সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...১৩



ইমাদকে ঝিলের পাড়ে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়েই এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে সুবহা বলল, কি রে তুই কোত্থেকে এলি?

ইমাদ
সালাম দিয়ে বলল, বড় ফুপ্পি, ফুপাজান, ভাইজান আর রাহাত ভাইয়াও এসেছেন আপ্পি। আমি উনাদের সাথে এসেছি।

সালাম
দিয়ে হাসিতে বিকশিত হয়ে সুবহা বলল, জাওয়াদ এসেছে? কোথায় এখন?

ভাইজান
রাহাত ভাইয়াকে নিয়ে উনার কটেজের দিকে গিয়েছেন। ফুপ্পি আর ফুপাজান কোথায় ঠিক জানি না

তোর
কি হয়েছে? চোখ-মুখ এতো শুকনো কেন? আচ্ছা এখন মনে পড়েছে। ছোটবেলায় তোদেরকে যেসব নীতি বাক্য পড়ানো হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যেভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো নাএটাও তো ছিল। বৌকে ড্রাকুলা বলার আগে পরিণতি চিন্তা করে নিলেই তো এখন এমন করুণ দশা হতো না

আপ্পি
তোমরা কেউই মূল ঘটনা না জেনেই আমাকে বকাঝকা করছো। জুনি সামান্য একটা ফানকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এত বড় করে ফেলবে জানলে, আমি কখনোই ফান করতাম না ওর সাথে। এত সাধারণ একটা বিষয়কে জুনি বিশাল ইস্যু বানিয়ে ফেলেছে। ব্যাপারটা তো আমরা দুজন মিলে কথা বলেই মিটিয়ে ফেলতে পারতাম। পরিবারকে ইনভলব করার কোন দরকার কি ছিল?

বাচ্চারা
বেলুন হাতে পেলে কি করে বল তো?

ফোলানোর
চেষ্টা করে মনেহয়। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বললো ইমাদ

সুবহা
হেসে বলল, একজন বিয়ে বিশেষজ্ঞ কি বলেছেন জানিস? বৌয়ের অপছন্দীয় প্রতিটা বিষয় হচ্ছে বেলুনের মতো। বৌদের হাতে কখনোই তাই বেলুন দিতে নেই। তা না হলে বৌরা যে শুধু সেই বেলুন ফোলায় তাই না। মনের রাগ, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদির গ্যাস ভরে ফোলায়। এখন তুই বল গ্যাস বেলুন কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারে কোথাও? প্রথম সুযোগেই ছুট লাগায় উর্দ্ধপানে। চলে আসে সবার দৃষ্টির সামনে। তারপর যেমন খুশি তেমন উড়ে বেড়ায়। তুই বেলুন দিয়েছিস বলেই তোর বৌ সেটাকে গ্যাস দিয়ে ফুলিয়ে পরিবারের সামনে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, দেখতে ড্রাকুলার মতো এটা আবার কোন ধরণের ফান?

দেখতে
ড্রাকুলার মতো এই কথা কিন্তু আমি বলিনি আপ্পি। এটা জুনি বানিয়ে বলছে। এজন্যই আমার আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে। আমার ভুল হয়ে থাকলে একবার কেন একশোবার সরি বলতে রাজী আছি আমি। কিন্তু মিথ্যা অপবাদ কেন দিলো আমার উপর? জুনি যাতে কষ্ট না পায় সেজন্য আমি ফান করে নিজের অপছন্দের কথাগুলো বলার চেষ্টা করি। কিন্তু এতে তো দেখছি বিপত্তি আরো বেশি।

সুবহা
হেসে বলল, চল তোকে আজ ফান করার উপরে একটা গল্প শোনাই। গল্পটা শোনার পর তুই নিজেই সিদ্ধান্ত নিস দাম্পত্য জীবনে ফান কেমন হওয়া উচিত। জাওয়াদ আর নূহার বিয়ে আমাদের আনন্দবাড়িতে একটা বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। ভালোবাসার বিপ্লব। বিয়ের ঠিক এক সপ্তাহ আগে নূহা এক্সিডেন্ট করেছিল সেটা তো জানিসই। এত ভয়ঙ্কর ছিল এক্সিডেন্টটা মনে হলে এখনো শিহরিত হয় মন। মাথায় প্রচন্ড আঘাতের ফলে পুরো চারদিন সেন্সলেস ছিল নূহা। উইন্ডো শিল্ড ভেঙে নূহার চেহারা, গলার কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল। তাকানো যেত না ওর চেহারার দিকে। ছোটবেলা থেকে সবার চোখে নিজেকে সুন্দর হিসেবেই জেনে এসেছে নূহা। হঠাৎ নিজেকে ওভাবে দেখলে হয়তো মেনে নিতে পারবে না এই ভয়টা কাজ করেছিল আমাদের সবার মনেই। তাই সম্পূর্ণ সুস্থ হবার আগে কোন ভাবেই যাতে নূহা নিজের চেহারা দেখতে না পারে সেই ব্যাপারে আমরা সবাই সচেতন ছিলাম। জাওয়াদ শুধু যে নির্দিষ্ট দিনেই ওদের বিয়ের আয়োজন করেছিল তাই নয়। নূহাকে টেক কেয়ার করার দায়িত্বও ধরতে গেলে একাই পালন করেছে দুই মাস। এক্সিডেন্টের মাস খানেক পর নূহা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সবসময় সবকিছু মিলিয়ে শুধু যে শুকিয়ে গিয়েছিল তাই না। নূহার গায়ের রঙও কেমন যেন কালচে হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া চেহারা দেখতে না পারলেও নিজের হাত-পা তো দেখতে পারতো। তখন শুধু প্রশ্ন করতো এই রুমে কোন আয়না নেই কেন? ওয়াসরুমে পর্যন্ত আয়না নেই। এর কারণ কি? একদিন এমন নিজের হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নূহা প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা আমার হাত এমন কালচে দেখাচ্ছে কেন? জাওয়াদ তখন চোখ বড় বড় করে বিস্ময় মাখা স্বরে বলেছিল, সেকি তুমি এখনো জানো না এই তথ্য? নূহা অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো, কোন তথ্য? জাওয়াদ তখন বলেছিল, এটাই যে তুমি শুধু আমাদের আনন্দবাড়ির প্রিন্সেসই নও। তুমি হচ্ছো গিয়ে রোমিং প্রিন্সেস। অর্থাৎ, যে কিনা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গার প্রিন্সেস হয়। তো ঘুরতে ঘুরতে বর্তমানে তোমার মাথায় আফ্রিকান প্রিন্সেসের তাজ। এখন তুমিই বিবেচনা করে বলো আফ্রিকান প্রিন্সেসের হাতের রঙ কেমন হওয়া উচিত?

ইমাদ
হেসে বলল, আপ্পা তখন হেসে ফেলেছিল তাই না?

সুবহা
হেসে বলল, হুম!

ভাইজানের
সত্যিই কোন তুলনা হয় না। এরপর বলো আপ্পি।

মুখে
হাসি লেগে থাকলেও বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছলছল করে উঠলো সুবহার। ষোল বছর আগের সেইসব দিন, মূহুর্ত যখনই ভাবনাতে দোলা দেয়, মুগ্ধতা ভালো লাগার ঐশ্বর্যে দুচোখে বরষা নামিয়ে দিয়ে যায়। ইমাদকে বলতে যেয়ে সুবহার মনের পর্দায় জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো সেই মূহুর্তটি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলো, জাওয়াদের কথা শুনে হেসে উঠেও আবার নীরব হয়ে গিয়েছিল নূহা। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবারো প্রশ্ন করেছিল, এই রুমে কোন আয়না নেই কেন?

জাওয়াদ
হাসিমুখে বলেছিল, কারণ এই রুমে আয়নার কোন প্রয়োজন নেই। জানোই তো মুমিন মুমিনের জন্য আয়না স্বরূপ। এই রুমে আমাকে দেখার জন্য তুমি আছো। আর তোমাকে দেখার জন্য আমি। বাড়তি আয়নার কি দরকার এখানে? আরে আবারো হাতের দিকে তাকিয়ে কি দেখছো? বুঝতে পারছি নিজেকে দেখতে চাইছো তুমি। সেজন্য তো আমি আছিই। আমার চোখে তাকিয়ে দেখো তাহলে বুঝবে যে, আমার মনের যতটুকুন চাওয়া ছিল তারচেয়েও অনেক বেশি সুন্দর তুমি।

নূহা
হেসে বলল, তাই? তা কতটুকুন চাওয়া ছিল আপনার মনের সেটা একটু শুনি?

আচ্ছা
তাহলো শোন! একটি হৃদয়ের সন্ধানে হেঁটেছি বহুপথ! সত্যাশ্রয়ী প্রাণ যার আলোকিত চেতনাধারী! ম্লানতা বিহীন পুষ্পিত যার ভাবনা! উড়তে জানে যে বাঁধনহারা! ভাসতে পারে শুভ্র মেঘ ছুঁয়ে! আশার বাণীর স্ফটিক ঝর্ণাধারা! হাসতে পারে অন্যের আনন্দে! তুলতে পারে সুর গভীর নিরানন্দে! পিপাসা মিটায় যে ধৈর্য্যের অমিয় সুধা পানে! অন্তঃরাত্মা যার ঘাসফুলে ছাওয়া মায়াময় প্রকৃতি! হতে জানে একাকীত্বের বিশ্বস্ত সাথী! চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যময়ী মোটেও সে নয়! সত্ত্বাধিকারী শুদ্ধ মননে যার সর্বদা সূর্যোদয়! জ্ঞানের আলোকিত বাতায়ন যার মন! সময়ের প্রতিটি মূহুর্তকে করে নিতে জানে আপন! স্বপ্নরা যার আকাশ জোড়া বর্ণিল রঙধুন! স্পর্শে যায় শুকনো পাতায় দোলে সজীবতার রেণু! ঘোর আঁধারের বুকেও জ্বালাতে পারে এক বিন্দু দিয়া! শোনাতে পারে সুখের বাঁশি, হয়ে চপলা রাখালিয়া!

নূহা
হেসে বলল, হায় আল্লাহ আপনি যে এমন ফ্লিমি ডায়লগও জানেন, সেটা তো জানাই ছিল না আমার। হয়েছে নিজেকে আর দেখতে হবে না আমার

জাওয়াদ
হেসে বলল, কিন্তু তারপরও আমি তোমার আয়না হতে চাই। ইনশাআল্লাহ সর্বদা আমি আয়না হয়ে তোমাকে দেখিয়ে দেবো কতটা আত্মিক সৌন্দর্যের অধিকারী তুমি।

কতটা
?

এতটাই
যে তোমার মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুচ্ছের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতাম! তোমার ভাবনার জোনাক জোনাক গুঞ্জরনে দুনিয়ার সহস্র হতাশা বুকে আশার সুর শুনতাম! আরেকবার আশাবাদী মানুষের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম তোমার শব্দঋণে আবদ্ধ হয়ে! খুঁজে পেয়েছিলাম সেই আমারে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতায় কোথাও কবে যে ধীরে ধীরে গিয়েছিল ক্ষয়ে! জীবনের সমস্ত ব্যস্ততা একপাশে রেখে, সবটুকুন আকর্ষণ তোমাতে হত জড়ো! তোমার তরেই ছিল প্রাণের নিঃশব্দ আকুতি, মনের নিভৃত চাওয়া যে, তোমার ভালোবাসায় নতুন করে আমায় গড়ো!

জাওয়াদের
কথা শুনে নূহার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলেও মুখের কিছু বলেনি। তবে এরপর আর কোনদিন আয়নায় নিজেকে দেখতেও চায়নি। একটা মেয়ে যখন তার স্বামীর মুখ থেকে এমন আন্তরিক ভালোবাসা মিশ্রিত স্বীকৃতি পায়। তার মনের সবটুকুন চাওয়া পূরণ হয়ে যায়। এমনই হওয়া উচিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তাই না? যেখানে ফান শুধু আনন্দের খোঁড়াকই নয়, মনের ভালোবাসারও সাক্ষী। বুঝেছিস?

সুবহা
আপ্পির কথা শুনে মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলো ইমাদ। জুনির উপর জমে ওঠা বিরক্তির বরফ গলতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ আগেই। ভাইজান আর নিজের ফানের পার্থক্যের কথা চিন্তা করে অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো মনকে।
ইমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সুবহা হেসে বলল, বসে থাক এখানেই। আমি জুনিকে ধরে এনে দিয়ে যাচ্ছি তোর কাছে

ইমাদ
বলল, না আপ্পি আমিই বরং জুনির কাছে যাই।

এটা
তো আরো উত্তম চিন্তা। ঠিকআছে তুই জুনির কাছে যা। আমিও আমার কাজে যাই। ইমাদকে জুনির কাছে পাঠিয়ে সুবহাও নিজের কাজে রওনা হলো।

@

একটি
মুসলিম কনজারভেটিভ ফ্যামিলিতে আমার জন্ম। আমার বাবা একজন মাদ্রাসার টিচার ছিলেন। পাশাপাশি একটি ইসলামী সংগঠনের দায়িত্বশীল। বাবা-মাকে দেখেই নাকি বাচ্চারা ছোটবেলায় সবকিছু শেখে। আমার শিক্ষার সেই পিরিয়ডটা খুব যাতনাকর ছিল। বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, সারাক্ষণ কুরআন হাদীসের কথা বলতেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের সাথে বাবার ব্যবহার মোটেই শরীয়তসম্মত ছিল না। সবসময়ই আমার মা' সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতেন। একটু ঊনিশ বিশ হলেই মারধর করতেন, নানান ধরনের শারীরিক মানসিক অত্যাচার করতেন। আমাদের ভাইবোনদের একটু কিছু ভুল হলেই বেত দিয়ে পিটাতেন। কারণে, অকারণে খুব মারতেন, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতেন। এককথায়, বাবার সুন্দর ভাবে কথা বলা কেমন কোনদিন বুঝিনি। ছোটবেলায় ধরে নিয়েছিলাম বাবারা বোধহয় এমনই হন। কারন আমাদের জীবন বাড়ির চার দেয়ালের মাঝেই বন্দী ছিল। আশে পাশে কোথাও যেতে দেয়া হতোনা, কারো সাথে মিশতে দেয়া হতোনা। মাদ্রাসায় যেতাম আসতাম এই পর্যন্তই। এই পর্যন্ত পড়ে ফাইল বন্ধ করে দিলো আদীর দিকে ঠেলে দিলো নূহা।

আদী
কিছুটা অবাক কন্ঠে বলল, এত দ্রুত পড়া হয়ে গিয়েছে?

পড়তে
চাইছি না ভাইয়া। কেমন যেন একটা দমবন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে। সংক্ষেপে বলো আমি শুনছি। ডিটেইল পড়ার মতো মানসিক শক্তি এই মূহুর্তে আমার নেই।

তুই
এখনো কারো সমস্যা পড়ার সময় তার স্থানে নিজেকে নিয়ে যাওয়াটাকে ব্যহত করতে পারিস না। তাই না? ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন সুহাইব আহসান সাহেব।

নূহা
বলল, মানুষের কষ্ট এখনো আমাকে খুব বেশি ব্যথিত করে বড় মামা। তবে আগে মনের ব্যথা আমার চোখে-মুখে ফুটে উঠতো। কেউ তার সমস্যা বলার সময় যতটা না দুর্বল হতো, শুনতে গিয়ে আমি তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি দুর্বল হয়ে যেতাম। সমস্যাগ্রস্তকে কি সামলাবো, নিজেকে সামলাতেই হিমশিম খেতে হতো। কেন দুনিয়াটা জুড়ে এত কষ্ট? কেন মানুষ এত দুঃখী? কেন মানুষই মানুষের সমস্ত কষ্টের মূল কারণ? কেন যেই সম্পর্কের বন্ধনগুলোর ছায়া দানকারী বৃক্ষ হবার কথা ছিল। তারাই তপ্ত দাহ নিয়ে হাজির হয় জীবনে? এমন ধরণের প্রশ্নরা হাহাকার তুলে যেত মনে। আমার ধারণা ছিল, কোন মানুষকে তার সমস্যার সঠিক সমাধান দেবার সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে, নিজেকে তার স্থানে বসিয়ে চিন্তা করা। তার দুঃখ-কষ্ট, সমস্যাগুলোকে নিজের মতো করে অনুভব করা। কিন্তু আদী ভাইয়া বুঝিয়ে বললেন, একজন সমস্যাগ্রস্তকে সাহায্য করার সবচেয়ে বেঠিক পদ্ধতি হচ্ছে, তার স্থানে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। নিজের মতো চিন্তা করে কখনোই অন্যের সমস্যার সমাধান করা যায় না। কারণ তুমি চিন্তা করবে তোমার জ্ঞানানুনাযী। যা ক্লায়েন্টের সাধ্যের অনেক বাইরে হওয়াটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ, ক্লায়েন্টের কোন সমস্যার সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করা যাবে না কখনোই। কোন কিছুকেই ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে না। ক্লায়েন্টের প্রতিটা ইস্যুতে সমানুভূতি অবশ্যই রাখতে হবে, থাকতে হবে। কিন্তু সহানুভূতি কখনোই নয়। ক্লায়েন্টের চোখে নিজের চোখ বসাতে কোন আপত্তি নেই বরং এটা অতীব জরুরী। ক্লায়েন্টের চোখেই তার সমস্যাগুলোকে দেখতে হবে। কিন্তু ক্লায়েন্টের মনে নিজের মন বসানো যাবে না কিছুতেই। এককথায়, সমস্যাকে দেখতে হবে ক্লায়েন্টের চোখে। কিন্তু সমাধান খুঁজতে হবে নিজের মতো করে। এরপর থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করি নিজেকে কারো স্থানে নিয়ে না যেতে। কিন্তু এমন কেসগুলোর ক্ষেত্রে কেন জানি পারি না।

সুহাইব
সাহেব বললেন, পারিস না কারণ তোর জগত পরিবারময়। আর তোর বাবা তোর সবচেয়ে প্রশান্তিকর জায়গার নাম।
বাবাদের তো সেটাই হওয়া উচিত তাই না মামা? বাবা মানে তো যে রাহবার সুন্দর জীবনের। নির্ভরযোগ্য আশ্রয় যে অশান্ত মনের। বাবা এমন এক সংগঠন, উদ্ভাসিত হয় যেথায় স্বপন। বাবা শিক্ষক হয়ে শেখান জীবনকে করতে যাপন, বাবাই এঁকে দেন নকশা কোন পথে মিলবে স্বপ্নীল ভুবন। বাবা কেন হবেন অত্যাচারী, নির্দয়? কেন করবেন অকারণ আঘাত? কেন মনে জাগাবেন ভয়, সংশয়? তাও আবার শরীয়তের লিবাস ধারণকারী বাবা?

আদী
বলল, এইসব প্রশ্নের উত্তর তুমিও জানো নূহা। এটাও জানো লিবাস কখনোই ধার্মিকতার প্রমাণ বহন করে না। কারো পোশাক কিংবা কোনভাবে ইসলামী কোন কার্যক্রমের সাথে জড়িত দেখেই, তার কাছ থেকে মুমিনের গুনাবলী আশা করাটা সাধারণ মানুষের চিন্তার অদূরদর্শীতা। যাইহোক, আমার এই ক্লায়েন্টের নাম হাদিয়া। বয়স বিশ বছর। দুই বছর আগে হাদিয়া, ওর মা, ছোট দুই বোন আর এক ভাইকে নিয়ে ইউরোপে এসেছে বড় ভাইয়ের কাছে। ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন দেশে। হাদিয়ার শৈশব কেমন কেটেছে সেটা তো বুঝতেই পারছো। অনাদর, ভালোবাসাহীন এবং অতি শাসন অত্যাচারে বন্দী জীবন। বাবা-মা মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক কাকে বলে সেটা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞাত ধরতে গেলে। মানুষের সাথে মেলামেশা, চলাফেরাও খুব কম ছিল সবসময়ই। এখানে আসার পর একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে জব করতো। ওখানেই এক কলিগের সাথে ধীরে ধীরে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে। এবং একটা সময় ওরা ফিলিক্যালিও ইনভলব হয়ে যায়। হাদিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। শরীয়তের জ্ঞানও কিছুটা ছিল। সবকিছু মিলিয়ে ছেলেটাকে বাধ্য করেছিল বিয়ের জন্য। ছেলেটি হিন্দু ধর্মের হলেও মূলত সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নয়। কিন্তু তবুও হাদিয়ার প্রতি ভালোবাসার কারণে মুসলিম হয়েছিল। সমস্যা শুরু হয়েছে এর পর থেকে। ইসলামকে ভালোবেসে ছেলেটি মুসলিম হয়নি। তাই শরীয়তের কোন বিধান মানতে সে কিছুতেই রাজী নয়। কিন্তু হাদিয়া নিজে যেহেতু চেষ্টা করে শরীয়তের বিধান মেনে চলতে, তাই স্বামীকেও মেনে চলার ব্যাপারে বোঝানোর চেষ্টা করতো। এভাবেই ধীরে ধীরে মনোমালিন্য বাড়তে শুরু করেছিল দুজনের। কেস ফাইল পড়লেই তুমি বুঝতে পারবে কিভাবে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে ওদের। বিয়ের আগে পরে হাদিয়া মানসিক উত্থান-পতন কেমন ছিল। তবে হাদিয়ার মনোজগতে মূল ঝড়টা উঠেছিল ছয় মাস আগে। যখন থেকে স্থানীয় ইসলামিক প্রোগ্রামে যাওয়া শুরু করেছিল। এই বিষয়টাও ডিটেইল তুমি কেস ফাইলে পাবে। ইসলামিক প্রোগ্রামেই মুনার সাথে পরিচিত হয়েছিল হাদিয়া। সেই সূত্র ধরেই রিহ্যাভ সেন্টারে এসেছে গত তিনদিন আগে। মানসিক ভাবে খুবই বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে মেয়েটি। তার বিয়েটা কি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ? স্বামী যেহেতু মন থেকে মুসলিম হয়নি তার সাথে সংসার করার পারমিশন কি শরীয়ত দেয়? নাকি ডিভোর্সই একমাত্র উপায়? হাদিয়া বেশ দৃঢ় ভাবেই বলে, শরীয়তে যদি অনুমতি না থাকে তাহলে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। কিন্তু একই সাথে ওর মনে প্রচন্ড ভালোবাসাও আছে ছেলেটির প্রতি। হাদিয়ার কথা থেকে এটাও স্পষ্ট ওর স্বামী অন্য আর সব দিকে যেমনই হোক না কেন, হাদিয়ার প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারে সে অনেস্ট। অবশ্য সিরিয়াস না হলে ধর্ম চেঞ্জ করে বিয়ে করতো না কখনোই। যদিও ছেলেটির কাছে হয়তো শুধুই এতা ফর্মালিটি ছিল। কিন্তু তবুও এটা হাদিয়ার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ দেয়। হাদিয়া একবার ভাবে সম্পর্ক ভেঙে দেবে, আবার মনেহয় এমনো তো হতে পারে একদিন হয়তো ওর স্বামী সত্যিকার মুসলিম হয়ে যাবে। নিজের ভুলের ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু সংশোধনের সঠিক পন্থা খুঁজে পাচ্ছে না। করণীয়র ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সবকিছু মিলিয়ে হাদিয়ার বর্তমান কন্ডিশন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।

হুম
!

নূহা
আমি আর মামা চাচ্ছিলাম হাদিয়ার কেসটা তুমি দেখো। হাদিয়ার সাথে সরাসরি কথা বললে হয়তো আরো ভালো ভাবে বুঝতে পারবে সবকিছু।

কিছুক্ষণ
চুপ থেকে নূহা বলল, ঠিকআছে আমি কথা বলবো ইনশাআল্লাহ হাদিয়ার সাথে। তবে এখন না বিকেলে। ফাইলটা থাক আমার কাছেই। কথা বলার আগে একবার পড়ে দেখবো।

আদী
হেসে বলল, ঠিকআছে তাহলে চলো কনফারেন্স রুমে যাই। তুমি যাতে আবার এখানের অন্য কোন কেসের সাথে ইনভলব হয়ে না যাও সেজন্য আগেই বলে রাখলাম হাদিয়ার ব্যাপারে।

সুহাইব
সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, চল। সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

নূহা
আর আদীও তখন উঠে দাঁড়ালো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন