কফি মেকারের দিকে তাকাতেই হাসি ফুটে উঠলো নূহার মুখে। বেশ কিছুদিন
আগে নানান ব্যস্ততার কারণে একদিন নাবিহাকে ফোন দিতে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য ঠিক ভুলে
যায়নি। সারাদিনে বারবারই মনে পড়েছে কিন্তু একটু পর ফোন দিচ্ছি ভাবতে ভাবতে
শেষপর্যন্ত দেয়াই হয়নি। পরদিন ভোরবেলাতেই নাবিহা হাজির হয়ে গিয়েছিল। মুখে কিছুই না
বলে গাল ফুলিয়ে সারাঘরে যেই জিনিসগুলো দিনের মধ্যে একাধিকবার ব্যবহার করে নূহা
সেসবের উপরে বড় বড় করে লিখে রেখে গিয়েছে, "মামণি
মিস না করলেও নাবিহা মামণিকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ মিস করে। কারণ নাবিহা মামণিকে
এত্তোগুলা এত্তোগুলা এত্তোগুলা ভালোবাসে। হুম্ফ..." মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে
আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিল নূহা। কিন্তু নাবিহার হুম্ফ, হুম্ফ
বন্ধ হয়নি তবুও। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অভিমান ভাঙাতে হয়েছিল। তারপরও গাল কিছুটা
ফুলিয়ে রেখেই গদগদ কন্ঠে নাবিহা বলেছিল, আর
যাতে কখনোই আমাকে ফোন দিতে ভুলে না যাও তাই সারাঘরে এটা লিখে দিয়ে গেলাম। তুমি
যখনই ফ্রীজ থেকে কিছু বের করবে, ওভেনে কিছু গরম করবে, কফি
বানাবে, ল্যাপটপ ওপেন করবে, ওয়াশরুমের
আয়নায় তাকাবে, বারান্দায় যাবে সারাক্ষণ নাবিহার কথা মনে পড়বে। নূহা হাসি মুখে
বলেছিল, মনে পড়ার জন্য তো আগে ভুলতে হয়। তোমাকে আমি কখনো ভুললেই না মনে
করবো। তুমি তো সারাক্ষণই আমার মন জুড়ে আছো, থাকো।
নাবিহার জবাব ছিল, এটাই তো সমস্যা। তুমি সবাইকে মনের ভেতরে রেখে দাও সারাক্ষণ। কিন্তু
বাইরে থেকে তো মনের ভেতর দেখা যায়না। তাই মাঝেমধ্যে মনের ভেতরের অবস্থা প্রকাশিতও
করতে হয়। এই নোটিশগুলো তোমাকে সেটা করতে সহায়তা করবে। আর কিছু না বলে হাসিমুখে
চুপচাপ মেনে নিয়েছিল তখন নাবিহার কথা। তবে এরপর থেকে যখনই নাবিহার লেখাগুলো চোখে
পড়ে শত টেনশনের মাঝেও অদ্ভুত রকম প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। সারাক্ষণই ভালোবাসার
আবর্তে ঘুরছে জীবন এই উপলব্ধিটা যে কারো জন্যই পরম পাওয়ার। একটা সময় অবশ্য নূহাও সর্বক্ষণ
প্রিয়জনদের প্রতি মনের ভালোবাসাকে জানান দেয়ার বাহানা খুঁজতো। কিন্তু নিয়তি যখন
সবার চেয়ে বেশি প্রিয় মানুষটাকে ঘিরেই ভালোবাসার প্রকাশকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিল।
এরপর থেকে ভালোবাসার সংজ্ঞা কেমন যেন বদলে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে ভালোবাসা প্রকাশ
করার চেয়ে নিভৃতে ভালোবেসে যাওয়াটাই স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছে। চিন্তার রাশ টেনে
না ধরলে মনের প্রকৃতি জুড়ে এখনই ঝরাপাতার গান শুরু হবে বুঝতে পারছিল নূহা। সুযোগের
অসৎ ব্যবহারে মনের জুড়ি মেলা ভার। মনকে কোনরকমের সুযোগ দেয়া যাবে না এখন। তাই কফি
মেকার ওপেন করে পাশ থেকে সেলফোন তুলে নিয়ে নাবিহাকে ফোন করলো। সালাম বিনিময়ের পর
ওপাশ থেকে নাবিহার হুম্ফ ধ্বনি শুনতে পেয়ে নূহা হেসে বলল, কি
হয়েছে আমার ছোট্ট পরী বুড়িটার?
নাবিহা অভিমান সিক্ত কন্ঠে বলল, তুমি
জানো পাপা এখনো আসেনি। পাপার কথা ছিল আমাদের চারজনকে নিয়ে লাইব্রেরীতে যাবে। আজ
লাইব্রেরীতে জ্ঞানার্জনের উপরে বাচ্চাদের অভিনীত একটা প্লে ছিল। আমাদের সবার সেটা
দেখতে যাবার কথা ছিল। কিন্তু পাপা কথা দিয়ে কথা রাখিনি। বিকেলে ফোন দিয়ে বললো, রিসাব
চাচ্চুর সাথে লাইব্রেরীতে যেতে। আমরা কেউ যাইনি। কেন যাবো পাপাকে ছাড়া? তুমি
বলো পাপাকে কিছু বলবে কিনা? হুম্ফ।
বলবো না মানে? তবে শুধু বললে তো হবেনা। এরজন্য তো তোমার পাপাকে কঠিন কোন শাস্তি
দিতে হবে। কিন্তু কি শাস্তি দেয়া যায় বলো তো?
আমরা চারজন ঠিক করেছি এখনই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো। পাপার
জন্য অপেক্ষা করবো না। পাপা এসে দেখবে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি। এটাই হবে শাস্তি।
আইডিয়াটা কেমন?
কিন্তু এমনটা করলে যে তোমাদের পাপার অনেক মনখারাপ হবে সোনা। আর
আমরা যাদেরকে ভালোবাসি তাদেরকে কখনোই এমন শাস্তি দেয়া ঠিক নয় যাতে তারা কষ্ট পেতে
পারেন। ভালোবাসা যন্ত্রণা দিতে পারে কিন্তু যাতনা কখনোই নয়। তাই পাপাকে যন্ত্রণা
দেবার কোন বুদ্ধি খুঁজে বের করো চারজন মিলে। অবশ্য তোমাদের আইডিয়াটাও এপ্লাই করতে
পারো। তবে সত্যি সত্যি না ঘুমিয়ে চারজন ঘুমের ভাণ করো। পাপা যখন এসে তোমাদেরকে
ঘুমন্ত দেখে মনখারাপ করে রুমে গিয়ে বসবে তখন চারজন মিলে হঠাৎ হাজির হয়ে চমকে দেবে
পাপাকে।
নাবিহা হেসে বলল, হ্যা এটা ফাটাফাটি আইডিয়া। এরপর হবে পাপার সাথে আমাদের পিলো ফাইট।
লাভ ইউ মামণি। তুমি বলে না দিলে আমরা তো পাপাকে কষ্ট দিয়ে ফেলতাম। আমরা তো জানি
পাপা ইচ্ছে করে প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেনি। নিশ্চয়ই খুব জরুরি কোন কাজে আটকে
গিয়েছিল। নয়তো পাপার কাছে তো আমাদের খুশি সবচেয়ে বেশি ইমপটেন্ট।
নূহা হেসে বলল, এই তো নাবিহা এখন আম্মাজানের মত চিন্তা করতে শুরু করেছে। অভিমানের
সবচেয়ে খারাপ দিক কি জানো মা?
কি মামণি?
অভিমান আমাদের চিন্তা-চেতনাকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। ঐ মূহুর্তে
আমরা শুধু নিজের কষ্টের কথাই ভাবি এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবেই প্রিয় কারো কষ্টের কারণ
হয়ে দাঁড়াই।
আমরা কখনোই পাপার কষ্টের কারণ হতে চাই না মামণি। আমরা সবসময় পাপাকে
আনন্দ দিতে চাই, অনেক অনেক ভালোবাসা দিতে চাই ইনশাআল্লাহ।
চাওয়া উচিত। কারণ তোমাদের পাপা তোমাদের কাছে শুধু আনন্দ আর
ভালোবাসাই ডিজার্ভ করেন। এটা ঠিক যে, বাবা-মা
যখন সন্তানদের জন্য কোন স্যাক্রিফাইস করেন। বদলে তারা সন্তানদের কাছে কিছুই আশা
করেন না। সন্তানদের জন্য বাবা-মার ত্যাগ নিঃস্বার্থই হয়। কিন্তু সন্তানদেরও কিছু
করণীয় থাকে। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কখনোই
এমন কিছু না করা যাতে বাবা-মা কষ্ট পেতে পারেন। আর তোমাদের পাপা তো এই পৃথিবীর
সবচেয়ে স্পেশাল পাপাদের একজন। তাই না?
হ্যা মামণি। আমাদের পাপা তো সবচেয়ে বেষ্ট পাপা।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে এরপর থেকে শাস্তির প্ল্যানিং নেবার সময়
অবশ্যই খেয়াল রাখবে পাপা অতি সামান্য পরিমাণ কষ্টও পেতে পারেন এমন কোন কিছু যাতে
কখনোই সংঘটিত নাহয় তোমাদের দ্বারা। সবাই মিলে পাপাকে এত বেশি ভালোবাসা দেবে, এত
বেশি ভালোবাসা দেবে যাতে পাপার মনের একবিন্দু স্থানও অন্তত পক্ষে তোমাদের
ভালোবাসার অভাবে শূন্য না থাকে।
ওকে মামণি ইনশাআল্লাহ। কিন্তু কিভাবে পাপাকে ভালোবাসতে হবে, কি
কি করতে হবে আমাদেরকে তুমি বলে দিও কেমন?
নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই বলে দেবো। আমাকে তো বলে দিতে হবেই। পাপাকে
ভালোবাসা যেমন তোমাদের ডিউটি। কিভাবে পাপাকে ভালোবাসতে হবে সেটা বলে দেয়া আমার
ডিউটি।
নাবিহা হেসে বলল, ওকে ডান ডিল। তাহলে বলে দাও এখন কি করতে হবে আমাদেরকে?
পাপা বিকেলে না আসার কারণে তোমাদের মনের আকাশে যে অভিমানের মেঘ
জমেছিল। সেই মেঘকে শব্দের বরষা রুপে সাদা কাগজের ফ্রেমে বন্দী করে ফেলো। তারপর খুব
সুন্দর একটা খামে ভরে পাপাকে উপহার দাও। তোমাদের অভিমানী শব্দমালা একদিকে যেমন
পাপার প্রতি তোমাদের ভালোবাসা জানান দেবে। অন্যদিকে পাপাও তোমাদের অভিমান ভাঙানোর
সুযোগ পেয়ে যাবে। ভালোবাসা আমাদের কাছে দাবী করে আমরা যেন ভালোবাসার মানুষদের
ভুলগুলোকে শুধতে নিতে যথাযথ সহায়তা করি। তাদের পরীক্ষাগুলোকে যেন সহজ করে দেবার
আপ্রাণ চেষ্টা করি। বুঝেছেন আম্মাজান?
নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ বুঝেছি মামণি। আমরা এক্ষুণি চিঠি লিখতে বসছি
পাপাকে। তোমার সাথে পরে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ মামণি।
নূহা হেসে বলল, ওকে আল্লাহ হাফেজ। শোনো চিঠির এক কপি কিন্তু আমিও চাই।
ওকে লেখা শেষ করে তোমাকে ফটোকপি করে পাঠিয়ে দেবো ইনশাআল্লাহ। এখন
যাই মামণি। লাভ ইউ। বলা মাত্রই ফোন ছেড়ে ছুট লাগালো নাবিহা। পাপার প্রতি নাবিহার
ভালোবাসা জানান দেয়ার আকুলতা অনুভব করে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো নূহার
চেহারাতেও। সেলফোন রেখে কফি মগের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলো তখন আবারো বেজে উঠলো
ফোন। কোন কারণে হয়তো নাবিহা আবারো কল দিয়ে ভেবে ফোন হাতে তুলে নিয়ে স্ক্রিনে দেখতে
পেলো জুনির নাম্বার। কল রিসিব করে হাসি মুখে সালাম দিলো নূহা। কিন্তু অপর পাশ থেকে
ফোঁপানোর শব্দ পেয়ে প্রথমে বেশ ঘাবড়ে গেলো। পরমূহুর্তেই মনে পড়লো একটুতেই কান্না
করে আকাশ-বাতাস ভারী করে তোলার স্বভাব জুনির। তাই টেনশন ঝেড়ে ফেলে মায়া জড়ানো
কন্ঠে বলল, কি হয়েছে জুনি? তুমি কান্না করছো কেন? কোন
সমস্যা? কেউ কিছু বলেছে? নাকি ইমাদের সাথে আবারো ঝগড়া হয়েছে? কথা
বলছো কেন? এভাবে শুধু কান্না করে গেলে আমি বুঝবো কিভাবে তোমার কি হয়েছে? আমাকে
আগে বলতে তো হবে কি হয়েছে, তাই না?
আরো কিছুক্ষণ ফোঁপানোর পর জুনি বলল, আপ্পা
তুমি আমাকে কেন ভালোবাসো সেটা বলো?
কেন ভালোবাসি মানে?
মানে কেন তুমি আমাকে ভালোবাসো? আমাকে
ভালোবাসার পেছনে কারণটা কি তোমার?
ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে ইমাদের সাথে জুনির কিছু হয়েছে আন্দাজ করতে
পারলো নূহা। কিন্তু যেহেতু ঘটনার আবহাওয়া সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তাই ঠিক
কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কেননা ভীষণ রকম সেনসেটিভ স্বভাবের মেয়ে জুনি।
একটু কিছু হলেই সেটা নিয়ে শোরগোল বাঁধিয়ে দেয়। তাকে বুঝিয়ে বলার ঝক্কিও অনেক। কথা
একটু খানি বিপক্ষে গেলেই দেখা যাবে কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। তাই কি ঘটেছে
সেটা জানার উদ্দেশ্যে হাসতে হাসতে নূহা বলল, তুমি আর নাবিহা মিলে এই লাইনটা সবাইকে এক এক করে জিজ্ঞেস করার
প্ল্যান নিয়েছো বুঝি?
কোন লাইনটা? আমি বুঝিনি আপ্পা।
নূহা কন্ঠে হাসি ধরে রেখে বলল, কয়েকদিন
আগে নাবিহাও এমন জানতে চেয়েছিল যে, মামণি
তুমি আমাকে কেন ভালোবাসো? শুধুই কি আমি তোমার মেয়ে সেজন্য? যদি
তোমার মেয়ে না হতাম তাহলে তুমি আমাকে ভালোবাসতে না? ইত্যাদি
ইত্যাদি।
তুমি নাবিহাকে কি জবাব দিয়েছিলে আপ্পা?
কোন জবাব দেইনি আসলে। তবে নাবিহাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম ভালোবাসার
পেছনে কারণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা।
সেটা কি রকম? আমাকেও বুঝিয়ে বলো।
আচ্ছা চলো বুঝিয়ে বলছি। যেমন ধরো, আমাদের
বাবা-মা। বাবা-মাকে আমরা কেন ভালোবাসি? কারণ
তাদেরকে জারিয়া করে আল্লাহ আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যখন পৃথিবীতে এসেছিলাম
তখন কতই না অসহায় ছিলাম আমরা। বাবা-মা আমাদেরকে আদর-ভালোবাসা, যত্ন-পরিচর্যা
ইত্যাদির মাধ্যমে ধীরে ধীরে বড় করে তুলেছেন। একসময় আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। নিজের
ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছি। নিজেই নিজেকে কেয়ার করা শিখেছি। আমাদের জীবনে বাবা-মার যে
অবদান সেটার কি কোন তুলনা চলে? আমাদের মনে বাবা-মার যে স্থান সেখানে কি অন্য কাউকে বসানো সম্ভব?
কখনোই না। বাবা-মা’র
মতো কেউ নেই পৃথিবীতে।
হ্যা। কিন্তু এর কারণ কি? কারণ
তারা আমাদের বাবা-মা। এখন বাবা যদি আমাকে প্রশ্ন করে তুমি কি আমাকে শুধু আমি তোমার
বাবা বলেই ভালোবাসো? অন্য আর কোন কারণ নেই? প্রশ্নটা
কি কিছুটা হাস্যেকর হয়ে যাবে না? আমি আমার চাচা, মামাকেও ভালোবাসি। কিন্তু সেটা চাচা বা মামা হিসেবেই। উনারা যদি
প্রশ্ন করেন তুমি কেন আমাকে চাচা হিসেবে ভালোবাসো? কেন
আমাকে বাবা হিসেবে ভালোবাসো না? এর জবাবে যে কেউ বলবে, কারণ
তুমি আমার চাচা। চাচাকে কেন আমি বাবা হিসেবে ভালোবাসতে যাবো? আর
আমার বাবাকেই বা কেন আমি অন্যকোন কারণে ভালোবাসতে যাবো? হ্যা
এটা ঠিক যে, সম্পর্কের বাইরে ব্যক্তি হিসেবেও আমরা কাউকে শ্রদ্ধা-সম্মান করতে পারি।
যেমন আমি সবসময় আমার বাবার সম্পর্কে বলি, শুধু
পিতা হিসেবেই নয় মানুষ হিসেবেও বাবা আদর্শবান। এমন আদর্শ বাবা আমার ফ্রেন্ডদের
অনেকেরই আছে। তাদের বাবাকেও আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমার বাবার মত ভালো
অবশ্যই বাসি না। বাসবোই বা কেন? আমার বাবা অন্য আর সবকিছুর উপরে আমার বাবা। ঠিক তেমনি নাবিহা আর
তুমিও। এটাই তো সম্পর্কের বাঁধন তাই না? যেখানে
একে অপরকে ভালোবাসার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এত চমৎকার বন্ধন আমাদের মাঝে বিরাজমান।
সেখানে ভালোবাসার পেছনে অন্য কারণ খুঁজতে যাওয়া কি বাতুলতা নয় বল?
কিন্তু কেউ যদি সম্পর্কের বাঁধনকেও অন্য কোন ভালোবাসার মানদণ্ডে
বিচার করে তাহলে?
সেটা কি রকম?
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে জুনি বলল, আজ
ফজরের সময় আমার শরীর খুবই খারাপ লাগছিল। উঠতে একটু দেরি হয়েছিল নামাজের জন্য। ইমাদ
আমাকে কয়েকবার ডেকে মসজিদে চলে গিয়েছিল। মসজিদ থেকে ফিরে এসেও যখন দেখলো তখনো
নামাজ আদায় না করে আমি শুয়ে আছি আমাকে খুবই কড়া কড়া কথা শোনালো। আরো বলল, জীবনের
প্রতিটা সম্পর্কের হক শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আদায় করে। ওর মনে আল্লাহর
ভয় আছে বলেই নাকি আমার অনেক অন্যায় ও ভুল চুপচাপ মেনে নেয়। ও নাকি এমন
জীবনসঙ্গী চেয়েছিল যে তাকে আরো আল্লাহর সান্নিধ্যে টেনে নিয়ে যাবে। আরো নানান
কথা। এমনিতেও সারাক্ষণ কথায় কথায় বলে, আমাকে
নাকি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে। এটা কি ধরণের কথা তুমিই বলো আপ্পা? স্ত্রী
হিসেবে কি আমার কোন মূল্যই নেই?
আল্লাহর জন্য কেউ তোমাকে ভালোবাসা মানে তুমি মূল্যহীন?! এমন
চিন্তা কে ঢোকালো তোমার মাথায়? জুনি তুমি কি কখনো শান্ত মনে ভেবে দেখেছো তোমার চিন্তাধারা কোনদিকে
প্রবাহিত? তুমি এতটাই আত্ম মোহাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছো যে কেউ তোমাকে আল্লাহর জন্য
ভালোবাসে সেটা মেনে নিতে বা সহ্য করতে পারছো না? এর
ফলে তুমি কি আল্লাহকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছো না এক হিসেবে? নাউজুবিল্লাহ!
না না আপ্পা আমি এমনটা মিন করিনি। প্রায় চিৎকার করে উঠলো জুনি।
নূহা বলল, কিন্তু তোমার চিন্তা তো এমনটাই বলছে। তুমি কি ঐ হাদীসটি সম্পর্কে
জানো না? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না সেদিন তিনি সাত
শ্রেণীর লোককে তার ছায়ায় স্থান দেবেন। তারা হলেন- এক. ন্যায় পরায়ন শাসক। দুই. যৌবন
কাল আল্লাহরইবাদতে কাটিয়েছে এমন যুবক। তিন. সে লোক যার মন মসজিদের সাথে যুক্ত
থাকে। মসজিদ থেকে বের হয়ে আসার পর আবার ফিরে যাবার জন্য মন ব্যাকুল থাকে। চার. সে
দু’ব্যক্তি যাদের ভালবাসার ভিত্তি আল্লাহর
সন্তুষ্টি। যাদের একত্রিত হওয়া এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে।
পাঁচ. ঐ ব্যক্তি যে, নিভৃতে আল্লাহকে স্মরণকরে চোখের পানি ফেলে। ছয়. ঐ ব্যক্তি যে, আল্লার
ভয়ে কোন উচ্চ বংশের সুন্দরী যুবতীর বদ কাজের আহবানকে প্রত্যাখান করেছে ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’ বলে।
সাত. ওই ব্যক্তি সাদকা করার সময় যার বাম হাত টের পায় না, ডান
হাত কী দানকরেছে।” এই দুনিয়াতে আমরা কেন এসেছি বলো তো? আল্লাহর
ইবাদাত করার জন্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে চির শান্তির জান্নাত লাভ
করার জন্য। তাই নয় কি?
জ্বি আপ্পা।
দুনিয়াতে আমরা যেই উদ্দেশ্যে এসেছি। সেই উদ্দেশ্যে বাস্তবায়িত করতে
পেরেছি কিনা, সেই হিসাব যেদিন করা হবে। সেই কিয়ামতের দিন, যেদিন
আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না। সেদিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয়
পাবার একটা পন্থা হতে পারে দুনিয়াতে কাউকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসা। যেই
উদ্দেশ্যে আমাদের দুনিয়াতে আগমন, অবস্থান। সেই উদ্দেশ্য হাশিলের এমন সহজ ও সুন্দর একটা সুযোগ কি কোন
বুদ্ধিমানের হাতছাড়া করা উচিত? আমার স্বামীকে আমার ভালোবাসতেই হবে বা তাকে আমি ভালোবাসবোই। এই
করণীয়টি করার সময় যদি আমি শুধুমাত্র একটা স্মরণে রাখি যে, এই
ভালোবাসা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাহলে স্বামীর হক আদায়ের সওয়াবের সাথে সাথে
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সওয়াবও আমার ভান্ডারে এসে জমা হবে ইনশাআল্লাহ। অথচ এই
সওয়াবের এর জন্য আমাকে বাড়তি কিছু করার প্রয়োজনও পড়বে না। কিন্তু এর বদলে আমি হয়তো
বা আল্লাহর আরশের নীচে একটু জায়গা করে নিতে পারবো। ভেবে দেখো দুনিয়াবী কত শত
সম্পর্ক আমাদেরকে ঘিরে আবর্তিত। বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, মামা-মামী, খালা-ফুপু, বন্ধু-বান্ধবী, শিক্ষক-ছাত্র, পাড়া-প্রতিবেশী।
এই সব সম্পর্কের ভিত্তি যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাহলে এই সব ভালোবাসার
যোগফলে সবচেয়ে লাভবান আসলে কে হবে? বুঝতে
পেরেছো আমার কথা?
জ্বি আপ্পা আমি বুঝতে পারছি!
নূহা হেসে বলল, কিন্তু এখনো মন থেকে মানতে পারোনি তাই না? সমস্যা
নেই। হুট করে মেনে না নেয়াই ভালো কোন কিছু। চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনার
দ্বারা কিছু মেনে নিলে সেটাই ভিত্তি মজবুত হয়। তবে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান
দুনিয়াবী ভালোবাসাগুলো যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতো। তাহলে আরেকটা কল্যাণকর
জিনিস কি হতো জানো?
কি আপ্পা?
দুনিয়াতে হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা-পরশ্রীকাতরতা, গীবত-চোগলখরী, সম্পর্কের
মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনেক কমে যেত। আমরা দোষের বদলে গুণের বিচারি হতাম। প্রতিশোধ
না নিয়ে ক্ষমা করে দিতে পারতাম। অসৎ কাজে বাঁধা প্রদান ও সৎ কাজের পরামর্শ দানে
অগ্রগামী হতে পারতাম। ইগো সম্পর্কের বন্ধনের মাধুর্যকে ঘুণ পোকার মত কুড়ে কুড়ে খেয়ে
ফেলতে পারতো না। কল্যাণকামী হতে পারতাম আমরা সত্যিকার অর্থে। একে অন্যের পরীক্ষা
না নিয়ে বরং একে অন্যেকে কিভাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে দেয়া যায় সেই চেষ্টা করতাম।
কারণ এই সবকিছুর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে দুনিয়াতে আসার লক্ষ্য ও
উদ্দেশ্যেকে গন্তব্যে পানে পৌছানোর প্রয়াস করতাম। ভেবে দেখো আমরা কত কিছু করি
ভালোবাসার মানুষদের জন্য। কষ্ট স্বীকার করি, ত্যাগ
করি। যেসব কখনো মুল্য পায়, কখনো পায় না। কিন্তু নিয়্যাত যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে তাহলে
দুনিয়াতে সেসবের মূল্যায়ন না হলেও। আখিরাতে ইনশাআল্লাহ হবে। আর সেদিনই মূল্যায়নের
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়বে আমাদের।
এখন আমি বুঝতে পেরেছি আপ্পা। নিজেকে খুব বোকা মনেহচ্ছে এখন।
এমন বোকামি আসলে আমরা অনেকেই করি। কেন করি জান? কারণ
দুনিয়াতে আসার উদ্দেশ্যেটাকেই আমরা ভুলে যাই বলে। দুনিয়াতে আসার উদ্দেশ্যে যে জানে
সে কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়্যাত ছাড়া কিছু করে না। এবং অন্য কেউও তাকে
আল্লাহকে অসন্তোষ করে কিছু করবে এমন কিছু চাইতে পারে না। যদি কেউ কখনো এমন চেয়ে
ফেলে বুঝতে হবে সে ঐ মূহুর্তে শয়তানের ওয়াসওয়াসার গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাকে
তখন আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে। কিভাবে বলো তো?
জুনি হেসে বলল, আউজুবিল্লাহ হি মিনাশ শায়তানির রাজিম।
নূহা হেসে বলল, ভেরি গুড। এখন তাহলে বোকামি ভুলে গিয়ে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে
থাকো শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে।
জুনি হেসে বলল, আই লাভ ইউ আপ্পা। তোমাকে ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি। অনেক অনেক
অনেক ভালোবাসি। এবং শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য এই ভালোবাসা।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। সেম টু ইউ। এখন বিদায় হও। আরেকবার লাভ ইউ বর্ষণ করে বিদায় নিলো জুনি। নূহাও ফোন রেখে কফি বানিয়ে অপেক্ষারত ফাতিমা ও সাবিরার কাছে রওনা দিলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন