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় যেত তাহলে ওদের কাছেও হয়তো একটা করে লক্ষ্য থাকতো জীবনের। কিংবা অন্তত পক্ষে তোমাদের চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারতো না। এখন বলো, মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য কেন প্রয়োজন? নাদীম বলো।

নাদীম বলল, জ্বি ভাইজান নিজের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করা জন্য। এবং একই সাথে অন্যের চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকার জন্য।

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, রাইট। জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে শুধু যে আমাদের নিজেদের জীবনটা সুশৃঙ্খল হয়ে যায় তাই নয়, আমরা অন্যের জীবনের ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারি। কিংবা অন্তত পক্ষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলা থেকে বিরত থাকতে পারি। আমাদের বোনদের মধ্যে থেকে একজনের প্রশ্ন ছিল, কেন ইদানীং সংসার বেশি ভাঙ্গছে? ঘরে ঘরে এত অরাজকতা কেন? বিয়ের কথা চিন্তা করলে তাই ভীতি জেগে ওঠে মনে। এককথায় জবাব দিতে গেলে বলতে হবে, সংসার ভাঙছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যহীনতার অভাবে। আজকাল কেমন যেন একটা বিয়ে করতে হবে তাই করা এমন একটা চিন্তাধারা। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য আল্লাহর নেয়ামত। যে নেয়ামতের সর্বাত্মক কদর করতে হয়। বৈবাহিক বন্ধন দুটি জীবনকে এক ডোরে আবদ্ধ করে,স্থিতিশীলতা দান করে। একই সাথে একে অন্যের প্রতি কিছু দায়িত্ব কর্তব্যও নির্ধারণ করে দেয়। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রশান্তির মাধ্যম, একে অন্যের পোশাক। এবং যেহেতু স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন ভিন্ন দুটি পরিবারের সদস্য। তাই নিজ নিজ এবং উভয়ের পরিবারের প্রতিও আছে কিছু দায়িত্ব। যা কেবল মাত্র তারাই যথাযথ কিংবা সাধ্যমত পালন করতে পারে বা চেষ্টা করে, যারা সম্পর্কের বন্ধনের লক্ষ্য সম্পর্কে অবগত এবং একই সাথে জীবনে মূল গন্তব্য সম্পর্কেও সচেতন। পারিবারিক সাংসারিক বন্ধনের হক আদায়ের জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে, ধৈর্য্য, ত্যাগ, সহনশীলতা, উদারতা এবং ভালোবাসা। নিজ চাহিদা বা স্বার্থ হাসিলের ভালোবাসা নয়। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা। আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা, তাঁর জন্যই ঘৃণা কেবল মাত্র তারাই করতে পারে, যারা দুনিয়াবী জীবনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে অবগত। খেয়াল করলেই দেখবে যারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে, যাদের মধ্যে সঠিক শুদ্ধ মাত্রায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বিদ্যমান। তাদের সংসার কিন্তু ভাঙছে না।

ইমাদ বলল, সঠিক শুদ্ধ মাত্রায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বিদ্যমান এমন মানুষ পাওয়াটাই তো মুশকিল ভাইজান।

এখন হয়তো বেশ মুশকিলই। যেহেতু জেনারেশনের পর জেনারেশন লক্ষ্যহীন জীবনযাপন করে আসছেন, করে চলছেন। কিন্তু বর্তমানে সচেতনতা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরাজমান নেতিবাচকতা, অনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে অনেকেই। তোমরা যেমন সুখী সার্থক জীবন গড়ার সন্ধানেই এখানে এসেছো। সুন্দর একটা পৃথিবীর স্বপ্নও মনের ভেতর লালন করো। তোমরা সাতাশজন যদি সাতাশটি পরিবারের পেছনে নিরলস শ্রম দিয়ে যেতে পারো। যদি এরমধ্যে সাতটি পরিবারও আলোর দেখা পায়। সেটাই বা কম কিসের? কিন্তু এরজন্য তোমাদেরকে আগে নিঃস্বার্থ হতে হবে। আমিই কেন শুধু ত্যাগ করবো? আমিই কেন মানিয়ে চলবো? উনি কেন এটা করছেন না, তিনি কেন সেটা করছেন না? এই সব চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। কারণ কেউ করছে না বলেই তুমি করছো। সবাই যদি করতো তাহলে তো এইসব সমস্যাই থাকতো না। যদি আমাদের পরিবারের উদাহরণ দেই। আমাদের বাবা-চাচারা যদি এভাবে চিন্তা করতেন যে, কেন আমরা এত কষ্ট করবো পরিবারের পেছনে? কেন নিজের সবকিছু ত্যাগ করে দেব পরিবারের পেছনে? তাহলে আজ হয়তো আমি তোমাদের সামনে বসে নিজ অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারতাম না। বাবা-চাচ্চুরা স্বার্থের গন্ডিকে ছাড়িয়ে যাবার যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। একটু বড় হবার পর আমরা ভাইয়েরাও সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম একটা আদর্শ পরিবার গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পথ চলতে গিয়ে কোন ফাঁক দিয়ে আমাদের শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে গিয়েছে নিজেরাও জানি না। আলহামদুলিল্লাহ সেজন্যই হয়তো আজ আমাদের সন্তানরা ওদের শৈশব-কৈশোরের প্রতিটা মূহুর্তকে ভরপুর উপভোগ করতে পারছে। তাই নিজের শ্রম ত্যাগের প্রতিদান ভোগ করার আশা রাখলে উদ্দেশ্যে পূরণ হবার সম্ভাবনা খুবই কম। ব্যাপারটা এমন যে, আমি যে বীজটা আজ বুনেছি, আদর-যত্নে একে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছি। এর ফল আমি খেতে না পারলেও আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইনশাআল্লাহ পারবে। মূল কথা হচ্ছে, সুন্দর পরিবার, সমাজ, পৃথিবী গড়ার জন্য এখন নিঃস্বার্থ কিছু মানুষ দরকার। যারা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে। উপকারের বদলে অবমূল্যায়নের জন্য প্রস্তুত থাকবে। উত্তম কাজের বিনিময়ে পুরষ্কার তো পাবেই না, উল্টো তিরষ্কার হজম করবে। নবী-রাসূলদের জীবনে আমরা এমন সব উদাহরণই খুঁজে পাবো। তবুও তাঁরা নিজ করণীয়তে অবিচল ছিলেন। কারণ তাঁরা নিজেদের লক্ষ্যে দৃঢ় প্রতীজ্ঞ স্থির ছিলেন। আর আমরা একটুতেই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেই, কারণ আমাদের সম্মুখে হয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না, নয়তো আমরা প্রতিদানের আশা মুক্ত হতে পারিনা। আমার কর্মের সুফল অন্যেরা ভোগ করবে এটা ভেবে আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারিনা। সুফল আমাদেরও চাই চাই। যারফলে, ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। এবং আমরা ধরে নেই এইসব মানুষ কিংবা এই সমাজের বদল সম্ভব নয়। তাই সবার আগে নিজেদের জীবনের লক্ষ্যটাকে নির্ধারণ করো। তারপর সেই ভিত্তিতে নিজ নিজ করণীয় লিষ্ট তৈরি করে মনের দেয়ালে পার্মানেন্টলি গেঁথে নাও। শরীয়তের মানদণ্ডে বিবেকে একটা আয়না বসিয়ে দাও। সেই আয়নায় প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই নিজেকে যাচাই করার চেষ্টা করো। দেখবে নিজ নিজ সমস্যার সমাধান তোমরা নিজেরাই করতে পারছো। কিংবা অন্তত পক্ষে ভুল কোথায় হচ্ছে, সেটা সঠিক কিভাবে করা যায় সেটা অন্তত বুঝতে পারছো। তোমাদের অনেকেরই একটা কমন প্রশ্ন ছিল, ইবাদত, আমলে অনীহা, অবহেলা, অলসতাকে ঘিরে।

জারীর বলল, জ্বি ভাইজান। এটা বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, মানুষ জ্বীন জাতিকে সৃষ্টিই করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তারমানে আমাদের দুনিয়াতে আগমনই ঘটেছে ইবাদতের লক্ষ্যে। অর্থাৎ, ইবাদতই আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। কিন্তু একথা জানার পরেও আমাদের দ্বারা ইবাদতে গাফলতি হয়ে যায়। এই অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমাদের মনে আল্লাহর শাস্তির ভয় আছে। আমরাও আল্লাহর আনুগত্যশীল বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই কিন্তু কেন জানি ইচ্ছেতে দৃঢ় থাকতে পারিনা কিছুতেই।

ইচ্ছেতে দৃঢ় থাকার জন্য সুস্পষ্ট লক্ষ্য থাকা আবশ্যক। মানুষকে ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ইবাদতের পেছনে উদ্দেশ্যটা কি? এক স্রষ্টার আনুগত্যের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধ অর্জন। কিভাবে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করতে হবে সেটার দিক নির্দেশনাও দিয়ে দেয়া হয়েছে। দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করতে যাতে তো সমস্যা না জটিলতার মুখোমুখী হতে না হয় সেজন্য পথ প্রদর্শকও দেয়া হয়েছে। যারা দেখিয়ে গিয়েছেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে করণীয় বর্জনীয়। ইবাদত মূলত নির্ভর করে ঈমানের উপরে। বিশ্বাসের ভীত যত মজবুত হয়, ইবাদতের আগ্রহ তত বৃদ্ধি পায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঈমান কিসের উপর নির্ভর করে? আমরা যারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে দাবী করি। যারা এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী এবং রাসূল (সাঃ)শেষ নবী হিসেবে মানি। যারা বিশ্বাস করি, প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এবং মৃত্যু মানেই চির সমাপ্তি নয়, বরং নতুন শুরুর দ্বার উন্মোচন। অনন্ত এক জীবন প্রতীক্ষিত আমাদের জন্য পরকালে। যে জীবনে আমাদের অবস্থা অবস্থান নির্ভর করছে মৃত্যুর আগের জীবনের কর্মকান্ডের উপর। দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কাজের হিসেব নিবেন আল্লাহ তায়ালা। এবং সেই ভিত্তিতেই পুরষ্কার শাস্তি প্রদান করবেন। অনেকটা স্কুল, কলেজের মতই ব্যাপারটা। পরীক্ষায় ভালো করলে পাশ, নয়তো ফেল। যে যত ভালো রেজাল্ট করতে আগ্রহী থাকে, তাকে তত বেশী পরিশ্রম করতে হয়। একটি ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং লাস্ট বয়ের মধ্যে তুলনা করলে খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় সফলতা অর্জনের জন্য চেষ্টা, শ্রম ত্যাগের বৈষম্য। পড়াশোনা না করলে কিছুতেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না এই বিশ্বাসই কিন্তু একজন ছাত্রকে অধ্যয়ন অধ্যবসায়ের প্রেরণা যোগায়। মূল পয়েন্টটা তাহলে কোথায়?

জিশান বলল, বিশ্বাস পাপা। মূল পয়েন্ট বিশ্বাস। বিশ্বাসের কারণেই চেষ্টা এবং চেষ্টার ফলে সফলতা।

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। রাইট মূল পয়েন্ট হচ্ছে, বিশ্বাস। কুরআনে বলা হয়েছে, “আমার এমন কি অজুহাত থাকতে পারে যে যিনি স্বয়ং আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার দিকে আমাদের সবাইকে একদিন ফিরে যেতে হবে, আমি তার ইবাদত করব না!” একটি বিশ্বাসই অন্তরই নিজেকে এই প্রশ্ন করতে পারে। তাই মনের বিশ্বাসকে দৃঢ় করো। ইনশাআল্লাহ ইবাদতের মাঝেই জীবনের সুখ-আনন্দ, প্রাপ্তি, কল্ল্যান, সার্থকতা পূর্ণতাকে খুঁজে পাবে। আরেকটা কথা হচ্ছে, নিজে আলোকিত মানুষ হতে চাই। অন্যেকে আলোর পথে আহ্বান জানাতে চাই। এই ধরণের কথাগুলো বলা আসলে খুবই সহজ। খুব সহজেই তাই এমনটা বলে ফেলি আমরা। কিন্তু নিজেকে আলোকিত করা এবং আলোর মশালধারী হওয়ার জন্য কতটুকু চেষ্টা করার প্রয়োজন আর কতটুকু আমরা করছি এই হিসাবটা করে দেখিনি। তবে সবচেয়ে ইম্পটেন্ট হচ্ছে, যেহেতু আমরা মানুষ। সবসময়ই একই রকম আচরণ করা সম্ভব বা পারফর্মেন্স দেখানো সম্ভব নয়। ফার্স্টও বয়ও তো সবসময় সফল হয়না নিজের অবস্থান ধরে রাখতে। পিছিয়ে যায় মাঝে মাঝে। কিন্তু সেজন্য হতাশ না হয়ে সে নতুন উদম্য নিয়ে নিজের অবস্থান ফিরে পেতে ঝাঁপিয়ে পরে। ইবাদত, আমলের ক্ষেত্রেও কখনো যদি একটু পিছিয়ে যাও। হতাশ হবার কিছু নেই। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং ঘাটতি পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করবে। কলেজ, ইউনিভারসিটি, ট্রেনিং সেন্টারের স্টাডির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কোন কারণে পিছিয়ে গেলে মনখারাপ না করে ঘাটতি পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করতে হবে। ঈমানদার কখনোই হতাশ হয় না ভুল-ভ্রান্তিতে। বরং বিশ্বাস তাকে প্রেরণা যোগায় পুনঃপুনঃ চেষ্টার। তোমরা সবাই এখান থেকে যাবার পর আজ আরেকবার নিজেদের জীবনের লক্ষ্যটাকে যাচাই করে দেখো। লক্ষ্যটাকে মনের মধ্যে দৃঢ় ভাবে আরেকবার প্রতিস্থাপন করে নিও। জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ঠিক থাকলে, চলার পথের বাহ্যিক অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকাশ সমস্যার সমাধানই অনেক সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ব্যক্তিগত, দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিজ নিজ করণীয় বুঝে ওঠাটাও সহজ হয়ে যাবে। জীবনের সমস্যাগুলো আসলে কঠিন নয়। সমস্যার সঠিক সমাধান জানা না থাকার কারনে আমরা ক্ষুদ্র কিছুকেও বিশাল করে ফেলি। সমস্যাকে বোঝার জন্য, সঠিক সমাধানের জন্যও জ্ঞানার্জন প্রয়োজন। দুনিয়াটা সুখের জায়গা নয়। তাই সর্বক্ষেত্রে সুখের নিশ্চয়তা চেয়ো না। দুনিয়াটা পরীক্ষাক্ষেত্র। সর্বদা তাই পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত থেকো। এই প্রস্তুতিই অকারণ যাতনা থেকে রক্ষা করবে ইনশাআল্লাহ। বোনদের মধ্যে থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলেন, প্রি ম্যারেজ কাউন্সিলিং কি আদৌ কোন গুরুত্ব বহন করে কিনা বিয়ে আগে? এক্ষেত্রে উভয়কে এক সাথে কাউন্সেলিং করা যাবে কিনা?

নাবিহা ভেতর থেকে বলল, জ্বি পাপা। এবং বাবা-মাকে কিভাবে বোঝানো যায় সন্তানদেরকে সময় মত বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে? আর বিয়ের ক্ষেত্রে স্ট্যাটাসের চেয়ে ঈমান জরুরী এটাই বা কিভাবে বোঝানো যেতে পারে অভিভাবকদেরকে? অনেক সময় অভিভাবকগণ যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করেন এটা কতটা মানবিক?

জাওয়াদ বলল, জাযাকিল্লাহ নাবিহা। ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করাটা কতটা মানবিক এই প্রশ্নের জবাব অপ্রয়োজনীয়। যেহেতু জোর করে বিয়ে ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু যাদের শরীয়তের জ্ঞান নেই, কিংবা থাকলেও নিজের সুবিধা মতো মেনে চলে। তাদের কাছ থেকে কতটা মানবতা আশা করা যায়? যাদের কাছে দুনিয়াটাই সবকিছু তারা তো ঈমানের স্বাদ থেকেই অজ্ঞাত। যারা কোনদিন ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেনি, তারা কিভাবে দুনিয়ার আগে ঈমানকে অগ্রাধিকার দেবে? লক্ষ্যহীন পিতা-মাতা সন্তানদেরকে জীবনের লক্ষ্য সন্ধান করে দেবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেহেতু পিতা-মাতার সাথে সর্বদা সর্বাবস্থাতেই উত্তম ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। তাই ধৈর্য্য সহনশীলতার সাথে তাদেরকে এই বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতে হবে। তোমরা যখন অবুঝ ছিলে পিতা-মাতা তোমাদেরকে বুঝিয়েছেন। চরম ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন। এখন তোমাদের সময় চরম ধৈর্য্য প্রদর্শনের মাধ্যমে বাবা-মাকে বোঝানোর। রাগ-অভিমান করে না, ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করবে। বাবা-মা যখন দেখবেন তাদের সেইদিনের ছোট্ট ছেলে বা মেয়েটি এতটা সমঝদার সহনশীল হয়ে উঠেছে। হয়তো তারাও উৎসাহী হয়ে উঠবে সেই উৎসটাকে জানার বোঝার জন্য। যার প্রভাবে তাদের সন্তানদের মধ্যে এমন ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। কিন্তু তোমরা যদি মিস বিহেব করো তাহলে পিতা-মাতা পজেটিভ চিন্তা করার সুযোগ পাবেন না। তারা আরো বিদ্বেষী হয়ে উঠবে বিধানে উপর এবং আরো বেশি কঠোর হবেন তোমাদের উপরও। তাই ঘৃণা ছড়িয়ে না, ভালোবাসা ছড়িয়ে ভালোবাসাকে জয় করার চেষ্টা করতে হবে। আর প্রি ম্যারেজ কাউন্সিলিং অবশ্যই কার্যকরী। প্রিপারেশন থাকলে পরীক্ষা দেয়াটা বেশ সহজ হয়ে যায় সেটা তো কারোরই অজানা নয়। আর বিয়ের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উভয়ে একটি গাইড লাইন ফলো করা যেতে পারে। অর্থাৎ, দুজনের কাছে সিলেবাস একই থাকবে। আমাদের এখানে আমরা যেমন, প্রি ম্যারেজ কাউন্সিলিংয়ের জন্য স্পেশাল ক্লাস আছে। কিন্তু ছেলেদের মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ক্লাস। এবং ছেলেদের জন্য পুরুষ টিচার, মেয়েদের জন্য মহিলা টিচার। নতুন জীবনে প্রবেশের আগে খানিকটা প্রশিক্ষণ থাকা আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ন মনেহয়। এতে বিয়ের প্রথম দিকে ভুল বোঝাবুঝি হবার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। আর পরবর্তীতে একে অন্যের সাথে পথ চলতে চলতে নিজেরাই বুঝে নিতে পারে, বুঝে চলতে পারে। আর কোন প্রশ্ন আছে কারো?

শাকের বলল, প্রশ্ন নেই ভাইজান। তবে আমাদেরকে কিছু গাইড লাইন দিন যাতে আমরা জীবনের মূল লক্ষ্যে সর্বদা স্থির থাকতে পারি। ধৈর্য্য সহনশীলতার সমন্বয়ে নিজ নিজ করণীয় করে যেতে পারি। অধমের সাথে উত্তম হতে পারি। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজের অন্ধকার দিক সমূহ উন্মোচন করে, আলোকিত মানুষের কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে পারি।
জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, ইনশাআল্লাহ এইসব কিছু তোমাদের আয়ত্বে এসে যাবে। সেজন্য শুধু একটি কাজ করতে হবে তোমাদেরকে। নিজেদের ঈমানকে মজবুত করতে হবে। বিশ্বাসেই সকল জাগরণ পরিবর্তনের সূচনা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “ঈমানদারের ব্যাপারটা অদ্ভুত। ঈমানদারের প্রতিটি কাজেই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটা একমাত্র মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য যে, সচ্ছলতা অর্জিত হলে সে শোকর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটা তার জন্য কল্যাণকর। আর বিপদ আপদ আসলে সে সবর ধৈর্যধারণ করে এটাও তার জন্য কল্যাণকর একজন মুসলিমের জন্য দুনিয়া আখেরাতের সবচেয়ে বড় সম্বল মূল্যবান নেয়ামত হচ্ছে, ঈমান। কোন বান্দার ঈমান যদি দৃঢ় থাকে, দুনিয়াবী শত বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট মিলেও তাকে হতাশ করতে পারে না। কিন্তু অন্তরে যদি বিশ্বাসের জ্যোতি না থাকে, পার্থিব শত উপকরণও ব্যর্থ হয় তাকে আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করাতে। তাই জীবনের সকল সমস্যার সমাধানের জন্য শুধুমাত্র প্রকৃত ঈমানদার হওয়াটাই যথেষ্ট। কারণ ঈমান এমন একটি আত্মিক শক্তি যা কিনা দুনিয়াবী সকল সমস্যার অব্যর্থ সমাধান। তাই তোমাদের জন্য পরামর্শ এটাই। পুনঃপুনঃ চেষ্টা নিরলস সাধনার মাধ্যমে নিজ নিজ ঈমানকে বুলন্দ করার অধ্যবসায়ে আত্নোনিয়োগ করো।

সবাই একসাথে ইনশাআল্লাহ ভাইজান। এরপর আরো কিছুক্ষণ সবার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে টুকটাক আলোচনা করে প্রোগ্রামের সমাপ্তি টানলো জাওয়াদ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন