দরজায় উঁকি দিয়েই কেউ ঝট করে সরে গিয়েছে সেটা মোটেই দৃষ্টি এড়ালো না খাদিজা বেগমের। এগিয়ে যেয়ে ভাতিজা ইমাদকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসি মুখে বললেন, কি রে কিছু বলবি?
ইমাদ সালাম দিয়ে বলল, ফুপ্পি তোমরা কি এখন রিহ্যাভ সেন্টারে যাবে?
সালামের জবাব দিয়ে খাদিজা বেগম বললেন, হ্যা। কেন তুইও যেতে চাস আমাদের সাথে? কথা বলছিস কেন? মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলে বুঝবো কি করে আমি?
আরো কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে ইমাদ বলল, জুনি আমার উপর রাগ করে আপ্পাদের সাথে রিহ্যাভ সেন্টারে চলে গিয়েছে। আমার এখন যাওয়া উচিত কিনা বুঝতে পারছি না।
জুনি তোর উপর রাগ করে চলে গিয়েছে? কেন ঝগড়া হয়েছে? বিয়ে হয়েছে তিন মাস হতে পারলো না। এখনই ঝগড়াঝাঁটি শুরু?
না ফুপ্পি ঝগড়া হয়নি। আমি ফান করে একটা কথা বলেছিলাম। কিন্তু জুনি রেগে গিয়েছে। আমি যেতে চাচ্ছি তোমাদের সাথে। কিন্তু ভাইজান শুনলে বিরক্ত হবেন তাই ভয় লাগছে।
বিরক্ত হবার মতো কাজ যদি করে থাকিস তাহলে তো বিরক্ত হবেই। আচ্ছা কি হয়েছে আমাকে খুলে বল। চুপ করে আছিস কেন?
কিছুক্ষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগার পর ইমাদ বলল, গতরাতে
জুনি সাজগোজ করেছিল।
একটু বেশিই ডীপ কালারের লিপস্টিক দিয়েছিল।
কেমন লাগছে জিজ্ঞেস
করলে আমি ফান করে বলেছিলাম, রক্ত
পিপাসু ড্রাকুলার মতো লাগছে। আমি সত্যিই
ফান করেছিলাম ফুপ্পি।
কিন্তু জুনি রেগে
টেগে, কান্নাকাটি করে অস্থির। মেকআপের যা কিছু ছিল সব নিয়ে বাস্কেটে ফেলে
দিয়েছে। বলেছে, জীবনে
কোনদিন আর সাজবে
না। সারারাত কোন কথা বলেনি আমার সাথে।
ফজরের পরে তোমাদের
বাড়িতে চলে এসেছে।
নাস্তার সময় আম্মুকে
বললাম। আম্মুকে আমাকে
বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে,
জুনিকে সাথে নিয়ে
বাসায় ফিরতে। একা গেলে আমার চামড়া
তুলে নেবে। আমি এখন কি করবো
কিছুই বুঝতে পারছি
না। ভাইজানের সাথে
কথা বলতে গিয়েছিলাম। তখন ফুপাজান
বললেন, তোমরাও এখন যাচ্ছো রিহ্যাব সেন্টারে।
হাসি চেপে খাদিজা বেগম বললেন, বউয়ের সাথে ফান করার আগে বুঝতে হয় কোন ধরণের ফান নিতে পারবে, কোন ধরণের পারবে না। শুধু নিজে আনন্দ পেলেই তো সেটা ফান হয়ে যায় না। উভয় পক্ষই যখন আনন্দ পায় তখন সেটা ফান হয়। ফান করার উদ্দেশ্যে একে অন্যেকে আনন্দ দেয়া। যে কথা শুনে পার্টনার কষ্ট পায়, রাগ হয় সেটা তো ফান হতে পারে না। যাইহোক, যা বলে ফেলেছিস সেটা তো আর ফেরত নেয়া যাবে না। পরবর্তীতে সতর্ক থাকার চেষ্টা করবি। এখন চল আমাদের সাথে। আমি জাওয়াদকে বুঝিয়ে বলে দেবো।
স্বস্থির কিছুটা আভাস ফুটে উঠলো ইমাদের চেহারাতে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, জ্বি আচ্ছা ফুপ্পি। আমি তোমার ব্যাগ নিয়ে যাই গাড়িতে?
খাদিজা বেগম হেসে বললেন, যা নিয়ে যা। আমি দেখি জাওয়াদ রেডি হলো কিনা। রুম থেকে বেরিয়ে বাগানে নামতেই জাওয়াদকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন খাদিজা বেগম। কাছে এসে জাওয়াদ বলল, তোমরা রেডি মা?
হ্যা। রাহাতকে বলেছিস?
হ্যা বলেছি। রেডি থাকবে রাহাত। তুলে নেবো আমরা রাস্তা থেকে ইনশাআল্লাহ। পাপা কোথায়?
খাদিজা বেগম হেসে
বললেন, সে আরো দশ মিনিট আগেই
গাড়িতে ঢুকে বসে আছে। ভাব দেখে
মনেহচ্ছে, তাকে ফেলে
আমরা চলে যাবো
এমন ভয়ে আছে।
জাওয়াদ হেসে বলল, পাপা ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করেন সেটা তো জানোই। ঘুরতে যাবার কথা শুনেই এক্সসাইটিং হয়ে যায়। মা’র সাথে কথা বলতে বলতে গাড়ির কাছে পৌঁছে ড্রাইভিং এর পাশের সীটে ইমাদকে মাথা নীচু করে বসে থাকতে দেখে জাওয়াদ বলল, ইমাদও যাচ্ছে আমাদের সাথে মা?
জুনি ইমাদের সাথে রাগ করে চলে গিয়েছে। এখন অভিমান ভাঙানোর উদ্দেশ্যে ইমাদও যাচ্ছে। খাদিজা বেগমের কাছ থেকে বিস্তারিত শোনার পর জাওয়াদ হেসে ফেলে বলল, রক্ত পিপাসু ড্রাকুলা? আশ্চর্য! এমন কথা বলে কেউ নববধূকে? বাচ্চাগুলোকে তো দেখছি ফান কিভাবে করতে হয় সেটাও শেখাতে হবে এখন।
সাথে সাথে ফান মেনে নেয়াটাও শিখিয়ে দিস। মাঝে মাঝেই দেখি আত্মজা একদিকে আর জুয়াইরিয়া আরেকদিকে। খোঁজ নিলে জানা যায় একজন ফান করে কিছু একটা বলেছে, অন্যজন তাতে কষ্ট পেয়েছে। এরা সবাই অন্যের সাথে ফান করার ব্যাপারে ওস্তাদ। কিন্তু নিজের ব্যাপারে কিছু শুনলেই কষ্ট পায়।
জাওয়াদ হেসে বলল, আমিও এই ব্যাপারটা নোটিশ করেছি বেশ কয়েকবার। ঠিকআছে আমি নূহাকে বলবো মেয়েদের সাথে যেন কথা বলে এই বিষয়ে। আর ইমাদ, মুহিব ওদেরকে আমি বুঝিয়ে বলবো ইনশাআল্লাহ। এখন তুমি যাও আমার পাপার পাশে বসো। দেখো কেমন উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছেন তোমার দিকে। এরচেয়ে বেশি অপেক্ষা করানোটা নিষ্ঠুরতা হয়ে যাবে।
খাদিজা বেগম জাওয়াদকে
ঘুষি লাগিয়ে দিয়ে
হাসতে হাসতে গাড়ির
ভেতরে গিয়ে বসলেন।
মাকে ঠিকমতো বসিয়ে
দিয়ে জাওয়াদ ড্রাইভিংয়ে বসলো। ইমাদ
প্রায় শোনাই যায় না এমন শব্দে
সালাম দিলো। সালামের
জবাব দেবার পর হাইওয়েতে ওঠার আগ পর্যন্ত আর কোন কথা বললো না জাওয়াদ।
এরপর বলল, ইমাদ
পড়াশোনা কেমন চলছে
তোমার?
ইমাদ বলল, জ্বি ভাইজান ভালো চলছে আলহামদুলিল্লাহ।
আর সংসার কেমন চলছে?
কিছুক্ষণ নীরব থেকে ইমাদ বলল, ভালোই আলহামদুলিল্লাহ। তবে জুনি খুব বেশি অভিমানী স্বভাবের ভাইজান। একটুতেই শুধু অভিমান করে।
জাওয়াদ হেসে বলল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমান, মনোমালিন্য, টুকটাক ঝগড়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া এসবের প্রয়োজনীয়তাও কিন্তু অনেক। দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয় প্রকার ভাবের আদান-প্রদানই খুব জরুরি। ইতিবাচক আবেগের বহিঃপ্রকাশ যেমন সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি করে। নেতিবাচক আবেগের বহিঃপ্রকাশ তেমন দুরুত্ব তৈরির উপসর্গ গুলোকে দূরীভূত করে সম্পর্কে নতুন গতি আনতে সহায়তা করে। তবে এজন্য দুজনকেই জীবনে সুখী হবার জন্য বদ্ধ পরিকর থাকতে হয়।
আমি সুখী হতে বদ্ধ পরিকর ভাইজান। কিন্তু জুনি ভীষণ অবুঝ।
জুনি অবুঝ বলেই তো তোমাকে সমঝাদারির পরিচয় দিতে হবে। যে ধরণের ফান জুনি নিতে পারে না তেমন ফান করো না। তাছাড়া ফান তো জীবনকে উপভোগ করার একমাত্র মাধ্যম নয়। আরো অসংখ্য উপায় আছে নিজেকের ব্যক্তিগত সময়গুলোকে আনন্দময় করে তোলার। মাত্র তিনমাস হয়েছে তোমাদের বিয়ের। এখন একে অন্যেকে জানার ও বোঝার সময়। কার ভালো লাগা কোথায়, মন্দ লাগা কোথায়। কি অপছন্দ করে, খুব পছন্দ করে কোন কোন জিনিস। বিরক্ত হয় কিসে, আনন্দিত হয় কিসে। এসব জানার ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কখনো ছাড় দিতে হবে, কখনো মানিয়ে নিতে হবে। এভাবেই তো গড়ে ওঠে ভালোবাসাময় একটি বন্ধন। আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে, আন্তরিক ভাবে প্রশংসা করতে পারাটা। তোমার ওয়াইফ তোমাকে খুশি করার জন্য নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবার পর, তাকে কেমন লাগছে এই প্রশ্নটাই বা করতে হবে কেন? তোমার তো নিজ থেকেই বলা উচিত। মানুষ যখন নির্দিষ্ট কারো জন্য কিছু করে। এবং তার মুল্যায়ন পায়না। তখন কি হয় জানো? সেই কাজটা করার ইচ্ছে দিন দিন কমতে থাকে। মানছি তোমার লিপস্টিক দেয়াটা পছন্দ না। কিন্তু নিজের অপছন্দ স্বর্ত্বেও যদি তুমি জুনির পছন্দকে মূল্য দিতে। একটা সময় তোমার পছন্দের মাঝেই নিজের পছন্দ খুঁজে নেয়া শিখে নিতো জুনি। এভাবেই স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের ভালো লাগা রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের শিক্ষকের ভূমিকাও পালন করতে হয়। কারো পক্ষেই তো সবকিছু জানা সম্ভব নয়। অনেককিছুই জুনির অজানা, একই ভাবে তোমারো অজানা আছে অনেককিছু। আজ যদি তুমি খুব ভালো ছাত্রের ভূমিকা পালন করতে পারো, আগামীকাল শিক্ষকের স্থানই তোমাকে স্বাদর সম্ভাষণ জানাবে ইনশাআল্লাহ। আবার স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের রাহবারও হতে হয়। যে মুখে বলে না বরং করণীয় করে দেখায়। আজ তুমি নিজের একটা পছন্দকে কিভাবে ত্যাগ করতে হয় সেটা করে দেখালে। আগামীকাল জুনিও হয়তো রাহবার হয়ে নিজের কোন অপছন্দকে ত্যাগ করে দেখিয়ে দেবে। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?
ইমাদ বলল, জ্বি ভাইজান আমি বুঝতে পেরেছি।
জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা দুজনই যেহেতু স্টুডেন্ট। পড়াশোনার অনেক প্রেশার থাকে। এছাড়াও সাংগঠনিক কাজের সাথে জড়িত আছো দুজনই। অনেকটা সময় ঐদিকেও দিতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে তাই বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় তোমাদেরকে। ক্লান্তি চেপে ধরাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করবে কখনোই যাতে রুমে ঢুকেই ক্লান্তিকর বিরক্তি ছড়িয়ে না দাও একে অন্যের দিকে। বরং, একসাথে বসে কি করলে তোমাদের ক্লান্তিভাব কেটে যায় দ্রুত সেটা বের করে নিতো পারো। তারপর সেই মতো মেনে চলতে চেষ্টা করবে। আবার এমনটাও যাতে নাহয় কখনোই যে, সারাদিন একে অন্যের সাথে যোগাযোগই হয়নি। দূরে থেকেও একে অন্যের টাচে থাকার অসংখ্য উপায় আছে। সবসময় ফোন দেয়া সম্ভব না হলেও টেক্সট করতে পারো যখন তখন। বইয়ের ভাঁজে রেখে দিতো পারো ভালোবাসা মিশ্রিত ছোট্ট কোন সারপ্রাইজ চিরকুট। জুনি, জুম্মি একই কলেজে যায়। জুম্মির হাতে পাঠিয়ে দিতে পারো ছোট্ট কোন উপহার। তোমাদের সম্পর্কের মাধুর্য বৃদ্ধির সাথে সাথে ওদের ননদ-ভাবীরও একে অন্যের সাথে খুনসুটি করার একটা সুযোগ তৈরি হয়ে যাবে।
হ্যা এক ঢিলে কিভাবে দুই পাখী মারতে হয় সেই ব্যাপারেও কিছু পরামর্শ দিয়ে দে ইমাদকে। তুই তো আবার এই ব্যাপারে অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত। পেছন থেকে বলে উঠলেন খাদিজা বেগম।
জাওয়াদও হেসে বলল, তুমি ঠিক কি মিন করছো মা?
খাদিজা বেগম বললেন, আচ্ছা আমিই বলে দেই। শোন ইমাদ বৌয়ের টানে কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাড়িতে এসে যদি প্রথমেই মায়ের সামনে পড়ে যাস। মা যদি প্রশ্ন করে, কি রে তুই এই সময় বাড়িতে যে? তখন মাকে জড়িয়ে ধরে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলবি, তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। তাই সব কাজ ফেলে তোমার সাথে গল্প করতে চলে এসেছি। মাও খুশি, বৌও খুশি। হয়ে গেলো এক ঢিলে দুই পাখী শিকার।
স্বশব্দে হেসে ফেললেন রায়হান সাহেব। জাওয়াদও হাসতে শুরু করলো। খাদিজা বেগম পেছন থেকেই জাওয়াদকে মেরে বললেন, তোর মতো ভন্ড পুরো দুনিয়াতে আর একটাও নেই।
জাওয়াদ হাসতে হাসতে বলল, ইমাদ হাসছি বলে কিন্তু এই পয়েন্টটাকে গুরুত্বহীন মনে করো না। বৌ আর মা যাতে তোমাকে নিয়ে দড়ি টানাটানি খেলা করতে না পারে। সেজন্য এক ঢিলে দুই পাখীর দক্ষ শিকারী তোমাকে হতেই হবে।
ইমাদ হেসে বলল, জ্বি ভাইজান ইনশাআল্লাহ।
মা এবং স্ত্রী দুজনই স্ব স্ব স্থানে সবচেয়ে মূল্যবান দুজন মানুষ প্রতিটি পুরুষের জীবনে। একজনের জন্য আরেকজনকে অবমূল্যায়ন করার কোন সুযোগ নেই। একজনকে খুশি করতে গিয়ে অন্যজনকে ব্যথা দেবারও কোন সুযোগ নেই। একজন আমাদের জন্য জান্নাত, তো আরেকজন দুনিয়ার বুকেই আমাদের জন্য স্বপ্ন-সুখের ভরপুর জীবন গড়ার ক্ষমতা রাখে। একজন আমাদের মা, অন্যজন আমাদের সন্তানদের মা। তাই দুজনই অমূল্য। দুজনকেই যথাযথ শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা দিতে হবে।
জ্বি ভাইজান। আমি অবশ্যই খেয়াল রাখবো ইনশাআল্লাহ।
আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে, ভুলেও কখনো কারো সাথে তুলনা করবে না জুনিকে। আমি নিজেই একদিন শুনেছি তুমি জুনিকে বলছিলে, সারাক্ষণ আপ্পার সাথে থাকো। কিন্তু আপ্পার কোন গুণই তো তোমার মধ্যে দেখিনা। এই কথাটা আর কোনদিন বলবে না। নূহা তোমার বোন আর জুনি স্ত্রী। বোনকে ভালোবাসো এতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু কখনোই এমন কিছু করো না বা বলো না যাতে তোমার বোনের প্রতি তোমার স্ত্রীর মনে বিদ্বেষ তৈরি হবার সুযোগ পায়। এটা ঠিক জুনিও নূহার মতো হতে চায়। কিন্তু বার বার তোমার বলাটা জুনিকে বিরক্ত করে তুলবে না এর কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই ভালোবাসাতে কন্ডিশন সেট করো না। কারো মতো হবার দরকার নেই। জুনি যেমন আছে তেমনই মেনে নাও, ভালোবাসো। তাহলে দেখবে তোমার এই মেনে নেয়া এবং ভালোবাসাই ওর মনে প্রেরণা যোগাবে নিজেকে আরো সুন্দর করে গড়ে তোলার। জীবনে সুখী হবার জন্য আসলে বিশাল বড় বড় স্যাক্রিফাইসের দরকার খুব কমই সময়ই পড়ে। এমন ছোট খাট বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলেই জীবন হয়ে ওঠে সহজ, সুন্দর ও সুখী। তাই নিজের ছোট ছোট ভালো লাগা গুলোর ব্যাপারে যত্নশীল হবার চেষ্টা করো।
একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝা ছেলেটাকে। তাহলে বুঝতে সুবিধা, মনেও থাকবে। পেছন থেকে দুষ্টুমি মাখা স্বরে বললেন খাদিজা বেগম।
জাওয়াদ হেসে বলল, তুমি শুনতে চাইছো সেটা সরাসরি বললেই তো হচ্ছে।
খাদিজা বেগম বললেন, যা বললাম। এখন শোনা তোর কাহিনী।
জাওয়াদ হেসে বলল, নূহা আর আমার ব্যাপারটা তো সম্পূর্ণই ভিন্ন ছিল মা। ছোটবেলা থেকে নূহাকে আমি আমার মনের মতো করে গড়ে তুলেছিলাম। আমাদের চিন্তা-ভাবনা, চাওয়া-পাওয়া প্রায় একই রকম ছিল। অবশ্য তারপরও ভিন্নতা ছিল। ওর প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা নতুন করে বোঝানোর দরকার নেই এমনটা আমি কখনোই ফিল করিনি। বরং, সবসময় চেষ্টা করেছি চমক দিতে। নিত্যনতুন কৌশলে ভালোবাসা প্রকাশ করতে। খুব ছোট ছোট জিনিসকে ঘিরে নূহার ভালো লাগা ছিল। মাটির গহনা, কাঁচের চুড়ি, তাঁতের শাড়ি, মেহেদী, কাজল, নূপুর, ফ্লাওয়ারস। খাবারের ব্যাপারেও অদ্ভুত পছন্দ ছিল। লটকন, বেতফল, কাঁচা খেজুর, কুমড়ো ফুলের বড়া। আমি চেষ্টা করেছি এসবের দ্বারা আনন্দ দিতে। নিত্যনতুন রান্নার শখ ছিল খুব নূহার। দেখা যেত এমন একটা খাবার রান্না করেছে, যা মুখে দেবার ইচ্ছে করাটাই কষ্টকর ছিল আমার জন্য। কিন্তু তবুও একটু হলেও খেতাম। ঐ মূহুর্তে এপ্রিশিয়েট করতাম। পরবর্তীতে কখনো সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতাম। একটা সময় পরে নূহা নিজ থেকে সেই সব খাবার রান্না করতো না। যা খাওয়াটা আমার জন্য কষ্টকর হতে পারে। একথাটাই বোঝাতে চাইছিলাম আসলে এতক্ষণ। তুমি যখন নিজের মন্দ লাগাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে কারো ভালো লাগাকে এপ্রিশিয়েট করবে। সেও একসময় নিজের ভালো লাগার উপরে তোমার মন্দ লাগাটাকে বিবেচনা করবে। এভাবেই সম্পর্কে গাঢ় হয় ভালোবাসার রঙ। আসলে ভালোবাসা অনেকটা দুধের মতো। তাড়াহুড়া করতে চাইলে উতলে পড়ে অর্ধেক হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বুদ্ধিমত্তা মৃদু আঁচে রাখার মাঝেই। মাঝে মাঝে শুধু একটু নেড়ে দিতে হয়। যাতে নীচ দিয়ে আবার পোড়া লেগে না যায়।
রায়হান সাহেব হাসি মুখে বলল, ভালোবাসা দুধের মতো এই তথ্য জীবনে আর কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে উদাহরণটা দারুন।
খাদিজা বেগমের চেহারা জুড়েও ছড়িয়ে পড়লো আনন্দময় হাসি। ইমাদেরও মুখ ভরে গেলো হাসিতে। জাওয়াদের খুব ইচ্ছে করছিল ভালোবাসা যে দুধের মতো এই তথ্যটা প্রথম যেদিন জেনেছিল সেদিনের গল্পটা সবাইকে বলতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত না বলার সিদ্ধান্ত নিলো। তুলে রাখলো গল্পটি অন্য কোন দিনের জন্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন