সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২৬




কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে? কে জানিত সঙ্গীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দ ধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে? কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে, অতলস্পর্শ কাল সমুদ্রের উপর একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে?” মুনার ঘরে কদম রাখতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলে যাওয়া খুব প্রিয় বাণীটি মনে পড়ে গেলো নূহার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে মুগ্ধ হওয়া থেকে নিজেকে কিছুতেই বিরত রাখতে পারলো না মুনার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, মনেহচ্ছে তোমার না আমি বুঝি আমার রুম দেখছি বিয়ের আগে আমার রুমের ডিজাইন, ডেকোরেশন সবকিছু একদম এই রকম ছিল

মুনা হেসে বলল, আমি তোমার রুম দেখেই নকল করেছি আপি। মনে নেই আমাকে তোমাদের বাড়ির ভিডিও দেখিয়েছিলে?

হুম, মনে আছে

আমার সেদিন ভীষণ ভালো লেগেছিল তোমার রুমের সবকিছু। তুমি যখন এখান থেকে চলে গিয়েছিলে খুব বেশি মিস করতাম তোমাকে। এতটা মিস আমি জীবনে কাউকে কোনদিন করিনি। খুব অল্প দিনের সম্পর্ক ছিল আমাদের। কিন্তু অল্প দিনেই তুমি আমাকে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলে। আমাকে জীবনের মূল লক্ষ্যের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলে। আমি নিজেকে তোমার মতো করে গড়তে চেয়েছিলাম। নিজের রুম থেকেই শুরু হয়েছিল আমার সেই সফর।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু সেলফে রাখা থরে থরে বই কি শুধু সাজানোর জন্য নাকি পড়াও হয়?

বই পড়াকে যথার্থ হিসাবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর এই বাণীটা তুমিই আমাকে একদিন বলেছিলে। সময় বই পড়ার কথা চিন্তা করলেই আঁতকে উঠতাম আমি। কিন্তু গত পনেরো বছরে আমি নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে বদলে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আপি। এখন বই আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। তোমার মত এখন আমিও বলি, দিনে কমপক্ষে একটা বই কচকচ করে চিবিয়ে না খেলে আমার মন নির্ঘাৎ মারা পড়বো খাদ্যাভাবে। তবে শুধু বই পড়া না আমি সবদিক দিয়ে তোমার মতো হতে চেষ্টা করেছি।

নূহা হেসে বলল, আমার মতো? আমার মতো কেন? মানুষের কখনোই অন্যের মতো হবার চেষ্টা করতে নেই। প্রতিটি মানুষের মনোজগৎ ভিন্ন ভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি মানুষের রেসিপি আলাদা। মাংসের রেসিপিতে যেমন মাছ কখনোই সুস্বাদু লাগতে পারে না। তেমনি অন্য কাউকে নিজের মধ্যে ধারণ করেও ব্যক্তি শান্তি-স্বস্থি লাভ করতে পারে না প্রকৃত অর্থে। সারাক্ষণই ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করে। জাজমেন্ট কাজ করে নিজেকে ঘিরে। প্রতেক্যের তাই তার নিজের মতোই হওয়া উচিত। তাছাড়া অন্যের মতো আসলে প্রকৃত অর্থে হওয়াও যায় না। তবে চেষ্টা সাধনা দ্বারা আমরা সবাই নিজের মতো হতে পারি। তুমি কখনোই আমার আমি হতে পারবে না। কিন্তু তুমি তোমার তুমি অবশ্যই হতে পারবে। আর ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমি একদম আমার মতোই, এটা জীবনের মৌলিক সার্থকতা সমূহের একটি।

তুমি তো এতদিন ছিলে না আমাকে এভাবে বুঝিয়ে বলার জন্য।

আলহামদুলিল্লাহ এখন তো এসেছি। এই মূহুর্ত থেকে শুরু করে দাও তোমার তুমি হবার সফর। ক্যানভাস, রঙ-তুলি এসব তোমার? তুমি পেইন্টিং করো?

মুনা হেসে বলল, হ্যা আপি আমি পেইটিং করাও শিখেছি। একদিন তুমি ছবি আঁকার সময় আমি গিয়েছিলাম তোমার বাসায়। সেদিন বলেছিলে, মনের কল্পনা গুলোকে তুলির আঁচড়ে, রঙের ছোঁয়ায় সাদা ক্যানভাসের বুকে ফুটিয়ে তোলার ফাঁকে মনের আশার নদীতে জোয়ার আসে। বিশ্বাস জাগে, মনের স্বপ্নগুলোকেও এমনি করেই বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারবো ইনশাআল্লাহ। আমিও এই উদ্দেশ্যে নিয়েই পেইন্টিং শিখেছিলাম। আজ স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই, আমি অনেক ভুল করেছি আপি। না চাইতেও তোমার কষ্টের কারণ হয়েছি। কিন্তু একই সাথে আমি তোমাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবেসেছি, ভালোবাসি এখনো। কারণ তোমার কাছেই জীবনে প্রথম সত্যিকার ভালোবাসার স্বাদ অনুভব করেছিলাম। তুমিই আমাকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর পথে নিয়ে গিয়েছিলে। তখনও তুমি আমার হাত ছেড়ে দাওনি, যখন আমার মনের অসৎ ইচ্ছের কথা জানতে পেরেছিলে।

নূহা হেসে বলল, আমার বাবা বলেন, জগতে প্রতিটা মানুষ সেকেন্ড চান্সের অধিকার রাখে। কাউকে তার অধিকার দেয়া থেকে কখনোই বঞ্চিত করো না। তাই এত বিগলিত প্রশংসার দরকার নেই। আমি তোমাকে সেকেন্ড চান্স দিয়েছিলাম কারণ সেটা তোমার অধিকার ছিল। অবশ্য এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা কারণ ছিল। সেটি হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তোষ অর্জন। তোমার প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর জন্যই ছিল, আছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই আমাকে শক্তি দিয়েছিলেন তোমার হাত ধরে রাখার। আল্লাহ যেমন আমাদের পরীক্ষা নেন। ঠিক তেমনি সেই পরীক্ষা জয়ের শক্তিও আল্লাহই আমাদেরকে দেন।

কিন্তু তোমার পরীক্ষাটা কি খুব বেশি কঠিন হয়ে গিয়েছে না আপি? তোমার জীবনটাকে আল্লাহ এমন করে দিলেন কেন? আমি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। মনেহয় এটা জুলুম হয়ে গিয়েছে তোমার উপর।

আলহামদুলিল্লাহ আমার এখন আর মনে হয়না। প্রথম দিকে বয়স যখন আরো কম ছিল, আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না, ভাবনারা নিজেকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খেতো, ভাবতাম আমার পরীক্ষাটা খুব বেশি কঠিন। এই বোঝা বহন আমার জন্য জুলুমের নামান্তর। আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন, এই উপলব্ধিটার উপর বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন কোনই সন্দেহ নেই, আল্লাহর প্রতিটি পরীক্ষার অন্তরালে আমাদের জন্য কল্যাণই নিহিত থাকে। বেশির ভাগ সময়ই আমরা সেই কল্ল্যাণ খুঁজে নিতে পারি না, কারণ আমাদের দৃষ্টি শুধু নিজের মাঝেই নিবদ্ধ থাকে। শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গীকে একটুখানি চেঞ্জ করলেই স্পর্শ করা যায় সেই কল্যাণের অস্তিত্বকে।

তুমি কি সত্যিই খুঁজে পেয়েছো তোমার জীবনকে আমূল বদলে দেয়া ঘটনার পেছনের কল্যাণকে?

উহু, খুঁজে পাইনি। কিন্তু আমি কল্ল্যাণকে খুঁজে নিতে চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করি। ঠিক বলেছো ঘটনা আমার জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল। পৃথিবী নামক এই গ্রহের ভেতর আমার ছোট্ট আরেকটি পৃথিবী ছিল আনন্দবাড়ি নামে। আমার জীবন ছোট্ট পৃথিবীকে ঘিরেই আবর্তিত ছিল। বাকি পৃথিবীর ব্যাপারে আমার না কোন ধারণা ছিল, না কোন আগ্রহ। আমি আমার নিজ জীবনে আপনজনদের ভিড়েই খুশি ছিলাম, পরিপূর্ণ ছিলাম। মানুষের ব্যথা আমাকে ব্যথিত করতো তাই কখনো বাড়ির বাইরে বের হলেও চোখ, কান বন্ধ রেখে চলতাম। কিন্তু এক্সিডেন্টটা আমাকে পরিবারের গন্ডি থেকে বের করে বাইরের জগতে নিয়ে এসেছিল। আমাকে বাইরের মানুষের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। এক্সিডেন্ট আমার জীবনে না ঘটলে আমি হয়তো কখনো জানতামই না বেদনারও এত রঙ আছে। আমার মনের আকাশে ভালোবাসার রঙধনুর পাশে একটা বেদনার রঙধনুও নিজ অস্তিত্ব গড়ে তুলেছিল। তা না হলে মানুষের বেদনাকে এত গভীর ভাবে অনুভব করতে পারতাম না হয়তো। আমি নৈরাশ্যের দমবন্ধকর অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতাম না। যারফলে প্রকৃত অর্থে আশা জাগানিয়া হতে পারতাম না। অন্ধকার যে কতটা ভীতিকর অজানাই থেকে যেত। তাই সুবহে সাদিকের সন্ধানে কারো পথ চলার প্রেরণা হতে পারতাম না। মনের রুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে কারো মনে আলোকিত বাতায়ন রূপে নিজেকে প্রতিস্থাপন করতেও পারতাম না। হতাশার সূর্যাস্তে আমি সুহাসিনী ভোরের স্বপ্ন বুনতে পারতাম না। আমি হয়তো কখনোই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হতাম না। দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে যে মানুষগুলো আমার কাছে এসে পৌঁছেছিল। তাদের তরে সুশীতল আশ্রয় হতে পারতাম না। আমার প্রতিজন ক্লায়েন্টের হাসি মুখে আমি কল্ল্যান খুঁজে পাই মুনা। আমার স্টুডেন্টরা যখন মনের এলোমেলো অগোছালো অবস্থা নিয়ে ছুটে আসে আমার কাছে। ফেরার পথে যখন ওদের চোখে আবারো স্বপ্ন চিকচিক করতে দেখি, আমি কল্ল্যাণ খুঁজে পাই। আমার জীবনের প্রতিটি বেদনার উপলব্ধিকে যখন অন্যের জীবনে আশির্বাদ হয়ে যেতে দেখি। অনুভব করি, কতই না জরুরি ছিল বেদনাটা আমার জন্য। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, ইনশাআল্লাহ এই সবকিছুর উত্তম প্রতিদান আমি সেদিন নিশ্চয়ই পাবো, যেদিন সবচেয়ে বেশি দরকার পড়বে।

আলহামদুলিল্লাহ। আমি এভাবে কখনোই ভেবে দেখিনি আপি।

নূহা হেসে বলল, এখন থেকে এভাবে ভাবার চেষ্টা করে দেখো। দেখবে প্রতিটা সমস্যার মাঝেই সম্ভাবনা খুঁজে পাবে। তোমার নিজের জীবনের কথাটাই চিন্তা করো। একজন বিবাহিত মানুষের প্রতি ভালো লাগাটা তোমার ভুল ছিল। তবে ভুলটাই কিন্তু তোমার জীবনকে ফুলেল পথে টেনে নিয়ে এসেছে। এভাবে সরাসরি বলার জন্য দুঃখিত। কিন্তু তোমার সাথে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলার চেয়ে সরাসরি কথা বলাটাই উত্তম মনে হয়েছে।

জ্বি আপি সরাসরি কথা বলাই ভালো।

নূহা হেসে বলল, তাহলে বলো ফুলেল পথের মোড়ে একা দাঁড়িয়ে আছো কেন এখনো? কেন নির্ভরযোগ্য কারো হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছো না? এখন তোমার জীবন যুগল স্রোতে প্রবাহিত হবার দাবী রাখে। তোমার আম্মুর সাথে কথা হয়েছে আমার। আন্টি বললেন, তুমি বিয়ে করতে নারাজ। কিন্তু কেন?

মুনা কোন কথা না বলে মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলো। বেশি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর হাসি মুখে নূহা বলল, জানো খুব ছোটবেলায় শখ করে গান শিখেছিলাম। মামণির এক বান্ধবী বাসায় এসে হামদ, নাত, গজল শেখাতেন আমাদের বোনদেরকে। আন্টির কাছেই প্রথম জেনেছিলাম যে, গান হচ্ছে একটা শিল্প। আর শিল্পর প্রয়োগে শিল্পী হতে প্রয়োজন অনেক সাধনার। সত্যি অনেক সাধনা করেছিলাম। সেই সময় আইসক্রিম খুব পছন্দ করতাম কিন্তু কণ্ঠস্বর খারাপ হয়ে যাবে সেই ভয়তে আইসক্রিম খেতাম না। কুসুম গরম পানি, আদা, লেবু, মধু, যষ্টিমধু আরো কত কি খেতাম সুন্দর কণ্ঠস্বরের জন্য। আর সকালে উঠে খালি গলার ---- সেতো ছিলোই। এইসব কষ্ট খুব মনের আনন্দ নিয়ে করতাম কারণ আমার শখ ছিলো শিল্পী হবার। আর মানুষ যখন মন থেকে কোন কিছু হতে চায়, তখন তারজন্য নিরলস পরিশ্রম করে যেতে পারে। আমিও পেরেছিলাম। আর সেই কষ্ট ত্যাগের ফল স্বরূপ কিছু পুরষ্কার, আপনজনদের আন্তরিক উৎসাহমূলক প্রশংসা, স্পেশ্যাল মূল্যায়ন যোগ হয়েছিলো জীবন ঝুলিতে।

মুনা হেসে বলল, এখন তাহলে আমাকে গান শোনাতে হবে। 

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা শোনাবো কোন এক সময় ইনশাআল্লাহ। আবার ছোটবেলা থেকেই রান্নার ভীষণ শখ ছিল আমার। স্বপ্ন দেখতাম সবাই আমার রান্না খেয়ে পরিতৃপ্তির ধ্বনি তুলছে। সবচেয়ে পছন্দ করতাম যেই মানুষটির রান্না তাকে গিয়ে ধরেছিলাম আমাকেও তার মত রাঁধুনী বানিয়ে দেবার জন্য। উনি হেসে বলেছিলেন, আমার রান্না মজা হবার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমি রান্না করতে ভালোবাসি। উপভোগ করি রান্না করাটাকে। আসলে উপভোগ না করলে মানুষের কোন গুণ বিকশিত হয় না পরিপুর্ণ ভাবে। কারণ কোন কিছুকে উপভোগ না করলে মানুষ সেই কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। আর মন যেখানে অস্থির বা অমনোযোগী সেখান থেকে ভালো কিছু আশা করাটাই আসলে ঠিক না। তাই কোন কিছুতে পারদর্শী হতে সেই জিনিসকে ঘিরে মনে সুখ সুখ আবেশ থাকাটা খুব জরুরি। তাই ভালো রান্না করতে হলে তোমাকে সবার আগে ভালবাসতে হবে রান্নাকে। কেননা রান্না একটি সাংঘাতিক আর্ট। একদম ছবি আঁকার মতো। মনের মাধুরী মিশিয়ে যে শিল্পকে রূপদান করতে হয়। রান্না সেরা শিল্প। কেননা রান্নাতে কিন্তু শুরু স্বাদ না অনেক কিছু আনতে হয়। দৃষ্টি ,ঘ্রাণ, স্বাদ তিনটি ইন্দ্রিয় সমান ভাবে কাজ করে এই শিল্পে। রান্নাকে আমি ছবি আঁকার মতই বহু যতনে আয়ত্ত্ব করতে চেষ্টা করেছি এরপর থেকে। মানুষের মন নিয়ে স্টাডি করতে করতে একদিন মনেহলো, শিল্পর প্রয়োগে শিল্পী হতে হলে সেই সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন। প্রয়োজন যোগ্যতা দক্ষতা অর্জনের। এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন চেষ্টার। নিরলস ভাবে লেগে থাকার ইচ্ছার। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যার প্রচেষ্টা যত বেশি থাকে, সে তত বেশি সফল হয়। ঠিক তেমনি ভালো থাকতে জানাটাও মনেহয় এক ধরনের শিল্প। কেননা এমন অনেক মানুষকে দেখেছি যারা ভালো থাকার জীবনাপোকরণে ভরপুর থাকা স্বত্ত্বেও হতাশা-নিরাশায় দিনযাপন করছে। জীবনকে ঘিরে শুধুই হাহাকার ধ্বনি তোলে তারা। আবার কিছু মানুষ দেখেছি যারা জীবনাপোকণেরর সন্ধানে ছুটে চলছে একরাশ তৃপ্ততা নিয়ে। তাদের কণ্ঠে সর্বদা ধ্বনিত হয়আলহামদুলিল্লাহ আসলে কি জানো?

কি আপি

ভালো যে আছি সেটা বুঝে নিতে জানতে হয়, শিখতে হয়। আর সেজন্য প্রয়োজন হয় জ্ঞানের। প্রয়োজন হয় যোগ্যতা দক্ষতা অর্জনের। দরকার হয় প্রচণ্ড চেষ্টা নিরলস লেগে থাকার ইচ্ছার। ত্যাগ করতে হয় অনেক অনেক কিছুকে। তা না হলে কখনোই অর্জন করা যায় না মনের আরাধ্য প্রশান্তিকে। ভালো থাকাটা শিখে গেলে জীবনে সুখী হওয়াটা বেশ সহজ হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মানুষ সহজ কাজ পছন্দ করে না। মানুষ তাই নিজেই নিজের সুখে থাকাটাকে জটিল-কঠিন করে ফেলে। সুখকে নানান শিকলে বেঁধে ফেলে। কখনো কোন মানুষ, কখনো বা কোন জিনিসের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে সুখকে। কন্ডিশন সেট করে ফেলে সুখকে ঘিরে। আসলে সুখের অভাবে আমরা অসুখী না। আমরা অসুখী সুখকে ঘিরে নানান কন্ডিশনের কারণে। তাই কন্ডিশনের বাঁধটাকে সরিয়ে দাও। দেখবে সুখের ফল্লুধারা প্রবাহিত হবে জীবন জুড়ে। বুঝতে পেরেছো তো আমি তোমাকে কি বোঝাতে চাইছি?

হ্যা আপি আমি বুঝতে পারছি

নূহা মুনার হাতের উপর হাত রেখে হাসি মুখে বলল, সালমান ভাইয়াকে তুমি হয়তো আমার চেয়েও বেশি চেনো, জানো। তোমরা একসাথে গত পাঁচ বছর ধরে কাজ করছো। একসাথে কাজ করার সময় শরীয়তের সীমা অক্ষুণ্ণ থাকার স্বর্ত্বেও একে অন্যের সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েই যায়। তাই সালমান ভাইয়ার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট আমার চেয়েও তুমিই বেটার দিতে পারবে। সালমান ভাইয়ার আম্মুর তোমাকে ভীষণ পছন্দ। সালমান ভাইয়ারও কোন আপত্তি নেই তুমি রাজী থাকলে। তোমার আব্বু-আম্মুও খুব আনন্দিত এই প্রপোজালকে ঘিরে। এখন সবকিছু তোমার ইচ্ছের উপর নির্ভর করছে। কোন প্রেশার নেই তোমার উপর। এখনই জবাব দিতে হবে এখন কোন বাধ্যবাধকতাও নেই। তুমি চিন্তা-ভাবনা করে এরপর জানালেই চলবে। তবে খেয়াল রেখো সিদ্ধান্ত যাই নাও না কেন, তার ভিত্তি যেন শুধু আবেগ না হয়। আবেগকে বিবেকের ছাঁকনিতে ছেঁকে নিও। জীবনের সিদ্ধান্ত সঠিক হবার পেছনে আবেগ বিবেকের সমন্বয় অতীব জরুরি।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে মুনা বলল, জ্বি আপি।

নূহা হেসে বলল, নিশ্চয়ই জানো আমাদের বাড়িতে ক্ষুদে বই পড়ুয়াদের অভাব নেই? তাদের কেউ কেউ আছে বাংলাও পড়তে পারে বেশ চমৎকার। বেশি কিছুদিন আগে এমন একজন সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে ষড় রিপুর কথা জানতে পারলো। নতুন শব্দ খুজে পাবার সাথে সাথেই অর্থ জানার জন্য ছুটে এলো। তাকে বোঝাতে গিয়ে অনেকদিন পর সেদিন ষড়রিপু নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ হয়েছিল। ষড়রিপু- কাম, ক্রোধ, ঘৃণা, মোহ, লোভ, হিংসা। কোথায় যেন পড়েছিলাম কাম হচ্ছে- চতুর বাজপাখী, ক্রোধ-দাউ দাউ দাবানল, ঘৃণা-বীভৎস গিরগিটি, মোহ-সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, লোভ-ক্ষুধার্ত তিমি, হিংসা-খিটখিটে হায়না। আর এদের ভিড়ে বিবেক কেবল একলা মানুষ। সাইকো থেরাপিষ্ট হবার সুবাদে প্রায়ই মানুষের ষড় রিপুকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। সত্যি সত্যি কারো কারো মনের ভিতর উঁকি দিয়ে দেখতে পাই কিলবিল করছে ঘৃণা। বীভৎস সেই গিরগিটি অক্টোপাসের মতো চারপাশে শুঁড় ছড়িয়ে দিয়ে বিষিয়ে রেখেছে তাদের মনকে। কল্যাণকামী হবার ইচ্ছে থেকে পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতির যে শব্দগুলো বলি। তা মুখ থেকে বের হবার সাথে সাথে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় কারো কারো ক্রোধের দাউ দাউ আগুন। আকণ্ঠ গিলে ফেলতে চায় কারো মনের লোভ। কারো হতাশাকে মনেহয় ব্ল্যাকহোল। উফফ, কি শক্তি তাদের সেই হতাশার বাণীতে। আশার শব্দগুলোকে শুষে নিতে চায় সম্পুর্ন রূপে। কারো মনকে মনেহয় মরুভূমি। মাইলের পর মাইল ধূ ধূ মরুভূমি। কোথাও প্রাণের ছোঁয়া নেই। এমনকি কাঁটাযুক্ত একটা ক্যাকটাসও না। শুধুই মরীচিকা। কারো মন শুধুই পানিতে টইটুম্বুর। বিশাল এক সমুদ্র যেন। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়েও সন্ধান মেলে না কোন দ্বীপের। থৈ থৈ কিংবা অথৈ পানির মহাসাগর।

আমার মন কেমন আপি?

মুনার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই নূহা বলল, কিছু কিছু মনে ঢুকতে গেলেই চাপা বোটকা গন্ধ এসে নাকে লাগে। বহু বছর আলোর কোন কিরণ প্রবেশ করেনি বলে ধূলোবালি জমে পুরু হয়ে থাকে যাদের মনের আসবাবপত্র গুলো। এখানে সেখানে মাকড়সার ঝাল। শত চেষ্টা করেও ভেতরে ঢোকা যায় না সেই মন গুলোর। প্রতি কদমে ওতঁ পেতে থাকে অজানা প্রতিকূলতা। আবার কিছু কিছু মন যেন স্বপ্নপুরী। একদম রূপকথার রাজত্ব। ঝলমল করে যার নগর-বন্দর। কান পাতলেই শোনা যায় পাখীদের কিচির-মিচির, ঝর্ণার নিরবধি কূলকুল বয়ে চলা। দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখা মেলে ফুলেদের বাগান, প্রজাপতিদের ছোঁয়া ছুয়ি খেলা, আকাশ জোড়া রঙধনু, পেখম মেলা ময়ূর, ঝিকিমিকি তারা। বেশির ভাগ সময়ই এমন মনের অধিকারী হয় শিশুরা। শিশুদের মনে প্রবৃত্তি তার কালোজাদু চালাতে ব্যর্থ হয় বলেই হয়তো এত সজীব-পবিত্র রঙিন থাকে তাদের মন গুলো। শিশুদের বিবেক অনেকটা সদা জাগ্রত অতন্দ্র প্রহরীর মত। জন্মের সময় যেমনটা আসলে প্রতিটা মানুষেই নিয়ে আসে। আর একমাত্র জাগ্রত বিবেকই পারে প্রবৃত্তিকে বধ করতে। যত বড় হতে থাকে মানুষ, তাদের বিবেকে লাগতে থাকে গ্রহণ। একটা সময় প্রবৃত্তির আঁধারে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায় বিবেক। মানুষ যেহেতু অভস্থ্য হয়ে যায় তাই একটা সময় ভুলেই যায় তার বিবেকের অস্তিত্বের কথা। শুধু প্রবৃত্তির হয় তাদের পথপ্রদর্শক। তাই তারা জানতেই পারে না যে, মানব জীবনের সার্থকতা নিহিত বিবেকের দায়বদ্ধতায়। মানুষকে তাই মানুষ হতে হলে তার বিবেককে প্রস্ফুটিত করতে হবে। কিন্তু ছয়টি শক্তিশালী প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে বিবেক একলা। অনেকটা আমি একা, বড় একা, আমার আপন কেউ নেই, এমন অবস্থা বিবেকের। ষড়রিপু প্রতি পদে পদে ব্যাহত করতে চেষ্টা করে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশকে। বিবেকের তাই একমুহুর্তও বিশ্রাম নেই।

এই ক্ষেত্রে করণীয় কি আপি

কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে মানব সম্প্রদায়। তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে এসেছে উপদেশ এবং তোমাদের অন্তরের [ব্যাধির] উপশম এবং মুমিনদের জন্য পথ নির্দেশ রহমত।এই আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে-“ সত্যবিমুখতা রীপু দ্বারা তারিত হওয়াই হচ্ছে আত্মার ব্যাধি। যার ফলে শেষ পর্যন্ত মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। কুরআনের উপদেশ গ্রহণ করলে অন্তর সে ব্যাধিমুক্ত হয়। কারণ কুরআন হচ্ছে, আল্লাহ্‌র রহমত স্বরূপ। পৃথিবীর জীবনে যে জীবন বিধান মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাই আছে কুরআনের নির্দেশে। আর "আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন" করাই এই বিধানকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করার একমাত্র উপায় সর্বাবস্থাতেই আমাদের করণীয় তাই আল্লাহ্‌র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন।

বুঝতে পারছি আপি। আমি আগামীকাল সকালে জানাই আমার সিদ্ধান্তের কথা?

নূহা হেসে বলল, অবশ্যই। তোমার যতটা সময় প্রয়োজন তুমি নাও। এখন চলো তোমার বইয়ের কালেকশন আর পেইন্টিং দেখবো।

মুনাও হেসে বলল, ওকে আপি


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন