সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...২৯



দরদ ভরা চোখে ননস্টপ হাঁচি দিতে থাকা নূহার দিকে তাকিয়ে ছিল রাহাত। পাঁচ মিনিটে কম করে হলেও পঁচিশটা হাঁচি দিয়েছে। নাক আর চোখ দিয়ে অঝোর পানি ঝরছিল। চোখ মুখ ফুলে একদম একাকার অবস্থা যাকে বলে। আরো কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর রাহাত বলল, কে বলেছিল তোমাকে বৃষ্টির মধ্যে পার্কে যেতে? জানোই যেহেতু বৃষ্টির পানি সহ্য করতে পারো না। তোমার এই অবস্থা দেখলে বাড়ির সবাই কতটা অস্থির হয়ে উঠবে সেটা কি তোমার অজানা?

আরো দুটা হাঁচি দিয়ে নূহা বলল, বৌ হাঁচি দিতে দিতে মরণ প্রায় আর তুমি কিনা বাড়ির মানুষের চিন্তায় অস্থির? বৃষ্টি ছিল না বলেই আমি রাহা পার্কে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে যাবে সেটা কিভাবে জানবো? আমি কি আবহাওয়াবিদ? আর শোনো বিপদে যেমন বন্ধুর পরিচয়, অসুস্থতার সময় তেমন স্বামীর পরিচয়। বুঝলে? রাহাত হেসে ফেললে নূহা বলল, আবার তুমি হাসছোও দেখি? এত বড় দুঃসাহস? তোমাকে উত্তম মানুষের সার্টিফিকেট দেবেটা কে শুনি? 

দরজার ওপাশ থেকে তাসমিয়ার কন্ঠ ভেসে এলো এই সময়। হাসতে হাসতে বলল, ছোট ভাইয়া ভাবীকে বলো যে, সার্টিফিকেট তো তুমিই দেবে। কিন্তু আমিও এত সহজে নিজের অধিকার ছেড়ে দেবার মানুষ নই। দরকার হলে ছরতা দিয়ে সুপারির মত তোমার বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিজেই সার্টিফিকেটে তোমার টিপসই দিয়ে নেবো। তারপরও সিগনেচার সহ সার্টিফিকেট আদায় করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।   

স্বশব্দে হেসে ফেললো রাহাত। হেসে ফেললো নূহাও। তাসমিয়াও হাসতে হাসতে বলল, ছোট ভাইয়া তুমি রুমে যাও। নিশ্চিন্তে প্রভাতী ঘুম দাও। তোমার বৌয়ের সেবা করার জন্য তোমার বোন হাজির আলহামদুলিল্লাহ।  

রাহাত ভেতরে চলে যাবার পর তাসমিয়া বারান্দায় এলো। বিশাল বড় একটা মগ নূহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নেন ভাবীজান ভেষজ চা পান করেন। বেটার ফিল করবেন ইনশাআল্লাহ। ইশশ, কি অবস্থা হয়েছে তোমার! দরকারটা কি ছিল এই বৃষ্টির দিনে বাইরে যাবার?   

আরে ভাইয়ের মতো একই ফ্লপ কোয়েশ্চেন জিজ্ঞেস করছে কেন এই মেয়েও? হঠাৎ আবারো বৃষ্টি নেমে যাবে সেটা কি জানতাম নাকি আমরা? রাহাকে দিয়েছো চা?   

না রাহা ভাবীর কন্যা ঘুম থেকে উঠে কান্না জুড়েছে শুনতে পেয়ে আর যাইনি চা নিয়ে। তাছাড়া তোমার মত সমস্যাও তো নেই রাহা ভাবীর। আমি বেশি করে বানিয়ে ফ্ল্যাক্সে রেখে এসেছি চা। লাগলে নিয়ে নেবে।   

কিন্তু তুমি আগে জবাব দাও আঙুল কেটে টিপসই নেবার কথা কোথায় পেয়েছো?

মনের আনন্দে কিছুক্ষণ আবারো হাসলো তাসমিয়া। এরপর বলল, ভাইজান যেদিন তোমাকে বলেছিলেন সেদিনই শুনেছিলাম।   

নূহা চোখ বড় বড় করে বলল, তোমরা সবাই কি সারাক্ষণ আড়ি পেতে থাকতে আমাদের কথা শোনার জন্য?

জ্বিনা ভাবীজান। আপনারাই কথার ফুলঝুরি বাড়িময় ছড়িয়ে দিতেন মুঠো মুঠো। ফুল যেমন আপনার জন্য ফোটে না। আপনাদের কথাও তেমন নিজেদের জন্য হতো না। সত্যি করে বলো তো ভাবী এটা কি তোমার আর ভাইজানের একটা কৌশল ছিল বাড়ির সবার কাছে এই ম্যাসেজটা পৌঁছে দেয়ার যে, কতটা আনন্দঘন হতে পারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক? আমার কেন জানি এমনটাই মনেহয়। নয়তো ভাইজানও তো অন্তত সারাক্ষণ ওভাবে কিচিরমিচির করা স্বভাবের মানুষ না।  

নূহা হেসে বলল, অন্যের কাজের পেছনে সুন্দর উদ্দেশ্যে খুঁজে নিতে পারাটা ব্যক্তির উন্নত ও সুন্দর মনের পরিচায়ক। মাশাআল্লাহ অনেক বেশি সুন্দর একটা মনের অধিকারীনি তুমি। আজকাল অন্যের কাজের সমালোচনা কিংবা নিন্দা করার মানুষ অনেক পাওয়া যায়। কিছু কিছু প্রশংসাকারীও মিলে যায়। কিন্তু মূল উদ্দেশ্যে সন্ধানী মেলে না সহজে। তাই অনেক কাজই খুব প্রশংসিত হবার পরেও উদ্দেশ্যে হাসিলে ব্যর্থ হয়। এবং অনেক কল্যাণময় কাজও ব্যর্থ হয় লক্ষ্যকে ছুঁতে।      

আলহামদুলিল্লাহ তোমার কথা শুনে তো নিজেকে ভীষণ স্পেশাল মনে হচ্ছে ভাবী। হাসতে হাসতে বললো তাসমিয়া।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ তুমি অবশ্যই অনেক অনেক স্পেশাল। আচ্ছা গতরাতে কি যেন বলতে চেয়েছিলে তুমি?

এখন থাক ভাবী। তুমি সুস্থ হয়ে নাও।

আমি সুস্থই আছি আলহামদুলিল্লাহ। আর অসুস্থতা বলতে যদি সর্দি আর হাঁচিকে মিন করে থাকো। কমপক্ষে দুইদিন উনারা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছেন না। তুমি তাই নিশ্চিন্তে তোমার কথা বলো।

তাসমিয়া হেসে বলল, তোমার সাথে একটা ব্যাপারে ডিসকাস করতে চাচ্ছিলাম।

হ্যা বলো।

সমস্যাটা আমার ফ্রেন্ড রাফিয়ার ছোট বোন জুমানার। তিন বছর আগে জুমানার বিয়ে হয়েছে। বিয়েটা অনেকটা ওর মতের বিরুদ্ধে হয়েছিল। বিয়ে করতে একদমই রাজী ছিল না। ওর বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পরও জুমানার বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল স্বামীর সাথে মানিয়ে নিতে। কারণ নিজের জন্য যেমন হাজবেন্ড চেয়েছিল মোটেই তেমন পায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে একটা সময় ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে স্বামীর সাথে। একটা সময় ভালোবাসাও তৈরি হয়ে গিয়েছে দুজনের মধ্যে। ওর স্বামী বেশ প্রাক্টিসিং ছিল। ধীরে ধীরে জুমানাও প্রাক্টিসিং হয়েছে স্বামীর উৎসাহে। বিয়ের দুই বছর পর ওদের একটা বেবীও হয়ে যায়। খুব সুখের সংসার বলতে যা বোঝায় এমনটা আসলে কখনোই ছিল না ওদের। ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্য হতো প্রায়ই। জুমানার স্বামী ওকে ফিজিক্যালি অ্যাবিউজও করেছে মাঝেমধ্যে। এই সব কিছুর পরেও মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু জুমানার সব ত্যাগ, কম্প্রোমাইজ বৃথা হয়ে গিয়েছে ছয় মাস আগে। যখন জানতে পেরেছিল ওর হাজবেন্ড অন্য একটি মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। যে মেয়েটির সাথে জুমানার সাথে বিয়ের আগে রিলেশনে ছিল ওর হাজবেন্ড। ঐ মেয়েটি ছেড়ে দিয়েছিল বলেই পরে জুমানাকে বিয়ে করেছিল ওর হাজবেন্ড। তবে সমস্যা মূলত এটাও না। জুমানার কাছে অ্যাফেয়ারের কথা প্রকাশিত হয়ে যাবার পর ওর হাজবেন্ড নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখবে না এই ওয়াদাও করেছে। কিন্তু শুরু থেকে নিয়ে নিজের জীবনের সাথে যা যা ঘটেছে সবকিছু মিলিয়ে জুমানা একদমই ফেডআপ। ওর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। জোর করে বিয়ে দেবার জন্য বাবাকে সবকিছুর জন্য দায়ী মনেহয় ওর। স্বামী ক্ষমা চাইবারও পড়েও দ্বিতীয় বার বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই ক্ষমাও করতে পারছে না। বাচ্চার দিকেও মনোযোগ দিতে পারছে না। সারাক্ষণই সবাইকে শুধু অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করে জুমানার। এই সবের প্রভাব ওর ইবাদতে গিয়েও পড়েছে। সালাতে দেরি করে ফেলছে, বাড়তি আমলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। একটুতেই ভয়ংকর ভাবে রেগে যাচ্ছে। এতটাই যে ওর হাত-পা কাঁপতে থাকে রাগে। জুমানা নিজেই বুঝতে পারছে এসব আচরণ স্বাভাবিক নয়। ওর কাউন্সিলিং দরকার। রাফিয়ার সাথে প্রায়ই তোমার ব্যাপারে কথা বলি। তাই বোনের সমস্যাটা আমার সাথে শেয়ার করে তোমাকে কোন পরামর্শ দিতে বলেছে।

আমি তো আছিই বেশ কিছুদিন বাড়িতে। একদিন আসতে বলো ওদেরকে। 

রাফিয়া আসতে পারবে ভাবী। কিন্তু জুমানা তো দেশে থাকে। তুমি চাইলে ফোনে কথা বলতে পারো।

হুমম, বলার পর বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো নূহা। এরপর বলল, বাবা-মায়েদের কখনোই জোর করে বিয়ে দেয়া ঠিক না সন্তানদেরকে। বিয়ের মতো একটা সম্পর্কের শুরু কখনোই অনিচ্ছাকৃত ভাবে হওয়া উচিত না। কারণ বেসিক্যালি স্বামী-স্ত্রী তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্তগুলো বিয়ের পরবর্তী সময়ে জড়ো করে। খুব বেশি স্পেশাল এই সময়টা। যখন দুটো মন প্রথমবারের মতো কাছাকাছি আসে। বিন্দু বিন্দু ভালো লাগা জমে ভালোবাসার সিন্ধু গড়ে ওঠে। কিন্তু যখন সম্পর্কটা জোর করে হয় এই সব কিছু মিস হয়ে যায়। পরবর্তীতে একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসার জন্ম হলেও এই ধরণের বন্ধনগুলোকে বেশির ভাগ সময়ই শুরুর তিক্ততাকে বয়ে বেড়াতেই হয় মনের কোনে। আমি এটা নিজেকে দিয়েও বুঝি। যদিও আমার প্রেক্ষাপট একদমই ভিন্ন। কিন্তু তারপরও রাহাতের সাথে আমার বিয়েটা জোর করে দিয়েছিলেন পরিবারের সবাই। এখনো যখন আমার ঐ সময়ের কথাগুলো মনে পড়ে তীব্র একটা অপরাধবোধ ঘিরে ধরে। প্রথম ছয়মাস অনেক অন্যায় আচরণ করেছি আমি রাহাতের সাথে। আমার তো শরীয়তের বিধিবিধানের জ্ঞান ছিল। খুব ভালো মতোই জানতাম স্বামীর হক, অধিকার সবকিছু। তারপরও কিন্তু আমি ছয় মাসের উপরে আলাদা রুমেই ছিলাম। বাড়ির সবার সাথে প্রচন্ড চিৎকার-চেঁচামেচি করতাম। সামান্য কিছুতেই সামনে যা পেতাম ছুঁড়ে ফেলতাম। তোমার হয়তো মনে আছে সবই। 

জ্বি ভাবী আমার মনেআছে। আমরা কেউ মিলাতেই পারতাম না সেই তোমার সাথে আমাদের চির পরিচিত নূহাকে। আমরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতাম জিহাদ, জিশান আর নাবিহার প্রতি তোমার অবহেলায়। বাড়ির অন্য কারো প্রতি তো নাই, এমনকি সন্তানদের প্রতিও তোমার কোন ফিলিংস ছিল না। 

হুম, এটাই বলতে চাচ্ছিলাম আমিও। কারো প্রতিই আমার কোন ফিলিংস ছিল না। আমি এমনিতেও খুব বেশি মনযোগী ছিলাম আমার ইবাদতের ক্ষেত্রগুলোতে। তোমার ভাইজানের সাথে বিয়ের পর সেই সিনসিয়ারিটি বেড়ে গিয়েছিল আরো অনেক গুণ বেশি। কিন্তু ঐ সময়টাকে আমি শুধু পড়তে হবে বলে নামাজ পড়তাম। কোন কোন দিন একদম শেষ সময়ে গিয়ে কোন ওয়াক্তের নামাজ আদায় করতাম। সারা রাত ঘুমোতে পারতাম না কিন্তু উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করার চিন্তা আসতো না মনে। তোমার ভাইজান শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন অবশ্যই এক পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আমাকেও উনি প্রতিদিন এক পারা কুরআন তিলাওয়াতে অভ্যস্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু ঐ সময় এক পারা তো অনেক পরের কথা। মাঝে মাঝে তিন-চার দিনও পেরিয়ে যেত আমি কুরআনের কাছেই যেতাম না। আর যেদিন তিলাওয়াত করতাম সেদিনও এক পৃষ্ঠা, বড়জোর দুই পৃষ্ঠা। কোন কোন দিন ছোট্ট একটা সূরা পড়েই দায় আদায় হয়ে গিয়েছে ভেবে নিতাম। আমি বুঝতে পারতাম যা করছি এসব ঠিক নয়। কিন্তু সঠিক পথে ফিরে যাবার কোন তাগিদা অনুভব করতাম না। এরপর ধীরে ধীরে রাহাতের ধৈর্য্যশীল স্বভাব, উত্তম গুণাবলী, আমার সন্তানদেরকে ঘিরে ওর উজাড় করা অকৃত্রিম ভালোবাসা, ত্যাগ ইত্যাদি মিলিয়ে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলাম। যে ঘাটতিগুলো তৈরি হয়েছিল আমার মধ্যে সেগুলোকে দূর করেছিলাম আস্তে আস্তে। রাহাত প্রতিটি বিষয়েই অনেক সাহায্য করেছে আমাকে। জারিফকে কন্সিভ করার পর আমি কিন্তু মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাম। ভালো লাগতো তখন রাহাতকে। পরিবারের সবার প্রতি অভিমানও কমে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম সবাই আসলে আমার কল্যাণ চেয়েছিলেন বলেই আমার উপর জোর করেছিলেন। এবং সেই কল্যাণকে আমি অনুভব করতেও শুরু করেছিলাম রাহাতের কথা, কাজ, আচরণ সবকিছুর মধ্যে দিয়ে। আবারো আমি তেমন মা হবার চেষ্টা করতে শুরু করেছিলাম যেমন মা হবার স্বপ্ন জিহাদ, জিশান আর নাবিহাকে কন্সিভ করার পর দেখেছিলাম। আমার জীবনে সবকিছু সুন্দর ও স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিলো। আমি সত্যিকার অর্থে সুখী ছিলাম রাহাত আর বাচ্চাদের সাথে। জারিফকে স্বাগত জানানোর স্বপ্ন বুনছিলাম রাহাতকে সাথে নিয়ে। কিন্তু ঐসময় তোমার ভাইজান আবার ফিরে এলেন আমার জীবনে। আবারো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো আমার। আবারো ঘোর আঁধার ছাড়া চারপাশে আর কিছুই নজরে আসছি না। বলতে বলতে দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর অশ্রু নেমে এলো নূহার।   

তাসমিয়া হাত বাড়িয়ে নূহাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আই এম সরি ভাবী। আমি তোমাকে আপসেট করার জন্য এই কথাগুলো বলিনি।

চোখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে নূহা বলল, তুমি সরি বলছো কেন বোকা মেয়ে? আমার কি মনেহয় জানো নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলোর কারণেই কেউ যখন তার সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসে। আমি কখনোই তাকে মুখস্ত কথা বলতে পারিনা। বরং আমি তাকে সম্পূর্ণ রূপে ফিল করতে চেষ্টা করি। এবং পারিও আলহামদুলিল্লাহ্‌। যারফলে তাকে ঠিক সেভাবে বোঝাতে পারি, যেভাবে বোঝার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে। যাইহোক, তোমার ভাইজান ফিরে আসার পর পরিবারের সবার প্রতি আমার রাগ-অভিমানও আবার ফিরে এসেছিল। খুব আঘাত দিয়ে মামণিকে কিছু কথা বলেছিলাম একদিন। মামণি আমার ভুল কথার কোন প্রতিবাদ করেনি। শুধু বলেছিল, কারো বাধ্যতা যখন আমাদের জীবনে কল্যাণকর কিছু নিয়ে আসে তখন আমরা খুব খুশি হই। তার প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করি জোর করেছিল বলে। তা না হলে তো এত উত্তম কিছু পেতাম না। এবং সাথে সাথে নিজের সুখ ও আনন্দকে ভরপুর উপভোগও করি। কিন্তু কারো বাধ্যতা যখন আমাদের জীবনের কষ্টের দ্বার খুলে দেয়। তখন সবকিছুর জন্য আমরা সেই মানুষটাকেই দায়ী করি। এটা শুধু মানুষের স্বার্থপর স্বভাবের বহিঃপ্রকাশই নয়। এটা সুস্পষ্ট শিরক। কারণ এরফলে আমরা আমাদের ভাগ্যের ভালো মন্দের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আল্লাহর স্থানে একজন মানুষকে বসিয়ে দেই। কথা শেষ করে মামণি চুপচাপ চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু মামণির এই কথাগুলো আমার মনের সমস্ত রুদ্ধতা উন্মোচন করে দিয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, কতটাই না সঠিক বলেছেন মামণি। 

সেটাই তো ভাবী আমরা আসলেই কারো যারা উপকৃত হলে অত্যন্ত খুশি হই। তখন আল্লাহর সাথে সাথে তাকেও শুকরিয়া জানাই। কিন্তু কারো দ্বারা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে বেশির ভাগ সময়ই শুধু তাকেই দায়ী করি। এটাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত বা পরীক্ষা এটা ভাবতে ব্যর্থ হই।   

হুম, এবং এই স্বভাবের জন্য কাউকে মাফ করাটা আমাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে যায়। জুমানার কথা যদি বলি। বাবার জোর করে বিয়ে দেবার কারণে যদি খুব ভালো একজন জীবনসাথী পেতো তাহলে কি সারাজীবন বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতো না? অবশ্যই থাকতো। কিন্তু যেহেতু বাবার বাধ্যতা জুমানার জীবনে উত্তম কিছু নিয়ে আসেনি তাই বাবাকে ক্ষমা করতে পারছে না। এটাই ওর জন্য আল্লাহর পরীক্ষা সেটা না ভেবে বাবাকে তার দুর্ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক ধরে নিয়েছে। আমরা মানুষেরা এমনই করি বেশির ভাগ সময়। অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে নিজের ঘাটতি গুলোকে ইগনোর করি। আবার হাজবেন্ডের অ্যাফেয়ারের কথা যদি বলি সেখানেও সংসারের তিক্ততাই নিশ্চয়ই দায়ী। যেহেতু জুমানার হাজবেন্ড প্রাক্টিসিং। যদিও আমাদের সমাজে প্রাক্টিসিংয়ের সংজ্ঞাটা যথেষ্টই হাস্যকর। শুধুমাত্র নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাতের মধ্যেই শরীয়ত সীমাবদ্ধ নয়। ছেলেরা মুখে দাড়ি আর টাখনুর উপরে পাজামা পড়লেই, মেয়েরা হিযাব আর নিকাব লাগালেই এখন প্রাক্টিসিংয়ের ট্যাগ লাগিয়ে নিয়ে পারে নিজের উপর। কিন্তু জীবনাচরণে সকল কর্মে যারা আল্লাহ্‌র প্রতি একান্ত নিবেদীত তারাই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে প্রাক্টিসিং। তবে সমাজের তথাকথিত প্রাক্টিসিংরাও খুব সুখের সংসার ফেলে সাধারণত অন্যদিকে নিজেকে ইনভলব করে না। আবার সংসারে অশান্তির পেছনেও একজন দায়ী থাকে না। তাই নিজের ভুলগুলোকে যদি এনালাইসিস করে দেখে তাহলে জুমানার ওর স্বামীকে ক্ষমা করাটাও বেশ সহজ হয়ে যাবে।   

ঠিকআছে আমি তাহলে রাফিয়াকে বুঝিয়ে বলবো এই কথাগুলো।

নূহা হেসে বলল, তুমি বুঝিয়ে বলতে পারার মতো কিছু তো আমি এখনো বলিইনি। আমি তো তোমার সাথে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। তুমি রাফিয়াকে বিকেলে আসতে বলো। আরেকটু ডিটেইল জানি জুমানা সম্পর্কে। এরপর ইনশাআল্লাহ ওর সাথে ফোনে বা স্কাইপে কথা বলে নেবো।

তাসমিয়া হেসে বলল, ওকে মাই সুইট ভাবীজান। আমি এখনি ফোন করছি রাফিয়াকে।

নূহা মগ বাড়িয়ে ধরে হাসি মুখে বলল, তারআগে আমাকে আরেক মগ ভেষজ টি দিয়ে যাও। 

তাসমিয়া হেসে বলল, আমি পুরো ফ্ল্যাক্সই দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে এক্ষুণি।

তাসমিয়া চলে যাবার পর নূহা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বৃষ্টি দেখাতে লাগলো।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন