সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২৭




ছুটন্ত বাতাসের কারণে অন্ধকার আকাশের বুকে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলছিল অবিরাম একদিক দিয়ে মেঘ এসে ঢেকে দিতে না দিতেই গায়ের উপর থেকে মেঘের পালকদের ঝেড়ে ফেলে অন্যদিক দিয়ে বেড়িয়ে আসছিল দুষ্টু চাঁদ মুগ্ধ চোখে মেঘ আর চাঁদের খুনসুটি অবলোকন করছিল নূহা চাঁদের মনোরম স্বিগ্ধ আলোকে সিঁড়ি বানিয়ে যখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমে আসতে শুরু করলো মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো নূহার মুখে যদিও তার মেঘে ঢাকা তন্দ্রালু মন জুড়ে বিরাজ করছিল ধূসরতা তবুও লিখতে ইচ্ছে করলো কোন বৃষ্টি ভেজা কবিতা অনেক বছর হয়ে গিয়েছে বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে শ্রাবণধারা রূপে ঝরা হয়নি ভালো লাগা সব কিছুর সাথে কেমন যেন একটা অজানা দুরুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে ভরা পূর্ণিমার রাতের অপেক্ষায় প্রহর গোনা হয়না এখন আর তারা ভরা আকাশের বুকে ছুটে বেড়ানো হয়না ভাবনার রথে চড়ে ধূসর আকাশের বুকে সাজানো হয়না বর্ণিল রঙের ইচ্ছেঘুড়ি মুনার রুমে রঙ-তুলি দেখে মনের ভেতরটা কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল কয়েক মূহুর্তের জন্য ছবি আঁকার মতো এতটা ভালোবাসা মনেহয় না অন্য কোন ভালো লাগাকে ঘিরে ছিল সেই ভালোবাসা যে এতটুকু ম্লান হয়ে যায়নি আজ আবারো টের পেলো প্রকৃতির প্রতিটা সুন্দর মূহুর্তকে মনের সাথে সাথে কাগজের ক্যানভাসেও বন্দী করে ফেলাটা কেমন যেন নেশাতে পরিণত হয়েছিল জীবনের সমস্ত ছন্দ, সকল সুর হারিয়ে গিয়েছিল একজন মানুষের বিচ্ছেদে সত্যিই জীবন কারো জন্যই থেমে থাকে না সুখ-আনন্দ-ভালোবাসাও ভিন্ন রূপে ফিরে আসেই জীবনে কিন্তু জীবনের কোন এক জায়গায় স্থির হয়ে যায় ছন্দপতন মনের কোন এক কোণ অনুর্বর, অনাবাদী, বিবর্ণই রয়ে যায় সর্বদা খুব আরাধ্য কাউকে হারানোর যাতনা নূহা জানে, খুব ভালো মতই জানে তাই কষ্ট হচ্ছিলো মুনার জন্য কিন্তু সেই কষ্ট মুনাকে বুঝতে না দেয়াটাই কল্ল্যাণকর মনে হয়েছে তা না হলে মুনা হয়তো আরো দুর্বল হয়ে পড়বে এই একটা ব্যাপারে শুধু মুনা কেন পৃথিবীর কারো ব্যাপারেই সুপারিশ করার ক্ষমতা নূহার নেই কারণ জাওয়াদের কাছে ওয়াদা করেছিল পৃথিবীর সবাই বললেও সে কোনদিনও জাওয়াদকে বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবে না তাই চাইলেও মুনার প্রতি মমতা দেখানোর কোন সুযোগ নেই এসব ভাবনা জড়ো হতেই মনের ভেতরটা আরো কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে গেলো নূহার হাত বাড়িয়ে দিলো বাইরে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজ মহিমায় হাতখানিকে ভিজিয়ে দিলো বরষার জলধারা বৃষ্টি ভেজা হাতের দিকে তাকিয়ে মনেহলো, জমেছিল ভাবনা যত মনের আকাশে, রিমিঝিমি ঝরছে আজি হিমেল পরশে বেদনা টোকা ছিল যত মনের খাতায়, শ্রাবণ হয়ে নেমেছে বুঝি চোখের পাতায় হারানো দিনের সুখাষ্ণতা বৃষ্টির জলে, বিন্দু বিন্দু পড়ছে জমা মোর করতলে রঙধনু উঁকি দেয় রোদ-বৃষ্টির ফাঁকে, মন কেন আকুল হয়ে অতীত স্বপ্ন আঁকে?!

আপি তোমার জন্য চা নিয়ে এসেছি। মুনার কথা শুনতে পেয়ে হাসি মুখে ঘুরে তাকালো নূহা। চায়ের কাপ নিয়ে বলল, শুকরিয়া। রুমের ভেতর আর না যাই। বারান্দাতেই বসি চলো। ভালো লাগছে ভীষণ বৃষ্টি ছোঁয়া হিম হিম আবহাওয়া
মুনিরা আর দশমিনিট সময় দিয়েছে আমাকে তোমার সাথে গল্প করার। এরপর নাকি ওর সময় শুধু হবে তোমার সাথে গল্প করার।

নূহা হেসে বলল, মুনিরা, মাওরাকে দেখে আমি চিনতেই পারিনি প্রথমে। সময় কত ছোট ছোট ছিল দুজন।

মুনা হেসে বলল, হ্যা মুনিরার আট বছর ছিল আর মাওরার ছয় বছর। এখন তো একজনের তেইশ আর অন্যজনের একুশ। আমার যতটুকু জ্ঞান ছিল তার দ্বারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আপি ওদের দুজনকে ছোটবেলা থেকেই শরীয়তের আলোকে গড়ে তুলতে। পুরোপুরি সফল হইনি। তবে একেবারে ব্যর্থও হয়নি। নামাজ পড়ে নিয়মিতই দুজন, পর্দা করে, কুরআন-হাদীসও পড়ে নিয়মিত। সপ্তাহে একদিন আব্বু-আম্মু আর ওদের দুজনকে নিয়ে পারিবারিক বৈঠকের মতো হয় আমাদের। আম্মুকে পর্দার বিধান মেনে নেয়াতেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ শেষপর্যন্ত গত দুই বছর আগে থেকে আম্মুও পর্দা করা শুরু করেছে।

আলহামদুলিল্লাহ তোমাদের বাসার পরিবেশ দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছি। আসলে মানুষ যখন কোন কিছুর পেছনে নিরলস চেষ্টা সাধনা করে যায় এবং সেটা যদি তারজন্য কল্ল্যাণকর হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে বিমুখ করেন না।

জ্বি আপি আমারো এখন তাই মনেহয়। এখন আমাকে একটা পরামর্শ দাও।

কি পরামর্শ?

ধৈর্য্য সহ্য ক্ষমতা কিভাবে বাড়ানো যায় সেই পরামর্শ। মানুষের হীনমন্যতা, স্বার্থপরতা একেবারেই সহ্য করতে পারিনা আজকাল। না চাইতেও এটা সেটা বলে ফেলি বেশ কড়া ভাবেই। এর প্রভাব আমি যে বোনদের গাইড করার চেষ্টা করছি তাদের উপর পড়ছে। বেশ কয়েকজন প্রোগ্রামে আসছেন না। কিন্তু সামান্য ব্যাপারে যখন ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচয় দিতে দেখি। মনেহয় এদেরকে কখনোই আলোর পথে নিয়ে আসা সম্ভব না। এরা স্বার্থপরতা ক্ষুদ্রতার চোরাবালিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত।

নূহা হেসে বলল, আমিও যখন প্রতিবেশী বোনদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, তোমার মতই অবস্থা হয়েছিল। একবার পরিচিতা এক বোন ফিরনী রান্না করে পাঠিয়েছিলেন আমার বাসায়। সমস্যা হচ্ছে আমি, জারিফ মিষ্টি খাবার খেতে পারি না। রাহাত যদিও মিষ্টি ভীষণ পছন্দ করে কিন্তু দুধে সেদ্ধ কোন মিষ্টি খাবার খেলেই এসিডিটির সমস্যা হয়। বাধ্য হয়ে তাই অন্য এক বোনের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সেই পরিচিত বোনের অনুমতি নিয়েই। যে বোনকে পাঠিয়েছিলাম উনি ফিরনী খেয়ে এতই মজা পেয়েছিলেন যে রেসিপি নিয়ে দিতে বললেন। রেসিপি দেবার কথা বলতেই পরিচিত সেই বোনটি বললেন, এটা আমার নিজের আইডিয়া থেকে বানানো। আমি চাই না অন্য কাউকে এটা শেখাতে। কিছু আনকমন রেসিপি থাকা উচিত সবার। সব বাসায় যদি একই রকম খাবার রান্না হয় তাহলে বৈচিত্র্য থাকবে না। উনার যুক্তি শুনে বেশ বড় ধরণের একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। কেউ খাদ্যের রেসিপি অন্যেকে শেখাতে আপত্তি করতে পারে এটা আমার ধারণাতেও ছিল না। হয়তো এরআগে সামাজিক মেলামেশা খুব সীমিত বলেই হয়তো এতটা অবাক হয়েছিলাম। আমার নিজেরও নতুন নতুন রান্নার খুব শখ। যখনই নতুন কিছু শিখি সাথে সাথে পরিবার পরিচিত সবাইকে ফোন করে রেসিপি দিয়ে রান্না করে বাসার সবাইকে খাওয়াতে বলি। মনেহয় সবার পক্ষে তো আমার বাসায় এসে খেয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রেসিপি দিয়ে দেই নিজেরাই রান্না করে খাবে। নতুন কিছু শেখার মজাই তো অন্যেকে সেটা শেখানোর মাঝে। আমি তো অন্তত এভাবেই ভাবতে শিখেছি আমার বেড়ে উঠার পরিবেশ থেকে

এমনটাই তো স্বাভাবিক তাই না আপি? আমার ভালো কিছু জানা থাকলে আমি কেন অন্যেকে জানাতে কৃপনতা করবো? যেখানে হাদীসে স্পষ্ট রূপে বলে দেয়া হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার ভাইয়ের জন্য তা- পছন্দ করবে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।

কিন্তু যার এই হাদীসটা জানা নেই তার ক্ষেত্রে হয়তো অনুদার হওয়াটাই স্বাভাবিক। যার বেড়ে উঠার পরিবেশটা সংকীর্ণ ছিল, তার কাছ থেকে উদারতা আশা করিই বা কিভাবে? জানো ছোটবেলায় নতুন বই পড়তে দেবার সময় বাবা বলতেন, পড়ার সময় ভালো লাগা লাইনগুলো লিখে রেখো। তাই করতাম আমরা সমবয়সী ভাইবোনেরা। বাবা এরপর নিজ নিজ কোট করা লাইনগুলো আমাদের পরস্পরের মধ্যে এক্সচেঞ্জ করতে বলতেন। বাবা বলতেন, প্রত্যেকটি মানুষের দেখা বোঝার ধরণ আলাদা, তাই ভালো লাগার বোধও আলাদা। একজনের কাছে যেটাকে খুব সাধারণ একটা লাইন মনে হবে, অন্যজন সেটার মাঝেই খুঁজে পাবে গভীর তত্ত্ব। তাই একে অন্যের সাথে ভালো লাগা বিনিময় করেও সমৃদ্ধ করা সম্ভব জ্ঞানভান্ডার। তাছাড়া জ্ঞান মানুষ অর্জন করবে আর ছড়িয়ে দেবে এটাই হচ্ছে নিয়ম। আমরা প্রতিটা ভাইবোন এই নিয়ম মেনে চলতে চেষ্টা করেছি জীবনের সর্বক্ষেত্রে, এখনো করি। অর্জিত অতি সামান্য একটা জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে চাই সবার মাঝে। তাই ব্যতিক্রম কিছু দেখলে ধাক্কা খাওয়াটাই আসলে স্বাভাবিক। আমাকে অবশ্য বেশ কয়েকবার এরকম ধাক্কা খেতে হয়েছে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনের কাছে। এই তো বছর দুয়েক আগেও একজন বোন বেশ কয়েক কেজি বাড়তি ওজন ঝেড়ে ফেলেছিল শরীর থেকে। অন্য এক বোন উনার কাছে ডায়েট টিপস জানতে চাইলে উনি এড়িয়ে গেলেন। অবাক হয়ে ভাবলাম একজন শরীরের বাড়তি ওজন ঝেড়ে ফেলুক সেটাতেও আরেকজনের আপত্তি থাকার কারণ কি হতে পারে? বরং বাড়তি ওজনের কষ্ট জানা থাকার কারণে অন্যেকে আরো সাহায্য করার কথা সেটা থেকে মুক্তি পেতে! তাহলে কেন পারছেন না এই বোনেরা? কি তাদেরকে বাঁধা দিচ্ছে অন্যেকে কিছু শেখাতে? উনারা কি শেখানোর আনন্দ জানেন না? কি জানি হয়তো উনারা শেখেননি যে জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার জিনিস, কুক্ষিগত করে রাখার নয়। নাকি অন্যের কল্যাণ কামনা করা, অন্যের কল্যাণে অংশীদার হবার মাঝে যে তৃপ্তি আছে, প্রশান্তি আছে সেটা সম্বন্ধে উনাদের ধারণাও নেই? এটাই সঠিক মনে হয়েছে। উনাদের আসলে ধারণাই নেই।

মুনা হেসে বলল, এখন সত্যিই আর রাগ হচ্ছে না বোনদের উপর। উনাদের আসলে ধারণাই নেই কারো সাথে ভালো কিছু শেয়ার করার মাঝে কি অদ্ভুত প্রশান্তি আর পরিতৃপ্তি লুকানো।

নূহা হেসে বলল, এটাই হচ্ছে মূল পয়েন্ট। এই পয়েন্টটা যেদিন ধরতে পেরেছিলাম মানুষের স্বার্থপরতা, হীনমন্যতা দেখে ঘৃণা করার বদলে তাদের প্রতি মায়া অনুভব করতে শুরু করেছিলাম।

আলহামদুলিল্লাহ আমারো এখনো মায়া হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি আপি নিজের করণীয়। কিন্তু শিক্ষিত, সমঝদার মানুষেরা যখন সংকীর্ণমনতার পরিচয় দেয় তখন করণীয় কি? আইমিন, যাদের হয়তো শরীয়তের জ্ঞানও আছে মোটামুটি। এই যেমন, কয়েক মাস আগে এক কলিগ একটা কেস নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। ওটার উপর সম্পূর্ণ কাজই আমি করেছি ধরতে গেলে। কিন্তু আদী স্যার যখন রিপোর্ট চাইলেন সেই কলিগ নিজের নামেই সেটা চালিয়ে দিলো। একবার আমার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করলো না। এমন ক্ষেত্রে করণীয় কি?

নূহা হেসে বলল, চলো তোমাকে একটা গল্প শোনাই। একদিন বিকেলবেলা একটি পাখী একটি গাছের ডালে এসে বসলো। গাছের অন্য ডালে একটি মৌমাছির বাসা ছিল। একটা ছোট্ট মৌমাছি পাখিটির সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো। পাখিটি মৌমাছিটিকে কাছে ডেকে বলল, কেমন আছো মৌমাছি? মৌমাছি উত্তর দিলো, ভালো। তুমি কেমন আছো? পাখী বলল, ভালো। অনেকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলবো ভাবছি। মৌমাছি জিজ্ঞেস করলো, কি কথা? পাখী বলল, মধুর জন্য তুমি কত কঠোর পরিশ্রম করো। কিন্তু লোকজন তোমাকে না জানিয়েই তা নিয়ে যায়। এতে তোমার দুঃখ হয় না? মৌমাছি উত্তরে বলল, না তো। পাখী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন? হাসিমুখে মৌমাছি উত্তর দিলো, কারণ তারা কখনোই আমার মধু তৈরির শিল্পকে আমার কাছ থেকে চুরি করতে পারবে না। বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত আমার ভাইয়াদের লেখা অন্যান্য মানুষকে নিজের নামে চালিয়ে দিতে দেখে, এমনকি বই প্রকাশ করতে দেখে ভাইয়াকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের রাগ হয় না মানুষ যখন তোমাদের লেখা নিজেদের নামে চালিয়ে দেয়? তোমাদের লেখা দিয়ে নিজেদের নামে বই বের করে? ভাইয়া তখন হাসিমুখে পাখী আর মৌমাছির গল্পটি আমাকে শুনিয়ে বলেছিলেন, মানুষ যতই নেতিবাচক কাজ করুক না কেন, তুমি তোমার দৃষ্টিভঙ্গীকে সবসময় ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করবে। মানুষের ক্ষুদ্রতায় তোমার অন্তরের বিশালতা যেন কখনোই হ্রাস না পায়। সবসময় মনে রাখবে মানুষ বড়জোর তোমার মেধা প্রসূত দুচারটা ভাবনা চুরি করতে পারবে। কিন্তু কখনোই তোমার মেধা বা প্রতিভাকে স্পর্শ করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।

মুনা হেসে বলল, সুবহানআল্লাহ। আপি মনের সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায় তোমার কথা শুনলে।

আলহামদুলিল্লাহ। আমারো হুবহু এমনটাই হয় আমার ভাইয়াদের কথা শুনলে। জানো আমার ভাইয়াদেরকে দেখেই উপলব্ধি করেছিলাম, পরিতৃপ্ত মন ছাড়া জীবনের বৈচিত্র্যময়তাকে কখনোই উপলব্ধি করা যায় না। জীবনের প্রতিটা ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ জুড়েও ছড়ানো রয়েছে অনুভবের শত সহস্র আয়োজন। জীবনের প্রতিটা অ্যাকশনে থাকে শিক্ষা, রিঅ্যাকশনের মাঝেও। মানুষের ইতিবাচকতা যেমন জ্ঞানোভান্ডারে দস্তক রাখে, নেতিবাচকতাও রাখে। সমস্যা শুধু একটাই বেশির ভাগ মানুষই জীবনকে কাটিয়ে তো যাচ্ছে প্রতি মূহুর্তেই কিন্তু ভীষণ অনুভূতির শূন্যতায়। তাই অভিজ্ঞতার ভান্ডার অসমৃদ্ধই থেকে যাচ্ছে।

হুম, আসলেই। ইনশাআল্লাহ আজ থেকে দেখবো কম, উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো বেশি। মানুষের নেতিবাচকতায় আহত না হয়ে তারমধ্যে লুকায়িত শিক্ষাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। সংকীর্ণতার জন্য কাউকে দোষারোপ কিংবা কারো সমালোচনা করবো না। উদার হবার সুযোগ সে পায়নি তাই সহমর্মিতা নিয়ে তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবো।

নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ অধমকে শেখাবো মোরা উত্তম হতে, বাঁধ দেবো তার ভুলের স্রোতে। দেখাবো কোথায় জীবনের স্বার্থকতা, কেমন করে অর্জিত হয় উদারতা। স্বার্থের মাঝে শুধুই অন্ধকারাচ্ছন্নতা, পরোপকারে নিহিত জীবনের সফলতা। ভুলে মিছে দ্বন্দ্ব, অকারণ সংঘাত, চলো ছুটি জান্নাতের পানে হাতে রেখে হাত।

মুনা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। আপি আমি রাজী।

ঈমানদারদের তো জান্নাতের পানে ছুটে চলার ক্ষেত্রে অরাজী হবার কোন সুযোগই নেই।

জ্বি সেটা তো অবশ্যই। তবে আমি সালমানকে বিয়ে করার ব্যাপারে রাজী সেটা মিন করছি। আমি যেভাবেই হোক তোমার সাথে, তোমাদের পরিবারের সাথে জুড়ে থাকতে চাই। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না ইনশাআল্লাহ।

নূহা হাসি মুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু শুধু কি আমাদের সাথে জুড়ে থাকাটাই বিয়েতে রাজী হবার একমাত্র কারণ

তা না আপি। তুমিই তো তখন বললে সালমানে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট তোমার চেয়েও হয়তো আমি বেটার দিতে পারবো। গত পাঁচ বছর ধরে একসাথে কাজ করছি। সালমান সত্যিই একজন উত্তম মানুষ। একজন আদর্শ মুসলিম। প্রয়োজনে অসংখ্যবার একসাথে কাজ করতে হয়েছে আমাদেরকে। কিন্তু কখনোই উনি কাজের প্রসঙ্গ ছাড়া একটি শব্দও বললেনি আমার সাথে। অবশ্য রিহ্যাভ সেন্টারের প্রতিজন ভাইয়াই এমন। চলার পথে যখনই কারো সাথে দেখা হয়ে যায়, যদি দূর থেকেই সরে যাওয়া সম্ভব হয় উনারা সেটাই করেন। কিন্তু যদি পাশ দিয়ে যেতেই হয় মাথা নীচু করে চুপচাপ হেঁটে চলে যান। এবং বেশ কয়েক কদম সামনে যেয়ে এরপর সালাম দেন। না চাইতেও উনাদের প্রতি শ্রদ্ধাতে মন ভরে উঠে। কতটা অসাধারণ করেই না গড়েছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা প্রতিজন ভাইকে। উনাদের মতো জীবনসাথী যে কোন মেয়ের জন্যই পরম পাওয়ার। এমন যাদের চরিত্র তাদেরকে ভালোবাসাটা যখন হালাল হয়ে যায়। তখন কেউ চাইলেও মনেহয় নিজেকে বিরত রাখতে পারবে না ভালোবাসা থেকে। আমিও ইনশাআল্লাহ একদিন মনের সবটুকুন দিয়েই সালমানকে ভালোবেসে ফেলবো। কারণ আমার বিশ্বাস এছাড়া সালমান আমার সামনে ভিন্ন কোন অপশনই রাখবে না ইনশাআল্লাহ।

হেসে ফেললো নূহা। হাসতে হাসতে বলল, ইনশাআল্লাহ। তুমি এত সুন্দর করে কথা বলো মাশাআল্লাহ। দোয়া করি সালমান ভাইয়ার কাছেও যেন স্বর্বস্ব উজাড় করে তোমাকে ভালোবাসা ছাড়া ভিন্ন কোন অপশনই না থাকে।

কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে

শর্ত?

হুম, আমাদের বিয়েতে তোমাকে অবশ্যই থাকতে হবে।

নূহা হেসে বলল, সেটা তো শর্ত না দিলেও থাকবো ইনশাআল্লাহ।

তাহলে অন্য আরেকটা শর্ত আছে।

হুম, বলো।

আমাকে ভাইজানের কাছ থেকে ক্ষমা এনে দিতে হবে।

নূহা হেসে বলল, ক্ষমা এনে দিতে হবে? ক্ষমা বহন যোগ্য এই তথ্য তো জানা ছিল না

প্লীজ আপি প্লীজ। আমি তোমাকে সরাসরি কষ্ট দেইনি কখনোই। কিন্তু ভাইজানকে অনেক বেশি বিরক্ত করেছি। যা এক অর্থে কষ্ট দেয়াই ছিল। এমনকি যখন জিহাদ, জিশান আর নাবিহা অনেক ছোট ছিল। এবং ওদেরকে নিয়ে ভাইজান এখানে থাকতে এসেছিলেন তখনও অনেক বিরক্ত করেছি। ভাইজান হয়তো চেয়েছিলেন একা হলেও তোমাদের ভালোবাসা ঘেরা স্থানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকতে। কিন্তু আমার কারণে বাধ্য হয়ে মাস খানেক পরেই বাচ্চাদের নিয়ে চলে গিয়েছিলেন এখান থেকে

নূহা হেসে বলল, তাহলে তো এজন্য তোমাকে স্পেশাল কোন পুরষ্কার দেয়া উচিত।

মুনা অবাক কন্ঠে বলল, পুরষ্কার কেন?

কারণ উনি আমার কাছ থেকে যখন বাচ্চাদের নিয়ে এসেছিলেন কোন আপত্তি করিনি। কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের আনন্দবাড়ি ছেড়ে যখন একা একা এখানে এসে উঠেছিলেন খুবই কষ্ট পাচ্ছিলাম। একা তিনটা বাচ্চাকে কিভাবে সামলাবেন এই টেনশনে আমার জীবনের শান্তি-স্বস্থি সব উবে গিয়েছিল। উনাকে বোঝানোরও কোন উপায় ছিল না। সময় টোট্যালি কথা বলতেন না আমার সাথে। আবার অন্য কারো কথা শোনার মতো ব্যক্তিও উনি না। কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত একবার নিয়ে ফেললে সেটা করবেনই। সেখান থেকে এক চুল নড়েন না। নাবিহা আর জিশান এত বেশি চঞ্চল ছিল ছোটবেলায়। এক মূহুর্ত কোথাও স্থির থাকতো না। তারউপর নাবিহা ছিল ওর বাবার ভক্ত। ওকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সব রাহাত করতো। জিশান আদী ভাইয়াকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না জিহাদ শান্ত সোনা মোনা একটা বাচ্চা ছিল। সারাক্ষণ আমার কোলের মধ্যে থাকতো। তিন বাচ্চার শোকে আমরা তিনজন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়েছিলাম। আর উনি নিষ্ঠুরের মতো বাচ্চাদের নিয়ে এখানে চলে এসেছিলেন। আদী ভাইয়া যদিও নিজের লাগেজ প্যাক করে এখানে চলে এসেছিলেন। রাহাতও প্রতিদিন একবার এসে দেখে যেত। কিন্তু একে তো প্রেগন্যান্ট ছিলাম, তারউপর ফিজিক্যাল কিছু সমস্যার কারণে সম্পূর্ণ বেডরেস্ট চলছিল। তাই এত দূর জার্নি করে বাচ্চাদের দেখতে আসাটা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। কি যে কষ্টে কেটেছিল সেই একটা মাস আমার। কিন্তু উনি এখান থেকে চলে যাবার ফলে আমাদের সকল কষ্টের অবসান হয়েছিল। এখন যদিও আমার বাসা বেশ দূরে। কিন্তু সময় আলাদা বাসা নেবার পারমিশন দিলেও, দূরে যাবার পারমিশন দেননি বাবা। আমাদের বাড়ির একদম পাশেই আমার বাসা ছিল। দিনের মধ্যে একাধীক বার পরিবারের সদস্যরা বাচ্চাদেরকে আমার কাছে নিয়ে যেত। এটা কিছুতেই সম্ভব হতো না উনি এখানে থাকলে। তাই পুরষ্কার তো তোমাকে দিতেই হবে।

তাহলে পুরষ্কার স্বরূপই আমাকে ভাইজানের কাছ থেকে ক্ষমা এনে দাও। প্লীজ আপি। আমি আর কিছুই চাই না।

নূহা আশ্বস্ত ভরা কন্ঠে বলল, ইনশাআল্লাহ আমি অবশ্যই কথা বলবো। আচ্ছা আমাকে যেতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তুমি মুনিরাকে পাঠিয়ে দাও। ওর সাথে কথা সেরেই আমি যাব ইনশাআল্লাহ।

মুনিরাকে ডাকার উদ্দেশ্যে মুনা উঠে যাবার পর নূহা আবারো প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করলো। ঝিরিঝিরি খোলশ ছেড়ে বৃষ্টি এখন মুষুল ধারে ঝরছে। শোনা যাচ্ছে টুপ টুপ শব্দও। পতনের ধ্বনিও যে মনে আনন্দের ঝঙ্কার তুলে যাতে পারে বৃষ্টিই মনেহয় তার প্রমাণ। অজানা এক ভালো লাগাময় আনন্দানুভূতির আবেশ হঠাৎ যেন জাপটে ধরলো নূহাকে। স্বয়ংক্রিয় ভাবে মন বুনতে শুরু করলো শব্দের নকশিকাঁথা! বৃষ্টি পড়ে টুপুর টাপুর, পায়ে পড়েছি স্বপ্নের নূপুর! হাঁটবো আমি সুর ছড়িয়ে, চলার পথে ফুল ফুটিয়ে! বলবো কথা গানে গানে, ছড়াবো সুবাস সবার প্রাণে! উড়বো আমি পাখী হয়ে, মেঘ সাগরে নাও সাজিয়ে! আলো হয়ে ভোর ফোটাবো, সুন্দর এক পৃথিবী গড়বো...... ইনশাআল্লাহ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন