সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৩২



চার সন্তানকে হাস্যেজ্জল চেহারা স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই বুকের ভেতর ভালোবাসা ছলকে উঠলো জাওয়াদের। মাত্র এক সপ্তাহ পেরিয়েছে কিন্তু মনে হচ্ছিলো কত যুগ যেন পেরিয়ে গিয়েছে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে ধরেনি। আদরে আদরে ভরিয়ে তোলেনি ছোট্ট প্রাণ গুলোকে। ওদের পরশের সিক্ততা ছড়িয়ে পড়েনি প্রশান্তির কণা হয়ে সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। চারজনের সম্মিলিত সালামের জবাব দিয়ে জাওয়াদ বলল, হ্যালো কিডস। আপনাদেরকে চেনা চেনা লাগছে। আগে ঠিক কোথায় দেখেছি বলেন তো আপনাদেরকে?   

জিহাদ, জিশান, জারিফ, নাবিহা চারজনই হেসে কুটিকুটি হলো পাপার প্রশ্ন শুনে। জিহাদ হাসতে হাসতে বলল, আপনার হৃদয়ের মাঝে যে ছোট্ট একটা ঘর আছে সেখানে দেখেছেন মনেহয়। ওই ঘরের চারপাশের চারটা দেয়াল হচ্ছি আমরা চারজন।

জাওয়াদ বিস্ময় মাখা স্বরে বলল, রিয়েলী? ওকে দ্যান লেট মি চেক। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন ভাণ করার পর হাসি মুখে জাওয়াদ বলল, আরে তাই তো আমার মনের ঘরের চারটা দেয়াল তো দেখছি আপনাদের চারজনকে দিয়ে তৈরি। এজন্যই তো এত চেনা চেনা লাগছে। তা কেমন আছেন আপনারা? কেমন কাটছে আপনাদের দিন-কাল?

জারিফ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ পাপা আমরা খুব ভালো আছি। আমাদের দিনকাল ফাটাফাটি কাটছে। সারাদিন অনেক মজা করি আমরা। কিন্তু তোমাকে ভীষণ মিস করছি। তুমি কবে আমাদের কাছে আসবে পাপা?  

জাওয়াদ হেসে বলল, এই তো সোনা পাপার কাজ প্রায় শেষ। আর চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই এসে যাবো তোমাদের কাছে ইনশাআল্লাহ।  

জিশান হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। পাপা জানো পরশু রাতে আমরা লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম। আমরা চারজন, মা আর বাবা। দুইটা পর্যন্ত বাইরে ঘুরেছি আমরা। এরপর রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাসায়  এসেছি। ছবি পাঠিয়েছিলাম তো তোমাকে। দেখোনি?

আলহামদুলিল্লাহ দেখেছি তোমাদের পাঠানো ছবি। মনে হচ্ছিলো আমিও এনজয় করছি তোমাদের সাথে।

নাবিহা হেসে বলল, তুমি তো সবসময়ই আমাদের সাথে থাকো পাপা। জানো পাপা আমরা বাবাকে একদিনও কাজে যেতে দেইনি। মামণিকেও অন্য কারো সাথে গল্প করতে দেই না। মামণি অন্য কোথাও গেলেই আমরা গাল ফুলিয়ে বসে থাকি। তাই মামণি এখন সারাক্ষণ আমাদের সাথে থাকে। আমরা চারজন আর মামণি মিলে সারাক্ষণ বাবাকে যন্ত্রণা করি।

চারজনের সম্মিলিত হাসির সাথে জাওয়াদও হাসলো। হাসতে হাসতে বলল, খুব বেশি দুষ্টু তোমরা সবাই। কিন্তু মামণিকে বাড়ির অন্য সবার সাথেও সময় কাটাতে দিও অল্প অল্প। 

নাবিহা বলল, আচ্ছা দেবো এখন থেকে। কিন্তু তুমি আগে মামণির বিচার করো। মামণি কি করে জানো? প্রতিদিন রাতে আমরা ঘুমিয়ে যাবার পর জিহাদ ভাইয়ার সাথে একা একা গল্প করে। আবার কবিতাও গিফট করে ভাইয়াকে আমাদেরকে না জানিয়ে। গতরাতে আমরা হাতে নাতে ধরে ফেলেছি দুজনকে। তুমি মামণির কাছে কৈফিয়ত চাও। শুধু ভাইয়ার জন্য কবিতা কেন? আমরা কি দোষ করলাম?  

জাওয়াদ হাসি চেপে বলল, জিহাদ ঘটনা কি সত্যি?

জিহাদ বলল, পাপা ওরা তিনজন আমাকে মা’র কাছে যেতেই দেয় না। সেজন্য আমি আর মা ওরা ঘুমিয়ে যাবার পর গল্প করি। গতরাতে মা আমাকে আমার ছোটবেলার গল্প শোনাচ্ছিলো তখন একটা কবিতা উপহার দিয়েছে। ওরা সেটা নিয়েও ঝগড়া করছে আমার সাথে। ওরা যে সারাক্ষণ মাকে ঘিরে বসে থাকে আমি কি সেটা নিয়ে অভিযোগ করি কখনো? অথচ আমি আর মা ওরা ঘুমিয়ে যাবার পর একটু গল্প করি সেটা নিয়েও ওদের আপত্তি। পাপা তুমি ওদের বিচার করো। 

জাওয়াদ হেসে বলল, আগে কবিতা শোনাও আমাদেরকে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কার বিচার হবে আর কাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে।

জিহাদ হেসে বলল, এক্ষুণি শোনাচ্ছি পাপা। আমার মুখস্ত আছে পুরোটাই। মা বলেছে, “তোর তরে রাখবো পেতে মোর আঁচলের ছা্য়া, বিছিয়ে দেবো পথে পথে হৃদয় ছোঁয়া মায়া। চাঁদের আলো হয়ে চোখে নামিয়ে যাবো ঘুম, দিনের বেলা সুর্য হয়ে নয়নে দেবো চুম। মমতা জাগাতে এসেছিস কোল জুড়ে, ভালোবেসে রাখবো তোরে আমারই অন্তরে। তোর প্রতীক্ষার প্রহর গুলো বলবো সুরে সুরে, কখনো তুই যাসনা সোনা মাকে ছেড়ে দূরে। বহু যাতনায় পেয়েছি তোরে জীবনও আঁধারে, অশ্রু ভেজা সহস্র শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে”।

জিহাদ যখন কবিতা পড়ছিল জিশান, জারিফ, নাবিহা তখন চেহারা আঁধার করে, গাল ফুলিয়ে, ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। তিনজনের চেহারার অবস্থা দেখে হাসি সামলাতে পারলো না জাওয়াদ। জিহাদকে বাদ দিয়ে তখন পাপার দিকে একই ভঙ্গিতে তাকালো তিনজন। জাওয়াদ হাসতে হাসতে  বলল, আচ্ছা আমার ফোন এসেছে। এই অপরাধের বিচার আমি ফিরে এসে করবো ইনশাআল্লাহ।

পাপার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিশান, জারিফ, নাবিহা জিহাদের দিকে তাকিয়ে কনিষ্ঠা আঙ্গুল উঁচু করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, তোমার সাথে আমরা গোসসা, গোসসা, গোসসা। তোমার সাথে তাই কাট্টি, কাট্টি, কাট্টি। বলা শেষ করেই ধুপধাপ করে তিন ভাইবোনকে বেরিয়ে যেতে দেখে হেসে ফেললো জিহাদ। তারপর তিনজনের পেছন পেছন হাঁটা দিলো।

@

বাচ্চাদেরকে পাপার সাথে গল্পে মশগুল হতে দেখে সেই সুযোগে নূহা বাইরে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ করেই চার ভাইবোন একেবারে গেদু বেবিদের মতো আচার-আচরণ শুরু করেছে। সারাক্ষণ চারপাশে ঘুরঘুর করে। মূহুর্তের জন্য নূহা অন্য কোনদিকে গেলেই চিৎকার শুরু করে চারজন একসাথে। দুষ্টু বাচ্চারা একসাথে মিলে জোট বেঁধে মায়ের পেছনে লেগেছে সেটা খুব ভালো মতোই বুঝতে পারছিল নূহা। কিন্তু সত্যি বলতে নিজেও খুব এনজয় করছিল বাচ্চাদের কোল ঘেঁষা স্বভাব। বাড়িতে থাকলে সকাল দিকটায় বোন-ভাবীরা সবাই মিলে বাগানে বসে গল্প করে। রুম থেকে বেরিয়ে তাই বাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো নূহা। ছোট ভাই রিফাতকে মুখ ভার করে বাইরে থেকে ফিরতে দেখে ডাক দিলো নূহা। কাছে এসে সালাম দিয়ে রিফাত বলল, কেমন আছো আপা?

সালামের জবাব দিয়ে নূহা বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি তো ভালো আছি। কিন্তু তোর চেহারার এই অবস্থা কেন?

মনটা খুব বেশি খারাপ লাগছে আপা।

কেন কি হয়েছে?

তোমার মনেআছে আপা কয়েক মাস আগে আমার এক ফ্রেন্ড নিশাদের কথা বলেছিলাম তোমাকে?

হ্যা মনেআছে। কেন কি হয়েছে নিশাদের? 

তোমাকে তো বলেই ছিলাম ওদের পরিবারের কেউই ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলে না। কিন্তু আমাদেরকে দেখে নিশাদ নিজেকে একজন আদর্শ মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ওর আগ্রহ দেখে আমি আর মুহিব আমাদের পক্ষে যত ধরণের সাহায্য করা সম্ভব ওকে করেছি। ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তনও এসেছিল। কিন্তু আজ ইউনিভার্সিটিকে একটা মেয়ের সাথে ওকে খুবই আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছি। এরপর থেকে আমার মন খুব খারাপ লাগছে। নিশাদের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না আমি। ওকেও জানিয়ে দিয়ে এসেছি এই কথা।

নূহা হেসে বলল, বুঝতে পারছি তোর অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। আসলে আমি তোর অবস্থাটা ফিলও করতে পারছি। কেন জানিস? কারণ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী প্রায়ই হতে হয় আমাকে। একজনকে ঠেলতে ঠেলতে হয়তো সিঁড়ির দশ ধাপ উঠিয়েছিলাম। একদিন দেখি আবারো সে নীচে ধূলোবালিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কারো পেছনে এতখানিক কষ্টের পর তার এমন পতন মেনে নেয়াটা সত্যিই অনেক কষ্টকর।

হ্যা, আমারো খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে আপা। সাত মাস ওর পেছনে এত কষ্ট করলাম কিন্তু চারিত্রিক দুর্বলতা কাটিয়েই উঠতে পারলো না।

গল্প শুনবি? চল তোকে একটা গল্প শোনাই। চীন দেশের এক বাঁশের গল্প। চীনে এক ধরণের বাঁশ গাছ আছে যাদের লাগানোর পর প্রথম চার বছর নিয়মিত পানি, সার দিতে হয়। যদিও এই চার বছরে বাঁশ গাছটি বাড়ে না। কিন্তু পঞ্চম বছরে বাঁশ গাছটি হঠাৎ ছয় সপ্তাহে ৯০ ফুট লম্বা হয়ে যায়। এর অর্থ কি দাঁড়ায়? এমনটাই যে, যদিও বাইরে থেকে কোন পরিবর্তনই পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু বাঁশ গাছটি ঠিকই পাঁচ বছর ধরে একটু একটু করে শক্তি সঞ্চার করেছে বেড়ে উঠার জন্য। এখন যদি বাইরে থেকে বাড়তে না দেখার কারণে পানি ও সার দেয়া বন্ধ করে দেয়া হতো তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াতো? অবশ্যই গাছটি মারা যেত। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর যাবত প্রয়োজনীয় যত্ন নেয়া হয়েছিল বলেই যথা সময়ে গাছটির বেড়ে উঠা সম্ভব হয়েছিল। কি বুঝলি গল্প থেকে? 

কিছুই বুঝিনি আপা। 

নূহা হেসে বলল, কারণ তুই এখন বেশ আপসেট। আসলে কি জানিস? আমরা অনেক সময় মানুষকে সত্যের পথে দাওয়াত দিতে গিয়ে একটুতেই হাল ছেড়ে দেই। তাৎক্ষনিক পরিবর্তন না দেখার কারণে ভেবে নেই যে, পরিবর্তন অসম্ভব। অথচ আমরা জানি না কখন, কাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাহমা'র চাদরে জড়িয়ে নেবেন। তার উপর হেদায়াত নাজিল হবে এবং সে সত্য ও সুন্দরের পথিকে পরিণত হবে। তাই মানুষের পরিবর্তনের ব্যাপারে কখনোই আশা ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা মানুষেরা সেহেতু খুবই অস্থির প্রাণী তাই কারো পেছনে ধৈর্য্য ধরে বেশিদিন লেগে থাকতে পারিনা। কিছু একটা করলেই তাৎক্ষণিক প্রতিফল পেতে চাই। কিন্তু শান্ত মনে ভেবে দেখ তো ফসল না বুনে কি কখনো ফলন ঘরে তোলা যায়? কাজ না করলে কি তোকে কেউ বেতন দেবে? খাওয়ার জন্য কি আগে রান্না করতে হয় না? ভেবে দেখ প্রতিটা ক্ষেত্রেই কিন্তু আগে পরিশ্রম তার বদলে ফল। কারন এটাই আসলে নিয়ম। কিছু পেতে চাইলে আগে কিছু দিতে হয়। মানবিক সম্পর্ক গুলোর ক্ষেত্রে যেমন এই নিয়ম, ঠিক তেমনি কাউকে সত্য ও সুন্দরের পথে দাওয়াত দেবার ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম। কারো কাছ থেকে ভালো কিছু পেতে চাইলে আগে তাকে ভালো কিছু দিতে হবে। কিন্তু ভালো কিছু দেবার সাথে সাথেই বদলে ভালো কিছু আশা করা যাবে না। কারণ যে কোন জিনিস প্রসেসিং এ কিছু সময় তো লাগেই তাই না? তুই’ই ভেবে বল বীজ বোনার সাথে সাথেই কি ফল ধরতে শুরু করে? তাহলে সত্য ও সুন্দরের পথে আহ্বান করা মাত্রই অপর পক্ষ থেকেও ইতিবাচক সাড়া মিলবে এমন আশা করাটাও কি ভুল নয়? অবশ্যই ভুল। ফসল যেমন একদিনেই ঘরে তোলা যায় না। ঠিক তেমনি একদিনেই কাউকে বদলে দেয়া সম্ভব হয় না। গাছ থেকে ফল পাবার আশায় যেমন নিরলস শ্রম দিয়ে যেতে হয়। ইতিবাচকতার প্রভাবে কারো নেতিবাচকতা দমনের জন্যও প্রয়োজন হয় আন্তরিক সাধনার। বুঝিয়াছেন আমার গোল্লু গোল্লু ভাইয়াটা?

রিফাত হেসে বলল, আমার আপা বোঝাবে আর আমি বুঝবো না এটা কি সম্ভব?

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আসলে যারা শরীয়ত বোঝেন না তাদেরকে চাইলেই চোখের পলকে শরীয়তের বিধান বোঝানো সম্ভব হয় না। যারা শরীয়তের গন্ডির বাইরে অবস্থান করে তাদেরকে শরীয়তের ভেতর টেনে আনতে চাইলে তাই অনেক বেশি মানসিক জোরের প্রয়োজন। কারণ বার বার তারা ভুল করবে, পুরনো অভ্যাসে সাড়া দিয়ে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। এই যেমন ধর সবসময়ই রামাদান শেষ হয়ে যাবার পর প্রথম কয়েকটা দিন আমার সাথে বেশ মজার একটা কান্ড হয়। সেটা হচ্ছে, খাবার বা পানি মুখে দিয়েই চমকে উঠে ভাবি হায় আল্লাহ আমি না রোজা। পরক্ষণেই যখন মনেহয় রামাদান তো শেষ, তখন একা একাই হেসে ফেলি। এবার রামাদান শেষ হয়ে যাবার পর একদিন এমন পানি পান করার সময় চমকে ওঠার সাথে সাথে মনেহলো, আমরা কত দ্রুতই কোন জিনিসের সাথে নিজেদের অ্যাডজাস্ট করে ফেলি। এরফলে বিপরীত কিছু করতে গেলেই ভেতর থেকে অটোম্যাটিক নির্দেশ আসে যে, তুমি অন্যরকম কিছু করতে যাচ্ছো। ভেবে দেখ কতই না ভালো হতো যদি উত্তম গুণাবলী গুলোর সাথে এমনি করে নিজেদের অ্যাডজাস্ট করে ফেলতে পারতাম আমরা। তাহলে যখনই নেতিবাচক কিছু করতে যেতাম অটোম্যাটিক হয়তো এমন করে ভেতর থেকে বাঁধা আসতো। ঠিক একই কথা আমাদের বদভ্যাস গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যখন আমরা খারাপ কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি তখন সেটা করার সময় আর ভেতর থেকে কোন বাঁধা আসে না। কেননা সেটাই স্বাভাবিক থাকে। তাই কাউকে খারাপ থেকে ভালোতে অভ্যস্ত হবার সুযোগ দিতে হবে।  

আলহামদুলিল্লাহ আমি বুঝতে পেরেছি আপা। আমি তাহলে এখনই ইউনিভার্সিটি চলে যাই। এক ঘন্টা পর আমার একটা ক্লাসও আছে। নিশাদের সাথে রাগ করার ফলে মন খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই ক্লাস বাদ দিয়েই চলে এসেছি। এখন যেয়ে ক্লাস করি এরপর নিশাদের সাথেও কথা বলবো।

নূহা হেসে বলল, ঠিকআছে যা। ফিরে এসে আমাকে জানাস কি কথা হলো তোদের। ভাইকে বিদায় জানিয়ে বাগানে দিকে হাঁটতে শুরু করলো নূহা। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলো বোন আর ভাবীরা সব গল্প করছে বসে। সবার কাছে পৌঁছে সালাম দিয়ে নূহা বলল, কি ব্যাপার সবার মুখে হাসি অথচ রাহার মুখ ভারি?

তাইয়্যেবা হাসতে হাসতে বলল, নূহা আজকের সকালের তাজা খবর হচ্ছে, রাহা আর রাফি ভাইয়ার গরমা গরম ফাইট।

বোনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো নূহা। তারপর বলল, ভাবীজানেরা চলেন আপনাদেরকে মজার একটা গল্প শোনাই। রাহা আর রাফি ভাইয়ার বিয়ে গল্প।

রাহা কপট রাগের স্বরে বলল, নূহা ভালো হবে না কিন্তু সবার সামনে আমার মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি করলে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, ভাবীজানেরা আপনাদের মধ্যে যারা যারা আমাদের পরিবারে নতুন প্রবেশ করেছেন। তারা কি জানতে চান কোন সেই দিন যেদিন রাহার গগন বিদারক চিৎকারে আমাদের আনন্দবাড়ি থরথর করে কেঁপে উঠেছিল?

সবাই একসাথে বলল, অবশ্যই জানতে চাই।  

তাহলে শোনেন। সেই দিনটি হচ্ছে যেদিন রাফি ভাইয়ার সাথে রাহার বিয়ে পাকাপাকি হয়েছিল। জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে কান্না করছিল আর একই কথা বলছিল, আমি  বিয়ে করবো না। মরে গেলেও বিয়ে করবো না। একই কথা বার বার শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে মামণি কঠিন গলার বললেন, মরে গেলে তোকে কেউ বিয়ে করতে বলবেও না। থাপ্পড় খেতে না চাইলে কান্নাকাটি বন্ধ কর ড্রামা কুইন। রাহা তখন আরো জোড়ে জোড়ে কান্না ধরলো।   

ভাবীদের সবাইকে হেসে গড়িয়ে পড়তে দেখে রাহা বলল, নূহা ভালো হচ্ছে না কিন্তু। তোমার অনেক গোপন তথ্য কিন্তু আমার কাছে আছে। সব কিন্তু মাইকিং করবো পুরো এলাকা জুড়ে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আগে তোমার কাহিনী শেষ হোক। এরপর নাহয় আমারটা শুনে দেখবো। ভাবীরা এরপর শোনেন। পুরো দুই দিন এক নাগাড়ে এমন কান্নাকাটি করলো রাহা বিয়ে করবে না বলে। কিন্তু বাড়ির কাউকেই গলাতে পারলো না। তখন নানান ধরণের যুক্তি প্রদান করতে শুরু করলো। যেমন, বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স আঠারো কিন্তু ওর সতেরো হতেও চার মাস বাকি। কম বয়সে বিয়ে হলে একটা মেয়ের কি কি সমস্যা হতে পারে সেসব বলেও বাড়ির কারো মন গলাতে ব্যর্থ হলো। বাল্যবিবাহ অপরাধে সবাইকে জেলে পাঠাবে সেই হুমকি ধামকি দিলো। কিন্তু তাতেও সুবিধা করতে পারলো না। বিয়ে ভাঙার সবরকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে গুম ধরে বসে রইলো দুই দিন। বাড়িতে বিয়ের আয়োজন শুরু হবার দিন থেকে আবার শুরু করলো ক্ষণেক কান্না, ক্ষণেক দীর্ঘশ্বাস, ক্ষণেক আহাজারি। যেমন, আমি কি অপরাধ করেছি যে এত অল্প বয়সে আমাকে তোমরা জোড় করে বিয়ে দিচ্ছো? তোমরাই তো বলো বিয়ে কোন ছেলে খেলা না। এরজন্য অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। আমি এখন প্রস্তুত নই বিয়ের জন্য। মামণি বললেন, বিয়ের পর তোকে প্রস্তুত হবার জন্য সময় দেয়া হবে। তোর বাবার ইচ্ছে সে সুস্থ্য থাকতে থাকতে তোদের সব বোনদের বিয়ে দিয়ে যাবার। রাহা তখন বলল, এমন অদ্ভুত ইচ্ছের কোন মানেই হয় না। দুনিয়াতে হাজার হাজার এতিম মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না? নাকি বাবা না থাকলে মেয়েদের বিয়ে হতে পারবে না এমন কোন আইন আছে? মামণি বললেন, তুই বিয়ে নিয়ে এত আপত্তি করছিস কেন সেটা আমাকে খুলে বল। কাউকে পছন্দ করিস? রাহা আস্তাগফিতুল্লাহ বলে বিকট চিৎকার দিলো। মামণি বললেন, তাহলে তোর সমস্যা কি? রাহা বলল, সমস্যা ঐ গলা লম্বা জিরাফকে আমি বিয়ে করতে চাই না। মামণি বললেন, ফাজিলের মত কথা বলিস না। রাহা রাগে কিড়মিড় করে বলল, আমি তোমাকে বলে রাখছি যদি আমাকে বিয়ে দাওই। এক কোপে আমি ঐ জিরাফের ধর থেকে কল্লা আলাদা করে ফেলবো। 

রাহা হাসি চেপে উঠে চলে যাবার চেষ্টা করলে সবাই মিলে টেনে ধরলো। নূহা হাসতে হাসতে বলল, এ তো গেলো মামণির সাথে চিল্লাপাল্লা। আমাদের বোনদের যাকেই সামনে দেখতো পারলে কাঁচা খেয়ে ফেলে এমন ভাব করতো। কারণ রাহার যুক্তি ছিল আমরা যদি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতি তাহলে আমাকে আজ বাল্যবিবাহের স্বীকার হতে হতো না। বিয়ে ভাঙ্গার অন্যসব বুদ্ধি ব্যর্থ হবার পর আমার কাছে এসে খুবই নরম সুরে বলল, নূহা ভাইয়ারা একমাত্র তোমার কথাই  শুনবে। প্লিজ সবাইকে বুঝিয়ে বল যাতে বিয়েটা ভেঙে দেয়। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আর কেনই বা এখন আমি বিয়ে করবো? একটা যুক্তি দেখাও আমাকে বিয়ের স্বপক্ষে? আমি বললাম বাবা চাইছেন এই একটি যুক্তিই কি যথেষ্ট নয় তোমার কাছে? তাছাড়া বিয়ের পর তুমি তো দূরে কোথাও যাচ্ছো না। তুমি চাইলে বাড়িতেও থাকতে পারো। তখন এই বাড়িতে কেউ আমাক বোঝে না, কেউ আমাকে ভালোবাসে না। ইত্যাদি বলতে বলতে আবারো কান্না জুড়ে দিয়েছিল। ঐদিকে বেচারা রাফি ভাইয়া তো রাহার এইসব কান্ড কারখানা দেখে ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছিলেন। আদী ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলল, ভাইয়া রাহা যেহেতু চাইছে না তাহলে নাহয় থাক এখন। বিয়েটা আমরা কিছুদিন পিছিয়ে দেই। জবাবে আদী ভাইয়া বলল, তুই পাগল হয়েছিস? কিছুদিন পিছিয়ে দিলে লাভের মধ্যে যা হবে তা হচ্ছে এইসব ড্রামা আবার দেখতে হবে। সুতরাং, যেদিন নির্ধারিত হয়েছে যেদিনই বিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। চিল্লাপাল্লা করে বাড়িটাকে মাছের বাজার বানিয়ে রাখে এই মেয়েগুলো। এইটা বিদায় হলেই শান্তি আর শান্তি। শান্তি প্রতিষ্ঠার এত বড় সুযোগকে পিছিয়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তারচেয়ে তুই যা গিয়ে একটা গজ ফিতা নিয়ে আয়। রাফি ভাইয়া গজ ফিতা দিয়ে কি হবে জানতে চাইলে আদী ভাইয়া বলল, তোর হবু বউ সারাক্ষণ কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে ভাইয়া আমি জিরাফ বিয়ে করবো না, জিরাফ বিয়ে করবো না। আরে কি যন্ত্রণা। তোর গলা আসলেই লম্বা কিনা মেপে দেখবো। মেপে যেটুকু বেশি হবে ফায়েজ কিংবা জাওয়াদ সার্জারী করে ঠিক করে দেবে। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, দুই সপ্তাহ ধরে এই সমস্ত কর্মকান্ড করার পর বিয়ের দিন ম্যাডামজ্বি একেবারে ভদ্র মেয়ে। কাজী সাহেব বলার আগেই পারলে কবুল বলে ফেলে অবস্থা। আর বিয়ের দু'দিন পরেই সেকি ভাব রাফি ভাইয়ার সাথে।  

উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো রাহাও হেসে ফেললো। এরপর সবাই মিলে গল্পে মশগুল হলো। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন