সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...১২

যথেষ্ট বড় হয়েছো তুমি! এখন এই ধরণের আহ্লাদ করার বয়স আর নেই ভুলে গেলে তো চলবে না বিয়ে হয়ে গিয়েছে তোমার কথায় কথায় এত রাগ-অভিমান এখন আর মানায় না বুঝেছো?

কেন
মানায় না? বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে কি মনের আবেগ প্রকাশের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাওয়া? জীবনের সব আনন্দ-উচ্ছ্বাস- হাসি-দুষ্টুমির অবসান হয়ে যাওয়া?

প্রশ্ন
শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে নূহাকে দাঁড়ানো দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আজরা। জুনি সুযোগ পেয়ে নূহার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, দেখো না আপ্পা আম্মু শুধু শুধু আমাকে সেই কখন থেকে বকাঝকা করছে। কিছু হলেই আম্মুর শুধু একই কথা। বিয়ে হয়ে গিয়েছে এখন এটা করা মানায় না, ওটা করা সাজে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি আম্মুকে বুঝিয়ে বলো বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে মনের আবেগ প্রকাশের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাওয়া নয় মোটেও।

নূহা
জুনির মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলল, কিন্তু তারআগে আমাকে জানতে তো হবে তোমাদের মা-মেয়ের ঝগড়ার কারণ। আজরা ভাবী আই এম সরি। আমি আর তাইয়্যেবা আসলে পেছনের বাগানের দিকে যাচ্ছিলাম। আপনাদের কথা শুনতে পেয়ে ইন্টারফেয়ার না করে পারিনি।

আজরা
হাসি মুখে বলল, সরি বলছো কেন নূহা? খুব ভালো হয়েছে তুমি আসাতে। আমিও জুনিকে নিয়ে তোমার কাছে যাবার কথাই ভাবছিলাম। তুমি কি জানো ইমাদের সাথে রাগ করে জুনি চলে এসেছে তোমাদের সাথে?
নাতো! জুনি আমাকে এই ব্যাপারে কিছুই বলেনি। সাথে আসতে চেয়েছিল তাই নিয়ে এসেছি। জুনি কি হয়েছে তোমার আর ইমাদের?

জুনি
অভিমানী কন্ঠে বলল, আপ্পা ইমাদ একটুও ভালোবাসে না আমাকে। বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা নেই আমার কোন কিছুর প্রতি। সবসময় কষ্ট দিয়ে কথা বলে। শুধু কষ্টই না, ইনসাল্ট করে কথা বলে। গতরাতে বলেছে আমি দেখতে নাকি রক্ত পিপাসু ড্রাকুলার মতো। এরআগে একদিন বলেছে আমার হাসির শব্দে নাকি বাড়ি ধ্বসে যাবে। আমার কোন কিছুই ওর ভালো লাগে না। তাহলে শুধু শুধু কেন থাকতে যাবো ওর কাছে? তাই আমি আম্মুর কাছে চলে এসেছি। কিন্তু আম্মুও আমাকে কথা শোনাচ্ছে। ইমাদকে যে আমাকে এত কথা শোনালো। আমার যে কতটা কষ্ট হয়েছে সেসব বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না আম্মু। উল্টো লেকচার দেয়া শুরু করেছে, বিয়ে হয়ে গিয়েছে এখন একটু স্বভাব বদলাতে চেষ্টা কর! এখন থেকে এভাবে চলবে, ঐভাবে বলবে, এটা করবে না, সেটা ভাববে না! ইত্যাদি ইতাদি! বিয়ে জিনিসটা তাহলে কি আপ্পা? জেলখানা? কয়েদি হয়ে ছোট্ট একটু পরিসরে বন্দি থাকা কি বিয়ের শর্ত? মায়ের কাছেও নিজের কষ্ট প্রকাশ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায় বিয়ের পর? বলতে বলতে ঝরঝর অশ্রু নেমে এলো জুনির দুচোখ বেয়ে।

মেয়ের
চোখে অশ্রু দেখে আজরার চেহারাও বেদনাক্ত হয়ে উঠলো। অসহায় চোখে নূহা আর তাইয়্যেবার দিকে তাকালো। জুনির কথা শুনে এবং কান্না দেখে নূহাও কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। এরপর বলল, তাইয়্যেবা জুনিকে নিয়ে বাগানে যাও তুমি। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি ইনশাআল্লাহ।

হাত
বাড়িয়ে জুনিকে ধরে তাইয়্যেবা হাসি মুখে বলল, চলো জুনি। মুখে কিছু না বলে চুপচাপ তাইয়্যেবার সাথে হাঁটতে শুরু করলো জুনি। দুজন কিছুটা দূরে চলে যাবার পর নূহা বলল, কখনো কখনো কাউকে বোঝানোর চেয়ে তাকে বোঝাটা বেশি জরুরি ভাবী। পরামর্শ দেবার আগে অন্যের কথা ভালো মতো শুনে নেয়াটা তেমনি শর্ত। আর এখানে তো আপনারা দুজন মা, মেয়ে। মা যদি মেয়ের কথা শোনার আগেই তাকে দোষারোপ করতে শুরু করে, তাহলে নিজের অবুঝ ভাবনাগুলো নিয়ে মেয়ে কোথায় যাবে?

এখন
বুঝতে পারছি আমার সত্যিই খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। আসলে ইমাদের সাথে রাগ করে চলে এসেছে শুনেই আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। একটুতেই রাগ করার, অভিমান করার স্বভাব জুনির। তাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম
এমন পরিস্থিতিতে অবশ্যই বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু মনের অবুঝ আবেগের উপর যখন বুঝ চাপিয়ে দেয়া হয়। তখন সেটা বোঝাতে পরিণত হয়। তাই অবুঝকে বোঝানোর চেষ্টা না করে তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এরপর সেই বুঝটাকেই কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে তাকে বোঝানোর জন্য।

আজরা
হেসে বলল, এত বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান কি আর আমাদের আছে?

নূহাও
হেসে বলল, এটা আসলে জ্ঞানের ব্যাপার নয় ভাবী। সমস্যাটা মূলত, খুব কম সময়ই আমরা অন্যেকে বোঝার চেষ্টা করি। বেশির ভাগ সময়ই নিজের বুঝটাকে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করি। মানসিকতাটা অনেকটা এমন যে, সবাই আমাকে বুঝবে, আমার অনুভূতিকে মূল্য দেবে। আমি কেন অন্যেকে বুঝতে যাবো? অন্যের অনুভূতি বিবেচনা করতে যাবো? অথচ অন্যেকে বোঝার মাধ্যমে, তার অনুভূতিকে মূল্য দেবার মাধ্যমে। খুব সহজেই আমরা নিজের মূল্যায়নও করিয়ে নিতে পারি।

হ্যা।
আমার এখন সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে জুনির সাথে রাগ করার জন্য।

আপনিই
চিন্তা করে দেখুন ভাবী, একটা মেয়ে যার চোখে হাজারো স্বপ্ন, মনে ফুল-পাখী-প্রজাপতি- রংয়ের ছড়াছড়ি। যার বাঁধনহারা মনটা মুক্ত বিহঙ্গের ডানা মত মেলে উড়তে চায়, খেলা করতে চায় মেঘেদের কোল ঘেঁষে, গাঁথথে চায় তারার মালা, ভিজতে চায় জোছনার শিশিরে! বিয়ে নামক শব্দটার মাঝে কি এতই জোর যে সব কেড়ে নেবে তার মন থেকে? এই একটা বন্ধনের কাছে বাঁধা পরে যাবে জীবনের সব স্বপ্ন? সব শখ? সব আনন্দ? কে সেট করেছে বিয়েতে এই কন্ডিশন? বিয়ে হতে পারে জীবনের একটি অধ্যায়ের নব সূচনা। কিন্তু একজন মানুষের নব জন্ম তো নয় যে, আমূল বদলে যাবে সে বিয়ের পর। নতুন এক ভুবনের পথ উন্মুক্ত হবার কথা যে বন্ধনের দ্বারা, সেই বন্ধনটাই যদি আস্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে, চোখের সামনে নোটিশ বোর্ড ঝুলিয়ে দেয় এটা করতে পারবে না, ওটা তোমাকে মানায় না, বিয়ে হয়ে গেছে তারমানে অনেক বড় হয়ে গিয়েছো তুমি। হাসি-আনন্দ-উল্লাস এখন অশোভন তোমার জন্য! ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে কিভাবে সেই বন্ধনে স্বতঃস্ফুর্ততা আসবে? এখন জুনি কিছু বলতে এলেই যদি আপনি বলতে শুরু করেন, বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাই এটা করতে পারবে না, ওটা করতে পারবে না। এরফলে তো বিয়েকেই নিজ জীবনের সব সমস্যা আর কষ্টের মূল কারণ হিসেবে ধরে নেবে জুনি। বর্তমান জেনারেশনের মনে বিয়ে ভীতির একটা মূল কারণ কিন্তু এটাও। আশেপাশে যেদিকেই তাকায় তারা বিয়ের কারণেই নানান ভাবে ভুক্তোভোগী দেখতে পায় বিভিন্ন জনকে। কিন্তু বিয়ে তো মূলত সমস্যা না। সমস্যা মানুষগুলোর মাঝে। বিয়ের বিধানে কোন জটিলতা নেই। জটিলতা, কুটিলতা যা কিছু বিয়েতে জুড়েছে, তার সবই মানুষের তৈরি। আর মানুষের বানানো নিয়মনীতি কখনোই জীবনে সুখ-স্বস্থি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তাই মেয়ে জামাইয়ের সাথে রাগ করে চলে এসেছে শুনে প্রেস্টিজ ইস্যুর কিছুই নেই। মানুষ কি বলবে তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মেয়ে খুশি মনে আবার জামাইয়ের কাছে ফিরে যাওয়া। আর সেজন্য আগে মেয়েকে বুঝতে হবে, এরপর বোঝাতে হবে।

আজরা
হেসে বলল, তুমি তো একদম অভিজ্ঞ মা-শ্বাশুড়ির মতো কথা বলছো।

নূহা
হেসে বলল, জুনি তো আমার মেয়ের মতোই। জাওয়াদের কাছেও জুনি ভীষণ স্পেশাল। মনে নেই আপনার জুনির বিয়ের দিন উনি কান্না করতে করতে অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন? নাবিহার বিয়ে সময় কি করবেন ভেবে এখনই আমি শঙ্কিত বোধ করি মাঝে মাঝে।

আজরা
হেসে বলল, হ্যা মনেআছে। জাওয়াদ ভাইজান নিজের মেয়ের মতোই বড় করেছেন জুনিকে। আমিও মাঝে মাঝে ভেবে শঙ্কিত হই, জীবনের চরম দূর্ভোগের সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যদি ভাইজানকে না পাঠাতেন। তাহলে দুই মেয়ে নিয়ে আমি কোথায় যেতাম, কি করতাম? বাবা-মা তো ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন। ভাইদের অমতে বিয়ে করেছিলাম জুনির আব্বুকে। ভাইয়েরা এরপর আর কোনদিন যোগাযোগ করেননি। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি খুশি মনেই মেনে নিয়েছিলেন আমাদের বিয়ে। কিন্তু জুনির জন্মের তিন বছর পরেই মারা গেলেন দুজনই অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে। জুনির আব্বুর কোন ভাই-বোনও ছিল না। দুই মেয়ে নিয়ে অনেক সুখেই কাটছিল আমাদের জীবন। কিন্তু একদিন জুনির আব্বুও চলে গেলেন আমাদেরকে ছেড়ে। জুনির তখন ছয় বছর বয়স আর জুবির দুই বছর। টুয়েলভ শেষ করার আগেই বিয়ে করেছিলাম এরপর আর লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। ছিল না কোন আত্মীয়-স্বজন, বয়সও অনেক কম ছিল। অথৈ সাগরে পড়েছিলাম দুই মেয়ে নিয়ে। তুমি তো সবই জানো।

নূহা
আজরার হাত ধরে বলল, হুম! সময়টা অনেক কষ্টের ছিল। কিন্তু জীবন তো আঁধারে ঢাকা পড়ে থাকেনি। আলহামদুলিল্লাহ নতুন সূর্যোদয়ে আবারো তো জীবন স্নাত হয়েছে আপনাদের। তাই না?

অশ্রুসিক্ত
কন্ঠে আজরা বলল, আলহামদুলিল্লাহ। সবসময়ই দোয়া করি ভাইজানকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উত্তম প্রতিদান দিন। ইনশাআল্লাহ আমি এখন থেকে খেয়াল রাখবো জুনির বিষয়টা। নিজে কিছু বলার আগে ওর কথা প্রথমে শোনার বোঝার চেষ্টা করবো তখন থেকে শুধু আমাদের কথাই বলছি। তুমি কেমন আছো বলো?

নূহা
হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তবে এখন যেতে হবে আমাকে। কিছুক্ষণ পর মিটিং আছে আমাদের। তারআগে জুনির সাথে কথা বলতে চাইছি কিছুক্ষণ। রাতে ইনশাআল্লাহ গল্প করবো। আজরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেন্টারের পিছনের বাগানে এসে দাঁড়ালো নূহা। তাইয়্যেবা বোঝানোর চেষ্টা করলেও কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিল জুনি। এই মূহুর্তে কিছু বোঝাতে না যাওয়াটাই ভালো মনেহলো নূহার। তাছাড়া মূল ঘটনাটা জানা জরুরি যে কোন কিছু বোঝানোর জন্য। জুনির সাথে কথা বলে বড়জোর এক তরফা জানা যাবে। ইমাদের তরফ থেকেও জানতে হবে আসলেই কি ঘটেছিল। জাওয়াদকে কি বলবে ইমাদের সাথে কথা বলতে? নিজেকেই প্রশ্ন করলো নূহা। জুনি, জুবি দুজনকেই নিজের সন্তানদের মতোই দেখেন জাওয়াদ। মেঝ মামার প্ল্যান করা সেই এক্সিডেন্টে মৃত ডক্টরদের মধ্যে একজন জুনির বাবাও ছিলেন। ফিরে আসার পর এক্সিডেন্টে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের সবার পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করেছিলেন জাওয়াদ। নিজ সাধ্যানুযায়ী তাদের জন্য যা যা করণীয় ছিল। এখনো পর্যন্ত করে যেতে চেষ্টা করছেন যথাযথ। অন্য আর সবার তুলনায় আজরার অবস্থাই সবচেয়ে বেশি নাজুক ছিল। আজরাকে দুই মেয়ে সহ তাই বাড়িতেই নিয়ে এসেছিলেন জাওয়াদ। এর বছর তিনেক তাদের পর দূর সম্পর্কের কাজিনের সাথে আজরার বিয়ের ব্যবস্থাও করেছিল জাওয়াদ। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত খুব সুখেই আছে দুই মেয়েকে নিয়ে আজরা। যুবাইরও নিজ সন্তানের চেয়ে কখনোই আলাদা করে দেখেনি জুনি জুবিকে। কিন্তু তারপরও জাওয়াদ সবসময়ই এক্সট্রা কেয়ার করে ওদের। ইমাদের সাথে জুনির বিয়ের সিদ্ধান্ত পরিবারের সবাই মিলেই নিয়েছিল। ছোট ভাইদের মধ্যে ইমাদ সবচেয়ে বেশি নরম মনের দায়িত্বশীল স্বভাবের ছেলে বলে জাওয়াদও পছন্দ করেছিল জুনির জন্য। যদিও নূহার মনে হয়েছিল জুনির জন্য চটপটে, আমুদে স্বভাবের লাইফ পার্টনার হলেই বেশি ভালো হতো। বারবার ভেতর থেকে তাগাদা আসার পরেও নিজের মনের ভাবনাটা বলতে পারেনি জাওয়াদকে। কিন্তু এই মূহুর্তে মনেহচ্ছে, বলাটা জরুরি ছিল। তাহলে জাওয়াদ অন্তত আরেকবার যাচাই করে দেখতো ফাইলান সিদ্ধান্ত নেবার আগে। এখন আর এসব কথা ভেবে কি হবে? ভাবনাদের ছুটি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে জুনির মাথার হাত রাখতেই কান্নার বেগ আরেকটু বেড়ে গেলো জুনির। নূহা হাসি মুখে বলল, এই বোকা মেয়েটা কাঁদছে কেন?

তাইয়্যেবা
হেসে বলল, এই প্রশ্নটা অলরেডি বিশ থেকে পঁচিশবার করেছি আমি। জবাব তো দেয়ইনি উল্টো প্রতিবার কান্নার গতি আরেকটু করে বেড়েছে।

তোমাদের
হাজবেন্ড যদি তোমাদেরকে রক্ত পিপাসু ড্রাকুলা বলতো তাহলে আর এমন করে হাসতে পারতে না। অভিমানের জলোচ্ছ্বাসের মতো বেরিয়ে এলো জুনির কথাগুলো।

অবশ্যই
এমন করে করে হাসতাম না। এমন কিছু বললে আমি তৎক্ষনাৎ গলা চেপে ধরে হিশহিশয়ে বলতাম, আজ তোমাকে বোঝাবো রক্ত পিপাসু ড্রাকুলা কাকে বলে, কত প্রকার এবং কি কি পদ্ধতিতে তারা রক্তের পিপাসা মেটায়। নূহার কথা শুনে তাইয়্যেবা হেসে ফেললেও, জুনি অভিমানে গাল আরেকটু খানি ফুলিয়ে বসলো। নূহা হেসে বলল, সিরিয়াসলি নিশ্চয়ই ইমাদ এমন কথা তোমাকে বলেনি তাই না? অবশ্যই ফান করে বলেছে। মানছি ফান করেও এমন কথা বলা ঠিক নয়। ইমাদকে আমি বুঝিয়ে বলবো যাতে আর কখনো তোমাকে ফান করে এমন কিছু না বলে। ঠিকআছে?

না
ঠিক নেই। শুধু বললে হবে না। তুমি ওকে বকেও দেবে

বকে
তো দেবোই। আমিও তো সারাক্ষণই সবাইকে বকাঝকা করার বাহানা খুঁজি। এত বড় একটা সুযোগ বুঝি ছেড়ে দেবো? কক্ষণো না। কিন্তু সেজন্য তো আগে ইমাদকে হাতের কাছে পেতে হবে। আপাতত ইমাদ যেহেতু আশেপাশে নেই তাই ওর কথা বাদ। চলো আমরা কিছুক্ষণ খালিপায়ে ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটি।

জুনি
হাসি মুখে বলল, আমি খালি পায়ে হাঁটতে গেলে হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে যাবো। কিছুদিন আগে আমাদের বাগানে খালি পায়ে হাঁটতে চেষ্টা করেছিলাম। ভীষণ সুড়সুড়ি লাগছিল পায়ে।

নূহা
হেসে বলল, এক সময় আমার সাথেও এমনটাই হতো। ঘাসে পা দেবার আগেই হাসি এসে যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কোন কিছু ট্রাই করার মজা কোথায় জানো? সেটা আয়ত্ত্বের মাঝে এসে যাওয়াতে। নিজে ভালো থাকাটা, অন্যেকে ভালো রাখাটাও অনেকটা এমন। প্রথম প্রথম একটু কঠিন লাগে কিন্তু ট্রাই করতে করতে রপ্ত করে ফেলা যায়। তখন চারপাশে বিস্তৃত খারাপের মাঝেও খারাপ থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন কিছু হয়ে দাঁড়ায়। ভালো থাকার ইচ্ছেগুলো কেমন যেন নাছোড় বান্দার মতো পিছনে লেগে থাকে। উফফ, কি যে এক যন্ত্রণা সেটা। একটা নূহুর্তের জন্য মন খারাপ করে বসে থাকবে সেই সুযোগও দেবে না তোমাকে। নানান যুক্তি নিয়ে হাজির হয়ে যাবে তোমার কাছে। তারপর কানের ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকবে।
জুনি হেসে বলল, সেটা কিভাবে আপ্পা?

সেটা
কিভাবে? আচ্ছা তোমার উদাহরণ দিয়েই বোঝাই। যেমন ধরো ইমাদ এমন কিছু একটা বলেছে কিংবা করেছে। যেটা তোমার খুবই অপছন্দ। যেই তুমি রাগ করতে যাবে ভালো থাকার ইচ্ছে হাজির হয়ে শুরু করে দেবে নানান যুক্তির প্রদর্শন। যেমন, কোন মানুষের পক্ষেই সর্বদা অন্যের অপছন্দীয় কাজ বর্জন করে চলা সম্ভব নয়। কেউ কোন কারণে কষ্ট দিয়ে ফেলাটা মোটেই তার ভালোবাসাহীনতার প্রমাণ দেয় না। হয়তো এই মূহুর্তে ব্যথা দিয়ে ফেলেছে নির্বুদ্ধিতার কারণে। কিন্তু তার দেয়া সুখের পরিমাণ এরচেয়ে অনেক বেশি। হয়তো মুখে ভালোবাসি, ভালোবাসি বলতে পারে না সারাক্ষণ। কিন্তু ভালো রাখার কোন একটি সুযোগও হাতছাড়া হতে দেয় না। হয়তো মানুষটা হুবহু মনের মতো নয়। কিন্তু মনের মানুষ হবার মতো অসংখ্য গুণ তার আছে। এমন আরো নানান যুক্তি দেখিয়ে তোমাকে বাধ্য করবে রাগটাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো বাইরে বের করে দিতে। এবং বাতাস থেকে অক্সিজেনের মতো ভালোবাসা মিশ্রিত ক্ষমা টেনে নিতে।

এটাকে
কি নিজে ভালো থাকা বলে নাকি অন্যের প্রতি ভালোবাসা? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো তাইয়্যেবা

নূহা
হেসে বলল, জীবনে অসংখ্য বার অসংখ্য জন ভালোবাসার সংজ্ঞা জানতে চেয়েছে বিভিন্ন সময় অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা বলেছিও অনেককেই। সেসব আসলে বলার জন্য বলা। না ঠিক তাও না। কেউ শুনতে চেয়েছে তাই বলা। নিজ থেকে, নিজ উপলব্ধি থেকে যেদিন জানতে চেয়েছিলাম মনেহয়েছিল, ভালোবাসা আসলে অনেকগুলো উপকরণের সংমিশ্রণে তৈরি অতি উপাদেয় কিছু। যা একই সাথে মনের মাল্টিপল ঘাটতি দূরীকরণের ক্ষমতা রাখে। বিনি সুতোয় গাঁথা নানান ধরণের আবেগের মালা হচ্ছে ভালোবাসা। এমন একটা অনুভূতি যে অনুভূতির মাঝে অবগুণ্ঠিত থাকে অসংখ্য অনুভূতি। এই মিশ্র অনুভূতিকে অনুভব করার দক্ষতার উপর নির্ভর করে কারো ভালোবাসার ক্ষমতা

জুনি
হেসে বলল, ভালোবাসা তো তাহলে বিরাট কঠিন কাজ আপ্পা। তবে আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কথা।

নূহা
হেসে বলল, বুঝতে পারলে আলহামদুলিল্লাহ। তবে ভালোবাসা এক রহস্যঘেরা গোলকধাঁধা, এত দ্রুত না করাই উত্তম তার সমাধা। নামতা জানা থাকলেও সাথে ক্যালকুলেটর নিয়ে বোস, অতঃপর কর গুনে গুনে অতি সাবধানে হিসাব মিলাও বৎস।
তাইয়্যেবা আর জুনি হেসে ফেললে নূহাও হেসে বলল, তাহলে এখন তুমি হিসাব-নিকাশ করো। আমাদের মিটিংয়ের সময় হয়ে গিয়েছে। পরে আমরা এই বিষয়ে ডিটেইল কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। জুনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নূহা আর তাইয়্যেবা কনফারেন্স রুমের দিকে রওনা দিলো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন