দরজা খুলে সামনে জাওয়াদকে দেখে সুহাইব সাহেবের একবার মনেহলো হ্যালুসিনেশন
হচ্ছে। বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও জাওয়াদকে না পেয়ে ঘুমোতে যাচ্ছিলেন। ডোরবেলের শব্দ
শুনে দরজা খুলে জাওয়াদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হ্যালুসিনেশনের চিন্তা আসাটা তাই
অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া উপর তলাতেই নূহার বাসা তাই সচারচর জাওয়াদ আসে না এই বাড়িতে। তারউপর এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। এত রাতে আসার তো প্রশ্নই ওঠে
না।
মামার মনের দোদুল্যমনতা বুঝতে পেরে হেসে ফেললো জাওয়াদ। সালাম দিয়ে হাসতে
হাসতে বলল, হ্যালুসিনেশন
হচ্ছে না মোটেও। আমি সত্যি সত্যিই এসেছি আলহামদুলিল্লাহ।
হাসলেন সুহাইব সাহেবও। সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ভেতরে এসো। আসলে এতরাতে তোমার আগমন কল্পনারও বাইরে ছিল। তারউপর তোমাকেই
ফোনে ট্রাই করছিলাম এতক্ষণ ধরে। সবকিছু মিলিয়ে তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না
সত্যিই তুমি নাকি আমার অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি।
জাওয়াদ হেসে বলল, সরি আমি ড্রাইভ
করছিলাম তাই কল রিসিভ করতে পারিনি। আমার কন্যা ও পুত্ররা অভিমান করেছিল আমার উপর।
তাদের অভিমান ভাঙানোর সবচেয়ে সহজ পন্থা একটাই সেটা তো জানোই। তাদের মা’র কাছে নিয়ে আসা। যখন বললাম, চলো মা’র বাসায় দিয়ে আসি তোমাদেরকে। সব অভিমান ভুলে লাফাতে লাফাতে রেডি হয়েছে
চারজন। ওদেরকে দিয়ে গেট থেকেই চলে যেতাম। কিন্তু তুমি কল দিচ্ছিলে তাই ভাবলাম দেখা
করেই যাই।
আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভালো করেছো এসে। তোমার সাথে অনেক জরুরি কথা ছিল। চলো
বারান্দায় গিয়ে বসি। এখানে কথা বললে তোমার মামীমা শুনতে পাবে।
তার মানে কি গোপন কথা নাকি মামীমার গীবত?
দুষ্টুমির স্বরে
প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।
সুহাইব সাহেব হেসে বলল, তুমি তো আমাদের
সাত রাস্তার মোড়। অর্থাৎ, পরামর্শদাতা।
তোমার কাছে আবার কথার কোন ভিন্ন ক্যাটাগরি আছে নাকি! তোমার কাছে বলা সব কথার একটাই
উদ্দেশ্যে থাকে। সেটা হচ্ছে, পরামর্শ চাওয়া।
জাওয়াদ হেসে বলল, ওহ! আমার তো
খেয়ালই ছিল না যে, এই মূহুর্তে একজন
মন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলছি। আর মন বিশেষজ্ঞ মানেই কথার মারপ্যাঁচে সিদ্ধহস্ত।
কিন্তু যিনি সারাক্ষণ অন্যদেরকে পরামর্শ দেন সমস্যা সমাধানের জন্য। তার আমার
পরামর্শের কি প্রয়োজন পড়লো?
কারণ গুরুরও যে থাকে। তবে এখানেও সমস্যা মনই। কথায় আছে না যে, বিশ্বাসে পাবি রে তারে তর্কে বহুদূর! পরামর্শ তেমনি বিশ্বাসের উপর
নির্ভরশীল। তাদের পরামর্শই আমাদেরকে সমস্যার মোকাবিলাতে দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে
সহায়তা করে, যাদের কথা আমরা
বিনাদ্বীধায় বিশ্বাস করতে পারি। যাদের উপর আমাদের মনের পুর্ণ আস্থা আছে। যাদের
সাথে আমাদের মস্তিষ্কের যুক্তিবাদী সত্ত্বা তার্কিকের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয় না।
মোটকথা, আমাদের মন ও
মস্তিষ্কের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা যাদের কথাতে থাকে, আমরা তাদের পরামর্শই উদার চিত্তে গ্রহণ ও প্রয়োগ করতে পারি। যেহেতু আমার
অসংখ্য ভুল সিদ্ধান্তের সাক্ষী তোমার মামীমা। তাই আমি যত ভালো কথাই বলি না কেন
তোমার মামীমা তর্ক করবেই। কিন্তু তুমি যদি একটা শব্দও বলো তোমার মামীমা সেটাকে
বিশ্বাস করবে। কারণ তুমি একদম ছোটবেলা থেকেই তার হিরো। তোমার মামীমার দৃঢ় বিশ্বাস
পরিবারের প্রতিটি ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া
তায়ালা তোমাকে দিয়েছেন।
আলহামদুলিল্লাহ। আমি জানি মামা আমার প্রতি মামীমার বিশ্বাসের তীব্রতা
সম্পর্কে। সমস্যাটা কি সাদাতের বিয়ে নিয়ে?
হ্যা। সাদাতকে বুঝিয়ে বললে অবশ্যই মেনে নেবে ওর আম্মুর সিদ্ধান্ত। কিন্তু
আমি চাইনা বিষয়টা কোন নেতিবাচকতার বীজ বুনে দিয়ে যাক আমাদের সম্পর্কে সাদাতের মনে।
আইমিন, ছোটবেলা থেকে
আমরাই ওদেরকে উদারমনা, পরোপকারী হবার
শিক্ষা দিয়েছি। নিজের সাধ্যমতো মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে এই ব্যাপারে উৎসাহী
করেছি। এখন আমরাই যদি শুধুমাত্র অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ধারণার বশবর্তী হয়ে
একজন অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানাই। সেটা আমাদের শিক্ষা ও
মূল্যবোধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাদাত যদিও বিষয়টাকে অন্যদিক থেকে ভাবছে। তোমার মামীমার শঙ্কা দেখে সাদাতের মনেহচ্ছে, ওর প্রতি আমাদের বিশ্বাস নেই। আমরা ওকে দুর্বল চরিত্রের ছেলে মনেকরি বলেই
নাকি ভাবছি, বিয়ের পর নিজের
দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে যাবে। এই চিন্তাটা সাদাতকে খুব কষ্ট দিয়েছে বলেই আমার ধারণা।
ব্যাপারটা ওর আত্মসম্মানেও লেগেছে বলে জেদ চেপে বসেছে মনে নিজেকে প্রুফ করে
দেখানোর। কিন্তু তোমার মামীমা এটা বুঝতে ও মানতে নারাজ। গত তিনদিন ধরে মা-ছেলের
মান-অভিমান চলছে। আমার ভয় হচ্ছে, এই মান-অভিমান
কখন না আবার দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়ে যায় দুজনের ইগোর প্রভাবে। সাদাতকে বোঝানোটা
আমার পক্ষে খুবই সহজ। কিন্তু এই ব্যাপারটাতে আমি চাই তোমার মামীমা বুঝুক এবং মেনে
নিক। কারণ বাবা-মা’র কোন অধিকার নেই
তাদের অতীতের বোঝা সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেয়ার। তোমাকেই এসব বুঝিয়ে বলতে হবে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জাওয়াদ বলল, পারিবারিক শান্তি
বিঘ্নিত হবার অনেক বড় একটা কারণ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমেই রিঅ্যাকশন দেখিয়ে
ফেলাটা। সাদাতের কথা শোনামাত্রই যদি মামীমা উত্তেজিত হয়ে না পড়তেন কিংবা সরাসরি নিষেধ না করতেন। বরং শান্ত মনে নিজের অতীত অভিজ্ঞতাকে ঘিরে ভয়টা বুঝিয়ে
বলতেন তাহলে সাদাত খুব সহজেই ব্যাপারটা বুঝতো এবং মেনে নিতো। কিন্তু মামীমার ভুল
উপস্থাপনের কারণে সাদাতের আত্মসম্মানে যেয়ে লেগেছে ব্যাপারটা। তাই মনে জেদ চেপে
বসেছে নিজেকে প্রুফ করে দেখানোর। আবার মামীমাও একথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন, এত আদর-ভালোবাসা দিয়ে যে সন্তানকে বড় করেছেন সে কিনা তার এত ছোট্ট একটা
চাওয়াকে মূল্য দিতে অপারগ? আবার যে ছেলে
কোনদিন মামীমার মতের বাইরে কিছুই করেনি। সেই আজ মতের বাইরে যেতে যাচ্ছে। সুতরাং, যে বিষয়টা ঘিরে এইসব পরিবর্তন ঘটছে, সবকিছুর জন্য
সেটাকেই মামীমা দায়ী মনে করবেন এটাও স্বাভাবিক। যারফলে, নিজের অমতে দৃঢ় থাকাটা এখন অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার চেয়েও জেদের ভূমিকাই
বেশি। তোমার ভয় যুক্তিযুক্ত মামা। অভিমান যখন জেদে আর জেদ যখন ব্যক্তিত্বের
দ্বন্দ্বে পৌঁছে যায়, তখন সম্পর্কের
বাঁধন দুর্বল হয়ে পরে। সম্পর্কের মাধুর্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তাই মানবিক আবেগগুলো
সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান থাকা উচিত কোনটা অভিমান, কোনটা জেদ আর কোনটা অহং। কারণ অভিমানে সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করার ক্ষমতা
ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তাতে রাগ, জেদ কিংবা অহংয়ের মিশ্রণ না ঘটে।
এই কথাটাই এখন আমার স্ত্রী আর পুত্রকে বোঝাতে হবে। পুত্র গাল ফুলিয়ে ভাবছে, আম্মু কিভাবে ভাবতে পারলো আমি বিয়ে করেই বদলে যাবো কিংবা আমাদের পরিবারের
ইউনিটিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেবো? আর তার আম্মু
আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে আর ভাবছে, কি করিনি আমি
সন্তানদের জন্য? সারাটা জীবন
নিজের চাওয়া-পাওয়া তুচ্ছ করে ওদেরকে
খুশি-আনন্দ দেবার চেষ্টা করেছি। আর আজ আমার সামান্য একটা চাওয়ার মূল্য দিতে পারলো
না?
জাওয়াদ হেসে বলল, এটাই মূলত সমস্যা
মামা। উভয় পক্ষই ভাবে অপরপক্ষ তাকে বুঝবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কেউই কাউকে বুঝতে
পারে না। যারফলে, জন্ম হয় ভুল
বোঝাবুঝির। যার জের ধরে বন্ধনে আসে তিক্ততা। একটা সময় তৈরি হয় সেই বন্ধন থেকে
মুক্তি পাবার আকুলতা। মাঝে মাঝে কি মনেহয় জানো মামা?
কি?
প্রত্যেকটি মনই এক একটি সাম্রাজ্য। আর মনটিকে ধারণকারী ব্যক্তি সেই
সাম্রাজ্যের সম্রাট। আর মনের অনুভূতিগুলো সেই সম্রাটের
মন্ত্রী-উজির-নাজির-প্রজা-সৈন্য। সাম্রাজ্যের সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবার
জন্য যেমন সম্রাটের মন্ত্রী-উজির-নাজির-প্রজা-সৈন্যদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন, মনোজগতের ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক তাই। অনুভূতিগুলোকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা
না গেলে বিঘ্নিত হয় মন সাম্রাজ্যের কার্যাবলী। সমস্যা হচ্ছে, মানবিক অনুভূতিগুলোকে কখনোই ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। ফুলের সৌরভের মত এগুলো
শুধুই অনুভবের। কবি সাহিত্যিকরা যদিও উপমা বা রূপকের মাধ্যমে অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ
করতে চেষ্টা করেছেন। যেমন, ফুলের মত
কোমল(কোমলতা), পাহাড়ের মত
অনঢ়(অনঢ়তা), চাঁদের মত
স্বিগ্ধ(স্বিগ্ধতা), হায়নার মত
হিংস্র(হিংস্রতা), শেয়ালের মত
ধূর্ত(ধূর্ততা)ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এই উপমা বা রূপকের দ্বারাও আসলে অনুভূতিগুলো
ব্যক্ত হয় না বরং অনুভবই করা হয়। যাইহোক, মন সাম্রাজ্যের
সম্রাটের মন্ত্রী-উজির-নাজির-প্রজা-সৈন্যরা হচ্ছে অনুভূতিরা। কিন্তু কোন অনুভূতি
কোন পদে আসন সেটা কি জানি? মন্ত্রীর আসনটা
চিন্তা করার সাথে সাথেই মনেহয়, সম্রাটের পাশে
মাথা উঁচু করে বসে আছে ‘অহং’। আর সামনে হাঁটু গেঁড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে অভিমান। অহং এর নাকটা ভীষণ
উঁচু তাই মাঝে মাঝেই তর্জনী ঘষে তা দিয়ে যাচ্ছে নাকের ডগায়। আর অভিমান নাক টেনে
টেনে রাশ টেনে ধরতে চেষ্টা করছে লাগামহীন অশ্রুর। যেদিন অহং আর অভিমানের মধ্যে
পার্থক্য কি ভাবতে বসেছিলাম
মনের অভিধানে উল্লেখিত
কথাগুলোর সন্ধান পেয়েছিলাম। অহং আর অভিমান কখনোই এক না। কারণ এই দুটিই ভিন্ন দুটি
মানসিক অনুভূতি। অভিমান হচ্ছে মনের কোনে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটি। যে কথায় কথায়
গাল ফুলিয়ে বসে যায়। কনিষ্ঠা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে আড়ি আড়ি আড়ি। আর অহং হচ্ছে সেই
স্বৈরাচারী সত্তা যে নিজেকে অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে পায়ের উপর পা
তুলে বসে থাকে। যে যাই বলুক পা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্রদর্শন করে বৃদ্ধাংগুলি।
হুমম, আসলেই তাই!
জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, অভিমানকে মনেহয়
ঋতু পরিবর্তনের সময়কার উষ্ণতা ও শীতলতার সংমিশ্রণের আদুরে জ্বর। নাকে সর্দির বন্যা, গলায় খুকখুক ধ্বনি। রেশমি শালে জড়িয়ে, পশমি মাফলার গলায়
ঝুলিয়ে, হাতে ধরিয়ে দিতে
হয় একমগ মসলা চা। এতোই আহ্লাদী অভিমান। আর অহং মারাত্মক কোন মরণব্যাধি। এইডস, ক্যান্সার নাকি ডায়াবেটিস? হ্যা ডায়াবেটিস।
একবার মনে বাসা বেঁধে ফেললে আর মুক্তি নেই। সবসময় তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বেড়ে
গেলেও বিপদ আবার কমে গেলেও বিপদ। এ যেন জলে কুমীর আর ডাঙ্গায় বাঘ অবস্থা। আবার
অভিমানের পেছনে লুকায়িত থাকে ভালোবাসা+ অনুযোগ+ অভিযোগ+ প্রত্যাশা-আশা-আকাঙ্ক্ষা, অর্থাৎ প্রাপ্তির আশা+ বিশ্বাস ও ভরসার অবমূল্যায়ন প্রসূত রাগ+
পছন্দ-অপছন্দের বিভেদ জনিত রাগের অভিনয় ইত্যাদি। আর অহং এর পেছনে থাকে নিজের কোন
কিছুকে উপরে তুলে ধরে অন্যদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন বা পেশ করা। যার উদ্দেশ্য থাকে
অন্যকে অবমূল্যায়ন করা বা হেয় করা। এবং নিজেকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে
আনন্দিত হওয়া। সুতরাং, অহং ও অভিমান
কখনোই একই অনুভূতি নয়। এই দুই অনুভূতিতে যোজন যোজন পার্থক্য বিরাজমান। তবে হ্যা
অভিমানের পথ বেয়ে মনে অহং ঢুকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। অভিমানের উপর যখন
অবিরাম তুষার ঝরতে থাকে এবং পরশ পায় না সে রোদের। ধীরে ধীরে একসময় তা বরফের পাহাড়ে
রুপান্তরিত হয়ে যায়। তখন সূর্যিমামার প্রখর কিরণও খুব সহজে সেই পাহাড়ের বুকে বইয়ে
দিতে পারে না ঝর্ণাধারা। তবে এই অহং এর পেছনে থাকে বেদনার উপাখ্যান, থাকে আত্মমর্যাদা বোধ ও অবমূল্যায়নের দহন। যা আসলে অভিমানেরই আরেক রূপ। আসলে মনের অনুভূতিগুলোর সাথে আমাদের স্বার্থ জড়িত। জড়িত আমাদের আত্মতৃপ্তি, বাসনা, সন্তুষ্টি।
অহংকার ও আসক্তিমুক্ত, বিবেকবোধ সম্পন্ন, পরমার্থজ্ঞাননিষ্ঠ, জীবনের
সুখ-দুঃখের অবস্থানকে ঘিরে নিয়তি প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী মানুষের পক্ষেই কেবল সম্ভব
স্বার্থ নির্ভর না হওয়া। আর একজন মানুষকে নিজকে স্বার্থহীন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য
যে পথে হাঁটতে হবে তার নাম শরীয়ত। যখন মনে আল্লাহর অবস্থান নির্দিষ্ট হয়ে যায়
ব্যক্তি পারিপার্শ্বিক শত প্রতিকূলতার মাঝেও করে যেতে পারে অনুভূতির সঠিক প্রয়োগ।
তাই আমি বিশ্বাস করি, শুধু যদি অহং
বিসর্জন দেয়া যায় তাহলেই পৌছানো যায় মন সাম্রাজ্যের সেই কুটিরটিতে যার নাম
প্রশান্তি। আর অভিমান? উহু সে থাকুক
সঙ্গোপনে, মনে মনে, নীরবে-নির্জনে, একান্ত আপনে।
অভিমান তো সেই অলংকার যা বন্ধনকে করে আরো রঙিন। কিছুটা বিষণ্ণ, সামান্য অবসন্ন, একবিন্দু বিরক্তি, অজানা আসক্তি, করে নিজের সাথে
চুক্তি, এসব থেকে নেয়া
যায় যদি মুক্তি, মনে বিরাজ করবে
প্রশান্তি, অভিমানের এতটাই
শক্তি।
সুহাইব সাহেব হেসে বললেন, পরিবারের
সদস্যদেরকে মানবিক আবেগসমূহ সম্বন্ধে সঠিক ও স্বচ্ছ ধারণা দেবার উদ্দেশ্যে একটা
বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করো জাওয়াদ। সপ্তাহে একদিন তুমি প্রবীণদের ক্লাস নেবে আর নূহা
নেবে নবীনদের ক্লাস।
জাওয়াদ হেসে বলল, কেন আমি নবীনদের
ক্লাস নিলে কি সমস্যা?
সুহাইব সাহেব হেসে বললেন, তুমি সবার ক্লাসই
নিতে পারো। এতে কোনই সমস্যা নেই। কিন্তু আনন্দবাড়ির প্রবীনগন নূহার কথা পাত্তা
দেয়না এটা হচ্ছে গিয়ে সমস্যা। অপরদিকে নবীনরা সব নূহার বিরাট ভক্ত।
জাওয়াদ হেসে বলল, পাত্তা দেন না
সেটা অবশ্য ঠিক না। সমস্যা হচ্ছে, প্রবীণদের সাথে
নূহার তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়াঝাঁটি লেগেই
থাকে। তাছাড়া নূহার সমস্ত অপকর্মের সাক্ষী উনারা। এতই যখন বোঝে নিজে কেন মেনে চলে
না এই প্রশ্নটা এসে যায় উনাদের মুখে। নূহাও চুপ করে কারো একটা শব্দ হজম করার মেয়ে
না। ব্যাস বেজে ওঠে দামামা। লেগে যায় যুদ্ধ।
সুহাইব সাহেব হাসতে হাসতে বলল, সেজন্যই তো বললাম, প্রবীণদের ক্লাস তুমি নাও। আর প্রথম ক্লাসটা তোমার মামীকে দিয়েই শুরু করো।
তুমি বোস আমি এক্ষুণি ডেকে নিয়ে আসছি তোমার মামীকে।
মামা উঠে যাবার পর জাওয়াদও উঠে বারান্দার আরেকপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দু’মাস আগে মামীমার অনুরোধে বাগানে
নানান ধরণের
পাতাবাহারের গাছ লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এরপর আর আসা হয়নি তাই গাছগুলো কেমন আছে
সেটাও জানা হয়নি। গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে জাওয়াদের মনেহলো, মামীর পরম যত্নের প্রমাণ স্বরূপ রাতের আঁধারেও মিটিমিটি করে হাসছে সবাই। মনের ভেতর যে আনন্দানুভূতি দোলা দিয়ে গেলো
মূহুর্তেই সেটা বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো উপর থেকে ভেসে আসা বাচ্চাদের সাথে
নূহার সম্মিলিত হাসি শুনতে পেয়ে। আনন্দ-উল্লাসে কারো হয়তো খেয়ালই নেই গভীর রাতে
সামান্য একটু শব্দও অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এখন ম্যাসেজ পাঠালে কেউ দেখবে না
সেটা খুব ভালো মতোই জানা আছে জাওয়াদের। তাই জিহাদকে ফোন দিয়ে বললো হাসির শব্দ নীচ
থেকে শোনা যাচ্ছে। প্রায় সাথে সাথেই থেমে গেলো উপর থেকে ভেসে আসা আনন্দধ্বনি।
মন খানিকটা
বিষণ্ণ হয়ে উঠলো জাওয়াদের। না দেখেও বুঝতে পারছিল,
হঠাৎ করেই
আনন্দ-উল্লাস ভুলে থমকে গিয়েছে সবাই। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করাটাও জরুরি ছিল। তা
না হলে আনন্দমগ্নতায় ডুবে থাকার কারণে নিজেদের ভুলটা ধরতে পারতো না কেউই। কখনো
কখনো ভুল শুধরে দেবার জন্য প্রিয়জনদের আনন্দে বিঘ্ন ঘটানোটা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে।
আর যা করণীয় তা করতেই হবে শত কষ্টের বিনিময়েও। কেননা কষ্টটাই তো পরীক্ষা। কষ্ট যদি
না থাকতো তাহলে তো সেটা পরীক্ষাই হতো না। মনের কষ্টের অনুভূতিটাকে তাই ডানা মেলতে
দিলো না জাওয়াদ। এই মূহুর্তে যা করণীয় ছিল সেটাই করেছে। একটু মনখারাপ হয়তো হবে
নূহার কিন্তু ঠিকই জাওয়াদের ইনটেনশন বুঝতে পারবে এবং সামলে নেবে ইনশাআল্লাহ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন