সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২২




নাবিহা চলে গেলেও খুলে দিয়ে গেলো রাহাতের মনের স্মৃতির বাতায়ন নূহার সাথে বিয়ের পরের অধ্যায় টিকে কি স্বপ্নময় বলবে নাকি পরীক্ষাময় ঠিক বুঝে উঠতে পারে না হয়তো কঠিন এক পরীক্ষাই ছিল সেই পথটুকুন যার গন্তব্যে তারজন্য অপেক্ষারত ছিল সুন্দর এক স্বপ্নময় প্রারম্ভ স্বপ্নময় সেই প্রারম্ভের স্মরণ সবসময়ই শিহরিত করে রাহাতকে আজও তার ব্যতিক্রম হলো না মন সমুদ্রে ঢেউয়ের আকারে ছড়িয়ে পড়লো অকল্পনীয় সুন্দর সেইসব মূহুর্তরা রাহাতের কাছে অকল্পনীয়ই ছিল তার দিকে নূহার স্বইচ্ছায় এগিয়ে আসাটা বিয়ে হলেও কখনোই নূহার সাথে সংসার করার কথা চিন্তাও করেনি চিন্তা করার আগেই জাওয়াদের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো সাথে সাথে প্রচন্ড একটা দ্বিধা, জড়তা ঘিরে ধরতো মনকে নূহা এগিয়ে না আসলে হয়তো নিজ থেকে কখনোই এই সাহসটা করতে পারতো না এখনো স্পষ্ট মনে আছে রাহাতের সেদিনের কথা অন্য আর সব দিনের মতো সেদিনও রাতের খাবার সেরে কিছুক্ষণ বাবার সাথে গল্প করে নিজের রুমে চলে গিয়েছিল কিছুক্ষণ পর দরজায় নক হলে এত রাতে কে এসেছে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে সামনে নূহাকে দাঁড়ানো দেখে কি বলবে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে ছিল বিস্ময় ভরা চোখে বিয়ের ছয় মাস পেরিয়ে যাবার পর নূহার প্রথম আগমন ছিল তার রুমে সালাম দিয়ে চোখ তুলে রাহাতের দিকে তাকিয়ে পর মূহুর্তেই চোখ নামিয়ে নিয়ে নূহা বলেছিল, আমি ভেতরে যাব প্লীজ আপনি একটু সরে দাঁড়ান সালামের জবাব দিতেও অনেকটা সময় লেগেছিল রাহাতের সরে দাঁড়িয়ে নূহাকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিয়েছিল পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিয়ে নূহা চুপচাপ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল রুমের এক কোনায় রাহাতও দাঁড়িয়ে ছিল একদম নিশ্চুপ বেশ কিছুক্ষণ পর নূহা বলেছিল, কথা বলতে চাচ্ছিলাম আপনার সাথে বারান্দাতেই বসি আমরা আলো নিভিয়ে দিন নয়তো বাইরে থেকে দেখা যাবে আমাদেরকে রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে চুপচাপ নূহার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাহাত খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই নূহা রাহাত সম্পর্কে, রাহাতের পরিবার সম্পর্কে টুকটাক প্রশ্ন করেছিল রাহাতও আন্তরিকতার সাথেই জবাব দিয়েছিল প্রতিটা প্রশ্নের এরপর আবারো বেশ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকার পর নূহা বলেছিল, আমার সম্পর্কে এতদিনে নিশ্চয়ই আপনাকে ডক্টরেট কমপ্লিট করিয়ে দিয়েছে আমার ভাইবোনেরা? কথাটা বলতে বলতে হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল নূহার চেহারা জুড়ে ছয় মাসে প্রথম হাসতে দেখছিল সেদিন নূহাকে তাও আবার এতখানিক কাছ থেকে অজান্তেই কয়েক মূহুর্তের জন্য দৃষ্টি আঁটকে গিয়েছিল নূহার চেহারাতে

মুখের হাসি ধরে রেখেই নূহা প্রশ্ন করেছিল, আপনি স্বপ্ন দেখেন?

প্রশ্নটা শুনে বেশ অবাক হয়ে নূহার দিকে তাকিয়েছিল রাহাত।

জবাবের অপেক্ষা না করেই নূহা বলেছিল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন না কিন্তু খোলা চোখের স্বপ্ন। জানেন ছোটবেলায় আমার জানাই ছিল না মানুষ ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখে। আমার ধারণা ছিল মানুষ যা করতে চায়, যা পেতে চায়, তারজন্য চেষ্টা করার নাম হচ্ছে স্বপ্ন। তবে স্বপ্নের এই সংজ্ঞা আমার নিজের না। আমি যার কাছে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলাম তার। অদ্ভুত রকমের স্বাপ্নিক ছিলেন মানুষটি। ইতিবাচক মানসিকতার পরশ পাথর ছিলেন। বুঝতে শেখার পর থেকে কোনদিন আমি তাকে নেতিবাচক কথা বলতে, আচরণ বা কাজ করতে দেখিনি। আমার ব্যাপারে এতটা ধৈর্য্যশীল আর কাউকেই পাইনি পরিবারে। এমনকি আমার মামণি-বাবাকেও না। উনিই আমাকে শিখিয়ে ছিলেন জীবন চলার পথের প্রথম পাঠ, এখন অবধি শেষ পাঠও উনার কাছেই শেখা। সাদা কাগজের বুকে অক্ষর লেখা হোক কিংবা ছবি আঁকা, উনার হাত ধরেই শিখেছিলাম। বা এভাবেও বলা যায় আমার হাত ধরে উনি শিখিয়েছিলেন। শব্দের পরে শব্দ বসিয়ে কাব্যে রচনা করা যেমন উনি শিখিয়েছেন, ক্যানভাসে রঙের ছোঁয়ায় স্বপ্নিল ভুবন গড়াও উনিই শিখিয়েছেন। গল্পে গল্পে রুপকথার রাজ্যে যেমন ঘুরাতে নিয়ে গিয়েছেন, ইতিহাসের বুকেও উনার হাত ধরেই আমি দীপ্ত পদে বিচরণ করেছি। মহাকাশ ভ্রমণ হোক কিংবা সাগরের ততদেশ, যখন ভেসে বেড়িয়েছি তখনও সেই ছিলেন সাথী হয়ে। পরের দুঃখে উনাকে কাঁদতে দেখে আমি কাঁদতে শিখে নিয়েছিলাম। নিজ ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগে মানুষের কল্ল্যাণার্থে উনাকে চেষ্টা করতে দেখে আমি নিজ করণীয় নির্ধারণ করে নিয়েছিলাম। ঠিক কি ছিল উনি আমার জন্য এখনো ঠিক জানি না। কে ছিলেন, কতটা জুড়ে ছিলেন, নাকি যা কিছু ছিল, যা কিছু আছে শুধু উনিই ছিলেন তাও জানি না। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু সবার স্থানে উনার নামই উচ্চারণ করেছি জীবনে অসংখ্য বার। হয়তো সবই ছিলেন উনি আমার। আমার গোটা দুনিয়াটা জুড়েই এই একজন মানুষই ছিলেন। সবাই থাকলেও শুধু উনার শূন্যতার কারণে মনেহতো কিছুই নেই, কেউ নেই আমার কাছে। আর যখন উনি কাছে থাকতেন আর কেউ আছে কিনা সেটা দেখার কথাও মনে আসতো না। সেই একজন মানুষের প্রভাবে পরিপূর্ণ হয়ে যেত আমার জীবন। তবে কি জানেন?

কি?

উনি কিন্তু শুধু আদরই করেননি, শুধু ভালোই বাসেননি আমাকে। শাসনও করেছে সবচেয়ে বেশি। জেদের কারণে জীবনের প্রথম থাপ্পড়টাও উনার হাতেই খেয়েছিলাম। শাস্তির ভান্ডার তো উনার দেয়া অগুণতি শাস্তিতেই টইটুম্বুর আমার। খুব বেশি জেদী ছিলাম, গোঁয়ার ছিলাম, একরোখা স্বভাবের ছিলাম তাই শাস্তি অবশ্য প্রাপ্যও ছিল। মানুষটা নিষ্ঠুরও ছিলেন খুব বেশি। তা না হলে রকম সব শাস্তি কিভাবে দিতেন? কঠোর কন্ঠে বললেন, আগামী তিনদিন আমার সামনে আসবে না কিংবা আমার সাথে কথা বলবে না আটচল্লিশ ঘন্টা। দুনিয়া থমকে যেত আমার কখনো তিনদিনের জন্য, কখনো বা দুদিনের জন্য। চরিত্রে পাহাড় প্রমাণ অনঢ়তা দৃঢ়তা ছিল। শাস্তির সময় পেরোনোর আগে ক্ষমা করে দিতেন না কখনোই। এরপর অবশ্য ছোট্ট আমাকে কোলে তুলে নিয়ে পরম আদরে বুঝিয়ে বলতেন ভুলগুলোকে। চলার পথে কোন বাঁধাগুলোর মোকাবিলা করতে হবে, কোনগুলোকে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে হবে, কোনগুলোকে এড়িয়ে যেতে হবে উনিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সর্বক্ষেত্রে শরীয়ত কে জীবনের একমাত্র মানদণ্ড নির্ধারণ করার শিক্ষাটাও উনিই দিয়েছিলেন। মোটকথা, জীবনকে যাপন করার জন্য যা কিছু প্রয়োজনীয় সবকিছু আমি উনার কাছেই শিখেছিলাম। এইসব কিছুর বদলে অবশ্য আমিও উনাকে একটা জিনিস শিখিয়েছিলাম। পরিবারকে শুধু দায়িত্ব পালনের জন্য ভালোবাসা নয়, ভালোবাসার জন্য ভালোবাসা। আদর্শ সন্তান ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পরিবারের প্রতিটা সম্পর্কের ক্ষেত্রেই উনার দায়িত্ব পালন পারফেক্ট ছিল। কিন্তু সদস্যদের খুঁটিনাটি তেমন কিছুই জানতেন না। আমাকে কেউ কোনদিন বলে দেয়নি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হয়তো আমাকে পরিবার প্রাণ করেই গড়েছেন। ছোটবেলায় সমবয়সী ভাইবোনদের সবকিছু খেয়াল রাখতাম। যত বড় হয়েছি আমার সেই খেয়াল পরিবারের সবার দিকে প্রসারিত হয়েছে। পরিবারের প্রতিটা সদস্যের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দ-অপছন্দ জানাটা খুব বেশি জরুরি মনেহতো আমার কাছে। একটি পরিবারের হেড যিনি তার এসব জানাটাকে বাধ্যতামূলক মনে হতো। উনি কখনোই জানতে চাইতেন না। আমি নিজ থেকেই পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে বলতে শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে জানাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল উনার। তখন ফোন করেই বলতেন, আজকের এফএমস নিউজ প্লীজ।

এফএমস নিউজ? প্রশ্ন করেছিল রাহাত

নূহা হেসে জবাব দিয়েছিল, ফ্যামেলি মেম্বার নিউজ। তখন কিন্তু আমি বেশ ছোট ছিলাম। বারো বছরের মত ছিল বয়স। রোজই ফোনে কথা হতো উনার সাথে। পরিবারের সবার কর্মকাণ্ড নোট করে রাখতাম বলার জন্য। আমার সারাদিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটাই ছিল তখন। এরফলে পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমার নজরদারী আরো বেড়ে গিয়েছিল। বেড়েছিল বোঝার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও। পরিবারের সদস্যদের নিত্যনতুন মজার কর্মকাণ্ড না জেনে থাকাটা ততদিনে উনার জন্যও কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। সবার সবকিছু জানতেই হবে আমার মতো এই নেশা উনাকেও পেয়ে বসেছিল। আমাদের ফোনে কথা বলাটা বন্ধ কেন হয়ে গিয়েছিল ঠিক মনে নেই। মে বি উনি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সময়। অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলার সময় করতে পারতেন না। আবার যখন উনি ফ্রি হতেন দেশে অনেক রাত হয়ে যেত। সময় দেশে ছিলাম আমরা আর উনি নিউজিল্যান্ড। মাঝখানে অনেকদিন এফএমস নিউজ পাঠ করার সুযোগ হয়নি আমার। পরিবারের সবার সব কথা উনাকে বলাটা অত্যাবশ্যকীয় একটি কর্মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। যত কথা জমেছিল সব একসাথ করে বিশাল একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। উনাকে যখন জানিয়েছিলাম চিঠি পাঠিয়েছি। বলেছিলেন, চিঠি আসতে তো সপ্তাহ পেরিয়ে যাবে। তারচেয়ে তোমাকে মেইল আইডি করে দিচ্ছি। তাহলে সাথে সাথেই পেয়ে যাব তোমার এফএমস নিউজ। একটি মেইল আইডি নিজেদের অজান্তেই বদলে দিয়েছিল আমাদের সম্পর্ক, আমাদের জীবন। কিভাবে, কেন তা আজো জানি না। শুধু জানি সারাদিনে একটি কাজই সবচেয়ে আনন্দময় ছিল। যে কাজটি পূর্ণতা এনে দিতো আমার প্রতিটি দিনকে। পরিবারের কথা লিখতে লিখতে কখন যেন নিজের কথাও লিখতে শুরু করে দিয়েছিলাম। ভালো লাগাগুলো, নিজস্ব ভাবনাগুলো, মনের একান্ত স্বপ্নগুলো, বাঁধনহারা ইচ্ছেগুলো, যা আড়াল করে রাখতে পছন্দ করতাম মামণি-বাবার কাছে পর্যন্ত, তাও উনাকে বলে দিতাম নির্দ্বিধায়, আনন্দিত চিত্তে। ভাবনাগুলো হয়তো মনে দানাই বাঁধতো উনার কাছে প্রকাশিত হবার জন্য। বছর পেরিয়ে যাবার পরও আগ্রহে এতটুকুন কমতি আসেনি কখনো। প্রথম দিকের সময়টাতে উনি শুধু আমার লেখা পড়তেন এবং দু'এক লাইনে জবাব লিখে পাঠাতেন। এরপর উনিও নিজের ভাবনাদের শেয়ার করতে শুরু করেছিলেন। এত কথা বলতেন নিজের সম্পর্কে অবাক হয়ে যেতাম মনে মনে। ধারণাই ছিল না উনারও বলার মতন এত কিছু থাকতে পারে। তারপর যেন কি হলো

এখানেই নূহাকে থেমে যেতে রাহাত প্রশ্ন করলো, কি হয়েছিল?

গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল নূহার। নীরব হয়েছিল অনেকটা ক্ষণ। এরপর ধীরে ধীরে বলেছিল, উনি একটু একটু করে দূরে সরে যেতেন লাগলেন আমার কাছ থেকে। আর একটু একটু করে উজ্জ্বলতা হারাতে শুরু করলো আমার ভুবন। আমার মনের আকাশ জোড়া রঙধনু ঝুরঝুর ক্ষয়ে যেতে শুরু করলো। বুঝতে পারছিলাম রঙহীন হয়ে যাচ্ছে আমার ভাবনারা। মন বাঁধনহারা হতে ভুলে যাচ্ছিলো, শব্দরা জোনাক জোনাক গুঞ্জরন তুলেছিল না। ইচ্ছেরা ঘুড়ি হয়ে ছুট লাগাচ্ছিল না আকাশ পানে, আঁটকে গিয়েছিল সবকিছু সাঁঝের মায়াতে। আমার স্বপ্নরা প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়তে ভুলে গিয়েছিল, শব্দের নকশিকাঁথা বোনার রেশমি সুতোগুলোকে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছিল কোন অজানাতে। আকুল হয়ে ডেকেছি বার বার, অসংখ্যবার। কিন্তু উনি কোন সাড়া দেননি। আমার কান্নারা বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে, তপ্তদাহে বাষ্প হয়ে ফিরে গিয়েছে মেঘের বুকে, আবারো ঝরেছে শ্রাবণধারা হয়ে। কিন্তু উনি একবারও বলেননি, আমার নূহা বেবীটা কেন কান্না করছে? নূহা বেবী কি ভুলে গিয়েছে ভাইয়া তার কান্না একদম সহ্য করতে পারে না? আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কেন ভাইয়া আমার সাথে এমন করছিলেন। কেন উনি আমার মেইলে, ম্যাসেজ কোন কিছুর জবাব দিতেন না? কেন ফোন করলে কথা বলতেন না। ভাইয়ার যুক্তি ছিল অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। তা না হলে ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। ভুল করলে মাশুল দিতেই হবে। নয়তো চলার পথে ভুলের ব্যাপারে সাবধান হবে কি করে? তাই ধরেই নিয়েছিলাম অনেক বড় কোন ভুল হয়েছে আমার দ্বারা, নিশ্চয়ই কোন অন্যায় করেছি। এই উপলব্ধি থেকে বার বার ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু তখনো উনি নীরব ছিলেন। এরপর আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারিনি। জেদ চেপে বসেছিল মনে, জানতেই হবে আমাকে এর পেছনের কারণ। সরাসরি কথা বলারও উপায় ছিল না। উনি প্রতিমাসে দেশে আসতেন। এক-দু'দিনের জন্য হলেও আসতেন। কিন্তু সেই এক বছরে একবারও আসেননি। আমার মনের রাগ, জেদ, অভিমান, কান্না সবকিছুই প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল ততদিনে। যদিও তখনো প্রতিদিন আমি পরিবারের সবার কথা উনাকে লিখে পাঠাতাম। কেন পাঠাতাম জানি না। কিন্তু প্রতিদিনই মন্ত্রমুগ্ধের মতো লিখতে বসে যেতাম।

নূহা আর জাওয়াদের সম্পর্কের উত্থান-পতন সম্বন্ধে তখন ধরতে গেলে কিছু জানা ছিল না রাহাতের। কিন্তু নূহার কন্ঠের আবেগ, দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুর বন্যায় সেদিন কিছুটা হলেও আঁচ করেছিল ভালোবাসার গভীরতা।

কিছুটা সময় পরে নিজেকে সামলে নিয়ে নূহা আবারো বলেছিল, শব্দের ফুল বিছানো পথে হাজারো মাইল আমার মনময়ূরী পেখম মেলে উনার সাথে ছুটে বেড়িছিল। অতঃপর কণ্টকাকীর্ণ, রুক্ষ-শুষ্ক, বিবর্ণ পথে বহু মাইল আমি একাই চলেছি। সে পথ সবুজে যাওয়া ছিল না, সে পথে গাছেদের ছায়া ছিল না, পিপাসা মিটানোর জন্য মিষ্টি ঝর্ণাধারা ছিল না, ক্ষুধা নিবারণের জন্য সুস্বাদু রসালো বুনো ফল ছিল না, ক্লান্ত হয়ে ঝিরিয়ে নেবার জন্য ঘাসের মাদুর ছিল না। সে পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার তরে কোন রাহবার ছিল না। পথ হারিয়ে ফেললে অভয় দিয়ে বলার মত কেউ ছিল না, আমি আছি তোমার পাশে। আর পাশে যখন নির্ভরযোগ্য সাথী থাকে, পথের শুরুটা ভুল হলেও দুজনে মিলে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায় সেই ভুলে ভরা পথে শুধু শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি আমার সাথী ছিল। আর কেউ ছিল না, কেউ না। তাই গন্তব্যেও পৌঁছোতে পারছিলাম না। ঘুরপাক খাচ্ছিলাম প্রাণহীন সেই বনাঞ্চলেই। দেড় বছর পর উনি দেশে এসেছিলেন আমাদের এক ভাইয়ার বিয়ে উপলক্ষ্যে। ভেবে রেখেছিলাম যখন দেখা হবে কৈফিয়ত চাইবো গুনে গুনে সবকিছুর। কিন্তু ততদিনে কৈফিয়ত চাইবার ইচ্ছেটাও মরে গিয়েছিল। এতটুকুন উচ্ছাসিতও হয়নি মন উনার আগমনে। বাগানে ছুটে যাইনি তাজা ফুল তুলে উনার রুমের ফুলদানিতে রাখার জন্য। কিচেনে গিয়ে মামণি, মা' সাথে ঝগড়াও করিনি রান্না করা নিয়ে। মিস্টার পারফেকশনিস্ট ছিলেন। বাড়ির কোন কিছুর এক চুল এদিক সেদিকে উনার ভ্রু কুঁচকে যেত। উনার আসার সংবাদে তাই ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস হাতে পুরো বাড়ি একবার ঘুরে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিতাম সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু সেই আগ্রহও করতে পারিনি।

তারপর?

তারপর এখানেই সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু প্রতিটি সমাপ্তিতেই মাঝেই থাকে নতুনের সূচনা। এই কথাটির প্রমাণ দিতেই বুঝি আমাদের জীবন যে বাঁকে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকেই নতুন পথের শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পথ নয়, সেবার যুগল পথের সূচনা হয়েছিল। উনি যেদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, পরিবারের সবাইকে আমাদের বিয়ের কথা বলবেন কিনা? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এমন অবিশ্বাস্য প্রশ্নের মুখোমুখী কোনদিন দাঁড়াতে হবে আমাকে সেটা কল্পনাতেও কখনো ছিল না। একই সাথে উনার প্রশ্নের জবাবে হ্যা বলতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময়ই নিয়েছিলাম। কেন হ্যা বলেছিলাম আমি সত্যি, সত্যিই জানি না। এখনো পর্যন্তও জানি না। উনি কেন দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে, কেনই বা আবার হুট করে একদিন বিয়ের কথা বললেন তাও আমি জানি না। কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। উনিও নিজ থেকে কোনদিন এই প্রসঙ্গটা তোলেননি। সুখী ছিলাম আমরা এক জীবনে যতটুকুন হওয়া সম্ভব হয়তো তার সবটুকুন। একে অন্যের কাছে আড়াল করার মতোই কিছুই ছিল না আমাদের। আয়না ছিলাম আমরা পরস্পরের। কিন্তু তারপরও কিছু প্রশ্নেরজানি নাজবাব লুকায়িত ছিল আমাদের মাঝে। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল আমার। কাউকে যা বলতে পারিনি কখনো তাও উনাকে বিনা দ্বিধায় বলতে পারতাম। কিন্তু মনের মাঝে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা কিছু প্রশ্নগুলো আমার কন্ঠের উপরে উঠতেই পারেনি কখনো। প্রচন্ড একটা ভীতি কাজ করতো মনে। কারণ মিথ্যা উনার স্বভাব বহির্ভূত জিনিস। জবাব দিলে সত্যিটাই দেবেন। আমি কষ্ট পাবো ভেবেও ভিন্ন কিছু বলবেন না। সেই সত্যটা যদি অসহনীয় কিছু হয়! এই ভয়ে কোনদিন আর জিজ্ঞেস করা হয়নি কেন দূরে সরে গিয়েছিলেন, কেনই বা আবার নিজ থেকেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আপনাকে এতসব কথা কেন বললাম শুনবেন?

জ্বি অবশ্যই।

আমার জীবনের ভাব-সম্প্রসারণ এটাই। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি আমার জীবন এই একজন মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত। উনি শুধু আমার হাজবেন্ড ছিলেন না। উনি আমার জীবনসাথী ছিলেন। হাজবেন্ড আর জীবনসাথী কিন্তু এক জিনিস নয়। কারো সাথে বিয়ে হলেই সে জীবনের সাথে জুড়ে যায় এটা ঠিক। কিন্তু জীবনের সাথে জুড়ে থাকা সব বন্ধন জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক হয় না। এজন্যই দেখা যায় কারো জীবন মাকে ছাড়া গতিহীন, কারো বাবাকে ছাড়া, কারো বা অন্য কাউকে ছাড়া। আমার জীবন তেমন উনাকে ছাড়া গতিহীন, প্রানহীন। আমার জীবনে এমন কোন একটা অংশ নেই যেখানে উনার স্পর্শ নেই, আমার মনে এমন কোন ভাবনা নেই, যা উনার রঙে নিজেকে রাঙায়নি। গড়ে তোলা মানুষের কাতারে গিয়েও দাঁড়িয়েছিলাম উনাকে অনুসরণ করেই। আমি তাই ভাঙার দলের মানুষ নেই। যেভাবেই হোক আপনার সাথে আমার জীবন জুড়ে গিয়েছে। হ্যা ব্যাপারটা মেনে নিতে আমি হয়তো একটু বেশিই সময় নিয়েছি। কিন্তু এখন মন থেকেই মেনে নিয়েছি আমি আপনার সাথে আমার বন্ধনকে। কিন্তু এই সম্পর্কটা কন্টিনিউ করা, না করা আপনার ইচ্ছে। আমার আমিকে তুলে ধরেছি যতটা সম্ভব। এমনই আমি যেমনটা এতক্ষণ শুনেছেন। আমি আমার কক্ষপথ চেঞ্জ করবো না। আপনাকে ঘিরে কোনদিনও আবর্তিত হবো না। কারণ আবারো বলছি, উনি কখনোই শুধু আমার হাজবেন্ড ছিলেন না। উনি সেই ব্যক্তি ছিলেন যার উপর ভিত্তি করে আমি গড়ে উঠেছি। তাই উনাকে যদি কেউ আমার থেকে আলাদা করতে চায় মূহুর্তেই ঝুরঝুর ভেঙে পড়বো আমি। তবে আমার হাজবেন্ডের অবস্থান সম্পূর্ণ রূপে আপনাকে আমি অবশ্যই দেবো। আমার প্রতি আপনার সমস্ত হক যথাসাধ্য আদায় করবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আমি আপনার জীবনসাথী হতে পারবো না। তবে হ্যা জীবনের পথ আঁকাবাঁকা হোক বা সরল সর্বদা আমাকে সাথে পাবেন। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। কারণ আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি আবেগের বশে এসব বলছি। দুদিন পরেই বদলে যাবে আমার এসব কথা। তাহলে ভাবনাটা সঠিক হবে না। আমি হয়তো এমনটা কখনোই করবো না ইনশাআল্লাহ। কারণ আমি এমনটা করতে চাই না। এবং আমার চাওয়া কখনোই মুখে মুখে হয়না। যা ফিল করি তাই বলি, আর যা বলি তাই করি আলহামদুলিল্লাহ। তাই পরবর্তীতে কখনোই বলতে পারবেন না আমি আগে কেন জানায়নি আপনাকে। তাহলে হয়তো আপনার সিদ্ধান্ত ভিন্ন কিছু হতো। আমি আমাকে জানিয়ে দিলাম। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।

হাসি ফুটে উঠলো রাহাতের মুখে। নূহার দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দগুলো শুনে কি জবাব দেবে বুঝেই উঠতে পারছিল না সেদিন। তবে জাওয়াদের সংস্পর্শে থেকে ততদিনে রাহাতও গড়ার দলের মানুষের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই নূহার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবার কথা চিন্তা করতে পারেনি। মেনে নিয়েছিল নূহার প্রতিটি কথা। নূহাও সেদিনের বলা প্রতিটা শব্দের সত্যতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে এখনো অবধি। স্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালনে বিয়ের প্রথম সেই ছয় মাসের পর আর কোনদিন বিন্দুমাত্র ঘাটতি বা অবহেলা করেনি। এমন কি জাওয়াদ ফিরে আসার পরেও না। ঠিক তেমনি এখনো নূহার কিছু কিছু জিনিস প্রথম দিনের মতোই অধরা রাহাতের কাছে। শুধু এই শূন্যতা টুকুতে দৃষ্টিপাত না করলে জীবনের আর কোথাও কোন অপূর্ণতা খুঁজে পায় না রাহাত। তার ছোট থেকে ছোট বিষয়ও অতি যত্নের সাথে খেয়াল রাখে নূহা। নূহার কথা, কাজ আচরণে তার প্রতি ভালোবাসাও অনুভব করতে পারে। কারো প্রতি কারো ভালোবাসা যখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সেটা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। কিন্তু কারো ভালোবাসা যখন অনুভবের তন্ত্রীকে ছুঁয়ে সুর তুলে যায়। তখন সেখানে ভালোবাসার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। তাই রাহাত জানে তাদের সুখের বাগিচায় ভালোবাসার বর্ণিল ঘাসফুল সংখ্যা একেবারে কম নয় ...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন