সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...২৫




মাগরীবের নামাজ সেরে মেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুনার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নূহা কিন্তু বাগানে নেমেই থমকে গেলো কদম কতই না প্রিয় ছিল এই ছোট্ট বাগানটা দুজন মিলে কত যত্ন করেই না সাজিয়েছিল বাগানটাকে বাগানের প্রতিটা গাছ দুজন মিলে একসাথে লাগিয়েছিল প্রতিদিন সকালে নূহার প্রথম কাজ ছিল বাগানের গাছগুলোতে পানি দেয়া খুব আনন্দ নিয়ে এই কাজটি করতো প্রায় দিনই মুনাও হাজির হয়ে যেতো মুনার কথা মনে হতেই নূহার দৃষ্টি চলে গেলো মুনাদের বাড়ির দিকে আবারো অতীত স্মৃতিরা ভিড় করতে শুরু করলো মনের মাঝে মুনার বিষয়টা জানার পর সেদিন রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি নূহা জাওয়াদ যদিও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল তার মন থেকে সব ধরণের টেনশন মুছে দিতে কিন্তু মনের ধোয়াঁশা ভাবটা কিছুতেই কাটাতে পারছিল না প্রায় সারারাতই জেগে ছিল তাই ফজরের পর ঘুমোতে চলে গিয়েছিল জাওয়াদ নূহা কিছুক্ষণ চেষ্টা করেছিল কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরের কিছু মনে হচ্ছিলো ঘুমকে তাই শেষ মেষ উঠে এসে বারান্দায় বসেছিল মন চাইছিল উঠে বাগানের গাছদের সাথে পানি নিয়ে খেলা করতে কিন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না আবারো ফিল করেছিল, শরীর আর মন যে আসলেই অবিচ্ছেদ্য একটির আন্তরিক সমর্থন ছাড়া অন্যটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে আরো কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে থাকার পর ধীর পায়ে বাগানে নেমে এসেছিল প্রতিদিনের অভ্যাসানুযায়ী চোখ চলে গিয়েছিল মুনাদের বাড়ির দিকে অন্য সব দিনের মতো সেদিনও বারান্দায় দাড়িঁয়ে ছিল মুনা নূহা তাকানো মাত্রই হেসে হাত নাড়লো ঠোঁটের কোনে ফুটিয়ে তুলে নূহাও হাত নেড়েছিল প্রতিদিন সকালে এমন দূর থেকে একে অন্যেকে দেখে হাসি উপহার দেয়া, হাত নাড়া এবং ঈশারায় ভাব বিনিময় করাটাও নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল

মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললেও বুকের ভেতরটা আবারো ভার হয়ে গিয়েছিল নূহার। প্রশ্ন জেগেছিল, মুনার অকৃত্রিম হাসির আড়ালে কি ভয়ংকর কৃত্রিমতা লুকিয়ে আছে সেটা কি কারো পক্ষে আঁচ করা সম্ভব?! হঠাৎ করেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে কান্না পাচ্ছিলো নূহার। কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করেনি সেদিন। যদিও ঠিক বুঝতে পারছিল না এই কান্নার উৎস কি রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা নাকি অন্যকোন আবেগ! কিংবা হতে পারে একাধিক আবেগের মিশ্র ধারা। তবে উৎস যাই হোক ঝরে যাক শেষ অশ্রু বিন্দুটি পর্যন্ত এটাই চাইছিল মনে প্রাণে। মন বেড়িয়ে আসুক এই অসহায় অবস্থা থেকে। মুনাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে কান্নার দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। মুনা ছুটতে ছুটতে এসে কাছে এসে হাসতে হাসতে বলল, আপুনি তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। গেস হোয়াট? নূহা শান্ত কন্ঠে বলল, সরি গেস করতে পারছি না। মুনা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি সূরা ফাজর মুখস্ত করে ফেলেছি আলহামদুলিল্লাহ। তোমার খুব প্রিয় সূরা এটি আমি জানি। পড়ে শোনাচ্ছি তোমাকে। নূহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিলাওয়াত করা শুরু করলো মুনা। মুনার কন্ঠস্বর অসম্ভব মিষ্টি। সেদিন যেন কেউ সেই মিষ্টি স্বরে সদ্য চাক ভাঙা মহুয়া ফুলের মধু ঢেলে দিয়েছিল। তিলাওয়াতের সৌন্দর্যে চারপাশে মৌ মৌ সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছিল। নূহার মনেহচ্ছিলো, এই উপহারটি যদি গতকাল মুনা দিতো আনন্দে কি করবে সেটাই হয়তো খুঁজে পেতো না। কিন্তু মূহুর্তে সবচেয়ে অপ্রিয় কারো কাছ থেকে সবচেয়ে প্রিয় কিছুকে ঠিক কিভাবে গ্রহণ করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। হঠাৎ হযরত ওমর () ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি মনে পড়ে গিয়েছিল। আল্লাহর পবিত্র কালাম যদি একজন জালিম ব্যক্তিকে সেই বান্দায় রুপান্তরিত করে দিতে পারে যাকে দেখে ইবলিশ পর্যন্ত পথ ছেড়ে দিত আতংকে সেই পবিত্র কালামের স্পর্শে কি মুনা বদলে যেতে পারে না? নূহার মন দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিয়েছিল, অবশ্যই পারে। একশোবার, হাজারবার, লাখো-কোটিবার পারে। মুনার উদ্দেশ্যে যাই হোক না কেন ওর অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের ভেতর পবিত্র কুরআনের আয়াত সমূহ আলোক খন্ড রুপে পুঞ্জিভূত হতে শুরু করেছে। তার কি একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত নয় মুনার ভেতর এই বোধটি জাগানোর? মনে পড়ে গিয়েছিল খুব প্রিয় একটি হাদীসের কথা। যার সারমর্ম হচ্ছে, যে উত্তম তার সাথে উত্তম ব্যবহার করার মাঝে তেমন কোন কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব হচ্ছে যে তোমার সাথে খারাপ তার সাথে ভালো আচরণ করার মাঝে। ছোটবেলায় পড়া সেই কবিতাটি মনে পড়ে গেলো। যেখানে ছোট্ট মেয়ে অভিমান করে বাবাকে বলেছিল কুকুর তোমাকে কামড় দিয়েছে বদলে তুমি দাওনি কেন? তোমার মুখে কি দাঁত ছিল না? জবাবে বাবা হেসে বলেছিলেন, কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়, তাই বলে কি কুকুরকে কামড়ানো মানুষকে শোভা পায়? সেটাই তো কেউ অধম হলে আমি উত্তম হবো না কেন? একজন মুসলিম তো অন্তত অধমের সাথে অধম হতে পারে না। তাছাড়া কেউ ভুল পথে চললে একবার অন্তত তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করার চেষ্টা করে দেখাটা প্রতিটি মুসলিমের দ্বায়িত্ব।

নূহা একটা কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো, এখনো করে, মাঝে মাঝে আল্লাহ কিছু কিছু মানুষকে আমাদের জীবনে রাহবার হিসেবে পাঠান। তারা আমাদেরকে অন্ধকার পথ থেকে আলোর দিশা বাতলে দেন। দেখিয়ে দেন কোন পথে চললে দেখা মিলবে গন্তব্যের। ঠিক তেমনি মাঝে মাঝে আমাদেরকেও কারো কারো জীবনে পাঠিয়ে দেন রাহবার হিসেবে। যাতে তাকে ভুলের জগত থেকে হাত ধরে বের করে সঠিক পথের দিশা দেখিয়ে দিতে পারি। এমনও তো হতে পারে মুনার জন্য সেও তেমনই একজন রাহবার। এটা ঠিক যে মুনা তার সংসার ভাঙার লক্ষ্যে নিয়ে তার জীবনে প্রবেশ করেছিল। এরজন্য হয়তো ওকে ক্ষমা করাটা মোটেই সহজ হবে না তার জন্য। কিন্তু জীবনের পরীক্ষা গুলো তো এমনই হবার কথা তাই না? যদি দিতে কোন কষ্টই না হয় তাহলে সেটা আবার কেমন পরীক্ষা? ধৈর্য্যের সাথে যখন মানুষ কোন সমস্যাকে মোকাবিলা করে তখনই না সে অর্জন করতে পারে সবরকারীর খেতাব! এমনিতেই তো আর সবরকারীকে এত মর্যাদা দেয়া হয়নি কুরআনে। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নূহা। সে একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখবে মুনাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার। মুনার চোখের সামনে থেকে নফসের লালসার পর্দা উন্মোচন করার চেষ্টা করবে। যে স্বপ্নিল স্রোতে মুনা আনন্দ চিত্তে ভেসে চলছে সেটা যে আসলে ভুলের স্রোত সেটা বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করবে। তাই তিলাওয়াত শেষ করে মুনা যখন জানতে চেয়েছিল কেমন হয়েছে আপুনি? নূহা হাত বাড়িয়ে মুনার চিবুক ছুঁয়ে হেসে বলল, মাশাআল্লাহ ভীষণ সুন্দর। তবে আরো অনেক প্র্যাকটিস করতে হবে তোমাকে। আনন্দিত মনেই মুনা সম্মতি জানিয়েছিল চেষ্টা করার।

জাওয়াদকে যখন প্রথম বলেছিল একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখতে মুনার ভুল ভাঙিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার। একদমই সমর্থন করেনি। কিন্তু নূহার মাথায় একবার কিছু ঢুকে গেলে সেটা বের করা অসম্ভব যদি না নূহা নিজে সেটাকে বের করে ছুঁড়ে ফেলে। জাওয়াদকে বলেছিল, ধরো নিজের ভুলেই কেউ তোমার গাড়ির সামনে এসে পড়লো এবং আহত হলো তুমি কি তাকে সে অবস্থায় ছেড়ে দেবে? নিজের ভুলে এক্সিডেন্ট করেছে বলে কি তার প্রতি মানবতা প্রদর্শন করবে না? ওসব নাহয় বাদ দিলাম। তোমার চিকিৎসক সত্ত্বা কি পারবে একজন ক্ষত বিক্ষত আহত মানুষকে রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দিতে? যেখানে মানুষের সেবা করাই একজন ডাক্তারের মূল লক্ষ্য। জানি কখনোই তুমি এমনটি পারবে না। তাহলে মুনাকে কেন ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো? নিজের ভুলের কারণে মুনাও তো এমনই একটি এক্সিডেন্ট এর স্বীকার হয়েছে। পার্থক্য শুধু এক্সিডেন্টটা মানসিক। একজন ডক্টর হিসেবে ওকে এভাবে ছেড়ে দেয়াটা কি তোমার উচিত হবে? এই কথার পরে আর আপত্তি করতে পারেনি জাওয়াদ। মেনে নিয়েছিল নূহার কথা। মুনাকে নূহা আর জাওয়াদ বুঝতে দেয়নি যে তারা টের পেয়ে গিয়েছে ওর মনের অসৎ ইচ্ছেকে। জাওয়াদ একশো ভাগ সতর্ক থেকেছে কোনভাবেই মুনার সাথে যাতে দেখা নাহয়। আর দেখা হয়ে গেলেও কথা বলার কোন সুযোগ যেন মুনা না পায়। নূহা সতর্ক থেকেছে শত কথার ফাঁকেও কোনভাবেই যাতে তার মুখ দিয়ে জাওয়াদের ব্যাপারে কিছু বের করাতে না পারে মুনা। মুনা যখন দেখলো যে সে জাওয়াদের ব্যাপারে কিছু বলতে গেলেই নূহা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করে। কিছুদিন পর নিজ থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিয়েছিল জাওয়াদের ব্যাপারে কথা বলা। ঐদিকে জাওয়াদকে নিজের দিকে আকর্ষিত করার সমস্ত চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখতে পেয়েছিল একে একে। যাতে নেতিবাচক কোন চিন্তাভাবনা কাজ না করতে পারে সেজন্য নূহা সারাক্ষণই বিভিন্ন ভাবে কুরআন, হাদীস, জীবনের মূল লক্ষ্য, মৃত্যু, আখিরাত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলতো মুনার সাথে। আগে শুধু মুনাই আসতো সবসময় কিন্তু এই ঘটনার পর নূহাও মাঝে মাঝে যাওয়া শুরু করেছিল মুনাদের বাসায়। সবকিছু মিলিয়ে মাস খানেকের মধ্যেই মুনার মধ্যে বদলের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হতে শুরু করে দিয়েছিল আল্লাহর অশেষ রহমতে। আসলে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে যখন আল্লাহর উপর ভরসা করে হাতে হাত মিলিয়ে কোন সমস্যা বা বিপদের মোকাবিলা করে। কারো সাধ্য থাকে না তাদেরকে হারিয়ে দেবার। মুনার ঘটনা থেকে জাওয়াদ আর নূহা উপলব্ধি করেছিল, যদি তারা দুজন এক থাকে, সঙ্ঘবদ্ধ থাকে, তাদের মনে যদি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকে, তাদের ইচ্ছেটা যদি নিজের এবং অপরের জন্য কল্যাণকর হয় তাহলে কোন ঝড়ই তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।

ফোনের শব্দে ভাবনারা ছিন্ন হয়ে গেলো নূহার। তাকিয়ে দেখলো স্ক্রিনে রাহাতের নাম। সালাম বিনিময়ের পর রাহাত বলল, এখান থেকে চার কিলোমিটার দূরে কয়েকজন বাঙ্গালী, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী আর আরবী ভাই মিলে একটা রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন। ভাইজান এসেছেন শুনে উনারা সবাই দলবল বেঁধে হাজির হয়েছেন আমাদের রেস্টুরেন্টে ইনভাইট করার জন্য। আগামীকাল দুপুরে ভাইজানের মিটিং আছে। তাই লাঞ্চের সময় যাওয়া সম্ভব হবে না। এখন তুমি বলো আজ রাতে ডিনার করতে যাবে নাকি আগামীকাল সকালের ব্রেকফাস্ট? তবে বাচ্চারা ডিনার করতে আগ্রহী

নূহা বলল, আর আপনি কিসে আগ্রহী?

রাহাত হেসে বলল, আমার সমস্ত আগ্রহ বহু বছর আগেই তোমার আগ্রহের কাছে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দিয়েছে।

নূহা হেসে বলল, বাচ্চারা যেহেতু ডিনার করতে চাইছে সেটাই ভালো হবে। ঈশার নামাজের পর যাবো তো আমরা?

হ্যা ইনশাআল্লাহ

তাহলে ঠিকআছে এরমধ্যে আমি আমার কাজগুলো সেরে ফেলতে পারবো

তোমার কাজের মধ্যে জুনির সাথে কথা বলাটাও রেখো। ইমাদের সাথে কথা হয়েছিল সন্ধ্যার দিকে। আমি তো তোমাকে ম্যাসেজ করেছিলাম।

হ্যা দেখেছি। ইনশাআল্লাহ আমি বুঝিয়ে বলবো জুনিকে। আরো কিছুক্ষণ রাহাতের সাথে কথা বলে ফোন রেখে জুনিকে ম্যাসেজ করে বাইরে আসতে বললো নূহা। কিছুক্ষণ পর জুনি এসে সালাম দিয়ে বলল, আপ্পা তুমি এখনো যাওনি আপা মুনার সাথে কথা বলতে?

সালামের জবাব দিয়ে হাসি মুখে নূহা বলল, এই তো যাব আর কিছুক্ষণ পর ইনশাআল্লাহ। হঠাৎ একটা মজার কৌতুক মনে পড়ে গেলো। তুমি কৌতুক খুব পছন্দ করো তাই ভাবলাম তোমাকে বলেই যাই

কি কৌতুক আপ্পা?

নূহা হেসে বলল, এক লোকের ছিল দুই বউ ছিল। বউ দুজনের মধ্যে সারাক্ষন ঝগড়া লেগেই থাকত। লোকটার ছিল শরীর টিপানোর অভ্যাস। দুই বউ এক সাথে লোকটার শরীর টিপতো। সেখানেও তারা ঝগড়া করতো কে শরীরের কোন অঙ্গ টিপবে। প্রতিদিন এই নিয়ে দুজনের ঝগড়া দেখে, লোকটা একদিন দুজনকে তার শরীরের অংশ ভাগ করে দিল কে কোথায় টিপবে। বড় বউকে দিল ডান হাত, ডান পা। ছোট বউকে দিল বাম হাত, বাম পা। যাই হোক কিছুদিন ভাল ভাবে সব চলল।একদিন বড় বউ শরীর টিপার জন্য তেলের কাসার বাটি হাতে নিয়ে লোকটার বাম দিক দিয়ে ডান দিকে যাওয়ার সময় হটাৎ তার হাত থেকে কাসার বাটিটা লোকটার বাম পায়ের উপর পড়ে গেল। ভারী বাটিটা গরম তেলসহ লোকটার বাম পায়ের উপর পড়া মাত্রই লোকটা চিৎকার করে উঠল। লোকটার চিৎকার শুনে ছোট বউ দৌড়ে এল। এসে ঘটনা জানতে পেরে স্বামি ব্যাথার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর বদলে বড় বউয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিল। কি ব্যাপার আপনি আমার ভাগের পায়ের উপর কেন বাটি ফেললেন? এই বলে সে তার হাতের ভারী কাসার বাটিটা লোকটির ডান পায়ের উপর ফেলল। এবার ডান পায়ের উপর বাটিটা পড়া মাত্র লোকটা আবার আর্ত চিৎকার দিয়ে উঠল। বড় বউ ছোট বউয়ের কান্ড দেখে দৌড়ে একটা লাঠি নিয়ে এল।তোকে বললাম হঠাৎ পড়ে গেছে তারপরও তুই আমার ভাগের পায়ের উপর বাটি ফেললি, তবে এই দেখ এবার ইচ্ছে করে মারলাম। এই বলে হাতের লাঠি উচিয়ে লোকটার বাম হাতে দিল এক বাড়ি। গেল লোকটার বাম হাতটা ভেংগে। লোকটার এখন মরন দশা। দুই বউয়ের এসব দেখার সময় নাই। ভাগের বাম হাত ভাঙতে ছোট বউ হুশ হারা হয়ে গেল। সেও এবার দৌড়ে একটা লাঠি নিয়ে এল। মৃত প্রায় লোকটার ডান হাতে মারল এক বাড়ি। এভাবে জিতাজিতি করে মারতে মারতে এক সময় দুই বউয়ে তাদের স্বামিকে মেরেই ফেলল। দুজনে বিধবা হয়ে গেল। তারপরও ওদের ঝগড়া থামেনি পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে আর বলছে তোর কারনে স্বামীটা মরল।

কৌতুক শুনে হাসতে হাসতে ঘাসের উপর বসে পড়লো জুনি। নূহা কিছুক্ষণ জুনিকে হাসির সুযোগ দিয়ে বলল, শিক্ষণীয় কি আছে কৌতুকটিতে বলতে পারবে?

জুনি হাসতে হাসতে বলল, এরমধ্যে আবার কি শিক্ষণীয় থাকবে আপ্পা?

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা শিক্ষণীয় কি আছে এই প্রশ্ন থাক। তবে বর্তমানে ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখলে দুই সতিনের এই জোকসটা মনে পড়ে আমার। ছেলে-মেয়ে মিনস দম্পতি। ছোট থেকে ছোট ইস্যুতেও আজকাল দম্পতিরা একে অন্যের সাথে ঠিক এই দুই সতীনের মতো ঝগড়া করে, লড়াই করে। কে কাকে হারাবে এই প্রতিযোগীতার লিপ্ত থাকার কারণে তারা ভুলেই যায় একে অন্যেকে হারাতে গিয়ে তারা আসলে সেই জিনিসটাকেই হারিয়ে ফেলছে যার জন্য বা যাকে ঘিরে এই ঝগড়ার সুত্রপাত হয়েছিল। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, এক দৌড় প্রতিযোগীতায় দুইজন প্রতিযোগী একে অপরকে হারানোর লক্ষ্যে প্রানপণে ছুটছে তো ছুটছেই। অন্যেকে হারিয়ে নিজেকে জিততেই হবে এই চিন্তায় তারা এতটাই বিভোর হয়ে পড়ে , কখন যে তাদের রুট চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে সেটাই খেয়াল করে না। যারফলে, অনেক পথ ঘুরে লাল ফিতার কাছে পৌঁছলেও বিজয়ীর ট্রফি আর হাশিল করতে পারে না। পারবেই না কিভাবে? তারা তো মূল লক্ষ্য পথ থেকেই বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। যারফলে অন্যেকে হারিয়ে জিতলেও সেই জিত হারের চেয়েও বেদনাক্ত লজ্জাকর হয়।

নূহার কথা শুনতে শুনতে হাসি মুছে গেলো জুনির মুখ থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বিকেলে ইমাদ এসেছিল আমার কাছে। সরি বলেছিল বার বার করে। কিন্তু আমি উল্টো আরো কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছি ওকে। আমার আসলে খুব বেশি রাগ লাগছিল আপ্পা ইমাদকে দেখে। মনে হচ্ছিলো, আমার ভালো লাগা, ভালোবাসাকে অবমূল্যায়নের জন্য এত অল্পে ওকে ক্ষমা করে দেয়াটা ঠিক হবে না। আমার কি ভুল হয়ে গিয়েছে আপ্পা?

সংসারে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতিযোগী নয় বরং সহযোগী এই ধারণাটা স্বচ্ছ থাকা খুবই জরুরি জুনি। আজকাল স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে কেমন যেন একটা প্রতিযোগী ভাব পরিলক্ষিত হয়। সারাক্ষণই অন্যেকে হারিয়ে দেবার একটা মনোভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দুজন। শুধু সরি বলাটাকেই হার মনে করে না, সরি মেনে নেয়াটাকেও হার মনে করে। প্রশ্ন জাগে এরা কি সংসার করতে একত্র হয়েছে নাকি কোন ফুটবল ম্যাচের দুই দলের দুই গোল কিপারের ভূমিকা পালন করছে? আচ্ছা তুমি কি করছো? তুমিই ভেবে চিন্তে বলো কেন বিয়ে করেছো? বিয়ের লক্ষ্যটা কি ছিল তোমার?

আই এম সরি আপ্পা?

আমাকে সরি বলছো কেন? আর আমাকে যদি এত সহজে সরি বলতে পারো, আমার কাছে যদি নিজের ভুল স্বীকার করে নিতে পারো এত দ্রুত। তাহলে তোমার স্বামীর কাছে পারো না কেন? এই না পারাটা কি প্রমাণ করে না যে তাকে তুমি ইমাদের সহযোগী নও, বরং ওকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করো? প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে জিতে যাবার, তাকে হারিয়ে দেবার মজাই আলাদা। কিন্তু সহযোগীর হার কষ্টের আর জিতে যাওয়াটা তৃপ্তির। কেন জানো? কারণ যখন আমরা আমাদের সহযোগী কাউকে জিতিয়ে দেই, তখন আমাদের নিজেদের জিতটাও সুনিশ্চিত হয়ে যায়। ফুটবল খেলায় যখন নিজ দলের কেউ বল নিয়ে গোলপোষ্টের কাছে পৌঁছে যায়। তখন কি সে গোল দিয়ে ফেলবে ভেবে দলের বাকিরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে? নাকি তার গোল দেবার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেটা দূর করার চেষ্টা করে দলের সবাই মিলে? কোনটা করে?

তার প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা করে।

হুম, এবং সে যখন গোল দেয় তখন সবাই মিলে উল্লাসে মেতে ওঠে। তাকে মাথায় তুলে নেয় আনন্দে। কারণ এটাই সহযোগীর করণীয়। জুনি সংসার না একার তোমার, না ইমাদের। সংসার তোমাদের দুজনের। দুজনকে মিলে সুখী সুন্দর করার চেষ্টা করতে হবে তোমাদের সংসারকে। জানো আমরা এখন এখানে এসেছিলাম এই বাগানটা ছিল না। এই বাগানটা তোমাদের ভাইজান আর আমি নিলে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলাম। ঘাস-পাতায় ছাওয়া ছিল জায়গাটা। সেসব পরিষ্কার করা, মাটি তৈরি করা, সার মেশানো, পানি দেয়া সব কিছু দুজন মিলে একটু একটু করে করেছিলাম। এরপর বাগানের কোন পাশে কোন গাছ লাগাবো সেটা নিয়েও অনেক চিন্তাভাবনা করেছি আমরা দুজন। যে গাছগুলোতে রোদের দরকার বেশি সেগুলোকে যে স্থানে রোদ বেশি পড়ে সেখানে লাগিয়েছি, ছায়ায় বেড়ে ওঠা গাছগুলোকে রোদ থেকে দূরে রেখেছি। দুজন মিলেই কয়েকদিন পরপর আগাছা পরিষ্কার করেছি। একসাথে বাগান গড়ে তোলার বেনিফীট হচ্ছে, অনেকটা অজান্তেই সম্পর্কের বন্ধনে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার নানান আইডিয়া মাথায় এসে যায়। এখান থেকে ফিরে গিয়ে তোমাদের বারান্দাতে একটা মিনি বাগান গড়ে তুলবে দুজন মিলে। বাগান গড়ে তোলার সময় যা যা করবে সব নোট করে রাখবে। এরপর সেই নোট দেখে নিজেদের দাম্পত্যে ফুল ফোঁটাতে চেষ্টা করবে।

ইনশাআল্লাহ আমি সত্যিই তাই করবো আপ্পা

নূহা হেসে বলল, আরেকটা কথা মনে রাখবে, ভালো লাগা, ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। তাই তোমার ভালো লাগা দিয়ে ইমাদের ভালো লাগাকে কখনোই বিবেচনা করবে না। ভালোবাসা কি এই প্রশ্নের জবাবে তোমার সংজ্ঞার সাথে ইমাদের সংজ্ঞা না মিললেই ওকে জিরো দিতে যাবে না কখনোই। ভালোবাসাকে প্রতিজন মানুষই ভিন্ন ভিন্ন রূপে পায় জীবনে। তাই কারো সাথে কারো ভালোবাসার সংজ্ঞা মিলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু সংজ্ঞার এই অমিল মানে ভালোবাসার অস্তিত্ব হীনতা নয়। তাই ভালোবাসা প্রকাশের ভিন্নতা নিয়ে না যুক্তি তর্কের অবকাশ আছে, না অন্যেকে ভুল প্রমাণের সুযোগ আছে। ইমাদকে ভুল প্রমাণিত করেই তোমার নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। তোমরা দুজনই সঠিক হতে পারে নিজ নিজ অবস্থানে। তেমনি আবার দুজনেই ভুল হতে পারো। বুঝতে পেরেছো?

জ্বি আপ্পা। খুবই দুঃখী কন্ঠে বললো জুনি।

হয়েছে এত মন খারাপ করার কিছু নেই। নতুন সংসার শুরু করেছো ভুল তো হবেই টুকটাক। জানো আগে সামনের রাস্তাটা ঘাসে ঢাকা ছিল একদম। একদিন বিকেলে তাকিয়ে দেখি ছোট্ট ছোট্ট সাদা আর বেগুনী রঙের ফুলে ছেয়ে গিয়েছে জায়গাটা। আমি আনন্দে চিৎকার করে তোমাদের ভাইজানকে ডেকেছিলাম। ঘাসফুলকে ঘিরে নিজের মুগ্ধতা প্রকাশের পর উনাকে সাবধান করে বলে দিচ্ছিলাম, আগামীকাল থেকে যেন পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসার সময় খুব সাবধানে ড্রাইভ করে। একটা ঘাসফুলও যেন কষ্ট না পায়, নষ্ট না হয়। আমি যখন উনাকে এসব বলছিলাম আমাদের এক প্রতিবেশী বৃদ্ধ ঘাসফুলগুলো মাড়িয়ে চলে গেলেন আমাদের চোখের সামনে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম ভেবে যে, ভদ্রলোক একবার ফিরে তাকিয়েও দেখলেন না ঘাসফুলগুলোর দিকে। আমার কান্না চলে এসেছিল একদম। আমাকে কান্না করতে দেখে জাওয়াদ হেসে ফেলেছিলেন। হাসতে হাসতে বুঝিয়ে বলেছিলেন, কাউকে যদি এমনি করে তোমার ভালো লাগাকে মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে দেখো মন খারাপ করো না। কারণ জগতে কেউ তোমার ভালো লাগার দ্বায়ে আবদ্ধ নয়। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ভালো লাগায় মোহাবিষ্ট। তাই কখনো যদি কেউ তোমার ভালো লাগাকে আপন করে নেয়, তাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করবে। কিন্তু কেউ যদি তোমার ভালো লাগার মাঝে নিজের ভালো লাগা খুঁজে না পায়, সেজন্য তাকে দায়ী করবে না। বরং এমনটাই স্বাভাবিক ধরে নেবে। তাহলে দেখলে জীবনে ভালো থাকাটা অনেক বেশি সহজ হয়ে যাচ্ছে তোমার জন্য।

জুনি হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি বুঝতে পেরেছি আপ্পা। প্রমিস, প্রমিস আমি আর এমন বোকামী আর কখনোই করবো না ইনশাআল্লাহ। এক্ষু্ণি ইমাদকে খুঁজে বের করে আমার কান ধরে মাফ চাইবো ওর কাছে।

নূহাও হেসে বলল, ঠিকআছে তাই করো। আমিও মুনার কাছে যাই। পরে ইনশাআল্লাহ কথা হবে তোমার সাথে। জুনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুনাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো নূহা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন