সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আঁধারে দীপ জ্বেলে যাই...১৬



দূর থেকে তাকে দেখা মাত্রই নাবিহাকে মুখ ঘুরিয়ে বসতে দেখে নূহা বুঝতে পারলো আজ খুব অভিমান হয়েছে তার কন্যার। তা না হলে দেখা মাত্রই মামণি বলে চিৎকার করে ছুট লাগাতো। অবশ্য অভিমান করাটা মোটেই অযৌক্তিক না নাবিহার। নূহা বলেছিল অল্প একটু কাজ করবে এবং বাকি সময় ওদের সাথে কাটাবে। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে গত সাত ঘন্টায় এক মূহুর্ত সময়ও কাটানো হয়নি বাচ্চাদের সাথে। একবারে কাজ সেরে বাচ্চাদের কাছে আসতে চেয়েছিল। যাতে বার বার ডাক না আসে। সেকথা বাচ্চাদেরকে বুঝিয়ে বলা হয়নি এটাই হয়েছে ভুল। কি করে কন্যার অভিমানী মনে ফুল ফোটানো যায় ভাবতে ভাবতে নাবিহার কাছে পৌঁছে গেলো নূহা। এরপর নাবিহার গা ঘেঁষে বসে আদুরে কন্ঠে বলল, খুকুমণির হয়েছে বুঝি অভিমান? মামণি কি ধরবো টেনে কান? না না তোমার কান কিন্তু নয়! এমন চিন্তাতেও মনে জাগে ভয়! তুমি যে আমার অন্তরের খুশি! তোমায় আমি বড্ড ভালোবাসি! দু'নয়নের শীতলতা তুমি মোর!আঁধারের অবসানে সুহাসিনী ভোর!তোমার খুশিতে উচ্ছলিত হয় হিয়া! স্বপ্নের উদাসী ক্ষণে তুমি আশা জাগানিয়া! সমস্যার গোলকধাঁধায় হয় যখন ভীরু প্রাণ! আলোক রুপে দাও সুবহে সাদিকের সন্ধান! শুকনো ডালে তুমি সুখানন্দের রেনু! তুমিই আমার আকাশ জোড়া রঙধনু! নানান যাতনায় হই যখন পেরেশান! শোনাও মোরে সুন্দর জীবনের গান! হয়ে আলোকিত বাতায়নের প্রতিচ্ছায়া! তপ্ত দাহে দাও হিমেল সুবাসিত ছায়া! ক্ষমা করে দাও কন্যা মোর অভিমানী! দুঃখের কণ্টকাকীর্ণ পথে তুমিই যে সুখ কুড়ানি!

কবিতা শুনে আর মুখ গোমড়া করে রাখতে পারলো না নাবিহা। হেসে ফেলে বলল, তুমি একটা কঠিন দুষ্টু মেয়ে। সবসময় পটিয়ে ফেলো আমাকে।

মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে নূহা বলল, আর তুমি একটা সোনার কন্যা। তাই তো মামণির কথায় বার বার পটে যাও। লাভ ইউ।

লাভ ইউ ঠু মামণি। কিন্তু তুমি যে আমাদের খোঁজই নিলে না সারাদিন। এটা কি ঠিক হয়েছে? পাপা আর বাবা না এলে আমাদেরকে তো একা একা থাকতে হতো।

আই এম রিয়েলি ভেরি সরি সোনা। মামণি সব কাজ সেরে একবারে তোমাদের কাছে আসতে চেয়েছিলাম। যাতে আবারো কেউ ডাকতে না আসে। তাই দেরি হয়ে গিয়েছে। জিহাদ, জিশান আর জারিফ কোথায়?

তিনজনই পাপা আর বাবার সাথে পার্কে ফুটবল খেলতে গিয়েছে।

আচ্ছা। তোমার বাবা কখন এসেছে?

বাবা তো পাপার সাথেই এসেছে। আমরা সবাই আনন্দ করবো আর বাবা একা একা কাজ করবে সেটা কি হয়?

নূহা হেসে বলল, কখনোই হয় না। তোমার পাপা কখনোই এমনটা হতে দেবেন না ইনশাআল্লাহ। উনি নিজে বঞ্চিত হবেন আনন্দ থেকে। কিন্তু অন্য কেউ যাতে কখনোই তার ভাগের এক বিন্দু আনন্দ থেকেও বঞ্চিত না হয় সেদিকে পরিপূর্ণ খেয়াল রাখবেন।

নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ সেজন্যই তো পাপা বাবাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে। মামণি পাপার চেয়ে ভালো কোন মানুষ কি আছে পৃথিবীতে?

নূহা হেসে ফেলে বলল, পৃথিবীতে হয়তো তোমার পাপার চেয়েও ভালো অসংখ্য মানুষ আছেন। কিন্তু তোমার আর আমার পৃথিবীতে উনার চেয়ে ভালো কেউ নেই। আর আমাদের জন্য এটাই তো যথেষ্ট তাই না?

নাবিহা হেসে বলল, হ্যা। কিন্তু তাহলে তুমি কেন পাপাকে কষ্ট দাও।

কষ্ট দেই? কখন আবার তোমার পাপাকে কষ্ট দিলাম আমি?

এই যে তুমি ঐ দুষ্টু আন্টিটার সাথে গল্প করছিলে হেসে হেসে। পাপা দেখে খুবই বিরক্ত হয়েছে। তুমি তো জানো পাপা ঐ আন্টিকে পছন্দ করেন না। তাহলে তুমি কেন কথা বললে? বলো বলো কেন কথা বললে? জবাব দাও এখন আমাকে!
নূহা হেসে বলল, তোমার পাপার মতো অদ্ভুতুড়ে মানুষ দুনিয়াতে দুটা নেই বুঝলে? কোন মেয়ে উনাকে পছন্দ করে এটা জানতে পারলে সেই মেয়েকে উনি আর সহ্য করতে পারেন না। উনি নাকি সেই মেয়ের মাঝে শয়তানের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পান। ছোটবেলায় কোনভাবে এই তথ্যটা উনার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। এরপর আর এটা বের করেননি। এই ব্যাপারে উনাকে বোঝানোর সাধ্যও কারো নেই।

নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, কোনভাবে নাতো মামণি। মাহমুদ দাদাভাই এই তথ্য পাপা, চাচ্চুদের সবার মাথায় ঢুকিয়েছিলেন। মাহমুদ দাদাভাই বলেছিলেন, জগতকে গড়ে তোলার হাতিয়ার সমূহের একটি হচ্ছে, ভালোবাসা। তবে সেই ভালোবাসাকে হয়ে হবে পবিত্র ও বৈধ। মনে রাখবে ভালোবাসাকে অপবিত্র করে নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক। তাই মেয়েদের কাছ থেকে সর্বদা দূরে থাকবে। কোন মেয়ে যদি কাছে আসতে চায় নানান কৌশলে বুঝে নেবে, এটা ভালোবাসা নয় সুস্পষ্ট শয়তানের ফাঁদ। দাদুভাই আরো অনেক কথা বলেছিলেন। ভুলে গিয়েছি আমি।

নূহা হেসে বলল, ছোট চাচ্চু পাগল ছিলেন। উনার নানান পাগলামো ঢুকিতে দিয়েছেন তোমার পাপা আর চাচ্চুদের মধ্যে। সবচেয়ে বেশি ঢুকেছে তোমার পাপার মধ্যে। যাইহোক, তুমিই ভেবে বলো শুধুমাত্র তোমার পাপা পছন্দ করেন না বলে কি আমি একজন দ্বীনি বোনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি? তাকে সংশোধনের চেষ্টা না করে ভুলের পথে ছেড়ে দিতে পারি?

হুম, সেটাও তো ঠিক। মামণি আমাকে বলবে?

কি বলবো?

মুনা আন্টির ঘটনা।

নূহা হেসে বলল, কেন পাপা বলেননি তোমাদেরকে?

উহু, তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে বলেছে। বলো না প্লিজ মামণি।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে নূহা হাসি মুখে বলল, যখন রিহ্যাব সেন্টার তৈরির কাজ চলছিল তখন আমরা এখানে ছয় মাসের মতো ছিলাম। এখন তো এই এলাকাতে বেশ অনেক মানুষ। পনেরো বছর আগে লোকসংখ্যা ছিল সব মিলিয়ে তিন হাজারের মতো। বাঙ্গালী পরিবার শুধু মুনারাই ছিল। এছাড়া চারটি পাকিস্তানী এবং দুটি ইন্ডিয়ান মুসলিম পরিবার ছিল। আমি যখন এখানে এসেছিলাম মুসলিম পরিবার গুলোর অবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হয়েছিলাম। একদম ইউরোপিয়ানদের মতই ছিল সবার জীবনযাত্রা। তোমার পাপা পরামর্শ দিয়েছিলেন মন খারাপ করে বসে না থেকে উনাদেরকে মুসলিমদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দেবার চেষ্টা করতে। এখানে আসার এক সপ্তাহ পরেই আমি মুনাদের পরিবার, পাকিস্তানী ও ইন্ডিয়ান পরিবারদের সবাইকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলাম। সেদিনই মুনার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল। আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট ছিল বয়সে। প্রায় সমবয়সী মুনাকেই পেয়েছিলাম এখানে। খুব দ্রুতই ওর সাথে অনেক সুন্দর একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। তোমার পাপা সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতেন। হসপিটালের ডিউটি সেরে এসে রিহ্যাভ সেন্টারের কাজ দেখতেন। আমার সকালে মেডিকেলে ক্লাস থাকতো কিন্তু এরপর বাসায় একদম একা। মুনা রোজই চলে আসতো। সারাটা বিকেল একসাথেই কাটাতাম আমরা। তোমার পাপা বাসায় ফেরার পর চলে যেত মুনা। কিন্তু যতক্ষণ থাকতো বিভিন্ন ভাবে শুধু তোমার পাপার কথাই জানতে চাইতো।
তুমি বলতে কেন? ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করলো নাবিহা।

নূহা হেসে বলল, ঐ সময় আমার বয়সও তো অনেক কম ছিল মা। তাছাড়া পরিবারের বাইরে কারো সাথে তেমন করে মেশাই হয়নি ধরতে গেলে। তাই কারো মুখের কথা ও মনের ভাবনার পার্থক্য ধরতে পারতাম না। বিশ্বাস করতে ভালোবাসতাম সবাইকেই। কারো কোন কথা বা কাজের পেছনে নেতিবাচক কিছুর সন্ধান করতাম না। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, তোমার পাপা কখনোই শুধু আমার হাজবেন্ড ছিলেন না। ছোটবেলা থেকে উনি আমার রোল মডেল। আমার হিরো। উনার হাত ধরে আমি আলোর পথে প্রথম কদম রেখেছিলাম। উনার কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আশার বাণী বলতে শিখেছিলাম। উনার স্বপ্নের মাঝেই আমি আমার সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্নের সন্ধান পেয়েছি। উনি কখনো বাবার মতো ছায়াদানকারী বৃক্ষ ছিলেন আমার জন্য। কখনো মায়ের মতো অবুঝ আমাকে পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়েছেন। ভাইয়া হয়ে সহ্য করেছেন জেদ, পূরণ করেছে শত উদ্ভট আবদার। বন্ধুর মতো বুঝেছেন, পাশে থেকেছেন কখনো নীরবে, কখনো বা সরবে। রাহবার হয়ে পথ প্রদর্শন করেছেন। শিক্ষক হয়ে বুঝিয়েছেন কিভাবে ভুলগুলোকে ফুলের মতো প্রস্ফুটিত করতে হয়। আমার মনের খুবই ছোট্ট একটা অংশে উনি প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সারাটা মন জুড়ে উনিই ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে। তাই কেউ যখন উনার কথা জিজ্ঞেস করতো আমি হড়বড় করে বলতে শুধু করতাম, উনাকে ঘিরে আমার মনের প্রাপ্তিগুলোকে। এখন যেমন তোমাকে বলছি।

নাবিহা হেসে বলল, কারণ পাপা এখনো তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।

নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। যাইহোক, আমি যেদিন প্রথম জেনেছিলাম তোমার পাপাকে ঘিরে মুনার ভালো লাগার কথা। সেদিনও মনে হয়েছিল অজান্তেই মুনার ভালো লাগাতে ডানা আমিই লাগিয়ে দিয়েছি। আমিই ওকে উড়ার স্বাধীনতা দিয়েছি। তাই সেদিন যেমন আমি ঘৃণা ভরে মুনাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারিনি। আজও পারিনি। তারউপর এখনো মুনা একা জেনে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। জীবনের অনেকটা সময় আমি শুধু নিজের মাঝেই নিমজ্জিত হয়ে পাড় করে দিয়েছি। তাদের কারো একবার খোঁজ নেবার চেষ্টাও করিনি। যারা হয়তো কোন না কোন ভাবে আমার প্রতীক্ষা করেছে। অতীতের উদাসীনতা নিয়ে আফসোস করতে চাই না আমি। বরং যা যা করণীয় ছিল আমার কিন্তু করতে পারিনি। সেগুলো যতটুকু সম্ভব করতে চাই এখন।

নাবিহা হেসে বলল, মামণি চলো মুনা আন্টিকে বিয়ে দিয়ে দেই। সালমান চাচ্চুর সাথে। গতবার যখন আমরা এখানে এসেছিলাম। আমিনা দাদুমণিও এসেছিল আমাদের সাথে। মুনা আন্টিকে দেখে আমিনা দাদুমণি বলেছিলেন, মেয়েটা তো একদম পরীর মতো সুন্দর। সালমানের সাথে বিয়ে দিলে কেমন হয়? পাপা কটমট করে বলেছিলেন, সেটা সালমানকে জিজ্ঞেস করো। আমার সাথে বিয়ে-শাদী নিয়ে কোন কথা বলবে না।

নূহা হেসে ফেললে নাবিহাও মনের আনন্দে কিছুক্ষণ হাসলো। এরপর বলল, পাপা আর বাবা মিলে চকলেট পেস্ট্রি আর চিকেন প্যাটিস বানিয়েছে। তোমার জন্য নিয়ে আসি? সাথে কফি?

নূহা হেসে বলল, আচ্ছা নিয়ে এসো। তবে সাথে চা। চলো আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।

নাবিহা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না তুমি বসে থাকো এখানে। তোমার মেয়ে এখন বড় হয়েছে তো মামণি। তুমি এখন আরাম করো। হেসে নাবিহার নাক টেনে দিলো নূহা। নাবিহাও আনন্দিত মনে মামণির জন্য নাস্তা আনতে গেলো। নাবিহা চলে যাবার পর চারপাশে চোখ বুলাতে গিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগও পেলো না নূহা। তার আগেই অদৃশ্য কিছু টেনে নিয়ে গেলো তাকে স্মৃতির রাজ্যে।

@

নীরবতা ভালো লাগে তাই শহর থেকে বেশ একটু দূরে ছোট্ট এই গ্রামে এসে ভীষণ ভালো লাগছিল নূহার। কিন্তু তাদের ছোট্ট কটেজটার চারপাশটা একদম গাছাপালা ঢাকা থাকার কারণে সারা দিন ভালো লাগলেও, সন্ধ্যা হতেই কেমন গা ছমছমে অনুভূতি হয়। আশেপাশের বাড়ি গুলোও অনেক দূরে দূরে। রাতের রান্না শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো নূহা। প্রায় দশদিন আগে এলেও আজই প্রথম সন্ধ্যার পর একাকী বাসায়। গত কয়েকদিন জাওয়াদ সাথে সাথেই ছিলো। বাসা গোছগাছ করতে সাহায্য করেছে নূহাকে। সংসারের টুকিটাকি সবকিছু দুজনে মিলেও ঘুরে ঘুরে কিনেছে। আজ ইমার্জেন্সির কারণে রাতে ডিউটিতে যেতেই হয়েছে। যদিও বলেছিল রাত দশটা নাগাদ ফিরে আসবে। কিন্তু সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে নূহার। দেড় বছরের বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা খুব ভালো মতো বুঝে গিয়েছে। তার ডক্টর সাহেব সব ব্যাপারে এক কথার মানুষ হলেও, ঘরে ফেরার ব্যাপারে নাইনটি নাইন পার্সেন্ট সময় কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেন না। তবে নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাবার পর থেকে বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত কিছুক্ষণ পরপর দুষ্টু-মিষ্টি ম্যাসেজ পাঠানোতে সে মহা ওস্তাদ। হাসিমুখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে আটটা বাজে। কিভাবে সময় কাটাবে ভেবে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো নূহা। ভেবে চিন্তে সেলফে বই সাজানোর আইডিয়াটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ হলো। ছোট্ট একটা রুম ছিলো সেটাকেই জাওয়াদ লাইব্রেরী বানিয়েছে। জানালা খুলে দিয়ে বই গোছানোতে মন দিলো নূহা। বই গোছানোতে এতটাই আত্মমগ্ন হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ পেছন থেকে হাই শুনে প্রচন্ড রকম চমকে উঠলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো জানালার দিয়ে তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে মুনা। নূহাকে চমকে উঠতে দেখে হাসির বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে মুনা বলল, আমি মনেহয় তোমাকে চমকে দিয়েছি আপি। অনেক সরি।

নূহা হেসে বলল, তা অবশ্য কিছুটা দিয়েছো। ঘুরে এসো আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। হাতের বইটা সেলফে ঢুকিয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো নূহা। যাক একা একা আর সময় কাটাতে হবে না। গত তিনদিন আগে পরিচয় হয়েছিল মুনার সাথে। তাদের একটা বাড়ি পরেই মুনাদের বাসা। বয়সে নূহার বছর দেড়েকের ছোট। খুবই প্রাণবন্ত, হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে মুনা। গতকাল যখন জাওয়াদের সাথে বিকেলে হাঁটতে বেড়িয়েছিল তখনো দেখা হয়েছিল মুনার সাথে। জাওয়াদ দুজনকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে বাসায় চলে এসেছিল। এমনিতে কাউকে পছন্দ করতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় নূহার। কিন্তু ছটফটে স্বভাব আর মন খুলে কথা বলার কারণে মাত্র কয়েক সাক্ষাতেই বেশ ভালো লেগে গিয়েছে মুনাকে। দরজা খুলে দিতেই চঞ্চল প্রজাপতির মত ছটফট করতে করতে ঘরে ঢুকলো মুনা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল, ওয়াও তোমার ঘর তো একদম ছবির মত সুন্দর।

নূহা হেসে বলল, থ্যাঙ্কইউ। আসলে আমার হাজবেন্ডের ঘর সাজানোর খুব শখ। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বোসো। কি খাবে বলো?

না বসবো না। তবে তোমার হাতের কফি খাবো আরেকটু পর। চলো তোমাকে বই গোছাতে সাহায্য করি।

কি করে জানলে আমি বই গুছাচ্ছিলাম?

আমি অনেকক্ষণ থেকে জানালায় দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছিলাম। তুমি বই গোছানোতে এত আত্মমগ্ন ছিলে খেয়ালই করোনি। বই পড়তে খুব পছন্দ করো তুমি তাই না?

ভীষণ। কেন তোমার ভালো লাগে না বই পড়তে?

মুনা চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি কি পাগল মনেকরো আমাকে? বই কোন সুস্থ্য মানুষের পছন্দের জিনিস হতে পারে? বইয়ের চেয়ে বড় কোন শত্রুই নেই আমার কাছে দুনিয়াতে। একটা জিনিস খুলে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকা। এরচেয়ে বোরিং আর কোন কাজ হতে পারে বলো! হাসলো নূহা। আচ্ছা তোমার তাহলে কি পছন্দ?

আনন্দে ঝিলমিল করে উঠে মুনা বলল, আমার? বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া পছন্দ, শপিংয়ে যাওয়া পছন্দ, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া পছন্দ। তবে সবচেয়ে বেশি পছন্দ গভীর রাতে একা একা হরর মুভি দেখে ভয় পেতে।

হরর মুভি দেখে ভয় পেতে পছন্দ?

খিলখিল করে হেসে উঠলো মুনা। হু অন্নেক অন্নেক বেশি পছন্দ। তুমি দেখো হরর মুভি?

না আমার আসলে মুভি দেখা হয় না।

চারপাশে চোখ বুলিয়ে মুনা বলল, তোমার হাজবেন্ড নেই বাসায়?

না উনি ডিউটি গিয়েছেন। রাত হবে ফিরতে।

বেশ লম্বা করে টেনে ওওও... বললো মুনা। চেহারা মলিন হতে হতেই আবার নিজেকে সামলে নিলো মুনা। হাসি টেনে কন্ঠের উচ্ছ্বাস ফিরিয়ে এনে বলল, কফি খাবো তোমার হাতের। তুমি কফি নিয়ে এসো আমি ততক্ষণে বই গোছাচ্ছি।

নূহাকে হাসি মুখে বেড়িয়ে গেলে পাশের আয়নার তাকিয়ে নিজেকে একবার সতর্ক চোখে দেখে নিলো মুনা। তার মুখ দেখে কিছু টের পায়নি তো নূহা? বুঝতে পারেনি তো সে এই বাড়িতে ছুটে এসেছে নূহার সাথে গল্প করার জন্য নয়। দূর থেকে কিংবা কাছ থেকে জাওয়াদকে শুধু আরেকবার একটু দেখার জন্য। মুনা নিজেও বুঝতে পারছে না তার ঠিক কি হয়েছে। কিন্তু যেদিন প্রথম দেখেছিল জাওয়াদকে দেখেছিল সেদিন থেকে ওর ভুবনটাই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। গতকাল পার্কে নূহার সাথে কথা বলতে বলতে খুব হাসছিল জাওয়াদ। আড়াল থেকে মুগ্ধ চোখে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে ছিল মুনা। কোন মানুষের হাসি এত সুন্দর হয় কিভাবে? আর হাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে থরথর করে কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো মুনার মনের সব কটি জানালা। এত সুদর্শন পুরুষ মানুষ এরআগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারে না মুনা। জাওয়াদের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের স্ফুরণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছে মুনা। সারাক্ষণ ইচ্ছে করে জাওয়াদকে দেখতে, ওর কথা শুনতে, অপলক ওর হাসি ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। মনে এক অংশ বার বার শাসাচ্ছে মুনাকে। মনে করিয়ে দিচ্ছে জাওয়াড একজন বিবাহিত পুরুষ।কিন্তু ভালোলাগা মনে যে তীব্র আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছে সেটার ক্ষমতা এত বেশি মুনা সেই স্রোতেই ভেসে যাচ্ছিলো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন