রুমে ঢুকে তিন পুত্র আর কন্যাকে ব্যাগ গোছানোতে ব্যস্ত দেখে বেশ অবাক হলো জাওয়াদ। তবে সে কোন প্রশ্ন করার আগেই জারিফ হাসি দিয়ে বলল, পাপা আমরা যাচ্ছি।
জাওয়াদ বলল, সেটা তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
জিহাদ হেসে বলল, আমাদের আহ্বান এসেছে পাপা। সেই আহ্বানে সাড়া দিতে যাচ্ছি।
আহ্বান? কিসের আহ্বান?
আসলে নিমন্ত্রণ বলাটাই শ্রেয়। বিজ্ঞের স্টাইলে বললো জিশান।
জাওয়াদ হেসে বলল, কেন দুষ্টুমি করছো তোমরা?
নাবিহা বলল, না না পাপা। আমরা মোটেই দুষ্টুমি করছি না। ঠিকআছে তোমাকে নিমন্ত্রণ পত্র পড়ে শোনাচ্ছি। শোন তাহলে।
হুম, শোনাও তাহলে।
নাবিহা আনন্দিত কন্ঠে বলল, কোথায় রে মোর আলোর কাফেলা? ছুটে আয় নিয়ে সুখানন্দের বেলা! আঁধারের বুকে বসিয়ে দে শুভ্র মেলা! জোনাক জোনাক গুঞ্জরনে কর খেলা! শুষ্ক ডালে ছুঁইয়ে দে রোদের মায়া! বুলিয়ে যা ঝরা পাতায় সজীব ছায়া! খিলখিলিয়ে হাস না তোরা ফুল ফুটিয়ে। হাত বাড়িয়ে যাস রে সাথে আমার নিয়ে! তোদের সাথে উড়বো আমি ডানা মেলে! বলবো কথা যেমন খুশি এলেবেলে! পা ডুবিয়ে বসবো মোরা নীলাভ ঝিলে! ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে নেবো ঘাসের কোলে! চল চলে যাই সবাই মিলে শহর ছেড়ে, আসবো না আর দু'তিনটে দিন ঘরে ফিরে। হাসবো মোরা, গাইবো মোরা ছন্দে ছন্দে, দিগন্ত রেখাকে ছুঁয়ে দেবো ভীষণ আনন্দে!" কি এবার বিশ্বাস হলো তো?
জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। বিশ্বাস তো সবসময়ই আছে আপনাদের উপর। কিন্তু মায়ের নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?
জিহাদ হেসে বলল, আমরা রিহ্যাব সেন্টারে যাচ্ছি পাপা। মা কোন একটা কাজে যাচ্ছে। আমাদের স্কুল তিনদিন বন্ধ তাই আমাদেরকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছে।
তোমাদের বাবাও যাচ্ছে সাথে?
না তুমি আর বাবা দুজনই বাদ। আমাদের সাথে আদীব্বা যাবে, নানাভাই, নানুমণি যাবে। আর জুয়াইরিয়া ফুপ্পি, নায়লা খালামণি, আত্মজা ফুপ্পি আর সুমাইয়া ফুপ্পি যাবে। হাসতে হাসতে বললো জারিফ।
জাওয়াদ হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলো চারজনকেই। আদর করে দিয়ে হাসি মুখে বলল, ঠিকআছে তোমরা ঘুরে এসো। অনেক বেশি করে আনন্দ করো সবাই মিলে। শুধু মাঝে মধ্যে একটু করে মিস করলেই চলবে পাপাকে।
নাবিহা বলল, কক্ষণো না। আমরা মোটেই তোমাকে একটু করে মিস করবো না। আমরা অনেক বেশি বেশি করে তোমাকে মিস করবো পাপা। তিন ভাইও বোনের কন্ঠে কন্ঠ মিলালো।
বুকের মধ্যে এখনই শূন্যতা হাহাকার তুলে গেলেও মুখের হাসি অক্ষুণ্ণ রাখলো জাওয়াদ। আরেকবার সবাইকে আদর করে দিয়ে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো। গাড়ি মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যাবার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। এরপর ঘুরে কটেজের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু বাগানে রায়হান সাহেবকে একাকী বসে থাকতে দেখে কটেজে না গিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। জাওয়াদকে তার দিকেই আসতে দেখে হাসি ফুটে উঠলো রায়হান সাহেবের চেহারাতে। পাপার কাছে পৌঁছে সালাম দিয়ে পাশে বসতে বসতে জাওয়াদ বলল, তুমি একা কেন পাপা? মা কোথায়?
সালামের জবাব দিয়ে রায়হান সাহেব হাসি মুখে বললেন, তোমার মা আমার সাথে রাগ করে বসে আছে গতকাল থেকে। বয়স বাড়লেও কিছু কিছু ব্যাপারে মেয়েরা অবুঝই থেকে যায় বুঝলে!
জাওয়াদ হেসে বলল, জ্বি পাপা এটা আমিও খুব ভালো মতোই বুঝি।
হেসে ফেললেন রায়হান সাহেব। হাসতে হাসতে বললেন, হ্যা, তাই তো! হসপিটালে যাবে না?
সকালটা বাচ্চাদের সাথে কাটাবো ভেবেছিলাম। এরপর ওদেরকে নূহার বাসায় পোঁছে দিয়ে হসপিটালে যাবার ইচ্ছে ছিল। আপাতত তাই আরো কিছুটা সময় থাকছি বাড়িতেই। তোমার শরীর আজ কেমন?
আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। তোমাকে পেয়ে যাওয়াতে ভালোই হলো। তোমার মা’র রাগ কিভাবে ভাঙানো যায় সেই ব্যাপারে একটা বুদ্ধি দাও। নূহা মার কাছেই বুদ্ধি চাইতাম। কিন্তু সকাল থেকে এক মূহুর্তের জন্যও একা পাইনি মেয়েটাকে।
জাওয়াদ হেসে বলল, কিন্তু বুদ্ধি তো দেয়া যাবে না। তুমিই একদিন আমাকে
বলেছিলে, ভালোবাসায় কখনোই
বুদ্ধির প্রয়োগ করতে
নেই। কারণ ভালোবাসা
এমনই এক মূক, বধির ও অন্ধ
অনুভূতি, যে কিনা
ভালোবাসা ছাড়া আর কোন আবেগই দেখে
না, শোনা না, অনুভব করতে পারে
না। ভালোবাসা শুধুমাত্র ভালোবাসার ভাষা
বোঝে। ভালোবাসাকে তাই একমাত্র ভালোবাসা দিয়েই
জয় করা সম্ভব।
রায়হান সাহেব হেসে বললেন, সেই কত ছোটবেলায় বলেছিলাম তোমাকে এই কথাটা। অথচ এখনো তুমি হুবহু মনে রেখেছো?
আলহামদুলিল্লাহ। আমি মন স্বর্বস্ব মানুষ পাপা।
তাই হয়তো বুঝতে
শেখার পর থেকে
যা কিছুই আমার
মনকে স্পর্শ করেছে,
এখনো পর্যন্ত আঁকড়ে
ধরে রেখেছি। সেটা
ছোট্ট কোন একটা
কথা হোক, কিংবা
সম্পূর্ণ একজন মানুষ।
যাইহোক, চলো লাভ টিপস খুঁজে বের করি মাকে পটানোর
জন্য।
হ্যা এই মূহুর্তে এটাই সবচেয়ে জরুরি। কি করা যায় বলতো?
কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে জাওয়াদ হেসে বলল, এক কাজ করো পাপা ফুল বাগানে চলে যাও। মা’র পছন্দের একগুচ্ছ কার্নেশান তোলো। তারপর মা’র কাছে গিয়ে ফুলগুচ্ছ বাড়িয়ে ধরে বলো, “তুমি আমার কে জানতে চাও? বলবো না আজ, বুঝে নাও! নাকি শুনবে আমার স্বপ্নগাঁথা? কি রূপে এঁকেছি তোমায় সেই কথা? তুমি...আমার জোছনা ঝরা রাত, আমার শুভ্র আলোর প্রভাত! আমার সূর্য পেখম মেলা, আমার অলস দুপুর বেলা! আমার মন বাগিচার ফুল, আমার শুদ্ধতম ভুল! আমার আঁকড়ে ধরা নীড়, আমার জল থই থই তীর! আমার উচ্ছ্বাসিত হাসি। আমার আনন্দ রাশি রাশি! আমার কাব্য রাঙা মন, তোমাতেই আমার স্বপ্নীল ভুবন!” চুপ করে আছো কেন পাপা? ভালো লাগেনি?
ভেতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেও কন্ঠের সিক্ততা আড়াল করতে পারলেন না রায়হান সাহেব। ধীরে ধীরে বললেন, যতবারই তোমার ভেতরের ভালোবাসাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি, স্তব্ধ হয়ে যাই জাওয়াদ।
জাওয়াদ হেসে বলল, আচ্ছা তাহলে এই কবিতা বাদ। তারচেয়ে বরং মাকে বলো, তোমার কাছে আকাশ জোড়া রঙধনু চাই না! বরষার প্রথম কদম চাই না! শরতের দোলায়িত কাশফুল চাই না! বসন্তের ফুলেল বাহার চাই না! আমাকে ক্ষমা করো সেটাও চাই না। শুধু চাই কখনোই অভিমানের মেঘে ঢেকে যাবে না। কোন না কোন উপায়ে খুঁজে নেবে সর্বদা হাসির বাহানা।
রায়হান সাহেব হেসে
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। জাওয়াদও
হেসে বলল, এখানে
একাকী বসে থেকো
না পাপা। মা’র কাছে যাও।
ভালোবাসার সুযোগ থাকলে
জীবনের একটি মূহুর্তকেও ভালোবাসাহীন কাটানো ঠিক নয়।
কিন্তু আমি চলে গেলে তুমিও তো একা হয়ে যাবে? তোমাকে সঙ্গ দেবার জন্য তো এখন তোমার সন্তানরাও কাছে নেই।
জাওয়াদ হেসে বলল, এই জগতে শত মানুষের ভিড়েও প্রতিটি
মানুষই জীবনের কোন না কোন ক্ষুদ্রতম অংশে একদম
একা। একাকীত্বকে তাই ভয় পাই না পাপা। তবে হ্যা
খুব বেশি ভয় পাই এমন চিন্তাকেও যে, কেউ পাশে থাকবে কিন্তু
তারপরও আমার মন জুড়ে বিরাজ করবে
নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব। এবং কোন বান্দার হক আদায় করতে না পারার দায় আমি নিজের উপর চাপাতে
চাই না। একই সাথে নিজের হকের
ব্যাপারেও আমি সচেতন।
আলহামদুলিল্লাহ সবকিছু মিলিয়ে
আমি খুব ভালো
আছি পাপা। টাস্ট
মি।
রায়হান সাহেব হাসি মুখে বললেন, আই টাস্ট ইউ জাওয়াদ। সেজন্যই তো কখনোই কিছু বলিনা তোমাকে। কারণ তুমি যে ভালো আছো সেটা অনুভব করতে পারি। জগতে কিছু মানুষ আছে যারা অন্যদেরকে ভালোবেসেই তৃপ্ত থাকে। তারা ভালোবাসতে ভালোবাসে। তাই কারো কাছে তাদের কোন চাওয়া-পাওয়া থাকে না। তুমি তেমন একজন মানুষ। আলহামদুলিল্লাহ তোমার মতো সন্তানের পিতা হতে পেরে আমি গর্বিত।
জাওয়াদ হেসে বলল, কামঅন পাপা। থাক না এসব কথা। ঐ দেখো মা আসছে। তুমি আরেকটু আগে চলে গেলেই আমার দেয়া টিপস গুলো ব্যর্থ হতো না। তবে এখনো সুযোগ আছে প্রয়োগের। কথা বলো তোমরা দুজন। আমি যাচ্ছি। পাপাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জাওয়াদ উঠে হাঁটতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর খাদিজা বেগম এসে রায়হান সাহেবের পাশে বসে বললেন, জাওয়াদ চলে গেলো কেন?
রায়হান সাহেব হাসি মুখে বললেন, তোমাকে আর আমাকে গল্প করার সুযোগ দিয়ে গেলো। অবশ্য তোমাকে বলার জন্য কবিতাও শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে। শুনবে?
বাচ্চারা বাড়িতে নেই সেজন্য কি মন খারাপ? কি বললো তোমাকে এতক্ষণ ধরে?
তেমন কিছু না। এমনিতেই গল্প করছিলাম পিতা-পুত্র মিলে। নূহার প্রসঙ্গ উঠতেই সবসময়ের মতো এড়িয়ে গেলো। জাওয়াদকে আর বিয়ের কথা বলো না খাদিজা। জাওয়াদ ওর বাচ্চাদেরকে নিয়েই ভালো আছে, আনন্দে আছে। নূহার উপর জোর করার পরিণতি তো ভোগ করছিই আমরা। আরেক সন্তানকে জোর করে সুখী করতে গিয়ে আরো দুঃখী নাহয় নাইবা করলাম।
আমরা জোর করতে
চাইলেও পারবো না। জাওয়াদ কখনোই সেই সুযোগ আমাদেরকে দেবে
না। জাওয়াদ এত সহজ পাত্র নয়।
রায়হান সাহেব খাদিজা
বেগমের হাত নিজের
হাতের ভেতর টেনে
নিয়ে হাসি মুখে
বললেন, আলহামদুলিল্লাহ আমি সত্যিই খুব গর্বিত জাওয়াদের মতো ছেলের পিতা হতে পারার জন্য। জাওয়াদের
ভেতরের ভালোবাসার ক্ষমতা
সম্পুর্ণ রূপে আল্লাহ
প্রদত্ত জানি। কিন্তু
তবুও বার বার মুগ্ধ, বিস্মিত হই ওর ভালোবাসার ক্ষমতা
দেখে। জীবন-মৃত্যুর
মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থায়ও
নূহাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে জাওয়াদের অটল থাকা, বিয়ের পর রাত-দিন সেবা,
শুশ্রূষা দিয়ে একটু
একটু করে নূহাকে
সুস্থ করে তোলা।
সর্বাবস্থায় নূহার মনোবল
ধরে রাখতে সহায়তা
করা। আবারো ওকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে
ফিরিয়ে আনা। আমি কেন জানি না ভুলতে পারিনা সেই দিনগুলোর কথা। যখনই
সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে নতুন
করে আরেকবার উপলব্ধি
করতে পারি নূহার
প্রতি জাওয়াদের ভালোবাসার মাত্রা। কোন কিছু পাওয়ার আশা তো কোনদিনও ছিল না জাওয়াদের ভালোবাসাতে। নূহাকে ভালোবাসা,
ওর প্রতি খেয়াল
রাখা জাওয়াদ ওর জীবনের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্তঃর্ভূক্ত করে নিয়েছিল। আর নিজ দায়িত্ব পালনে
আমাদের ছেলে তো সেই ছোটবেলা থেকেই
সদা জাগ্রত অতন্দ্র
প্রহরীর মতো। আমার
তো মনে পড়ে না কোনদিন জাওয়াদ
ওর ছোট্ট কোন একটা দায়িত্ব পালনেও
অবহেলা করেছে।
স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে খাদিজা বেগম বললেন, আমারো মনে পড়ে না। জাওয়াদ সবসময় নিজের করণীয়র ব্যাপারে সতর্ক। আমিও এখন আর বিয়ের কথা বলি না জাওয়াদকে। নিজের অবস্থানের মধ্যে থেকেই সুখ খুঁজে নিয়ে সুখী হবার চেষ্টা করার শিক্ষা তো আমরাই দিয়েছি সন্তানদেরকে। ওরা তো সেই শিক্ষাই মেনে চলছে। সুখকে নির্দিষ্ট কোন চাওয়া-পাওয়ার মোহতাজ না করে, সময়ের প্রতিটি মূহুর্তকে খুশি মনে আপন করে নেয়ার মাঝেই সুখ খুঁজে নিচ্ছে। নিজেরা যেমন ভালো থাকার চেষ্টা করছে, অন্যদেরকেও ভালো রাখার চেষ্টা করছে।
রায়হান সাহেব হেসে বলল, হ্যা ঠিক বলেছো। জাওয়াদের একটা কথা আমার খুব ভালো লেগেছিল। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, সন্ধান করলে সুখের দেখা কখনোই মিলবে না পাপা। কারণ সুখ তো কোন বস্তু নয়। সুখ একটা অনুভূতি। অনুভবে জুড়েই এর বাস। চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করো। দেখবে মন বাঁধা পড়বেই সুখের শৃঙ্খলে।
খাদিজা বেগম হেসে বলল, ছেলেটা এত ভাবুক কথা কোত্থেকে শিখেছে বলো তো? তুমি আর আমি তো এত রোম্যান্টিক ছিলাম না কখনোই।
রায়হান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, জাওয়াদও তো এমন ছিল না। মনে নেই প্রচন্ড রকম রাগী ছিল জাওয়াদ। বাড়ির প্রতিটা মানুষ ওকে ভয় করে চলতো। এমনকি আমরা পর্যন্ত হিসাব করে কথা বলতাম ওর সাথে। অবশ্য এত বড় একটা পরিবারের দায়িত্ব যার কাঁধের উপর থাকে। কঠোর না হয়ে তার উপায়ও থাকে না।
সেটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু তোমার ছেলে একটু বেশিই রাগী ছিল আগে। কথার স্টাইলও ভীষণ কাঠখোট্টা ছিল। সঠিক পথে তো ওকে নূহা এনেছিল। নূহার জেদ জাওয়াদকে হারতে শিখিয়েছিল ভালোবাসার কাছে, স্নেহের কাছে। জাওয়াদের মনের কঠোরতাতে নূহা দু’হাতে চেপে চেপে কোমলতা ভরে দিয়েছিল। এখন যখন পেছনের দিকে তাকাই বুঝতে পারি এসব। পরিবারের প্রতি জাওয়াদের আকুল করা ভালোবাসাতে আমি নূহার প্রতিচ্ছবিই খুঁজে পাই বার বার। কারণ পরিবারকে সবকিছুর উর্দ্ধে ভালোবাসতে নূহার কাছ থেকে শিখেছে জাওয়াদ। এই একটা জিনিস আমরা জাওয়াদকে শেখাইনি। না নূহাকে শিখিয়েছি। মানুষকে অকাতরে ভালোবাসার ক্ষমতা নূহার স্বভাবজাত। যেই ভালোবাসা যথাযথ প্রয়োগ ও ছড়িয়ে দেবার ক্ষমতাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নূহাকে দিয়ে দিয়েছেন। খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে জাওয়াদ, আদী, ফায়েজ, রিসাব, হুমায়ূন, সুবহা, রাহাত এমন কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া নূহার কাছাকাছি থাকা মানুষগুলো সব অকর্মণ্য টাইপের। ওরা কিছুই করতে পারে না ঠিকমতো। শুধু ভালোবাসাতে পারে অকাতরে।
আলহামদুলিল্লাহ! এখন অকাতরে ভালোবাসতে পারে এমন মানুষই দরকার খাদিজা। ভালোবাসাকে এখন দুর্বলতা মনে করা হয়। তাই জগতকে ভালোবাসার ক্ষমতা দেখানোর মতো কিছু মানুষ দরকার। মনে আছে বেশ কয়েকমাস আগে একদিন ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছিল পুরো এলাকার কোন একটা সমস্যার কারণে। লাইটার দিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে পরে সেই মোমবাতিটি দিয়েই একটি একটি করে মোমবাতি জ্বালিয়ে সবার হাতে হাতে দিয়ে দিচ্ছিলে তুমি। মোমবাতি পেয়ে বাচ্চাদের আনন্দ দেখছিলাম এক পাশে চুপ করে বসে। জাওয়াদ পাশে বসা আদীকে প্রশ্ন করেছিল, একটা ব্যাপার নোটিশ করেছিস? আদী জবাবে বলল, বাচ্চারা অনেক মজা পাচ্ছে এটা? জাওয়াদ হেসে জবাব দিয়েছিল, উহু। দেখ মা কেমন একটি মোমবাতির আলো দিয়েই বাকি মোমবাতিগুলোকে আলোকিত করে দিচ্ছেন। অথচ এতে মা’র হাতে থাকা মোমবাতিটার আলো একটুকুও ম্লান হচ্ছে না! আমাদের প্রতিটা গুণও আসলে এক একটি মোমবাতির মতই। একটি গুণ মানে এক টুকরো আলো। যে আলো নিজেকে আলোকিত করার পরও অন্যেকে আলোকিত করতে সক্ষম। তাই সুন্দর গুণাবলী নিজের মধ্যে ধারণ করার পর সেটা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। নিজের আলোতে অন্যেকে আলোকিত করলে নিজের আলো কিন্তু কমে যায় না। বরং আশপাশটাও আলোকিত হয়ে উঠতে পারে এমনটা করলে। এতে নিজের চলার পথটাও আলোকিত হয়।’ ঠিক তেমনি কিছু মানুষের অপপ্রয়োগের ফলে ভালোবাসার ক্ষমতা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। এখনই সময় ভালোবাসার সঠিক প্রয়োগে বিরাজমান আঁধারের বুকে দিয়া জ্বালাবার। আলহামদুলিল্লাহ আমরা অনেক সৌভাগ্যবান। কারণ আমাদের সন্তানরা নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী এই কাজটি করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
খাদিজা বেগম হাসি মুখে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। এক কাজ করি চলো আমরাও রিহ্যাব সেন্টারে চলে যাই। দু’তিনটা দিন বেরিয়ে আসি।
গাড়িতে ওঠার আগেও সুরাইয়া, নুসরাত, নূহা কতবার করে বললো তোমাকে। কিন্তু রাজী হলে না যেতে। সাড়ে তিনশো কিলোমিটার ড্রাইভ করে এখন কে নিয়ে যাবে আমাদেরকে?
তখন ইচ্ছে হয়নি। এখন ইচ্ছে হচ্ছে। তুমি যাও তোমার বড় ছেলেকে বলো আমাদেরকে যেন পৌঁছে দিয়ে আসে। আমি প্যাকিং করতে গেলাম। কথা শেষ করেই খাদিজা বেগম উঠে হাঁটতে শুরু করলেন। রায়হান সাহেবও উঠে জাওয়াদের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন