সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৩৪



চায়ের পানি চাপাতে যেয়ে আনন্দে চোখ ভিজে উঠছিল বার বার নাবিহার। ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাবার আগে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে পাপা ফিরে এসেছেন। যখন জাল দাদাভাইয়ের বদলে পাপার কন্ঠের তিলাওয়াত শুনতে পেয়েছিল ইচ্ছে করছিল আনন্দে চিৎকার করে উঠতে। অবশ্য একটু একটু অভিমানও হয়েছিল পাপা এসে তাকে ডাকেনি কেন ঘুম থেকে? কিন্তু আনন্দের প্রচন্ডতার কাছে অভিমান ভেসে গিয়েছিল। নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বেরিয়েই সোজা কিচেনে চলে এসেছে নাবিহা পাপার জন্য চা বানাতে। গত দুই সপ্তাহ বাবা-মামণির সাথে বসে গল্প করতে করতে প্রভাতী চা পান করতেও অনেক ভালো লেগেছে। কিন্তু মনের মধ্যে চুপিচুপি একটা ভাবনা শুধু উঁকি দিয়ে যেত একটু পর পরই। শুধু মনে হতো এমন দিন কবে আসবে তার জীবনে যেদিন পাপা-মামণির মাঝখানে বসে গল্প করতে করতে প্রভাতী চা পান করতে পারবে? গত কয়েকদিন এত কষ্ট হয়নি কিন্তু এখন কথাটা ভাবতে গিয়েই দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো নাবিহার। তাড়াতাড়ি চোখ মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে নিলো চেহারাতে। এতদিন পর কিছুতেই কান্না মাখা চেহারা নিয়ে পাপার সামনে যেতে চায় না। চা বানানো হলে হাসি ভরা চেহারা নিয়ে পাপার রুমে রওনা দিলো নাবিহা। রুমের ভেতর উঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বুঝলো পাপা এখনো মসজিদ থেকে ফেরেনি। বিছানার উপর চোখ পড়তেই খুব সুন্দর একটা ডায়েরী দেখতে পেলো। ট্রে পাশে রেখে তখন ডায়েরীটা হাতে তুলে নিলো নাবিহা। ঠিক ঐ মূহুর্তেই রুমে ঢুকলো জাওয়াদ। মেয়েকে রুমে দেখে হাসি মুখে সালাম দিলো।

নাবিহা সালামের জবাব দিয়ে হাসির বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে বলল, পাপা তোমার জন্য চা নিয়ে এসেছি। আজ কিন্তু চা পান করতে করতে গল্প করবো না। আজ তোমার সাথে ঝগড়া করবো। তুমি রাতে ফিরে কেন আমাদেরকে ডাকোনি?

জাওয়াদ হাসি মুখে কাছে যেয়ে দঁড়িয়ে প্রথমে নাবিহার হাত থেকে ডায়েরি নিলো। এরপর ওর দু’হাত ধরে বলল, আমার সল্টি বেবিটার গুল্লু গুল্লু হাত দু’খানি কত্তো বড় হয়ে গিয়েছে। আসলে একটু বেশিই বড় হয়ে গিয়েছে। এত বড় হাত থাকা ঠিক না। হাত যখন এমন বেশি বড় হয়ে যায় তখন কি করতে হয় জানো?  সেটাকে কেটে ছোট করে সঠিক মাপে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। 

নাবিহা চিৎকার করে বলল, পাপা তুমি এত শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছো কেন? আমি অনেক ব্যথা পাচ্ছি তো! 

জাওয়াদ মেয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ব্যথা পাচ্ছিলেন কারণ আপনাকে আমি ব্যথা চাচ্ছিলাম আম্মাজান। কেন শুনবেন? এটা বোঝানোর জন্য যে, সন্তানরা যখন কোন অন্যায় বা ভুল করে তখন তাদের পিতা-মাতারা অন্তরে এরচেয়েও হাজার গুণ বেশি ব্যথা অনুভব করে।  

নাবিহা চোখ বড় বড় বলল, আমি কি অন্যায় করেছি?  

অনুমতি ছাড়া কারো জিনিস ধরা অন্যায় এটা নিশ্চয়ই অজানা নয় তোমার? আজ তুমি আমার ডায়েরি ধরেছো, আগামীকাল অন্য কারোটা যাতে না ধরো তাই তোমাকে সংশোধন করে দেয়াটা জরুরি ছিল। 

একথা তো মুখে বললেও হতো। অভিমানী কন্ঠে বললো নাবিহা।

যদি শুধু মুখে বললেই হয়ে যেত তাহলে পাপা অবশ্যই কখনোই তোমাকে ব্যথা দিতাম না। ঠিক তেমনি যেখানে ব্যথা দেবার প্রয়োজন সেখানে কখনোই তোমাদের পাপা শব্দের প্রয়োগ করবে না। এখন তুমি প্রশ্ন করতে পারো, কেন তোমাকে ব্যথা দিলাম। 

করলাম প্রশ্ন। পাপা তুমি কেন আমাকে ব্যথা দিলে? 

যাতে এরপর যখনই তুমি বিনা অনুমতিতে কারো জিনিস ধরতে যাবে এই ব্যথার কথা স্মরণে আসে। এবং অনাধিকার চর্চা এবং একটি অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পারো। বিষে বিষ ক্ষয়ের মতো এটা হচ্ছে ব্যথায় ব্যথা হয়। 

ব্যথায় ব্যথা ক্ষয় কিভাবে? অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো নাবিহা।

নিজের ব্যথার স্মরণ তোমাকে অন্যেকে ব্যথা দেওয়া থেকে ব্যহত করবে। হলো কিনা ব্যথায় ব্যথা ক্ষয়? 

হুম, হলো। 

তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো। 

নাবিহা কিছু না বলে দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে আঙ্গুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, তোমাকে আমি কিছুই বলবো না দুষ্টু ছেলে। যা বলার আমার মামণি বলবে। রেডি হও তুমি। তার কথা শুনে পাপাকে হেসে ফেলতে দেখে চেহারা আরো গম্ভীর করে দুপদাপ করে চলে গেলো নাবিহা।  

স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে জাওয়াদ ডায়েরী ড্রয়ারে রাখলো। নাবিহাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিল কান্না করার পুরো আয়োজন করে এসেছে। মেয়েরা বেশির ভাগ সময়ই বাবার জন্য সাত সমুদ্র ভালোবাসা লালন করে মনের মধ্যে। একটু কিছু হলেই সমুদ্রের নোনা পানি অঝোর ঝরিয়ে বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। নাবিহাও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিদিন প্রভাতী চা পানের সময় মিস করেছে বাক্যটা কমপ্লিট করার আগেই কান্না জুড়ে দিতো। তাই নাবিহার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার লক্ষ্যেই ইচ্ছে করেই ডায়েরী ধরার জন্য একটু শাস্তি দিয়েছে। অবশ্য ছোট ছোট ভুলগুলোতেও সন্তানদেরকে সতর্ক করে দেয়াটাও পিতা-মাতা হিসেবে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোনাহ যেমন বড় গোনাহের দ্বার খুলে দেয়। ভুলের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম। নয়তো নাবিহার জন্যই নিয়ে এসেছে এই ডায়েরীটা। ছোটবেলা থেকেই নিজের ভাবনাদের শব্দের ফ্রেমে বন্দী করে রাখার শখ নাবিহার। একই শখ জাওয়াদেরও ছিল ছোটবেলাতে। আর নূহা তো পারলে সারাদিনের প্রতিটি মূহুর্তকে টুকে রাখতো ডায়রীর পাতায়। কিছুক্ষণ মামণির সাথে মিলে হৈচৈ করে নিক এরপর মেয়ের অভিমান ভাঙানো যাবে। সাথে ডায়েরীটাও উপহার দেবে ভাবতে ভাবতে ট্রে থেকে চা নিয়ে জানালায় এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পাপা, পাপা বলে চিৎকার করতে করতে জিশান রুমে ঢুকলো। ঢুকেই ছুটে এসে জড়িয়ে পাপাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ আহ্লাদ করলো। জাওয়াদ ছেলেকে আদর করে হেসে বলল, কেমন আছে আমার ক্ষুদে বিজ্ঞানীটা? নতুন কোন দুষ্টুমি কি আবিষ্কার করেছে এই কয়দিনে?    

জিশান হাসতে হাসতে বলল, আলহামদুলিল্লাহ অনেকগুলো করেছি পাপা। এখন তো তুমি ক্লান্ত। বিকেলে বলবো ইনশাআল্লাহ। এখনো তোমাকে একটুও বিরক্ত করতে আসিনি আমি। এখনি চলে যাচ্ছি রুম থেকে। যাবার আগে শুরু একটা প্রশ্ন করতে চাই।

জ্বি অবশ্যই।

আচ্ছা পাপা শাস্তির শর্ত কি?

মানে?

মানে হচ্ছে কাউকে শাস্তি কেন দেয়া হয়?

যখন কেউ অন্যায় করে তখন তার ভেতর সেই উপলব্ধি জাগ্রত করা এবং যাতে নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারে সেজন্য শাস্তি দেয়া হয়। 

জিশান সবগুলো দাঁত বের করে বলল, তারমানে শাস্তির শর্ত হলো অন্যায় করা। এই তো?

হুমম, তা বলা যায়। 

পাপা কেউ যদি কোন কিছু না করে তাহলে কি তাকে শাস্তি দেয়া উচিত?

অবশ্যই না।

পাপা জিশান যদি কোন কিছু না করে সেজন্য কি জিশানকে শাস্তি দেয়া যুক্তিযুক্ত হবে?

এবার কিছুটা সতর্ক হয়ে উঠলো জাওয়াদ। মায়ের মতো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলে দুষ্টু কার্য হাসিল করে নেবার স্বভাবটা খুব ভালো মতো পেয়েছে জিশান। তাই বলল, ঠিক কি বলতে চাইছো তুমি?

জিশান পাপা হয়েছে কি শোনো। তুমি যাবার আগে যেসব হোমওয়ার্ক দিয়ে গিয়েছিলে জিশান বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে সেগুলো করতে পারেনি। সেজন্য আমি জেনে নিলাম শাস্তির শর্ত কি। তুমি বলেছো, শাস্তির শর্ত কিছু করা। কিন্তু জিশান তো হোমওয়ার্ক করেনি। অর্থাৎ, কিছু করেনি। সুতরাং, এটা শাস্তির শর্তের মধ্যে পড়ে না। ইয়াহুউউউউউউ! আচ্ছা তুমি রেস্ট নাও পাপা। জিশান চলে যাচ্ছে। বলে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

জিশানের এই সমস্ত দুষ্টুমি জাওয়াদ সবসময়ই খুব এনজয় করে। মনেহয় নূহার দুষ্টুমির পুরো খাজানা একাই দখল করে বসে আছে জিশান। রুমের দরজায় এসে জাওয়াদকে একা একা হাসতে দেখে বেশ অবাক হলো ফায়েজ। এক মূহুর্ত অপেক্ষা করে দরজা নক সালাম দিলো।

সালামের জবাব দিয়ে জাওয়াদ বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।

রুমে ঢুকে ফায়েজ বলল, একা একা হাসছিস কেন?

জাওয়াদ হেসে বলল, আমার কন্যা আর পুত্রদের কর্মকান্ড দেখে না হেসে কোন উপায় নেই তো সেজন্য। যাইহোক, কিছু বলতে এসেছিস?

না এমনিতেই ইচ্ছে হলো তোর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করতে।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর জাওয়াদ বলল, গতরাতে বাড়িতে ঢোকার সময় অনেক বছর পর মনেহচ্ছিলো সত্যি সত্যিই আমাদের আনন্দবাড়িতে ঢুকছি। বাতাসে গুঞ্জিত হচ্ছিলো আনন্দ ধ্বনি। প্রতিবারই যখন ট্যুর থেকে ফিরে আসি জিশান, জিহাদ, নাবিহা কতটা মিস করেছে আমাকে বলতে বলতে কান্না জুড়ে দেয়। অথচ আজ ওদের দুষ্টুমি দেখে আমিও হাসছি। কিন্তু বাড়ির এমন আনন্দময় পরিবেশ কতক্ষণ স্থায়ী হবে ভেবে শঙ্কিতও হচ্ছি। নূহা কি কিছু বলেছে চলে যাবার ব্যাপারে?  

না আমি তো এমন কিছু শুনিনি। মসজিদ থেকে বেরোনোর সময় দেখা হয়েছিল। অন্যান্য দিনের মতো হাসি-খুশির তো মনে হয়েছে। আমি কি জিজ্ঞেস করে দেখবো নূহাকে? কথা বলছিস না কেন?

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে ঈশারা করে জাওয়াদ বলল, জিহাদ আর জারিফ এতক্ষণ হাত ধরে হাঁটছিল বাগানে। দুজনের মধ্যে কিছু মনেহয় হয়েছে। জারিফ এখন দূরে সরে হাঁটছে এবং চোখ মুছছে। চল তো দেখি কি হলো আবার দুই ভাইয়ের।   

ফায়েজ আর জাওয়াদ রুম থেকে বেরিয়ে বাগানে নেমে এলো। জিহাদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরুত্ব রেখে চোখ মুছতে মুছতে হাঁটছিল জারিফ। জাওয়াদ বলল, জিহাদ জারিফ কি কান্না করছে?

জিহাদ জবাব দিলো, জ্বি পাপা। বেশি পাকামো করে জারিফ। সারাক্ষণ বড়দের ব্যাপারে কথা বলে। তাই ওকে শাস্তি দিয়েছি আমি। বলেছি আমার কাছ থেকে দূরে সরে হাঁটতে। পাপা তুমি কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে ইন্টারফেয়ার করবে না।    

জাওয়াদ হেসে বললেন, অবশ্যই করবো না। শাস্তি দেয়া বা পাওয়া নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। তবে পিতা হিসেবে দুঃখ ভারাক্রান্ত পুত্রের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো আমার দায়িত্ব ও কতর্ব্য। এটা আমি কিছুতেই অবহেলা করতে পারবো না। 

জিহাদ  তখন হেসে ফেললো। জাওয়াদ এগিয়ে গিয়ে জিহাদের মাথায় হাত বুলিয়ে জারিফের কাছে দাঁড়াতেই জারিফের কান্নাতে জোয়ার চলে এলো। ঝিরিঝিরি বারিধারা অঝোর শ্রাবণধারাতে পরিণত হলো। জাওয়াদ চোখ বড় বড় করে বললেন, কি সর্বনাশ জারিফ কি কান্না করছে নাকি? পুরুষ মানুষ এমন দিবালোকে খোলা ময়দানে কান্না করলে তাকে কি বলে জানো?

জারিফ দু’হাতে চোখে মুছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, কি বলে পাপা?

ভীতু, দুর্বল, কাঁদুনে স্বভাবের পুরুষ বলে। বীরপুরুষ বলে না। কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম জারিফ বীরপুরুষ!

জারিফ দু’হাতে ভালো করে চোখ মুছে বলল, হ্যা আমি বীরপুরুষ তো। দেখো কান্না নেই চোখে।

জাওয়াদ দেখে হেসে বলল, ভেরি গুড। দ্যাটস লাইক অ্য মাই পার্টনার। গিভ মি ফাইভ।জারিফ তখন পাপার সাথে হাত মিলানো। জাওয়াদ হেসে বলল, চলো তো দেখি কে বেশি ফার্স্ট। কে আগে দৌড়ে নানাভাইকে ধরতে পারে। জাওয়াদ কথা শেষ করার আগেই জারিফ দৌড়াতে শুরু করলো। এক ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আজাদ সাহেবের কোলে। তারপর হাসতে হাসতে বলল, পাপা হেরে গিয়েছে। আমি বেশি ফার্স্ট। আমি আগে নানাভাইকে ধরেছি। আই উইন, আই উইন।     

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আজ থেকে তাহলে জারিফ আমার দৌড়ের টিচার। সময় পেলেই পাপা তোমার কাছে দৌড় শিখবো। কেমন? জারিফ তখন মহা আনন্দে লাফাতে শুরু করলো। ছেলেকে শান্ত করে ফায়েজকে নিয়ে বাগানের এক পাশে এসে বসলো জাওয়াদ। ফায়েজ হাসি মুখে বলল, লাইক ফাদার লাইক সান বাক্যটির প্রমাণ দেখছি আজকাল তোর বড় পুত্রের মধ্যে। তুই যেমন ছোটবেলা থেকেই সবসময় আমাদের সব ভাইবোনদেরকে আগলে রেখেছিল সকল ভুল কাজ, অকল্যাণকর সবকিছু থেকে। রাহবার হয়ে সবসময় দেখিয়ে দিয়েছিল আলোকিত পথের দিশা। আমাদের জিহাদ আব্বাজানও তেমনি ছোট সব ভাইবোনদের জন্য রাহবার হয়ে গিয়েছে এখনই। অবশ্য শুধু ভাইবোনই না বাড়ির প্রতিটা সদস্যর প্রতিই সজাগ দৃষ্টি থাকে জিহাদের সবসময়। 

আলহামদুলিল্লাহ এই বিষয়টা আমিও খেয়াল করেছি। জিহাদ চুপচাপ থাকে কিন্তু বাড়ির সবার সবকিছুই খেয়াল করে। যে কারো ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতে পারে। আমি একদিন কথায় কথায় জিহাদকে বলেছিলাম, সারাক্ষণ তুমি সবার কথা বলো কিন্তু নিজেকে নিয়ে একদম ভাবো না। এটা ঠিক নয়। জিহাদ জবাব দিয়েছিল, পাপা আমি তো সবকিছু তোমাকে আর মাকে দেখে শিখেছি। সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা রাখা, পরিবারের সবার প্রতি খেয়াল রাখা, ভাইবোনদের খুশির জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকা, সবসময় সত্য কথা বলা, মানুষের উপকার করা। ইত্যাদি সবকিছু আমি তোমাকে আর মাকে দেখে দেখে শিখেছি। তুমি আর মা নিজেকে নিয়ে কখনো ভাবোনি বলেই আমিও নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখিনি। তাই আমি যে নিজেকে নিয়ে ভাবি না এই দোষ তোমাদের। নিজেকে নিয়ে কিভাবে ভাবতে হয় সেটা তুমি আর মা আমাকে করে দেখিয়ে দিও। ইনশাআল্লাহ তোমাদেরকে দেখে দেখে আমিও শিখে ফেলবো নিজেকে নিয়ে ভাবতে। 

ফায়েজ হাসতে হাসতে বলল, মাশাআল্লাহ। সাধে কি আর বলেছি লাইক ফাদার লাইক সান। তোর ছেলে এমন জবাব দেবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এই মূহুর্তে আমি ছেলের জবাবেও চেয়েও ছেলের মায়ের মতি গতি নিয়ে চিন্তিত। কখন না জানি আবার ব্যাগ গুছিয়ে ছুট লাগায় সেই আতঙ্কে যাচ্ছে প্রতিটা মূহুর্ত। এক ফুঁয়ে প্রদ্বীপ নিভে যাবার মতো অবস্থা দাঁড়াবে তখন বাড়ির। 

আমার মনেহয় না আজই ছুট লাগাবে। গত দুই দপ্তাহ ধরে নূহাকে দেখে মনেহচ্ছে আমাদের আগের সেই নূহা আবার ফিরে এসেছে।

তারপরও আমি ঠিক ভরসা করতে পারছি না। নিজের সদা পরিবর্তনশীল মুডের উপর বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই নূহার। কখন যে কি করবে সেটা নূহা নিজেও জানে না। তুই বরং নূহার কাছে গিয়ে ওর গতিবিধি দেখে আয়। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।

ফায়েজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাসি মুখে বলল, ঠিকআছে আমি দেখে আসছি।

@

ফজরের নামাজ সেরে রুমে আসার পর থেকেই রাহাতকে সারাক্ষণ পেছন পেছন ঘুরতে দেখে একই সাথে মজা এবং বিরক্ত দুটাই লাগছিল নূহার। কিছু কিছু ঘটনা অনুভূতির মিশ্র স্রোত হয়ে প্রবাহিত হয় মনের মাঝে। এই যেমন জাওয়াদ ফিরে আসার কারণে বাড়ির প্রতিটা সদস্যই নিজের সাথে নিজেই বৈঠকে বসে গিয়েছে। তর্ক-বিতর্ক চলছে সর্বত্রই নূহা কি করবে সেটা নিয়ে। তবে রাহাতের ব্যাপারটা ভিন্ন। রাহাত আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে সাপোর্ট দেবার নিয়্যাতে। নূহা জানে সে যদি বলে এই মূহুর্তে আমি চলে যাবো। রাহাত হাসি মুখে বলবে, ঠিকআছে তুমি গুছিয়ে নাও আমি গাড়ি বের করছি। এত ভালো মানুষটাকে আর চিন্তার সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়াতে ইচ্ছে করলো না নূহার। হাসি মুখে বলল, তুমি কি একটা তথ্য জান?

কি তথ্য? প্রশ্ন করলো রাহাত। 

সুর্যোদয়ের সাথে সাথে জীবনের প্রতিটি দিন আলোক ছটায় সিক্ত হয় না! দু’একটি দিন কিছুতেই কেন জানি তন্দ্রা ভাব কাটিয়ে আড়মোড়া ভেঙে আকাশ পানে তাকিয়ে আপন মনেই মুচকি হেসে নিজেই নিজেকে বলতে পারে না “সুপ্রভাত”! এমন দিনগুলো পায়ে কচ্ছপের জুতো পড়ে আসে! প্রতিটা সেকেন্ড জানান দিয়ে যায় এই যে আমি গেলুম! পাখীর কিচির মিচির, ফুলের সুবাস কিছুই মনকে জাগাতে পারে না! কফির মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে আদর দিলেও সতেজ ভাব আসে না! চায়ের কাপের ভেতর থেকে পাক খেয়ে উঠে আসা ধোঁয়া দেখেও আনন্দিত হয় না মন! মন হেসে ওঠে না কাছের মানুষদের মজার কথা বা কান্ডে। সর্বত্রই কেমন যেন একটা বিরক্তিকর কুয়াশা পেখম মেলে থাকে। এমন কোন দিনে বিরক্ত কন্ঠে যদি কাউকে বলা হয়, আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। জবাবে সে যদি দৃঢ় কন্ঠে বলেন, অসম্ভব! শোনো আমি তোমার সুসময়ের বন্ধু হতে চাই না। যদি আনন্দের সময় তুমি আমাকে বলো যে, চলে যাও আমার সামনে থেকে। আমি তোমার সাথে আমার আনন্দ শেয়ার করতে চাই না। আমি বিনা বাক্যে ব্যয়ে সেই মূহুর্তে প্রস্থান করবো। কিন্তু মন খারাপ করে যদি বলো, আমাকে একা থাকতে দাও। আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো তো নাই উল্টো সুপার গ্লু'র মতো লেগে যাবো তোমার সাথে। কষ্টের একটি মূহুর্তও আমি তোমাকে একা কাটাতে দেব না ইনশাআল্লাহ। তুমি জীবনকে একা একা যত ইচ্ছে উপভোগ করো। কিন্তু প্রতিটি কষ্টে তুমি আমাকে সাথে পাবে। সেটা তুমি চাও বা না চাও। মূহুর্তেই তখন জোড়া লেগে যায় মনের ভাঙা সাঁকো! ছড়িয়ে পড়া রঙগুলো একসাথ হয়ে পরিণত হয় আকাশ জোড়া রঙধনুতে! কিছু কিছু মানুষ আসলে আমাদের মনে সুবহে সাদিক নিয়ে হাজির হওয়ার ক্ষমতা রাখেন যখন তখন! তাদের শব্দরা মনের গোধূলি বেলাতেও ঘটিয়ে দেয় আশা জাগানিয়া সূর্যোদয়! এমন মানুষগুলোকেই মনেহয় বন্ধু বলে। তুমি কি জানো তুমি আমার ঠিক এমন একজন বন্ধু?   

রাহাত হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। মনেহয় জানি। কিন্তু আবারো জেনে ভালো লাগছে।

খেয়াল করে দেখলাম তুমি ঘরজামাই হয়ে খুবই আনন্দে দিনকাল কাটাচ্ছো। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আরো কিছুদিন তোমাকে বাবা-মামণির ঘরজামাই করেই রাখবো। তোমার আপত্তি নেই তো?

রাহাত হেসে ফেললে নূহাও হেসে বলল, আচ্ছা আমি যাই দেখি নাস্তার কি আয়োজন চলছে রান্নাঘরে। রুম থেকে বের হলেই দরজার সামনে মামাতো বোন জুম্মিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নূহা বলল, তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? 

তোমার আর রাহাত ভাইয়ার কথা শুনছিলাম আড়ি পেতে আপ্পা। বলতে বলতে নূহাকে জড়িয়ে ধরলো জুম্মি। 

নূহা জুম্মিকে ঠেলে সরিয়ে বলল, একদিন বলেছি না দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে। ছোটবেলার গা ঘেঁষা স্বভাবটা গেলোই না তোর।

যাবেও না। আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরবোই। কিন্তু আমি তোমার উপর অনেক রেগে আছি আপ্পা। তুমি দুই সপ্তাহ ধরে এখানে অথচ আমাকে জানাওনি। গতরাতে আব্বু স্কটল্যান্ড থেকে ফেরার পর শুনলাম।

নূহা হেসে বলল, মামীমা বললেন তোর এগজাম শুরু হবে আগামী মাসে তাই জানাইনি। কিন্তু এত ভোরে কার সাথে এসেছিস?

জুম্মি হেসে বলল, আব্বু-আম্মু দুজনই এসেছে। আব্বু নাকি স্কটল্যান্ডে গিয়ে বড় ফুপিকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। গতরাতে আবারো নাকি কি স্বপ্নে দেখেছে। ফজরের নামাজের পরই ছুটে এসেছেন ফুপির কাছে। আর আমি তোমার কাছে। আপ্পা আমি মহা বিপদে আছি। প্লিজ আমাকে হেল্প করো।

কিসের বিপদ? নায়লার মতো কোন কান্ড ঘটাসনি তো আবার?

জুম্মি হেসে বলল, তওবা তওবা তওবা। আরে না আপ্পা ওমন কিছু না। আমার যে কি হয়েছে আজকাল একদমই পড়তে ইচ্ছে করে না। জানোই তো ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ। কিন্তু বর্তমানে সেটা আমার নিজের সহ্য সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। নিজেই নিজের কর্মকান্ডে আমি নিজেই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তবুও কিছুই ঠিক করতে পারছিনা। কলেজেও যেতে ইচ্ছে করে না একদমই। এই সবকিছুর চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে ইবাদতের ক্ষেত্রেও অমনোযোগী হয়ে পড়েছি। নামাজ মনোযোগ দিতে পারিনা। কুরআন পড়া নিয়েও অলসতা করি। প্লিজ আপ্পা আমাকে উদ্ধার করো এই অধঃপতন থেকে।

নূহা হেসে বলল, আজ এমনিতেই উদ্ধার সভা আছে নাস্তার পর। বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করতে হবে। সেই সাথে নাহয় তোকেও করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। এখন চল আগে মামা-মামীমার সাথে দেখা করে আসি।

তুমি যাও দেখা করো তোমার মামা-মামীমার সাথে। আমি আত্মজা আর জুয়াইরিয়ার ঘুমের বারোটা বাজাতে যাই।

নূহা হেসে বলল, ওদের রুমে নায়লা আর সুমাইয়াও আছে।

জুম্মি হেসে বলল, তাহলে তো আরো বেশি মজা। একসাথে চারজনের ঘুম উড়াবো আজ। আল্লাহ হাফেজ আপ্পা। নাস্তার সময় দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

কথা শেষ করেই জুম্মি ছুট লাগালো। নূহাও হেসে মামা-মামীমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন