সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...শেষ পর্ব




ফজরের নামাজ সেরে জানালা খুলে জাওয়াদকে বাগানে গাছগাছালির ভিড়ে বসে থাকতে দেখে মনের অতীত স্মৃতির বাতায়ন খুলে গেলো মিসেস সুরাইয়ার জাওয়াদ আর নূহা যখন এখানে ছিল প্রায়ই তিনি আর খাদিজা বেগম মিলে হানা দিতেন ইচ্ছে মতো জাওয়াদ, নূহাকে জ্বালা যন্ত্রণা দিতেন দুই বোন মিলে দু'তিন দিন এরপর আবার ফিরে যেতেন এখানে আসার পর থেকেই সেই সব স্মৃতি একের পর এক ভেসে উঠছে মনের পর্দায় কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না কোথাও নূহাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল বার বার মনেহচ্ছিলো তার যদি এতখানিক কষ্ট হতে পারে, তাহলে নূহার না জানি কেমন লাগছে? কিন্তু গতকাল সারাটা দিনে এক মূহুর্তের জন্যও কাছে পাননি নূহাকে গতকাল থেকেই গাল ফুলিয়ে বসে আছেন ভেবেছিলেন নূহা রাতে হলেও অন্তত একবার কাছে আসবে দুষ্টুমি কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে মনের মেঘকে আনন্দময় বৃষ্টি করে ঝরাবে কিন্তু সেই আশাতেও গুঁড়েবালি পড়েছে রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে যেয়ে ফিরতে ফিরতেই রাত দুটা বেজে গিয়েছিল এরপর আর কথা বলার সুযোগ হয়নি যদিও অভিমানকে এখনো পর্যন্ত মনের মধ্যে সযতনে আগলে রেখেছেন তিনি নূহার সাথে ছোটখাট হলেও একটা ঝগড়া করার পর অভিমানের কি করা যায় সেই চিন্তা করবেন তাকিয়ে দেখলেন কুরআন তিলাওয়াত সেরে আজাদ সাহেব ঘুমোনোর আয়োজন করছেন সাধারণত কখনোই ফজরের পর ঘুমোন না কিন্তু ফজরের আগে ঘন্টা দুয়েকই সময় পেয়েছিলেন ঘুমোবার এখন খানিকটা না ঘুমোলে শরীর খারাপ করবে সেই রিক্স নিতে চাচ্ছেন না বলেই হয়তো ঘুমিয়ে নিয়ে চাচ্ছেন আরেকটু ক্ষণ কিন্তু নিজের চোখের আনাচে কানাচে কোথাও ঘুমের লেস মাত্র খুঁজে পেলেন না তাই আজাদ সাহেবের শরীরে কম্বল ঠিক করে, বাতি নিভিয়ে দিয়ে জাওয়াদের সাথে গল্প করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলেন রুম থেকে

ড্রইংরুমের দরজায় এসে সোফার এক কোণে চাদর জড়িয়ে নূহাকে বই হাতে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো মিসেস সুরাইয়ার। না ঘুমিয়ে বই নিয়ে বসেছে! অথচ মায়ের সাথে যে গতকাল থেকে কোন কথাবার্তা নেই সেটা চিন্তা থেকেই বিস্মৃত! মনের অভিমান আরো দৃঢ় হলো মিসেস সুরাইয়ার। মাঝে মাঝে মনেহয় নূহার কোন দরদই নেই তার উপর। সামনে চলে এলে মামণি মামণি না করে উপায় থাকে না, তাই তখন আহ্লাদীপনা করে। অথচ ছোটবেলায় এক মূহুর্তের জন্যও নূহাকে কোল থেকে নামাতে পারতেন না। হাঁটতে শেখার পরও সারাক্ষণ আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াতো। এই স্বভাবের কারনেই সন্তানদের অন্য আর সবার চেয়ে নূহা বেশি কাছের ছিল সবসময়ই। এমনকি জাওয়াদের সাথে বিয়ের পরেও নূহার মা ঘেঁষা স্বভাব একটুও বদলায়নি। জাওয়াদ মাঝে মাঝেই বলতো, আপনার মেয়ে যে এখনো ফিডার খেকো বেবী সেটা আগে জানানো দরকার ছিল। বিয়ের ব্যাপারে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার সুযোগ পেতাম আমি। হাসির মৃদু রেখা ফুটে উঠলো মিসেস সুরাইয়ার মুখে। জাওয়াদ, নূহা দুজনই দুষ্টু কথার সাগর। তিনি যে কত বড় ভক্ত এই ছেলে মেয়ে দুটার কথার, সেটা কেউই জানে না।

মামণি এমন করে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে? কি ভাবছো? দেখে অবশ্য বুঝতে পারছি অতীত স্মৃতির আঁকেবাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছো।

নূহার কথা শুনে খানিকটা বিরক্ত মিশানো কন্ঠে মিসেস সুরাইয়া বললেন, দেখেই তুই মনের সব অবস্থা বুঝে যাস?

নূহা হেসে বলল, মানুষের বাহ্যিক সিমটম দেখে তার মনের অবস্থা বুঝে নেয়াটাই আমার প্রফেশন মা জননী। পারসোনাল লাইফে আমি যেমনই হই না কেন, প্রফেশনালি সর্বদা অন ডিউটি থাকি।

ঘরে বাইরে সব জায়গাতেই মুখোশ লাগিয়ে ঘুরিস সেটা বললেই পারিস।

একজন মানুষের পাবলিক এন্ড প্রাইভেট লাইফ আলাদা হওয়া মানে যদি মুখোশ লাগিয়ে ঘোরা হয়। তাহলে তোমার অপবাদ শিরোধার্য

পাবলিক এন্ড প্রাইভেট লাইফ আলাদা হবে কেন?

এক হবার সুযোগ নেই সেজন্য আলাদা হবে। এই যেমন ধরো, আমি আমার মামণির সাথে ছোট থেকে ছোট বিষয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা আরগু করি। তাই বলে তো বাইরের কারো সাথে এমনটা করতে পারি না। তুমি আমার ফান বুঝবে, বাইরের কেউ তো সেটা বুঝবে। বোঝাতে পেরেছি?

চুপ করে থাক একদম। তোর কাছে আমি জ্ঞান নিতে আসিনি। সারাক্ষণ টিচার সেজে জ্ঞান দিয়ে বেড়াস মানুষকে। তারা তোর সম্পর্কে জানে না তাই তোর কথা শুনে আহ্লাদে গদগদ হয়। কিন্তু আমি খুব ভালো করে জানি কত বড় মূর্খ তুই। তোর চেহারা দেখলেই গা জ্বালা করে আমার

নূহা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে বাইরে থেকে ঘুরে এসো। শীতলাভ শিশির ঝরছে ঝুর ঝুর, তোমার গা জ্বালা করে দেবে দূর।

মেয়েকে আর কিছু না বলে বাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন মিসেস সুরাইয়া। বাগানে পৌঁছে জাওয়াদের পাশে গিয়ে বসলেন। মিসেস সুরাইয়ার থমথমে চেহারা দেখে জাওয়াদের বুঝতে সমস্যা হলো না, ভোর না হতেই মাতা-কন্যার এক রাউন্ড ঝগড়া কমপ্লিট। হাসি মুখে বলল, বুঝলে মামণি সম্পর্কের বন্ধনে মান-অভিমান হচ্ছে, পাঁচফোড়নের মত। মনের উত্তপ্তায় যার বিস্ফারণ ঘটে ভালোবাসাতে টক-মিষ্টি-ঝাল সমৃদ্ধ আচারি সুবাস ছড়িয়ে দেয়

চুপ করে যা করছিলি করতে থাক। কথা বলবি না আমার সাথে একদম। বিরক্ত কন্ঠে বললেন মিসেস সুরাইয়া।

জাওয়াদ হেসে বলল, একটুতেই রাগ করার স্বভাবটা নূহা তোমার কাছ থেকেই পেয়েছে। তোমাদের মা-মেয়ের একেবারে সর্পিণী স্বভাব। কিছু বলার আগেই ফণা তুলে ফোঁস, ফোঁস শুরু

তুই ওকে কিছু বলিস না কেন? তোর আহ্লাদ পেয়ে পেয়েই ছোটবেলা থেকে এমন স্বেচ্ছাচারী হয়েছে মেয়ে। কারো কোন একটা কথা শোনে না। নিজের যা ইচ্ছে তাই করে। রাহাতটা হয়েছে আরেক গাধা। বেয়ারা মেয়েটাকে ঠিক করার জন্য মনের মতো একটা জামাই পেলাম না। মুখ খোলার আগেই থাপ্পড় দেবার মতো একটা জামাই দরকার ছিল মেয়ের জন্য।

জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, এমন কেউ এলেও তাকে তোমার কন্যা বশ করে ফেলতো। বশীকরণ মন্ত্র পাঠে উস্তাদ বালিকা সে

কিসের বালিকা? বুড়ি বল বুড়ি। তুই একবার তাকিয়ে দেখেছিস ওর দিকে? খাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমের ঠিক নেই। নিজের প্রতি সামান্য একটু খেয়ালও রাখে না। অথচ কত আদর-যত্নে বড় করেছি আমি ওকে। অথচ সেই মেয়ের কি অবস্থা। বলতে বলতে কন্ঠ ধরে গেলো মিসেস সুরাইয়ার

কোন কারণে মামণি খুব বেশি ইমোশনাল বুঝতে পারলো জাওয়াদ। মুখে কিছু না বলে তাই হাত বাড়িয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর হাসি মুখে বলল, গতকাল থেকে বুঝি গল্পগুজব হয়নি মেয়ের সাথে?

মানুষকে জ্ঞানদান শেষ হলেই না তোদের পরিবারের সাথে সময় কাটানোর সময় হবে! এখানে এসে একা একাই বসে থাকতে হবে জানলে আমি আসতামই না মেয়ের সাথে। কত রকমের কথা বলে আমাকে সাথে আসতে বাধ্য করলো। এরপর আমার কথা বেমালুম ভুলে গেলো। তুই জানিস এখন কি করছে? বই নিয়ে বসেছে। কি পারতো না বই নিয়ে না বসে আমার কাছে যেতে?

যেহেতু গতরাতে কারোরই পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। তাই হয়তো ভেবেছিল তুমি ফজরের পর আরো কিছুক্ষণ ঘুমোবে। জানোই তো নিজের সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে কোন খেয়াল না থাকলেও, অন্যের ব্যাপারে খেয়ালের কোন কমতি নেই তোমার কন্যার।

আমিও পাগল তোর কাছে এসেছি মনের দুঃখ বলতে। তুই তো ওর হয়েই যুক্তি দিবি।

জাওয়াদ হেসে বলল, আচ্ছা দুঃখ-কষ্ট, মান-অভিমান, অভিযোগ-অনুযোগ সব বন্ধ করে চলো নাস্তা বানাতে যাই। আমারও আর বিছানায় যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। তুমিও যেহেতু ঘুমোবে না। দুজন মিলে পরিবারের সবার জন্য নাস্তা বানানোটাই উত্তম হবে। অবসর সময়ের মারাত্মক ক্ষতিকর একটি দিক হচ্ছে, অকারণ চিন্তা-ভাবনা মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। নেই কাজ তো খৈ ভাঁজ থিওরী অনুযায়ী মানুষ আর কোন কাজ না পেয়ে নানান ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা করে। ব্যস্ত মানুষদের এসব সুযোগ থাকে না। সময়ের অভাবে খাওয়ার টাইম পায় না, অন্যেরা কি করেছে, কি করেনি আর কি করা উচিত ছিল সেসব ভাববে কখন?

তুই কি বোঝাতে চাচ্ছিস আমি অলস বসে থাকি?

জাওয়াদ হেসে বলল, মোটেই তা বোঝাতে চাচ্ছি না মামণি। তোমরা যদি অলস বসে থাকতে, তাহলে কি আমরা আজ এই অবস্থানে আসতে পারতাম? আলহামদুলিল্লাহ আমরা তো তোমাদেরই নিরলস পরিশ্রমের প্রতিফল। তোমরা যে কল্যাণময় কাজ শুরু করেছিলে, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তো আমাদেরই। আমরা যদি অবহেলা করি তাহলে শুধু আমরাই না, আমাদের সন্তানরাও পিছিয়ে পড়বে। মামণি আমরা যেমন কৃতজ্ঞ চিত্তে আমাদের সন্তানদের কাছে তোমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প বলি। আমাদের সন্তানদের সামনে তেমন কিছু উদাহরণ রাখার দায়িত্ব তো আমাদেরই তাই না? তাই অনেক সময় হয়তো চাইলেও পারিনা তোমাদের সব চাওয়া পূরণ করতে। কিন্তু সেটা তোমাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসার ঘাটতি নয় মোটেও।

হয়েছে আর বলতে হবে না। তোদের এসব মিষ্টি মিষ্টি কথা যে হিপনোটিক সাজেশন সেটা এতদিনে খুব ভালো মতোই বোঝা হয়ে গিয়েছে।

হেসে ফেললো জাওয়াদ। হাসলেন মিসেস সুরাইয়াও। এরপর হাসি মুখে বললেন, মুনা সালমানকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে সেটা শুনেছিস?

হুম, শুনেছি। এই যে তুমি এত রাগ দেখালে। কিন্তু তুমিই বলো নূহা ছাড়া আর কেউ কি এত দ্রুত এই কাজটি করতে পারতো? আলহামদুলিল্লাহ, হাদিয়াও গতরাতে ডিভোর্সের ব্যাপারে ওর ফাইনাল সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এমনটা নয় যে, নূহাকে ছাড়া এসব কিছু সম্ভব হতো না। ব্যাপারটা হচ্ছে, মানুষ অনেক সময় সিদ্ধান্তের সীমানাতে দাঁড়ানো থাকে। এপাড় নাকি ওপাড় এটা বোঝার জন্য তাদের শুধু ছোট্ট একটা ঈশারায় প্রয়োজন হয়। এমন কারো কাছ থেকে যার প্রতি নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস থাকে। আসলে মানুষের মন কারো কারো মাঝে নিজের সাপোর্ট সিস্টেম খুঁজে নেয়। যখন সবকিছু এলোমেলো থাকে তখনো মানুষটির সংস্পর্শে ভীষণ রকম গোছালো সবকিছু। অবচেতনেই এমন মানুষগুলোর সঙ্গ পেতে আকুল থাকে মন। তাকে যখন পেয়ে যায় তখন আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠে। এবং অনেকদিনের জমানো কাজগুলোও মূহুর্তেই করে ফেলতে পারে। স্বভাবজাত গুণ অর্জিত গুণের মধ্যে পার্থক্য কি জানো মামণি?

কি?

স্বভাবজাত গুণসমূহের প্রয়োগ খুব সহজ। ব্যক্তি না চাইলেও স্বয়ংক্রিয় ভাবে তার চরিত্রে এই সমস্ত গুণ প্রকাশিত হয়ে যায়। কিন্তু আন্তরিক ইচ্ছে থাকার ফলেও অর্জিত গুণ প্রয়োগ করাটা অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। নূহার চরিত্রের প্রতিটি উত্তম গুণ ওর স্বভাবজাত। নূহার অর্জিত গুণ নেই বললেই চলে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ওকে অসংখ্য গুণের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। ওর হিলিং পাওয়ার, পজিটিভিটি, কনফিডেন্ট, পেশেন্স সবকিছু স্বভাবজাত। মনে করে দেখো ছোটবেলায় খেলার সময় কখনো যদি পড়ে যেতো, নূহা কিন্তু কান্না করতো না। নিজেই উঠে বসে পড়ে যাওয়া সেই স্থানটিকে বলতো, কেন আমাকে ফেলে দিলে? দেখো ব্যথা পেয়েছি। আর কাউকে ফেলে দিয়ো না। পড়ে গেলে ব্যথা লাগে বুঝেছো? কাউকে ব্যথা দিতে নেই। তাহলে কিন্তু আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন না। পাতাবাহারের ভিন্ন দুটি পাতার বিন্দুর কম-বেশিও মেনে নিতে পারতো না নূহা। অন্য পাতাটি কষ্ট পাবে ভেবে নিজেই রং-তুলি নিয়ে ছুটে যেত। এঁকে সমান করে দিতো দুই পাতার বিন্দুর সংখ্যা। সাড়ে চার বয়স ছিল নূহার। ইনজেকশন দেবার সময় যখন একটুও ভয় পেলো না। আমি ব্রেভ গার্ল বলে উৎসাহ দিয়েছিলাম। তখন আমার কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল, ভাইয়া আমি অনেক ভয় পেয়েছি তো। কান্নাও এসেছে তো। কিন্তু আমি ভয় পেলে, কান্না করলে যে বাবা কষ্ট পাবে। তাই চুপ করে ছিলাম। আমরা কেউ কিন্তু নূহাকে এসব শেখায়নি মামণি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা হয়তো ওকে এমন দরদী স্বভাবের করেই গড়েছেন।

তুই যা বোঝাতে চাইছিস আমি বুঝতে পারছি। নূহার কাজ নিয়ে তো আমার কোন অবজেকশন নেই। যত ইচ্ছে করুক সমাজসেবা। কিন্তু আমারো তো ওকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। ওর আগডুম বাগডুম কথা শুনতে ইচ্ছে করে। এবং এটার জন্যও ওর স্বভাবজাত আহ্লাদীপনাই দায়ী।

জাওয়াদ হেসে বলল, তোমাদের মাতা-কন্যার সাথে আমি কোনদিনও যুক্তিতে পারবো না। তারচেয়ে চলো যাই নাস্তা বানাই। তোমরা নিজেরাই মিটমাট করে নিও।

মিসেস সুরাইয়া হেসে বললেন, সেটাই ভালো। চল নাস্তা বানাই সবার জন্য।

@

গতকাল সারাদিন এক মূহুর্ত সময়ও মামণির সাথে কাটানো হয়নি। তাই মামণির অভিমান করে থাকাটা স্বাভাবিক। অভিমান ভাঙানোর উদ্দেশ্যে বই বন্ধ করে মামণির পেছন পেছন বের হলেও জাওয়াদকে বাগানে বসে থাকতে দেখে আবারো ভেতরে চলে এলো নূহা। জাওয়াদের কাছে যেহেতু গিয়েছে মামণির মনখারাপ, অভিমান নিয়ে টেনশনের আর কিছুই নেই। মানুষ পটানোতে ওস্তাদ ব্যক্তি জাওয়াদ। তাই নিশ্চিন্ত মনে গল্প করার জন্য বাবার রুমে উঁকি দিলো। কিন্তু বাবাকে ঘুমন্ত দেখে নিঃশব্দে আবার দরজা চাপিয়ে দিলো। রাহাতের একটাই দুর্বলতা, ঘুম। ফজরের নামাজ আদায় করে এসে রুমে ঢুকে নূহার উদ্দেশ্যে বিদায় বলে ধপাস করে বিছানাতে পড়ার আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। সেজন্যই ড্রইংরুমে এসে বসেছিল। মামণির সাথে চা খেতে খেতে গল্প করতে ইচ্ছে করছিল খুব। কিন্তু হয়তো ঘুমোবে মামণি ভেবে বিরক্ত না করে তাফসীর নিয়ে বসেছিল। একটু পরই আশার আলো হয়ে যাও মামণি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু কথা বলার আগেই ঝগড়া শুরু করলো। অবশ্য দোষ তারও হয়েছে। প্রথমেই দুষ্টুমি শুরু করা ঠিক হয়নি। মামণিকে দেখা মাত্রই উঠে টাইট একটা হাগ দেয়া উচিত ছিল। তাহলেই আর মামণির সাথে গল্প করার সুযোগটা হাতছাড়া হতো না। এইসব ভাবতে ভাবতে বাচ্চাদের রুমে উঁকি দিলো। বাচ্চাদের দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠার সাথে সাথে চোখের ভেতরও কেমন যেন জ্বালা করে উঠলো নূহার। গতরাতে রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার সেরে ফিরতে ফিরতে বেশ অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। ফজরের আগে ঘন্টা দুয়েকের মতো ঘুমের সময় পেয়েছিল বাচ্চারা। তাই ফজরের নামাজ আদায় করেই আবার পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের রাজ্যে। রুমের দুই পাশে দুটা করে মোট চারটা বেড। এক পাশে জিশান আর জারিফ নিজ নিজ বেডে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। আরেক পাশের এক বেডে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে ছিল নাবিহা। নিজের বেডের একপাশে ডায়েরী হাতে বসেছিল জিহাদ। ভাইবোনদের যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিমগ্ন হয়েছিল ডায়েরীর খোলা পাতাতে। দূর থেকে দেখতে না পেলেও নূহা বুঝতে পারছিল এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছে জিহাদ।

জীবনে নতুন প্রাণেদের আগমনের অভাবিত সুন্দর মায়ালো জড়ানো ভালোবাসার গুঞ্জন তোলা কথাটি জানার পর সেদিন থেকেই নতুন একটা ডায়েরী লেখা শুরু করেছিল। উপরে বড় বড় করে লিখেছিল "মামণির ডায়েরী" বাচ্চাদেরকে ঘিরে মনের প্রতিটি ভাবনা সেই ডায়েরীতে লিখে রাখতো নূহা। ইচ্ছে ছিল তাদের ত্রিরত্ন বড় হয়ে জানবে কতটা আকুল হয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছে ওদের জন্য পাপা-মামণি। ডায়েরী লিখতে গিয়ে নিজের সাথেই জল্পনা কল্পনার কত শত মূহুর্ত যে কাটিয়েছে। একদিন কি লিখেছে এতদিন ধরে জানার জন্য ডায়েরী প্রথম থেকে পড়ে দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই লজ্জা রাঙা হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই ডায়েরী পড়লে নির্ঘাত চোখ পাকিয়ে, আঙ্গুল নাচিয়ে বাচ্চারা প্রশ্ন করবে, সত্যি করে বলো তো মামণি এই ডায়েরী কি তুমি আমাদের জন্য লিখেছিলে নাকি পাপার জন্য?! এখানে আমাদের কথা কোথায়? সব তো দেখি তুমি পাপার কথা লিখে রেখেছো! আপন মনেই হেসেছিল বাচ্চাদের প্রশ্নের জবাব কি দেবে ভেবে! ঐদিন ঐসময়ই প্রথম নিজের ভেতরে শিহরণ জাগানো একটা কাঁপন অনুভব করেছিল। যদিও ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিল না এটি কি তার ভেতরে নতুন প্রাণগুলোর অস্তিত্ব জাগানিয়া সেই কাঁপন?! কতদিন ধরে প্রতীক্ষায় ছিল এই ক্ষণটির জন্য। যখন শুধু অনুভবেই না বাস্তবেও নিজের সর্বক্ষণিক উপস্থিতি জানান দিয়ে যাবে তার ছোট্ট ছোট্ট অংশগুলো। সত্যিই কি বাবুদের সাড়া ছিল?! যেহেতু সেদিনই প্রথম এমন অনুভব করেছে তাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। জাওয়াদকে ফোন দেবার কথা ভেবেও দেয়নি হাসবে বলে। ফোন দেয়ার আইডিয়া বাদ দিয়ে অনেকক্ষণ অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছিল আবারো সেই সুখানুভূতির দোলায় দোলায়িত হবার জন্য। কিন্তু দুষ্টু মিষ্টি ত্রিরত্ন তখন থেকেই মা' সাথে লুকোচুরি খেলতে শুরু করে দিয়েছিল।

সেদিনটিকে আরো আনন্দময় স্মরণীয় করে দেবার জন্যই মনেহয় হসপিটাল থেকে ফেরার পথে জাওয়াদ হাজির হয়েছিল রঙবেরঙে পেইন্ট নিয়ে। পুরো বাসার চেহারাই বদলে গিয়েছিল এরপর। দুজন মিলে লেগে গিয়েছিল ঘরের দেয়ালে যেমন খুশি তেমন রঙ করো প্রতিযোগিতায়। দুজন শখের চিত্রশিল্পী তাদের ছোট্ট দুনিয়াকে মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙের ছটায় সাজাতে চাইলে যা হয় আরকি! কোথাও গাছের ডালে ডালে চকলেট, আইস্ক্রিম ঝুলছে, তো কোথাও জমিনের বুকে বসেছে হাজারো তারার মেলা। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসছে ফুলের বন্যা, অন্যদিকে ফুল বাগিচা হয়েছে টইটুম্বুর বইতে। তবে লিভংরুমের একপাশের পুরো দেয়াল জুড়ে জাওয়াদ এঁকেছিল সবুজের বিভিন্ন সেডে আঁকা বাঁশঝাড় আর তার ফাঁকেফাঁকে আকাশ গলে নেমে আসা জোছনার ফোয়ারা! একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে জাওয়াদের আঁকা এই দৃশ্যটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল নূহা। অবশ্য নূহাকে মুদ্ধ করে দেবার উদ্দেশ্যেই সারারাত জেগে চিত্রটি এঁকেছিল জাওয়াদ। হাসি মুখে বলেছিল, মানুষ যতবেশি প্রকৃতির সান্নিধ্য থাকে তত বেশি উদার এবং চিন্তাশীল হয়। মন সতেজ প্রফুল্ল থাকে। সুন্দর সুন্দর ভাবনা মনে এসে জড়ো হয়। জীবনকে অনুধাবন, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ গ্রহণের যোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। রোদ-বৃষ্টি-ঠান্ডা কোনকিছুই যাতে আপনাদেরকে প্রকৃতি থেকে দূরে রাখতে না পারে সেজন্য ঘরের ভিতরেই এক টুকরো প্রকৃতি অংকিত করে দেয়া হলো। তবে অন্যান্য সব জায়গায় মনে যা এসেছে দুজন মিলে তাই আকঁলেও বাচ্চাদের রুমকে ঘিরে অনেক শলা পরামর্শ করে তবেই মাঠে নেমেছিল। রুমের পুরো ছাদটিকে এক টুকরো নীলাকাশে রুপান্তরিত করেছিল জাওয়াদ। কোথাও গাঢ় নীল, কোথাও হালকা, কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে নীলাকাশের বুকে সাদা মেঘ। কোথাও পপকর্ণের মত ফুটে রয়েছে থোকা থোকা মেঘগুচ্ছ। এক পাশে হাজার তারার ভিড়ে চন্দ্রিমা বাসন্তী আলো ছড়াচ্ছে রাতের আকাশের রিপ্রেজেন্টিভ হিসেবে। পুঞ্জিভূত মেঘমালা থেকে ঝরে পড়ছে অঝর বরষা। মহাকাশও আকঁতে চেয়েছিল জাওয়াদ। কিন্তু নূহা আপত্তি করেছিল। আগে জীবনের পূর্ণতাগুলোকে উপভোগ করানোর ইচ্ছে ছিল সন্তানদেরকে। শূন্যতা জীবনই নিয়ে হাজির হয়ে যাবে নানা রুপে। তখন গ্রহণ উপভোগ করতেও শিখে যাবে ইনশাআল্লাহ। রুমের চারপাশের দেয়ালের একপাশ জুড়ে দুজন এঁকেছিল সমুদ্রের নীচের বর্ণিল জগতের প্রতিচ্ছবি। আরেকপাশে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া বাগিচা। অন্যপাশে ভীষণ সবুজারন্য। আর বাকি পাশ জুড়ে এঁকেছে থরে থরে সাজানো বইয়ের ছবি। ঠিক মধ্যেখানে বিশাল একটা উন্মুক্ত জানালা। যে জানালার দিকে তাকালেই মনেহয় হাতছানির ঈশারায় কেউ দিচ্ছে জ্ঞানোরাজ্যে নিমন্ত্রণ

আলতো করে রুমের দরজার চাপিয়ে দিয়ে পেছনের বাগানে নেমে এলো নূহা। গল্পের পার্টনার হিসেবে জিহাদ অসাধারণ। কিন্তু কখনো কখনো বিশেষ কিছু সময়ে ব্যক্তির চেয়েও তার প্রতিচ্ছায়া বেশি আরাধ্য হয়ে ওঠে। এই মূহুর্তে জিহাদকে তাই মামণির সঙ্গের চেয়ে মামণির ডায়েরীর সাথে থাকতে দেয়াটাই উত্তম মনেহয়েছে। কুয়াশার শিশির সিক্ত প্রকৃতিকেই নিজের সঙ্গী করে নিলো নূহা। সিঁড়িতে বসে আকাশ পানে তাকালো। সূর্যোদয় হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। যদিও মেঘলা আবহাওয়ার কারণে চারপাশ আঁধারে ঢাকা। মনের ইচ্ছে ডানা উড়াল দিলো বহু বছর আগের এমনই এক মেঘলা সুবহে সাদিকে। ফজরের সালাত আদায় করে ঠিক এমনি সূর্যোদয়ের সন্ধানে ছুটে গিয়েছিল ছাদে। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলার সুযোগে সংগোপনে থেকেই সূর্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছিল আলোর ফোয়ারা। সূর্যোদয় দেখার সাথী হিসেবে সেদিন জাওয়াদ পাশে ছিলেন। যখন মনখারাপের সুরে বলেছিল, ধূর মেঘের কারণে সূর্যোদয় দেখা হলো না। জাওয়াদ হাসি মুখে বলেছিলেন, “তাতে কি চমৎকার একটি শিক্ষা তো অর্জিত হলো আজ। দেখো চোখের আড়ালে থেকেও দুনিয়াকে আলোকিত করার কি অদ্ভুত ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূর্যকে দিয়েছেন! আমার কি মনেহয় জানো এমন ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা প্রতিটি মানুষকেও দিয়েছেন। মানুষ চাইলে চুপটি করে বসে থেকেও কারো জীবনে নিয়ে আসতে পারে সুহাসিনী ভোর!উপস্থিতির চেয়েও অস্তিত্ব জানান দিয়ে যেতে পারাটাকেই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মনেহয় আমার কাছে। পাশে থাকার চাইতে বোধহয় সর্বাবস্থায় সাথে থাকাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মানুষ জীবন থেকে চলে গিয়েও যেমন জুড়ে থাকে মনের অনেকটা জায়গা। তেমনি বহুদূরে থেকেও কেউ কেউ পালন করে যায় নিজের যাবতীয় করণীয় নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালনে তারা সূর্যের মতো। প্রতিকূল আবহাওয়া তাদের কাজের গতিকে ব্যহত করে ঠিকই কিন্তু নিজ কর্মের ব্যাপারে তারা থাকে দৃঢ়প্রত্যয়, অটল অপ্রতিরোধ্য জাওয়াদ থামা মাত্রই নূহা দুষ্টুমির স্বরে বলেছিল, ‘মেঘে ঢাকা সূর্য হয়েই থেকো সর্বক্ষণ, তবুও জানান দিয়ে যেয়ো অস্তিত্ব প্রতিক্ষণ মূহুর্তে হয়তো অচিন্তনীয় ছিল, দুষ্টুমির ছলের এই চাওয়াটাই জীবনের বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়। জাওয়াদ মেঘে ঢাকা সূর্যের মতোই তো নূহার জীবনে!

সূর্যোদয়ের হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো নূহার চেহারা। হঠাৎ তারও খুব মেঘে ঢাকা সূর্য মানুষ হতে ইচ্ছে করলো। ইনশাআল্লাহ সবার তরেই চলার পথের কাঁটাগুলো মাড়িয়ে, পথে পথে যাবে ফুল ছড়িয়ে! ঝরে পড়া স্বপ্নগুলোকে, আবারো চিন্তা মননে দেবে সাজিয়ে! হতাশার ভাটাকে, আশার জোয়ারে যাবে ভাসিয়ে! শুষ্কহৃদয়ের ভূমি, অঝর শ্রাবণ হয়ে দেবে ভিজিয়ে! নব প্রারম্ভের, আলোকচ্ছটা দু'হাতে যাবে বিলিয়ে! তবে পিনপতনহীন নিস্তব্ধতায়......


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন