সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৮



ফজরের নামাজের পর কুরআন তিলাওয়াত সেরে আবারো ঘুমানোর অভ্যাস রাহার। অবশ্য অভ্যাস না বলে বদভ্যাস বলাই ঠিক হবে। কারণ এই ঘুমের জন্য অনেক কথা শুনতে হয় তাকে পরিবারের বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। যদিও সেসব কথাতে রাহার কিছু এসে যায় না। তার নীতি হচ্ছে, যেই কাজ সে করবে না সেই ব্যাপারে কারো কথার প্রভাব নিজের উপর পড়তে না দেয়া। মানুষের কথা শুনতে শুনতে নিজস্ব সত্ত্বা বলেই আর কিছু থাকে না মেয়েদের। নিজের জীবনকে নিজের মত করে উপভোগ করার কিছু অংশও থাকা উচিত প্রতিটা মানুষের জীবনে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের সারাটা জীবন চলে যায় অন্যকে খুশি করতে। অথচ অন্যেকে খুশি করার জন্য নিজের মনে যে সুখ থাকা যে শর্ত সেই কথা কেউ বোঝে না। যাইহোক, কেউ বুঝুক বা না বুঝুক রাহা বোঝে এবং মেনেও চলে। 

কুরআন তিলাওয়াত শেষ করে উঠার পর পানি পিপাসা লেগেছিল খুব। গতরাতে রুমে পানির বটল আনতে খেয়াল ছিল না। বাধ্য হয়েই তাই পানির সন্ধানে রান্নাঘরের দিকে রওনা করলো। রান্নাঘরে ঢুকতেই চোখে পড়লো নূহা জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে আছে। নূহার স্বভাব জানা আছে ভালো মতোই। পাশে দাঁড়িয়ে বেশ জোড়ে করে কিছু না বললে কিংবা স্পর্শ না করলে ধ্যান ভাঙবে না। এমন আত্মমগ্ন হয়েই দাঁড়িয়ে থাকবে। একবার ইচ্ছে হলো তার উপস্থিতি নূহাকে বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ চলে যেতে। গতরাত থেকে সযতনে এড়িয়ে চলছিল নূহাকে। কিন্তু তারপরও কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলো না রাহা। অদ্ভুত রকম একটা হাহাকার খেলা করছিল মনের ভেতর। বার বার শুধু একটা প্রশ্নই উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলো মনের কোনে। নূহার কি মনে আছে আজকের তারিখটির কথা? পর মূহুর্তেই আবার নিজেকেই বলছিল, নূহার পক্ষে কি কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব আজকের তারিখটিকে? ষোল বছর আগে আজকের এই তারিখেই হসপিটাল থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছিল নূহা। এক্সিডেন্টের কারণে প্রায় এক মাস হসপিটালে থাকতে হয়েছিল। নূহাকে বাড়িতে স্বাগতম জানানোর আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিল ভাইবোনেরা সবাই মিলে। কিন্তু বাড়িতে ফেরার আগের দিন রাতে নূহা আবদার ধরে বসেছিল পুরোপুরি সুস্থ হবার পর আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাইকে নিয়ে জাওয়াদ আর তার বিয়ের রিসিপশন হবে সেটা ঠিকআছে। কিন্তু আগামীকাল পরিবারের সবাইকে সাথে নিয়ে যেন ছোট্ট করে আবারো তাদের বিয়ের আয়োজন করা হয়। কারণ হসপিটালের বেডে শুয়ে পরিবারের সব প্রিয়জনকে বাদ দিয়ে হওয়া ঐ বিয়ের কথা মনে হলেই নাকি মন খারাপ হয়ে যায়। জাওয়াদ ভাইয়া বাধ্য হাজবেন্ডের মতো শোনা মাত্রই সবাইকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিয়ের আয়োজনে। সারারাত সেদিন পরিবারের কেউ ঘুমোয়নি। সবাই মিলে রাশি রাশি ভালোবাসার সংমিশ্রণে সেদিন তাদের আনন্দবাড়িকে বিয়ের সাজিয়েছিল নূহার জন্য। কথা ছিল বিকেলে বাড়িতে আসবে নূহা। তাই কিছু আয়োজন বাকি রেখেই ফজরের পর সবাই একটু রেষ্ট নিতে গিয়েছিল। কিন্তু অস্থির স্বভাবের দুষ্টু নূহা সবাইকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য সবার সারপ্রাইজ ভেস্তে দিতে বড়মামার সাথে হাজির হয়ে গিয়েছিল ভোর বেলাতেই। বাকি আয়োজন তাই নূহাকে দোতলার করিডোরে বসিয়ে রেখেই করতে হয়েছিল। নূহা যাতে কোন পন্ডিতি করতে না পারে সেজন্য রাহা বডিগার্ড হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রাহার সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ নূহা খপ করে হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল। কাকে ফোন করছো? রাহার এই প্রশ্নের জবাবে নূহা হাসিমুখে স্পীকার অন করে দিয়েছিল। ওপাশ থেকে জাওয়াদ ভাইয়ার ঘুম জড়ানো কন্ঠে সালাম শুনে অবাক হয়ে নূহার দিকে তাকিয়েছিল। নূহার চোখে মুখে দুষ্টুমি ঝিকমিক করলেও কন্ঠস্বরে বেশ গাম্ভীর্য এসে সালামের জবাব দিয়ে বলল, কেমন আছো ভাইয়া?   

আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি অবস্থা?

আমার অবস্থা ভালো না ভাইয়া। তোমাকে নিয়ে বিরাট টেনশনে আছি।

আমাকে নিয়ে? কেন?

এই যে কেমন হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে। ভাইয়া তুমি কি জানো পুরুষ মানুষ দুই প্রকার? বিবাহিত আর জীবত। সারাটা জীবন তুমি আমাকে এত আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছো। তাই তোমার কল্যাণ কামনা করাটা আমার অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্বের মধ্যে পরে। আমি শুনেছি তোমার বৌ নাকি পুরাই আবোল তাবোল। তারউপর সাঙ্ঘাতিক বদমেজাজী স্বভাবের মেয়ে। 

তোমার ভাইয়াও তো সাঙ্ঘাতিক রাগী স্বভাবের ছেলে। বুনো ওল বাঘা তেঁতুল। ইনশাআল্লাহ মিলবে ভালোই। নাকি বলো?

আমি আসলে কিছুই বলতে চাচ্ছি না। আমি ভয়তে অস্থির হয়ে আছি। তোমার বৌয়ের বেতাল চরিত্রের যে বর্ণনা পেয়েছি। তাতে তোমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই আতঙ্কে আছি। না জানি শেষপর্যন্ত কি হয়!

জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমার জন্য তোমার এই অস্থিরতা দেখে খুবই ভাল লাগছে। অন্যের কল্যাণ কামনায় এই আন্তরিকতার উত্তম প্রতিদান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তোমাকে দিন এই দোয়া করছি। তবে কি জানো?

কি?

ফরাসী একটা প্রবাদ আছে-“ মাই লাইফ হ্যাজ বিন ফুল অব টেরিবল মিসফরচুনস, মোস্ট অব হুইচ নেভার হ্যাপেন্ড”। অর্থাৎ, সারাজীবন যত বিপদ আপন আমাকে বিপন্ন করেছে তার বেশির ভাগই কখনো ঘটেনি। নিজ জীবনে অন্তর এই প্রবাদটিকে বেশির ভাগ সময়ই সত্যি বলেই প্রমানিত পেয়েছি। নিজেকে নিয়ে, নিজের কাজকে ঘিরে, পরিবারের অন্যান্য সবাইকে নিয়ে যখনই দুশিন্তা করার মত কিছুর সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এত্তো এত্তো আগাম চিন্তায় দিনরাত মশগুল থেকেছি। নানান আশংকায় অকারণে ভীত হয়েছি, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত করেছি। কিন্তু পরবর্তীতে বেশির ভাগ সময়ই তার কিছুই সংঘটিত হয়নি। হলেও চিন্তার সাথে তার পার্থক্য ছিল যথেষ্ট। আসলে আমাদের জীবনে দুর্ঘটনা, সমস্যা, বিপদাপদ যে ঘটে না তা কিন্তু নয়। কিন্তু যেহেতু আমাদের বিশ্বাস আমাদেরকে এই কথা বলে যে, সেগুলোর পেছনে কোন না কোন কল্যাণ নিহিত আছেই। তাই দুশ্চিন্তায় জীবনের স্বাভাবিকত্ব বিসর্জন না দেখায় উচিত। তবে হ্যা সতর্ক অবশ্যই থাকতে হবে আমাদেরকে। কিন্তু সতর্কতা আর দুশ্চিন্তাকে মিলিয়ে ফেললে হবে না। বৃষ্টির দিনে যেমন সাথে ছাতা রাখাটা সতর্কতা। কিন্তু সাথে ছাতা না রেখে এই বুঝি বৃষ্টি নামলো, এই বুঝি বৃষ্টি নামলো ভেবে বার বার আকাশ পানে তাকানোটা হচ্ছে অকারণ দুশ্চিন্তা। যদি জানা থাকেই যে কোন মূহুর্তে বৃষ্টি নামতে পারে তাহলে সাথে ছাতা রাখলেই হয়। তাহলেই তো আর বৃষ্টির প্রতীক্ষায় আতংকিত হবার প্রয়োজন পরে না। ঝিরঝির, টিপটিপ, এলোমেলো নাকি দমকা হাওয়ার সংমিশ্রণে হাজির হবে বৃষ্টি? বৃষ্টির ধরণ বা প্রচন্ডতা কেমন হবে সেটা নাহয় নাই বা জানা থাকলো। কিন্তু সাথে যেহেতু ছাতা আছে কোন না কোন ভাবে ম্যানেজ হয়েই যাবে ইনশাআল্লাহ। বোঝাতে পেরেছি? 

নূহা হেসে বলল, হুম! আলহামদুলিল্লাহ তোমার কথা শুনলে মন ভালো হয়ে যায়। 

তাহলে তোমার যখনই মন খারাপ হবে আমাকে ফোন করবে। আমি তোমার মন ভালো করে দেবো ইনশাআল্লাহ।

কিন্তু এখন তো আর যখন তখন তোমাকে ফোন করা যাবে না। তোমার বৌ যদি বিরক্ত হয়? মেয়েরা খুবই সন্দেহপ্রবণ আর পজেসিভ হয় স্বামীর ব্যাপারে। তোমার জীবনে আমার অবাধ বিচরণ যদি তোমার বৌ মেনে নিতে না পারে। তাহলে?

জাওয়াদ হেসে বলল, মাথা ভর্তি দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করছে তাই না? ফোন রাখো দুষ্টু মেয়ে। আমাকে কিছুক্ষণ রেস্ট করতে দাও। মাথা ব্যথা করছে খুব। 

আগে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। তোমার জীবনে আমার অবাধ বিচরণ যদি তোমার বৌ মেনে নিতে না পারে। তাহলে? যদি অপশন দেয়া হয় ছোটবেলা থেকে যাকে তুমি অতি আদর- ভালোবাসায় বড় করেছো সেই মেয়েটি নাকি এইমাত্র তোমার জীবনে যে প্রবেশ করেছে সেই মেয়েটি? কাকে বেছে নেবে তুমি? 

আমি নূহাকে বেছে নেবো। যত রূপে আমার সামনে আসবে সেই প্রতিটা রূপেই আমি শুধু নূহাকেই বেছে আমার জন্য নেবো ইনশাআল্লাহ। পেয়েছো না জবাব এখন ফোন রাখো। 

নূহা হেসে বলল, যখনই আমাদের পরিবারে কোন বোনের বিয়ে হয়েছে। তুমি অনেক দোয়া এবং সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দিয়েছো তাদেরকে। আমি নিজেকে এটা থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। অনেক অনেক দোয়ার সাথে আমাকে এমন কিছুও বলে দাও, যা কিনা জীবন যদি কখনো ঘোর আঁধারে ঢেকে যায়। তোমার শব্দরা আলোকিত জীবনের পথে চলার রাহবার হতে পারে আমার জন্য।

একটুক্ষণ চুপ থেকে জাওয়াদ বলল, জীবন যখন যে রূপের তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে তাকে সর্বদাই আলহাদুলিল্লাহ সম্বোধনে স্বাগত জানাবে। তুমি আর আমি হয়তো কল্পনাও করতে পারবো না সর্বাবস্থায় আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারাটা যে আল্লাহর কত বড় একটা নিয়ামত কোন মানুষের প্রতি। আলহামদুলিল্লাহ। এই যোগ্যতা, এই তাওফীক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সবাইকে দেন না। যাদেরকে দেন তারাই শুধুমাত্র উপলব্ধি করতে পারে কি প্রশান্তি, কি পরিতৃপ্তি সর্বাবস্থায় আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারার মাঝে। আসলে আমরা মানুষেরা এতই দুর্বল একটা প্রাণী যে আল্লাহর দয়া, করুণা ও রহমত ছাড়া কৃতজ্ঞ বান্দাহ হবার ক্ষমতাও আমাদের নেই। তাই যখনই আল্লাহর দরবারে নিজের জন্য কিছু চাইবে আকুল হয়ে বলবে, হে আল্লাহ! আমাকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাহ হবার তাওফীক দিন। আমাকে সর্বাবস্থায় আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারার তাওফীক দিন। আমীন।

নূহা আর রাহাও তখন জাওয়াদ ভাইয়ার সাথে আমীন বলেছিল। নূহার মুখে সারাদিনে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা উচ্চারিত হয় সেটি আলহামদুলিল্লাহ। সেদিনের পর থেকে রাহাও চেষ্টা করে সর্বাবস্থাতে আলহামদুলিল্লাহ বলতে। নূহাকে পালিয়ে চলে যাবার ইচ্ছে পরিত্যাগ করে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এই কাক ডাকা ভোরে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কথা বলছো না কেন? কি দেখছো এমন করে?  

বিন্দুমাত্র না নড়ে নূহা বলল, আধারাচ্ছন্ন লাজুকতার ঘোমটা সরাইয়া ধীরে ধীরে রবি তাহার আলোকিত মুখখানা পৃথিবীকে দর্শন করিবার আয়োজন করিতেছে। আমি মুগ্ধ নেত্রে তাহাই অবলোকন করিতেছি ভগ্নী।  

রাহা অবাক কণ্ঠে বলল, রবি? রবিটা আবার কে? আমি তো রবি নামে কাউকে চিনি না।  তারমানে তো আমাদের মাহরাম না। আর তুমি মুগ্ধ নেত্রে নন মাহরাম রবিকে অবলোকন করিতেছো? আস্তাগফিরুল্লাহ। বাবা শুনলে তো স্ট্রোক করবে। 

এবার ঘুরে বোনের দিকে তাকালো নূহা। হেসে বলল, ভেরি ফানি। শোন এই কুসুম কুসুম আলোস্ফুত প্রভাতে তোমার এইসব অতি দুষ্টু ধরণের শব্দগুচ্ছকে গলধঃকরন করিতে চাই না আমি। সুতরাং, চা লাগলে বলো করে দিচ্ছি। নিয়ে তুমি প্রস্থান করো। 

রাহা এগিয়ে গিয়ে বোনকে ধরে হেসে বলল, আসতে না আসতে বাড়ির সবার জন্য তোমার চা গরম সেশন শুরু। আমি আগে ভাবতাম জীবনের প্রতিটা ভোর বাড়ির সদস্যদের রুমে রুমে গিয়ে চা পৌঁছে দেবার মধ্যে কি শান্তি পাও তুমি। আচ্ছা কখনোই বিরক্ত লাগতো না তোমার? 

তুমিও তো তোমার জীবনের প্রতিটা ভোর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছো। তোমার কি কখনো বিরক্ত লাগে? জানি লাগে না। কারণ এটাতেই তোমার আনন্দ । ঠিক তেমনি সবাইকে নিজ হাতে সকালের চা দেয়াতে আমার আনন্দ লুকায়িত ছিল।

 ওহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে নিজেকে ‘আনন্দ বিতরণ তহবিল’ হিসেবে গড়ে তোলাটা তোমার এম ইন লাইফ ছিল।  

নূহা হেসে বলল, বারো বছর পেরিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে ভোরে যখন শুধু নিজের জন্য চা বানাতে যাই মনেহয় আরে আমি এত ছোট কেতলিতে চা বসিয়েছি কেন? তবে যাই বলো নিজেকে ‘আনন্দ বিতরণ তহবিল’ ভাবতে সত্যিই কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হয়। ভেবে দেখো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের সমাহার তো আমাদের সবার কাছেই আছে। সবাই যদি একে অপরের মনে জ্বালিয়ে যেতে পারতো আনন্দের মৃদুমন্দ আলোচ্ছাস। কতই না ভালো হতো তাহলে। রাতের আকাশের বুকে টিমটিমে তারকার ফুলরাশির মতো প্রতিটি মনের অন্ধকার কোণ উদ্ভাসিত হতো স্বপ্নাশেষের বাতায়নে।  

তোমার কথাকে মাঝে মাঝে আমার স্লিপিং পিল মনেহয়। যত শুনি ততই ঘুম পায়। বয়স হয়েছে তো আজকাল ঘুমে কিঞ্চিৎ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই তোমার কথাকে বোতলে ভরে কাছে রাখবো কিনা ভাবছি! যাইহোক তোমার তহবিল থেকে কিছু আনন্দ মিহরায আর জাবীনের জন্য বরাদ্দ করো। দুইজনকে গতরাতে আলাদা আলাদা বাড়িতে ফিরতে দেখেছি।   

নূহা হেসে বলল, আনন্দ ছড়ানোর জন্য কিন্তু কোথায় নিরানন্দ বিদ্যমান সেটার খোঁজ রাখাটা শর্ত। আর এই কাজটিতে তোমার কোন তুলনা নেই সেটা কি জানো? পরিবারের কোথায়, কখন, কার, কি সমস্যা হচ্ছে সব তোমার জানা থাকে।

জানা থাকে কারণ সংসারে আমি চক্ষু মেলিয়া বিচরণ করি। তোমার মতো বইয়ের পাতায় কিংবা নিজের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া রাখি না। 

কি করবো বলো? যত পড়ি ততই অনুভব করি এই পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারের কাছে আমার জ্ঞান কত ক্ষুদ্র! কত ধরণের জ্ঞানই না ছড়ানো রয়েছে এই পৃথিবীতে! আর কতই না তার শাখা-প্রশাখা! সাধ জাগে যদি ছুটে বেড়াতে পারতাম জ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা, অলিতে গলিতে! যদি আস্বাদন করতে পারতাম একটু একটু করে অমীয় সেই সুধা! না সব জ্ঞান ধারণ করতে চাইবার মত ক্ষমতা বা দুঃসাহস কোনটাই আমার নেই! তবে জ্ঞানের সব রঙকে ছুঁয়ে দেখার লোভ আছে এটা অস্বীকার করতে চাই না! জ্ঞানের প্রচণ্ড অভাব বোধ থেকেই মনেহয় আমার মনে জ্ঞানাহরনের এই তৃষ্ণার জন্ম! যাইহোক, মিহরায আর জাবীনের  কি হয়েছে সেটা কি জানো?

সবসময় যা হয় তাই হয়েছে। মতের অমিল। আর দুজনেরই তো একই রকমের স্বভাব। জীবনের সুখ-স্বস্থিকে কোরবানী করে দেবে কিন্তু নিজ নিজ মতকে নয়। 

আসলে প্রতিটা সম্পর্ককেই কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যখন কোন একটা বিষয়ে একে অপরকে বোঝানোটা খুব বেশি কঠিন হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি গুলোতে তাই একে অপরকে বোঝানোর চেষ্টা না করে বরং বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তাহলে জীবনের অকারণ জটিলতার সুযোগ অনেক কমে যায়। চলো মিহরায আর জাবীনের রেসলিংয়ে রেফারি হওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখি। 

এখন? অসম্ভব। ঘুম কম হলে আমার চোখের নীচে কালি পড়বে, মেজাজ খিটপিট করবে, ক্ষুধামন্দা দেখা দিবে, সারাদিন ঘুম ঘুম লাগবে। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে আমার শরীর ও মনে। আর ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি’ ইট’স ওকে। কিন্তু ‘পরের কারণে শরীর ও মনের সৌন্দর্য দিয়া বলি’ ইট’স নট ওকে। তোমার শখ তুমি রেফারি, গোলকিপার, উইকেট কিপার যা ইচ্ছে হয় হও। আমার পক্ষে এখন ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করা ছাড়া অন্য আর কিছুই সম্ভব নয়।   

নূহা হেসে বলল, তুমি কি জানো তোমার কথা রস টুপটুপ রসোগোল্লার মতো? আর স্বাদে গন্ধে এতটাই অতুলনীয় আমিই পারবো গপাগপ দশ-পনেরোটা খেয়ে ফেলতে। 

রাহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ হজম করতে পারলে অবশ্য তোমার কথার স্বাদও মিষ্টই। আসলে কি জানিস তোমার কথা হচ্ছে আমলকীর মতো। খেতে তিতকুটে কিন্তু কিছুটা সময় পেরোবার পর মিষ্টতায় ছেয়ে যায় মন।  

নূহা কিছু না বলে হেসে আবারো জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করলো। কিছুটা সময় নীরবতার পর ধীরে ধীরে বলল, পাথরে তৈরি মানুষের ভিড়ে পাতলা কাঁচের তৈরি ভঙ্গুর মনটিকে নিয়েই বড়ই বিপদে থাকতে হয়। খুব সাবধানে চলতে হয় প্রতি মুহুর্তে। কখন না কার টোকা লেগে ফেটে যায় মন, কারো আঁচড় না দাগ ফেলে দেয় সারাজীবনের মত স্বচ্ছ কাঁচের উপর। 

বেশ অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকালো রাহা। এভাবে বলছো কেন? তোমার মুখে অভিযোগ, হতাশা বা আক্ষেপ এই ধরণের কথা কেন জানি না ভীষণ বেমানান লাগে।

এখানেই তো সমস্যা।

মানে? 

মানে, সুখের নগরে করো বসবাস থাকো তাই সদা আনন্দে, কেমনে বুঝিবে তার যাতনা জীবন ভরা যার মন্দে। আকন্ঠ নিমগ্ন থাকো তুমি চারিদিকে ছড়ানো প্রাচুর্যে, স্বপ্ন সাধের দিতে হয়নি কুরবানি কভুও তোমাকে ধৈর্য্যে। আশার প্রদ্বীপ জ্বালাতে চাইলে বলে যখন লোকে এমন কথা, মুচকি হাসির ভেলভেটের আড়ালে লুকাই তখন নিজের ব্যথা। তোমার চলার পথে নিত্য বুনে যাই হরেক রঙের ফুল, তাই বলে ভেবো না পাড়াইনি কখনোই কন্টকাকীর্ণ পথের ধূল।

রাহা হেসে বলল, আসলেই এই ভুলটা আমরা খুব করি। কাউকে যখন খুব পজেটিভ দেখি ভেবে নেই তার জীবনে মনেহয় কোন সমস্যাই নেই।  

অথচ সবসময় যদি কেউ আশা জাগানিয়া কথা বলে তার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে, তার জীবন ক্যানভাসে হতাশার কোন আঁচড় পড়েনি বা পড়তে পারবে না। আমার কি মনেহয় জানো? কাঁটার আঘাতের রক্তাক্ত পদচিহ্ন ফুলে ফুলে ঢাকা পড়ে যায় বলেই হয়তো ফুল ছড়িয়ে যারা পথ চলে তাদের ক্ষতবিক্ষত পদযুগল কারো দৃষ্টি গোচর হয় না। বেদনার মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আসার অভিজ্ঞতা থাকে বলেই হয়তো কষ্টের নদীগুলোর বুকে তারা রচনা করতে পারে ছোট্ট ছোট্ট সাঁকো। কিন্তু একথা বেশির ভাগ মানুষই বোঝে না। আসলে মানুষ বুঝতে চায় না বলেই হয়তো বোঝে না কারো প্রফুল্লতা, আনন্দময়তার অর্থ এটা নয় যে সে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা শূন্য। তাই কারো উপর মানান-বেমানানের সীলমোহর লাগিয়ে দেয়া ঠিক না। কারণ মানুষ বড় ভঙ্গুর প্রাণী। সর্বাবস্থায় তার কাছে তাই একই রকম আচরণ আশা করা ঠিক নয়। তাছাড়া ছায়া ও আশ্রয়দানকারী বৃক্ষকেও কিন্তু ঝড়ের প্রকোপে সমূলে উৎপাটিত হতে দেখা যায়। 

কোন কারণে কিংবা হয়তো আজকের এই দিনটির অতীত স্মরণে নূহার মনকে বিষাদ ছুঁয়েছে বুঝতে পারলো রাহা। বোনকে কাছে টেনে নিয়ে তাই আদুরে গলায় বলল, চল আজ প্রাতঃভ্রমণে বের হই। 

নূহা কিছুটা আপত্তি করলেও রাহার আবদারের তোড়ে সেটা ভেসে গেলো সব আপত্তি। দুই বোন বেড়িয়ে গেলো প্রাতঃভ্রমণে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পাশের পার্কে চলে গেলো দুজন মিলে। একে অন্যের হাতে হাত রেখে স্মৃতির যানে চড়ে ছোট্টবেলার দিনগুলিতে অতীত ভ্রমণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসায় জায়গা খুঁজতেই রাহার চোখ চলে গেলো পার্কে ঝুলতে থাকা দোলনাতে। 

আশেপাশে তেমন কোন মানুষজন না থাকাতে মনের আনন্দে দোলনাতে দোল খেতে খেতে গল্পে মশগুল হলো দু’জন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন