বেশ অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার চাদর মুড়িয়ে বসে থাকার পর খানিকটা নড়েচড়ে বসলো
নাবিহা। আড় চোখে ভাইদের দিকে তাকালো। জিহাদ
ভাইয়া এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। নিজে নড়াচড়া না করলেও জিশানের চোখের মণি
এক মূহুর্তের জন্য স্থির হচ্ছে না। সারাক্ষণই বাড়িময় ঘুরে বেড়ানোর জন্য ‘চরকা বাবা’ খেতাব অর্জন
করেছে জিশান। এই
মূহুর্তে জিশানের দু’চোখে ‘চরকা বাবার’ প্রতিচ্ছবি দেখতে
পেলো নাবিহা। সবচেয়ে মজা পেলো জারিফকে
দেখে। জারিফের
খেতাব হচ্ছে জাম্পিং বেবী। এর কারণ জারিফ কোথাও এক মূহুর্ত স্থির থাকে না।
সারাক্ষণ লাফাতেই থাকে। তাই এমন চুপচাপ বসে থাকাটা জারিফের জন্যই সবচেয়ে বেশি
কষ্টকর। চোখ ঘুরিয়ে এবার নানাভাই আর নানুমণির দিকে তাকালো নাবিহা। পাপা যখন
তাদেরকে মামণির বাসায় নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল,
তখন নানুমণিও
সাথে ছিল। পাপার প্রস্তাব শুনে যখন চারজন লাফাতে শুরু করেছিল নানুমণি চুপচাপ
বেরিয়ে গিয়েছিল রুম থেকে। তারা সবাই রেডি হয়ে গাড়ির কাছে এসে দেখে নানুমণি আর
নানাভাই আগেই গাড়িতে ঢুকে বসে আছে। কিছু কিছু সময় পাপা কিছুই বলে না শুধু হাসে আর
হাসে। আজও নানাভাই আর নানুমণিকে দেখে হাসতে শুরু করেছিল। পাপার হাসি নাবিহার
সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলোর একটা। পাপাকে হাসতে দেখলে মন যদি অনেক বেশিও খারাপ থাকে
মূহুর্তেই ভালো হয়ে যায়। নাবিহা অনেক গবেষণা করে দেখেছে মামণির চেয়ে পাপার হাসিতেই
ম্যাজিক বেশি। কোনদিন পার্কে ঘুরতে যাবার সময় যদি সাথে দাদুমণি বা নানুমণি থাকে।
পাপাকে হাসতে দেখলেই আঁতকে উঠে বলেন, এই খবরদার তুই
হাসবি না। মানুষের নজর লেগে যাবে। পাপা তখনো মুখে কিছু না বলে হাসতে শুরু করে। আর
দাদুমণি বা নানুমণি সেই সাথে থাকে ছুটে গিয়ে পাপাকে আড়াল করে দাঁড়ায়। যাতে পার্কের
কেউ দেখতে না পারে।
এসব ভাবতে ভাবতে আপন মনেই হাসলো নাবিহা। কত কথা জমেছে এখনো মামণিকে বলা
হয়নি। ফোনে এসব কথা বলতে ভালো লাগে না নাবিহার। মামণির কোলে হেলান দিয়ে বসে এসব
কথা বলতে হয়। যাতে একটু পরপর তাকিয়ে
মামণিকে ঠোঁট
চেপে হাসি আটকাতে দেখা যায়। এই যেমন আজও তো কত দুষ্টু কথা শোনালো পাপা তাকে। চারজন মিলে পাপাকে অভিমানী পত্র লিখে ঝগড়া মিটমাট করে ফেললেও একটুখানি অভিমান
রয়েই গিয়েছিল মনে। কেনই বা থাকবে না? তার বান্ধবীদেরকে
বলেছিল আজ সবাই তাদের পাপার সাথে আসবে। নাবিহাও তখন বলেছিল সেও পাপার সাথে
লাইব্রেরীতে আসবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত যেতে পারলো না। যদিও মন যে খারাপ সেটা পাপা বুঝতে দিতে চাইছিল না। বুঝতে দিলেই পাপা কারণ জানতে চাইবে। আর কারণ শুনলে পাপারও মন খারাপ হবে।
তাই একদম বুঝতে দিচ্ছিলো না যে তার
মন খারাপ হয়েছে।
কিন্তু পাপাকে কোন কিছু বলতে না চাইলে, বুঝতে দিতে না
চাইলেও কিভাবে যেন ঠিক ঠিক বুঝে ফেলে। আজও বুঝে ফেললো। এবং নাবিহার পাশে এসে বসে
বলল, তোমার আর তোমার
মামণির মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল কোথায় জানো? নাবিহা জবাবে বলল, জানি তো। আমাদের দুজনেরই টকেটিভ আইস। তুমিই তো বলেছিলে এই কথা। ক্লান্ত হয়ে
আমাদের মুখ মাঝে মাঝে বিশ্রামাগারে চলে গেলেও,
চোখ কটর কটর
করতেই থাকে, করতেই থাকে। পাপা
তখন হেসে বলল, হুম! কিন্তু একটা কথা তোমার মামণিকে অনেক আগে বলা হলেও, তোমাকে এখনো বলা হয়নি। কটর কটর করার সাথে সাথে তোমাদের দুজনের চোখই বিরাট
চুগলিবাজ। তোমরা যখনই আমার কাছ থেকে কোন কথা গোপন করতে চাও। তোমাদের চোখ আমার কাছে
চুগলি করে এবং তোমাদের মনের সব গোপন কথা বলে দেয়। নাবিহা হেসে ফেলেলে পাপাও
হাসিমুখে বলল, তুমি আর তোমার
মামণি যখন ঠিকমতো কথাও বলতে শেখোনি, তখনো আমি তোমাদের
মনের কথা বুঝে নিয়েছি। তাই এমন চিন্তার কোনই অবকাশ নেই যে, তোমরা বলতে না চাইলে তোমাদের মনের কোন কথা আমার কাছে গোপন থাকবে।
আলহামদুলিল্লাহ আমি তো দেখেই বুঝতে পারি তোমাদের মনে এখন দক্ষিণা হাওয়া বইছে নাকি
ঝরাপাতার সুর! মনেতে কি সূর্যোদয়ের ছায়া, নাকি হারিয়েছে সে
সাঁঝের মায়ায়!
এরপরই পাপা সবাইকে মামণির বাসায় নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল। নাবিহার
সত্যিই আজ খুব মামণির কাছে আসতে ইচ্ছে করছিল। মামণির কোলে মাথা রেখে শুয়ে গল্প
করতে ইচ্ছে করছিল। পাপার কাছে চুগলি করার জন্য তাই মনে মনে চোখের শুকরিয়া আদায়
করলো। সাথে সাথে বলল, তুমি যেমন আমার
মনের ইচ্ছের কথা পাপাকে বলে দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছো। আমিও তেমন তোমার হক আদায়
করে তোমাকে সাহায্য করবো। আমি তোমাকে দিয়ে সবসময় সুন্দর ও পবিত্র জিনিস দেখবো। সকল
অসুন্দর ও অপবিত্র জিনিস দেখা থেকে তোমাকে বিরত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করবো। এবং তোমাকে বেশি বেশি আল্লাহর পবিত্র কালামকে দেখার ও পড়ার সুযোগ করে
দেবো ইনশাআল্লাহ। এই জিনিসটাও পাপাই শিখিয়েছে তাদের সবাইকে। আরো অনেক ছোটবেলায়
একদিন পাপার অনেক পিপাসা পেয়েছিল আর নাবিহা পানি এনে দিয়েছিল। পানি পান করে
নাবিহাকে কোলে বসিয়ে পাপা বলেছিল, আমার সল্টি
বেবিটা কি তার সুন্দর সুন্দর হাত আর সুন্দর সুন্দর পা দুটাকে থ্যাংকইউ বলেছে? এই যে পায়ের সাহায্যে সল্টি বেবী গুটিগুটি করে হেঁটে কিচেন পর্যন্ত গিয়েছে।
এরপর হাত দিতে বটল থেকে পানি ঢেলে পাপার জন্য নিয়ে এসেছে। এজন্য তো হাত আর পা কে
স্পেশাল থ্যাংকইউ দেয়া উচিত তাই না? নাবিহা সাথে সাথে
মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যা। এক্ষুণি
বলে দিচ্ছি পাপা। হাত-পা তোমাদেরকে জাযাকাল্লাহ। পাপা তখন হেসে বলেছিল, এভাবে না আমার সাথে সাথে বল, হাত-পা এই যে
তোমরা আমাকে সাহায্যে করলে পাপাকে পানি এনে দিতে। এবং আমাকে উত্তম কাজ করতে সহায়তা
করলে। সেজন্য আমিও সবসময় সচেষ্ট থাকবো তোমাদের হক আদায়ে। পা তোমার দ্বারা আমি
সবসময় সত্য ও আলোর পথে চলবো। অন্যায় ও ভুল পথ থেকে দূরে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা
করবো। আর হাত তোমাদের প্রয়োগ সর্বদা আমি কল্যাণময় কাজেই করবো ইনশাআল্লাহ। এরপর
থেকে ধীরে ধীরে উত্তম কাজের জন্য শরীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে শুকরিয়া জানানোটা অভ্যাসে
পরিণত হয়ে গিয়েছে।
পাপার কথা ভাবতে ভাবতে নানাভাই’র দিকে তাকিয়ে
চোখ বন্ধ দেখে চিৎকার করে উঠলো নাবিহা, মামণি দেখো
নানাভাই ঘুমোচ্ছে। রাতের নীরব প্রকৃতির ভেতর করে সরবতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে
না।
সৌন্দর্য অবলোকন ও বিমুগ্ধ বর্ণন কনটেস্ট থেকে নানাভাইকে ডিসকোয়ালিফাইড করা
হোক। ছোটখাট হুঙ্কার ছেড়ে বললো জিশান।
নূহা হেসে বলল, শুধু নানাভাই না
সাথে আপনারা দুইজনও ডিসকোয়ালিফাইড। কন্ডিশন কি ছিল আমাদের? কেউ কোন কথা বলবে না দশ মিনিট। এরপর যেই কথা বলবে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ঘিরে
তার মনের আকাশে উদিত ভাবনাগুলো বলবে।
জারিফ দাঁত বের করে বলল, এখনো দশমিনিট
হয়নি। নানাভাই, আপ্পি আর জিশান
ভাইয়া সাথে সাথে মা ও ডিসকোয়ালিফাইড।
নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, এবং আমাদের সাথে
সাথে তুমিও ডিসকোয়ালিফাইড পন্ডিত।
সাথে সাথে তো আঁধারে ঢেকে গেলো জারিফের চেহারা। দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে প্রবল বেগে ডানে-বামে মাথা নাড়তে শুরু করলো।
জিশান হাত বাড়িয়ে মুখ থেকে জারিফের হাত সরিয়ে বলল, হে অনুজ, এখন আর মুখে হাত
চেপে ধরে কোনই লাভ নেই। কথা হচ্ছে তীরের মতো। আর তীর তুমি ছুঁড়ে ফেলেছো। এখন আর
সেটা তোমার তুনিনে ফিরে আসবে না।
কথোপকথনের এই পর্যায়ে সশব্দে হেসে ফেললেন আজাদ সাহেব। জিহাদ তাড়াতাড়ি বলল, নানাভাই এত জোরে হেসো না। পাপা নীচের বারান্দাতে বসে আছে। এক্ষুণি ফোন দেবে
নয়তো।
আজাদ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আচ্ছা মুখ বন্ধ
করার আগে শুধু একটা কথা বলতে চাই। জিহাদ তুমিও ডিসকোয়ালিফাইড।
মিসেস সুরাইয়া নড়েচড়ে বসে বললেন, তারমানে দেখা
যাচ্ছে আমিই ফার্স্ট হয়েছি। অবশ্য এটা কনটেস্ট শুরু হবার আগেই জানতাম। আমি ছাড়া আর
কেউ মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারবে না বেশিক্ষণ। কথা কি ছিল?
জিহাদ হেসে বলল, যে ফার্স্ট হবে
কিংবা সবচেয়ে সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা দিতে পারবে,
আমাদের পরবর্তী
প্রোগ্রাম কি হবে সেই সিদ্ধান্ত সে নেবে।
আলহামদুলিল্লাহ আমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গিয়েছে। সবাই এখন চুপচাপ ঘুমোতে
যাবে।
চিৎকার করে উঠে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালো সবাই। ঘুমোতে যাবার
জন্য কেউই রাজী ছিল না। কিন্তু সিদ্ধান্ত কিভাবে মানাতে হয় সেই ব্যাপারে মিসেস
সুরাইয়ার অভিজ্ঞতার ভান্ডার খুবই সমৃদ্ধ। প্রথমেই তিন নাতী আর স্বামীকে টেনে ধরে
বিছানাতে শুইয়ে দিয়ে এলেন। ফিরে এসে কোমরে হাত দিয়ে বললেন, আপনাদের মাতা-কন্যার তো ঘুমোতে যাবার লক্ষণ দেখছি না!
নূহা হেসে বলল, না না আমরাও
অবশ্যই ঘুমোতে যাবো। তবে আর একটুখানি গল্প করি। চাইলে আপনিও আসন গ্রহণ করতে পারেন
আমাদের আসরে। চোখে-মুখে গাম্ভীর্য ধরে রাখলেও আনন্দিত মনেই মেয়ে আর নাতনীর আসরে
আসন গ্রহণ করলেন মিসেস সুরাইয়া। মামণি বসা মাত্রই এগিয়ে গিয়ে কোল ঘেঁষে বসলো নূহা।
নাবিহাও আরো কাছে সরে এলো নূহার। কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর নাবিহা হেসে বলল, নানুমণি গল্প বলো। মামণির ছোটবেলার কোন মজার গল্প।
মিসেস সুরাইয়া হাসি মুখে বলল, সার্কাসের জোকার
ছিল তোর মামণির ছোটবেলায়। ওর ছোটবেলার সব গল্পই মজার। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে
আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত আমার সারাটা ক্ষণ কাটতো তোর মামণির পেছনে পেছনে ছুটতে
ছুটতে।
নাবিহা হেসে বলল, এত বেশি দুষ্টু
ছিল মামণি?
না মোটেই চঞ্চল বা দুষ্টু ছিল না তোর মামণি। বরং বাড়ির অন্যান্য সব বাচ্চার
চেয়ে শান্তশিষ্ট ছিল। একমাত্র খাওয়া
ছাড়া আর কোন কিছু নিয়েই ঝামেলা করতো না বলতে গেলে। তোর মামণি যন্ত্রণা করতো ওর
উদ্ভট কর্মকান্ড আর কথাবার্তা দিয়ে। এই যেমন ধর একদিন ফুলের টবে পানি দিতে গিয়ে
দেখি গাছের নিচে সাদা সাদা দাগ। ডাক দেয়া মাত্রই নূহা ছুটে এসে বলল, আমাকে ডেকেছো মামনি? যেহেতু ওর কান্ড
জানাই ছিল তাই কান ধরে ঝাঁকিয়ে বললাম, তুই আবার গাছের
গোঁড়ায় দুধ ঢেলেছিস? পাগল হয়ে যাবো
আমি তোর যন্ত্রণায়। কতবার বলেছি তোকে এই কাজ না করতে। আচ্ছা তুই কথা কেন শুনিস না
বল তো? তোর মামণির চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি জানো মামনি
আমরা কিভাবে বেঁচে থাকি? অক্সিজেন নিয়ে।
বাতাসে অক্সিজেন আছে। তুমি জানো বাতাসে অক্সিজেন কে দেয়? গাছ দেয়। তাই আমাদের উচিত গাছদের যত্ন করা। ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়া।
যাতে গাছ বেশি বেশি করে অক্সিজেন দিতে পারে। নয়তো তো আমরা মারা যাবো। তাই আমি
গাছকে দুধ খেতে দিয়েছি। আমি তখন বললাম, সব ঠিকআছে কিন্তু
দুধ তো গাছের খাবার না সোনা। গাছের খাবার হচ্ছে পানি। তোর মামণি জবাব দিলো, শুধু পানি খেলে তো গাছ বড় হবে না মামনি। ভিটামিনও খেতে হবে তো। বাবা বলেছে
দুধে সব ভিটামিন আছে। বাবা আরো বলেছে কোন কিছু খেতে ইচ্ছে না করলে সেটা কাউকে দিয়ে
দিতে। কক্ষনো ফেলে না দিতে। ফেলে দিলে অপচয় করা হবে। আর যে অপচয় করে সে ইবলিশ
আঙ্কেলের ভাই হয়ে যায়। আমার দুধ খেতে ইচ্ছে করছিলো না তাই আমি গাছকে দিয়ে দিয়েছি।
ইবলিশ আঙ্কেল? প্রশ্ন করে হাসতে
হাসতে গড়িয়ে পড়লো নাবিহা।
মিসেস সুরাইয়াও হাসতে হাসতে বললেন, ইবলিশ আঙ্কেল
শুনে আমি নিজেও ভীষণ অবাক হয়েছিল। তোর মামণিকে যখন জিজ্ঞেস করলাম ইবলিশ আবার তোর
আঙ্কেল হল কবে? জবাব দিলো, তুমিই তো বলেছো বড়দের নাম ধরে না ডাকতে। তুমি জানো ইবলিশ আঙ্কেল আমাদের
চেয়ে কত বড়? সারাক্ষণ এমন
আবোল তাবোল কথাবার্তা আর উদ্ভট কর্মকান্ড করতো। কিছু বলাও যেত না কারণ নিজের সব
কথা ও কাজের পেছনে যুক্তি রেডি থাকতো। মাঝে মাঝে তো আমার মনেহতো নির্ঘাৎ পাগল হয়ে
যাবো ওর এইসব কথাবার্তা শুনতে শুনতে। আবার একদিন দুপুরে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি
হলুদের গুঁড়া একটা বাটিতে নিয়ে তারমধ্যে পানি দিয়ে মনের আনন্দে নাড়ছে তোর মামণি।
আমাকে দেখতে খুশিতে ঝলমল করে উঠে বলল, মামণি আমি ছবি
আঁকতে গিয়ে দেখি আমার হলুদ রং শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই হলুদ দিয়ে রং বানিয়ে নিচ্ছি।
দেখেছো আমার কত বুদ্ধি? আদর দাও আমাকে।
নাবিহা জড়িয়ে ধরে নূহাকে আদর দিয়ে বলল,
তুমি কি তখন আমার
মামণিকে এমনি করে আদর দিয়েছিলে?
বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছলছল করে উঠলো মিসেস সুরাইয়ার। চোখের কোণে
অশ্রুবিন্দু চিকচিক করে উঠলেও মুখে হাসি টেনে বলল,
হুম, এমন করেই আদর করে দিয়েছিলাম তোর মামণিকে। এরপর ওকে গোছল করতে পাঠিয়ে আমি
রান্নাঘর পরিষ্কার করে বাথরুমের গিয়ে দেখি বাথটাবে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে কাপড় ধোঁয়ার সাবান দিয়ে গোছলের সাবানকে ঘষছে।
কি করছে জানতে চাইলে জবাব দিলো, মামণি আমি সাবান
ধুচ্ছি। সাবান দিয়ে গোছল করবো তো তাই আগে পরিষ্কার করে নিচ্ছি। তুমিই না বলেছো
সবসময় সবকিছু পরিষ্কার করে ব্যবহার করতে।
নূহা হাসতে হাসতে বলল, সেদিন তোমার
নানুমণি আমাকে কি বলেছিল শুনবে? বলেছিল, তোকে উচিত সার্কাসে নিয়ে দিয়ে আসা। টিকিট কেটে দেখার মতো একটা প্রাণী তুই।
আমি আল্লাহর কাছে এখন থেকেই দোয়া করা শুরু করবো তোর মতো পিকুলিয়ার একটা মেয়ে যেন
আল্লাহ তোকে দেন। যাতে সে এইসব কর্মকান্ড করে আমার হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে তোর
উপর।
লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস সুরাইয়া বললেন,
কিন্তু আমার
দোয়ার উল্টোটা হয়েছে। তোর মামণিকে আল্লাহ মেয়ে না দিয়ে আরেকটা আম্মাজান দিয়েছেন।
যে জ্বালা-যন্ত্রণা তো দেয়ই না উল্টো আরো মায়ের আদর-যত্ন করে।
আনন্দের অভিব্যক্তি স্বরূপ তিনজনের মুখ দিয়েই আলহামদুলিল্লাহ বেড়িয়ে আসার
সাথে সাথে অধরা এক প্রশান্তিময় প্রাপ্তিতে সিক্ত হয়ে উঠলো তিন জোড়া চোখই। মেয়ে ও
নাতনীকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে মিসেস সুরাইয়া মন উড়াল দিলো অতীতের সেই দিনটিতে। যেদিন
নাবিহা এসেছিল নূহার কোল জুড়ে। হসপিটালের বেডে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকা
নূহার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপন মনেই বলেছিলেন,
মা-মেয়ের মিষ্টি
ভুবনে আপনাদের দুজনকে স্বাগতম। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যেসব মিষ্টি জিনিসে একটু
লবণের ছিটা দিলে স্বাদ আরো বেড়ে যায় মা-মেয়ের সম্পর্ক হচ্ছে তেমন ধরণের মিষ্টি বন্ধন। কখনো মা মেয়েকে বোঝে না তো কখনো মেয়ে মাকে। কখনো দৃষ্টিভঙ্গীর
পার্থক্যর কারণে মতের অমিল, রুচিবোধের
ভিন্নতার কারণে পছন্দের অমিল। আরো কত কি লবণের ছিটা পড়ে মা-মেয়ের এই বন্ধনের উপর।
কিন্তু তাতে কখনোই বন্ধন ছিড়ে যায় না। আর যাবেই না কিভাবে মেয়েরা তো মায়েরই অংশ।
কথায় আছে, সাম রিলেশনশীপ আর
লাইক টম এন্ড জেরী। দে টিচ ইচ আদার, নক ডাউন ইচ আদার, ইরেটেট ইচ আদার, বাট কান্ট লিভ ইচ
আদার। মা-মেয়ের সম্পর্কটাকেও এমনই মনে হয়েছে অভিজ্ঞতা থেকে। মেয়ের সাথে আমার মতের
মিল কখনোই হয়না। সারাক্ষণ দুজন তর্কবিতর্ক করতেই থাকি। কিন্তু না আমার মেয়ে আমাকে
ছাড়া থাকতে পারে, না আমি পারি ওকে
ছাড়া একমুহুর্ত কোথাও থাকার চিন্তা করতে। নিজের সাথে কথোপকথনের এই পর্যায়ে নূহার
দুর্বল কন্ঠে ‘মামণি’ ডাক শুনে বাস্তবে ফিরে এসেছিলেন মিসেস সুরাইয়া। উঠে নূহার পাশে বসে মাথায়
হাত বুলিয়ে আদর মাখা কন্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন, কিছু লাগবে মা? পিপাসা পেয়েছে?
নূহা জবাব দিয়েছিল, না। তুমি অত দূরে
বসেছিলে কেন? এমনি করে আমার
কাছে বসে থাকো।
নূহার আরো কাছে সরে বসে আদুরে গলায় জানতে চেয়েছিলেন, শরীর এখন কেমন লাগছে মা তোর?
আলহামদুলিল্লাহ্! এখন অনেক ভালো ফিল করছি মামণি। কিন্তু খুব টেনশনে আছি।
টেনশন? কিসের টেনশন?কি হয়েছে মা?
বার বার শুধু মনে হচ্ছে, আল্লাহ যদি তোমার
দোয়া কবুল করে ফেলেন আর আমার মেয়েটা যদি সত্যি আমার মতো পিকুলিয়ার হয়। তাহলে কি
হবে ভাবে আমি এখনই শঙ্কিত ফিল করছি।
জাওয়াদের
এক্সিডেন্টের পর ঐ প্রথম নূহার মধ্যে সত্যিকার নূহার এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলেন
সেদিন। যে সারাক্ষণ দুষ্টু কথার ফাঁদ পেতে সবাইকে যন্ত্রণা করতো। খুশি তাই বাঁধ
ভাঙা জোয়ারের মত নেমে এসেছিল মিসেস সুরাইয়ার মনে। নূহার কান টেনে ধরে হাসতে হাসতে
বলেছিলেন, দুষ্টু মেয়ে আমি
তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
নূহা হাত বাড়িয়ে
মায়ের হাত নিজের দুহাতের মাঝে পুরে
বলেছিল, মামণি আমাকে দোয়া করে দাও আমি যেন তোমার মতো মা হতে পারি।
মিসেস সুরাইয়া
দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বলেছিলেন, কেন এই দোয়া করবো
কেন? সারাজীবন আমার
প্রতি তো তোর অভিযোগের শেষ ছিল না। তোর মেয়েও কিন্তু তাহলে তাই করবে।
করুক। তারপরও আমি
তোমার মতো মা হতে চাই। যেসব শিক্ষা তুমি আমাকে দিয়েছো তার সব শেখাতে চাই আমার
মেয়েকে।
যেমন?
যেমন, অন্যের সুখের বদলে নিজের সুখ না কেনা। অর্থাৎ, নিজে সুখী হবার জন্য অন্য কাউকে দুঃখী না করা। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব
না করা, অল্পে সন্তুষ্ট
থাকা, ভালোবাসার অপর
পিঠেই থাকে ঘৃণা! সেই ঘৃণা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। অপরের কাছে নিজেকে
গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে ধৈর্য্য খুব গুরুত্বপুর্ন। তাই সর্বাবস্থায় ধৈর্য্যশীল
থাকার চেষ্টা করা। মানুষকে তার ভালো ও মন্দ দুটি দিক থেকে আলাদা করে দেখতে চেষ্টা
করা। কেউ কষ্ট দিলে সেটা ফিরিয়ে দেবার আশা না রাখা। বরং আশা রাখা যে কষ্টদাতা
একদিন তার ভুল বুঝবে, আর তাতেই সব কষ্ট
দূর হবে। এইসব কিছু তো আমি তোমার কাছ থেকেই শিখেছি মামনি। আরো কি শিখেছি তোমাকে
দেখে জানো মামনি? শিখেছি যে জীবন
প্রতি মুহুর্তে আমাদের পরীক্ষা নেয়! সেই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য যেমন আমরা চেষ্টা
করি, তেমনি সম্পর্কের
মধ্যে সমস্যাগুলোকেও যদি আমরা পরীক্ষা হিসেবে দেখি এবং পাশ করার চেষ্টা করি তাহলে
মনেহয় অকারণ ভাবনা অনেক কমে যায়। কারণ যার যার পরীক্ষা তার তার। অন্য কি করলো
দেখার চেয়ে আমি পাশ করছি কিনা সেটা বেশি গুরুত্বপুর্ন। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বাস্তবতা
হল পৃথিবীর সবাই সম্পর্কের মূল্য বোঝে না। তাই যারা বোঝে তাদের কষ্টও বেশি পেতে
হবে, ছাড়ও বেশি দিতে
হবে। আর তারা এমন করে বলেই তো সম্পর্কগুলো সফল ভাবে টিকে থাকে।
মেয়েকে বুকে
জড়িয়ে ধরে মিসেস সুরাইয়া তখন বলেছিলেন, আমি দোয়া করি তোর
মতো একটা মেয়েই যেন আল্লাহ তোকে
দেন। আর মামণির বুকে মুখ গুঁজে অস্ফুট কন্ঠে নূহা বলেছিল, আর আমি দোয়া করি তোমার মতো একটা করে মা যেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা
দুনিয়ার সব মেয়েকে দেন। ঐ মূহুর্তে মা-মেয়ের সম্মিলিত হাসির মূর্ছনায় ঘুম থেকে উঠে
গিয়েছিল তাদের নতুন প্রজন্ম। গল্প-কথা ছেড়ে মা-মেয়ে তখন তাদের ছোট্ট পরী নাবিহার
সেবাযত্নে মশগুল হয়েছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন