সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...৩



স্পর্শে যার দূর হয় মনের সমস্ত কালো, তুমি আমার এমনই এক আলো এটা আবার কেমন ধরণের ম্যাসেজ? পাশের টেবিল থেকে উঠে এসে বসতে বসতে প্রশ্ন করলেন মিসেস নুসরাত

আফজাল
সাহেব বললেন, কেমন ধরণের ম্যাসেজ সেটা আমি কি করে বলবো?

তুমি
কি করে বলবে মানে? ম্যাসেজ তো তোমার নাম্বার থেকেই এসেছে। নূহার দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলেন মিসেস নুসরাত। বুঝে গেলেন আসল ঘটনা। চোখ পাকিয়ে বললেন, তোর লজ্জা করে না এই ধরণের কাজ করতে?

নূহা
অবাক কন্ঠে বলল, কোন ধরণের কাজ আম্মি? আমি তো এই মূহুর্তে আইসক্রিম কেক খাওয়ার কাজ করছি। খেতে লজ্জা পাবো কেন?

আফজাল
সাহেব হেসে বললেন, এইজন্য তুই আমার সেলফোন নিয়েছিলি কিছুক্ষণ আগে। খুব বেশি দুষ্টু হয়েছিস তুই। আজই তোর নামে বিচার সভা বসাতে হবে।

নূহা
হেসে বলল, এছাড়া তোমার বউকে গসিপের আসর থেকে উঠানো যেতো না বাপী।

গসিপের
আসর বলতে কি মিন করছিস তুই? কেউ নিজের কষ্টের কথা পরিচিত জনদের সাথে শেয়ার করতে পারবে না? কিছুটা বিরক্ত কন্ঠে বললেন মিসেস নুসরাত

নিজের
কষ্টের কথা শেয়ার করতে কোন সমস্যা নেই আম্মি। কিন্তু আমি তো দুতিন মিনিট দাঁড়িয়ে উনাদের কথা শুনেছি। তুমিই ভেবে বলো উনাদের আলোচনা কি হেলদি ছিল?

কিছু
না বলে চুপচাপ আইসক্রিম নিজের দিকে টেনে নিলেন মিসেস নুসরাত।

বেশ
অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর নূহা বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ কি? প্রশ্নটা মনেহয় আপেক্ষিক তাই না? শুধু ব্যক্তি ভেদেই আপেক্ষিক নয়। একজন ব্যক্তির কাছেও একেক সময় একেক কাজকে কঠিন মনেহয়। বর্তমানে আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মনেহচ্ছে সামাজিক হওয়াকে। নিজের গন্ডি ছেড়ে একটু বাইরে বের হতে চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতি কদমেই বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে চলার গতি।

কেন
? চলার গতি বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে কেন? প্রশ্ন করলেন আফজাল সাহেব।

কারণ
আমাদের চোখ দুটা নিজকে দেখতে পায়না বলেই হয়তো নিজেকে ছাড়া দুনিয়ার বাকি সবার দোষ খুব চমৎকার ভাবে দেখতে পায়। বাবাকে প্রায়ই আর্তনাদ করে বলতে শুনতাম, ক্ষুদ্রতা আমাকে খুব বেশি কষ্ট দেয় বলেই কি বারবার মানুষের ক্ষুদ্রতা পরীক্ষায় রূপে হাজির হয় আমার সামনে? কিছুদিন থেকে নিজের ভেতরেও এই আর্তনাদটার অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে। বাবাকে যখন আমার মনে অবস্থাটা বলেছিলাম। বাবা হেসে বলেছিলেন, মানুষের মনের মাপ ছোট দেখে হতাশ হবার কিছু নেই রে মা। তারচেয়ে মন গুলোকে বড় করার চেষ্টা কর। একজন মানুষের মনের আকারও যদি বড় করতে পারিস সেটাও তো অনেক।

আফজাল
সাহেব হেসে বললেন, ভাইয়া ঠিকই তো বলেছেন। একজন মানুষের মনের আকার বড় করতে পারাটাও তো বিশাল কিছু।

নূহা
হেসে বলল, তা তো অবশ্যই। তুমি অনেকদিন আগে একটা কৌতুক বলেছিলে মনেআছে বাপী? ‘নিজেকে চিকন দেখানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে মোটা কারো পাশে গিয়ে দাঁড়ানো এই কৌতুকটির খুব প্রয়োগ দেখতে পাই চারপাশে। তবে নিজেকে চিকন দেখানোর জন্য নয় ভালো প্রমাণ করার জন্য। নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে আমাদেরকে বেশির ভাগ সময়ই অন্যেকে খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। অর্থাৎ, আমাদের ভালো খারাপের মানদণ্ড শরীয়তের বিধানকে ছাড়িয়ে ব্যক্তিসত্ত্বাতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে ভালো বা সঠিক প্রমানের জন্য তাই মানুষের দোষ বর্ণণা না করে আমাদের কাছে আর কোন পথ থাকে না। অন্যের দোষকে উপমা, রূপক, ছন্দে উপস্থাপন করে অতঃপর আমরা বলি বা প্রমান করি যে আমি এসব মুক্ত। অর্থাৎ, দেখো আমি কতো ভালো মানুষ। এই ধরণের ভালো মানুষগুলোর জন্য খুব বেশি মায়া হয়। নিজেকে বিচার করার সময় এরা যে আত্মকানা রোগী হয়ে যায় সেটা বুঝিয়ে বলতে ইচ্ছে করে। যারা বুঝবে মনেকরি তাদেরকে অবশ্য বুঝিয়ে বলি। আর বাকিদের জন্য দোয়া করে দেই মন থেকে। যাতে নিজেকে বিচার করার সময় তাদের এই অন্ধত্ব দূর হয়। কেননা অন্যেকে খারাপ সাজিয়ে যাদেরকে নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে হয় তাদের অনেক বেশি হেদায়াতের দোয়ার প্রয়োজন।

আফজাল
সাহেব বললেন, এই ব্যাপারে তোর সাথে একমত না হয়ে পারছি না আমি। আসলেই অনেক বেশি হেয়াদাতের দোয়া প্রয়োজন এমন মানুষদের।
হুম
! জানো বাপী মনটা ভীষণ খারাপ লাগে ভেবে কবে আমরা এমন মানসিক দীনতা থেকে বেড়োতে পারবো? কবে নিজেকে অন্যের অবস্থানে রেখে বিচার করতে শিখবো? কবে বুঝতে চেষ্টা করবো একজন মানুষের ভুলের পেছনে কোন না কোন কারণ থাকে?! কবে এই উপলব্ধি জাগবে মনে যে, একজনের জন্য যা খুব সহজ অন্য কারো জন্য সেটাই হয়তো খুব কঠিন কিছু? কবে মানুষকে তার দোষ দিয়ে না গুণ দিয়ে যাচাই করার মত উদারতা অর্জন করতে পারবো? মানুষ তো কোন পণ্য দ্রব্য নয় যে ইনগ্রিডিয়েন্ট দেখেই বুঝে নেয়া যাবে কি কি বিদ্যমান আছে ভেতরে! আর মানুষ পণ্য দ্রব্য নয় বলেই তো পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ, আজ যে দোষে একজনকে দোষী ভেবে ত্যাগ করছি, কাল হয়তো সে নিজেকে সংশোধনের মাধ্যমে সেই দোষ মুক্ত করে ফেলবে। কিন্তু সেই সুযোগ দিতে বেশির ভাগ সময়ই আমরা নারাজ থাকি। আমরা তাই খুব সহজেই মানুষের উপর ভালো-মন্দের লেবেল লাগিয়ে দেই। যা অনেক সময় সেই ব্যক্তির সংশোধনের পথ বন্ধ করে দেয়। অবশ্য একটা সময় আমি নিজেও কি এমন ছিলাম না?! কিংবা এখনো কি নেই?! একটা ভুলের কারণে কি এখনো মানুষের শুদ্ধ কাজগুলো থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার ভুল হয় না আমার দ্বারা?! বিচার করতে কি বসে যাই না মানুষকে?!

মিসেস
নুসরাত বললেন, আমি তো যাই। জানি ঠিক না তবুও প্রায়ই বিচার করতে বসে যাই মানুষকে। এই বদভ্যাস থেকে মুক্তি পাবার উপায় কি বলতো মা?

আমিও
মনে এই উপলব্ধিটা জাগ্রত হবার পর উপায় খুঁজতে শুরু করেছিলাম। ভাবতে ভাবতে একসময় মনেহলো, মানুষের মানবিক গুণাবলী অনেকটা -কোডের মত। সুপার মার্কেটে গিয়ে -কোড দেখে খাবার কেনাটা প্রথম প্রথম খুব ঝামেলার মনেহতো। কিন্তু যখন -কোড নাম্বার গুলো মুখস্ত হয়ে গেলো এবং কোন কোন খাবার সন্দেহজনক হারাম -কোড মুক্ত মোটামুটি জানা হয়ে গেলো তখন থেকে আর ঝামেলার মনেহয় না। তাছাড়া ততদিনে অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছি ব্যাপারটার সাথে। আসলে যে কোন জিনিস প্রথম প্রথম যতটা কঠিন লাগে পরবর্তিতে আর তেমনটা লাগে না। ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যেও হালাল, হারাম সন্দেহভাজন গুণাবলী বিদ্যমান। হারামটাকে বাদ দিয়ে, সন্দেহভাজন সবকিছুকে এড়িয়ে চলে, হালালটাকে গ্রহণ করতে দোষ কোথায়? বরং সেই ব্যক্তির মনে এই উপলব্ধি জাগিয়ে যাওয়া যায় যে তার মধ্যেও ভালো কিছু আছে। যা হয়তো তাকে আরো ভালো হবার পথে চলতে প্রেরণা যোগাবে! যদিও এটা হয়তো খুব সহজ কিছু না। মানুষের দোষকে না দেখার ভাণ করে গুণের স্বীকৃতি দেয়াটা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব বেশি কঠিনই বলা যায়। কিন্তু লক্ষ্য যদি থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি তাহলে হয়তো পথ চলাটা সহজ হয়ে যায়। কেননা আল্লাহ তায়ালা তো বলে দিয়েছেন, “ আমি তোমার জন্য সহজ করে দেবো সরলপথ এই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে-“ ধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম হচ্ছে সহজ সরল।মানুষের প্রকৃতির যা সহজাত প্রবৃত্তি তারই সুস্থ সুন্দর বিকাশ ঘটানো হয়েছে ইসলাম ধর্মে।ইসলাম হচ্ছে জীবনের ধর্ম। সুস্থ,সুন্দর জীবন যাপন প্রণালীর নামই ইসলাম। তবে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সম্পূর্ণতা লাভের পথ দুর্গম। পথে সার্থকতা সফলতা লাভের প্রথম শর্ত হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন। আমাদের সকল কর্ম, চিন্তা, ভাবনা, ইচ্ছা সব কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হতে হবে। বান্দা যখন এভাবে নিজেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির লাভের জন্য নিজস্ব সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারে তখনই আল্লাহ্ বান্দার জন্য তার আধ্যাত্মিক জগতের রাস্তাকে সহজ করে দেন।

আফজাল
সাহেব বললেন, হ্যা সেটাই। আসলে ভালো মন্দের সংমিশ্রণেই প্রতিটা মানুষ। কারো ভেতরে হয়তো ভালোর আধিক্য বেশি আর কারো ভেতরে মন্দের। কিন্তু কারো পক্ষেই সর্বদা, সর্বক্ষণ একই রকম আচরণ করা সম্ভব নয়। ভুল হবেই। তাই ইচ্ছা চেষ্টা থাকা উচিত ভুলের দ্বারা কাউকে বিচার না করা। তার উপর লেবেল লাগিয়ে না দেয়া। তার সংশোধনের পথকে রুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকা। বরং ভালোটা গ্রহণ করে মনে এই বিশ্বাস জাগানো যে তার মাঝেও আলো আছে। যে উপলব্ধি হয়তো একদিন তাকে নিয়ে যাবে জোনাক জোনাক মানুষদের সারিতে ইনশাআল্লাহ।

মিসেস
নুসরাত বললেন, এই কথাগুলো ওদেরকে বুঝিয়ে বললি না কেন?

নূহা
হেসে বলল, কারণ বুঝিয়ে বলার মতো অনুকূল পরিবেশ ওখানে বিদ্যমান ছিল না। বুঝলে আম্মি চোখের মতো মনেও পাওয়ার আছে। আইমিন, প্লাস-মাইনাস। মন তাই কখনো দূরের জিনিস দেখতে পায় না, আবার কখনো বা কাছের জিনিস অস্পষ্ট দেখে। সমস্যা একটাই চাইলেই চশমা বা লেন্স কিনে চোখের পাওয়ায়ের মতো মনের পাওয়ার অ্যাডজাস্ট করে নেয়া সম্ভব হয় না। মনের ঘাতটি দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান। শুদ্ধ, শুভ্র, আলোকিত জ্ঞান। আবার অক্ষর জ্ঞানহীন কেউ চাইলেই কি বই খুলে পড়া শুরু করে দিতে পারবে? কখনোই না। সেজন্য আগে তাকে অক্ষর চিনতে হবে। তাই এই মূহুর্তে উনাদেরকে জ্ঞান দান করা সম্ভব নয়। তারআগে অক্ষর চেনাতে হবে।

তাহলে
অক্ষর শেখানোর কাজটাই কর।

নূহা
হেসে বলল, আচ্ছা সেটা পরে চিন্তা-ভাবনা করে দেখা যাবে। এখন বাইরের মানুষের কথা বাদ। তোমরা দুইজন কেন সারাক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি করো সেই কৈফিয়ত দাও আগে আমাকে?

আফজাল
সাহেব বললেন, আমি কখনোই কিছু করিনা। যা করার তোর আম্মি করে।

আম্মির
উপর সব দোষ চাপিয়ে হাত ঝেড়ে ফেললে তো হবে না বাপী। আচ্ছা তুমিই চিন্তা করে বলো ঢোল কি একা শব্দ করতে পারে? পারে না। কেউ যখন আঘাত করে তখনই ঢোল শব্দ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢোলের দোষ কোথায়? উত্তর হচ্ছে, ঢোলের দোষ ঢোল হওয়াতে। ঢোল যদি না থাকতো তাহলে কেউ বাজাতেও পারতো না। ঠিক তেমনি তোমার দোষ তুমি একটুতেই বিরক্ত দাও। নাচুনে বুড়োকেই মানুষ নাচায়। তুমি বিরক্ত হও বলেই আম্মি তোমাকে বিরক্ত করে।

তোর
আম্মির কোন দোষ নেই?

আলবৎ
নেই। একসাথে টেবিল চাপড়ে বললো নূহা আর মিসেস নুসরাত।

আফজাল
সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বুদ্ধিমান পুরুষ কখনোই মেয়েদের সাথে তর্ক করে না। আলহামদুলিল্লাহ আমি নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করি। তাই স্যালেন্ডার করলাম।

মিসেস
নুসরাত আর নূহা হেসে ফেললো। আফজাল সাহেবের চেহারাতেও হাসির আভা ফুটে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নূহা বলল, আজকাল প্রায়ই একজন কখনো আমার মেঘ ঢাকা গুমোট মনে রোদেলা দুপুর হয়ে হাজির হয়। আবার কখনো বা মরুময় শুষ্ক প্রাণকে অঝোর শ্রাবণ হয়ে চঞ্চল করে দেয়। হয়তো কোন কারণে প্রচন্ড মনখারাপ। সে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, জানো কি হয়েছে? আধ ঘন্টার উপরে হয়েছে আমি তোমার মুখে হাসি দেখি না। প্লিজ একটু হাসি দাওওওও... আবার হয়তো খানিককা একাকীত্ব ভর করার কারণে চুপ করে বসেছিলাম। পাশে এসে বলবে, কতক্ষণ হয়ে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করো না। জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে সে মুখ দিয়ে প্রশান্তি সূচক একটা ধ্বনি ছড়িয়ে দিয়ে বলে, এবার আমাকে আদট দাওওওও। আলহামদুলিল্লাহ মূহুর্তেই অদ্ভুত এক মুগ্ধতা ভরা প্রাপ্তিকর প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। না চাইতেও হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোনে, চোখ ভিজে ওঠে আনন্দ্রাশ্রুতে।

মিসেস
নুসরাত হেসে বললেন, জারিফ এমন করে বুঝি?

নূহা
হেসে বলল, হুম, আলহামদুলিল্লাহ। ছয় মাস আগেও উঠতে, বসতে, শুতে, জাগতে জারিফ লাভ ইউ, লাভ ইউ করতো। কিন্তু আজকাল সে মুখে না বলে আচরণে দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করাটা বেশ ভালো মতই রপ্ত করে নিয়েছে, মাশাআল্লাহ। গত কয়েকদিন আগে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আমার কাছে। এই স্টাইলে সে দুর্বুদ্ধি শেয়ার করার জন্যই আসে সাধারণত। তাই বললাম, আবার কি? জবাবে বলল, কিছু নাতো মা তোমাকে ঝাপ্পি দিতে এসেছি। বলে সে দুষ্টু মিষ্টি হাসি ভরা মুখে আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থেকে লাফাতে লাফাতে চলে গেলো। সেদিন সকাল থেকে অনেক ছোটাছুটি গিয়েছিল। ক্লান্ত ছিলাম খুব বেশি। কিন্তু রান্না না থাকার কারণে বাধ্য হয়েই কিচেনে ঢুকেছিলাম। জারিফের ছোট্ট ভালোবাসার প্রকাশ টুকু শুধু আমার মুখেই হাসি নিয়ে আসেনি। সাথে সাথে সারাদিনের ক্লান্তিও দূর করে দিয়েছিল, আলহামদুলিল্লাহ। এটাকে কি বলে জানো বাপী?

কি
বলে? হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন আফজাল সাহেব।

নূহা
হেসে বলল, ভালোবাসার জাদু। আমরা যখন ট্রেনিং নিচ্ছিলাম আমাদের ম্যাজিক্যাল কিছু ওয়ার্ড শেখানো হয়েছিল। যেগুলোকে গোল্ডেন ওয়ার্ড বলা হয়। গোল্ডেন ওয়ার্ডেরও আবার বেশ কয়েকটা ভাগ আছে। সম্পর্কের বন্ধন সমূহের মধ্যে সদা চঞ্চলতা বিদ্যমান রাখার জন্য সাতটি গোল্ডেন ওয়ার্ডের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই সাতটি গোল্ডেন ওয়ার্ড হচ্ছে, লাভইউ, মিসইউ, থ্যাঙ্কইউ, সরি, ইয়েস, নো এন্ড গুড বাই। এখনই আমাদেরকে উঠতে হবে। তাই সাতটি ওয়ার্ড সম্পর্কে ডিটেইল বলার সময় নেই। তবে ভালোবাসা জাদু সম্পর্কে কিছু কথা বলা যায়।

মিসেস
নুসরাত হেসে বললেন, তাই বল শুনি।

তোমরা
তো জানোই জারিফ আমার জীবনে এমন সময়ে এসেছিল যখন জিহাদ, জিশান আর নাবিহাকে ওদের পাপা উনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি আমার মাতৃত্বের সবটুকুন ভালোবাসা সমন্বয়ে জারিফকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। জিহাদ, জিশান আর নাবিহার আদরও আমি জারিফকে করে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করতাম। জারিফকে আদর দিলে একসাথে চারটা দিতাম, লাভ ইউ বললে চারবার বলতাম। সবকিছুই চারবার করে করতাম। জারিফ তাই ভালোবাসাটাকে রপ্ত করে নিয়েছিল একদম ছোটবেলাতেই। ওর যখন তিন বছর বয়স ছিল একদিন ঘুমের মধ্যে ওর গায়ের কম্বল ঠিক করে আদর দিয়ে যখন উঠে আসছিলাম ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠেছিল, মা আই লাভ ইউ। মুহুর্তেও অনুভূতিটাকে শব্দে প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। অন্যরকম এক অধরা ভালোবাসা সিক্ত প্রাপ্তি। এরপর থেকে অসংখ্যবার এমনটা হয়েছে। এখনো জারিফ গভীর ঘুমের ঘোরেও কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় ওর পাশে আমার অস্তিত্ব। তখন ওর ঘুম জড়ানো কন্ঠে শোনা লাভ ইউ আমার চোখে বরষা নামিয়ে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে বোঝার চেষ্টা করি, কতটা ভালোবাসে আমাকে ছোট্ট প্রাণটা? কতটা যে অচেতনেও ভালবাসতে ভুলে যায় না। যখন স্কুলে থাকে কিংবা আমি দূরে কোথাও থাকি ওর এইসব ভালোবাসার প্রকাশ ক্ষণে ক্ষণেই দোলা দিয়ে যায় আমার মনে। তখন মনেহয় জারিফ শারীরিক ভাবে হয়তো কিছুটা দূরে আছে আমার কাছ থেকে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে সারাক্ষণই এক টুকরো ভালোবাসার রূপে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে।

নূহার
হাতের উপর হাত রেখে মিসেস নুসরাত বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। থাক এসব বলে এখন মন খারাপ করতে হবে না তোকে।

নূহা
হেসে বলল, মন খারাপ হচ্ছে না। মন ভালো আছে বলেই বলছি। ট্রেনিং সেন্টারে যখন গোল্ডেল ওয়ার্ড সম্পর্কে টিচার বলছিলেন আমাদেরকে। একজন প্রশ্ন করেছিল, ভালোবাসা আসলে কি? জবাবে টিচার বলেছিলেন, তাই তো ভালোবাসা আসলে কি? কেন ভালোবাসার কেন্দ্র করে ঘুরতেই থাকে আমাদের মন? পুনঃপুনঃ একই প্রশ্নে দোলায়িত হতে থাকে। ভালোবাসা কি? আচ্ছা ভালোবাসা কি পাশে থাকা? হুম, মনেহয় তাই! কোন আকুলতা, ব্যাকুলতা নয়! কোন কাব্যিক ভাবাবেগও নয়! ব্যাস শুধু পাশে থাকা! অবচেতনেই কিছু করে যাওয়া! পাশে আছি জানান দেয়া! আর কিছুই না! শুধু বার বার ভালোবাসি বলাতেই নয়! ভালোবাসা শব্দহীনও রাখে পরিচয়! ভালোবাসা উপঢৌকনে নয়, ভালোবাসা প্রশান্তিময় আশ্রয়। ভালোবাসা নয় প্রেমময় উপন্যাস! ভালোবাসা দুএকটি পংত্তির সুবিন্যাস! ভালোবাসা হয় সঙ্গোপনে প্রবাহিত! তবুও অন্তরকে করে যায় সিক্ত। এরপর বলেছিলেন, “ভালোবাসা রব্বের দেয়া নেয়ামত, প্রকাশে যার সুখানন্দে আসে বরকত

আলহামদুলিল্লাহ।
প্রতিটি শব্দ অসাধারণ। বেশ মুগ্ধ কন্ঠে বললেন আফজাল সাহেব।

নূহা
হেসে বলল, হ্যা। কিন্তু অনেকেই আছেন প্রচন্ড ভালোবাসার মানুষকেও মুখ ফুটে ভালোবাসি বলতে পারেন না। লাভ ইউ বা ভালোবাসি খুব ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু এর অনুভূতি আকাশ ছোঁয়া। হাদীসেও এসেছে, “তোমরা কাউকে ভালোবাসলে তা মুখে প্রকাশ করো। এতে তোমাদের মোহাব্বত আরো বৃদ্ধি পাবে তাই যাদেরকে ভালোবাসি বলতে শরীয়তে কোন বাঁধা নেই। আমাদের সেই আপনজন, প্রিয়জন, কাছের মানুষদের বার বার জানিয়ে দেয়া উচিত তাদেরকে আমরা ভালোবাসি। কারণে-অকারণে অভিযোগ, অনুযোগ তো কতই করি। কারণে-অকারণে ভালোবাসি, ভালোবাসি নাহয় করলাম একটু আধটু। নাকি বলো তোমরা দুইজন?

হেসে
ফেললেন আফজাল সাহেব, মিসেস নুসরাত দুজনই। নূহার দুজনের সাথে হাসিতে যোগ দিলো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন