আপাআআ... আজকের পরীক্ষা ক্যান্সেল!
ফজরের নামাজ সেরে নাবিহাকে নিয়ে বাগানে নেমেছিল নূহা। কিছুক্ষণ শিশির ভেজা
ঘাসে মামণির হাত ধরে হাঁটার পর পাপাকে চা দিতে গিয়েছে নাবিহা। বাগানের একপাশে
ছাওনীর নীচে বসে চারপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে মেয়ের ফিরে আসার অপেক্ষা করছিল
নূহা। এরমধ্যে হঠাৎ সাহিলের চিৎকার শুনতে পেয়ে বেশ চমকে উঠেই ঘুরে তাকালো।
দুই লাফে নূহার কাছে এসে দাঁড়িয়ে সাহিল মুখের সবগুলো দাঁত বের করে বলল, পরীক্ষা ক্যান্সেল রে আপা! পরীক্ষা ক্যান্সেল। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে।
নূহা হেসে বলল, লাফাতে কি বাকি
রেখেছিস কিছু?
সাহিল হেসে বলল, আপা সিচুয়েশনটা
চিন্তা করো। সারারাত জেগেও পরীক্ষার সিলেবাস কমপ্লিট করতে না পারার দুঃখ নিয়ে
বিধ্বস্ত মন যখন দেখে পরীক্ষা দিতে যাবার জন্য রেডি হবার সময় আসন্ন। এবং ঠিক ঐ
মূহুর্তেই যখন ক্লাসমেট ফোন করে জানায় যে, আজ পরীক্ষা হবে
না। কেমন হতে পারে ঐ মূহুর্তটা! বুঝলে আপা চোখের পলকেই আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা, ভয়, উত্তেজনা কোথায়
যেন উড়ে চলে গেলো। অদ্ভুত রকমের এক প্রশান্তির অস্তিত্ব টের পেলাম মন জুড়ে।
পরীক্ষা ক্যান্সেল হয়ে
যাওয়া দিনগুলোকে একদম ঈদের মতো মনেহয়।
নূহা হেসে বলল, মাঝে মধ্যে
জীবনের দু’একটা পরীক্ষাও
যদি এমনি করে ক্যান্সেল হয়ে যেত। মন্দ হতো না তাই না?
ঠিক বুঝিনি আপা?
নূহা হেসে বলল, গেদু
বাচ্চাকাচ্চাদের সবকিছু বুঝতে নেই। কিন্তু পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করতে করতে তোর ভেতর
যে পরীক্ষা ভীতি তৈরি হয়ে যাচ্ছে সেটা কি খেয়াল করেছিস?
তুমি আছো না খেয়াল করার জন্য। তাছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমার আপা শুধু
সমস্যা খেয়ালই করবে না। সেটা থেকে মুক্তি পাবার পন্থাও আমাকে বলে দেবে ইনশাআল্লাহ।
এবং মুক্তির সেই পথে চলার সময় আমি যতবার ভুল করবো। আমার আপা হাসিমুখে আমাকে সঠিক
পথ দেখিয়ে দেবে।
আর কিছু পারুক বা না পারুক। কথা বলায় ওস্তাদ আমাদের আনন্দবাড়ির বুড়া থেকে
গুড়া সমস্ত সদস্য।
সাহিল হাসতে হাসতে বলল, তোমার ল্যাপটপ
ঠিক হয়েছে আপা?
অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে সাদাত। দেখা যাক কি হয়। আচ্ছা তুই HALT পদ্ধতির নাম শুনেছিস?
HALT পদ্ধতি? নাতো! এটা কি?
HALT পদ্ধতি বলে একটা
ব্যাপার আছে। পদ্ধতিতে ‘এইচ’ ফর হাঙ্গরি। এখানে এইচ হচ্ছে ক্ষুধার প্রতিচ্ছবি। খাদ্য এমন একটি জিনিস যা ছাড়া আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব
নয়। খাদ্য আমরা তখন খাই যখন আমাদের ক্ষুধার অনুভূতি হয়। তবে এই পদ্ধতিতে ক্ষুধা
বলতে শারীরিক না মানসিক ক্ষুধাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, তোকে জানার চেষ্টা করতে হবে যে জীবনের কোন জিনিসটির জন্য তুই মানসিক ভাবে
ক্ষুধার্ত। কোন জিনিসটা তোকে মানসিক ভাবে সবল রাখতে খাদ্যের ভূমিকা পালন করছে।
সাহিল হেসে বলল, শুনতেই তো কেমন
জানি মজা লাগছে। তবে এখনই জবাব দিতে পারবো না আপা। আগে ভাবতে হবে আমাকে।
অবশ্যই খুব ভালো মতো ভেবে এরপরই জবাব দিবি। এরপর হচ্ছে, এ। ‘এ’ ফর অ্যাঙ্গরি। রাগ এমন একটি আবেগ যা
আমাদের মানসিক শক্তিকে প্রচন্ড রকম ক্ষতিগ্রস্ত করে। বলা হয় যে রাগ দমন করা ছাড়া
কারো পক্ষে আত্মিক সাধনার পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি ধর্মেই রাগের
ধ্বংসাত্মক দিক সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। আমাদের রাসূল(সঃ) বলেছেন, “ রাগান্বিত হয়ো না, যে ব্যক্তি রাগকে
সংবরণ করতে পারে সেই প্রকৃত বীর। বুদ্ধদেব বলেছেন,
“ রণক্ষেত্রে সহস্র
যোদ্ধার উপর বিজয়ীর চেয়ে রাগ-ক্রোধ বিজয়ী বা আত্মজয়ী বীরই বীরশ্রেষ্ঠ।”বেদে আছে, “জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত রাগ-ক্রোধ থেকে দূরে থাকো। যিশুখ্রীস্ট বলেছেন, “ যখন কেউ তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করে, তুমি তাকে ক্ষমা
করে দাও। সদাপ্রভু তোমাকে ক্ষমা করবেন।” রাগের কারণে আমরা
নিজেই নিজের মধ্যে গুম হয়ে থাকি। অনেক সময় অন্যের উপর রাগ দেখাতে না পেরে বিভিন্ন
ভাবে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করি। তাই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার পন্থা তোকে খুঁজে
বের করতে হবে।
আলহামদুলিল্লাহ আমার এমনিতেই রাগ কম। তবে এটা ঠিক বলেছো আপা রাগের কারণেও
অনেক সময় নষ্ট হয়। আর মেজাজ গরম থাকলে পড়াশোনা তো হয়ই না।
হুমম! যাইহোক, এরপর হচ্ছে এল।
এল হচ্ছে একাকীত্বের প্রতীক। এখানে দুটা বিষয় আনা যায়। এক. একাকীত্বকে তুই কিভাবে
উপভোগ করিস। দুই. একাকীত্বকে দূর করার জন্য তুই কি কি করিস।
দুইটা প্রশ্নের জবাব কি একই হবে না আপা?
নূহা হেসে বলল, না একই হবে না।
আচ্ছা তোকে উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি। আমাদের মনটা এত অদ্ভুত একটা জিনিস যে অনেকসময়
হাজারো মানুষের ভিড়েও নিজেকে ঘিরে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায় না। মানে সব
থাকতেও হঠাৎ কেউ নাই, কিছু নেই এমন
একটা উপলব্ধি ঘিরে ধরা। আমার সাথে যখনই এমন হয় আমি তখন কবি হয়ে যাই। জানি না
কোত্থেকে জানি দলে দলে ছন্দরা হাজির হয়। আবার দু’
একদিন শুধুই
আকাশের দিকে তাকিয়ে সুবিশাল ভাবনার জগতে ডানা মেলে অবাধ বিচরণ করি হঠাৎ ঘিরে ধরা
একাকীত্বের মুহূর্তগুলোতে। এবার হচ্ছে একাকীত্ব দূর করার জন্য আমি কি কি করি। বই
পড়ি, বাগান করি, প্রিয়জনদের সাথে গল্প করি। ইত্যাদি।
সাহিল হেসে বলল, হ্যা এবার বুঝতে
পেরেছি আমি।
শেষ অক্ষরটি হচ্ছে টি। টায়ার্ড অর্থাৎ,
ক্লান্তি। তোকে
জানতে হবে কোন বিষয়গুলো তোকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্লান্ত করে তোলে। এবং সেই
ক্লান্তি দূর করার সম্ভাব্য পন্থাগুলোও তোকে খুঁজে বের করতে হবে। যাতে
ক্লান্তিভাবের কারণে তোর জীবন থেকে মূল্যবান সময় হারিয়ে না যায়। এই পদ্ধতির যথাযথ
প্রয়োগে আত্মোন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ অনেকখানিক সুগম হয়। তুই আজ খুব ভালো করে
এই চারটি বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা কর। আর এখন তুই এখান থেকে যা। আমার দুই স্টুডেন্ট
আড়াল থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তুই এখানে থাকার কারণে আসতে পারছে না। নাস্তার পর
ওরা চলে যাবে। তাই ওদের সাথে এখন কিছুক্ষণ সময় কাটাই। বিকেলে কিংবা আগামীকাল এই
বিষয়ে তোর সাথে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।
আপার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চুপচাপ নিজের রুমের বারান্দায় এসে বসলো সাহিল।
গভীর ভাবে ভেবে দেখার চেষ্টা করলো, তার জীবনের
ক্ষুধা কি? কিন্তু ক্ষুধার কথা চিন্তা করার সাথে সাথে বেশি করে মটরশুঁটি দিয়ে রান্না করে পোলাও,
মচমচে করে ভাঁজা
ইলিশ মাছ, হাড়ি কাবাব, লেয়ার পুডিং ইত্যাদি খাবারের ছবি ভেসে উঠলো সাহিলের মনের পর্দায়। নিজেই
নিজেকে বোকা, পেটুক বলে বকা
দিয়ে আবারো ভাবতে চেষ্টা করলো সাহিল। কি তার মনের ক্ষুধা? অনেক চেষ্টা করেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। মানসিক ভাবে তাকে শক্তি দেয় এমন
কি আছে? কোন জিনিসটার
অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে সে মানসিক ভাবে? বার বার শুধু
অনলাইন জগতের কথাই মনে আসতে লাগলো। অনেক বন্ধুবান্ধব তার অনলাইনে। তাদের সাথে
একদিন যোগাযোগ না হলেই মনখারাপ লাগে! যত যাই কিছু হোক না কেন একটু পর পর অনলাইন না
হলে তার অস্থির লাগে। গতমাসে যখন বাবা অসুস্থ হয়েছিল তখন বাবার কষ্টে তার মুখ দিয়ে
খাবার ঢোকেনি। কিন্তু একটু পর পর অনলাইন হয়ে সে ঠিকই বাবার আপডেট জানিয়ে স্ট্যাটাস
দিয়েছে। বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন এসেছিলেন তখন। কিন্তু তাদের সবার সহানুভূতি, দোয়া, সান্ত্বনার চেয়ে
ফেসবুকের বন্ধুদের লেখা
শব্দগুলোকেই বেশি প্রশান্তিকর মনে হয়েছে তার কাছে। শরীর আর ক্ষুধার সম্পর্ক
অবিচ্ছেদ্য। ভেবে দেখলো অনলাইন জগতটাও তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে
গিয়েছে। তাহলে তার মনের ক্ষুধা কি অনলাইন জগত আর সেই জগতের বাসিন্দারা? উপলব্ধিটা নিজেই কাছেই কেমন যেন অস্বস্থিকর লাগলো সাহিলের। কেমন যেন একটা
লাজুক আবহ ছেয়ে গেলো তার মনের ক্ষুধা অনলাইন ভাবতে। কিন্তু যেহেতু সে নিজেকে
সংশোধন করতে চায় তাই পাশ থেকে ডায়েরি টেনে নিয়ে সত্যি কথাটিই লিখলো। নয়তো আপা তাকে
সাহায্য করতে পারবে না।
রাগ নিয়ে তেমন বিপদে পড়তে হলো না সাহিলকে। তার তেমন একটা রাগ হয় না কখনোই
কারো উপর। আবার হলেও দ্রুতই সে সেটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। ছোটবেলা থেকেই সাহিল
পছন্দের মানুষদের সাথে রাগ করে থাকতে পারে না। কেউ যখন বকাঝকা করে তখন কষ্ট পায়, অভিমান হয়। কিন্তু নিজেই আবার বুঝতে পারে অকারণে তো কেউ বকা দেননি। অবশ্য
সাহিল এই স্বভাবটা বাবার কাছ থেকে পেয়েছে বলেই মনেহয়। বাবাকে সাহিল কখনোই কারো উপর
রাগ করে থাকতে দেখেনি। বাড়িতে যখনই কারো সাথে বাবার রাগারাগি হয় দু'চার ঘন্টা মধ্যেই বাবা তাকে ডেকে বলেন,
চলো আমরা ভেতরে
ভেতরে একে অন্যেকে দোষারোপ না করে সরাসরি কথা বলি। কথা বলতে গেলে আবারো মতের অমিল হতে পারে। তারচেয়ে চলো লিখে ফেলি যার
যার যুক্তি। এরপর পয়েন্ট ভিত্তিক আলোচনা করা যাবে। এতে অকারণে আমাদের মনে বিষবাষ্প
জমা হবে না। এবং সেটার দ্বারা নিজেকে বা অন্যকাউকে আমরা ক্ষতিগ্রস্তও করবো না। সাহিলের
যদি কখনো কারো উপর রাগ হয় সে এই কাজটি করে। রাগের পেছনের কারণগুলো লিখে ফেলে
পয়েন্ট ভিত্তিক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কয়েক ঘন্টা পর
সেই লেখা দেখলে নিজেই অনেক পয়েন্ট বাদ দিয়ে ফেলে অহেতুক মনে করে। বাবাও এই কথাটিই বলেন। রাগের সময়টায় নাকি খুবই অসহায়
হয়ে পড়ে মানুষ। তাই চারপাশে ধরার মত যাই পায় খপ করে ধরে সেটাকে রাগের পেছনে একটা
যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। এবং তার রাগ আরো জোড়ালো হয় এরফলে। তাই রাগের পেছনের
কারণগুলো যদি লিখে রাখা হয়। তাহলে মন শান্ত হবার পর সেটি চোখের সামনে মেলে ধরলে
নিজের কাছেই অনেক কারণকে অনর্থক মনে হয়। যাক একটা ব্যাপারে অন্তত সে ভালো ছেলে
আলহামদুলিল্লাহ। ভাবতে ভাবতে দন্ত বিকশিত হয়ে গেলো সাহিলের।
একাকীত্ব কিভাবে উপভোগ করে? প্রশ্নটা মনে
হতেই সাহিলের মনে হলো, ধূর একাকীত্ব কি
উপভোগ করার জিনিস হলো। খুব একটা একাকীত্ব ফিলই তো কখনো করে না সে। সারাক্ষণই তো
বাস্তবে নয়তো ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে হাসি-মজা,
গল্প, খুনসুটি চলতেই থাকে তার। কখনো কখনো অবশ্য এমন হয় যে কাউকেই পাওয়া যায় না
আশেপাশে বা অনলাইনে কোথাও। তখন সাহিল ঘুম দেয়। ঘুমের কোন সমস্যা তার নেই। শোবার
সাথে সাথে সে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠে কাউকে না কাউকে পেয়ে যায় আবার
একাকীত্ব দূর করার জন্য। সেই হিসেবে এভাবে বলা যায় যে, একাকীত্বকে সে উপভোগ করে ঘুমিয়ে আর একাকীত্ব দূর করে বন্ধুবান্ধবের সাথে
আড্ডা দিয়ে। গঠনমূলক কিছুই সে করে না আসলে। ক্লাসের বইয়ের বাইরে খুব বেশি একটা পড়ে
না। সৃজনশীল কোন শখও তার নেই। আবারো ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো সাহিলের
ভেতর থেকে। জীবনটাকে কি উদ্দেশ্যহীন ভাবে কাটিয়ে দিচ্ছে এরআগে কখনোই বুঝতে পারেনি।
যাইহোক, যা করে ফেলেছে
সেটা তো বদলে ফেলা যাবে না। এখন থেকে সে নিশ্চিত একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোবে
ইনশাআল্লাহ। এরপরের প্রশ্নের উত্তরে মন দিলো সাহিল। কি কি বা কোন কোন জিনিস তাকে
ক্লান্ত করে?! সারাবছর যেহেতু
ঠিকমতো পড়াশোনা করে না তাই পরীক্ষা এলেই সে সবচেয়ে বেশি ক্লান্তি বোধ করে পড়ার
চাপে। পড়তে পড়তে শরীর মন ভেঙে পড়ে। জানা জিনিসও ভুলে যায়। মাথার ভেতরটা কেমন যেন
ফাঁকা হয়ে যায়। এই যেমন গতরাতে ফিজিক্স অর্থ কি সেটাই মনে করতে পারছিল না। মানসিক চাপ বা ক্লান্তি আসলেই ভয়াবহ জিনিস। নিয়মিত পড়াশোনা করতে
হবে এখন থেকে। আরো একবার মনকে এই ব্যাপারে দৃঢ় প্রতীজ্ঞ করে নিলো সাহিল। হঠাৎ মনে
পড়লো বেশ কিছুদিন আগে আদী ভাইয়া ট্রেনিং সেন্টারের ক্লাসে তাদেরকে কিছু প্রশ্ন দিয়েছিল
এবং চিন্তাভাবনা করে উত্তর লিখতে বসেছিল। কিন্তু আলসেমি করে বসাই হয়নি প্রশ্নগুলো
নিয়ে। রুমে গিয়ে প্রশ্নগুলো লেখা সেই কাগজটা খুঁজে বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলো
সাহিল।
১. তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?
২. “সময়”কে তুমি কিভাবে দেখো?
৩. রুটিন মেনে চলা কি পছন্দ করো?
৪. পড়াশোনা করতে কেমন লাগে?
৫. ক্লাসের বই ছাড়া অন্য কি ধরণের বই পড়তে ভালো লাগে?
৬. অবসরের উপকরণ সমূহ কি তোমার?
৭. তোমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি?
৮. মনখারাপ হলে কি করো?
৯. কোন জিনিসটা ছাড়া তোমার দিন চলেই না?
১০. কোন বিষয় কঠিন লাগলে কি করো?
১১. জীবনের সার্থকতা কিসের মাঝে খুঁজে পাও?
১২. যদি একবাক্যে জানতে চাওয়া হয় তোমার কাছে পরিবারের গুরুত্ব?
১৩. পড়ার সময় কি নোট করতে পছন্দ করো?
১৪. কেমন পরিবেশে পড়তে সবচেয়ে বেশি আনন্দ বোধ হয়?
১৫. পড়ার জন্য কি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা আছে?
১৬. তোমার ভীষণ প্রিয় তিনটি বইয়ের নাম বলো!
১৭. ‘মুমিন মুমিনের
আয়না’ এটি কি বিশ্বাস
করো?
১৮. কারো সাথে বন্ধুত্ব করো কিসের ভিত্তিতে?
১৯. স্বপ্ন দেখো? খোলা চোখের
স্বপ্ন? খুব বেশি দেখো
এমন একটা স্বপ্ন বলো।
২০. তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে?
প্রশ্নগুলো নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লো সাহিল। আবার একটু অবাকও হলো ভেবে তাকে তো
অন্যকারো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে।
অথচ উত্তর কি লিখবে সে ভেবে পাচ্ছে না! এটা কি খুব বেশি অদ্ভুত না যে সে নিজের
সম্পর্কেই ভালো মত জানে না?! অথচ নিজেকে জানার
প্রয়োজনীয়তা তো তার অজানা নয়!
আদী ভাইয়া কি তাদেরকে
এইজন্যই প্রশ্নগুলো দিয়েছিল যাতে উপলব্ধি করতে পারে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞতাকে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, প্রতিদিন
তিলাওয়াত, কোরআনের তাফসীর ও
হাদীস অধ্যয়ন অবশ্যই করে সাহিল। কিন্তু মুমিন মুনিনের আয়না এটা বিশ্বাস করে কিনা
সেটা তো কখনোই ভেবে দেখার চিন্তা মনে আসেনি! ফেসবুকে তার চার হাজারের উপরে
ফ্রেন্ড। নিয়মিত যোগাযোগ থাকে এমন ফ্রেন্ডের সংখ্যাও পঞ্চাশের উপরে। হ্যা এটা অবশ্যই খেয়াল রাখে সাহিল যাতে অশ্লিলতা
সমর্থন ও প্রচার-প্রসার ঘটায় এমন কেউ যেন না আসে তার ফ্রেন্ড লিষ্টে। কিন্তু এছাড়া
তো তেমন কিছু ভেবে দেখে না কখনোই। আজকের আগে তো ভেবে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
পরীক্ষায় পাশ করতে হবে তাই নাকে মুখে পড়ে সবসময়। পড়ার সাথে পরিবেশের সম্পর্ক থাকতে
পারে এমন চিন্তাও কখনো উদয় হয়নি মনে! এককথায় পরিবারের গুরুত্বই বা কি বলবে? স্বপ্ন তো কত রকমেরই দেখে। ভাইয়াদের রুমে গেলে সেলফে সাজিয়ে রাখা মেডেল, ট্রফি দেখে খোলা চোখেই স্বপ্ন
দেখে একদিন তার
রুমেও এমন মেডেল, ট্রফিতে ভর্তি
একটা সেলফ হবে। কিন্তু এটা যে সম্ভব না সেটাও জানে। সময়কে নিয়ে তো ভাবেই না
পরীক্ষার সময় ছাড়া! আর ভাবতে ইচ্ছে করলো না সাহিলের নিজের সম্পর্কে। নিজের দিকে
তাকাতে পারছে না সে। কেমন যেন সংকুচিত হয়ে আসছে ভেতরটা। অবনত হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি।
একজন মুসলিমের জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত সে খুব ভালো মতই জানে। তেমনি এটাও জানে
তার জীবন যে লক্ষ্যহীন ছুটে চলছে। উঠে দাঁড়ালো সাহিল। আপা এখন ব্যস্ত কিন্তু তার
সৌভাগ্য যে ভাইজান এখন এখানেই আছেন।
দ্রুত পায়ে
ভাইজানের রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। এইটুকু অন্তত খুব ভালো মতো জানে ও বোঝে
সাহিল যে, হতাশাকে কখনোই
মনে বাসা বাঁধতে দেয়া চলবে না। এখন তার কারো সঙ্গের প্রয়োজন। এমন কারোর যে তাকে
সাহায্য করবে ভুলে ভরা জীবন থেকে বেড়িয়ে আসতে ইনশাআল্লাহ।
@
নিজেই নিজের সম্পর্কে ঠিকমতো জানে না! এই উপলব্ধি থেকে সাহিলের লজ্জা ও
অপরাধ বোধে নিমজ্জিত চেহারাটা দেখে ভীষণ মায়া লাগছিল জাওয়দের। জীবনে সুবহে সাদিক আসার জন্য আঁধার ছেয়ে যাওয়ায় কোন বিকল্প নেই। একথা জানে বলেই হয়তো দুঃখিত
হবার বদলে আনন্দিত বোধ করছিল জাওয়াদ ছোট ভাইয়ের অবস্থা দেখে। মানুষের জীবনের
পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে
জরুরী হচ্ছে, তার ভেতর এই
আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হওয়াটা যে, সে এতদিন ভুলের
পথে ছিল! এই বোধ একবার জাগ্রত হয়ে গেলে যে নিজেই নিজের সংশোধনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। আর তখনই কারো পক্ষে সম্ভব হয় সেই ব্যক্তিকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা।
কোন মানুষ যেই পর্যন্ত নিজে না চায়, কারো পক্ষে সম্ভব
নয় তাকে আত্মোন্নয়নের পথে পরিচালিত করা। কেননা আত্মিক শুদ্ধতা কোন মেডিসিন না যে
জোড় করে খাইয়ে দেয়া সম্ভব হয়। এর প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে ব্যক্তিকে উপলব্ধি করতে
হবে। তাহলেই কেবল সম্ভব তার আত্মশুদ্ধি বা পরিবর্তন। মানুষের যেই গুণগুলো একই সাথে
কল্যাণকর এবং অকল্যাণকর তার মধ্যে একটি হচ্ছে যে কোণ অবস্থা বা পরিস্থিতির সাথে
দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। এই গুণের ফলে মানুষ যেমন শত দুঃখ-বেদনা-অপ্রাপ্তির পরেও
আবারো হাসতে পারে। আবার এই দোষের কারণেই মানুষ তার ভুল পথ ও মতের উপর বেহুঁশের মত
চলতে পারে। যখন কোন মানুষ নিজে এটা বুঝতে পারে। তখনই আসলে শুরু হয় তার জীবনের সঠিক
লক্ষ্যে পানে ছুটে চলা। জাওয়াদ বুঝতে পারছিল সাহিল আজ নিজেকে দেখেছে বিবেকের
আয়নায়। মনের যে দ্বার রুদ্ধ ছিল, যে জানালাগুলোতে মরচে পড়ে গিয়েছিল বন্ধ থাকতে থাকতে। আজ সব খুলে গিয়েছে।
হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়া আলোর বন্যায় তাই চোখ ধাধিয়ে গিয়েছে সাহিলের। সইতে পারছে না আলোর
উত্তাপ। বদ্ধ ঘরের বাতাসের এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, বিশুদ্ধ বাতাসের ঠিকভাবে শ্বাস
নিয়ে পারছে না।
কিন্তু এতে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। এই আলো এই বাতাসের সাথেও নিজেকে মানিয়ে নেবে
সাহিল দ্রুতই ইনশাআল্লাহ। অতঃপর শুরু হবে একটু একটু করে নিজের মাঝ থেকে নিজেকে
খুঁজে বের করে, সঠিক গন্তব্যের
পানে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলা।
সাহিলের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো জাওয়াদের। নূহার সাথে ছায়ার মতো লেগে
থাকতো সারাক্ষণ। যখন সাহিল হাঁটতে
শিখেছিল। এক পা দু পা করে হাঁটতে গিয়ে যখন পড়ে যেত। বড় বড় চোখ করে নূহার দিকে
তাকিয়ে দু’হাত বেড়িয়ে বলতো, আপা তোলে। নূহা তখন নানান কথা বলে, হেসে আবার উঠে দাঁড়ানোতে উৎসাহ যোগাতো সাহিলকে। এবং একসময় সাহিল উঠে দাঁড়াতো।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো নূহার কোলে। পবিত্র হাসির বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে বলতো, আপা আমি উইন, আমি উইন। খুব
ছোট্ট বেলাতেই উইন শব্দটা শিখে ফেলেছিল সাহিল। উইন হবার স্পিডও ওর ভেতরে ছিল। সেই স্পীড সাহিল ধরে রাখতে পারেনি সেই ব্যর্থতা শুধু ওর একার
নয়, তাদের সবার’ই। প্রতিটা শিশুর মধ্যেই সম্ভাবনার আলো থাকে। প্রতিটা শিশুরই একজন রাহ’বার প্রয়োজন পড়ে সঠিক গন্তব্যে এগিয়ে যাবার জন্য। তাই কারো মধ্যের
সম্ভাবনার আলো যদি নিভু নিভু হয়ে যায়, চলতে শুরু করে
ভুল পথে। সেটা দায় শুধু তার একার নয়। সেই দায় তাদেরও যারা ছোট্ট আলোর বিন্দুটিকে
প্রজ্জলিত আলোক শিখায় রূপান্তরিত করতে সহায়তা করতে পারেনি। হাত ধরে গন্তব্যের পথে
বিছিয়ে থাকা চোরাকাঁটা, খাঁদা-খন্দ পাড়
করিয়ে দিতে পারেনি। তাই সাহিলের এই অবস্থার জন্য নিজেকেও দায়ী মনেহলো জাওয়াদের।
সাহিলকে আবারো হাঁটতে শেখাতে হবে। পার্থক্য শুরু এবার শেখাতে হবে মানসিক ভাবে
হাঁটা। হাত ধরে পার করে দিতে হবে কন্টকাকীর্ণ পথ! ওর মনে জাগাতে হবে জীবনের প্রকৃত
বোধ। বোঝাতে হবে জীবনের জটিলতা! শেখাতে হবে ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া! জানাতে হবে
চাইলেই জীবনে সবকিছু হাজির হয়ে যায় না। সেজন্য কষ্ট করতে হয়, চেষ্টা করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়।
কিন্তু তারপরেও সেটি থেকে যেতে পারে অধরাই। আর এইসব শিক্ষা শুধু কারো মুখে শুনে
শুনে, বা কাউকে দেখে
দেখে উপলব্ধি করাটা খুব বেশি কঠিন। তবে হ্যা পড়ে পড়ে অর্জন করাটা সেই তুলনায় বেশ
সহজ।
মানুষের শেখার মাধ্যম সাধারণত তিনটি। মানুষ নিজ অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, অন্যেকে দেখে শেখে এবং পড়ে শেখে। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বেশির ভাগ সময়ই
শিখতে পারে না জ্ঞানের অভাবে। অন্যেকে
দেখে শিখতে পারলেও। সেটাকে সঠিক মাত্রায় কাজে লাগাতে পারে না জ্ঞানের স্বল্পতার
কারণে। তাই পড়ে শেখাটাকেই নিজের জন্য সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে জাওয়াদ। এতে একটা বিষয় নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা করে মূল জিনিসটাকে খুঁজে পেতে অনেক সহজ মনেহয়। যত বেশি
জ্ঞানার্জন করা হবে নিজেকে তত বেশি জানার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। যখনই কুরআনের তাফসীর
বা হাদীস নিয়ে বসে। রাসূল (সঃ) ও সাহাবীদের উন্নত চরিত্র, ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরোপকার, ধৈর্য্য ইত্যাদি
সম্পর্কে পড়ে, অনুভব করার
চেষ্টা করে। তখন বুঝতে পারে মুসলিম হিসেবে কতটা দীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় দিন যাপন করছে
সে। কারো মুখ থেকে শুনে কখনোই হয়তো এভাবে উপলব্ধি করতে পারতো না। একটা অভিজ্ঞতার
মধ্যে দিয়ে যাবার সময় সেটি থেকে শিক্ষা নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করাটা সুকঠিন। অন্যেকে
দেখে অবস্থায় গুরুত্ব একই ভাবে অনুভব করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া যুক্তি কাজ করে
অবচেতনে, আমি তো তার মত
নই। কিংবা দূর থেকে দুটা পরিস্থিতিকে একই মনে হলেও পার্থক্য থাকে যথেষ্ট। ঠিক যেমন
একই চেহারার দুজন জমজ ভাই বা বোনের বাহ্যিক মিল যতই থাকুন না কেন, অভ্যন্তরীণ পার্থক্যই বেশি থাকে।
তাই নিজে পড়ে
জ্ঞানার্জন করাটাকেই সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেয় জাওয়াদ। সাহিলকে এখন এটাই
বোঝাতে হবে। যত বেশি জ্ঞানার্জন করবে, সেই জ্ঞানের
আলোতে নিজেকে তত স্পষ্ট ভাবে দেখতে, চিনতে, জানতে ও বুঝতে । আর যত নিজেকে জানবে ও বুঝবে জীবনে আগত সমস্যাগুলোকে কিভাবে
মোকাবিলা করতে হবে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠবে। এবং
নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে জীবনের সঠিক ও মূল লক্ষ্য পানে। সেজন্যই এই ধরণের প্রশ্নগুলো তৈরি করা হয়েছিল ট্রেনিং সেন্টারের
স্টুডেন্টদের জন্য। যাতে সবাই উপলব্ধি করতে পারে সে যে, তারা আসলে হাওয়ায় ভেসে চলছে। ডানা মেলে উড়াকে অপছন্দ করে না জাওয়াদ। বরং
সমর্থন করে ভীষন রকম। কিন্তু ডানা মেলে উড়ার আগে অবশ্যই মাটিতে পা দু’খানিকে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে নিতে হবে। যাতে কখনো যদি ডানা ভেঙ্গেও যায়, অন্তত হুমড়ি খেয়ে যেন পড়তে না হয় মাটিতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন