সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...৮

ভুলে যাওয়া নিয়ে এত মন খারাপের কি আছে? আমি তো জানি তোমার ভুলে যাওয়া ভালোবাসার ঘাটতি নয় মোটেও দায়িত্বহীনতা কিংবা অবহেলারও প্রমাণ নয় তোমার ভুলে যাওয়া আমার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের প্রমাণ তাছাড়া তুমি ভুলে যাও বলেই তো শব্দরা ফুল হয়ে ফোঁটে! কাব্যরা তোলে ছোট ছোট ঢেউ! ছন্দরা কথা বলে অনর্গল, জোছনা ঝরায় শিশির! জ্বলে নক্ষত্রের দিয়া, স্বপ্ন দেখে নিষ্প্রভ হিয়া! তোমার ভুলে যাওয়া নিয়ে কোন অভিযোগ নেই! নেই এতটুকুন অভিমান, অনুযোগও! তুমি ভুলে যাও বলেই আমি মনে রাখি! তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও, খোলা আছে মোর আঁখি!” হৃদয়ের গহীন থেকে উঠে আসা শব্দগুলোতে বেশ কয়েকবার চোখ বুলালো জাওয়াদ সেন্ড করার প্রচণ্ড ইচ্ছে স্বর্ত্বেও ক্যান্সেল বটনে চাপ দিলো এমন দুর্বল মূহুর্তগুলোতে মনের ইচ্ছের কাছে ভেসে যাওয়া থেকে বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে সেলফোন পাশে রেখে উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো খুব ভোরেই নূহার আগমন দেখে বুঝতে মোটেও কষ্ট হয়নি সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে এমনিতে শত অভিযোগ করলেও পাত্তা দেয় না নূহা উল্টো যা ইচ্ছে তাই করবো এমন একটা ভাব করে কিন্তু বাচ্চাদের ব্যাপারে ছোট কোন একটা ভুল হলেও খুব দুর্বল হয়ে পড়ে, খুব বেশি কষ্ট পায়, অপরাধ বোধে ভোগে বিষয়টা জানা থাকার কারণে জাওয়াদ বাচ্চাদেরকে ঘিরে কোন অভিযোগ করে না কখনোই নূহা ভুল করলেও সবসময়ই সতর্ক থাকে অভিযোগের আকারে ভুলটাকে দেখিয়ে দিতে বরং সময় নিয়ে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে কিন্তু গতরাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে, তার নীরবতাও অনেক অভিযোগ পৌঁছে দিয়েছে নূহার কাছে বুঝতে পারছে নূহা কথা বলতে চাইছে জিশানের ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু সঙ্কোচের কারণে পারছে না বুকের ভেতর থেকে গভীর নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো জাওয়াদের প্রতিটা সম্পর্কের মাঝেই এমন অনেক কথা থেকে যায় যা কিনা অসম্পূর্ন এর কারণ এটা নয় যে বলার মত শব্দ থাকে না শব্দ থাকে, বলার ইচ্ছেও থাকে কিন্তু তবুও মানুষ বলতে পারে না সংকোচের কারণে এই সংকোচই একসময় অপরাগতায় রূপান্তরিত হয়ে সম্পর্কের মাঝে নিয়ে আসে দুরুত্ব সন্তানদেরকে ঘিরে নূহার সাথে মানসিক দুরুত্ব তৈরি হোক এমনটা কখনোই চায় না জাওয়াদ নতুন করে তাদের মধ্যে কিছু বিষয় আবারো স্বচ্ছ করে নেয়ায় প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো হঠাৎ বেজে ওঠা ইন্টারকম ভাবনার সুর কেটে দিল জাওয়াদের অলরেডি দুইবার নাস্তা করতে যাবার জন্য ডেকে গিয়েছে নাবিহা এখনো নাস্তার ডাকই এসেছে বুঝতে পেরে ডাইনিং হলের দিকে রওনা দিলো

নাস্তা
করার উদ্দেশ্যে ডাইনিং হলে ঢুকে জিশানকে গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তার জগতে ডুবে থাকতে দেখে জাওয়াদ পাশে বসতে বসতে বলল, নতুন কোন ফাঁকিবাজি চিন্তা আবিষ্কৃত হতে যাচ্ছে মনেহচ্ছে?

জিশান
একটু নড়ে চড়ে বসে খুকখুক করে কাশি দিয়ে বলল, জিশানের একটা প্রশ্ন ছিল পাপা।

জ্বি
বলেন আমি শুনছি।

পাপা
হয়েছে কি জানো? গতরাতে ঘুমোতে যাবার আগে চাণক্যের একটা শ্লোক পড়েছিলাম।শাস্ত্র অনন্ত, বিদ্যাও প্রচুর। সময় অল্প অথচ বিঘ্ন অনেক। তাই যা সারভূত তারই চর্চা করা উচিত। হাঁস যেমন জল মিশ্রিত দুধ থেকে শুধু দুধটুকুই তুলে নেয় তেমনি।পাপা তুমি কি জিশানকে একটা হাঁস এনে দেবে? জাওয়াদ কিছুটা অবাক কন্ঠে বলল, হাঁস? হাঁস দিয়ে কি করবে?
জিশান গম্ভীর কন্ঠে বলল, জল মিশ্রিত দুধ থেকে কিভাবে শুধু দুধটুকুই তুলে নিতে হয় সেটার উপর গবেষণা করবো পাপা। দুধের মধ্যে পানি মিশিয়ে হাঁসের সামনে দেবো। হাঁস কিভাবে পানি বাদ দিয়ে শুধু দুধ খায় সেটা পর্যবেক্ষণ করবো। তারপর জিশানও সেভাবে করার চেষ্টা করবে। ফাটাফাটি আইডিয়া কিনা বলো?

টেবিলে
বসা বাকি সবাই হেসে ফেললে জাওয়াদও হাসি চেপে রাখতে পারলো না। হাসতে হাসতে বলল, মেরে তোমাকে ফাটিয়ে ফেলার মত আইডিয়া এটা। দুষ্টু ছেলে নাস্তা করো চুপচাপ।

পাপাকে
হাসতে দেখে মনের জোর আরো বেড়ে গেলো জিশানের। ঘ্যান ঘ্যান জুড়ে দিলো, প্লিজ পাপা একটা হাঁস এনে দাও জিশানকে। শুধু একটা। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।

জাওয়াদ
বলল, নাস্তার টেবিলে আর কোন উদ্ভট কথা বলবে না তুমি। এই শর্তে এনে দেব হাঁস।

জিশান
বিরাট হাসি নিয়ে ঈশারায় ঠোঁট লক বুঝিয়ে নাস্তার প্লেট টেনে নিলো।

ডাইনিং
হলের সাথেই লাগোয়া কিচেন। কিচেনে দাঁড়িয়ে ছেলের কথা শুনছিল আর হাসছিল নূহা। পাশে দাঁড়ানো তাসমিয়াও হাসতে হাসতে বলল, তোমার এই পুত্রটা আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় ভাবী।

নূহা
হাসতে হাসতে বলল, নিজের সন্তানদেরকে ভিন্ন চোখে দেখতে নেই। নয়তো আমিও তোমার কন্ঠে কন্ঠ মেলাতাম।

তাসমিয়া
হেসে বলল, সত্যিই ভাবী আমাদের আনন্দবাড়িতে যতগুলো লিটল স্টার আছে সবার চেয়ে উচ্ছল, প্রানোবন্ত দুষ্টুর শিরোমণি হচ্ছেন আমাদের ক্ষুদে বিজ্ঞানী জিশান সোনা বাবাটা। পুরো বাড়ির কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সব জিশানের নখদর্পণে। সবার কারেন্ট নিউজ জানতে চাইলে জিশানের কোন অল্টারনেটিভ নেই। আবার যে কারো মনখারাপ হলে সবার আগে জিশানকেই পাশে পাওয়া যায়। আমাদের ক্ষুদে এই বিজ্ঞানী যেহেতু কুরআনে হাফিজ। কাউকে স্বান্তনা দেবার সময় কুরআনের কথা বলেই তাকে শান্তির পথপ্রদর্শন করে। এজন্যই আমাদের বাড়ির নানান রঙের মানুষগুলোর মধ্যে জিশানের প্রতি সবার ভালোবাসা কমন। জানো কিছুক্ষণ জিশানকে বাড়ির মধ্যে ঘুরঘুর করতে দেখা না গেলে অস্থির হয়ে যায় সবাই। বাড়ির বেশির ভাগ মানুষের মনের কথা, ব্যথা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা ভাইজানের কাছে পাঠানোর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যমও জিশান। বুড়া আব্বাটা শুধু যে কারো সমস্যার কথা শোনে তাই না আশ্বস্ত করে বলে, তুমি কোন চিন্তা করো না। জিশান এক্ষুনী পাপাকে বলছে। পাপা মানতে না চাইলে জিশান ঠিক পাপাকে পটিয়ে ফেলবে ইনশাআল্লাহ। কথাটা অবশ্য সত্যি। ভাইজানকে পটাতে জিশানের জুড়ি মেলা ভার। যতক্ষণ কোন ব্যাপারে রাজী না হয় জিশান আঠার মত লেগেই থাকে ভাইজানের পিছনে। সাথে চলতে সাথে ওর ননস্টপ কথা। ভাইজান মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলেন, উফ এত কথা কিভাবে বলো বাবা? জিশান তখন বিশাল হাসি দিয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ মার জিন থেকে জিশান কথা বলার ক্ষমতা পেয়েছে। ভাইজান তখন হেসে নাক কিংবা কান টেনে দেন জিশানের। তবে আমারো ধারণা জিশান একদম তোমার মতো হয়েছে। মনে আছে তুমিও ছোটবেলায় এমনি করেই ভাইজানের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকতে। আমাদের সব কথাও আমরা তোমাকে দিয়েই বলতাম ভাইজানকে।

হুম
, ছোটবেলাটাই অনেক ভালো ছিল। আবার ছোট হয়ে যেতে পারলে মন্দ হতো না আসলে। তাহলে সেইসব কিছু দেখে দূরে থাকতাম এবার, যেসবের কারণে আমাদের আনন্দবাড়ি থেকে এত দূরে থাকতে হচ্ছে আমাকে

তাসমিয়া
দুষ্টুমি হাসি হেসে বলল, ভেবে চিন্তে বলছেন তো ভাবীজান? সেক্ষেত্রে কিন্তু আপনার জীবনের সবচেয়ে রোম্যান্টিক দিনগুলো অন্য কারো দখলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, আনন্দবাড়ির আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তিন তারকা জিহাদ, জিশান আর নাবিহা তাহলে কোত্থেকে আসবে শুনি?

নূহা
হেসে বলল, ধোলাই খাবে তুমি এখন। কাজ করো ঠিকমতো। হায় আল্লাহ! কি আঁকাবাঁকা করে লুচি বানাচ্ছে এই মেয়ে। সবাই জানে কিচেনে এখন আমি। নিশ্চিন্ত ধরে নেবে বিভিন্ন দেশের এইসব ম্যাপ আমি বানাচ্ছি।

তাসমিয়া
হাসতে হাসতে বলল, আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন ভাবীজান। সবাই এমনটা ভাববেন না। এছাড়া বাকি যারা ভাববেন তাদের ভাবনাতে আপনার কিছু এসে যায় না। আচ্ছা আচ্ছা ঠিকআছে চোখ বড় বড় করে তাকাতে হবে না। আমি বাটি দিয়ে কেটে গোল বানিয়ে দিচ্ছি সব লুচি। আপনি ভাঁজতে ভাঁজতে আমাকে একটু জ্ঞানদান করেন

কোন
বিষয়ে জ্ঞানদান?

তুমি
তো জানোই পরিবারের বাইরে মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে আমি একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। আবার মানুষের ছোট একটা নেতিবাচক কথা বা কাজও আমার মনের শান্তিতে ভীষণ প্রভাব ফেলে। আমি অন্য আর সব কাজ বাদ দিয়ে তখন মানুষের সেই কথা বা কাজকে নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে বসে যাই। আদী ভাইয়ার কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলে ভাইয়া আত্মসচেতনতা আত্মসতর্কতা মাঝে বিদ্যমান পার্থক্য নিয়ে বললেন আমাকে। বললেন যে, সতর্কতা আত্মনিয়ন্ত্রণের সহায়ক। সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গী মানুষকে নিজেকে বুঝতে, জানতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। পক্ষান্তরে, সচেতনতা নিজের চেয়ে অন্যেকে গুরুত্ব দিতে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থাৎ, কে কি ভাবলো, কি বললো, কি করলো ইত্যাদি ভাবনার জন্ম দেয় মনে। যা কিনা খুঁতখুঁত থেকে ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাই আত্মসতর্কতা যেখানে নিজেকে বিকশিত করতে সহায়ক, আত্মসচেতনতা সেখানে মনে লজ্জাবোধ, অপরাধবোধ, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বীজ বুনে দেয়। সেজন্য সেই ব্যক্তিরাই নিজের এবং অন্যের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে যারা সতর্ক কিন্তু সচেতন নয়। তাই মানুষকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে কিন্তু সচেতন নয়। ভাইয়ার তাড়া ছিল তাই ডিটেইল বুঝিয়ে বলতে পারেননি। এরপর থেকে আমার আমার মাথায় আত্মসতর্কতা এবং আত্মসচেতনতার পার্থক্য ঘুরছে। বুঝতে পারছি না ঠিক মতো। প্লীজ এই বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলো।

আত্মসতর্কতা
এবং আত্মসচেতনতার পার্থক্য এতটাই সূক্ষ্ম যে, কোনটা যে সতর্কতা আর কোনটা যে সচেতনতা বোঝাটাই মুশকিল। আমার কাছেও বেশ জটিল লাগে বিষয়টা। তাছাড়া এসব সংজ্ঞা বলা যতটা সহজ, প্রয়োগ করা ততটাই কঠিন। কার এত সময় আছে নিজের প্রতিটা আচরণকে নিয়ে গবেষণা করার?

হুম
, তাও অবশ্য ঠিক। আচ্ছা ভাবী যারা এসব তথ্য বের করার জন্য বছরের পর বছর গবেষণা করছে। তারাও কি সর্বক্ষেত্রে এসব মেনে চলতে পারে বলে মনেহয় তোমার?

নূহা
হেসে জবাব দিলো, কি জানি। তবে মনেহয় না তারাও পারে। তাছাড়া একদল ফর্মূলা উদ্ভাবন করবেন আর আরেকদল প্রাক্টিক্যাল করবেন এটাই মনেহয় স্বাভাবিক। যাইহোক, তবে আমার কি মনেহয় জানো? এই ধরণের তথ্যাদি জীবন যাপনকে অকারণ জটিল করে তোলে। জীবন যাপনের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি শরীয়তে খুব সুন্দর সহজ ভাষায় বলে দেয়া আছে। সেসব যারা যথাযথ মেনে চলে তাদের স্বস্থিতে থাকার জন্য এইসব ফমূলার কোন প্রয়োজন পরে না কখনোই। তাদের মনে যখনই অস্থিরতার তৈরি হয় তারা রবের পানে ছুটে যায়। কারণ একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্তির সন্ধান পায়। তাই আত্মসতর্কতা আত্মসচেতনতার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সময় নষ্ট না করে, সেই সময়টুকু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে ব্যয় করাটাই উত্তম। এরফলে ব্যক্তি নিজের মন যেমন প্রশান্ত হয়, তেমনি অন্যের সাথে তার আচার-আচরণ সুশৃঙ্খল সুশোভিত হয়ে যায়। নিজের করণীয়-বর্জনীয় নির্ধারণ করাটাও সহজ হয়ে যায়। এবং অন্যের কথার দ্বারা অকারণ প্রভাবিতও হয় না।

তাসমিয়া
হেসে বলল, আদী ভাইয়া আর তোমার কথার মধ্যে এখানেই সবচেয়ে বেশি অমিল। আদী ভাইয়া মানসিক ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ব্যাপার গুলোকেও খুব গুরুত্বের সাথে বর্ণনা বিবেচনা করে। কিন্তু তুমি বিশাল বড় বড় বিষয়গুলোকেও শরীয়তের মানদণ্ডে বিবেচনা করে উড়িয়ে দাও।

নূহা
হাসি মুখে বলল, এখানেই হয়তো পার্থক্য গুরু-শিষ্য কিংবা জ্ঞানী-অর্ধজ্ঞানীর। আদী ভাইয়া প্রায় সাতাশ-আটাশ বছর ধরে এই সাবজেক্টের উপরে স্টাডি করছেন। সাইকোলজির প্রতিটা শাখাতে উনার অবাধ বিচরণ। সেই তুলনায় আমি সবে মনোজাগতিক ভ্রমণ শুরু করেছি। ভাইয়ার চিন্তাধারা, বিচার-বিবেচনা সাথে আমার পার্থক্য বিদ্যমান থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। ভাইয়া কথা বলেন উনার এক সমুদ্র জ্ঞানের আলোকে। আর আমি কথা বলি আমার স্বপ্নের নীলাভ ঝিলের বুকে পড়া ভাবনার প্রতিচ্ছবি দেখে।

সেসব
তো ঠিক আছে। কিন্তু এরফলে যত বিপদ হচ্ছে গিয়ে আমাদের। যখন আদী ভাইয়ার কথা শুনি মনেহয় মনের প্রতিটি অনুভূতিই মূল্যবান। নিজের চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে ভেসে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক কিছু। কিন্তু যখন তোমার কথা শুনি মনেহয় যে অনুভূতিকে মূল্য দিতে গেলে অন্য কেউ কষ্ট পাবে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়াটাই উত্তম। তোমার কথারা মনে ত্যাগের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। নিজের চেয়ে অন্যের খুশিকে বড় করে দেখতে প্রেরণা পাই। মনেহয় যে, একজন ঈমানদার কখনোই বিরূপ পরিবেশ-পরিস্থিতির স্রোতে ভেসে যেতে পারে না। বরং ঈমানদার সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকে সত্য সুন্দরের পথে। তোমার আর আদী ভাইয়ার দেয়া সমাধানের মাঝে অনেক পার্থক্য। তুমি শুধু ত্যাগের কথা বলো। আর ভাইয়া বলে নিজের মনে শান্তি না থাকলে কখনোই অন্যকে সুখী করা যায় না। আমি সত্যিই খুব কনফিউজড হয়ে যাই তোমাদের দেয়া সমাধান পাশাপাশি রাখলে।

তাহলে
এখন থেকে আর আমাদের দুজনের দেয়া সমাধানকে পাশাপাশি রাখবে না। বরং একসাথে মিশিয়ে খুব করে ঝাঁকিয়ে নেবে।

তাহলে
কিভাবে এই ঝাঁকাঝাঁকি করবো সেটাও বলে দেন আমাকে ভাবীজান।

নূহা
হেসে বলল, এটা তো খুবই সহজ। এক্ষুণি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। এই যেমন আদী ভাইয়া নিজের মনের প্রশান্তিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। আমিও কিন্তু মূলত এই কাজটিই করি। নিজের মনের শান্তিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই বলেই আমি ত্যাগ, মেনে নেয়া, মানিয়ে চলার চেষ্টা করি। আমাদের দুজনের মধ্যে সূক্ষ্ম যে পার্থক্যটা বিদ্যমান সেটা হচ্ছে, উনার থিওরি হচ্ছে তোমার সাথে আমি অবশ্যই উত্তম ব্যবহার করবো কিন্তু এর বদলে তুমি যদি মন্দ ব্যবহার করো তাহলে আমি তোমাকে এড়িয়ে চলবো। কারণ যদি কারো কাছ থেকে আঘাত পাবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে দূরে থাকাটাই উত্তম। তা না হলে বার বার আঘাত পেতে হবে। এবং একসময় অধৈর্য্য হয়ে নিজেও আঘাতকারীতে পরিণত হয়ে যাবে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, হয় অন্যায় দূর করতে হবে নয়তো অন্যায় থেকে দূরে থাকতে হবে। তা না হলে অন্যায়ের স্বীকার হতে হবে কিংবা নিজেই অন্যায়ের অংশীদার হতে হবে। আর আমার থিওরি হচ্ছে, তুমি অধম হলে আমি উত্তম হবো না কেন? তাছাড়া ইসলামের শিক্ষাও তো এটাই। যে উত্তম তার সাথে উত্তম হবার মাঝে আসলে বাড়তি কোন কৃতিত্ব নেই। যে অধম তার সাথে উত্তম হতে পারাটাই হচ্ছে পরীক্ষা। তুমি হয়তো আমার ভালো কাজকে মূল্যায়ন করছো না। কিন্তু যদি আমার নিয়্যাত সহীহ থাকে তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে অবশ্যই আমি প্রতিদান পাবো। আর এটাই তো আমাদের জীবনের লক্ষ্য তাই না?

হ্যা
তাই তো! আমাদের জীবনের লক্ষ্য তো মানুষ নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি। মানুষের আচরণের উপর কেন তাহলে আমাদের আচরণ নির্ভর করবে? কেউ আমার সাথে নেতিবাচক আচরণ করলেই আমি কেন তাকে এড়িয়ে চলবো? এমনও তো হতে পারে আমার উত্তম ব্যবহারে তাকে উৎসাহিত করবে নিজেকে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। তাছাড়া বাইরের মানুষকে নাহয় আমি এড়িয়ে চললাম। কিন্তু পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন এদের ক্ষেত্রে কি করবো? আর আমাদের জীবনে সমস্যা তৈরি তো মূলত কাছের মানুষেরাই করে

আমার
পয়েন্টও তো এটাই। ফ্যাক্ট হচ্ছে, ঘরের শত্রু বিভীষণ। কাছের মানুষদের এড়িয়ে চলা মানে সম্পর্কের বন্ধনের হক আদায় থেকে বিরত থাকা। আমরা মুসলিমরা তো অন্তত পক্ষে এমনটা করতে পারিনা। মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না পরিবার কিংবা স্বজনদের উপর থেকে। যেহেতু আমাদের সামনে জবাবদিহীতার প্রশ্ন আছে।

তাহলে
করণীয় কি?

করণীয়
মানুষের জন্য মনের দরজা তো খুলতেই হবে। তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারও করতে হবে। কিন্তু সাথে সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন আমাদের বিনয় উদারতাকে দুর্বলতা না ভেবে বসে। কারণ আমাদের সমাজে বিদ্যমান অন্য আরো অনেক ভুল ধারণার মধ্যে এটিও একটি যে, বিনয়কে দেখা হয় ব্যক্তির দূর্বলতা হিসেবে। মানুষের আত্মিক দীনতার কারণে ভালো হতে চাওয়াটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে গিয়েছে। কারণ যখনই কেউ কারো সাথে উত্তম কিছু করার চেষ্টা করে প্রথমেই তার মনে প্রশ্ন জাগে, এই ভালোর আড়ালে অন্য কোন স্বার্থসিদ্ধির পরিকল্পনা লুকায়িত নেই তো? এমন চিন্তা হচ্ছে এক গ্রুপের। অন্য গ্রুপ আবার বিনম্রতার সুযোগে নিজের স্বার্থ হাসিলের সুযোগে থাকে। সেজন্যই উত্তম আচরণ করার সাথে সাথে এটাও বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বিনয় আমার দুর্বলতা নয় বরং উদারতা। এবং সর্বদা সর্বাবস্থায় নীতিতে অটল থেকে আমরা বুঝিয়েও দিতে পারি দায়িত্ব পালনে আমরা যতটা দরদী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ততটাই প্রতিবাদী। আসলে কি জানো?

কি
ভাবী?

সকল
ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাটা খুব বেশি দরকার। আমাদের সমাজে যারা কঠোর তারা কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনেও কঠোর। আবার যারা বিনয়ী তারা শত অন্যায় ভুল মুখ বুজে মাথা পেতে মেনে নেয়। তাই চারপাশে যখন তাকাই নেতিবাচক উদাহরণই খুঁজে পাই। তাই এখন করণীয় হচ্ছে নতুন উদাহরণ তৈরি করা। অর্থাৎ, নীতিতে অটল থেকে আমরা বুঝিয়ে দিতে পারি আমরা বিনয়ী কিন্তু দুর্বল নই। এবং আমরা উদার কিন্তু অন্যায়ে আপোষহীন। আর মানুষের নেতিবাচক বা ইতিবাচক কিংবা ষে কোন ধরণের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার ফলপ্রসূ টিপস হচ্ছে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ, তুমি আমার সাথে ইতিবাচক কিছু করলেই খুশিতে গর্জন করা থেকে যেমন বিরত থাকতে হবে, তেমনি নেতিবাচক কিছু করার সাথে সাথেই বর্জন করাও যাবে না। যদিও যে কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকাটা বেশ কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কাজটি রপ্ত করতে পারলে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে অকারণ জটিলতা, সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্ট মনোমালিন্য ইত্যাদি এড়িয়ে যাওয়াটা বেশ সহজ হয়ে যায়। মোটকথা, সময়কে সময় দিতে হবে। তাহলে সময় শুধুই বয়ে না গিয়ে নিজের করণীয় করে যাবার সুযোগও পাবে ইনশাআল্লাহ।

তাসমিয়া
হেসে বলল, ঠিক বলেছো ভাবী সময়কে সময় দিতে হবে। তাহলে সময় শুধুই বয়ে না গিয়ে নিজের করণীয় করে যাবার সুযোগও পাবে ইনশাআল্লাহ।

হুম
! কিন্তু এই মূহুর্তে সময়কে সময় না দিয়ে একটু কাজ দেন। লুচিগুলো দিয়ে আসেন টেবিলে।

জো
হুকুম ভাবীজান বলে নূহার হাত থেকে লুচির প্লেট নিয়ে ডাইনিং হলের দিকে রওনা দিলো তাসমিয়া

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন