সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৩০



আমি ঠিক কি করলে তুমি রাগ ভুলে গিয়ে আমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করবে বলো তো? সরি বলবো নাকি কান ধরবো? তুমি চাইলে আমি নীলডাউন হয়ে বসে যেতে পারি কিংবা নাকে খৎ-ও দিতে পারি। কি করবো বলো?  

রাগ করতে যেয়েও হেসে ফেললো নূহা। পরমূহুর্তেই গাল ফুলিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল, দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।   

উহু, শুধু তোমার এই একটি হুকুম মানতে পারবো না। 

কষ্ট তো ঠিকই দিতে পারো।

আরে সেটা তো দেবোই। হক আছে আমার। আচ্ছা তুমিই ভেবে বলো কষ্ট কি সবাই সবাইকে দিতে পারে? আমরা শুধু তাদের কথা, কাজ এবং আচরণ থেকেই সযতনে কষ্টকে তুলে নেই যাদেরকে আমরা অসম্ভব ভালোবাসি। কিন্তু যাদেরকে আমরা ভালোবাসি না, পছন্দ করি না তাদের কথা আমাদের বিরক্ত করে, বড়জোর রাগান্বিত করে। কিন্তু আমাদেরকে কষ্ট দেবার কোন অধিকার তাদের থাকে না। তাই কারো আচরণ আমাদেরকে প্রচন্ড কষ্ট দেয়ার অর্থ হচ্ছে সেই মানুষটার বাস অন্তরের গভীর অরণ্যে। আর হৃদয় রাজ্যে জুড়ে করে যে অবাধ বিচরণ, ক্ষমা করে দেয়াই যায় তার অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ।

নূহা হেসে বলল, বুঝলাম, মানলাম এবং তোমার অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ঠুর আচরণ ক্ষমাও করলাম।

আলহামদুলিল্লাহ। এখন আমার দিকে তাকাও। আমি জানি সকালের কথাগুলো একটু বেশিই কড়া ছিল। কিন্তু তুমি সবসময় এমন মুখে মুখে তর্ক কেন করো বলো তো? আইমিন, ইট’স পারফেক্টলি অলরাইট তুমি তর্ক করো, জেদ করো। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থাটা বুঝে করো। আমি যখন অফ মুডে থাকবো প্লিজ আমার সাথে আরগু করো না। আমি তোমাকে কখনোই কষ্ট দিতে চাই না। তাহলে কেন বাধ্য করো আমাকে কড়া কথা বলতে?

কারণ কড়া কথা বলার কিছুক্ষণ পর তুমি যখন আমার পিছন পিছন ঘুরতে থাকো তখন নিজেকে তোমার বস মনেহয়।  

জাওয়াদ হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে নূহার কান ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দিলো। নূহা হেসে বলল, তোমার মনেআছে একদিন বলেছিলে অন্য আর সবকিছুর মতো ভালোবাসার কোন টাইম লাইন থাকে না। কিন্তু আমার কি মনেহয় জানো? প্রতিবার যখন আমি কোন অন্যায় বা ভুল করি কিংবা অদ্ভুত কোন কান্ড ঘটাই। এরপর তুমি যখন আমাকে অনেক বকাঝকা করো। রাগ করে উঠে চলে যাও আমার সামনে থেকে কিংবা আমাকে বের করে দাও রুম থেকে। কিছুক্ষণ পর যখন আবার নিজ থেকেই আমার কাছে আসো। তোমার মনের সবটুকুন ভালোবাসার আকুলতা নিয়ে আমাকে বোঝাও। প্রতিবারই আমি আরেকবার করে তোমার প্রেমে পড়ে যাই। প্রতিবারই আমার মনের ভালোবাসার পারদ আরেকটু খানি করে উপরে উঠে যায়। ছোটবেলা থেকে যে ভালোবাসা তুমি আমাকে দিয়েছো। যদি সেই ভালোবাসার কিছুটা আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারতাম নিজেকে কৃতজ্ঞ মনেহতো। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আমি তোমাকে কিছুতেই তোমার মতো করে ভালোবাসতে পারি না। মন কেন জানি তৃপ্তই হয় না।

ঘটনা কি আজ হঠাৎ এতো ভালোবাসার মুড কেন আপনার? দুষ্টুমির স্বরে প্রশ্ন করলো জাওয়াদ। 

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূহা বলল, জানি না কেন? আজ শুধু মনেহচ্ছে ভালোবাসার যে প্রশান্তিকর বাঁধনে তুমি আমাকে বেঁধেছো, তোমার ভালোবাসাকে যেভাবে আমার অন্তরে গেঁথে দিয়েছো। পৃথিবীর কোন ঝড়, কোন বাঁধা, কোন দুরত্ব আমার মন থেকে সেই ভালোবাসার রঙকে এতটুকু ম্লান করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। আজ বৃষ্টি শুরু হবার পর থেকেই বার বার শুধু একই দোয়া করছিলাম। কখনোই যেন আমার মন থেকে তোমার মন দূরে সরে না যায়। শারীরিক দুরুত্ব আসে আসুক কিন্তু তোমার মন যেন সর্বদা ছুঁয়ে থাকে আমার মনকে।

জাওয়াদ হেসে বলল, এটা আবার কেমন অদ্ভুত দোয়া?

এটা অতি ব্যস্ত একজন মানুষের বৌয়ের দোয়া। যে মাসের মধ্যে দুই সপ্তাহ থাকে দেশের বাইরে, এক সপ্তাহ থাকে নানান কাজের ঘেরাটোপে আর এক সপ্তাহ কাটায় পরিবারের সাথে। যার মধ্যে অল্প একটু খানি সময় থাকে তার বৌয়ের জন্য।  

আচ্ছা তো এটা অবজেকশন টাইপের দোয়া? 

উহু, অবজেকশন করতে চাইনা বলেই তো তোমার মনকে বেছে নিয়েছি। কারণ তুমি যতটুকু সময় আমার কাছে থাকো, তারচেয়ে বহু গুণ বেশি সময় দূরে থাকো। কিন্তু তারপরও সর্বক্ষণ তোমার ভালোবাসা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি তোমার চোখে চোখ রাখার সময়ই পাই না। কিন্তু যখনই চোখ পড়ে যায় তোমার চোখে। আমাকে ঘিরেই মায়াময় এক স্বপ্নীল ভুবন খুঁজে পাই তোমার ভেতর। আমি তাই ঐ জগতটাতেই অবাধ বিচরণ করতে চাই। আমি তোমার মাঝে স্বপ্ন হয়ে বন্দী হয়ে থাকতে চাই বাস্তবতার রূপে প্রতিক্ষণ।

জাওয়াদ হেসে বলল, এমন কি কোনদিন হয়েছে তুমি আমার কাছে কিছু চেয়েছো আর আমি সেটা তোমাকে দেইনি?

না কখনোই এমনটা হয়নি।

আলহামদুলিল্লাহ। অবশ্য এর দুটি কারণ। এক. তুমি কখনোই এমন কিছু চাওনি যা দিতে গেলে আমাকে  নীতির সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হবে। দুই. তুমি কখনো আমার সাধ্যের বাইরে কিছু দাবী করো না আমার কাছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিচক্ষণতার অলঙ্কারে সজ্জিত করে সৃষ্টি করেছেন তোমাকে। তাই অন্যের জন্য কষ্টকর হতে পারে এমন সবকিছু তুমি শৈল্পিক ভাবে এড়িয়ে যাও। তুমি যদি আমার সঙ্গ এমনি করে দাবী করতে আমি সত্যিই অসহায় হয়ে যেতাম। আমাকে বিপদে ফেলতে চাওনি বলেই তুমি আমার মনেই নিজের আবাস গড়ে নেবার বায়না ধরেছো। জীবনসাথী মনেহয় এমন কাউকেই বলে। যে অবুঝ আবদারও করে জীবনসাথীর সাধ্যের দিকে লক্ষ্যে রেখে। ওয়াদা করছি ইনশাআল্লাহ তুমি সর্বদা আমাতে থাকবে বর্তমান, আমি যেখানেই থাকি তোমাতেই রবে মোর বাসস্থান।  

নূহা আবারো তুমি বৃষ্টিতে ভিজছো? রাহাতের কথা শুনতে পেয়ে সৎবিৎ ফিরে পেলো নূহা। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে অতীতের এক বৃষ্টি ভেজা দিনে গিয়ে নোঙর গেড়েছিল মন টেরই পায়নি। অজান্তেই হয়তো চেয়ার থেকে উঠে বারান্দা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। বৃষ্টির ছাঁট এসে ধরতে গেলে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছিল।

তাকিয়ে কি দেখছো? যাও আগে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করো। রাহাতের তাগাদা শুনে রুমের দিকে পা বাড়ালো নূহা। কিছুক্ষণ পর ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলো ধূমায়িত স্যুপের বাটি নিয়ে রুমে ঢুকছে রাহাত। চেহারায় থমথমে ভাব স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিলো।

নূহা বলল, তোমার চেহারা কেন ভোঁতা?

আমাকে জিজ্ঞেস না করে নিজেকে করো এই প্রশ্ন। তাহলেই জবাব পেয়ে যাবে।

নূহা হেসে বলল, তুমি কি একটা তথ্য জানো?

খুব ভালো করে জানি। গত এক যুগ ধরে শুনে আসছি এই একই ডায়লগ। "দোস্ত কখনোই দোস্তের সাথে করে না রাগ, বন্ধুত্বকে করে গভীর সমঝদারি ও আত্মত্যাগ।"

মাশাআল্লাহ এই তো কত সুন্দর মনে আছে তোমার। তাহলে শুধু শুধু গোসসা কেন করছো? আচ্ছা আজ নতুন আরো দুটা লাইন নোট করো। ‘দোস্ত তোমার অন্তরে আছে ধৈর্য্যশীলতার সিন্ধু, তাই তো আমি জ্বালাই তোমায় প্রতিদিন বিন্দু বিন্দু।'   

রাহাত হেসে বলল, তুমি কেন এমন করো নূহা? ইচ্ছে করে অসুস্থ হয়ে নিজে তো কষ্ট পাওই, সাথে আমাদেরকেও কষ্ট দাও। তোমার হাঁচি শুনে মামণি উঠে এই ভোর বেলায় স্যুপ রান্না করলেন। তুমি বৃষ্টিতে না ভিজলে আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারতেন মামণি।

এই সব দোষ তোমার?

আমার দোষ?

একশো বার তোমার দোষ। তোমাকে আমি গতরাতে কি বলেছিলাম?

কি বলেছিলে?

বলেছিলাম সারাক্ষণ আমার কাছে কাছে থাকতে। যাতে আমি শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার উল্টো পাল্টা কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে পারি। কিন্তু তুমি আমার কথা শোনোনি। সেজন্যই তো এমনটা ঘটেছে।

স্যুপ খেয়ে নাও নয়তো ঠান্ডা হয়ে যাবে। চেহারায় গাম্ভীর্য ধরে রেখেই বললো রাহাত।

তুমি কি সত্যিই রাগ করেছো? রাহাতের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো নূহা।

নূহাকে খানিকটা কাছে টেনে নিয়ে রাহাত বলল, মাঝে মাঝে আমার সত্যিই মনেহয় সব দোষ আসলে আমারই। আমার কারণেই তোমার এত কষ্ট। পরিবারের সবার এত দুঃখ।
এমন মনেহয় কারণ ওই সময় গুলোতে শয়তান তোমার উপর ডানা বিছিয়ে থাকে। এরপর যখনই এমন মনেহবে প্রথমে আউজুবিল্লাহ পড়বে এবং আস্তাগফিরুল্লাহও পড়বে। কারণ একজনের মুমিনের জন্য এমন চিন্তা গোনাহের দ্বার খুলে দেয়।  

রাহাত হেসে বললল, কথায় কে পারবে তোমার সাথে? কথার সাথে মিল রেখে অর্ধেক কাজও যদি তুমি করতে তাহলেই তো এসব ভাবনা মনে আসার সুযোগ পেতো না।

নুহা হেসে বলল, আচ্ছা এই মূহুর্ত থেকে ভালো হয়ে গেলাম যাও। চলো বারান্দায় গিয়ে বসি।

আবারো ভিজার জন্য?

নূহা হেসে বলল, তুমি সাথে থাকলে কি ভুল কাজ করতে দেবে আমাকে? আসলে একটা জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছি তোমার সাথে।

কোন বিষয়ে?

স্বামী জাতির বিষয়ে।  

রাহাত হেসে বলল, আগে স্যুপ খেয়ে নাও।

স্যুপ সাথে নিয়ে নিচ্ছি। কথা বলতে বলতে খেয়ে নেবো ইনশাআল্লাহ।

বারান্দায় এসে বসার পর বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরও নূহাকে নীরব দেখে রাহাত বলল, আমাদের তো আলোচনা করার কথা ছিল।

হুম, ভাবছি কোথা থেকে শুরু করবো। আচ্ছা আমরা কি কিছুটা সময় স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের বাইরে এসে কথা বলতে পারি?

রাহাত হেসে বলল, অবশ্যই পারি। প্রশ্ন করো আমি জবাব দেব ইনশাআল্লাহ।

একজন বিবাহিত পুরুষ বেসিক্যালি কি চায় দাম্পত্য জীবন থেকে?

সব মানুষের চাওয়া যেমন একরকম নয়। তেমনি সব পুরুষের চাওয়াও এক নয়। তবে আমি শুধু শান্তি চাই। সারাদিন পর ঘরে ফিরে যখন তোমার হাসি মুখ দেখি সমস্ত ক্লান্তি মূহুর্তেই কেটে যায়। নিজের কোন চাওয়া যদি অপূর্ণও থাকে মন অস্থির হয় না। কিন্তু যে দিন গুলোতে এর ব্যতিক্রম ঘটে। ঘরে ফিরে তোমাকে তোমার মাঝে পাইনা। সেই দিনগুলো সত্যিই অসহনীয়। সবকিছু ঠিক থাকার পরেও মনেহয় কোথাও কোন ছন্দ নেই।  

এমন দিনগুলোতে মনের শান্তি বজায় রাখার জন্য তুমি কি করো?

ধরে নেই যে এটাই আমার আজকের দিনের পরীক্ষা। অভিজ্ঞতা থেকে জানি ঐ মূহুর্তে তোমার সাথে কথা বলতে যাওয়ার চেয়ে অনর্থক আর কিছুই নেই। তাই তোমার কাছে যাওয়াটাও আমি এড়িয়ে চলি। মনে যাতে ক্ষোভ তৈরি হতে না পারে সেজন্য তিলাওয়াত করি নয়তো নফল ইবাদাত করি। আলহামদুলিল্লাহ মনটা তখন অনেক শান্ত হয়ে যায়। তুমি যখন মন খারাপের খোলস ভেঙে আমার কাছে আসো, পেছনের প্রসঙ্গ টেনে আনা থেকে বিরত থাকি। কারণ কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করা মানেই আবারো তোমাকে মন খারাপের কথা মনে করিয়ে দেয়া। আমি খুব বেশি শান্তি প্রিয় মানুষ। তাই যা আমার না জানলেও চলবে সেটা জানতে গিয়ে শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাতে আমি নারাজ। শান্তিতে থাকার মূল্য যদি তোমার চরিত্রের কিছু অজানা দিক হয়। আই এম ওকে উইথ দ্যাট। 

নূহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এটাই আসলে নিয়ম। যে কোন নেতিবাচক মূহুর্তে শান্তি ও স্বস্থির সন্ধানে আল্লাহর সান্নিধ্যে ছুটে যাওয়া। আবার স্বামী-স্ত্রী হয়েছে বলেই যে একে অন্যের সবকিছু জানতেই হবে এমন ধারণা পরিত্যাগ করা। দরকার নেই এমন কিছু জানতে গিয়েও অকারণ তিক্ততার জন্ম হয় সম্পর্কে। এবং দাম্পত্য অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো উচিত। যদি আমার জানা থাকে আমার পার্টনার বিশেষ একটা সমস্যায় আক্রান্ত। তাতে সেটা নিয়ে কখনোই খোঁচানো ঠিক না। এবং প্রতিটা নেতিবাচক মূহুর্তকেই পরীক্ষা হিসেবে মেনে নেয়া। জীবনে বিপদগুলো তো মূলত পরীক্ষা হিসেবেই আসে। নিজেকে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের পথে আরেকটু এগিয়ে দেবার লক্ষ্যেই আসে। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তখন আমরা আরো দূরে সরে যাই আল্লাহর কাছ থেকে। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা আমি এটা খুব ভালো মতো বুঝি। যে পরীক্ষাটা মূলত আমাদের ঈমানের মজবুতি দান করতে আসে, সেটাই ঈমানকে আরো দুর্বল করে দিয়ে যায়। অথচ একজন ঈমানদারের কি এমন ভঙ্গুর আচরণ শোভা পায়?  

তোমার কি কোন কারণে মন খারাপ নূহা?

নূহা হেসে বলল, উহু, মন ঠিক আছে আলহামদুলিলাহ। আসলে বেশ কয়েক মাস আগে আমার কাছে একজন ক্লায়েন্ট এসেছিল। চমৎকার সুখী জীবনের বিবরণ দেবার পর জানালেন তার স্বামী অন্যকারো সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছে। অথচ ভীষণ ভালোবাসে নাকি স্বামী তাকে। দুই সন্তানের পিতা-মাতাও তারা। এই ধরণের কেসগুলো খুব অস্থির করে তোলে আমাকে। কোন সম্পর্কে যখন ভালোবাসা বর্তমান আছে বলে দাবী করে, সেই সম্পর্কে কিভাবে থার্ড পারসন প্রবেশ করতে পারে? আরেকটা মেয়ে এসেছিল ওর সমস্যা নিয়ে। নিজেদের পছন্দে বিয়ে ছিল তাদের। কিন্তু মেয়েটা যখন কন্সিভ করেছিল তখন থেকে ওর স্বামী বদলে যেতে শুরু করেছিল। বায়োলজিক্যাল নীড পুরণের লক্ষ্যে দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করেছিল। এভাবে বাবা-মায়ের বন্ধনকে দৃঢ় করার ক্ষমতাটা প্রয়োগ করার সুযোগই পেলো না শিশুটি। উল্টো বাবা-মা’র মধ্যে দুরুত্ব তৈরি হয়ে গেলো তার কারণে। আরেকজনকে এসেছিল বিয়ের পর থেকে মনোমালিন্যে ভরপুর দাম্পত্যের দাস্তান শোনাতে। এখানেও একই সমস্যা হাজবেন্ড অন্য রলেশনে জড়িয়ে পড়েছে। এই তিনটা কেসে অন্তঃমিল কি ছিল জানো? তিনজনই নিজ নিজ স্বামীর পরিচয় দিয়েছিলেন প্রাক্টিসিং মুসলিম হিসেবে। আজ তাসমিয়া ওর এক ফ্রেন্ডের বোনের অনেকটা এমনই ঘটনা শোনালো। এখানেও মেয়েটির হাজবেন্ড প্রাক্টিসিং। আমি বলছি না যে কোন ঈমানদার ভুল করতে পারবে না। শয়তান এবং প্রবৃত্তির ধোঁকায় ঈমানদারও ভুলের পথে চলতে শুরু করতে পারে। কিন্তু ভুলের উপলব্ধি হওয়া মাত্র যে তওবা করে সেই পথ থেকে ফিরে আসবে। কিন্তু কেউ যখন ফিরে না আসে, তখন সেটাকে আর ভুল বলার কোন সুযোগ নেই। তখন সেই ব্যক্তিকে ঈমানদার বলারও কোন সুযোগ নেই। যতই তার কপালে নামাজের চিহ্ন চিকচিক করুক না কেন।  

আমিও তোমার সাথে সম্পূর্ণ একমত। ঈমান যখন কারো জীবনাচরিতে পার্থক্য নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়, সেটা আর যাই কিছু হোক ঈমান অবশ্যই নয়। তবে তোমার কেসগুলোর ব্যাপারে যদি বলতে যাই। যদিও আমি তোমার মতো বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু এইটুকু অন্তত বলতে পারি, একটা সংসার গড়তে যেমন দুজন ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ে। ঠিক তেমনি ভাঙতেও দুজনকেই অংশগ্রহণ করতে হয়। দোষ কম-বেশি হতে পারে এটা ঠিক। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দোষ দুজনেরই থাকে এই ধরণের কেসে। তাই স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাথে সাথে স্ত্রীদের এটাও ভাবা উচিত  এমন কি ঘাটতি সংঘটিত হয়েছে তার  দ্বারা যারফলে তার স্বামীকে অন্য নারীর দিকে হাত বাড়াতে হয়েছে। সেকেন্ড যে জিনিসটা সেটা হচ্ছে, যদি স্বামীকে ক্ষমা করা সম্ভব না হয় তাহলে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই উত্তম। যেহেতু আলাদা হবার অপশনও শরীয়ত আমাদেরকে দিয়েছে। কিন্তু যদি ঝড় সহ্য করেও সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে রাগ-ঘৃণা ইত্যাদি সবার আগে ত্যাগ করে নেয়া উচিত। আমি তোমার সাথে সংসারও করবো, আবার তোমাকে ঘৃণাও করবো, তোমাকে অপরাধী ভাববো। এমনটা কখনোই ঠিক না। এই ধরণের সম্পর্ক শুধু যাতনাই বয়ে আনে জীবনে। যদি কেউ সন্তানের কথা ভেবে নিজের অনিচ্ছা সর্ত্বেও এই ধরণের দাম্পত্যের সাথে জুড়ে থাকে। তাতেও কিন্তু কোন লাভ হয় না। বাবা-মা’র তিক্ততা ছায়ায় একজন আদর্শ মানুষ গড়ে উঠতে পারে না বেশির ভাগ সময়ই।

কিন্তু আলাদা হতে না পারার আরেকটা বড় কারণ কিন্তু মেয়েটির অসহায়ত্ব থাকে। অর্থাৎ, মেয়েটির যাওয়ার তেমন কোন জায়গা থাকে না। বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়াও সম্ভব হয় না এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকার কারণে নিজের দায়িত্ব তুলে নেয়ার যোগ্যতাও থাকে না। স্বামীর কাছে আবার এটাই শক্তির কারণ থাকে। যেহেতু তোমার যাওয়ার জায়গা নেই, সেহেতু আমার অনৈতিকতা সহ্য করেও তোমাকে থাকতে হবে।  

রাহাত হেসে বলল, কঠিন অবস্থা! কিভাবে দাও এইসব ব্যাপারে পরামর্শ?

পরামর্শ দেই না কখনোই কাউকে। অপশন বলে দেই।   

সেটা কি রকম?

তুমি যেটা বললে একটু আগে। যদি সংসার ভেঙে ফেলা সম্ভব নাহয় তাহলে সেটাকে গড়ে তোলা। বিদ্বেষের অনলে না জ্বলে, ধৈর্য্যের আলোকিত পথে চলা। যদি কারো সাথে থাকতেই হয় তাহলে ঘৃণা করে থাকার চেয়ে, ক্ষমা করে দিয়ে ভালোবাসার সহিত থাকাটাই উত্তম।

কিন্তু একই সাথে ভীষণ কঠিন এবং কষ্টকর এই কাজ।  

কঠিন আর কষ্টকর বলেই তো পরীক্ষা। তা না হলে তো এটার নাম অন্যকিছু হতো। তাছাড়া বলে না যে, পজেটিভ চিন্তা হচ্ছে সেই মন্ত্র যা ফুঁকে দিলে কঠিন থেকে কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। একজন মানুষ কিন্তু তাকে ঘৃণা করার অসংখ্য কারণের সাথে সাথে তাকে ক্ষমা করে দেবার মতো কিছু কারণও দেয় আমাদেরকে। একজন স্বামী অন্য মেয়ের দিকে নজর দিলেও স্ত্রীর ভরণপোষণের দিকেও তো খেয়াল রাখে। নিরাপদ বাসস্থান, খাদ্য-বস্ত্রের নিশ্চয়তাও তো দেয়। যে মেয়েটির অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, নিজের এক্সট্রা কোন যোগ্যতা নেই তারজন্য কিন্তু খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-নিরাপত্তা হেলাফেলার জিনিস নয়। দুনিয়াটা অনেক খারাপ জায়গা এর কারণ ভালো মানুষেরা আড়ালে আবডালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। খারাপরা যেভাবে নিজেদের খারাপ সত্ত্বাকে জাহির করে। ভালোরা পুরোই তার উল্টো। তাদের ভালোমানুষী না আবার কোন বিপদ টেনে আনে জীবনে এই ভয়ে তারা নাক-কান-চোখ বন্ধ করে দুনিয়াতে বিচরণ করে। এমন মূক-বধির আর অন্ধ ভালো মানুষের ভরা সমাজে একটি মেয়ে তার পরিবারে এবং কাছের মানুষদের দ্বারাই ফিজিক্যালি, মেন্টালি অ্যাবিউজড হচ্ছে অহরহ। সেখানে বাইরে কে তার নিরাপত্তা দায়িত্ব নেবে? নারীবাদীরা বড় বড় লেকচার লেখা আর দেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তারা পুরুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার আহ্বান দেয়। কিন্তু একটি নারীকে তার সন্তান সহ ভরণপোষণ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কি দিতে পারে? আমি তাই মনেকরি যে, ‘নারী-পুরুষ দ্বন্দ্ব, করতে হবে বন্ধ। উভয়ে মানলে শরীয়ত, দুনিয়াটাই হবে জান্নাত’। আর যারা শরীয়ত মেনে চলতে ইচ্ছুক তারা জীবনে আপতিত ছোট-বড় সব ধরণের দুর্ঘটনাকে পরীক্ষা হিসেবেই দেখে। এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভরসা এবং ধৈর্য্যের সাথে মোকাবিলার মাধ্যমে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার চেষ্টা করে। 

তারমানে সম্পর্কের মাঝে দুরুত্ব সৃষ্টিতে নিজের ঘাতটি গুলোকে খুঁজে বের করতে হবে সর্বপ্রথম। অতঃপর সেগুলো দূর করার সাথে সাথে ধৈর্য্যশীলতার সাথে সম্পর্কে মাধুর্য্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এটাই তো?

এবং স্বামীকে প্রাক্টিসিং ভাবা থেকে বিরত থাকতে হবে। বুঝতে হবে তার স্বামী একজন মুমিন বান্দাহ নয় বলেই এই ধরণের ভুল থেকে ফিরে আসতে পারছে না। সুতরাং, তাকে ফিরে আসার জন্য সহায়তা করতে হবে। সে তো প্রাক্টিসিং, সবই বোঝে তাহলে কেন ভুল করলো ইত্যাদি ভাবার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীকে একে অপরের পোশাক বলা হয়েছে। এই পোশাক শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও হতে হবে। সম্মুখে গর্ত দেখলে আমি নিজে যেমন সতর্ক হবো, তোমাকেও করবো। কারণ তোমার পতন আমাকেও প্রভাবিত করবে। ঠিক তেমনি অন্যায় ও ভুলের জন্য আমি নিজে যেমন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করি। ঠিক তেমনি কোন মানুষের কাছ থেকে আমি অনুতপ্ত হবার অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারিনা। কেউ যখন আমার কোন অতীত ভুলের কথা স্মরণ করে সেটার আলোকে আমাকে বিচার করে, তখন আমি যেমন ব্যথিত হই। ভাবি যে, এটা আমার প্রতি জুলুম করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি অন্য কাউকেও তার ভুলের দ্বারা পুনঃপুনঃ বিবেচনা করা পরিহার করতে হবে। হ্যা এটা ঠিক যে বিশ্বাসে ফাটল ধরলে সেটা আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াটা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সুখের জন্য বিদ্রোহ, মিটিং, মিছিল করার চেয়ে মনেহয় অবশ্যই সহজ।  

তাছাড়া নিজের ভুলগুলোকে ভালো করে এনালাইসিস করলেও কিন্তু লড়ার জন্য কিছুটা বাড়তি শক্তি পাওয়া যায়। আসলেই তো সংসারে একজনের জন্য কিছু করার অর্থ পরোক্ষ ভাবে সেটা নিজের জন্যই করা। তোমার মনেহয় এমন একটা প্রশ্নবিদ্ধ কবিতা আছে। 

কোনটা?

বিবেকের আয়নায় চেয়ে দেখেছো কি নিজের প্রতিচ্ছবি? যা বলে লোকে, যা ভাবে লোকে মিলেছে কি তার সবি? সত্য মিথ্যা মিলেমিশে গড়ে তোলেনি তো নতুন আবাস? ভালোবাসার সাথে ঘৃণাও যে করে মনের ঘরে বসবাস! প্রতিশোধের অগ্নিশিখা অন্যেকে পুড়িয়ে নিজেকে করে ক্ষয়!  আগুনে পুড়ে যেমন ইট হয়ে মাটি হারায় নিজের পরিচয়!  তপ্ত দাহ, ধূধূ বালুচর, শুষ্ক বাগান, ফেটে চৌচির মনের ভূমি! আল্লাহর রঙে রঞ্জিত অন্তরেই বয় কেবল ভালোবাসার সুনামি।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আসলেই সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান শরীয়তের মধ্যেই নিহিত। যদি আল্লাহর রঙে নিজেদেরকে রাঙিয়ে নিয়ে পারতাম তাহলে নিজেরা যেমন ভুলের পথ থেকে দূরে থাকতে পারতাম। তেমনি অন্যের ভুল ক্ষমা করে দেবার মতো উদার হতে পারতাম। ভাইয়া ছোটবেলায় বলেছিলেন, কারো ভুল ক্ষমা করতে না পারাটা যতটা না সেই ব্যক্তির দোষ, তারচেয়ে অনেক বেশি আমাদের মনের অনুদারতা ও ক্ষুদ্রতা দায়ী। 

রাহাত হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ ভাইজানের কথা সবসময়ই মনে দস্তক রেখে যায়। আচ্ছা আমি এখন পালাই।

কেন?

রাহাত হাসতে হাসতে বলল, মামণি আসছেন এদিকে। তোমার আশেপাশ থাকলে আমিও বকা খাবো। স্যুপ আনতে গিয়ে অলরেডি একবার বকা খেয়েছি তোমাকে মারধোর করিনা কেন সেজন্য। বকাঝকার এই সেশন তাই শুধুই তোমার। বলতে বলতে উঠে রুমের দিকে হাঁটা দিলো।

নূহা হাসি মুখে মামণির বকাঝকা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন