সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২৩




আপি আমি যদি বিয়ে করতে না চাই তাহলে কি আমার গোনাহ হবে? বিয়ে না করার ব্যাপার শরীয়তের বিধান কি?
তাবাসসুমের প্রশ্নটা হঠাৎ করেই চেন টেনে গল্পের আনন্দময় ট্রেনটাকে থামিয়ে দিলো। সবাই গভীর দৃষ্টিতে তাকালো তাবাসসুমের দিকে। সকাল থেকে ননস্টপ এত কথা বলতে হয়েছে, এখন কোন কথা বলবে না শুধু সবার কথা শুনবে এই শর্তে মেয়েদেরকে তার কাছে আসার পারমিশন দিয়েছিল নূহা। শর্ত মতো তাই চুপচাপ হাসি মুখে মেয়েদের কিচির মিচির শুনছিল। তাবাসসুমের প্রশ্ন নূহার মুখের হাসি আরেকটু ব্যাপকতা পেলো। সব প্রশ্নের জবাব না দেয়াটাই উত্তম। তাই প্রশ্নে জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো, কেন তুমি কি বিয়ে করতে চাইছো না?

দুঃখী কন্ঠে তাবাসসুম বলল, জ্বি আপি বিয়ে করতে চাইছি না ইনশাআল্লাহ। বিয়ে করে তো কাউকে সত্যিকার অর্থে সুখী হতে দেখিনি। বরং নিত্য নতুন ঝামেলা তৈরির পথ উন্মুক্ত হয় বিয়ের ফলে। এমনিতেই অনেক ঝামেলাপূর্ণ জীবন আমার। আর বাড়াতে চাইনা।

নূহা হাসি মুখে বলল, “পুনঃপুনঃ ঝামেলা মানুষকে করে তোলে আত্মঘাতী, আমিও তাই ঝামেলা থেকে দূরে থাকার পক্ষপাতী। আসলে সম্পর্কের বন্ধনে থাকে না যখন প্রীতি, মনে জাগিয়ে যায় সেটা নিরন্তর হতাশাকর ভীতি। তবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে মনের গতি, বুদ্ধিমান তারাই মেনে নেয় যারা নিয়তি।"

আপ্পা আবারো নিয়তি? এই নিয়ে নয়টা কবিতা শুনেছি নিয়তিকে মেনে নেয়ার উপরে। দাঁত বের করে বললো আত্মজা।

নূহা হেসে বলল, মাত্র নয়টা বলেছি? নিয়তির ভান্ডার তো অসীমিত আমার। সে যাইহোক, নিয়তি ব্যাপারটার ম্যাজিক কোথায় জানো?

কোথায়? মেয়েরা সব একসাথে প্রশ্ন করলো।

মেনে নেয়াতে। আর ঝামেলার ম্যাজিক হচ্ছে, পরীক্ষাতে। প্রতিটা ঝামেলা এক একটি পরীক্ষা। একাডেমিক লাইফে যেমন পরীক্ষা দিতে দিতেই একটার পর একটা ক্লাস টপকে এগিয়ে যেতে হয়। রিয়েল লাইফে সামনে এগোতে হয় ঝামেলা টপকে। প্রতিটা বড় ঝামেলা একেকটা ফাইনাল এগজাম। কোনটা সেমিস্টার, কোনটা টিউটোরিয়াল, কোনটা ঝটিকা টেস্ট। ঝটিকা টেষ্ট কোনগুলো বুঝেছো তো?

ডানে বামে মাথা নেড়ে না বললো মেয়েরা।

নূহা হেসে বলল, টিচার ক্লাসে ঢুকে রহস্যময় হাসি হেসে যখন বলেন, খাতা-কলম বের করেন আপনারা। টেস্ট নেয়া হবে আজ। আমি প্রায়ই করি এই কাজটা। কারণ একজন ভালো স্টুডেন্ট হচ্ছে সে যে সবসময়ই জ্ঞানার্জনের উপরেই থাকে। পরীক্ষার আগের দিন নাকে মুখে পড়ে এসে গড়গড় করে খাতায় লিখে ভালো মার্কস তুলতে পারার মাঝে আসলে কোন ক্রেডিট নেই। গড়ে মার্কস হয়তো কম কিন্তু অধ্যয়নে নিয়মিত এমন স্টুডেন্ট আমার বেশি পছন্দ। তাই কারা নিয়মিত পড়াশোনা করে সেটা বোঝার জন্যই আমি হঠাৎ হঠাৎ এজগাম নেই। আচ্ছা নিয়মিত আমল বিষয়ক একটা হাদীস আছে। কে বলতে পারবে?

জুয়াইরিয়া বলল, আমি পারবো আপ্পা। আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, আল্লাহ্‌ তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কি? তিনি বললেনঃ যে আমল নিয়মিত করা হয়। যদিও তা অল্প হোক। তিনি আরোও বললেন, তোমরা সাধ্যমত আমল করে যাও।

নূহা হেসে বলল, মাশাআল্লাহ। এই হাদীসটা আমার প্রিয় হাদীস সমূহের একটি। এবং শুধু আমলের ক্ষেত্রেই না স্বাভাবিক পড়াশোনা কাজকর্মের ক্ষেত্রেও আমার মনে হয়েছে নিয়মিত যেসব জিনিসের চর্চা করা হয় সেই ব্যাপারগুলো খুব কমই আমাদের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়। আবার চর্চা থাকার কারণে হঠাৎ যদি বাড়তি কোন বোঝা চলে আসে, খুব বেশি হিমশিম খেতে হয় না। যেমন ধরো, আমি প্রতিদিন পাঁচজন মানুষের রান্না করি। কোনদিন যদি পঁচিশজনের রান্নার আয়োজন করতে হয়, তাহলে হয়তো একটু কষ্ট হবে কিন্তু ম্যানেজ ঠিকই করে ফেলতে পারবো। জীবনের সমস্যাগুলোকেও এভাবেই দেখতে ভালো লাগে। হুটহাট চলার পথে যখন সমস্যা এসে হাজির হয়, তখন অস্থির না হয়ে ভাবতে চেষ্টা করি হোমওয়ার্কে তো কখনোই ফাঁকি দেইনি, ক্লাসের লেকচারেও মনোযোগী ছিলাম সবসময়। আলহামদুলিল্লাহ নিজেকে প্রুফ করার একটা সুযোগও পেয়ে গেলাম। আসলে কি জানো দুনিয়ার এই জীবনে সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার একটাই উপায়। সেটা হচ্ছে, সর্বদা সমস্যার জন্য প্রস্তুত থাকা। এবং সমস্যা মোকাবিলার জন্য নিয়মিত হোমওয়ার্ক করা। কেননা সমস্যার জটিলতা নির্ভর করে আমাদের যোগ্যতা প্রস্তুতির উপর। বেশির সময়ই আমরা ব্যর্থ হই নিজেদের অপ্রস্তুতির কারণে, সমস্যার কারণে নয়। যাইহোক, তাবাবসুম বিয়ে করতে না চাইবার পেছনে কারণ কি শুধু এটাই যে, চারপাশে কাউকে ভালো থাকতে দেখছো না?

জ্বি আপি এটাই মূল কারণ বলা যায়।

তোমার আগের ব্যাচের একশো জনের মধ্যে ৯৫ জনই ম্যারেজ প্রাক্টিক্যালে ফেল করেছে। তাই বলে তুমি প্রাক্টিক্যাল দেবার ইচ্ছাই পরিত্যাগ করে দেবে? সম্মানিত তো আমরা সফলদেরকে করি তাই না? তাহলে অনুসরণ বিফলদেরকে করতে যাবো কেন? এরচেয়ে কি যারা সফল তাদের সফলতার পেছনের মূলমন্ত্রগুলো খোঁজার চেষ্টা করে নিজের জন্য গাইড লাইন নির্ধারণ করাটাই উত্তম নয়? বুদ্ধিমত্তা কি জীবনকে সহজ সুন্দর করে গড়ে তোলার ব্যাপারে সহায়ক বিষয় সমূহ চর্চা করার মধ্যে নয়? যাতে চলার পথের সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করা যায়? পালিয়ে যাওয়া কিংবা মুখ ফিরিয়ে নেয়া আসলে কোন সমস্যার সমাধান নয় কখনোই। জীবন সমস্যা মূখর। কয়টা সমস্যা থেকে পালাবে? সবচেয়ে বড় কথা লুকোচুরি খেলা তো জীবনের মূল লক্ষ্যে নয় আমাদের। তাই না?

জ্বি আপি। আসলে সবই বুঝি কিন্তু মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যাই

নূহা হেসে বলল, হতাশারও তো রাইট আছে আমাদের মনের দোলনাতে বসে মাঝে মধ্যে একটু দোল খাওয়ার। তাই কি দরকার কারো হক নষ্ট করার? শুধু মনে রাখলেই হবে লাইনে হতাশার পড়ে সবসময় আশা দন্ডায়মান থাকে। হতাশার নামতে যা দেরি। শুধু হয়ে যাবে আশার দোল দোল দুলুনি।

সবাই হেসে ফেললে নূহাও হেসে বলল, তাই এত মন খারাপের কিছু নেই। দৃষ্টিকে সর্বদা জীবনের মূল লক্ষ্য পানে ফোকাসড রাখার চেষ্টা করবে। এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে নিয়মিত হোমওয়ার্ক করে যাও। ইনশাআল্লাহ ঝটিকা টেস্ট দুর্বল কিংবা ভীত তো করবেই না, উল্টো প্রতিবার তোমাদেরকে আরেকটু করে দক্ষ করে দিয়ে যাবে সমস্যার মোকাবেলায়।

তাবাসসুম হেসে বলল, জ্বি আপি ইনশাআল্লাহ।

আপি এবার তাহলে আমাকে কিছু পরামর্শ দিন প্লীজ।। অনুরোধের সুরে বললো সাদিকা।

নূহা হাসি মুখে বলল, কিন্তু কথা তো ছিল আমি শুধু তোমাদের কথা শুনবো। আচ্ছা যাইহোক, বলো তুমি।

সাদিকা বলল, আমি অনেক অনেক পড়াশোনা করতে চাই, ভালো রেজাল্ট করতে চাই আপি। কিন্তু কেন জানি না মনই বসাতে পারি না পড়াতে। খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে বসি কিন্তু পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যেই কেমন যেন বিতৃষ্ণা লাগে। ক্লাসের লেকচার, গ্রুপ স্টাডি কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারিনা। আমার চাওয়াতে কিন্তু কোন ঘাটতি নেই। আন্তরিক ভাবেই চাই। কিন্তু বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারিনা। কি করবো আপি?

শুধু মনোযোগীটার অভাব নাকি অন্য কোন সমস্যাও আছে?

এছাড়াও সমস্যা আছে। আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। এনার্জি পাই না একদমই। খুব দুর্বল লাগে। সারাক্ষণ ঘুমোতে ইচ্ছে করে।

কোন কিছু নিয়ে টেনশন করো?

টেনশন তো আছেই। তবে সেটা সবসময় না। মাঝে মাঝে কিছুই ভালো লাগে না। নিজেকে খুব বেশি একা মনেহয়। কিসের যেন একটা শূন্যতা হাহাকার তুলে যায় মনে। কি সেটা ঠিক নিজেও বুঝিনা।

পরিবারের সদস্যদের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? আইমিন, পারস্পরিক বন্ডিং কেমন তোমাদের?

বন্ডিং কেমন সেটা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না। আম্মুর সাথে বেশ ফ্রেন্ডলি আমি। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন কারণে আম্মু খুব রাগ করেন আমার সাথে। মাঝে মাঝে আমি নিজের কোন দোষই খুঁজে পাই না। কিন্তু আম্মু ঠিকই বকাঝকা করতে থাকেন আমাকে। আসলে আব্বুর রাগ বা অন্য যে কোন টেনশনও আম্মুও আমার উপর ঢালেন। কিন্তু আমার কি দোষ আপি? আমার সাথে এমন করলে আমি কোথায় যাবো? এই সমস্ত পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ লাগে আমার।

হুমম, খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। আচ্ছা ফেন্ডদের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?

ফ্রেন্ড বলতে তেমন কেউ নেই আসলে। কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করে না। মনেহয় মিশলে সেও আমার ভেতর নানান ধরণের দোষ খুঁজতে শুরু করবে, এটা সেটা নানান কথা শোনাবে। তাই ফ্রেন্ড বলতে যারা আছে তাদের সাথে খুবই ফর্মাল রিলেশন আমার।

তারমানে সম্পর্ক তৈরি করতে ভয় পাও তুমি। কাউকে নিজের খুব কাছে আসতে দিতে ভয় পাও। কারণ তুমি চাও না কেউ তোমাকে কষ্ট দিক। তাই সম্পর্কে জড়িয়ে কষ্ট পাবার চেয়ে, এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করো। এই তো?

হ্যা কারো সাথে মিশতে গেলে খুব ভয় কাজ করে। যদি আমাকে কষ্ট দেয়। তাই একাই থাকি আমি। বাইরে কোন কাজ না থাকলে বাসাতেই থাকি। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আবার মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই খুব মন খারাপ লাগে। খুব বেশি কান্না পায় তখন। কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ আদায় করেও দেখেছি। মন শান্ত হয় না কোন কিছুতেই। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় বলে দিন আপি।

একটু বেশিই সমালোচনা করা হয়েছে কি তোমাকে ছোটবেলাতে? উৎসাহিত করা হয়নি ব্যাপারটা এমন?

উৎসাহ? উৎসাহ কাকে বলে সেটা তো আমি জানিই না। প্রতিটা কাজেই ভুল ধরা হয়েছে। আগ্রহ নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করলে উল্টো বকাঝকা করা হয়েছে। আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরাও খুব অদ্ভুত রকমের। গীবত-পরচর্চা, দোষ ধরা, ছোট করা এসবই উনাদের কাজ। সেজন্যই তো জুনির কাছে যখন প্রথম প্রথম আপনাদের পরিবারের কথা শুনতাম আমার বিশ্বাসই হতো না। মনেহতো বানিয়ে বলছে।

নূহা হেসে বলল, আমাদের পরিবারও একসময় এমনই ছিল। নানা রকমের মানসিক দীনতায় পরিপূর্ণ। অনেক চেষ্টা, সাধনার পর অল্প অল্প করে স্বার্থের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে নিজেদেরকে উদার, ধৈর্য্যশীল, ত্যাগী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্যরা, আলহামদুলিল্লাহ। কোন একদিন সময় করে তোমাদেরকে সেই কাহিনী শোনাবো ইনশাআল্লাহ। এখন তোমার সমস্যা নিয়ে কথা বলি। আসলে কি জানো সাদিকা বেড়ে ওঠার পরিবেশের ঘাটতিগুলো দূর করাটা কিছুটা মুশকিল কিন্তু অসম্ভব নয় মোটেও। আবার মানুষের মন কখনোই অকারণে খারাপ হয় না। কখনো আমরা কারণটা ধরতে পারি, কখনো ধরতে পারিনা এই যা। ব্যাপারটা অনেকটা একসাথে অনেকগুলো রঙ মিশে যাবার মতো। অনেক রঙ মিলে যখন একটা মিশ্র রঙ তৈরি করা হয়। তখন আলাদা করে কোন রঙকে চেনার সুযোগ থাকে না। তেমনি মনের ভেতর যখন একসাথে অনেকগুলো কারণ ছড়িয়ে পড়ে তখন অজানা একটা আবহ তৈরি হয়। মূহুর্তগুলোতে ঠিক কেমন লাগছে নিজের পক্ষে বুঝে ওঠাটাই সম্ভব হয় না। কোন কিছুর প্রয়োগেই মনকে স্বাভাবিক করে তোলা সম্ভব হয় না।

একদম ঠিক বলেছেন আপি। সত্যিই এমনটাই ফিল করি তখন। মন কিছু দিয়েই ঠিক করা যায় না। এমন মূহুর্তগুলোতে কি করা উচিত?

এমন মূহুর্তগুলোতে আমি কিছুই না করার চেষ্টা করি। কারণ মনের এমন অবস্থা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না আঁধার যেমন একটা নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে হাল ছেড়ে দেয়। কারণ তারচেয়ে বেশি আঁধার ছড়ানোর ক্ষমতা থাকে না বলে। মনের ব্যপারটাও তাই। সারাক্ষণই মেঘাচ্ছন্ন থাকবে না। বাতাস বইবে, কালো মেঘ সরে গিয়ে রোদ আবারো হাসবে। ঐটুকু সময় মনকে দিতে হবে তোমার। তাই মন খারাপ হবার পরে কি করবে সেই ব্যাপারে কোন পরামর্শ দিতে চাইছি না তোমাকে। তবে মন যখন ভালো থাকবে তখন কি করবে সেই ব্যাপারে কিছু কথা বলি। নিজেকে খুব ভালো মতো চেনার, জানার বোঝার চেষ্টা করবে। শুধু নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগা জেনে বসে থাকলেই চলবে না। নিজের শক্তি কোথায়, দুর্বলতা কোথায় সেটাও জানতে হবে। মনে ফুলেল বসন্ত আসে কখন, ঝরাপাতার হাত ধরে শীত নামে কখন? রিমিঝিমি বরষা নামে কিসের প্রভাবে? কালবৈশাখীর ঝড় কেন ওঠে? কাশফুলের দোলায় শরৎ মৃদুমন্দ স্পর্শই বা কখন রাখে? নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে কখন মন? অর্থাৎ, মনের ঋতু চক্র সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। এক কথায় ডুবুরির ড্রেস পড়ে নেমে পড়তে হবে মন সমুদ্রে। খুঁজে বের করতে হবে নিজের মণি-মুক্তোগুলোকে। আর হ্যা, লন্ঠন ফিশটাকে খুঁজে পাওয়া মাত্রই সযতনে রেখে দিতে হবে একপাশের অ্যাকুরিয়ামে। বিশাল সমুদ্রে তাকে ছেড়ে দেয়া চলবে না। কারণ আপন আঁধারে মন যখন হারিয়ে যাবে তখন পথ খুঁজে পেতে লন্ঠন ফিশের দরকার পড়বে সবার আগে।

নায়লা হেসে বলল, লন্ঠন ফিশ মানে হচ্ছে গিয়ে শরীয়ত। ঠিক বলেছি না আপ্পা?

আলহামদুলিল্লাহ! বেশ কিছুদিন ধরেই নোটিশ করছি নায়লা শুধু ঠিক ঠিক কথাই বলছে আজকাল। মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ। নূহার সাথে সাথে মেয়েরা সবাইও মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ বলতে শুরু করলো।

নূহা হেসে বলল, হয়েছে থামেন এবার। শুধু দুষ্টুমি শুরু করার সুযোগের সন্ধানে থাকে সবগুলা মিলে। যা বলছিলাম, আসলে যখন নিজের সম্পর্কে সবকিছু ভালো মত জানা থাকবে তখন পরিস্থিতি নেতিবাচক হোক কিংবা ইতিবাচক নিজ করণীয় বুঝে ওঠাটা খুব বেশি কঠিন হয়না। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার হই কারণ মূহুর্তে নিজের করণীয় কি সেটা সম্বন্ধে অজ্ঞাত থাকি। তাই নিজেকে জানতে হবে, প্রাত্যহিক হোমওয়ার্ক অবশ্যই নিয়মিত করতে হবে। তোমাদের মনের রাজ্যে রাজা তোমরাই। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসের সমন্বয়ে গড়ে তোলো নিজ নিজ সাম্রাজ্যে। তবে হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া দিয়ে নয় কিন্তু।

তাহলে? প্রশ্ন করলো সবাই একসাথে

তাহলে, “নিজ প্রবৃত্তিকে জয় করার মিশন যদি থাকে মনে! লক্ষ্য পূরণে মন দিতে হবে সবার আগে জ্ঞানার্জনে! করণীয়-বর্জনীয়র সীমা জানতে মানতে! পরিপক্কতা হাসিল করতে হবে শরীয়তে! শুদ্ধ জ্ঞানাই পারে দূর করতে সমস্ত অপচ্ছায়া, অবাস্তবতা! আত্মিক উন্নতি সাধনে লাগবে মনের একাগ্রতা! তবেই সম্ভব সময়ের সাথে কদম মিলিয়ে চলা! হাসি-আনন্দের জোয়ারে ভাসবে আবার জীবন ভেলা!” এখন বুঝেছেন কি করতে হবে আপনাদেরকে?

সবাই একসাথে বলল, জ্বি আপ্পা।

আলহামদুলিল্লাহ! তারপরও আরেকবার বলে দিচ্ছি, আমরা ব্যর্থ হই প্রস্তুতির অভাবে। আমাদের মন আপনও আঁধারে ঢাকা পড়ে যায় নিজের আলো হীনতার জন্য নয়। আমরা নিজ নিজ আলোর সন্ধান জানি না বলে। তাই সবসময় মনে রাখবে, “তোমাদের ভেতরেও আছে গোটা একটি পৃথিবী! আছে আকাশ-বাতাস, বন-বনাঞ্চল, নক্ষত্র সবি! তোমাদের আছে আলো, ডুবে যাও কখনো আঁধারে! সূর্যোদয়ে হও উচ্ছল, সূর্যাস্তে সাজো নিমগ্নতার সম্ভারে! তোমাদের কাছেও আছে জোছনার ফুলেল ঝর্ণাধারা! ছোট্ট ছোট্ট দিয়া জ্বেলে তোমাদেরকে হতে হবে জমিনের বুকে তারা!”

ইনশাআল্লাহ আমরা অবশ্যই তারা হবো, আঁধারের বুকে দিয়া জ্বালবো। সম্মিলিত কন্ঠে বললো সবাই।

নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। আর সাদিকা সন্তান লালন-পালনের সঠিক জ্ঞান থাকে না বলেই পিতা-মাতারা নিজেদের অজানতেই সন্তানদের মানসিক বিকাশকে ব্যহত করেন। এটা উনাদের ভালোবাসার ঘাটতি নয় বরং উনাদের অজ্ঞতা। এক দুই কথায় উনাদের এই ভুল ভাঙানোটাও সম্ভব নয়। উনাদের ভুলের চারাগাছ এখন বটবৃক্ষ হয়ে গিয়েছে। আমার মতে বটবৃক্ষকে উপড়ে ফেলাতে শক্তি ক্ষয় করার চেয়ে নতুন চারা রোপণ করাই বুদ্ধিমত্তা। অর্থাৎ, ভুলে ভরা মানুষগুলোকে সঠিক পথের সন্ধান দেবার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু তাদের সঠিক পথে ফিরে আসাটা যেন আমাদের সুন্দর পৃথিবী গড়ার পথে প্রতিবন্ধক নাহয়। তাদের ভুল তারা করে ফেলেছেন, এতদিন অনেক সেই ভুলের মাশুল গুনেছো। কিন্তু আর নয়। বেরিয়ে এসো সেই ভুলের কারাগার থেকে। কারণ কেউ তোমাকে যাবতজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তি প্রদান করেনি। কারো ভুলে তুমি ভুল করে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলে কারাগারে। আর আত্মীয়-স্বজন হোক কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী মানুষের কথার প্রভাব মুক্ত হবার চেষ্টা করতে হবে। মানুষের নেতিবাচকতার ডাস্ট যাতে কিছুতেই ভাবনাকে ধূলো ধূসারিত করতে না পারে, সেজন্য সর্বদা ডাস্টিংয়ের উপর থাকতে হবে। ঠিকআছে?

সাদিকা জ্বি আপি বললেও কন্ঠের জোর যথেষ্ট কম ছিল।

নূহা হেসে বলল, বুঝতে পারছি কঠিন মনেহচ্ছে তোমার। কঠিন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলাতেই তোমাদের ডানা দুটিকে ভেঙে দেয়া হয়েছিল। আর আমি তোমাকে খোলা আসমানে উড়ার কথা বলছি। মানছি কঠিন বেশ, কিন্তু টাস্ট মি অসম্ভব নয় মোটেও। তুমি শুধু দৃঢ় ভাবে সিদ্ধান্ত নাও বেরিয়ে আসবে সকল আকারণ বাঁধা পেরিয়ে। দেখবে পথই তোমাকে পথ করে দিচ্ছে সামনে এগিয়ে চলার ইনশাআল্লাহ। আর আগামী সপ্তাহ থেকে যখন আমাদের ট্রেনিং সেন্টারের ক্লাস শুরু হবে। আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে ডিটেইল আলোচনা করবো। তখন বিস্তারিত বুঝিয়ে বলবো ইনশাআল্লাহ। এখন চলো আমরা মাগরীবের নামাজের প্রস্তুতি নেই। এরপর আবার গল্প করা যাবে ইনশাআল্লাহ।
সবাই তখন হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালো নামাজের প্রস্তুতি নেবার উদ্দেশ্যে


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন