সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...১৪





কনফারেন্স
রুম থেকে নূহাকে বেরিয়ে আসতে দেখে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলেও আড়ালে সরে দাঁড়ালো মুনা লজ্জা-ভয়-শঙ্কা-দ্বিধার মিশেল অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরলো তার মনকে সকালে যখন জেনেছিল তখন থেকেই বার বার একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে মনের মাঝে কি করে আপির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? নিজেকে করা এই প্রশ্নে প্রতিবারই মুনার চোখে অশ্রু ছলকে উঠছিল যদিও খুব ভালো করেই জানে নূহা হাসি মুখে অকৃত্রিম আন্তরিকতার সাথেই তাকে বুকে জড়িয়ে নেবে অতীতের প্রসঙ্গ টেনে আনবে না কখনোই কারণ নূহা তো তখনো তার অন্যায়ের কথা, ভুলের স্রোতে ভেসে চলার কথা জানতো কিন্তু কখনোই কোন কথা, কাজ বা আচরণের দ্বারা বুঝতে দেয়নি তাকে নূহা যে তার মনের অসৎ চিন্তা উদ্দেশ্যে জানতো সেটা অনেক পরে জেনেছিল মুনা এরপরে আর কখনোই নূহার সাথে দেখা হয়নি সুযোগ এসেছে অনেকবারই কিন্তু নূহার সামনে যাবার সাহস করতে পারেনি সেজন্যই অপরাধ বোধের মাত্রা এত বেশি মুনার মনে বার বার শুধু মনেহয়, নূহা আপি যদি খুব করে বকে দিতো তাকে, ভর্ৎসনা করতো তাহলে হয়তো নিজেকে এতটা ছোট মনে হতো না এই সমস্ত ভাবনার উত্তাল ঝড় নিয়ে ঝিলের পাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলো যখনই কোন কারণে মন খারাপ হয় চুপ করে ঝিলের পাড়ে বসে থাকে একটা সময় ধীরে ধীরে মন শান্ত হয়ে যায় কিন্তু আজ ঝিলের পাড়ে পৌঁছতেই মন আরো অশান্ত হয়ে উঠলো বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছেন জাওয়াদ এতটা দূর থেকে শোনা যাচ্ছে না কারো কথাই কিন্তু সবার উচ্ছ্বাসিত অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিলো খুব আনন্দময় কথোপকথন চলছে মনের সমস্ত বিশৃঙ্খলতা কোথায় যায় নিমিষেই মিলিয়ে গেলো মুনার টের পাচ্ছিলো মুগ্ধময় ভালো লাগার তীব্র স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে মনের অন্য আর সব অনুভূতি আবারো ব্যর্থ হলো মনের রাশ টেনে ধরতে মন ডানা মেলে ছুট লাগালো অতীতের পানে

পনেরো
বছর আগে রোজকার মতো সেদিন বিকেলেও ছোট দুই বোনকে নিয়ে বাড়ির পাশের পার্কে ঘুরতে বেড়িয়েছিল মুনা। বিশাল এই রিহ্যাভ সেন্টারটা তখন ছিল না এখানে। সবে মাত্র কাজ শুরু হয়েছিল। বাবার কাছ থেকে আগেই জেনেছিল কয়েকজন বাঙ্গালী, পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান এবং ইউরোপিয়ান ব্যক্তির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে রিহ্যাভ সেন্টারটি। আর্কিটেক্টদের মধ্যে একজন মুনার বাবাও ছিলেন। তাই রিহ্যাভ সেন্টার লক্ষ্য উদ্দেশ্যে সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছিল বাবার কাছ থেকে। জেনেছিল উদার-আলোকিত কিছু মানুষের স্বপ্নকথন। স্বার্থবাদী এই দুনিয়ায় নিঃস্বার্থ কিছু মানুষের অন্য মানুষের জন্য কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অনুভব করেছিল মানুষগুলোর সাথে কাজ করতে শুরু করার পর থেকে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে তার বাবার স্বভাবের নেতিবাচক দিকগুলো। তাই অজানা একটা কৌতুহল সবসময়ই কাজ করতো উদ্যোক্তা সেই ব্যক্তিদেরকে ঘিরে। মুনার শৈল্পিক মনা বাবা ঘুরে ফিরে শুরু একটা কথাই বলতেন, “সৌন্দর্য দেখার ছোট্ট কোন সুযোগও হাতছাড়া করবে না। কাছ থেকে হোক কিংবা দূর থেকে সৌন্দর্যকে সর্বদা উপভোগ করার চেষ্টা করবে। তাহলে চোখে দেখা বাহ্যিক সেই সৌন্দর্যের প্রভাবে ধীরে ধীরে তোমার অন্তঃজগতও সুন্দর হয়ে উঠবে ছোটবেলা থেকে বাবার এই কথাটা এতবার শুনেছে মুনা। যে শুনতে শুনতে মনে সৌন্দর্যের প্রতি নেশা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সুন্দর যে কোন জিনিসের জিনিসের প্রতিই ছিল অদম্য এক ভালো লাগাময় আকর্ষণ।

প্রায়
দিনের মতো সেদিনও দূর থেকে সৌন্দর্য কর্ম অবলোকন করার উদ্দেশ্যে দুই বোনকে নিয়ে সেন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটি স্বপ্নকে পূরণের উদ্দেশ্যে একদল মানুষ রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। দেখতে খুব ভালো লাগতো। মুসলিম হলেও ইউরোপিয়ানদের মতোই লাইফ স্টাইল ছিল মুনাদের পরিবারের সবার। বাবা-আম্মু কাউকেই কোনদিন নামাজ পড়তে, কুরআন পড়তে দেখেনি। তাই যখনই নামাজের সময় হতো মুসলিম স্টাফদের সবাইকে কাজ বন্ধ করে একসাথে নামাজ পড়তে দেখে খুব অবাক হতো। সবচেয়ে অবাক হয়েছিল যেদিন সবার সাথে তার বাবাকেও নামাজ পড়তে দেখেছিল। সেদিনই জাওয়াদকেও প্রথম দেখেছিল মুনা। নামাজ শেষ করার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বুঝিয়ে বলছিলেন সবাইকে জাওয়াদ। মুনা অপলক শুধু তাকিয়ে দেখছিল আর ভাবছিল, একজন মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? কথা বলার ফাঁকে কোন কারণে জাওয়াদ যখন হেসে ফেলেছিল। মুনার মনে হয়েছিল, কোন ছেলের হাসি এমন অদ্ভুত নজর কাড়া হতে পারে এই তথ্য তো জানাই ছিল না তার। এরপর এক মাস প্রতিদিন যখনই সুযোগ পেয়েছে রিহ্যাভ সেন্টারে ছুটে গিয়েছে জাওয়াদকে দেখার জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই দেখা পায়নি জাওয়াদের। কৌশলে বাবার সেলফোন থেকে জাওয়াদের নাম্বার বের করে বেশ কয়েকবার বাইরের বিভিন্ন টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করে কথা বলারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নাম, পরিচয় এবং কেন কথা বলতে চায় সেটা ঠিকমতো বলতে না পারার কারণে জাওয়াদ কথা বলেননি। ডক্টর জানার পর যেই হসপিটালে প্র্যাক্টিস করছেন সেখানেও ছুটে গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। দুতিন বার দূর থেকে দেখেছে কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়নি কখনোই।

জাওয়াদকে
কাছ থেকে দেখার, উনার কথা শোনার প্রথম সুযোগ হয়েছিল এর প্রায় দুই মাস পরে। দরকারি কিছু কেনাকাটা করার জন্য সুপার মার্কেটে গিয়েছিল। হঠাৎ গ্রোসারী সেকশনে জাওয়াদকে দেখতে পেয়ে প্রায় ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিভাবে কথা শুরু করবে ভাবছিল এমন সময়ই জাওয়াদই বলে উঠেছিল, কি ব্যাপার তুমি কিছু বলছো না কেন? আমার মিটিং আছে ঘন্টা খানেক পর। প্লীজ যা যা নেবার আরেকটু তাড়াতাড়ি নিয়ে নাও। কথাগুলো যে তাকে উদ্দেশ্যে বলা হয়নি বুঝে নিয়েছিল মূহুর্তেই মুনা। কাকে বলেছে দেখার জন্য জাওয়াদের পেছনে তাকাতেই নূহাকে দেখতে পেয়েছিল। জাওয়াদের কথার জবাবে নূহা বলেছিল, তাড়াতাড়ি করার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমার যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ লাগিয়েই বাজার করবো। তাছাড়া বাসা থেকে বের হবার সময় আপনি অকারণে আমাকে একগাদা কথা শুনিয়েছেন। সেজন্য আগে লিখিত ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এরপর গিয়ে আপনার সাথে কথা বলার প্রশ্ন আসবে। সুতরাং, এরআগে নো কথা। চুপচাপ আমার পেছন পেছন ট্রলি চালকের কাজ করেন। জাওয়াদ বলেছিলেন, তারচেয়ে বরং অন্য আরেকটা কাজ করি। তোমাকে দুটা থাপ্পড় দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। ক্ষমা প্রার্থনার একদম নিউ স্টাইল এটা। এরআগে কেউ কারো কাছে এভাবে ক্ষমা চেয়েছে বলে আমি শুনিনি কিংবা পড়িনি। কি বলো লাগাবো কষে দুটা থাপ্পড়? নূহা জবাবে হেসে বলেছিল, হায় আল্লাহ কত খারাপ এই লোক। অনেক সহ্য করেছি শব্দের অত্যাচার। আর না। আজই আমি চলে যাবো এখান থেকে। দুজন ননস্টপ তর্ক-বিতর্ক করেই চলছিল একে অন্যের সাথে। নূহা আর জাওয়াদ স্বামী-স্ত্রী এবং একে অন্যের সাথে দুষ্টুমি করছে এটা বুঝতে বেশ অনেকক্ষণ লেগেছিল মুনার। কিন্তু মূহুর্তে এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ভয়াবহ এক যাতনা নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে এসেছিল।

বাসায়
ফিরে বাবার কাছ থেকে জেনেছিল রিহ্যাব সেন্টারের কাজ নিজেই তদারকি করার জন্য জাওয়াদ আপাতত কয়েকমাস এখানেই থাকবেন। তাই সাথে করে ওয়াইফকেও নিয়ে এসেছেন। তখন নিজ উদ্যোগেই নূহার সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছিল মুনা। নূহার সাথে বন্ধুত্ব করার মূল উদ্দেশ্যে জাওয়াদের কাছাকাছি যাওয়াই ছিল। কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে নূহাকেও ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল মুনার। যদিও নূহার প্রতি সেই ভালো লাগাও মুনার মন থেকে জাওয়াদের আকর্ষণকে কম করতে পারেনি। বরং নূহার কাছে জাওয়াদ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা জেনে আকর্ষণ আরো বেড়ে গিয়েছিল। তবে নূহা বুঝতে না পারলেও জাওয়াদ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল তার মনের গোপন চাওয়া। সেটা জাওয়াদের কঠোর ভাবে তাকে এড়িয়ে চলা দেখেই আঁচ করে নিয়েছিল মুনা। সময়ও যেমন তার প্রতি মনের বিরক্তি স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিতো জাওয়াদ। গত এগারো বছরেও যে কয়বারই কোন কারণে জাওয়াদের মুখোমুখি হয়েছে, একই রকম বিরক্তি ফুটে উঠতে দেখেছে জাওয়াদের চেহারাতে। প্রতিবারই ভাবে এরপর আর কোনদিন জাওয়াদের সামনে যাবে না। কিন্তু যখনই জাওয়াদ রিহ্যাভ সেন্টারে আসে, না চাইতেও নানান বাহানায় উনার সামনে যাবার সুযোগ খোঁজে। এই মূহুর্তেও ভেতর থেকে কেউ টানছিল অন্য কোথাও নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু চেতন মন এখান থেকে সরে যাবার বিন্দুমাত্র তাগিদা অনুভব করছিল না। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে ঘুরে তাকিয়ে নূহাকে দেখে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুনা।

সালাম
বিনিময়ের পর নূহা হাসি মুখে বলল, কি মনটা জুড়ে অশান্তি? খুঁজছো একটু প্রশান্তি? খুঁতখুঁতে অস্বস্থি! মিলছে না স্বস্থি! কি করি, কোথায় যাই? মিলবে যেথায় সুখ ভাই? হাসবে মন! দেখবে স্বপন! জেগেছে শঙ্কা? লাগছে ভয়? না জানি কখন কি হয়? অকারণ ভাবনা! দিচ্ছে শুধু যাতনা! পাবো না কি মুক্তি? লড়ে যাবার শক্তি? লাগবে ধৈর্য্য! বাড়াতে প্রাচুর্য!দিচ্ছি তোমায় সমাধান! আঁকড়ে ধরো কুরআন। আরে এমন পলকহীন তাকিয়ে আছো কেন? নিউ বর্ন কবিতা এটা। মনে নেই তোমার কাছে প্রমিস করেছিলাম কবিতা লিখে সবার আগে তোমাকে পড়তে দেবো? সাথে করে অনেক অনেক নিউ বর্ন কবিতা নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। যদিও লেখা হয়েছে অনেক আগেই কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ পড়েনি।

দু
হাতে নূহাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো মুনা। মুনার মনের অবস্থা অজানা ছিল না নূহার কাছে। তাই ওকে কিছুটা সময় দেয়া উচিত নিজেকে সামলে নেবার জন্য ভেবে চুপ করে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে মুনা বলল, আই এম সরি আপি। আমাকে মাফ করে দাও প্লীজ। আমি অনেক ভুল কাজ করেছিলাম। তুমি আমাকে ছোট বোনের মতো আপন করে নিয়েছিলে। আমাকে অন্ধকার থেকে আলোকিত জীবনের সন্ধান দিয়েছিলে। আর আমি তোমাকেই প্রতিনিয়ত ধোঁকা দিয়েছি। নিজের প্রবৃত্তির ওয়াসওয়াসার কাছে হেরে গিয়ে তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছি।

নূহা
হেসে বলল, মনেআছে তোমাকে গোল্ডেন ওয়ার্ড শিখিয়েছিলাম আমি?

জ্বি
আপি মনেআছে

তাহলে
নিশ্চয়ই এটাও মনে আছে। ভুল থেকে শুধু শিক্ষা নিতে হবে এবং ভুলটাকে গুড বায় জানাতে হবে। অকারণ জটিলতা তৈরি করতে পারে এমন সব কিছুকে হাসি মুখে গুড বায় বলে জীবন থেকে বের করে দিতে হবে। আমি নিশ্চিত তুমি সব ভুলে গিয়েছো। আজ রাতে তোমার গোল্ডেন ওয়ার্ডের উপর পরীক্ষা। সবার আগে গুড বায় সম্পর্কে বলতে হবে। ঠিকআছে?

হাসি
ফুটে উঠলো মুনার মুখে। বলল, ঠিকআছে আপি। আপি তুমি একটুও বদলাওনি। একদম আগের মতোই আছো
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ তুমিও আগের মতোই আছো। একদম পুতুল পুতুল মাশাআল্লাহ। আচ্ছা মুনা আমরা রাতে ইনশাআল্লাহ অনেক করে গল্প করবো। এই মূহূর্তে অন্য বিষয়ে জানতে চাই তোমার কাছে। হাদিয়ার কেসটা আমি দেখছি। ওর সাথে কথা বলতে যাবার আগে তোমার সাথে কথা বলে নিতে চাইছি। যেহেতু এতদিন তুমিই দেখছিলে হাদিয়াকে। কি অবস্থা এখন ওর বলো আমাকে।

আপি
হাদিয়া খুব কঠিন মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। নিজের করণীয় কি, বর্জনীয় কি সেটা মোটামুটি বুঝতে পারছে। কিন্তু মনকে মানাতে পারছে না সেইমতো। বর্তমানে অন্যসব সমস্যার চেয়ে হাদিয়ার মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে হাজবেন্ডের সাথে ওর সম্পর্কটা। ওদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে শরীয়তে এর বৈধতা আছে কি নেই এটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে। কোন স্কলারের সাথে কথা বলার সাহসও করতে পারছে না। ভয় পায় ওকে হয়তো ভর্ৎসনা করবে সবাই। আবার নিজের বিবেকের দ্বায় থেকেও মুক্তি পাচ্ছে না। তাই সারাক্ষণই পাপ করছে এমন একটা আতঙ্কও ঘিরে থাকে ওর মনকে। এইসব কিছু মিলিয়ে হাজবেন্ডের সাথে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে একদিকে, অন্য দিকে দৈনন্দিন ইবাদত সমূহও আগের মতো পালন করতে পারছে না। আগের মত আগ্রহ পাচ্ছে না। হয়তো কোন ইবাদতই কবুল হচ্ছে না এমন একটা সন্দেহও কাজ করে ওর মনে। এছাড়া পরিবারের কেউ এখনো ওদের বিয়ের কথা জানে না। জানলে কি হবে? ছোট ছোট ভাইবোনদের উপর এই ঘটনা কেমন প্রভাব ফেলবে? পরকালে ওর পরিণতি কি হবে? এমন চারপেশে দুশ্চিন্তায় মানসিক ভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হাদিয়া।

হুম
, এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি তো ওর কেস ফাইল পড়তে গিয়েই অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। মনে ভুলের উপলব্ধি জাগ্রত হওয়াটা আল্লাহর অনেক বড় একটা রহমত বান্দাহর প্রতি। কিন্তু একই সাথে বিশাল এক পরীক্ষাও। যাইহোক, তুমিও চলো আমার সাথে। দুজন মিলেই কথা বলবো হাদিয়ার সাথে।

খানিকটা
দ্বিধা ভরা কন্ঠেই মুনা বলল, হাদিয়ার এই অবস্থায় কি করা উচিত আপি? অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া একজন বিধর্মীকে বিয়ে তো কোনভাবেই বৈধ হতে পারে না। যদিও হাদিয়ার হাজবেন্ড নাম মাত্র মুসলিম হয়েছিল। কিন্তু সে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে শরীয়তের বিধি-নিষেধ পালন করতে পারবে না। এবং পালন করেও না। এমন ব্যক্তি তো নিঃসন্দেহে একজন মুশরিক। এমন কারো ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার কি কোন সুযোগ আছে?

মুনা
তুমি আমি যেই স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। সেখান থেকে এক কথায় বলতে গেলে সুযোগ নেই বলাটা আসলে খুবই সহজ। সহজ এই কাজটা খুব সহজেই করে ফেলি আমরা। কারো অবস্থা, অবস্থান, পরিবেশ-পরিস্থিতি কিছুই বিবেচনা না করে ঠাস করে নিজের মতটা প্রকাশ করে ফেলি। যে কারো শুধু বাইরের আচরণটা দেখেই মুশরিক, মুনাফিক, মুরতাদ, কাফির ট্যাগও লাগিয়ে দেই। কিন্তু কেন আজ আমি ঈমানদারের কাতারে আর কেন আজ সে বিধর্মীর কাতারে এই চিন্তাটা একবারও করে দেখিনা। জানো যখন আমি বাচ্চাদের স্কুলে ভলান্টিয়ার টিচার হিসাবে ছিলাম। ব্রেকের সময় যখন জীবন্ত ফুল হয়ে ছোট ছোট শিশুগুলো ছুটে বেড়াতো। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসতো। মনেহতো, আমার কাছে যদি কোন ম্যাজিক স্টিক থাকতো তাহলে সবগুলো বাচ্চাকে আমি মুসলিম বানিয়ে দিতাম। কেননা ওরা হয়তো একদিন ভুলের স্রোতেই ভেসে যাবে শুধুমাত্র অমুসলিম পিতা-মাতার সন্তান হবার কারণে। এই উপলব্ধিটা অনেক ছোটবেলায় আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাই কখনোই ভিন্ন ধর্মের কারণে কাউকে ঘৃণা করতে শিখিনি। এবং ইসলামের শিক্ষাও এমনটাই।

সরি
আপি আমি আসলে এত কিছু ভেবে বলিনি।

নূহা
হেসে বলল, আমি সেটা জানি। আসলে হাদিয়া যে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এক মূহুর্তেই নিজের সেই ভুল থেকে বেরিয়ে আসাটা প্রায় অসম্ভব। অসংখ্য কারণে হাদিয়া এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এরমধ্যে ভালোবাসার চাহিদাটাই হয়তো সবচেয়ে বেশি জড়ালো। একজন অভুক্ত কিংবা পিপাসাক্ত হঠাৎ খাদ্য বা পানির সন্ধান পেলে যেমন চিন্তা করার আগেই ঝাঁপিয়ে পরে। ভালোবাসায় অনাহারী মনগুলোও এমনটাই করে। সারাটা জীবন ভালোবাসার যে তৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল হাদিয়ার মনে। সেই তৃষ্ণা মিটানোর মিঠা সরোবর হয়তো ছেলেটির মাঝে খুঁজে পেয়েছিল। তৃষ্ণায় এতই কাতর ছিল হাদিয়ার মন যে, উৎসের সন্ধান করার কথা হয়তো চিন্তাতেই আসেনি। যখন মনে এই চিন্তাটা জাগ্রত হয়েছে, ততদিনে হয়তো ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর পিছিয়ে গিয়ে বন্ধ পথ খোলাটা খুব সহজ কিছু তো নয়। তাই না?

জ্বি
আপি। কিন্তু এতে কি শরীয়তের বিধান বদলে যাবে?

না
শরীয়তের বিধান কখনোই কারো জন্য বদলে যাবে না। কিন্তু মানুষ বদলে যেতেই পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কখন কাকে হেদায়াতের পথে টেনে নেবেন সেটা আমাদের সবারই অজানা। তাই চেষ্টা করার আগ পর্যন্ত কারো ব্যাপারে হতাশ হবার অবকাশ নেই। এমনো তো হতে পারে শুধুমাত্র বিয়ের কারণে নাম মাত্র মুসলিম ছেলেটাই একদিন আদর্শ মুসলিমের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে। যে বিয়েটাকে আমরা হাদিয়ার জীবনের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ হিসেবে দেখছি। সেই বিয়েটাই হয়ে যাবে কারো হেদায়াতের মাধ্যম। আমি বলছি না যে এমন কিছু হবেই। কিন্তু আশা নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কোথায়?

মুনা
হেসে বলল, জ্বি আপি। এখন ক্লিয়ার আমার কাছে। আসলে আমি নিজেই খুব দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম এটা নিয়ে। মনেহচ্ছিলো ভুল কোন পরামর্শ দিলে আমাকে দায়ী হতে হবে আল্লাহর কাছে।

এই
ভয়টাকে আমাদের প্রতিমূহুর্তের সঙ্গী করে নিতেই হবে মুনা। কারণ এই ভয়টা যত কম থাকে পরামর্শ দেয়াটা তত বেশি সহজ হয়ে যায়। এই ভয় থেকে তাই এক মূহুর্তের জন্য নিজের মনকে মুক্ত রাখতে চাই না। জবাবদিহীতার ভয় সদা জাগরূক রাখুন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের অন্তরে। কিন্তু একই সাথে আমাদেরকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, ভয় যেন আমাদের সঠিক চিন্তাকে ক্ষয় করে দিতে না পারে।
মুনা হেসে বলল, ঠিকআছে আপি। চলো আমরা হাদিয়ার কাছে যাই।
নূহা হেসে বলল, হ্যা চলো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন