সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমাদের আনন্দবাড়ি...৩৩



ক্লাস শেষে নোটের দিকে তাকিয়ে ভীষণ বিরক্ত হলো নূহা। দুই সপ্তাহের জন্য ইন্সটিটিউট এবং হাসপাতাল থেকে ছুটি নিলেও আরবি ভাষা শেখার কোর্সে সপ্তাহে দুইদিন নিয়মিতই ক্লাস করতে আসছে। কিন্তু আজ কিছুই নোট করা হয়নি ঠিকমতো। নূহার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কেউ যদি বলে, তোমাকে খুব জরুরি কিছু কথা বলতে চাই কিন্তু এখন না পরে বলবো। পরে বলবো বলে ব্যক্তি তো নিশ্চিন্ত মনে চলে যায় কিন্তু নূহার মনে একের পর প্রশ্ন হানা দিতে থাকে। কি বলবে? কি হয়েছে? কোন সিরিয়াস সমস্যা বা বিপদে নয় তো? প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করবে পারবে তো? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন চলতেই থাকে মাথার মধ্যে। নিজের ব্যাপারে খুব একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগার স্বভাব নেই নূহার। কিন্তু অন্যের সমস্যা খুব ভোগায়। ক্লাস থেকে বেড়িয়ে সমস্ত মনোযোগের কেড়ে নেয়া সেই আসামীর খোঁজে চারপাশে তাকালো নূহা। বেশ খানিকটা দূরে লুবনাকে দেখতে পেয়ে হাঁটতে শুরু করলো নূহা। আরবি শেখার ক্লাসে যেদিন জয়েন করেছিল সেদিনই পরিচয় হয়েছিল লুবনার সাথে। দু’মাসেই বেশ চমৎকার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে দুজনের। লুবনার কাছে পৌছে নূহা বলল, আজ তোমার কারণে আমার ক্লাসের বারোটা বেজেছে। আচ্ছা যদি পরেই বলবে তাহলে আগে জানানোর দরকারটা কি যে কথা আছে? আমি বুঝি না মানুষ কেন অকারণে মানুষকে টেনশন দেয়। এখন আবার চুপ করে আছো কেন? কথা বলতে বলতে লুবনার  চেহারার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো নূহা। মেঘে মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশের মত থমথম করছে চেহারা। কাঁধে হাত রেখে মায়া জড়ানো কণ্ঠে বলল, কি হয়েছে লুবনা এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?         

কিছুক্ষণ নীরব থেকে মৃদু কন্ঠে লুবনা বলল, বাসায় আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।  

নূহা হেসে, আলহামদুলিল্লাহ। আরে এটা তো সুখবর। কিন্তু তুমি এমন দুঃখী দুঃখী চেহারা করে রেখেছো কেন? এখন বিয়ে করতে চাইছো না?

বিয়ে করতে চাইছি না তা নয়। কিন্তু বিয়ের কথা ভেবে খুব শঙ্কিত বোধ করছি। তোমাকে তো বলেছিই আমাদের পরিবার শরীয়তের বিধি-নিষেধ খুব একটা মেনে চলে না। আমিও অনেকটা তেমনই ছিলাম। যখন কলেজে পড়তাম, ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম অনেক ভালো ভালো বিয়ের প্রপোজাল এসেছে। কিন্তু তখন ভাবতাম আগে পড়াশোনা শেষ করবো, চাকরী করবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো এরপর বিয়ে করবো। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিকল্পনা হয়তো অন্যরকম ছিলো। আমার মনের অন্ধকারাচ্ছন্নতা দূর করার জন্য ইসলামকে জানা ও বোঝা সহজ করে দিয়েছিলেন আমার জন্য। ভুল পথ থেকে আমি সরে এসেছিলাম সত্য ও সুন্দরের পথের সন্ধান পাবার পর। আমার ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া এখন আগের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত। দুনিয়াবী কোন চাওয়া নেই এখন আমার। আমি শুধু একজন প্রকৃত ঈমানদার জীবনসাথী চাই। যাতে তার হাত ধরে দ্বীনের পথে চলাটা আরো সহজ হয়ে যায় আমার জন্য। কিন্তু আব্বু-আম্মুদের চাওয়া মোটেই এমন নয়। তাই উনারা দ্বীনদার পাত্রের চেয়ে দুনিয়াদার পাত্রই খুঁজে নিয়ে আসেন বার বার। কিন্তু আমি কিছুতেই ভুল আকিদার কাউকে বিয়ে করতে চাই না।  
নূহা বলল, চলো সামনের পার্কে গিয়ে বসে কথা বলি। পার্কে এসে বসার পর নূহা বলল, তুমি আগে থেকেই এত সব নেতিবাচক কথা কেন ভাবছো বলো তো? আমাদের চিন্তা করা বেশির ভাগ নেতিবাচক চিন্তাই কিন্তু বাস্তবতায় রূপ নেয় না।  

কিন্তু আমি যা ভাবছি তাই ঘটবে। কারণ আমি আমার পরিবারকে জানি। আমি আসলে আমার নতুন জীবনের শুরুর সবকিছু সুন্নাহ অনুযায়ী করতে চাই। আর এমন কাউকে চাই না জীবনসাথী হিসেবে যার কারণে আমার ঈমান হুমকির মুখে পড়তে পারে। এখন আমি কি করবো তুমিই বলো।    

আমি কি পরামর্শ দেবো বুঝতে পারছি না। আমার বাবা সবসময় বলেন যে, ভবিষ্যতের চিন্তা যদি কখনো মনে ঝড় তোলে তাহলে সম্ভাব্য সবকিছুর জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে ধীরে ধীরে। যাতে আঘাত যেদিক দিয়েই আসুক না কেন সময়মত নিজেকে সামলে নেয়া যায়। কিন্তু কখনোই দুশ্চিন্তা করা ঠিক না। কারণ দুশ্চিন্তা মানুষকে দুর্বল করে দেয় খুব বেশি। যার ফলে সবকিছু অনেক বেশি জটিল লাগে। তাছাড়া আমরা যেভাবে চিন্তা করবো সবকিছুকে সেভাবেই সামনে দেখতে পাবো।

আমার সমস্যার কথা বলে আমি কি তোমার মন খারাপ করে দিলাম?    

নূহা হেসে বলল, আমি খুব প্র্যাক্টিকাল মেয়ে লুবনা। তাছাড়া জীবনের এত রঙ দেখেছি যে এখন  আর কোন কিছুকে ঘিরেই ভয় কাজ করে না মনে। দুশ্চিন্তাও প্রভাব ফেলতে পারে না খুব একটা। মনেহয় যে যাই কিছু হোক না কেন, ইনশাআল্লাহ আমি মেনে নিতে পারবো। আর বইতে পারবো না এমন কোন বোঝা তো আল্লাহ আমার উপর চাপাবেন না, একথা তো আল্লাহ বলেই দিয়েছেন। 

আলহামদুলিল্লাহ্‌! এই কথাটা আমিও বিশ্বাস করি। আমিও পারি সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করতে কিন্তু এই ব্যাপারটাতে কেন জানিনা মনে খুব ভয় কাজ করে। নূহা আমি এমন কাউকে জীবনসাথী হিসেবে চাই না যার সাথে আমার আইডোলজি মিলবে না।  

তুমি এইসব নেগেটিভ চিন্তা বাদ দাও তো। ভাবতে চেষ্টা করো যে ইনশাআল্লাহ এমন কিছুই হবে না।  

আর যদি হয়? 

তাহলে সেটাই হবে তোমার জন্য পরীক্ষা। আর আল্লাহ যেহেতু কাউকে সাধ্যের অধিক বোঝা চাপান না, সেহেতু আমাদের প্রস্তুতি থাকা উচিত যে পরীক্ষাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ‘স্বাগতম’ তাকে, আলহামদুলিল্লাহ্‌। এখন এই মন খারাপ করা ভাবটা ছাড়ো তো। তোমার এই অবস্থা দেখে তো আমার ক্ষুধা লেগে গিয়েছে।    

আমি আছি মহা যন্ত্রণায়। এর সাথে ক্ষুধা লাগার কি সম্পর্ক? 

আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার কি জানো?

কি?

দুশ্চিন্তা, হতাশা আর নেতিবাচক চিন্তা। আমি যখনই আশেপাশের কারো মধ্যে এসব জিনিস দেখি প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করি। আর কচকচ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে এসব।   

লুবনা হেসে বলল,  তোমার মাথায় সবসময় এতো দুষ্টু কথা আসে কিভাবে বুঝি না। কিন্তু আমি কিছুতেই আমার মন থেকে এই ভাবনাটা দূর করতে পারছি না। সঠিক ইসলাম মানতে চাইলে আমাকে আমার বাবা-মা আর পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কি মনেহয় জানো? ম্যাজিকাল কিছু ঘটতো আর আমার পরিবারের সবাই সঠিক সুন্নাহর অনুসারী হয়ে যেত। আমি রাতদিন আল্লাহর কাছে এখন এই দোয়াই করছি। জানিনা আমার দুয়া কবুল হবে কিনা। মিলাদ, মাজার এইসব বিদয়াত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে কিনা আমার পরিবার।   

কবে যে মানুষ নিজের ভালো বুঝতে শিখবে আল্লাহই জানেন। অবশ্য সবাই তো বুঝবে না আর এটাই স্বাভাবিক। কথা প্রসঙ্গে একদিন ভাইয়া বলেছিলেন, একজন নাস্তিক বা অমুসলিম ইসলামের যতটুকু না ক্ষতি করতে পারে, তারচাইতে অনেক অনেক গুণ বেশি ক্ষতি করতে পারে একজন নির্বোধ, অজ্ঞ আস্তিক বা মুসলিম। একজন মুসলিমের অন্ধবিশ্বাসের ফলে অনেকেই ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যেতে পারে।  

হুম! আর ব্যতিক্রম কোন কাজ করতে গেলে সবচেয়ে বেশি বাঁধা আসে পরিবারের কাছ থেকেই। কেন যেন কাছে মানুষগুলো প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সামনে। তারা বেঠিক বা ভুল হতে পারেন এই কথাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না।

তুমি তো সবই বোঝো লুবনা। তোমাকে তাই ধৈর্য্যের সাথে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে।তাছাড়া ইসলামের সঠিক জ্ঞান, পবিত্র আলো-উদারতা-দীক্ষা পরিবারের মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্য সহনশীলতা বাড়াতেই হবে তোমাকে। পরীক্ষা হিসেবে দেখ ব্যাপারটাকে দেখবে অনেক শক্তি পাবে আর আল্লাহর সাহায্যেও ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া পরিবারের হকও তো আছে তোমার উপর। তুমি যেহেতু সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছো, এখন পরিবারকে সেই পথের দিশা দেখানো তোমার দায়িত্ব। 

আমি পারবো তো নূহা?    

ইনশাআল্লাহ! অবশ্যই পারবে। তুমি শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রেখে চেষ্টা করে যাও সবকিছু একদিন ঠিক হয়ে যাবে এই আশাটা মনে ধরে রেখে। আর বিশ্বাস রাখো যে যা ঘটবে তার মধ্যেই নিহিত থাকবে তোমার কল্যাণ।     

ভরসা দিচ্ছো? 

নূহা হেসে বলল, উহু আশা জাগাচ্ছি। আমি সবসময় সর্বাবস্থায় আশার সাথে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে রাখার দলের মানুষ। তাছাড়া আমি মনেকরি অনেক সময় আমাদের ভালো কাজের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতেই পারে আপনজনেরা। কিন্তু তাই বলে আমরা তো তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারিনা। আবার তাদেরকে ছেড়েও দিতে পারিনা। কারণ ইসলাম আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় না।    

ইনশাআল্লাহ! আমিও এখন থেকে এভাবে চিন্তা করবো। সব দুশ্চিন্তা এই মুহুর্তে ঝেড়ে ফেললাম। আশার সাথে বাঁধলাম মন, যা হবে দেখা যাবে। কিন্তু আরেকটা সমস্যাও খুব ফেস করছি শরীয়ত ভিত্তিক জীবন যাপন শুরু করার পর। মাহরাম-নন মাহরাম একদমই মেনে চলে না পরিবারের কেউ। আমি মেনে চলতে চেষ্টা করছি কিন্তু সাহায্য করা তো দূরে থাক উল্টো বাঁধাগ্রস্ত করছে সবাই। আমার কি মনেহয় জানো? এটা আসলে যারা শরীয়তের বিধি নিষেধ মেনে চলে না তাদের এক ধরণের হীনমন্যতা। তারা বোঝে যে পথে চলছে সেটা সঠিক না। কিন্তু নিজেদেরকে আবার সেই পথ থেকে ফিরিয়েও আনতে পারে না। তাই অন্যদের সঠিক পথে চলাটা সহ্য করতে পারে না।  

নূহা হেসে বলল, আমার ধারণাটাও অনেকটা এমনই। কিছু অভিজ্ঞতা থেকে আমারো মনে হয়েছে নিজেরা শরীয়তের বিধান মেনে চলে না বলেই যখন অন্যদেরকে মেনে চলতে দেখে একটু হলে নাড়া দিয়ে ওঠে বিবেক। বিবেকের সেই নাড়াকে থামিয়ে দেবার জন্যই অন্যদের উপর জোর খাঁটিয়ে তাদেরকেও ভুল পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করে। নানান ধরণের যুক্তি দেয়। যেমন, পরিবারের মধ্যে আবার কিসের পর্দা, সবাই তো আপনজন, তুমি কি পরিবারের সদস্যদেরকেও সন্দেহের চোখে দেখো, তোমার মনেই যত সমস্যা, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, নিকাব করে চলা মেয়েরাই বেশি খারাপ, মনের পর্দাই বড় পর্দা আরো নানান ধরণের কথা বলে ইমোশনালি অ্যাবিউজ করার চেষ্টা করে।

হুম, এসব কথা তো প্রতিনিয়তই শুনতে হয়। সেজন্যও ভয় হয় যদি শ্বশুরবাড়িতে যদি দ্বীনি পরিবেশ না থাকে তাহলে তো আবারো সেই একই ভোগান্তির স্বীকার হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে করণীয় কি নূহা?

খুব বেশি ধৈর্য্যশীল হতে হবে এইসব কিছুর মোকাবিলা। কখনোই রাগ না করে বরং সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হবে তুমি যেভাবে চলছো এটা মোটেই তোমার নিজের নির্ধারিত কিছু নয়। আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন আমাদের জন্য এই বিধান। পর্দার ব্যাপারে কারো কোন কথাকে প্রশয় দেবে না। কিছুদিন যখন দেখবে শত কিছু বলার পরেও তুমি নীতির ব্যাপারে অবিচল, দৃঢ়। তখন আর তোমাকে ঘাঁটতে আসবে না। হ্যা, এরপরেও হয়তো মাঝে মাঝে খোঁচা দেবে। ঐটুকু তো সহ্য করতেই হবে।   

কিন্তু আমার যে চট করে রাগ হয়ে যায়! তখন উল্টা পাল্টা অনেক কথা বলে ফেলি। পরে বুঝলেও ঘটনা যা ঘটার তা তো ঘটেই যায়। এই স্বভাব কিভাবে চেঞ্জ করবো বলো?

নূহা হেসে বলল, বলা হয় যে “কৃতজ্ঞতাবোধ যেমন সকল সৎ গুনের জননী, জ্ঞানার্জন তেমনি বিনয়ের জননী”। জ্ঞানার্জনের ফলে ভাবনার পরিধি বাড়ে। মানুষ ভালো-মন্দ যেমন অনুধাবন করতে পারে। তেমনি করণীয় ও বর্জনীয় নির্ধারণ করতে পারে। যারফলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হাসিল করতে পারে। তাই বেশি বেশি জ্ঞানার্জন করা শুরু করো। কুরআন পড়ো তাফসীর সহ, হাদীস পড়ো নিয়মিত, সীরাত, সলফে সালেহীনদের জীবনী পড়ো। দেখবো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ যেমন বৃদ্ধি পাবে। তেমনি তোমার চিন্তা-চেতনাও আরো পরিশোধিত হবে। মূলত জ্ঞানও আমাদেরকে বিনয়ী, নম্র ও ভদ্র হতে শেখায়। বিনয় ও নম্রতা দ্বারা মানুষ পরম শত্রুকেও বন্ধুতে পরিণত করতে পারে। জীবনে তাই বিনয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

কিন্তু বিনয়কে তো আবার চারিত্রিক দুর্বলতা হিসেবে ধরা হয়। দেখা যাবে আমি কারো অসম্মানজনক কাজকে সম্মানের সাথে মোকাবিলা করছি কিংবা কারো আঘাতের বদলে আঘাত করছি না। যারফলে আমার এই নম্রতাকেই আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। কম অভিজ্ঞতা তো আর অর্জিত হয়নি। এখন তাই নিজের জন্য দৃঢ়তাই পছন্দ করি।   

নূহা হেসে বলল, জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদেরকে বিনয়ী আচরণ করতে হবে। কিন্তু বিনয়ী হওয়া মানে এমনটা নয় যে, কারো ভুল কথা, কাজ ও আচরণ নিশ্চুপে মেনে নেয়া। কারো অন্যায়ের সাথে সম্মতি পোষণ করা। আমাদের জীবনকে সুখী ও সুন্দরের পথে পরিচালিত করার জন্য, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য বিনয় ও নম্র ব্যবহার যেমন অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক তেমনি সকল ভ্রান্ত ধারণা, অন্যায় কাজ ও অসত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ়তাও সমান  প্রয়োজন।

তারমানে চরিত্রে নম্রতা ও দৃঢ়তার সহবস্থান ও সংমিশ্রণ প্রয়োজন?    

হুম! আসলে এই বিষয়গুলো একদম ছোটবেলা থেকে শেখানো উচিত। বাবা-মায়েদের উচিত বুঝতে শেখার পরই সন্তানদেরকে জীবনের ছোট ছোট কিন্তু মৌলিক শিক্ষাগুলো দেয়া। কেন সত্য বলতে হবে, কেন মিথ্যা পরিহার করে চলতে হবে, কেন অন্যের সাথে অন্যায় করবে না, কেন অন্যের ভুল কথা ও কাজের প্রতিবাদ করবে। মোট কথা দুনিয়াতে কেন এসেছি, দুনিয়া থেকে ফিরে যাবার সময় আমাদের পাথেয় কি হবে? জীবন গল্পের কোন এক অধ্যায়ের প্রতিটা মূহুর্ত পরীক্ষা হতে পারে কারো কারো জন্য। সম্পর্কের বন্ধনগুলো চলার পথে ভাঙা সাঁকো হতে পারে, গর্ত হতে পারে, চোরাবালি হতে পারে, হতে পারে গোলকধাঁধাও। এসব থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় কি? কেন পড়বো কুরআন, কেন জানবো রাসূলের জীবনী, সাহাবাদের আত্মত্যাগে লুকায়িত আছে কত শিক্ষা! ভুলে ভরা আমাদের এই সমাজের জন্য দায়ী ভুলে ভরা প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি মানুষ। জানো ছোটবেলায় পড়তে, জানতে এবং এত কিছু বুঝতে গিয়ে অতিষ্ট হয়ে যেতাম আমার। কিন্তু বাবা-ভাইয়াদের শেখানো মোটে শেষই হতো না। আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে বাবা একদিন হাসি মুখে বলেছিলেন,  তোমরা অনেক বিরক্ত হও তাই না এত লেকচার দেই বলে? আসলে কি জানো সবাই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে তাই আমি জীবনের ছোট ছোট শিক্ষাগুলো তোমাদেরকে দিয়ে যেতে চাই। পিতা হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। আমি চাই চারপাশের মানুষের মধ্যে যখন নেতিবাচক আচরণকেই অধিক শক্তিশালী রুপে দেখবে। তখন তাদের প্রতি রাগ বা ঘৃণার চাইতে যেন তোমাদের মনে দয়া আর ভালোবাসাই বেশি কাজ করে। কারন জীবনের মৌলিক কিন্তু খুব ছোট ছোট শিক্ষাগুলো যদি পেতো তাহলে এই মানুষগুলো কখনোই এমন হতোনা। আমি বিশ্বাস করি যে মানুষ আসলে জন্ম থেকে খারাপ হয় না। তার পরিবেশ, পরিস্থিতি, অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর অজ্ঞতা তাদের উপর খারাপের মোহর লাগিয়ে দেয়। তোমরা যাতে পরিবেশের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে পারো সেজন্যই জীবনে আসা প্রতি মূহুর্তকে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেই প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি শরীয়তের আলোকে।    

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লুবনা বলল, আসলেই পারিবারিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। তা না হলে সঠিক পথে চলাটা কঠিন হয়ে যায়।

কিন্তু আবার এটাও ঠিক যে অনেকেই নিজ ইচ্ছে, চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা পারিবারিক শিক্ষার ঘাটতি দূর করতে সক্ষম হয়। আমাদের বাবা-চাচ্চুরাই তো এর উজ্জ্বল প্রমাণ। উনাদেরকে উনাদের পরিবারের অন্যায়-ভুল ইত্যাদিই প্রেরণা যুগিয়েছিল সুন্দরের পথে চলার, আলোর সন্ধানে ছোটার। তাই পরিবারে যদি শরীয়তের বিধিবিধান মেনে চলার ব্যাপারে ঘাটটি থাকে হতাশ হবার কিছু নেই। বরং আঁধারের বুকে আলো জ্বালাবার নিয়্যাত করতে হবে। হুম, অনেক বাঁধা আসবে চলার পথে। কিন্তু বাঁধা তো মূলত স্পীড ব্রেকার। 

লুবনা হেসে ফেললে নূহাও হেসে বলল, বাবার একটা কথা খুব প্রিয় আমার। “ তোমার জীবনের সফেদ ক্যানভাসকে রাঙানোর ক্ষমতা নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই দেবে না কখনোই। তুলির ছোঁয়ায় একটু একটু করে ক্যানভাসকে এমন করে সাজাবে, যার দিকে তাকালে তোমার বিবেক জুড়ে বয়ে যাবে প্রশান্তির মৃদু হাওয়া। আর এমনটি শুধুমাত্র তখনই তোমার পক্ষে সম্ভব হবে, যখন তুমি শরীয়তের রঙের বাইরে নিজেকে রাঙানো হতে ব্যহত থাকবে।” তাই...

তাই কি? থেমে গেলে কেন? 

নূহা হেসে বলল, তাই যদি স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের চাও সন্ধান, দিগ্বিদিক ছোটা বন্ধ করে পড়তে বসো কুরআন। প্রাণ ভরে করতে চাও যদি জীবনকে তুমি উপভোগ, অনুসরণ করো সুন্নাহর এড়াতে সকল দূর্ভোগ। মানুষ হিসেবে পালন করতে মৌলিক সব দায়িত্ব, নিশ্চিন্ত মনে করে যাও শরীয়তে যা কিছু অনুমোদিত। ইসলাম হল ‘দ্বীনুল ফিতর’ অর্থাৎ, স্বভাব ধর্ম, সকল প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র বর্ম।

লুবনা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আমি তাই করবো। শরীয়তের বর্ম পড়ে নেবো। তাহলে কোন নেতিবাচক মানুষ আর প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ এই তো বুঝে গিয়েছো। এখন তাহলে আমাকে কফি পান করাও। তোমাকে লেকচার দিতে দিতে মাথা ধরে গিয়েছে।

লুবনা হেসে বলল, শুধু কফি কেন? সাথে তোমাকে টফিও খাওয়াবো। চলো যাই।

হাসি মুখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নূহা বলল, হ্যা চল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন