সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২৮




আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, সারাক্ষণ শুধু স্বপ্ন দেখি

মুনিরার কথা শুনে হেসে ফেলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো নূহা। নিজের ব্যাপারে কথা বলতে এসে প্রথম কিছুক্ষণ গুম ধরে বসে ছিল মুনিরা। ওর চেহারা দেখে মনেহচ্ছিলো বিশাল সমুদ্রে নুড়ি সমান সমস্যাটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অবশেষে খুঁজে পেয়ে ঘোষণা দিলো সমস্যা হচ্ছে, সারাক্ষণ শুধু স্বপ্ন দেখা।

নূহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুনিরা আবারো বলল, অকারণ স্বপ্ন দেখি আপি। জীবনেও যা সম্ভব না তেমন স্বপ্ন দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতে পারি। বছরের পর বছর ধরে দেখছি এমন স্বপ্নও দেখি।

দুএকটা স্বপ্নের উদাহরণ দেবে? তাহলে আমার বুঝতে সুবিধা হতো।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুনিরা বলল, আমি মুনাপুকে খুব বেশি ভালোবাসি আপি। আব্বু-আম্মু, মাওরার চেয়েও অনেক বেশি। মুনাপু আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। বুঝতে শেখার পর থেকেই মুনাপুকে আমি একটা ব্যাপারেই কষ্ট পেতে দেখছি। কি করেনি মুনাপু সেই কষ্টটা থেকে মুক্তি পাবার জন্য? নিজেকে সম্পূর্ন রূপে বদলে ফেলেছে। আমি ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, একদিন পছন্দের মানুষটির সাথেই মুনাপুর বিয়ে হয়েছে। দুজন ভীষণ সুখে আছে। আরো অনেককিছু দেখতাম। কিন্তু আজ আমার সেই স্বপ্নটা ভেঙে গেলো। আপি আমার শুধু মনেহচ্ছে আপনি একটু চেষ্টা করে দেখলেই হয়তো মুনাপুকে ঘিরে আমার স্বপ্নটাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারতেন।

নূহা হাসি মুখে বলল, না পারতাম না। সমস্যাটা কোথায় জানো? প্রিয়দের ঘিরে ভালোবাসার কাছে আমরা খুব দুর্বল থাকি। তাই আমার চিন্তাভাবনা তখন একপেশে চিন্তা করে। তাই তুমি বুঝতে পারছো না যে, মুনা জাওয়াদের জন্য কষ্ট পেয়েছে সেই দায় সম্পূর্ণ রূপে মুনার একার। নিজেকে বদলে ফেলার পেছনেও মুনার নিজের ইচ্ছে কাজ করেছে। তাই সেটাকে তুমি জাওয়াদের জন্য বদলে ফেলা বললেও আমি বলবো না। কারণ এমনটা শুধু তখনই বলা সম্ভব হতো, যদি জাওয়াদ মুনার সামনে নিজেকে বদলে ফেলার কন্ডিশন রাখতো। কিন্তু কন্ডিশন রাখা তো অনেক দূরের ব্যাপার, একবিন্দু আশা জাগানোর মতো কোন আচরণ কিংবা একটি শব্দও জাওয়াদ কখনো মুনার উদ্দেশ্যে করেননি, বলেননি। না আমি কখনো মুনাকে কোনভাবে আশা দিয়েছি। সুতরাং, এক্ষেত্রে আমার করণীয় যতটুকু ছিল আমি সেটাই করার চেষ্টা করেছি।

মুনাপু যদি আপনাদের পরিবারের কেউ হতো তাহলেও কি এভাবে বলতেন আপি?

নূহা হেসে বলল, আমাদের পরিবারের কারো এমন হবার সুযোগ নেই। আমাদের পরিবারে জাওয়াদের অবস্থান আকাশের চাঁদের মতো। যার স্বিগ্ধ আলোতে দেখে মুগ্ধ হওয়া যায়, বড়জোর স্নাত হওয়া যায় যার শিশিরে। কিন্তু কখনোই তাকে স্পর্শ করা কিংবা হাশিল করার ইচ্ছে জাগ্রত হয়না কারো মনেই। তাই তোমার প্রশ্নের আলোকে চিন্তা করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

একটুক্ষণ চুপ থেকে মুনিরা বলল, এভাবে প্রশ্ন করার জন্য সরি আপি। তবে আমি আপনাকে বিরক্ত কিংবা কষ্ট দেবার জন্য এসব প্রশ্ন করিনি

নূহা হেসে বলল, আমি বুঝতে পারছি বোনের প্রতি তোমার অপরিসীম ভালোবাসাই এসব প্রশ্নের কারণ।

শুধু এটাই কারণ নয় আপু। আমি আর নায়লা একই ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করি। নায়লার কাছে অনেক গল্প শুনেছি আপনার। নায়লা একবার না অনেকবার বলেছে ভাইজান যদি কোন কাজ করতে না চান একমাত্র নূহা আপ্পাই পারে সেটা ভাইজানকে দিয়ে করাতে। যখন নায়লা সৈকতের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল। তখনো একদিন বলেছিল, আপ্পা যেহেতু বলেছে সৈকতের ব্যাপারে ভাইজানকে রাজী করাবে ঠিকই করিয়ে ফেলবে। পরে অবশ্য নায়লা নিজ থেকেই সরে গিয়েছিল। আবার মুনাপুও সারাক্ষণ আপনার কথা বলে। অনেক ভালোবাসে আপনাকে। তাই আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো ভাইজানকে রাজী করানোর চেষ্টা করবেন। তা না হলে সালমান ভাইয়াকে আমার ভীষণ পছন্দ। উনি খুবই ভালো। ছোটবেলায় অনেক স্নেহ করতেন আমাকে আর মাওরাকে।

নূহা হেসে বলল, নায়লার মতো আমাদের পরিবারের সবারই এই তথ্যটা জানা আছে। কেউ যে কাজ জাওয়াদকে দিয়ে করাতে পারেন না। আমি অবলীলায় সেটা করিয়ে ফেলতে পারি। ছোটবেলায় আমাকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য উনি নিজের অপছন্দনীয় কাজ করতেও দ্বিধা করতেন না। আমি তো এটাকে দুর্বলতা হিসেবে ব্যবহার করতামই, সাথে সাথে পরিবারের অন্যরাও করতো। বিশেষ করে আমাদের মামণি, খালামণি, ফুপিরা নানান কথা আমাকে দিয়ে উনাকে বলাতেন, আমাকে দিয়ে উনার কাছ থেকে আদায় করে নিতেন। এক্সিডেন্টের পর জাওয়াদ ফিরে আসার বছর দুয়েকের মধ্যেই আমরা সবাই নিজ নিজ জীবনের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। আমি আমার সংসারে ভালো ছিলাম। জাওয়াদও বাচ্চাদের নিয়ে খুব আনন্দেই সময় কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবাদের-মায়েদের কারো মনেই শান্তি ছিল না জাওয়াদের একাকীত্বের কথা চিন্তা করে। সবাই তখন আমাকে এসে ধরেছিলেন বিয়ের ব্যাপারে উনাকে রাজী করানোর জন্য। আমি শুধু একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম, বিয়ে করা উচিত এই ধরনের কিছু কথা লিখে। ম্যাসেজের কোন জবাব দেয়নি। কিন্তু পরদিন তিন বাচ্চা নিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন। পুরো তিনমাস কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে পরিবারের সবাই। কিন্তু কোন সন্ধানই পাননি। তিনমাস পর নিজ থেকে ফিরে এসেছিলেন বাচ্চাদের নিয়ে আবার। ফিরে এসে ম্যাসেজের জবাবে লিখেছিলেন, বিয়ের ব্যাপারে আমাকে ম্যাসেজ করার যে দুঃসাহস তুমি দেখেয়েছো তার শাস্তি, তিনমাস সন্তানদের সাথে তোমার এই বিচ্ছেদ। যদি কোনদিন বিয়ে শব্দটাকে মুখে উচ্চারণ করো তাহলে কি হতে পারে নিজেই ভেবে নাও। এমনো হতে পারে সারাজীবনেও সন্তানদেরকে দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ আসবে না তোমার জীবনে। এমন ভয় পেয়েছিলাম আমরা সবাই। এরপর একটানা আট-নয় বছর শুধু আমি কেন পরিবারের কেউ বিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করেনি জাওয়াদের সামনে।

মুনিরা চোখ বড় বড় করে বলল, করলে কি সত্যিই সত্যিই ভাইজান চলে যেতেন জিহাদ, জিশান আর নাবিহাকে নিয়ে?

নূহা হেসে বলল, হয়তো যেতেন না। কান্ডটা উনি আমাদেরকে ভয় দেখানোর জন্যই করেছিলেন। কিন্তু ঘটনার পর আমাদের বাবা-মায়েরা বুঝে নিয়েছিলেন বিয়ের ব্যাপারে উনার অনিচ্ছার মাত্রা। জাওয়াদ বাচ্চাদের নিয়েই উনার জীবন সাজিয়ে নিয়েছিলেন আসলে। জানো বাচ্চাদের ছয় বছর বয়স হবার আগ পর্যন্ত উনি হসপিটালে জয়েন করেননি। যে কিন্ডার গার্ডেনে জিহাদ, জিশান, নাবিহা যেতো উনি সেখানে টিচার হিসেবে জব করেছেন। এবং কিন্ডার গার্ডেনের তিন বছর উনিই টিচার ছিলেন ওদের। সর্বক্ষণ বাচ্চাদের সাথে থাকতেন। সাহায্য করার অনেকেই ছিল কিন্তু বাচ্চাদের প্রতিটা কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন। ওদেরকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, খাবার রান্না করা, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো, এমনকি বাচ্চাদের ড্রেস পর্যন্ত উনি নিজ হাতে ধুতেন, ওয়াশিং মেশিনে দিতেন না। আমি কোনদিনও এমনটা করতে পারতাম না। আমি তো এক জারিফকে নিয়েই অস্থির হয়ে যেতাম। অবশ্য জারিফকেও নিয়ে যেতেন প্রায়ই উনার কাছে। কারণ চাননি ওদের চার ভাইবোনের মধ্যে কোন দুরুত্ব তৈরি হোক। এমনকি জারিফ যখন কিন্ডার গার্ডেনে যাওয়া শুরু করেছিল তিন বছর বয়সে। এক বছর উনি আবারো স্কুলে জব করেছেন। শুধুমাত্র জারিফ যাতে এমন ভাবতে না পারে যে, পাপা আমাকে কম ভালোবাসে আপ্পি, ভাইয়াদের থেকে। জিহাদ, জিশান আর নাবিহার মতো জারিফও যাতে বলতে পারে ছোটবেলায় পাপা আমার প্রফ ছিল।

মুনিরা হেসে বলল, ভাইজান বাচ্চাদেরকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। যে ভালোবাসার মাত্রা আমাদের পক্ষে হয়তো কখনোই উপলব্ধি করাও সম্ভব নয়।

আলহামদুলিল্লাহ এতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। এবং উনি উনার বাচ্চাদের নিয়ে সর্বক্ষণই অনেক সুখানন্দেই সময় কাটাতেন। বাচ্চাদের মাঝেই উনি জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিয়েছিলেন। আমরা সবাই তাই উনার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছিলাম। তাছাড়া বিয়ের ব্যাপারে না কোন বাঁধা অতীতে উনার ছিল, না এখন আছে। উনি চাইলে যে কোন মূহুর্তে, যে কাউকে বিয়ে করতে পারেন। পরিবারের সবাই আনন্দিত মনে মেনে নেবে উনার সিদ্ধান্ত। বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ উনার একার ছিল, আছে। তবে বিয়ে না করার ব্যাপারে উনার অসংখ্য যুক্তি। পরিবারের যে ব্যক্তি যেই যুক্তিতে নরম হবে, তাকে উনি সেই যুক্তি প্রদান করে নিজের দলে টেনে নিয়ে তার মুখে সীলমোহর এঁটে দেন। তবে সব কথায় এক কথা হলো উনি বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। উনি নিজের অবস্থা অবস্থানে সন্তুষ্ট। ব্যক্তির যেখানে ইচ্ছে নেই, সেখানে আমরা ইন্টারফেয়ার করার কে তাই না? তুমি আমি হয়তো ভাবছি বিয়ে করলেই উনার জীবন পারফেক্ট হয়ে যাবে। কিন্তু উনি হয়তো তেমনটা ভাবছেন না। প্রত্যেকেরই রাইট আছে নিজস্ব টার্ম এন্ড কন্ডিশনের ভিত্তিতে তার জীবনকে যাপন করার, নিজের জন্য সুখের আলাদা সংজ্ঞা তৈরি করার। আমার রাহাতের সাথেই জীবন পথে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত উনি বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছিলেন। সম্মান করেছেন আমার সিদ্ধান্তকে। তেমনি আমারো উচিত উনার সিদ্ধান্তকে সম্মান করা। আমি সেটা করারই চেষ্টা করছি মূলত।

মুনিরা বলল, জ্বি আপি আমি বুঝতে পারছি। এই ব্যাপারে আমার আর কিছু জানার নেই। আমি কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজছিলাম। পেয়ে গিয়েছি আপনার কথার ভেতর। এখন তাহলে আমার মূল সমস্যাটা বলি।

নূহা হেসে বলল, হ্যা বলো।

আমি লেখাপড়ায় একদম আগ্রহ পাই না আপি। ক্লাসেও যাই না ঠিকমতো। ফজরের নামাজ আদায় করে ঘুম দেই। সেই ঘুম থেকে উঠি সাড়ে এগারটা, বারোটার দিকে। এরপর সময় যে কিভাবে কেটে যায় বুঝি না। প্রতিদিন ঠিক করি আজ থেকে পড়ব। কিন্তু পড়া হয় না। অলসতা করি, আমলেও ঢিলামি করি। কিন্তু আমার পড়ার ইচ্ছা প্রচুর। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করতে চাই। দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে চাই, এই জন্য আরবী শিখতে চাই, পাশাপাশি কুরানিক সাইন্স আর কম্পারেটিভ রিলিজিওন দক্ষ হতে চাই। আমি শুরু করি খুব আগ্রহ নিয়ে কিন্তু পরিবার থেকে সবাই বলে আগের কাজ আগে, আগে অ্যাকাডেমিক পড়া শেষ করো। কিন্তু অ্যাকাডেমিক পড়ার চাপে আবার হারিয়ে যায় দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করার ইচ্ছে। এছাড়া আমার মনে হয় আমি অলস, খুব বেশি অলস। এটাই সবচেয়ে বড় বাঁধা। এছাড়াও আমি একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং আবার পিছিয়ে যাই। আর সবচেয়ে বড় যেই জিনিস সেটা হচ্ছে আমার মনে হয় আমি সিনসিয়ার না। সিনসিয়ার হলে অবশ্যই কোন বাঁধাই পথ আগলে দাঁড়াতে পারত না। রিহ্যাব সেন্টারে নিজেকে গড়ার যে কোর্সটা আছে। সেখানেও নিয়মিত যেতে পারিনা। যেতে পারি না মানে হচ্ছে যাইনা। পড়া দেয় তো অনেক। কমপ্লিট করতে না পারলে যেতে ভয় লজ্জা দুটাই লাগে। কিন্তু ওখানে কয়েকদিন ক্লাস করার পর থেকে আমিও সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই এবং অন্যের অন্ধকার পথেও দিয়া জ্বালাতে চাই। আমিও চাই অভাব মুক্ত, অশিক্ষা মুক্ত, কুটিলতা-জটিলতা, দীনতা-হীনতা মুক্ত পৃথিবী গড়ার একজন কারিগর হতে চাই। হুবহু মানুষের মতো দেখতে প্রাণীগুলো যখন অমানুষের মতো কাজ করতে দেখি খুব বেশি অবাক হই। আমার ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে মানুষের অমানুষিক কর্মকান্ড। সেসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে সময় চলে যায়। অন্যদিকে আমার কাজের বোঝা বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। কি করবো আপি?

নূহা বলল, এইসব সমস্যা নিয়ে তুমি এখনো এখানে বসে আছো কেন?

তাহলে কি করবো আপি?

নূহা হেসে বলল, রিহ্যাভ সেন্টারে দৌড় দাও। এই সমস্ত সমস্যা নিয়েই তোমাদের ভাইজান আলোচনা করবেন আজ। এতক্ষণে তো আলোচনা শুরুও হয়ে গিয়েছে মনেহয়। জুনি, নায়লা ওরা সবাই তো ওখানে গিয়েছে।

নূহার কথা শোনা মাত্রই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুনিরা। প্রায় চিৎকার করে বলল, কত বড় বিশ্বাসঘাতক একেকটা চিন্তা করেন আপি। আমাকে একবার বলেওনি। আচ্ছা আপি আপনার সাথে পরে কথা হবে। বলে মুনিরা ছুটে বেরিয়ে গেলো। নূহাও হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালো। এরপর আরো কিছুক্ষণ মুনা আর ওর আম্মুর সাথে সময় কাটিয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। কিছু দূর আসার পর পেছন থেকে ডাক শুনতে পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো নূহা। মুনার ছোটবোন মাওরাকে দেখে বেশ অবাক হলো।

কাছে এগিয়ে এসে মাওরা বলল, সরি আপি। আমি একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম আপনার সাথে। তাই পেছন পেছন এসেছি। আমি চাইনা বাসার কেউ জানুক।

নূহা হেসে বলল, কোন সমস্যা নেই। বলো।

আপি আব্বু আমাদের তিন বোনের বিয়ে নিয়েই খুব তোড় জোড় শুরু করেছেন। বিয়ে ব্যাপারটাকে ঘিরে আমার কনসেপ্ট ঠিক ক্লিয়ার না। আব্বু-আম্মু বেশ সুখী ক্যাপল। ভালো থাকেন এমনিতে আবার মাঝে মাঝে মনোমালিন্য, টুকটাক ঝগড়াও হয়। দুজন মিলে সেটা মিটমাটও করে ফেলেন। তাই আব্বু-আম্মুকে দেখে বিয়ের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তেমন হয়নি এটা যেমন সত্যিই। তেমনি খুব আকর্ষণীয় কিংবা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক কিছুও মনে হয়নি বিয়েকে। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনেহয় প্রি ম্যারেজ কাউন্সিলিং দরকার খুব। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন এই ব্যাপারে?

ঠিক কেন কাউন্সিলিং দরকার বলে মনে করছো?

কিছু কিছু ব্যাপারে বেশ ভীতি কাজ করে। যেমন, মনের মতো লাইফ পার্টনার পাবো কিনা? এই ভীতিটাই সবচেয়ে বেশি কাজ করে।

নূহা হেসে বলল, একটা খুব সহজ হিসাব হচ্ছে, নেগেটিভ মাইন্ড কখনোই পজেটিভ লাইফ দিতে পারে না। এই তত্ত্ব বিয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নেতিবাচক অভিজ্ঞতা কিংবা ধারণা থেকে চিন্তা করলে বিয়ের ব্যাপারে পজেটিভ লুক আসবে না। স্বপ্নের সঙ্গী কিংবা মনের মতো জীবনসাথী কনসেপ্টটা যথেষ্ট যাতনা দায়ক এবং সমস্যাগ্রস্ত। এই চিন্তাটা সিদ্ধান্ত নেয়াকে কঠিন করে দেয়। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য সাথী সৃষ্টি করেছেন, যেনো তোমরা তাদের সাথে পরস্পর শান্তিতে বসবাস করতে পারো। এবং তিনি তোমাদের [ হৃদয়ের] মাঝে ভালোবাসার [বন্ধন ] দিয়েছেন এই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে, “নারী পুরুষের মাঝে আল্লাহ স্বভাবজাত আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন যেন পৃথিবীতে তারা সুখ শান্তিতে বসবাস করতে পারে। সংসার জীবনে নারী পুরুষের সম্পর্ক সমতার ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। " যেনো তোমরা তাদের সাথে পরস্পর শান্তিতে বসবাস করতে পার" এখানে লক্ষণীয় "পরস্পর " শব্দটি স্বামী স্ত্রীর প্রভু নয়। স্বামী স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, সহযোগী সহকর্মী। কেউ কারও প্রভুও নয় বা অধিকারভুক্ত নয়। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, পুরুষ নারীর দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্য মনের শান্তি। এটা তখনই সম্ভব, যখন উভয় পক্ষ একে অপরের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয় এবং তা আদায় করে নেয়। নতুবা প্রভু -ভৃত্যের সম্পর্কের মাঝে প্রেম-প্রীতিপূর্ণ বন্ধুত্ব স্থান পেতে পারে না। সুতারাং সে সব সংসারে পরিপূর্ণ শান্তি বা শৃঙ্খলাও সম্ভব নয়। যে সংসারে স্বামী স্ত্রীর মাঝে প্রেম প্রীতির সম্পর্ক বিরাজ করে সেই সংসারই প্রকৃত শান্তির নীড় এখন কথা হচ্ছে, কারো একার পক্ষে সংসারকে শান্তির নীড় হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে পার্টনার সাপোর্টিভ হবে কিনা এই চিন্তা ভীতির উদ্রেক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তো ভবিষ্যৎ জানি না। তাই আল্লাহ যা হালাল করেছেন এমন কিছু আমরা নিজের জন্য নিষিদ্ধ করতে পারিনা শুধুমাত্র ধারণার বশবর্তী হয়ে।

কিন্তু আপি কুরআনে তো একথাও বলা হয়েছে, "দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য, আর দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্য, আর সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য, আর সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্যে,” কিন্তু এর ব্যতিক্রম আমরা অহরহ দেখছি আমাদের চারপাশে।

বিয়ের ক্ষেত্রে যাচাই বাছাইয়ের কথাও তো বলা হয়েছে। তারপরও যদি কোন সচ্চরিত্র নারীর জীবন কোন দুশ্চরিত্র পুরুষের সাথে জুড়ে যায়, সেক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি বিয়েটাই তার জীবনের পরীক্ষা।

আমার আরো কিছু প্রশ্ন আছে। বিয়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এই অংশটিকে প্রশান্তিময় করার উদ্দেশ্যেই সঠিক জ্ঞান নিয়ে সামনে এগোতে চাই। আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমি বিয়ে করতে চাই কিন্তু ভয় হয় আমি কি আদৌ উত্তম জীবনসঙ্গী হতে পারবো?

নূহা হাসি মুখে বলল, একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবে আজকাল আমাদের ভালো হওয়াটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেমন যেন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমরা যারা উত্তম তাদের সাথেই উত্তম। অথচ হাদীস বলে, তোমার সাথে যে ভালো তার সাথে ভালো হবার মাঝে বিশেষ কোন ক্রেডিট নেই। বরং যে খারাপ তার সাথে উত্তম হওয়াটাই পরীক্ষা। অর্থাৎ, তুমি অধম হলে আমি উত্তম হবো না কেন? ভালো লাইফ পার্টনার এই চিন্তার উপর নির্ভর করে অনেকটা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করা। নিজের যেটা পছন্দ করা হয়, অন্যের জন্যও সেটাই পছন্দ করা। তাহলে ইগো চলার পথে বাঁধা হতে পারে না। এবং ইচ্ছে, চেষ্টা অধ্যবসায়ের সমন্বয়ে পুনঃপুনঃ নিজেকেই যাচাই করা, গড়ে তোলা। কারণ আখেরে যার যার হিসাব তার তার। বলার সুযোগ নেই, সে খারাপ ছিল তাই আমিও খারাপ আচরণ করেছি। কারণ তোমাকে স্বাধীন ইচ্ছেশক্তি, ভালো-মন্দের জ্ঞান এবং বিবেকবোধ দেয়া হয়েছে। এইসব কিছুর সমন্বয়ে একজন উত্তম সাথী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলাটা মনেহয় না খুব বেশি কঠিন কিছু। আরো প্রশ্ন আছে?

আরো অনেক প্রশ্ন আছে আপি। আচ্ছা আপি বিয়ের আগে কোন কোন বিষয় শরীয়ত ভিত্তিক জানা বেশি জরুরী।?

একজন মুসলিম হিসেবে জীবন যাপনের জন্য শরীয়তের প্রতিটা বিষয়েই বেসিক জ্ঞান থাকতে হবে, রাখতে হবে। কারণ কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না কখন জীবন কোন দিকে মোড় নিবে, পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে। আমাদের প্রতি কুরআনের সর্বপ্রথম নির্দেষ এসেছেপড়ো তাই জানতে হবে প্রতিটা মৌলিক বিষয়েই। আর বিয়ের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের আলোকে দাম্পত্য পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে সন্তান লালন-পালন সম্পর্কেও। আমাদের সামনে রাসূল (সঃ) দাম্পত্য জীবন আছে রাহবার হিসেবে। সাহাবায়ে কিরামগণের দাম্পত্য জীবনেও ছড়িয়ে আছে অসংখ্য শিক্ষা। যেসব সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে পরিস্থিতির মোকাবিলায় নিজের করণীয় বুঝে নেয়াটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

জ্বি আপি বুঝতে পেরেছি।

নূহা হেসে বলল, তোমার আরো প্রশ্ন আছে বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন একজনের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আমার। তুমি এক কাজ করো রিহ্যাভ সেন্টারে চলে যাও। ওখানে আলোচনা চলছে। অনেকেই আছে। সবার সাথে বসে আলোচনা শোনো। এই বিষয়েও হয়তো আলোচনা উঠতে পারে। যদি তোমার প্রশ্নের জবাব না পাও। তাহলে আগামীকাল ইনশাআল্লাহ আমরা কথা বলবো।

মাওরা হাসি মুখে বলল, ঠিকআছে আপি। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।

মাওরাকে বিদায় দিয়ে নূহা নিজ গন্তব্যের দিকে কদম বাড়ালো


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন