সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২৪




সালাম দিয়ে রাহাতের পাশে বসতে বসতে ইমাদ বলল, ঘটনা কি দুলা মিয়া?

সালামের জবাব দিয়ে রাহাত বলল, কিসের ঘটনা?

দূর থেকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে নোটিশ করছি থেকে থেকেই হাসি ফুটে উঠছে আপনার মুখে। আপন মনে একা একা এভাবে হাসি তো আমার জানা মতে প্রেমে পড়ার লক্ষণ। সেজন্যই জানতে চাইছি ঘটনা কি? আপাকে লাগানোর আগে নিজে শিওর হয়ে নিতে হবে তো।

স্বশব্দে হেসে ফেললো রাহাত। ইমাদের পিঠ চাপড়ে বলল, এত বড় লক্ষণ স্পেশালিষ্ট হয়ে বৌয়ের লক্ষণ বোঝো না কেন? শুনলাম আবারো ফাইট করেছো দুজন? এগারো মাসে সতেরো বার ঝগড়া। আনন্দবাড়িতে দাম্পত্য কলহের রেকর্ড গড়ার দুরভিসন্ধি নাতো এটা আবার?

ইমাদের হাসি ভরা চেহারাটা মূহুর্তেই আঁধারে ঢেকে গেলো। বিরক্ত কন্ঠে বলল, মেয়েরা এত অদ্ভুত কেন বলো তো ভাইয়া? নিজেরা সারাক্ষণ ফান করবে কিন্তু অন্যের ফান সহ্য করতে পারবে না। অন্যায় করে নিজেরা তো সরি বলেই না, অন্যরা যখন সরি বলে সেটাও মেনে নিতে চায় না। সারাক্ষণ ভালোবাসে না, ভালোবাসে না জপতে থাকে। কিন্তু যারা ভালোবাসে তাদেরকে মূল্যায়ন করার সামান্য ইচ্ছেও থাকে না মনের ভেতর। মেয়েদের মুখে এক মনে আরেক। চায় একটা বলে ভিন্ন আরেকটা।

রাহাত হাসতে হাসতে বলল, আমি তো জানতাম তুমি আইটি বিশেষজ্ঞ। এখন তো দেখছি সাথে নারী বিশেষজ্ঞও।

ফান না ভাইয়া আমি সত্যিই খুব বিরক্ত। সবাই বলার পর নিজের ভুল আমি আরো গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছি। ভেতরে ভেতরে অনেক অনুতপ্ত হয়েছি। আসলেই ফানের ছলেও কখনো এমন কিছু বলা উচিত নয় যাতে আরেকজন কষ্ট পাবার সম্ভাবনা থাকে। আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম জুনির কাছে। কিন্তু যে ব্যবহারটা জুনি করলো আমার সাথে। তাও আবার জুম্মি আর আত্মজার সামনে। আমি ভীষণ আপসেট। এত সামান্য একটা কারণে যারা এমন সিন ক্রিয়েট করে, তাদের কখনোই বিয়ে করা উচিত নয়। নিজেদের জটিল মানসিকতার কারণে অন্যদের জীবনকেও জটিল করে তোলে।

বুঝতে পারছি তুমি সত্যিই বেশ আপসেট। কিন্তু এত অল্পে ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে কিন্তু সংসার জীবনে সুখী হওয়াটা বেশ কঠিন

এটাকে তুমি ছোট কারণ বলছো ভাইয়া? আপা কখনো তোমার সাথে এমন আচরণ করেনি তো তাই বোঝো না
রাহাত হেসে বলল, সেটা মানছি। কিন্তু তোমাকেও মানতে হবে সবার পরীক্ষা এক রকম নয় এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি সংসারে আমরা সবাই পরীক্ষার্থী এটাও সত্যি। আমাদের প্রশ্নপত্র আলাদা কিন্তু সবাই প্রতি মূহুর্তে নিজ নিজ পরীক্ষা দিয়ে চলছি।

তারমানে কি আপাও উল্টো পাল্টা করে তোমার সাথে? কিছুটা বিস্ময় মেশানো স্বরে প্রশ্ন করলো ইমাদ

রাহাত হেসে বলল, তোমার আপা কিছুই করে না, এটাই আমার পরীক্ষা। বিয়ের এক যুগ পেরিয়ে যাবার পরেও আমাদের কোনদিন ঝগড়া হয়নি, মনোমালিন্য হয়নি। কেন হয়নি এটা এখনো আনসলভড ধাঁধা আমার জন্য। আমি ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে এমন কিছু করি বা বলি যাতে নূহার মেজাজ আকাশ ছুঁয়ে যাবার কথা। কিন্তু নূহা হাসি মুখে মেনে নেয়। অথচ আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে তাকে ভাজাভাজা করে ফেলতো। তখন বেশ মন খারাপ হয়। মনেহয়, কেন রাগ করে না আমার সাথে? কেন চিৎকার করে না ছোট ছোট কারণে? কেন অভিযোগ করে না? অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে যায় না কেন কথায় কথায়?

আর আমি ভাবি কেন এত অল্পতেই রাগ করে জুনি? এত ছোট কারণে এত অভিমান বা এভাবে রিঅ্যাক্ট করার কি আছে? এবার বুঝলাম কেন বলে, নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপাড়েতেই সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।

রাহাত হেসে বলল, এই তো এতক্ষণে ট্র্যাকে ফিরে এসেছো। কিন্তু ইমাদ এভাবে সবার কাছে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে অভিযোগ করাটা কি ঠিক? তোমার আর জুনির এই বিষয়টা নিয়ে একসাথে বসে আলোচনা করা উচিত। দাম্পত্যে ভুল বোঝাবুঝি, মনোমালিন্য ইত্যাদি সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে ভাইজান আমাদেরকে বলেছিলেন, "বলাটা যত সহজ, মানসিক অস্থিরতার সময় মোটেই ততটা সহজ নয় শান্ত ভাবে একে অন্যের সাথে কমিউনিকেট করা। তাই প্রত্যেক দম্পতির অন্তত একজন হলেও সাপোর্ট সিস্টেম থাকা উচিত। সে হতে পারে পরিবারের বড় কেউ, কোন ফ্রেন্ড কিংবা এমন কেউ যার উপর ভরসা করা যায়। এবং যখনই কোন সমস্যা হবে তাকে সাথে নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে তোমাদের যেহেতু অতি সামান্য কারণেই মনোমালিন্য হচ্ছে, আমার মতে তোমাদের উচিত নিজেদের জন্য একজন সাপোর্ট সিস্টেম ঠিক করে নেয়া। যাতে সমস্যা হলে তার কাছে যেতে পারো দুজন। এভাবে পুরো পরিবারকে টেনশন না দেয়াটাই উত্তম। তাছাড়া সংসারে দুজন একসাথে অবুঝ হলে কিভাবে হবে বলো? জুনির বয়স কম, আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ কম। তোমাকে তাই সমঝদারির পরিচয় দিতে হবে।

দিতে তো চাই ভাইয়া। কিন্তু ওর অভিযোগই তো মোটে শেষ হয়না। আমি কি করবো বলো?

জুনির কথাগুলোকে অভিযোগ হিসেবে নিয়ো না। আবদার কিংবা তোমাকে ঘিরে ওর চাওয়া হিসেবে নাও। ভালোবাসার ঘাটতি নিয়েই তো বেশির ভাগ অভিযোগ। ভালো তো তুমি বাসোই জুনিকে। সেই ভালোবাসাটাই বেশি বেশি করে বোঝানোর চেষ্টা করবে। ওর চাওয়াগুলোকে বোঝার চেষ্টা করো। দেখবে এসব সমস্যা দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

হুম, তাই করতে হবে। প্লীজ ভাইয়া আমাকে আরো কিছু বুদ্ধি দাও।

রাহাত হেসে বলল, আমি আর কি বুদ্ধি দেব তোমাকে? এইসব বিষয়ে আমার ধারণা তোমার আপাতে শুরু হয়ে তাতেই শেষ।

আমরা সবাই জানি আপা আমাদের বাড়ির সবচেয়ে জটিল মেয়ে। তুমি আপার সাথে এক যুগ পার করে ফেলেছো নির্ঝঞ্ঝাটে। তুমি জানো না এই কথা বললে হবে?

রাহাত হেসে বলল, তোমার আপার আর আমার জীবন ছন্দময়, গতিময় হওয়া শুরু করেছিল কখন থেকে শুনবে?

ইমাদ হেসে বলল, অবশ্যই শুনবো। তবে আন্দাজ করতে পারছি কিছুটা। জারিফ তোমাদের জীবনে আসার পর থেকে

উহু, ভাইজান ফিরে আসার পর থেকে। এরআগ পর্যন্ত পরিবারের সবার সাহায্য, বিশেষ করে আদী ভাইয়ার সহায়তাতে আমাদের সংসার চলছিল। সময়ও একজন স্ত্রীর সমস্ত দায়িত্ব নূহা পালন করতো। পারলে আরেকটু বেশি করতো। কিন্তু প্রাণ ছিল না ওর কোন কিছুতেই। ওর কান্নার চেয়ে হাসি বেশি বেদনাক্ত মনেহতো আমার কাছে। কেমন যেন যান্ত্রিক ছিল সবকিছু। অর্থাৎ, করতে হবে তাই করা। মনেহতো একটা শব্দই জানে, ওকে। যাই জিজ্ঞেস করতাম, জবাব একটাই ছিল, ওকে। জারিফের কন্সিভের কথা জেনে আমি তাই যতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, তারচেয়ে হাজার গুণ বেশি শঙ্কিত হয়েছিলাম। আমার ভয়টা অযৌক্তিকও ছিল না একেবারে। কারণ যেখানে ভাইজানের প্রতি এত ভালোবাসা থাকার পরও নূহা জিহাদ, জিশান, নাবিহার ব্যাপারে এতটা উদাসীন ছিল। সেখানে এই বাচ্চার ব্যাপারে উদাসীনতার মাত্রা না জানি কতটা হবে, ভেবে ভীতি জাগাটা স্বাভাবিক ছিল। ভাইজান যখন ফিরে এসেছিলেন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল নূহা। আমার মনেহয় শুধু আমারই না, আমাদের আনন্দবাড়ির প্রতিজন সদস্যের মনে আছে নূহার সেদিনের আর্ত চিৎকারের কথা। ভাইজানকে আগে থেকে সব জানানো হয়েছিল। কিন্তু নূহাকে জানানোর সাহস কেউ করতে পারেনি। ভাইজানকে সরাসরি দেখেই নূহা অবগত হয়েছিল। বাড়ির কেউ থামাতে পারছিল না নূহার কান্না। বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত ভাইজান গিয়েছিলেন। ঐদিন প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম ইমাদ একে অন্যের জন্য পাগল দুজন মানুষের জীবনে কত বড় পরীক্ষা রূপে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। ভাইজান না পারছিলেন নূহার কান্না সহ্য করতে, না পারছিলেন ওকে বুকে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে। জানি না কিভাবে সামলে নিয়েছিলেন মূহুর্তে ভাইজান নিজেকে।

আর আপা?

ভাইজানের কথাতেও শান্ত হয়নি। যতটুকু শক্তি ওর শরীরে ছিল নিঃশেষ হয়ে যাবার আগপর্যন্ত কান্না করেছে। এরপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠার পর আবারো সেই কান্না। তিনদিন এভাবেই চলেছে। ঘাবড়ে গিয়েছিল সবাই খুব বেশি।সিদ্ধান্তই নিতে পারছিল না কেউ কি করবে, কি করা উচিত এই মূহুর্তে। কিন্তু তিনদিন পর নূহা নিজ থেকেই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। এতটা প্রশান্তচিত্ত নূহাকে এরআগে আমি অন্তত দেখিনি কখনোই। অদ্ভুত এক ধরণের শান্তি, স্বস্থি, সুখ সুখ আবেশে ঘেরা ছিল নূহার অভিব্যক্তি। প্রচন্ড এক ঝড়ের পর ঝকঝকে উজ্জ্বল, চঞ্চলা রোদেলা নীলাকাশ যেন। আমার কাছে এসে বেশ খানিকটা আদুরে স্বরে বলেছিল, আমাকে কি তুমি হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবে? গত তিনদিন খুব বেশি অনিয়ম হয়ে গিয়েছে। না জানি বাচ্চাটা আমার কেমন আছে। নিশ্চিত হতে চাইছি বেবীর কোন সমস্যা হয়নি। নূহার কন্ঠে আবদার ছিল, আহ্লাদ ছিল, দরদ ছিল। এরআগে কখনোই এমন কন্ঠে ওকে কথা বলতে শুনিনি আমি।

ইমাদ হেসে বলল, তখন তোমার কেমন লেগেছিল?

রাহাত হেসে বলল, আমার শব্দ ভান্ডার এমনিতেই সীমিত। ভালো লাগার মাত্রাকে প্রকাশ করা তাই অসম্ভব। এরআগে নূহার প্রতি আমার দায়িত্ববোধ ছিল, অনেক মায়া ছিল, ভালো লাগাও হয়তো ছিল। কিন্তু সেসবই ভাইজানকে কেন্দ্র করে ছিল। কিন্তু নূহার জন্য নূহাকে ভালো লাগাটা সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল। নূহার জন্য সবকিছু আমি ভাইজানের প্রতি ভালোবাসা কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে করেছিলাম। কিন্তু নূহাকে ভালো আমি ওর কারণেই বেসেছিলাম। কেন জানো?

কারণ এছাড়া আপা কোন অপশনই রাখেনি তোমার কাছে। এটা আপার কমন কাজ এবং ডায়লগ। আমরা সবাই জানি। হাসতে হাসতে জবাব দিলো ইমাদ।

রাহাতও হাসি মুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। সত্যিই তাই এছাড়া কোন অপশনই রাখেনি। ভাইজান ফিরে আসা মাত্রই নূহা ফিরে এসেছিল ওর নিজের মাঝে। নূহা আমাকে বলেও ছিল, উনি পৃথিবীর কোথাও আছেন এবং ভালো আছেন। আমার আনন্দে থাকার জন্য এই জানা টুকুই যথেষ্ট। কারণ উনি আছেন, তারমানে আমি একা নই। যখনই ডাকবো উনি ঠিক ঠিক এসে যাবেন আমার কাছে ইনশাআল্লাহ। দুনিয়া নামক এই শস্যক্ষেতে নিজের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাজ করে যাবার জন্য আমার আর কিছুরই দরকার নেই। উনি দূরে কোথাও হলেও আছেন শুধু এই বিশ্বাস আর ভরসাটুকু দরকার। যখন নূহা বলেছিল তখন কথাগুলোর মর্ম বুঝতে না পারলেও, এখন পারি। নূহার দুনিয়া ভাইজানকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। ভাইজানকে ছাড়াও যে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব। সেটাই ওর জানা ছিল না। তাই ভাইজানকে জীবিত দেখা মাত্রই বেঁচে থাকার ইচ্ছে ফিরে এসেছিল ওর মনে। তবে বাবা-মামণি, পরিবারের অন্যান্যদের সাথে নূহার অভিমান, দ্বন্দ্ব অনেক লম্বা সময় ধরে চলেছে। যদিও আমার উপর কখনোই তার প্রভাব পড়তে দেয়নি। সত্যি বলতে আমি কখনোই একবিন্দু কৃত্রিমতা অনুভব করেনি ওর কথা বা আচরণে। যখন উচ্ছল তখন আন্তরিক ভাবেই আনন্দিত মনে হয়েছে। যখন ডিস্টার্ব ফিল করেছে দ্বিধাহীন কন্ঠেই বলেছে, তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ আমাকে কিছুক্ষণের জন্য একা ছেড়ে দাও। স্পষ্টভাষীতা সাময়িক কষ্ট দিলেও, সম্পর্কের মধ্যে কখনোই বিষবাষ্প জমাট বাঁধার সুযোগ পায় না। এরফলে নূহার আর আমার সম্পর্কের ভীত স্বচ্ছতা ঘেরা ছিল সবসময়ই। যখন আলাদা বাসায় ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ জানতে চাইলে নূহা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলেছিল, আমার পক্ষে উনার সাথে একই বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। আমি দুর্বল হয়ে পড়বো, আমার দ্বারা ভুল হয়ে যাবে। বার বার হবে। তাই এই একটা জায়গাতেই আমি পতনের ভয় করি। সুতরাং, এখান থেকে আমাকে দূরে থাকতেই হবে। আবার যেমন নূহার মুড খুব আপ ডাউন করতো, অবশ্য এখনো করে। এত দ্রুত চেঞ্জ হয় ওর মুড নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয় প্রায়ই। অবশ্য নিজের মুন্সিয়ানা খুব কমই ব্যক্তি নিজের উপর প্রয়োগ করতে পারে।

এটা একদম ঠিক বলেছো ভাইয়া। বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজেকে কন্ট্রোল করাটাই সবচেয়ে কঠিন।

হুম, তবে নূহার এই ব্যাপারটাতে ভাইজান আমাকে সাহায্য করেছেন। সংসার জীবনে প্রতিটি করণীয় বিষয় সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত ভাইজানই আমার সাপোর্ট সিস্টেম। এখনো নূহাকে কোন কারণে আপসেট দেখলে আমি ভাইজানকে ফোন করেই জিজ্ঞেস করি কি করতে হবে। তবে ভাইজানের নিজ থেকে বলে দেয়ার মাত্রা সেই তুলনায় অনেক বেশি। এই যেমন কিছুক্ষণ আগেও বাচ্চাদের নিয়ে খেলতে বেড়িয়েছিলাম আমি আর ভাইজান। আদী ভাইয়া যখন ফোনে জানালেন মিটিং শেষ। ভাইজান আমাকে বললেন, বাচ্চাদের সাথে আমি আছি। তুমি নূহার কাছে যাও। অনেক স্মৃতি জায়গাটাকে ঘিরে। কারো সাপোর্ট দরকার এখন নূহার। আজ আরেকবার নিশ্চিত হলাম কাউকে ভালোবাসা দাবী করাটা খুব সহজ। কিন্তু ভালোবাসার হক আদায় অতটা সহজ নয়। তা না হলে ভাইজান বলার আগেই আমি ছুটে যেতাম নূহাকে সাপোর্ট দেবার জন্য। ভাইজানই আমাকে বলেছিলেন, আকাশের চাঁদ এনে দিলেও নূহাকে খুশি করতে পারবে না। কারণ ওর দুনিয়াবী কোন চাহিদা নেই। ওর মনে ভালোবাসা জাগাতে হলে ওকে শুধু আকুল হয়ে ভালোবাসতে হবে। প্রতিটি কথা, কাজ আচরণে ওর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে। খুনসুটি পছন্দ করে খুব বেশি। ভালোবাসার আবেগীয় প্রকাশের চেয়ে দুষ্টুমির ছলে প্রকাশ ওকে বেশি আনন্দিত করে। আমার এখনো মনেআছে ভাইজান দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বলেছিলেন, তোমার কাছে সার্টিফিকেট আছে তাই নূহাকে জয় করার জন্য এখন শুধুমাত্র আর তিনটা জিনিস প্রয়োজন তোমার। বুক ভরা অকৃত্রিম ভালোবাসা, বেশ অনেকটা ধৈর্য্য আর খানিকটা কেয়ার। ভালোবাসা দরকার কারণ মেয়েটা একটা ভাষাই বোঝে জ্ঞান হবার পর থেকে। তাই তোমার টার্গেট থাকতে হবে এত ভালোবাসা দেবার যাতে ভালোবাসা পেতে পেতে বিরক্ত হয়ে যায়। চিৎকার করে যাতে বলে ওঠে তুমি অসহ্য, তোমার ভালোবাসাও অসহ্য। প্রচন্ড রকম বিরক্তিকর হয়ে ওঠে নূহা মাঝে মাঝে। সময়গুলোতে ওকে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়া থেকে নিজেকে প্রতিহত করার জন্য ধৈর্য্যের দরকার পড়বে তোমার। আর দুনিয়ার সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজের দিকে ফিরে তাকানোর কথাও মনে থাকে না নূহার। তাই ওর কেয়ার তোমাকেই করতে হবে। আমি এখনো ভাইজানের কথাগুলো মেনে চলতে চেষ্টা করি। কেন করি জানো?

কেন ভাইয়া?

কারণ আমি জীবনে সুখী হতে চাই। ভালো থাকতে চাই। আর জগতে সুখী হবার সবচেয়ে ফলপ্রসূ টিপস হচ্ছে, অন্যেকে সুখে রাখার চেষ্টা করে। আমার আর নূহার মাঝে ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্য না হবার একটা কারণ এটাও হতে পারে, আমরা দুজনই একে অন্যেকে ভালো রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নূহার অনেক অপছন্দনীয় কাজ আমি খুশি মনে মেনে নেই। কখনো ঝামেলা এড়িয়ে যাবার জন্য, কখনো ওকে কষ্ট দিতে চাই না সেজন্য। তবে মোষ্ট অব দ্য টাইম এমনটা করি ওর প্রতি ভালোবাসার জন্য। যে ভালোবাসা মানুষকে ধৈর্য্যশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে না, যে ভালোবাসা ত্যাগের আকাঙ্ক্ষা বিবর্জিত। সেটা সত্যিই ভালোবাসা কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যখন কারো হাসির মাঝে সুখের অনুভূতির দেখা মেলে, তখনই না বলা যায় ভালোবাসি মানুষটাকে। ভাইজান আমাদেরকে একদিন বলেছিলেন, আমি মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই ছোট্ট শিশুরাও বোঝে এমন কিছুতে অবুঝের মতো আচরণ করি, খুবই বোকার মতো কথা বলি। যা শুনে হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে ওঠে আমার ওয়াইফ। ইচ্ছে করে বোকা সাজার, অবুঝ হবার লক্ষ্যটাকে ছুঁয়ে দেবার আনন্দে তখন আমিও মনে মনে উল্লাসিত হয়ে উঠি। কারণ ওর হাসিটুকুনই আমার প্রাপ্তি। আরেকদিন ভাইজান বলেছিলেন, আমরা দুজন যখন কোন ইন্টালেক্টুয়াল গেমস খেলি দুজনই ইনটেনশন থাকে একে অন্যেকে জিতিয়ে দেবার। মুখে মুখে যদিও বলি হেরে ধূলিসাৎ হবার জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু মনে মনে দুজনই হেরে যেতে চাই প্রাণপণে একে অন্যের কাছে। নিজে হেরে গিয়েও অন্যেকে জিতিয়ে দেবার এই আকুলতাটাই ভালোবাসা। তাছাড়া দুজন মানুষইই যখন একে অন্যেকে জিতিয়ে দিতে চায়। তারা কেউই হারে না। কিন্তু তাদের সম্পর্কের বন্ধন জিতে যায় বারংবার।

ইমান ধীরে ধীরে বলল, আমি বুঝতে পেরেছি ভাইয়া তুমি যা বোঝাতে চেয়েছো। আমার সত্যিই এখন খুব বেশি মন খারাপ লাগছে। আমরা আসলে ভালোবাসা কি জানিই না ভাইয়া

রাহাত হেসে বলল, বিশ্বাস করো আমিও জানতাম না। তুমি আনন্দবাড়ির সদস্য হয়েই জানো না। আমার জানার তো তাই প্রশ্নও ওঠে না। আমি ভালোবাসা জেনেছি, দেখেছি, বুঝেছি ভাইজানের সাথে পরিচিতি হবার পর। এই মানুষটাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভালোবাসা শেখানোর জন্যই মনেহয় আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। তাই উনার কাছ থেকে ভালোবাসা শিখে নিয়ে নিজ জীবনকে ভালোবাসাময় করে তোলার চেষ্টা করো।

হ্যা ভাইয়া আমি তাই করবো ইনশাআল্লাহ।

রাহাত হাসি মুখে বলল, জারিফকে দেখো কি আনন্দে ঝাঁপাঝাপি করছে ভাইজানের চারপাশ ঘিরে। ওকে যখনই জিজ্ঞেস করি তুমি কি বাবাকে ভালোবাসো। দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে বলে, এই এত্তোগুলা ভালোবাসি তোমাকে বাবা। এরপর হাত গুঁটিয়ে নিতে নিতে বলল, শুধু একটু কম পাপার চেয়ে। পাপাকে একটু বেশি ভালোবাসি তোমার আর মা চেয়ে। পাপা যে বেশি বেশি ভালো আমি কি করবো বলো? নূহা দুষ্টুমির ছলে ঝগড়া জুড়ে দেয় জারিফের সাথে। চোখ পাকিয়ে বলল, আজই তোকে তোর পাপার কাছে পাঠিয়ে দেবো দুষ্টু ছেলে। আমরা তোর পেছনে খেঁটে মরি, আর ভালো পাপাকে বেশি বাসা হয়। জারিফ তখন কুটকুট করে হাসে। নূহার মুখে হাসি থাকলে চোখের কোনে চিকচিক করে অশ্রু। বাবা কথায় কথায় বলেন, আমাদের আনন্দবাড়িতে অসংখ্য ঘর আছে কিন্তু সেইসব ঘর একটি জমিনের উপরই দাঁড়ানো। আর সেই জমিন হচ্ছে জাওয়াদ। বাবার এই কথার সাথে দ্বিমতের কোনই সুযোগ নেই। যখন মনে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের আকুলতা থাকে এবং স্বভাবে সত্যিকার ভালোবাসা থাকে। তখন জগতের কঠিন থেকে কঠিন কাজও অতি সহজেই করে ফেলা সম্ভব হয়। ভাইজানকে দেখেই এটা আমি উপলব্ধি করেছি। এবং নিজেকে সেই মতো গড়ে তোলার নিরন্তন চেষ্টা করে যাচ্ছি। তুমিও চেষ্টা করে দেখো ইমাদ। দেখবে সুখকেই সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিস মনে হবে জীবনের ইনশাআল্লাহ।

ইমাদ হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো। তোমাকে অনেক অনেক শুকরিয়া ভাইয়া।

রাহাত হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। বাচ্চাদের সুইমিং মনেহয় আজকের মতো সমাপ্ত হয়েছে। চলো আমরা উঠি। মাগরীবের সময়ও হয়ে আসছে। রাহাত আর ইমাদ দুজনই তখন হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালো


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন