কফির ঘ্রাণ নাকে এসে লাগতেই চোখ খুলে তাকালো আদী।
সুহাইব সাহেব চেয়ার টেনে বসতে বসতে হাসি মুখে বলল, সকাল থেকেই দেখছি ঝিম ধরে বসে আছো। শরীর খারাপ লাগলে
বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নাও।
আদী হেসে বলল, না মামা শরীর আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। রাতে ঘুম হয়নি
ঠিকমতো। তাই হয়তো ঘুম ঘুম লাগছে। কফির জন্য জাযাকাল্লাহ। দেখা যাক ঘুম ভাব কাটিয়ে
সতেজতা ফিরিয়ে আনতে পারে কিনা মিঃ কফি।
সুহাইব সাহেব হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ফায়েজকে ঢুকতে
দেখে থেমে গেলেন। দুজনের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে নিজের টেবিলে যাবার সময় আদীর সামনে
থেকে কফির মগ তুলে নিয়ে থ্যাংকস ফর দ্য কফি বললো ফায়েজ।
সালামের জবাব দিয়ে মোটামুটি হুঙ্কার দিয়ে আদী বলল, মামা ওকে বলো যদি
জীবনের মায়া থাকে তাহলে যেন এক্ষুণি ফিরিয়ে দেয় আমার কফি।
ফায়েজ নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মামা তুমি ওকেও
বলে দাও এক মূহুর্তের নেই ভরসা এমন জীবনের মায়ায় জড়ানো থেকে ঈমানদার নিজেকে বিরত
রাখে। আলহামদুলিল্লাহ, আমি একজন ঈমানদার।
সুহাইব সাহেব হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের এইসব
কান্ড দেখলে মনেহয় এখনো বুঝি সেই ছোটটিই রয়ে গিয়েছো। আদী আমি কফি নিয়ে আসছি তোমার
জন্য।
আদী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বিনা যুদ্ধে নাহি
দেব কফির মগ। মামা তুমি বোস। মল্ল যুদ্ধের রেফারি দায়িত্ব তোমার। যে জিতবে কফি
তার।
যোদ্ধা হতে কোনই আপত্তি ছিল না ফায়েজেরও। মামার হাতে
কফির মগ দিয়ে দুজন লেগে গেলো পাঞ্জা যুদ্ধে। দুই ভাগনের কান্ড দেখে মনের আনন্দে
হাসছিলেন সুসাইব সাহেব। জাওয়াদ রুমে ঢুকে দুই ভাইয়ের পাঞ্জা যুদ্ধ দেখে হাসি মুখে
মামার দিকে তাকালো প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে। সুহাইব সাহেব হাতে ধরে কফির মগ উঁচু করে
দেখাতেই জাওয়াদ বুঝে নিলো তার দুই বীর ভ্রাতা এক কাপ কফির জন্য যুদ্ধরত। চেয়ার
টেনে মামার পাশে বসে সালাম দিয়ে কফির মগ নিয়ে আয়েশ করে চুমুক দিয়ে জাওয়াদ বলল, নূহাকে দরকার ছিল
এখানে।
সালামের জবাব দিয়ে সুহাইব সাহেব বললেন, কেন?
এক কাপ কফি শিরোনামে জটপট একটা কাব্য বুনে ফেলতো।
সুহাইব সাহেব হাসতে হাসতে বলল, তা অবশ্য ঠিক।
কিন্তু তুমি এই সময়ে হসপিটালে যে?
একটা কাজে এসেছিলাম। চলে যাবো এখনই। মনেহলো যাবার আগে
দেখা করে যাই তোমাদের সাথে।
তাহলে সবার আগে এই বিজয়ীকে দেখো ভ্রাত। ফায়েজকে
হারিয়ে বিজয়ীর ভাব ধরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো আদী।
জাওয়াদ উঠে কফির মগ বাড়িয়ে ধরে বলল, নাও বিজয়ীর
পুরষ্কার।
মগ হাতে নিয়ে আদী বিস্ময় ভরা কন্ঠে বলল, কফি কোথায়?
ফায়েজ হাসতে হাসতে বলল, তুই কি ভেবেছিস শক্তিতে আমাকে হারিয়েছিস? নারে গাধা, কফি মগ থেকে উড়ে
যাচ্ছে দেখতে পেয়েই আমি অকারণে শক্তি ক্ষয় করা থেকে নিজেকে বিরত করেছি।
হেসে ফেললো চারজনই তখন একসাথে। কিছুটা সময় হাসি
আনন্দে কাটানোর পর জাওয়াদ বলল,
নাস্তা করেছো তোমরা সবাই?
না করে থাকলে চলো একসাথে নাস্তা করেই নিজ নিজ কাজে যাই।
সুহাইব সাহেব হেসে বললেন, আমি যদিও একবার
করেছি নাস্তা। কিন্তু তোমাদের সাথে বসে আরেকবার করতে কোন আপত্তি নেই। শুধু আদী
তোমাদের বড় মামীর কাছে সংবাদটা পাচার না করলেই হলো। বাড়ির বাইরে স্বামী-স্ত্রীদের
ঝগড়াঝাঁটি মিটমাট করে আর বাড়িতে কিভাবে ঝগড়া লাগাবে ক্যাপলদের মধ্যে সেই সুযোগের
সন্ধানে থাকে আদী।
আরেকবার হাসলো সবাই মিলে। হাসি-আনন্দ, দুষ্টুমি করতে
করতেই রেস্টুরেন্টের দিকে হাঁটতে শুরু করলো সবাই। রেস্টুরেন্টের পৌঁছে নাস্তার
অর্ডার দিয়ে একপাশে গিয়ে বসলো চারজন। আদীর চোখ চলে গেলো একদম লাস্ট টেবিলে মাথা নীচু
করে বসে থাকা এক ইন্টার্নের দিকে। বার বার একই ভুল করার জন্য গতকাল বিকেলে বেশ রাগ
করেছিল শাফাতের উপর। এরপর আর কথা বলার সুযোগ হয়নি। উঠে দাঁড়িয়ে মামা আর দুই ভাইয়ের
উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা কন্টিনিউ করো আমি আসছি।
নিজের মধ্যেই গুম হয়ে বসেছিল শাফাত। নানান কারণে মনের
ভেতরটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল একদম। নিজেকে কেমন যেন শূন্যে ভাসমান মনে হচ্ছিলো। কিছু
একটা ভাবনা চলছিল মস্তিষ্কে। কিন্তু সেটা যে কি নিজেই ঠিক ধরতে পারছিল না। হঠাৎ
সালাম শুনতে পেয়ে চোখ তুলে তাকালো। সামনে আদীকে দেখতে পেয়ে গতকালের ভুলের কথা মনে
পড়ে বেশ ঘাবড়ে গেলো। সালামের জবাব দিতে হবে সেটাও ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে
রইলো।
কোন একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শাফাত বুঝতে
পারলো আদী। চেয়ার টেনে সামনে বসে বলল, সালামের জবাব দেবার কথা মনেহয় খেয়াল নেই তোমার।
আদীর কথা শুনে যেন চেতনা ফিরে পেলো শাফাত। সালামের
জবাব দিয়ে বলল, আই এম সরি স্যার। আমি আসলে আপসেট ছিলাম।
আদী হাসি মুখে বলল, ইট’স ওকে। ডিস্টার্ব মনেহচ্ছে তোমাকে। চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।
বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শাফাত বলল, স্যার কেউ যদি
বিশ্বাস ভঙ্গ করে তাহলে কি করা উচিত? কারো উপর বিশ্বাস করে যখন জীবনের অনেক বড় একটা
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়। একটা লক্ষ্য সেট করে ফেলা হয়। এবং লক্ষ্যটা যখন একদম
হাতের নাগালের মধ্যে এসে যায়। এমন সময় যদি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তারফলে
লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়তে হয় অনেক দূরে। তখন নিজেকে সামলানোর উপায়ই বা কি?
আদী বলল, জীবনে আগত সমস্যা থেকে নিজেকে সামলানোর উপায় হচ্ছে, সমস্যাটাকে মেনে
নেয়া। আসলে কি জানো? জীবনে কিছু জিনিস হঠাৎ করেই খুব ভালো লেগে যায় আমাদের। সেটা হতে পারে কোন
মানুষ কিংবা অন্য যে কোন কিছু। এবং সেটাকে ঘিরে খুব এক্সাইটিং ফিল হয়। সেটার
মধ্যেই আনন্দ কিংবা প্রেরণা খুঁজে পায় মন। কিন্তু কোন জিনিস সবসময় একই রকম থাকে
না। নিয়ম মেনেই একসময় বদলে যায়। একটা সময় মন উপলব্ধি করে সে যা চেয়েছিল, ভেবেছিল জিনিসটা
ঠিক তেমন নয়। হতাশ হয়ে যায় তখন মন। এক সময় আবার সময় ধীরে ধীরে মেনে নেয় ব্যাপারটা।
এবং সেটা ভুলে নতুন কোন ভালো লাগা কিংবা প্রেরণা খুঁজে নেয় জীবনের জন্য। সাময়িক
কষ্ট হবার পরেও যারা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় তাদেরকে মূলত খুব বেশি সমস্যার
স্বীকার হতে হয় না। কিন্তু যারা মেনে নিতে পারে না সমস্যাটা তাদের জীবন হয়ে উঠতে
পারে ছন্দহীন। কারণ সমস্যা মেনে না নিলে সমধান করাও সম্ভব হয় না। আর জীবনের
সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পাবার জন্য সমাধান করতে হয়, কখনো বা চ্যানেরালাইজড করতে হয়। তাই সবার আগে
সমস্যাটাকে মেনে নাও।
চেষ্টা করছি স্যার। কিন্তু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি
না। স্বপ্নভঙ্গ, বিশ্বাসভঙ্গ মেনে নেয়াটা বোধহয় একটু বেশি কঠিন স্যার!
একটু ক্ষণ চুপ থেকে আদী বলল, জীবন কখনো কখনো
হঠাৎ এমন এক স্থানে থমকে দাঁড়িয়ে যায়,
যেখান থেকে গন্তব্যটা স্পষ্ট দৃষ্টি সীমার মাঝে ধরা দেয়। মনেহয় এটাই সেই
অভীষ্ট লক্ষ্য যার সন্ধানে ছুটেছিল এতটা পথ। চোখের সম্মুখে গন্তব্যকে দেখতে পেয়ে
আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে মন। কিন্তু কিছুটা সময় পর বোঝা যায় যে, যেটাকে গন্তব্য
ভেবেছিল সেটা আসলে জীবনের আরেকটি মোড়। তখন কিছু সময়ের জন্য হলেও আশাহত হতে হয়!
তেমনি জীবনে কেউ কেউ হঠাৎ একদিন স্বপ্নময় কোন এক ভুবন থেকে হাজির হয়ে যায় যেন!
যাকে দেখেই মনেহয় এমন কারো সন্ধানেই তো ছিল মন। তারপর তাকে নিয়েই বুনতে শুরু করে
ভীষণ স্বপ্নময় কোন উপাখ্যানে। অতঃপর একদিন সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে হারিয়ে যায় সেই
মানুষটি। যাকে স্বপ্নের আহ্বায়ক ভেবে নিয়েছিল মন, সেই সূচনা করে জীবনের স্বপ্নহীন একটি অধ্যায়ের। জীবনে
আসলে ব্যর্থতারও দরকার আছে। স্বপ্নীল ভুবনের দোর গোড়ায় পৌঁছে রুদ্ধ দ্বার থেকে
বিমুখ হয়ে ফিরে আসারও
দরকার আছে। কারো প্রতি বিশ্বাসের ঘুড়িটা উড়তে উড়তে আকাশ ছুঁয়ে দিতে দিতে
হঠাৎ সুতো ছিঁড়ে পথভ্রষ্ট হওয়াটাও অপ্রয়োজনীয় নয়। শ্বেত শুভ্র ভালোবাসার পায়রাটি
রক্তাক্ত হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ারও প্রয়োজন আছে।
কিন্তু কেন স্যার? এসব তো জীবনের অন্ধকার দিক!
স্বপ্নভঙ্গ, বিশ্বাসঘাতকতা, আশাহত হওয়া অবশ্যই জীবনের অন্ধকারাচ্ছন দিক। আর কেউই
চায় না তার সাধের স্বপ্নটা ভেঙে যাক। না কেউ বিশ্বাসের বদলে আঘাত পেতে চায়। কেউই
ভালোবাসার প্রতিদানে ঘৃণা আশা করে না। কেউই চায় না জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত
হতে। কিন্তু তবুও নেতিবাচকতা দু’বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকে চলার পথে বাঁকে বাঁকে। জীবনে যখন যে রুপেই
নেতিবাচকতা হাজির হোক না কেন,
সাথে করে একরাশ কষ্টও নিয়ে আসে। নানার রঙের কষ্টের ভিড়ে শুধু একটা জিনিসই
কমন থাকে। সেটা হচ্ছে, শিক্ষা। জীবনে সংঘটিত প্রতিটি ভুল খুলে দিয়ে যায় একটি একটি নতুন শিক্ষার
দুয়ার। কোন কিছুর বিনিময়েই জীবনে কিছু পেতে হয়। তেমনই চলার পথেও প্রতিটি হোঁচটের
বিনিময়েই সমৃদ্ধ হয় জীবন। আগত প্রতিটা আঘাত থেকে নিতে হবে শিক্ষা। ব্যর্থতা সিঁড়ি
টপকেই ছুঁতে হবে সফলতা। বিশ্বাসঘাতকতা থেকে শিখতে হবে বিশ্বাস করার ভিত্তি। জীবনে
কখনোই থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া চলবে না। চলার পথ যেমনই হোক এগিয়ে চলতে হবে শিক্ষা অর্জন
করতে করতে। জীবন মানেই ভাঙা-গড়ার এক অবিশ্রান্ত খেলা। যার কোন মধ্য বিরতি নেই। তাই
হারতে ভয় পেতে নেই জীবনে। ব্যর্থতাতে ঘাবড়ে যেতে নেই। বিশ্বাসঘাতকতায় দুর্বল হতে
নেই। আশাভঙ্গে হতাশ হতে নেই। বরং প্রতিটি নেতিবাচক ঘটনা পেছনে নিজের ভুলটা খুঁজে
বের করে নেবার পাশাপাশি নতুন শিক্ষার রত্নটিকে তুলে নিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলতে হয় জীবন
ভান্ডারকে। এবং সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হয় নতুন কোন শিক্ষার আগমনের প্রতীক্ষায়।
আমার কথাগুলো কি এলোমেলো লাগছে তোমার কাছে?
বুঝতে পারছি না স্যার। কিছুই বুঝতে পারছি না।
আদী হেসে বলল, বাসায় চলে যাও। ভালো মতো শাওয়ার নিয়ে লম্বা একটা ঘুম
দাও। ঘুম থেকে উঠে আমার কথাগুলো ভেবে দেখো। তখনো যদি বুঝতে না পারো তাহলে রাতে যখন
ডিউটিতে আসবে তখন বুঝিয়ে বলবো ইনশাআল্লাহ।
সত্যিই বাসায় চলে যাবো স্যার? আধঘন্টা পর আমার
ডিউটি শুরু।
আদী হেসে বলল, সত্যিই বাসায় চলে যাও। আমি তোমার শিফট চেঞ্জের কথা
বলে দেবো ইনশাআল্লাহ। কিসে যাও বাসায়? মেট্রোতে?
জ্বি স্যার।
এখন বাসে যাবে। উইন্ডো সীটে বসে চারপাশের প্রকৃতি
দেখতে দেখতে।
শাফাতকে বিদায় জানিয়ে আবারো মামা ও ভাইদের সাথে এসে
বসলো আদী।
===============
ক্লাস শেষ করে বেড়িয়েই মামণিকে ফোন করলো নূহা। সালাম
ও কুশলাদী বিনিময়ের পর বলল, মামণি কোন প্রশ্ন না করে আমি যা বলবো তাই করবে। চোখ বন্ধ করো। এখন ভাবো যে
তুমি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছো। তোমার মনে আজ অনেক আনন্দ কারণ বাবা আজ আবদারের সুরে
তোমাকে বলেছে, সুরাইয়া মনেহচ্ছে বহুদিন তোমার হাতের ইলিশ মাছের পাতুরি খাই না। বড় বড় পুঁই পাতা দিয়ে
রাঁধো না আজ ইলিশ পাতুরি। শোন ঝাল ঝাল করবে কিন্তু। আনন্দে তাই টগবগ করে ফুটতে
ফুটতে তুমি রান্নাঘরে ঢুকেছো। ট্যাপের নীচে রেখে ঘষে ঘষে যত্ন করে পুঁই পাতা ধুচ্ছো।
পেছনে কারো পদশব্দে ভগ্ন হলো তোমার নিমগ্নতা। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখো অবনত মস্তকে
তোমার অবাধ্য কন্যা মানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। কেঁপে উঠলো তোমার বুকের ভেতর। মনেহলো
হায় আল্লাহ কি হয়েছে আমার মেয়ের?
এত শুকনো লাগছে কেন আমার পাখীটার চেহারা? দ্রুত হাতে পানির কল ট্যাপ বন্ধ করে আঁচলে হাত মুছতে
মুছতে তুমি আমার কাছে এসে দাঁড়ালে। আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বললে, কি রে মা কি
হয়েছে তোর? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?
আমি আহ্লাদে গদগদ হয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললাম, মামণি জানোই তো
আমি অদ্ভুত, করে ফেলেছি তোমার কিঞ্চিৎ গীবত। দয়া করে মোরে করো ক্ষমা, এখানেই লুকানো
মাতৃত্বের মহিমা।
মিসেস সুরাইয়া বললেন, সামনে পেলে এখন এমন একটা থাপ্পড় দিতাম তোকে, সব দুষ্টুমি ভুলে
যেতি।
হাসতে হাসতে নূহা বলল, আচ্ছা চলো কল্পনায় থাপ্পড় দেবার দৃশ্যও হয়ে যাক।
যথেষ্ট হয়েছে বন্ধ কর তোর ভুজুংভাজুং। কোথায় তুই এখন? কার কাছে করেছিস
আমার নামে গীবত।
এই তো ক্লাস থেকে বের হলাম মাত্র। লেকচার ছিলো আজ
আমার। স্টুডেন্টদেরকে একটা বিষয় বোঝাতে গিয়ে তোমার সামান্য উদাহরণ টানতে হয়েছিলো।
তারপর থেকে মনের মধ্যে খচখচ করছে।
মনের মধ্যে খচখচ করে এমন কথা বা কাজ করার দরকারটা কি
তোর?
দরকার আছে মামণি। যখন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেয়ার
কথা হয় তখন সেটার ব্যাপারে দৃঢ়তা থাকে মনে। তাছাড়া নিজের উদাহরণ দিয়ে কথা বলার
আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, মানুষ বোঝে যে উনি শুধু লেকচারই দিচ্ছেন না সাথে ফিলও করছেন। যদিও ফিল করার
জন্য প্রতিটি পরিস্থিতিকে ফেস করা শর্ত নয়। কিন্তু অভিজ্ঞতার একটা আলাদা মর্যাদা
আছে। কোন মানুষ যখন এমন কাউকে দেখে যে তারই মত করে কথা বলে, চিন্তা করে কিংবা
পেরিয়ে এসেছে তারই মতো অবস্থা,
তাহলে খুব দ্রুত আপন করে নেয় তাকে। আর এটাই আমি চাই। আমার কাছে যারা সমস্যা
নিয়ে আসে তারা যেন আমাকে আপন ভাবতে পারে। যা আমাকে তাদেরকে বুঝতে ও সঠিক পরামর্শ
দিতে অনেক বেশী সাহায্য করে।
তা এই লক্ষ্যে কি তুই গিনিপিগ শুধু আমাকেই বানাস নাকি
আমি ছাড়াও আরো গিনিপিগ আছে তোর ভান্ডারে?
নূহা হাসতে হাসতে বলল, আরো আছে। যেদিন যাকে বানাই সেদিন তোমার মতো তাকেও চার
লাইন কাব্য শুনিয়ে দেই। আলহামদুলিল্লাহ। কি রান্না করছো মামণি?
কি রান্না করছি সেটা তো জানিসই। এই বাড়ির সব কথা তোর
কাছে পাচার করার কারবারই তো করে তোর বাপ-চাচারা। আমি চিংড়ী দিয়েও পাতুরি করে তোর
জন্য পাঠাবো ভাবছিলাম। চলে আয় তুই।
না আজ আসতে পারবো না। তুমি রান্না করে পাঠিয়ে দিও
বাসায়। আমি রাখছি এখন।
কিন্তু কি গীবত করেছিস আমার নামে সেটা তো বললি না?
আমি আজ শরীর ও মন নিয়ে কথা বলছিলাম মামণি। শরীরের
ব্যাপারে আমরা নিজেরা যেমন যত্নশীল আমাদের প্রিয়জনেরাও। কিন্তু মনের ব্যাপারে সবাই
উদাসীন। অথচ মনেরই কিন্তু বেশি প্রয়োজন নিজের এবং অন্যের যত্নের। যেমন ধরো, আমার মাথা ব্যথার
সময় তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলেও আমি পেইনকিলারের সাহায্যে খুব সহজেই দূর করতে
পারবো আমার ব্যথা। কিন্তু মামণি যখন আমার মনে কোন কারণে ক্ষতের সৃষ্টি হয় আর তার
প্রভাব পড়ে আমার কথা, কাজ বা আচরণে। দেখা যায় না বলে সেই ক্ষতে মলম লাগানোর বদলে হয়তো তাতে
আরেকটা আঁচড় কেটে যাও তুমি। যারফলে গড়িয়ে পরে আরো কয়েক ফোঁটা রক্ত।
কোন মা নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে এটা করে না? তুই নিজেও তো মা।
পারবি তোর মেয়েকে সজ্ঞানে রক্তাক্ত করতে শারীরিক বা মানসিক ভাবে?
বেশির ভাগ সময়েই প্রিয়জনরা না জানার কারণেই আঘাত দেয়
ক্ষতে এতে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু কথা এখানে নয়। কথা হচ্ছে মনকে দেখা যায় না তাই
কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না যে,
নিশ্চয়ই কোন সমস্যার কারণেই কথা বা আচরণে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এখন দুনিয়ার সবার পক্ষে তো তোর মত মন ও মস্তিষ্কের
গবেষক হওয়া সম্ভব নয়।
আমি তো সেকথাই বলছি মামণি। সেজন্যই তো নিজেকেই নিজের
আশ্রয় হতে হবে। ‘দুনিয়া বার বার হাজির হবে নিয়ে তার রূপ বীভৎস, থমকে যেন না যায়
কদম হতে হবে তাই নিজেই নিজের প্রেরণার উৎস’।
যখনই মামণির সাথে কথা বলতে শুরু
করে কথারা ডাল-পালা ছড়িয়ে, পুষ্প-পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়ে অনবরত ঝরাতে থাকে তাজা তাজা সবুজ পাতা। কত সময়
ধরে যে গল্প চলতে থাকে কোন হিসাবই থাকে না। কিন্তু ক্লাস থেকে বেরিয়ে যয়নবকে বার
বার তাকাতে দেখে নূহা বুঝতে পারলো হয়তো কথা বলতে চাচ্ছে। অবশ্য ক্লাস থেকে বের
হবার সময়ই খেয়াল করেছিল যয়নব বেরিয়ে আসছে তার পেছন পেছন। ক্লাস চলাকালীন সময়েও খুব
চিন্তিত দেখাচ্ছিল যয়নবকে। কথা বলতে ইচ্ছুক সেটাও বুঝতে পারছিল। তাই পরে গল্প করার
ওয়াদা করে মামণির কাছ থেকে বিদায় নিলো। নূহা কথা শেষ করতেই যয়নব এগিয়ে এসে সালাম
দিয়ে বলল, ম্যাম আপনার কি কিছুক্ষণ সময় হবে?
হাসি মুখে সালামের জবাব দিয়ে নূহা বলল, হ্যা, আলহামদুলিল্লাহ।
নিজের কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে যয়নব বলল, ম্যাম আপনি তো
জানেন আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার বিয়ে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু
আমি অনেক বড় একটা সমস্যাতে পড়েছি।
কি ধরণের সমস্যা?
আমি এবং রিয়াদ দুজনই চাচ্ছি আমাদের বিয়েটা শরীয়তের
বিধান মতো হোক সব দিক দিয়ে। কিন্তু আমাদের দুজনের পরিবার থেকেই নানান বাঁধার
সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ট্র্যাডিশনাল মুসলিম ফ্যামিলি আমাদের দুজনেরই। বিয়ে আনুষঙ্গিক
কত ধরণের ইভেন্ট যে আছে। অনেক কষ্টে সেসব থেকে ফিরিয়েছি
ফ্যামিলিকে আমরা দুজন মিলে।কিন্তু এখনো কিছু কিছু সমস্যা আছে। সেসব নিয়ে আলোচনা
করতে চাইছি আপনার সাথে।
নূহা বলল, তাহলে এক কাজ করো তুমি ক্যান্টিনে গিয়ে বোস। আমি কাজ
সেরে পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি ইনশাআল্লাহ। এরপর কথা বলবো।
যয়নব হেসে বলল, জ্বি ম্যাম ঠিকআছে। থ্যাংকইউ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন