সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৩১



খুব মধুর কোন স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমের রাজ্যেকে বিদায় জানিয়ে স্বপ্নাবেশ জড়ানো চোখ খুলতেই সামলে খোলা জানালা, পর্দার সাথে বাতাসের খুনসুটি এবং বাইরে রিমিঝিমি বৃষ্টি ঝরতে দেখলে যে কারোরই প্রথমে মনে হতে পারে এখনো স্বপ্নেই বিচরণ করছে। কয়েক মূহুর্তের জন্য রিসাবেরও তাই মনেহলো এখনো বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। যখন বুঝতে পারলো স্বপ্ন নয় সত্যি সত্যি অসাধারণ সুন্দর একটি প্রভাতের সূচনা হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ বলে ভালোবাসাময় দৃষ্টিতে পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকাতেই সত্যিকার অর্থে স্বপ্নভঙ্গ হলো। পাশের স্থানটি ফাঁকা। অর্থাৎ, সুবহা আগেই উঠে গিয়েছে ঘুম থেকে। স্বপ্নভঙ্গের সাথে সাথে খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণও হলো রিসাব। বিয়ের চব্বিশ বছর পেরিয়ে যাবার পরেও কিছু কিছু অভ্যাস সে আর সুবহা এখনো অটুট রেখেছে। তারমধ্যে একটি ফজরের নামাজ আদায় করে ছোট্ট যে ঘুমটা দেয়। সেই ঘুমটা ভাঙার পর দুজন মিলে কিছুক্ষণ গল্প করা। যে দিনগুলোতে এর ব্যতিক্রম ঘটে খুব মন খারাপ লাগে রিসাবের। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সরাসরি সামনের বারান্দায় নূহাকে বসে থাকতে দেখে মন খারাপ ভাব মূহুর্তেই উবে গেলো রিসাবের। পারত পক্ষে এই বারান্দায় আসাটা এড়িয়ে চলে সে। কারণ এখানে এসে দাঁড়ালেই নূহার শূন্য রুম চোখে পড়ে। বুকের ভেতর তখন কষ্টের স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে। এরচেয়ে এখান থেকে দূরে থাকাটাই ভালো মনেহয়। কিন্তু আজ নূহাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে টের পেলো প্রকৃতি মত হঠাৎ তার বুকের মধ্যের ঝমঝম বর্ষণ শুরু হয়েছে। ভালোবাসা ও আদরে মাখামাখি একটা অনুভূতি ঢেউ খেলে গেলো মনের মাঝে। হাসি মুখে সালাম দিয়ে বলল, যে পরিমাণে হাঁচি দিচ্ছিস তাতে তো মনেহচ্ছে আবারো বৃষ্টিতে ভিজেছিস আজ?     

সালামের জবাব দিয়ে নূহা বলল, ইচ্ছে করে ভিজিনি আরভি। রাহার সাথে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ নামলো ঝুম বৃষ্টি। কিন্তু একথা একশোবার বলার পরেও মামণি বিশ্বাস করেনি। এক গাদা কথা শুনিয়ে গেলো আমাকে এখন। আমি নাকি বাড়ির সবাইকে অস্থির করার পুরো পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এসেছি।  

রিসাব হাসতে হাসতে বলল, দুষ্টু রাখালের গল্প পড়িসনি ছোটবেলায়? তোর ইমেজ মামণির কাছে সেই দুষ্টু রাখালের চেয়েও নাজুক। এখন তাই যতই সত্য কথা বলিস না কেন উল্টো বকাই খেতে হবে। তাছাড়া চারিত্রিক দাগ বিষয়ে ভাইজান কি বলেছিলেন মনে নেই?   

মনে ছিল না নূহার কিন্তু রিসাবের মুখে শোনা মাত্রই মনে পড়ে গেলো। বেশ কয়েকমাস আগে এক স্টুডেন্ট খুব মনখারাপ করে জানিয়েছিল ওর ছোটভাইয়ের কথা। চৌদ্দ বছর বয়স ওর ভাইয়ের। এমনিতে ভালো ছেলে কিন্তু বাবা-মা-বড়ভাই-বোন সবার পার্স থেকে সুযোগ পেলেই টাকা নিয়ে যায় না বলে। টাকা নিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। নতুন কোন কার্টুনের মুভি এলে সেটা দেখতে যায়। এসবের জন্য ওকে আলাদা করে টাকা দিলেও সেই একই কাজ করে। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাসায় যখনই টাকার গড়মিল হয় সবাই ছেলেটিকেই দায়ী করে। কিন্তু আসল সমস্যাটা হয়ছে গত দু’দিন আগে। চাচার বাসায় একটা ফ্যামেলি ফাংশনে গিয়েছিল সবাই মিলে। আজ সকালে চাচী ফোন করে কথায় কথায় বললেন গতকাল উনাদের বাসা থেকে কিছু টাকা চুরি হয়েছে। এবং আকারে ইঙ্গিতে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন চাচী যে টাকাটা ওর ছোটভাই নিয়েছে। কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই টাকাটা ওর ছোটভাই নেয়নি। কিন্তু টুকটাক চুরির স্বভাব থাকার কারণে একটা মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ওর উপর। পরিস্থিতিটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, ওরা না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। সেই স্টুডেন্টকে পরামর্শ দেবার সময় বহু কষ্টে হাসি চাপতে হয়েছিল নূহাকে। হাসি চাপতে হয়েছিল মূলত নিজের কথা মনে করে। ছোটবেলা থেকেই তাদের বাড়িতে যখনই কোন উল্টাপাল্টা কান্ড ঘটতো সবার আগে আঙুল নূহার দিকেই উঠতো। এমনকি এখনো বাসায় যদি কিছু ভাঙা দেখে রাহাত নূহাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে জারিফকে উদ্দেশ্যে করে হাসতে হাসতে বলে, বাবা আজ আবার তোমার মা কি ভাঙলো। যেহেতু নূহার হাত থেকে কেন জানি না এমনি এমনিই জিনিসপত্র পড়তেই থাকে আর ভাঙতেই থাকে। তাই প্রথমেই তাকেই বিনষ্টকারী ভাবা হতো অতীতেও এবং এখনো। আবার পরিবারের যাকেই বলে মাথাব্যথা করছে। কোন সহানুভূতি না দেখিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলে, নিশ্চয়ই  চশমা ছাড়া বই পড়েছো কিংবা রোদে গিয়েছো আজ তুমি। নয়তো বলবে, চুল নির্ঘাৎ ভালো মতো না শুকিয়েই বেঁধে রেখেছিলে কিংবা আজ বৃষ্টির পানি মাথায় লাগিয়েছো ইত্যাদি ইত্যাদি। নূহা প্রতিবাদ করতে পারি না বেশির ভাগ সময়ই। কারণ তার দ্বারা এসব অপকর্ম সংঘটিত হয় কম বেশি।       

একদিন তাই খুব ক্ষোভের সাথে প্রতিবাদ করেছিল এইসব অপবাদের। ভীষণ অভিমানী কন্ঠে  জাওয়াদকে বলেছিল, আমি মানছি যে উল্টাপাল্টা কাজ আমি করি। কিন্তু তার অর্থ তো এটা নয় যে, সবসময়ই সমস্যার পেছনে আমার হাত থাকবে। কিন্তু তোমরা কেউ কেন সেটা বিশ্বাস করতে চাও না। কেন সবসময় আমাকে কাঠগড়ার দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের উকিল হয়ে গাদা গাদা শব্দ প্রয়োগ করে নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করতে হয়? জাওয়াদ জবাবে বলেছিলো, চলো তোমাকে আমাদের ছোটবেলার একটা ঘটনা শোনাই। আমাদের বয়স তখন বারো বছরের মত হবে। গ্রামে থাকতাম আমরা তখন। মোট ছ'টা পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়ির বাউন্ডারি ছিল। বাড়ির গেটের বাইরে ডাস্টবিন ছিল। তখন শুধু আমরা পাঁচ ভাই ছিলাম। আমরা পাঁচজন মিলেই মাকে সাহায্য করতাম সংসারের কাজে। যাতে আমাদের মাঝে ঝগড়াঝাটি না হতে পারে সেজন্য বাবা আমাদের কাজ এবং কাজের দিন ভাগ করে দিয়েছিলাম। এক বর্ষার রাতে বাবা বাড়ি ফেরার সময় অনেক মাছ নিয়ে এসেছিলেন। মাকে মাছ কাটতে ফায়েজ আর আদী সাহায্য করেছিল যাতে তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। মাছ কাটার পর সব ময়লা মা একটা বাক্সে দিয়ে আমাকে বললেন গেটের বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতে। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। ঘর থেকে সদর দরজা অনেকখানি পথ ছিল। তারউপর রিসাব বলল, অতো দূর গিয়ে কাজ নেই এই বৃষ্টির মধ্য। তারচেয়ে চলো রান্নাঘরের ছাওনির নীচে রেখে দেই এখন। আমার কাছেও মনেহলো এটা ভালো আইডিয়া। এখন রান্নাঘরের পাশে ছাওনির নীচে রেখে দেই ময়লা। সকালে বাইরে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসবো। যেই ভাবা সেই কাজ। ফজরের সময় যখন নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাচ্ছিলাম তখন মনে ছিল না ময়লা ফেলার কথা। তাছাড়া তখনো বৃষ্টি হচ্ছিলো বেশ। এমনিতে ফজরের পড়ে আমরা আর না ঘুমালেও সেদিন শুক্রবার এবং বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব ছিল তাই সবাই কাঁথা মুড়ি গিয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙলো মা, ফুপি, খালামণিদের হৈচৈ শুনে। বেড়িয়ে দেখি পুরো উঠোন জুড়ে মাছের আঁশটেতে ছড়াছড়ি। ঘটনা হয়েছিল আমাদের বাড়িতে ঘর আলাদা হলেও বাজার একই হতো। সেদিন বাবা-চাচ্চু-ফুপাজান সবাই মাছ নিয়ে এসেছিল। বৃষ্টির কারণে সবারই কষ্ট হচ্ছিলো বাইরে যেতে। আমাকে রান্নাঘরের ছাউনীর নিয়ে ময়লা রাখতে দেখে ফুপিও পাশে উনার ময়লা এনে রেখেছিলেন। এরপর বাকিরাও আমার দেখানো পথে চলেছেন। ফজরের পর কেউ একজন বাড়ির সদর দরজা খোলা রেখে দিয়েছিলেন। যারফলে কয়েকটি কুকুর ঢুকে এই কান্ড করেছিল।  

সেদিন মা আর মামণির কাছে বকা তো খেয়েছিলামই। সাথে সাথে আমাদের পাঁচ ভাইকে মিলে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করতে হয়েছিল। মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিলাম ফুপি আর খালামণিদের উপরে। উনারা কেন আমার দেখাদেখি ময়লা রাখতে গিয়েছিলেন? আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বাবা আমাদের পাঁচজনকে পাশে বসিয়ে হাসিমুখে বলেছিলেন, একটা ব্যাপার কি জানো তুমি যদি খুব সুন্দর একটা সাদা দস্তরখানা বিছিয়ে কাউকে খাবার খেতে দাও। সে কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় চেয়েও অনেক সাবধানে খাবে সেটার উপর বসে। কারণ একটা দাগহীন ঝকঝকে জিনিসে কেউই সহজে দাগ ফেলতে চায় না। কিন্তু তুমি যদি একটা ময়লা বা দাগযুক্ত দস্তরখানা দাও তাহলে কিন্তু অতো খানিক সতর্কতা কেউ অবলম্বন করবে না। কারণ তখন চিন্তা কাজ করবে অসংখ্য দাগের মধ্যে আরেকটি দাগ পড়লে কি আর এমন হবে। ঠিক তেমনি তুমি হয়তো ক্ষুব্ধ হচ্ছো সবাইকে কেন শাস্তি দেয়া হলো না ভেবে। এর কারণ হচ্ছে, কোথাও ময়লা জড়ো দেখলে যে কেউ সেখানে তার ময়লাটা ফেলতে দ্বীধা করবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই সেই স্থানে ময়লা ফেলার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়। তাহলে তাকেই করতে হবে যে পরিষ্কার একটি স্থানে সর্বপ্রথম আবর্জনার স্তূপ নিয়ে ফেলেছিল। ছোটবেলার ঘটনা বলার পর জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বাবার এই উদাহরণটা আমার জীবনে অনেক বড় একটা গাইড লাইন ছিলো। এরপর থেকে আমি সদা সর্বদা সতর্ক থেকেছি দাগের ব্যাপারে। কারণ কোনক্রমে যদি আমার উপর একবার একটি দাগ লেগে যায়, সেটির পিছু পিছু আরো দাগ এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। মানে যখন আমার গায়ে দাগ দেখবে তখন যে কেউ আরেকটা দাগ বসিয়ে দিতে খুব বেশি দ্বিধা করবে না। আবার একটি দাগ পড়ে গেলে আমি নিজেও হয়তো সতর্কতার ব্যালেন্স হারাবো। কেননা কিছু কিছু কাজ প্রথমবার করাটাই কঠিন মানুষের জন্য। একবার কোন কারণে শুরু হলে গেলে মানুষের জন্য সেটা সহজ হয়ে যায়। যেমন ধরো, কাউকে গালি দেবার কথা হয়তো তুমি চিন্তাও করতে পারো না। কিন্তু যদি একবার কোন কারণে তোমার মুখ দিয়ে গালি বেড়িয়ে যায়। দ্বিতীয়বার গালি দেয়াটা আর ততটা কঠিন মনে হবে না। একটা সময় সেটা আর কোন ব্যাপারই থাকবে না তোমার কাছে। সুতরাং যদি চাও কেউ তোমার দিকে আঙ্গুল না তুলুক। তাহলে সেই সব কাজ করা থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করো যা তোমার গায়ে সিলমোহর এঁকে দেবে। আরেকটা কথা হচ্ছে যে ভুল মানুষের হতেই পারে। একথা সবাই জানে এবং বেশির ভাগ মানুষ মেনেও নেয়। কিন্তু ভুল তো মানুষ বার বার করে না। যখনই কোন ভুলের পুনঃ পুনঃ পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। সেটা তখন আর ভুল থাকে না। সেটা তখন দাগে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এবং ব্যক্তির দিকে আঙ্গুলের প্রদর্শনীও শুরু হয়ে যায়।

কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি তুই?

নূহা হেসে বলল, তোমাদের ছোটবেলার সেই দাগের ঘটনাতে।

রিসাব হাসতে হাসতে বলল, আসলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা ছিল আমাদের জন্য ঐ ঘটনাটা। কিন্তু এখন আর ঐ ঘটনায় হারিয়ে কি হবে? তুই তো দাগে দাগে দাগী আসামীর অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিস নিজেকে। পথ যেহেতু খুলে দিয়েছিল সেহেতু অপবাদ এখন সইতেই হবে নীরবে। যাইহোক, রাতে তোকে খুঁজছিলাম আমি।

কেন?

একটা সংবাদ দেবার জন্য। 

কি সংবাদ?

আলহামদুলিল্লাহ ভাইজান ঠিকঠাক মতো স্কটল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছেছেন। 

তাতে আমার কি?

রিসাব হেসে বলল, তোর কিছুই না। কিন্তু আমি আমার আদরের বোনের মনে যাতে কোন ধরণের টেনশন কাজ না করে সেই ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছুক। তাই জানিয়ে দিলাম আরকি। যাইহোক, সরে বোস একটু তুই। পুরো বাড়ি ঘুরে তোর কাছে যাবার চেয়ে একটা লাফ দিয়ে চলে আসি। 

নূহা হেসে বলল, তুমি পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙলে কিন্তু মামণি আবারো একগাদা কথা শোনাবে আমাকে।

কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ। তুই শুধু সরে বোস আরেকটু।

নূহা সরে দাঁড়ালে রিসাব নিজের বারান্দা থেকে লাফিয়ে পাশের বারান্দায় চলে এলো। নূহা হাসতে হাসতে বলল, বুড়া বয়সেও তোমরা বাচ্চাদের মতো কর্মকান্ড করো।

এই তুই বুড়া বলিস কাকে? তোর ভাইয়াদেরকে কি বুড়া দেখায়? এখনো স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট অফার করে মানুষ। এই তো গত তিন মাসের আগের ঘটনা। আমি আর ভাইজান লিভারপুলের এক ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম একটা কাজে। ক্ষুধা লেগে যাওয়াতে ইউনিভার্সিটির পাশের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। ওয়েটার বিল দেবার সময় স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট ধরিয়ে দিয়েছিল ভাইজানকে।

তোমাদের ভাইজান খোকা সেজে থাকতে জন্য এত পরিশ্রম করেন রাতদিন। স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট তো দেবেই মানুষ।   

এটাকে খোকা সেজে থাকা বলে নারে পাগলী। ফিট থাকা বলে। তবে তুই এসব বুঝবি না। ত্রিশ পেরোতে না পেরোতেই চুলে পাক ধরিয়ে সেই আনন্দে সবাইকে আবার মিষ্টিও বিলি করে ফেলেছিস। আচ্ছা তুই এত দুষ্টু কেন বলতো? এত কিছু বদলে গিয়েছে কিন্তু তোর দুষ্টুমি তো একটুও কমেনি।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, দুষ্টুমি তো আমার স্বভাব তাই অন্য আর সবকিছুর মতো বদলে যায়নি, ছেড়েও চলে যায়নি।

তোকে আবার কে, কবে, কোথায় ছেড়ে গেলো? আমাদের আনন্দবাড়িতে তো এই ক্ষমতাটা তো শুধু তোর একার। 

নূহা কিছুক্ষণ বসে হাসলো। তারপর বলল, তোমরা কিন্তু ওয়াদা করেছিলে কোনদিন কোন কষ্টকে ছুঁতেও দেবে না আমাকে। আমি মন খারাপ করতে পারি এমন কিছু ঘটতে দেবে না আমার সামনে। আমার মন বিষণ্ণ হবে এমন কিছুই শুনতে দেবে না কখনোই। কিন্তু সেই ওয়াদা রক্ষা তো অনেক দূরের ব্যাপার। তোমরা নিজেরাই আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলো, পরোক্ষ ভাবে আঘাত করো, কষ্ট দাও।  

নূহার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে রিসাব বলল, আই এম সরি। আসলেই মাঝে মাঝে বোকার মতো কথা বলে ফেলি। কষ্ট পেয়েছিস খুব আমার কথায়?

নূহা হেসে বলল, উহু, কষ্ট পাইনি। এটা ঠিক যে আপনজনদের কথা থেকেই আমরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই। ঠিক তেমনি এটাও ঠিক যে আপনজনদের ভালোবাসার গভীরতাই আবার সেই কষ্টের মলমের কাজ করে যায়। তাই তোমরা যখন আমাকে খোঁচা দিয়ে কিছু বলো আমি বুঝতে পারি তার পেছনে লুকায়িত তোমাদের কষ্টকে। কষ্ট আর কষ্ট মিলে তখন আনন্দানুভূতি তৈরি হয়। আলহামদুলিল্লাহ কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন আমাকে ঘিরে পরিবারের সবার অকৃত্রিম ভালোবাসাকে অনুভব করে। 

রিসাব হেসে বলল, আসলেই পাকনা একটা বুড়ি তুই বুঝেছিস!

হুম, বুঝেছি। আচ্ছা আমি এখন ঘুমোতে যাই।

এখন ঘুমোতে যাবি?

হুম, মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। তবে তুমি এখানেই বসে থাকো আমি ভাবীকে পাঠাচ্ছি।

রিসাব হেসে ফেলোলো। নূহাও হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালো।


ঘুম ভাঙতেই সুরলিত কণ্ঠের সুমধুর কুরআনের ধ্বনি শুনতে পেলো নূহা। মুহুর্তেই তন্দ্রা ছুটে গিয়ে একরাশ মুগ্ধতা আড়মোড়া ভেঙে ছড়িয়ে পড়লো অন্তর জুড়ে। না দেখেও বুঝতে পারছিল রুমের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বাগানে গাছে পানি দিচ্ছে আর তিলাওয়াত করছে নাবিহা। আপন মনে যখনই কোন কাজ করে ওর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হতে থাকে কুরআনের সুর। ভীষণ ভালো লাগে নূহার মেয়ের মনে কুরআনের প্রতি এই ভালোবাসাময় আকর্ষণ দেখে।     

নূহার মন চলে গেলো বেশ কয়েক বছর আগের রোদের মিষ্টি পরশ বুলানো এক বিকেলে। জাওয়াদ ট্যুরে যাবার কারণে একটানা প্রায় আড়াই মাস বাচ্চারা নূহার কাছেই ছিল। সাড়ে সাত বয়স ছিল তখন নাবিহার। সূরা মুখস্ত করতে বলায় অভিযোগের গলায় নাবিহা বলেছিল, আমি তো বিশটা সূরা পারি। তাহলে আবারো কেন মুখস্ত করতে বলছো? মেয়ের অনিচ্ছা বুঝতে পেরে নূহা হেসে বলেছিল, আচ্ছা ঠিকআছে তুমি বিশটার বেশি সূরা মুখস্ত করতে না চাইলে আমি জোড় করবো না। মামণিকে জোড় করতে না দেখে খুব খুশি হয়েছিল নাবিহা। এরপর সপ্তাহ খানেক নাবিহাকে কুরআন পড়ার ব্যাপারে কিছুই বলেনি নূহা। নাবিহাও স্কুলের পড়াশোনা আর খেলাধূলা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে।   

এক সপ্তাহ পর আবার নাবিহাকে নিয়ে কুরআন পড়তে বসেছিল নূহা। মেয়েকে কুরআন পড়ানো শেষ করে খুব শান্ত ও মায়া মেশানো স্বরে বলেছিলো, গত এক সপ্তাহ মামণি নানা কারণে ব্যস্ত ছিলাম তাই তোমাকে কুরআন পড়াতে পারিনি। তুমি তো একা একা পড়তে পারো কুরআন। কিন্তু মামণি বলিনি বলে তুমি নিজ থেকে পড়তে বসোনি। এটা কি ঠিক হয়েছে মা? তুমি ভেবে দেখো তো মামণি যদি এক সপ্তাহ তোমার কাছে না আসি, তোমার সাথে কথা না বলি, তোমাকে আদর না করি, তোমাকে ভালো না বাসি তাহলে কি তোমার কষ্ট হবে না?   

জবাবে নাবিহা বলেছিল, ভীষণ কষ্ট হবে মামণি। আমি তো অনেক অনেক কান্না করবো তুমি এমনটা করলে।  

কেন কান্না করবে?

কারণ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। পৃথিবীতে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসি। তুমি আমার কাছে না এলে আমাকে আদর না করলে আমি তো কান্না করবোই।

মামণিও তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া মামণিও থাকতে পারি না। জানো মা তুমি আমি একে অন্যেকে যতটুকুন ভালোবাসি তারচেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি ভালো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে বাসেন। তাই আমাদেরও তো উচিত আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা। কিন্তু কাউকে ভালোবাসার জন্য তাঁর সম্পর্কে জানতে হয়। কারণ মামণি যদি তোমাকে আদর না করতাম, ভালো না বাসতাম, তোমার খেয়াল না রাখতাম তাহলে কি তুমি মামণিকে ভালোবাসতে? আর বাসলেও মামণির অভাবে তুমি কান্না নিশ্চয়ই করতে না। কারণ মামণি তোমার কাছে থাকা আর না থাকা তখন অনেকটা একই রকম হতো তাই না?

কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে নাবিহা বলেছিল, হুম!   

নূহা হেসে বলেছিল, এই যে তুমি যেমন শুধু মামণির ছোট বেলার গল্প শুনতে চাও। কারন মামণি সম্পর্কে জানতে তোমার ভালো লাগে, তুমি আনন্দ পাও। আবার জানার কারণেই কিসে মামণি রাগ করে, কিসে খুশি হয় সেটা তুমি বুঝতে পারো। তেমনি কুরআন পড়লে তুমি আল্লাহর সম্পর্কে জানতে পারবে। আল্লাহ কেন আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, কেন দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, আমরা কি করলে আল্লাহ খুশি হন, কিসে নারাজ হয়, কোন কোন কাজ আমাদের বেশি বেশি করা উচিত, কোন সব কাজ এড়িয়ে চলা উচিত সবকিছু জানতে পারবে। এবং মেনেও চলতে পারবে।

কুরআনে আল্লাহ সবকিছু বলে দিয়েছেন?

হ্যা মা যাতে আমাদের কোন কিছু মেনে চলতে কষ্ট না হয় সেজন্য কুরআনে আল্লাহ সবকিছু বলে দিয়েছেন। অনেক ভালো একটা মেয়ে হতে হলে তোমাকে কি কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে সবকিছু বলে দিয়েছেন আল্লাহ। কিন্তু তুমি যদি কুরআন না পড়ো তাহলে কিভাবে জানবে সেসব বলো?

আল্লাহ যা যা বলেছেন আমি সব জানতে চাই মামণি। আর কি বলেছেন আল্লাহ কুরআনে? 

আরো অনেক কিছু। যেমন ধরো, কুরআন পড়লে তুমি রাসূল সঃ সম্পর্কে জানতে পারবে, অন্যান্য নবী ও রাসূলদের সম্পর্কে জানতে পারবে। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। কুরআনে এমন আরো অনেক মজার মজার জিনিস আছে। জানতে পারবে তোমার চারপাশের মানুষদের সম্পর্কেও। এবং তখন তুমি বুঝতে পারবে আল্লাহ কত মহান, কত ভালোবাসেন তোমাকে।

আমি এখন থেকে রোজ কুরআন পড়বো মামণি। আল্লাহ যা বলেছেন সবকিছু জেনে নেব।

নূহা হেসে বলেছিল, ইনশাআল্লাহ।   

এরপর থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নাবিহাকে নিয়ে অর্থসহ কুরআন পড়া শুরু করেছিল নূহা। কি পড়ছে তার অর্থ বুঝতে পারার কারণে নাবিহার আগ্রহ দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে কুরআনের প্রতি। একটা সময় নাবিহা নিজ থেকে কুরআনে হাফিযা হবার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। আলহামদুলিল্লাহ দশ বছর বয়সেই নাবিহা হিফজ কমপ্লিট করে ফেলেছিল। আসলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে করণীয় ও বর্জনীয় গুলো চাপিয়ে না বুঝিয়ে শুধু সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে হয় শিশুদেরকে। যদি জীবনে কুরআনের প্রয়োজনীয়তাকে খুব সহজ ও সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হয় শিশুদেরকে তাহলে আর জোড় করার দরকার হয় না। বোঝার কারণে শিশুরাই হৃদয়ের টানে ছুটে যায় কুরআনের পানে।        

সুখময় অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে দু’চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নূহার। বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। একটু আড়াল হয়ে দাঁড়ালো যাতে নাবিহা দেখতে না পায়। আগে কতই না বিরক্ত হতো মামণি চুপিচুপি তাকে দেখতো বলে। কিন্তু আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েকে দেখার মধ্যে যে কি অদ্ভুত রকমের সুখানুভূতি লুকানো এই মূহুর্তে সেটা অনুভব করতে পারছিল। আবারো মনেহলো মাকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে হলে আসলেই মনেহয় নিজে মেয়ের মা হওয়াটা জরুরি। মেয়েকে ঘিরে মায়ের মনের অনুভূতি গুলো বড় বেশি অধরা। কেমন যেন শুধুই অনুভবের।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন