মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...১৪



মন যখন কোন কিছু মেনে নিতে নারাজ থাকে, তখন তার পেছনে নানান ধরণের যুক্তি দাঁড় করিয়ে নেয়। এবং সেই যুক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলে তার সুপ্ত ইচ্ছের প্রাসাদ। মিসেস আলিফাও যে মনের মধ্যে এমনই এক প্রাসাদ গড়ে বসে আছেন সেটা অজানা ছিল না জাওয়াদের। সাথে সাথে জানা ছিল তাঁর দুঃসহ সেই অতীতের প্রতিটি ছোট থেকে ছোট ঘটনাও। তাই ব্রোকেন ফ্যামেলির কোন মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে কেন প্রস্তুত নন মিসেস আলিফা সেটাও বুঝতে পারছিল। ঠিক তেমনি এটাও বুঝতে পারছিল যে, তাঁর মনের ভয়টা যে শুধুই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা প্রসূত ধারণা বৈ কিছুই নয়। কিন্তু সেটা বোঝাতে গেলে হয়তো এমন অনেক কথাই বলতে হবে যা মিসেস আলিফার মনের কষ্টগুলোকে আবারো তাজা করে দিয়ে যাবে। কাছের মানুষ হোক কিংবা দূরের কাউকেই কখনো কষ্ট দিতে চায় না জাওয়াদ। আর বিশেষ কিছু মানুষ আছেন যাদেরকে শুধু কষ্ট দেয়া থেকেই নয়, কষ্ট পাওয়া থেকেও আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করে। মিসেস আলিফা সেই মানুষদেরই একজন। যাদের কষ্ট জাওয়াদের কাছে নিজের কষ্টের চেয়েও অসহনীয় লাগে। কিন্তু একই সাথে প্রিয়জনদের কাউকে কোন ভুল ধারণা লালন করতে দেয়ার পক্ষপাতীও নয় সে।

অন্যকোন দিন হলে জাওয়াদকে দেখামাত্রই আনন্দে শোরগোল বাঁধিয়ে দিতেন এতক্ষণে মিসেস আলিফা। কিন্তু আজ সুহাইব সাহেবের ডাক শুনে বারান্দায় এসে জাওয়াদকে দেখে কেমন যেন থমকে গিয়েছেন। সুহাইব সাহেবের সাথে যখন তার বিয়ে হয়েছিল মাত্র পনেরো বছর বয়স ছিল। শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ, মানুষজন, জীবনযাত্রা সবকিছুর সাথেই ভীষণ রকম অপরিচিত ছিলেন। নিজেকে খুব বেশি অসহায় লাগতো। কি করবেন আর কি করা উচিত কিছুই বুঝে উঠে পারতেন না। ঐ সময় বন্ধুর মত তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল জাওয়াদ, আদী, ফায়েজ, রিসাব, হুমায়ূন আর সুবহা। বয়সে ওরা সবাই পাঁচ-ছয় বছরের ছোট থাকলেও, জীবনে প্রথম বন্ধুত্বের স্বাদ ওদের দ্বারাই আস্বাদন করেছিলেন। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত ওরা ছয়জনই মিসেস আলিফার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাথী। তাই ওদের মধ্যে থেকে কেউ তাকে বোঝার বদলে উল্টো বোঝাতে আসবে এটা মেনে নেয়াটা বেশ কষ্টের। তাই কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলেন।

মামীমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বেশ কিছুক্ষণ জাওয়াদও চুপচাপ বসে রইলো। এরপর ধীরে ধীরে বলল, মনের মধ্যে অতীতের কোন নেতিবাচক স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখা। এবং সেটার উপর ভিত্তি করে বর্তমান সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা যে কোন মানুষের জন্যই ভীষণ ক্ষতিকর। কারণ মানুষের জীবনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আসে সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য। সেই শিক্ষাকে খুঁটি বানিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য নয়। অপর পক্ষে মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার চলার পথকে সুগম করার জন্য, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার জন্য নয়। মানছি তোমার খুবই কষ্টকর একটি অতীত আছে। খুবই বেদনাদায়ক কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতাকে মনে ধরে রাখতে চাইলে সমস্যা নেই। কিন্তু হুবহু সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কোন কিছু বিবেচনা করাটা অবশ্যই দোষের পর্যায়ে পরে। কারণ কারো দেয়া নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে তুমি অন্য কারো উপর চাপিয়ে দিতে পারো না। তবে হ্যা সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার-বিবেচনা-বিশ্লেষণ অবশ্যই করতে পারো। কিন্তু অতীতে একটি ব্রোকেন ফ্যামেলির মেয়ে তোমাদের পরিবারকে ভেঙে দিয়েছিল বলে তো তুমি সমস্ত ব্রোকেন ফ্যামেলির মেয়েকে সেই একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইলে, সেটা তো ভুল হবে তাই না? আর সবচেয়ে জরুরি কথা হচ্ছে, ভাঙা হোক কিংবা গড়া কোন কিছুই একা করা সম্ভব নয় কারো পক্ষে। সেই ব্রোকেন ফ্যামেলির মেয়েটা তোমাদের পরিবার ভাঙতে পেরেছিল কারণ তোমার বাবা তাকে পূর্ণ সহায়তা করেছিল। আমিও একজন পিতা তাই সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা আকুলতাকে খুব ভালো মত উপলব্ধি করতে পারি। আমার কাছে তো পুরো দুনিয়া একদিকে আর আমার সন্তানদের খুশি একদিকে। ওদের মুখের হাসি দেখার জন্য নিজ সাধ্যের মধ্যে থাকা সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে আমি সদা প্রস্তুত থাকি। নিজের আত্মতৃপ্তি বা আত্মসুখের জন্য ওদেরকে কষ্ট দেবার কথা চিন্তা করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি নিজেও একজন মা তাই সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দরদ বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। তুমি নিজেই ভেবে দেখো নিজ সন্তানদের প্রতি কি সেই দরদ ও ভালোবাসা ছিল তোমাদের বাবার? উনি কি উনার পিতা-মাতার জন্য একজন আদর্শ সন্তান ছিলেন? আমি নিশ্চিত অবশ্যই তিনি একজন উত্তম পিতা কিংবা সন্তান ছিলেন না। মানুষ হিসেবেও হয়তো উত্তম ছিলেন না। কেননা উনি যদি উত্তম মানুষ হতেন তাহলে নতুন সংসার ও পুরোন সংসারের মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন। দেয়াল না তুলে সেতু নির্মাণের চেষ্টা করতেন। এতে যদি বিফল হতেন তাহলে আলাদা হবার পরও দূর থেকেই তোমাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু উনি এর কিছুই করেননি। এর কারণ হিসেবে আবেগের বশে তুমি উনার নতুন স্ত্রীকে দায়ী করতে পারো। কিন্তু আমি এমনটা করবো না। শুধু আমি কেন, কোন বিবেচক মানুষই এমনটা করবে না। তোমাদের সংসার ভেঙেছে কারণ তোমার বাবা সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। তোমাদেরকে কন্টকাকীর্ণ পথে চলতে হয়েছে, কারণ তোমাদের বাবা সেটা চেয়েছেন। এখানে উনার দ্বিতীয় স্ত্রীর ভূমিকা খুবই গৌণ।

মিসেস আলিফা কোন রকমের বাঁধা দেবার চেষ্টা না করে চুপচাপ বসে জাওয়াদের কথা শুনছিলেন। কিন্তু জাওয়াদের শেষের কথাগুলো শুনে চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। স্ত্রী চোখে কষ্টের অশ্রু দেখে সুহাইব সাহেবের ভেতরটাও দুর্বল হয়ে উঠলো। অসহায় চোখে জাওয়াদের দিকে তাকালেন তিনি।

মামীমাকে কান্না করতে দেখে থমকে গিয়েছিল জাওয়াদও। একটুক্ষণ সময় নিয়ে কন্ঠে কোমলতার  মাত্রা বাড়িয়ে বলল, আমি দুঃখিত মামীমা এত কঠিন ভাবে এসব কথা বলার জন্য। কিন্তু এছাড়া আসলে তোমাকে বোঝানো যেত না। মামীমা দুনিয়ার এই জীবনটাকে আমরা পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে পেয়েছি। তাই দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-বেদনা-ব্যর্থতা-গ্লানি থাকবেই জীবন সফরের মোড়ে মোড়ে। কিন্তু তার অর্থ মোটেই এটা নয় যে, আমাদেরকে ব্যথায় ডুবে থাকতে হবে কিংবা আহাজারি করতে হবে জীবনভর। খুব যাতনাকর কিছু জীবনে ঘটতেই পারে। তাই বলে কেন সেই যাতনাকে আরাধ্য কিছুই মতো মনের মাঝে আগলে রাখতে যাবো আমরা? আমার কি মনেহয় জানো? নিজের নেতিবাচক কোন অভিজ্ঞতাকে ইতিবাচকতায় রুপান্তরিত করার প্রতিটি সম্ভাবনাতে সেচ দিয়ে দেখা উচিত। কেননা আল্লাহ চাইলে হয়তো মিলেও যেতে পারে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারাবাস থেকে মুক্তি। যেহেতু চিরমুক্তির সুযোগ আছে, তাহলে কেন নিজ ইচ্ছেয় আজীবন কারাবাস বেছে নিতে যাবে? তাই অতীতের কোন অভিজ্ঞতার দ্বারা তোমার বর্তমান সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত হতে দিও না। নিজেকে বন্দী করে রেখো না অতীতের কারাগারে। বন্দী থাকতে থাকতে মন একসময় সংকীর্ণ ও অনুদার হয়ে পড়ে। আর সংকীর্ণ ও অনুদার মন নিয়ে কখনোই প্রকৃত অর্থে মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। অথচ আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য তো এটাই তাই না? চলার পথের প্রতিকূলতা সমূহকে দূর করে একজন আদর্শ মুসলিম হিসেবে দুনিয়া ও আখিরাতে নিজেদের জন্য কল্ল্যা প্রতিষ্ঠা করা। আমি কি তোমাকে বোঝাতে পেরেছি আমার কথা?

হ্যা জাওয়াদ আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। একটি ঘটনা বা একজন মানুষের দ্বারা সবাইকে বিবেচনা করাটা যে ভুল সেটা আমিও জানি। কিন্তু ব্রোকেন ফ্যামিলি শুনলেই চোখের সামনে অতীতের সেই ভয়ংকর কষ্টের দিনগুলো ভেসে ওঠে। নিজেকে তখন আর সামলাতে পারিনা। অনেককিছু বুঝেও মেনে নিতে পারি না।

আসলে মামীমা অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এটা যেমন ঠিক। তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতীতকে উপেক্ষা করাটাও খুব জরুরি। অতীতকে উপেক্ষা করার সবচেয়ে বড় সুবিধা বা উপকার হচ্ছে, অকারণ দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, অস্থিরতায় ভোগার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমনতা হ্রাস পেয়ে, দৃঢ়তা ও আশাবাদীতা বৃদ্ধি পায়। জীবনযাপন অনেক বেশি সহজ ও সুন্দর হয়ে যায়। আগত সমস্যায় মন ঘাবড়ে না গিয়ে বরং মোকাবিলা করার চেষ্টা করে। ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে বসে না গিয়ে শিক্ষা খুঁজে নিতে পারে। ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজের বা অন্যের উপর অবিচার করার ভয়ও থাকে না। মোটকথা, বর্তমানের প্রতিটি মূহুর্তকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। আমরা অতীতের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে খেতে বর্তমানকে কাজে লাগাতে পারি না বিধায়ই সম্মুখ পানে তাকালে শুরু আঁধার আর আঁধারই দেখতে পাই। এবং ভবিষ্যৎ এর সেই আঁধারের কারণ হিসেবে অতীতকে দায়ী করার পছনে এমন ভাবে লেগে থাকি যে, খেয়ালই করি না সময় যে বয়ে যাচ্ছে। যে সময়টাকে কাজে লাগাতে পারলে হয়তো সম্মুখের ঐ আঁধারের বুকে ছোট্ট একটা দিয়া জ্বালানো সম্ভব হতো।

আমি বুঝতে পেরেছি জাওয়াদ। এখন আমাকে কি করতে হবে সেটা বলে দাও।

প্রথমেই আমি অনুরোধ করবো প্লিজ বেড়িয়ে এসো অতীত অভিজ্ঞতার কারাগার থেকে। ইতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোতে আলোকিত হবার সুযোগ দাও তোমার নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে। মনের ব্যথাতুর কোণে আশার কিরণ প্রবেশ করতে দাও। ইতিহাসের পুরনাবৃত্তি সূচক কিছু না করে বরং একটি ব্রোকেন ফ্যামেলির মেয়েকে পরিবার নামক সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় পেতে দাও। ঐ মেয়েটি হয়তো কখনোই বাবা-মায়ের প্রকৃত আদর-ভালোবাসা পায়নি। আদর ভালোবাসার ক্ষমতা তাই হয়তো ওর জানা নেই। ওকে সত্যিকার ভালোবাসার সাথে পরিচয় হবার সুযোগ করে দাও। ওকে বুঝতে দাও পারিবারিক বন্ধন মূলত কেমন হয়। তবে এই সবকিছুর আগে তোমার বাবার সেই দ্বিতীয় স্ত্রীকে ক্ষমা করে দাও একদম মনের গভীর থেকে। জানো নিশ্চয়ই ক্ষমা অনেকটা বুমেরাং এর মতো। অর্থাৎ, করা হয় অন্যকে কিন্তু এরফলে ব্যক্তির মনেই ফিরে আসে স্বস্থি। ক্ষমা মনের উপর জমে থাকা রাগ, ঘৃণা, অহং, হিংসা-প্রতিহিংসা ইত্যাদিতে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, মনটাকে পুনরায় ঝকঝকে তকতকে করে দেয়। এজন্যই ক্ষমাকে স্পিচুয়াল বাথের সাথে তুলনা করা হয়। যারা ক্ষমা করতে পারে তারা শুধু যে আল্লাহর কাছেই উত্তম প্রতিদান পায় তাই নয়, তাদের মনের রাজ্যে প্রশান্তির বাতায়ন উন্মুক্ত হয়ে যায়। তারা নিজেরা যেমন ভালো থাকে, অন্যদেরকেও ভালো থাকার সুযোগ করে দিতে পারে।

মিসেস আলিফা বলল, ইনশাআল্লাহ আমি তাই করবো। মনের উপর যে কষ্টের বোঝা চেপে বসেছে, সেটাকে আর বয়ে বেড়াতে চাই না আমি। তিক্ত অভিজ্ঞতাকে লালন করে আমার মনটাকে তিক্ত ও বিষাক্ত করতে চাই না। সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে মনে প্রশান্তির বাতায়ন উন্মুক্ত করতে চাই। বের করে দিতে চাই এত বছর ধরে আটকা পরে থাকা দূষিত বাতাস। বুক ভরে টেনে নিতে চাই বিশুদ্ধ ও সুবাসিত অক্সিজেন।


জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আমাদের সবারই খেয়াল রাখা উচিত। সেটা হচ্ছে, শুধুমাত্র নিজেদের অভিজ্ঞতা বা ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা যাতে কখনোই কারো ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না নেই। আমাদের ধারণা যাতে কারো সম্ভাবনার পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। নিজেদের কষ্টকে মূল্য দিতে যেয়ে আমরা যেন অন্য কারো কষ্টের কারণ হয়ে না যাই। একজন মানুষকে দিয়ে অন্যান্য সব মানুষকে বিবেচনা করার মতো বোকামী আর হতেই পারে না। হ্যা এটা ঠিক যে, কারো দ্বারা যখন আমরা আঘাতপ্রাপ্ত হই কিংবা আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। তখন পরবর্তীতে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে আমাদের ভালো হবার সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে ক্ষতি করতে না পারে, আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে না পারে। কিন্তু এমনটা ভাবার কোনই অবকাশ নেই যে, দুনিয়াতে কোন ভালো মানুষ নেই, বিশ্বাসযোগ্য মানুষ নেই। মামীমা দুনিয়াতে খারাপ মানুষ যেমন আছে, ভালো মানুষও আছে। এখন খারাপ মানুষদের ভয়ে ভালো মানুষেরা যদি মনের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে, কিংবা খারাপ ভেবে আন্দাজেই কাউকে শাস্তি দেয়। তাহলে তো দুনিয়াতে থেকে ধীরে ধীরে সমস্ত ভালো মানুষ হারিয়ে যাবে। খারাপ মানুষে ছেয়ে যাবে আমাদের চারপাশ। নিজেদেরকে তো সারাক্ষণ বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারবো না আমরা। তাই শুধু নিজেরা ভালো থাকলেই চলবে না, অন্তত পক্ষে নিজ নিজ গণ্ডির মানুষদেরকে ভালো হবার সুযোগ দিতে হবে। আর সেজন্য অতীতে কারো দেয়া কষ্টের বোঝা বর্তমানে কারো কাঁধে চাপিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলেই কেবল বোঝা বিহীন একটা ভবিষ্যতের আশা করতে পারবো আমরা ইনশাআল্লাহ।

জাওয়াদ তোমার কথা শুনেই আমার অনেক হালকা লাগছে নিজেকে। এখন আমি সত্যিই বুঝতে পেরেছি পুরো বিষয়টা। ইনশাআল্লাহ আমি তোমার পরামর্শ মোতাবেগ কাজ করার চেষ্টা করবো।
জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে এখন আমি উঠি। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।

সুহাইব সাহেব বললেন, রাত পনে দুটা বাজে। এখন তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না আমরা। তাছাড়া তোমার কলিজার টুকরোরা সব এখানেই। সুতরাং, বাড়িতে ফেরার তাড়া থাকারও কথা না। তাই আজ তুমি এখানেই থাকছো। আগামীকাল সকালে তোমাকে নিজ হাতে মুগ ডাল দিয়ে খাসির মাথা আর ছিটা রুটি বানিয়ে খাওয়াবো আমি।

মিসেস আলিফাকে হাত মুখ চেপে ধরে হাসতে দেখে জাওয়াদও হেসে ফেললো। তবে বাড়িতে চলে যাবার জন্য জেদ করলো না অন্যান্য দিনের মতো। খুশি মনেই মেনে নিলো মামার প্রস্তাব। বাচ্চারা বাড়িতে না থাকলে সত্যিই ভীষণ কষ্ট হয় জাওয়াদের। তাই যখনই বাচ্চারা নূহার কাছে আসে, সেই রাতগুলো হসপিটালেই কাটায়। মামার বাসা থেকে বেরিয়ে হসপিটালে যাবার কথাই ভাবছিল। তারচেয়ে এখানে থেকে যাওয়ায় আরেকটা কারণ হচ্ছে, সে নীচে আছে জানতে পারলে আর কেউ না এলেও জিশান ঠিকই চলে আসবে পাপার সাথে দুষ্টুমি করতে। মামা-মামীমার সাথে কথা বলার ফাঁকে বাচ্চাদের ম্যাসেজ করে তার থেকে যাবার খবর জানিয়ে দিলো জাওয়াদ। এরপর আরো কিছুক্ষণ গল্প করে মামা-মামীমাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে নিজেও ঘুমোতে গেলো।

@

বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করছিল নাবিহা। কিন্তু মামণিকে বলার জন্য জমিয়ে রাখা ঘটনাগুলো চোখের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো বলে হয়তো ঘুম এসে জায়গা করে নিতে পারছিল না চোখে। কিন্তু এই কথা তার নানুমণিকে কে বোঝাবে? জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। সাথে আবার আদেশও জারি করে, টুঁ শব্দ শুনতে চাই না কারো মুখ থেকে। কম্বলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে মনের দুঃখের কথা পাপাকে ম্যাসেজ করে করলো নাবিহা। প্রায় সাথে সাথেই পাপার রিপ্লাই এলো, তোমার নানুমণি মুখ থেকে টু শব্দ শুনতে চান না বলেছেন। কথা শুনতে চান না সেটা তো বলেননি। তুমি তোমার মামণিকে ডেকে নিশ্চিন্তে কথা বলো। কিন্তু খেয়াল রেখো তোমাদের মুখ থেকে যেন কোন মতেই টুঁ শব্দ বের না হয়। পাপার রিপ্লাই দেখে বহু কষ্টে হাসি চেপেছে নাবিহা। সাথে সাথে মনেহলো তাই তো এই বুদ্ধিটা তার মাথা থেকে কেন বের হলো না। নাহ! পাপার মতো জিনিয়াস হবার জন্য এখনো তাকে আরো অনেক জ্ঞানার্জন করতে হবে। পাপাকে লাভ ইউ ম্যাসেজ পাঠিয়ে নাবিহা ফিসফিস করে বলল, মামণি একটুও ঘুম আসছে না।

নূহাও ফিসফিস করে বলল, আমারো না। কিন্তু তোমার নানুমণি গভীর ঘুমে মগ্ন। চলো আমরা দুজন আস্তে আস্তে বারান্দায় চলে যাই। তুমি আগে যাও। এরপর আমি আসছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাবিহা আর নূহা বারান্দায় এসে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে মুক্তির হাসি হাসলো। নাবিহা আনন্দিত কন্ঠে বলল, মামণির মামণিকে ফাঁকি দেয়া ফাটাফাটি মজা। আচ্ছা মামণি মামণিকে ফাঁকি দিতে কেমন লাগে।

নূহা হেসে বলল, আরো বেশি ফাটাফাটি লাগে। বাট ইউ ডোন্ট টু ডেয়ার ট্রাই উইথ মি।

নাবিহা কিছু না বলে মনের আনন্দে কিছুক্ষণ হাসলো। এরপর বলল, মামণি গল্প শুনবে?

তা অবশ্য শোনা যায়। বলো।

নাবিহা বেশ গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বলল, আচ্ছা তাহলে শোনো। ছোট্ট এক আনন্দময়ী বালিকার গল্প। একথা তো সবারই জানা কারো মনের প্রিয় স্থানটি সাধারণত যেচে পড়ে সে কাউকে দেয় না। বরং কেউ সঙ্গোপনে, আপনও মহিমায় অর্জন করে নেয় জীবনে প্রিয়র অবস্থান। কি করে কারো মনের প্রিয় স্থানটিকে নিজের করে নিতে হয় সেই বালিকাটি সেই শিক্ষাই দিয়ে যেত কথা ও কাজের মাধ্যমে। সদা হাস্যময়ী সেই বালিকা নিজের সাথে সাথে আরো বহু মনকুটিরের সম্রাজ্ঞী ছিল। তার কাছে যখন সর্বক্ষণ আনন্দে থাকার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল। হাসির ফুলঝুরি ছড়িয়ে বলেছিল, আরে এত খুবই সহজ। চোখ বন্ধ করে তোমার মনের গহীনে তাকাও। দেখো বিশাল এক পর্বত দন্ডায়মান মাথা উঁচু করে। ওটা নীতির পর্বত। ভালো করে তাকিয়ে দেখো নীতির পর্বতের বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ভালোবাসার ঝর্ণাধারা। পাহাড়ের কোল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পানিরাশি একদম নদীতে গিয়ে মিশেছে। কূলকূল ধ্বনি তুলে ত্যাগের নদী ছুটে যাচ্ছি সাগর পানে। একাকার হয়ে যাচ্ছে বিশালতা, উদারতা ও গভীরতার সাথে। বুঝেছো তো কত সহজ আনন্দে থাকা? আচ্ছা আরেকটু সহজ করেই নাহয় বুঝিয়ে বলছি তোমাকে। সর্বক্ষণ আনন্দে থাকতে চাইলে তোমাকে নীতিতে অটল থেকেও ঝরতে হবে ভালোবাসার ঝর্ণাধারা হয়ে। অতঃপর প্রবাহিত ত্যাগের নদীর মতন মিশে যেতে হবে বিশাল গভীরত্বে। ও হ্যা আগে বলে নেই বালিকার কাছে আনন্দে থাকার সংজ্ঞা জানতে চেয়েছিল পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের সাথে আবার বালিকার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। প্রতি পুর্ণিমার রাতের মতো সে রাতেও আনন্দময়ী বালিকা তার ছোট্ট কুটির ছেড়ে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে এসেছিল। ভরা পূর্ণিমার রাত ছিল তাই আকাশ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে নেমে আসছিল জোছনা। সেই আলো আয়না হয়ে আঁকতে বসেছিল আনন্দময়ী বালিকাটির প্রতিচ্ছবি। অনেকদিন থেকেই মনে মনে এই দূরভীসন্ধিটি লালন করছিল চাঁদ। এমনি করে তার আলোর ঝর্ণাধারায় আনন্দময়ী বালিকার গোপন সব স্বপ্নকে মনের গহীন থেকে বাইরে বের করে আনবে। মুক্ত করে দেবে অন্তরে লুকায়িত সমস্ত বর্ণিল আবেগকে। তারায় তারায় সাজিয়ে দেবে বালিকার সেই সব ভাবনাগুলোকে যার মূর্ছনায় সে হয়ে ওঠে উদ্বেলিত, উচ্ছাসিত, কখনো লিখে কবিতা, কখনো বা তুলে যায় সুর মনবেহালায়। কেমন করে চিরচেনা এই বালিকাটি মূহুর্তেই অচেনা, অজানা, অদেখা কেউতে রুপান্তরিত হয় সেই রহস্য উন্মোচন করবে চাঁদ। গভীতম সমুদ্রের তলদেশে ঝিনুকের খোলসের আড়ালে সবার অলক্ষ্যে চুপটি করে বসে থাকা বালিকাটিকে নিয়ে আসবে সন্মুখে। কল্পনা যেমন ভাসাতে পারে মেঘের কোল ছুঁয়ে, উড়াতে পারে পাখী হয়ে। আনন্দময়ীও তেমন মনের মাঝে আনন্দের ডানা লাগিয়ে দিয়ে ভাসাতে পারে আকাশে, উড়তে পারে মেঘের কোল ছুঁয়ে। মৌমাছি যেই নিপুণতায় ফুলের বুক থেকে মধু শুষে নেয়, তেমনি দক্ষতায় বালিকা মনের দুশ্চিন্তাগুলোকে বাতাসে মিলিয়ে দেয়।

নাবিহা থেমে গেলে নূহা বলল, তারপর?

নাবিহা হেসে বলল, গল্পের এই পর্যায়ে পাপার ফোন এসেছিল। আর পাপা গল্প শেষ না করে আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর শোনার জন্য আমাদের মতো তাই তোমাদেরকে অপেক্ষা করতে করতে হবে মামণি।

নূহা হেসে বলল, অনেক বেশি দুষ্টু হয়েছো তুমি। অর্ধেক গল্প কেন শোনালে আমাকে? তুমি জানো অর্ধেক কিছু শুনলে কত অস্থির লাগে আমার?

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, সেজন্যই তো শুনিয়েছি। এখন পাপাকে বলতে পারবো গল্পের পরের অংশ শোনার জন্য মামণি অস্থির হয়ে আছে। তাহলে পাপা আমাদেরকে ফাঁকি না দিয়ে তাড়াতাড়ি গল্পের পরের অংশ শোনাবে। তখন আমিও তোমাকে শোনাবো।

কিছু বলতে যাচ্ছিলো নূহা কিন্তু গেট খোলার শব্দ শুনে বলল, এত রাতে বাইরে যাচ্ছে কে?

নূহা উঠতে গেলে নাবিহা হাত টেনে ধরে হাসতে হাসতে বলল, জিশান পাপার কাছে যাচ্ছে মামণি। পাপা যায়নি তো। নীচে বড় মানা ভাইয়ের বাসাতেই আছে।

নূহা হেসে বলল, তারপরও দেখে আসি আমি।


মামণি চলে যাবার পর নাবিহা উঠে দাঁড়ালো। নীচের বাগানের দিকে চোখ পড়তেই হাসি ফুটে উঠলো মুখে। গতকাল ভোরটা ভীষণ রকম স্পেশাল ছিল তার জন্য। কারণ গতকাল তার দিনের শুরু হয়েছিল পাপার হাত ধরে শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটা্র মাধ্যমে। হাঁটতে হাঁটতে আকাশের রঙ বদলের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যোদয় দেখেছিল। প্রকৃতির সব শিশির মনেহয় তাদের বাগানেই ঝরে পড়েছিল গতকাল। পাপাকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিল, ঘাসের বুকে জমে থাকা শিশিরের পরশে আমার পা একদম ভিজে গিয়েছে। জবাবে পাপা তাকে বলেছিল, প্রকৃতির কিছু সৌন্দর্য দু'চোখ ভরে দেখতে হয়, কিছু সৌন্দর্য চোখ বন্ধ করে গভীর মনোযোগ সহকারে শুনতে হয়। আর কিছু সৌন্দর্য চোখ- কান দুটোই বন্ধ করে শুধুই অনুভব করতে হয়। শিশির ভেজা ঘাসে তোমার প্রতিটি কদমকে তাই শুধুই অনুভব করার চেষ্টা করো। দেখবে তখন আর পা ভিজে যাচ্ছে মনে হবে না। বরং, শিশিরের শীতলতা তোমার মনে ও প্রাণে দিয়ে যাবে আনন্দানুভূতির ছোঁয়া। সত্যি সত্যিই যখন অনুভব করার চেষ্টা করেছিল। মনে হয়েছিল, শিশির না আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। তখনই মনে মনে ভেবেছিল ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে একদিন মামণির হাত ধরে খালি পায়ে হাঁটবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কত দ্রুত তার মনের চাওয়াটা পূরণ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেজন্য মন ভরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করতে ইচ্ছে করলো নাবিহার। তাহাজ্জুদ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার সুন্দর সুযোগটিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে বারান্দা থেকে ঘরে প্রবেশ করলো নাবিহা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন